যে সত্য বিষাদের
১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসের ৭ তারিখ।ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাসার সামনে বিশাল জনস্রোত। উৎসুক মানুষের সবাই বঙ্গবন্ধু কে দেখতে চায়, পা ছুঁয়ে সালাম করতে চায়, কথা বলতে চায়। সদ্য স্বাধীনতা অর্জন করা দেশের মানুষ গুলো তাদের আপনজন হারানোর শোক বঙ্গবন্ধুর সাথে ভাগাভাগি করে নিতে চায়। বঙ্গবন্ধু সবারই আবদার মেটাচ্ছেন। দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ গুলোর ক্লান্তি নেই। বঙ্গবন্ধু তার বসার ঘরে সবার সাথে আন্তরিকতার সাথে কথা বলছেন। দুপুর ২ টা পার হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর ক্ষিধা পেয়েছে। মানুষ গুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারছেন না ক্ষিধের কথা। সবাই না খেয়ে এই কাঠ ফাটা রোদে তাকে এক নজর দেখতে এসেছে, তাদের প্রিয়জন হারানোর দুঃখ ভাগাভাগি করতে এসেছে। এসময় খাওয়ার জন্য সময় চেয়ে তাদের অপেক্ষা করতে বলাটা অমানবিক।
এসময় সাদা দাড়িওয়ালা এক মৌলানা এলেন। উনার নাম মাওলানা সিরাজুল ইসলাম।*১ এসেছেন কুমিল্লার মুরাদনগর থেকে। সাথে তার ছোট মেয়ে ময়না, ছোট ছোট রঙ্গিন ফুল আঁকা ফ্রক পরা। মাওলানার হাতে মস্ত এক রাজ হাঁস, মেয়ের হাতে টিফিন বক্স। একজন মাওলানার সামনে পাইপ টানাটা অভদ্রতা। বঙ্গবন্ধু তার সার্বক্ষণিক পাশে থাকা আব্দুর রহমানের হাতে পাইপ টা রেখে মাওলানা কে বসতে বললেন।*২
মাওলানা বললেন, “শেখ সাবকে সালাম কর মা”
ময়না টিফিন বক্স ফ্লোরে রেখে বঙ্গবন্ধু কে পা ছুঁয়ে সালাম করল। বঙ্গবন্ধু ময়না কে তার কোলে বসালেন।
-“জনাব, আমার পরিবার আপনার জন্য সামান্য আমন চাউলের সিন্নি আর এই রাজ হাঁস পাঠিয়েছেন। আমাকে বলে দিয়েছেন যেন এই সিন্নি আপনি আমার সামনে বসে খান। রাজ হাঁসের গোস্ত খাইতে হয় শীতকালে, ঝাল করে পাক করে আটার রুটি দিয়ে। বড়ই অমৃত। এখন গরম কাল। জানি খেয়ে আরাম পাবেন না। ইচ্ছা ছিল আপনাকে আমার পরিবারের হাতের রান্না খাওয়ানোর। তার এখন ভারি শরীর । রান্না বান্না করতে পারে না। এই ভারি শরীর নিয়াই সিন্নি পাক করেছে। হাঁসের গোস্ত পাক করতে পারে নাই। তাই জেতা হাঁসই আনতে হইল”।--- মাওলানা লজ্জা মাখা গলায় বললেন।
টিফিন বক্স খুলতেই খেজুর গুরের সিন্নির ঘ্রানে ঘর ভরে গেল । বঙ্গবন্ধু হাত ধুয়ে মৌলানার সামনে বসেই সিন্নি খেলেন। তার চোখে মুখে তৃপ্তির আলো।
“ এমন অমৃত আমি জীবনে খাই নাই। আপনার পরিবার কে বলবেন কোন এক শীতে আপনার বাড়ি গিয়ে আমি তার হাতের রাজ হাঁসের গোস্ত খাব। আপনার আর কোন কথা থাকলে বলতে পারেন”।
“ এমন অমৃত আমি জীবনে খাই নাই। আপনার পরিবার কে বলবেন কোন এক শীতে আপনার বাড়ি গিয়ে আমি তার হাতের রাজ হাঁসের গোস্ত খাব। আপনার আর কোন কথা থাকলে বলতে পারেন”।
- “ আপনার সাথে একান্তে কিছু কথা বলতে চাই। যদি ময়নাকে ভেতরের ঘরে পাঠানো যায়......”
আব্দুর রহমান ময়নাকে নিয়ে ভেতরের ঘরে গেল। মাওলানা কিছুক্ষন মেঝেতে ফুল তোলা কার্পেটের দিকে তাকিয়ে রইলেন চুপচাপ। তারপর শুরু করলেন.........
- “ আমি মুরাদনগর জামে মসজিদের ইমাম। মুরাদনগরে পাকিস্তানী মিলিটারি বাহিনী ঢুকে গত বছরের ঠিক এই দিনে। দেশের অবস্থা খারাপ দেখে আমার পরিবারকে গত বছরের ২৯ই মার্চ তার বাপের বাড়ি সুনামগঞ্জে পাঠাই। তারপর আমি মসজিদেই ঘুমাইতাম রাতে। গ্রামের সরফরাজ হাজী সাবের বাড়ি থেকে আমার তিন বেলা খাবার আসতো।*৩ খাবার নিয়া আসতো সরফরাজ সাবের কামলা ইয়াসিন। সেইদিন এশার নামাজ শেষে মসজিদে শুয়ে আছি। এমন সময় কতগুলা মানুষের ঠক ঠক জুতার শব্দ পাই। মসজিদের সামনে দাঁড়াইয়া দেখি পাকিস্তানি মিলিটারি। দেইখা আমার কলিজা শুকাইয়া গেছিলো। মনে মনে দুরুদ শরীফ পাঠ করতেছিলাম। তাদের কমান্ডার আমারে জিজ্ঞাসা করছিল,
- “ তোমহারা নাম কেয়া ? সারফারাজ খান কা ঘার কাহা ?”
আমি তাদের কে সরফরাজ হাজী সাবের বাড়ি নিয়া যাই। হাজী সাব সে রাতে তাদের খানা দানার জন্য খাসি জবাই দেন। আমি নিজ হাতে সেই খাসি জবাই করি। মিলিটারিরা স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে ক্যাম্প করে। তাদের খানা দানা, দেখাশোনার দায়িত্ব নেন হাজী সাব। হাজী সাব আমারে বলেন প্রতি জুম্মায় নামাজ শেষে পাকিস্তান সম্পর্কে বয়ান দিতে। পাকিস্তানের জন্য দোয়া চাইতে। যারা মুক্তি যুদ্ধ করতে চায়, পাকিস্তান কে ভাঙ্গতে চায়, তাদের মালাউন বলে ঘোষণা দিতে। মসজিদের মাসিক সকল খরচ হাজী সাব দেন। আমার সংসার চলে ওনার দেয়া ৭৫ টাকা বেতনে। আমি ওনার কথা অমান্য করতে পারি নাই। পরের শুক্রবার, জুম্মার নামাজ শেষে আমি পাকিস্তান সম্পর্কে বয়ান দেই। গ্রামের কয়েকজন তার প্রতিবাদ করে। হাজী সাবের সঙ্গে তাদের বাক বিতণ্ডা হয়। কয়েকজন ছেলে মসজিদ থেকে বেরিয়ে যায়। হাজী সাব ঘোষণা দেন, যারা পাকিস্তানের বিরোধিতা করবে তারা যেন এই মসজিদে আর না আসে। যারা যারা প্রতিবাদ করেছিল, হাজী সাব পাকিস্তানী মিলিটারি নিয়া তাদের বাড়ি ঘর পুড়াই দেয়। গ্রামের মেয়েছেলেদের ধরে এনে হাজী সাব মিলিটারিদের আমোদের ব্যাবস্থা করে দিতেন। গ্রামের লোকজন কমতে থাকে। মসজিদে আমি আর হাজী সাব নামাজ পড়তাম। এর মাস দুই পরে গ্রামে মুক্তি বাহিনী ঢুকে। মুরাদনগর স্বাধীন হয় নভেম্বর মাসের ১৮ তারিখ।
গ্রামে এখন মানুষজন ফিরা আসছে। রাজাকারদের লিস্টি তৈরি করতেছে। যারা যারা লিস্টি তৈরির কাজ করতেছে, তারা সবাই হাজী সাবের আপনা লোক। হাজী সাবের কথায় উঠা বসা করে। লিস্টিতে তারা আমার নাম দিছে। লিস্টিতে হাজী সাবের নাম নাই। এইটা নিয়া গ্রামের কেউ মুখ খুলার সাহস ও পায়না। আমি আপনার কাছে রাজাকারের লিস্টি থেকে আমার নাম কাটাইতে আসি নাই। আল্লাহ মাবুদ আমার মরন যেখানে লেখছে সেখানেই আমার মরন হবে। আটকানোর শক্তি কারো নাই। আমি আসছি আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে। নিজের রুজির কথা চিন্তা কইরা মসজিদে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বইলা বয়ান দিছি। দেশের সাথে বেইমানী করছি। আপনে এই দেশের নেতা। আপনি আমারে ক্ষমা করে দেন। আমার পরিবার খালি কান্দে। আমার সন্তানরা রাজাকারের সন্তান বলে পরিচিত হবে, এইটা সে মানতে পারতেছে না। আল্লাহ যেন আমারে তার আগেই নিয়া নেয়।
বঙ্গবন্ধু মাওলানা কে জড়িয়ে ধরে বললেন, “ আপনি আপনার মেয়েকে নিয়ে খানা খেয়ে যাবেন। ভেতরের ঘরে রান্না হচ্ছে। আর আমি খুব শীঘ্রই সরফরাজ সাহেবের সাথে দেখা করব”।
____________________________________________
*১--- মাওলানা সিরাজুল ইসলামের নাম রাজাকারের লিস্ট থেকে বাদ পরেনি। ঐ বছরই মাওলানা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। (এলাকার প্রবীণদের মত)
*২---- এই আব্দুর রহমান বঙ্গবন্ধুর বাসায় কাজ করতেন। ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সকল সদস্য হত্যার একমাত্র চাক্ষুস সাক্ষী তিনি। ( সুত্রঃ দেয়াল, হুমায়ুন আহমেদ)
*৩---- হাজী সরফরাজ খান পরবর্তীতে এলাকার চেয়ারম্যান নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হন। (এলাকার প্রবীণদের মত)
*২---- এই আব্দুর রহমান বঙ্গবন্ধুর বাসায় কাজ করতেন। ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সকল সদস্য হত্যার একমাত্র চাক্ষুস সাক্ষী তিনি। ( সুত্রঃ দেয়াল, হুমায়ুন আহমেদ)
*৩---- হাজী সরফরাজ খান পরবর্তীতে এলাকার চেয়ারম্যান নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হন। (এলাকার প্রবীণদের মত)
___________________________________________
দৃশ্য-২
কিছুক্ষন পর ঘরে বোরখা পরা ২ জন নারী ঢুকলেন। একজন বয়স্ক মহিলা, আরেকজন তরুনী। দুজনের মুখই নেকাব দিয়ে ঢাকা। শুধু চোখ দেখা যাচ্ছে। যুবতীর সৌন্দর্য তার চোখ দেখেই অনুমান করা যাচ্ছে। শেষ বিকেলের সূর্যের আলোর রং পেয়েছে মেয়েটা। চোখ দুটো সেই গায়ের রঙে বেশ ভালোই মিশে গেছে। ঘরে বিদ্যুৎ নেই। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে বিদ্যুৎ তো বিলাসীতা, অনেকের ঘরে খাবারই জুটছে না। আব্দুর রহমান হাত পাখা এনে দিল। মহিলা মুখের নেকাব খুলে সোফায় বসলেন। মহিলার ঘর্মাক্ত মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক দূর থেকে এসেছেন। আব্দুর রহমান ওনাদের বাতাস করতে লাগলো। মেয়েটা পানি চাইল। আব্দুর রহমান লেবুর সরবত আনলেন জগ ভর্তি করে। বঙ্গবন্ধু আব্দুর রহমানের বিচক্ষণতা দেখে বেশ খুশি হলেন। মেয়েটা নেকাব খুলে ডক ডক করে ২ গ্লাস সরবত খেলো। বঙ্গবন্ধু মেয়েটার মুখ দেখে আশ্চর্য হলেন। এত মায়াবী মুখ খুব কমই দেখেছেন তিনি। সরবত খাওয়া শেষে আবার নেকাব দিয়ে মুখ ঢেকে দিল। বৃদ্ধ মহিলার চেহারার সাথে এই রমনীর চেহারার মিল নেই।
বৃদ্ধ মহিলা বললেন, “ আমার বাড়ি ফরিদপুর। ও আমার ছেলের বউ রেহেনুমা। আমার ছেলের নাম আমানউল্লাহ।*১ আমার ছেলে করাচী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাস করেছে। সেখানে রেহেনুমার সাথে পরিচয়। পড়াশোনা শেষ করে সেখানেরই এক পত্রিকা অফিসে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করত। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে রেহেনুমা কে নিয়ে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসে। আমাদের কে তাদের সম্পর্কের কথা জানায়। গ্রামের ইমাম সাহেব ডেকে তাদের বিয়ে পড়ানো হয়। গত বছর ২৩ই মার্চ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একটি টেলিগ্রাম আসে। তার পাওনা বেতন আর জিনিস পত্র আনার কথা বলে সে আবার পাকিস্তান যায়। আমাদের বারন সত্ত্বেও কোন কথা শোনেনি। সেই যাওয়াই তার শেষ যাওয়া। খবর পেয়েছি পশ্চিম পাকিস্তানের খবর পূর্ব পাকিস্তানে গোপনে ফাঁস করার দায়ে আমার ছেলেকে করাচীর আদালতে ফাসির রায় দেয়া হয় .........
আমার ছেলেরে তারা কবর দিছে নাকি পানিতে ভাসাই দিছে জানিনা। আমি আমার ছেলের লাশ ফেরত চাই। বাবা, তুমি আমার ছেলের লাশ ফেরত আনতে পারবা না ? আমার ছেলেরে আমার কাছে আইনা দিতে পারবা না ? একটা দেশকে স্বাধীন করতে যে নেতৃত্ব দিতে পারে, তার কাছে এক মায়ের সন্তানের লাশ ফেরত এনে দেওয়াটা কি কঠিন কিছু.........
এই বউকে নিয়ে বড় বিপদে আছি। গ্রামের লোকজন নানান কথা বলে। মেয়ে পাকিস্তানী তাই। এই দেশে নাকি পাকিস্তানী কারো ঠাই নাই। অনেক বুঝাইলাম পাকিস্তানে ফিরে যাইতে। মেয়ের এক কথা- যাবেনা। ফিরে গেলেও নাকি বাবা মা মেরে ফেলবে। সে এখানেই মরতে চায়, স্বামীর ভিটায়।
বঙ্গবন্ধু কিছু বলার শক্তি খুঁজে পেলেন না। দেশ স্বাধীন হয়েছে সত্যি, কিন্তু মেরুদণ্ডটা ভাঙ্গা। এই জাতিটার ভাঙ্গা মেরুদণ্ড কীভাবে সোজা করা যায়, সে উত্তর খুঁজে বের করা, দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের চেয়েও কঠিন বলে মনে হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু সেদিন নিশ্চুপ ছিলেন। এখন আমরাও নিশ্চুপ আছি। মুখ বুঝে শত অন্যায়-অবিচার, নর পশুদের ধ্বংসলীলা, প্রকাশ্য খুন সবই মুখ বুঝে সহ্য করি। “স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন”- মহান সেই উক্তি বাঙ্গালী জাতীর দিকে তাকিয়ে আজ বিদ্রুপের হাসি হাসে।
____________________________________________
*১--- এই আমানউল্লাহ করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় আওয়ামী মুসলিম লীগের কর্মী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু কে বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করেছেন। ( অসমাপ্ত আত্মজীবনীঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান )
____________________________________________
"হৃদয়ে একাত্তর"
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
ইসমাত ইয়াসমিন ১২/১২/২০১৩লেখা সুন্দর হয়েছে, অনেক কিছু জানলাম।