চলো বাংলাদেশ
প্রিয় ক্রিকেট দল,
আমার এই চিঠিটা তোমাদের ১৪ জনের কাছে, যারা বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পেয়েছ। নাহ, আমার জ্ঞান লোপ পায়নি, দলে তোমরা ১৫ জন আছো, আমি জানি। কিন্তু একজনের এই চিঠি না পড়াই ভালো। আমি চাইনা সে এই চিঠি পড়ুক। এবার আসি মূল প্রসঙ্গে।
ক্রিকেট খেলা ভালোভাবে বুঝতে শিখি ২০০০ সাল থেকে। ৯৯ এর বিশ্বকাপে তোমাদের পারফর্মেন্সে বড়দের দেখাদেখি আমি ও লাফিয়েছি। তখন বুঝতাম না, ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনিস, শোয়েব আক্তার, ইঞ্জামাম, সাইদ আনোয়ার সমৃদ্ধ পাকিস্তান দল কে নাস্তানাবুদ করার আনন্দ কত । বুঝলে হয়তো আরও বেশি লাফাতাম।
ভালো সূচনার পর খেই হারিয়ে ফেলার প্রবনতা আমাদের বাঙ্গালী জীবনে সাধারন ঘটনা। নিয়ম মেনেই বোধয় টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর আমাদের দুঃস্বপ্নের প্রহর শুরু হয় ২০০০ সাল থেকে। জয় তো দূরে থাক, মান সম্মান বজায় রেখে হারা টাও অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। চললো দল নির্বাচনে কাটা ছেড়া। পেসারের বড় অভাব। মাছে ভাতে বাঙালীর শক্তি যতই হোক, ১৩৫/১৪০ কিঃমিঃ গতিতে বল করা একজন পেসার পাওয়া যেন অমাবস্যার চাঁদ। বাংলাদেশ “এ” দল, বয়স ভিত্তিক দল...... উপেক্ষা করে চোখ পড়ল সদ্যই ১৭ তে পা রাখা খুলনা ডিভিশনে খেলা “মাশরাফি” নামক এক তরুনের উপর। সোজা অভিষেক জাতীয় দলে। এন্ডি ফ্লাওয়ার, গ্রান্ট ফ্লাওয়ার, কারলিসেল সমৃদ্ধ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। ইনিংসের প্রথম ওভার করতে যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, ধারাভাষ্যে তখন অস্ট্রেলীয়ার একজন সাবেক প্লেয়ার ( ভদ্রলোকের নামটা মনে পড়ছে না, সম্ভবত গ্রেগ চ্যাপেল/ ইয়ান চ্যাপেল)। ক্যামেরা যখন মাশরাফির দিকে, ওই ভদ্রলোক অবাক হয়ে পাশে বসা বাংলাদেশের ধারাভাষ্যকার আতাহার আলী খান কে ইংরেজিতে যা বললেন, তার খাটি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করলে দাড়ায় “এটা তোমরা কী করলে! এ তো বাচ্চা ছেলে! নাক টিপলে দুধ বের হবে। ছেলেটার ক্যারিয়ার তোমরা ঝুঁকির মুখে ফেলে দিলে!”
১৭ তে পা দেয়া এক তরুন ছেলের ১৩৫/ ১৪০ কিঃ মিঃ গতিতে বল করা দেখে ওই ভদ্রলোক তার নাম দিয়েছিলেন “নড়াইল এক্সপ্রেস”। যা এখন ও ধারাভাষ্যকাররা উচ্চারন করেন। আর ফ্লাওয়ার ভাইদ্বয় দেখেছিলেন, ১৭ বছরের তরুনের রকেট গতির বল। প্রথম ইনিংসে ৩৬ ওভার বল করে ১০৬ রান দিয়ে নিয়েছিলেন ৪ উইকেট। একজন পেসার এক ইনিংসে সর্বোচ্চ কত ওভার বল করতে পারেন- সে হিসেব তোমাদের অজানা নয়। তাই নিজ গুনে ১৭ বছরের বালকের পরিশ্রম টা তোমরা মূল্যায়ন করে নিও। আর টেস্ট ম্যাচে অনেক ওভার বল করতে হয় বলে লাসিথ মালিঙ্গার মত বোলার টেস্ট থেকে অবসর নিয়ে নিয়েছেন ২০১০ সালেই।
ওই অস্ট্রেলীয় ভদ্রলোকের ভবিষ্যৎবানী সত্য প্রমানিত হল তার পরের বছরই। ইঞ্জুরির ছোবলে ছুরির নিচে যেতে হল ১৮ বছর বয়সে। সেই থেকে এই অব্দি ৫ বার পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়েছে। আরেকবার ছিঁড়লেই ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন তার বাদ হয়ে যাবে। ডেভিড ইয়ং (অস্ট্রেলীয় শল্য চিকিৎসক) এর ভবিষ্যৎবানী।
এই কাটা ছেঁড়া সমৃদ্ধ ক্যারিয়ারে তার অর্জন নেহায়েত কম নয়। বাংলাদেশের বড় দলের বিপক্ষে জয় গুলোতে তার রয়েছে প্রত্যক্ষ অবদান। ভারত কে দেশের মাটিতে প্রথম বার হারানোর নায়ক এই মাশরাফি। ২০০৫ এ অস্ট্রেলিয়াকে হারানো সেই ঐতিহাসিক জয়ে কোন রান করতে না দিয়েই গিলক্রিসট কে ফেরত পাঠিয়েছিলেন এই মাশরাফি। ২০০৭ এ ভারত কে বিশ্বকাপে হারানো ম্যাচে ৪ উইকেট নিয়ে হয়েছিলেন ম্যাচ সেরা। আর শেবাগ এর মিডল ষ্ট্যাম্প যেভাবে উড়ালেন, শেবাগ তাকে আজীবন মনে রাখবেন। ওই বছরই এক পঞ্জিকা বর্ষে ৪৯ উইকেট নিয়ে আই সি সি রাঙ্কিং এ হয়েছিলেন ২য়। ব্রেট লি ছিলেন ১ এ (৫১ উইকেট)।
তার অবদান আমার চেয়ে তোমরা কম জানো না। তাই আর সে পথে গেলাম না। মাশরাফির বয়স এখন ৩২। হিসেব অনুযায়ী তার ৩ টি বিশ্বকাপ খেলার কথা। ক্রিকেট বোর্ডের অতি পাণ্ডিত্যে হোক, আর পচন ধরা রাজনীতির প্যাচে হোক, ২০১১ সালের ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ টা তার খেলা হয়নি। আজীবন শক্ত মনবলের মূর্ত প্রতীক দল ঘোষণার পর সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে কতটা কষ্টে চোখের পানি ছেড়েছিলেন তা আমি দেখেছি। এবারের বিশ্বকাপে তাই নিন্দুকদের বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে অধিনায়ক হয়ে গেলেন অস্ত্রেলিয়ায়। সম্ভবত এটাই “পাগলা”র (ডেভ হোয়াটমোরের দেয়া উপাধি) শেষ বিশ্বকাপ।
এই পাগলা টা দেশের জন্য যা করেছে, তার প্রতিদান স্বরূপ তোমরা পারবেনা এই বিশ্বকাপটা স্মরণীয় করে রাখতে ? মাঞ্জারুল রানার অকাল মৃত্যুর শোককে শক্তিতে পরিনত করে, শুধু মাত্র মাঞ্জারুল রানাকে জয় উৎসর্গ করতে তোমারা ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতের উপর যেরূপ বাঘের থাবা বসিয়েছ, পারবেনা এবার মাশরাফির জন্য সেরূপ ঝাঁপিয়ে পড়তে ? এই পাগলাটা দেশের জন্য তার পা দুটো উৎসর্গ করেছে, তোমরা তাকে শুধু তোমাদের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ টুকু দাও। আমরা বিশ্বকাপ চাইনা, চাই ক্রিকেটের কুলীন জগত অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের শক্তির, সামর্থ্যর প্রমান রাখতে। এই পাগলাটা যেন অবসরের পরেও এই বিশ্বকাপের প্রাপ্তি নিয়ে নিজেকে সার্থক মনে করতে পারে। প্লিজ...... অনুরোধ করছি... পারবে না? , তার কাছ থেকে নিয়েছি অনেক, বিনিময়ে কিছু দিবেনা?......
তোমরা মাঠে খেলবে ১১ জন, আমরা পাশে থাকবো ১৭ কোটি জনতা। মশাল প্রস্তুত। এবার জ্বলে উঠার সময়।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
জহির রহমান ১০/০২/২০১৫
-
ইঞ্জিনিয়ার সজীব ইমাম ০৩/০২/২০১৫ভাই সেলুট। বাংলার মানুষ ক্রিকেট ভালোবাসে বাট আমার মত ভক্ত আছে বলে আমি সন্দিহান ছিলাম। বাট আপনার লেখা পড়ে সেই সন্দেহ দুর হয়ে গেছে। লেখাটি আমার কত ভালো লেগেছে বলে বোঝাতে পারবো না। শুধু বলি প্রিয়তে রেখে দিলাম।
-
মিজান রহমান ০২/০২/২০১৫সময়োপযোগী চিন্তাধারা ।।ভালো লাগলো প্রবন্ধটি পড়ে ।
বাংলাদেশ ভালো করবে- এটা আমার বিশ্বাস। যে কোন সময় জ্বলে উঠার মত শক্তি বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম রাখে। শুভ কামনা তাদের জন্য।