শেষ বলে ছয়
(১)
বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে পা টিপে টিপে বের হয় মিঠু। মা রান্নাঘরে আছে। কোনভাবে তার চোখ এড়িয়ে বাইরে বেরিয়েই ভোঁ দৌড়। বাইরের ঘরে বাবা বসে আছেন। ভাবছেন, মিঠু তার রুমে বসে অংক কষছে। সে যে বেড়িয়েছে, বুঝতে বাবার বেশ কিছুটা সময় লাগবে। তারপর তার মুখের কি অবস্থা হবে ভেবেই মিঠু হেসে দেয়। আজ রাতে তার ধোলাই হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কাল রাতে বাবা অবশ্য মুখে একচোট ঝেড়ে দিয়েছেন।
তা মিঠু ধোলাই খাওয়ার উপযুক্তই বটে! মাত্র দেড়মাস পরে তার এসএসসি পরীক্ষা। আর সে কিনা এ সময়ে মেতে আছে ক্রিকেট নিয়ে! না মেতেই বা তার উপায় কি? বছরে একটা মাত্র টুর্নামেন্ট। আর এবার তাদের ‘দুরন্ত দুর্বার সংঘ’ ফাইনালে! ভাবা যায়! যেখানে বেশিরভাগ দলেরই দু-চারটে হায়ার করা খেলোয়ার আছে, সেখানে তারা একেবারেই স্থানীয় এবং বয়সের হিসেবে সবচেয়ে নবীন। তারা প্রায় সবাই স্কুলের নাইন-টেনের ছাত্র। তাদের কোন স্পনসর কিংবা অর্থনৈতিক সাহায্য ছিলনা। স্রেফ নিজেরা চাঁদা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করিয়েছিল। মিঠু এবং তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা আগেকার বছরের টুর্নামেন্টে বিভিন্ন দলে খেললেও এবারে নিজেরাই ‘দুরন্ত দুর্বার সংঘ’ নামে ক্লাব খুলে অংশ নিয়েছে।
বাড়ি থেকে অনেকটা এসে দৌড় থামিয়ে হাটা ধরে মিঠু। বাবা-মা শুধু শুধু চিন্তা করেন! সে কি আর পড়া বাদ দিয়ে খেলে! যতই খেলুক, সে ঠিকই ভালো রেজাল্ট আদায় করে নেবে। সে খুবই নিয়মিত ছেলে। ভাবতে ভাবতে বাজারের মধ্যে ঢুকে মিঠু। মজিদদের দোকানের পেছনে যে খালি রুমটা আছে, সেটাই তাদের আপাতত ক্লাব। অনেকেই এসে গেছে এরি মধ্যে। মেঝেতে ব্যাট দিয়ে খুটাতে খুটাতে রাশেদ ইঙ্গিতে বলে, “আজকে টসে জিতলে যাতে বোলিং করা হয় আগে”। মিঠুর ভালো লাগে। রাশেদের সাথে তার কথা বন্ধ। মাঝেমাঝেই এটা তাদের মধ্যে হয়। ছোটখাটো কোন বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি, দুদিনের জন্য কথা বন্ধ। তারপর আবার আগের মতই। সে ক্যাপ্টেন। টসে জিতলে কি নেয়া হবে, তা সে এখনই আলোচনা করতে চেয়েছিল। রাতে কুয়াশা ভালো পড়েছে। এখন রোদ উঠলেও পীচ একটু ভেজা থাকবে। পেসবোলিংএ তারা খুবই ভালো। সুবিধাটা নেয়া যাবে। তাছাড়া পরে রোদ উঠলে ব্যাটিংটাও ভালো হবে। নয়টার মধ্যেই ওরা বেড়িয়ে পড়ে হই হই করে।
(২)
মাঠে ঢুকতেই মিঠুর কেমন যেন নার্ভাস লাগে। ফাইনাল উপলক্ষে বিশাল প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে। আজকে নাকি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আসবেন ফাইনাল দেখতে আর পুরষ্কার দিতে। দর্শক উপচে পড়ছে। ফাইনাল বলতে কথা! মিঠু অবাক হয়ে দেখল, দর্শকরা তাদের টিমের নাম ধরেই বেশি চেচাচ্ছে। সে তার পাশের মিনহাজকে জিজ্ঞাসা করল, “কিরে ব্যাপার কি? আজ হঠাত এত বেশি দর্শক আমাদের হয়ে গেল যে!” মিনহাজ কিছু বলার আগেই যুবসংঘের মুহিত ভাই এসে বললেন “কাপ কিন্তু তোদের জিততেই হবে মিঠু। চালিয়ে যা। আমরা আছি তোদের সাথে”। আসলে তারা ছিল আন্ডারডগ। কেউ তেমন পাত্তা দেয়নি। কেউ ভাবতেই পারেনি, হাইস্কুল পড়ুয়া এই টিম ফাইনাল খেলবে! তাদের প্রতিপক্ষ ‘রেইনবো স্পোর্টিং ক্লাব’ খুবই শক্তিশালী। যা হয় আর কি! টুর্নামেন্টের অন্যতম শক্তিশালী দলের সাথে যদি কোন আন্ডারডগের খেলা পরে, তাও যদি হয় আবার ফাইনাল, তাহলে বাকি সবাই আন্ডারডগের সাপোর্টে চলে আসে। ঐ যে ছিলনা, অস্ট্রেলিয়া যখন টানা ক’বছর এক নম্বর, তখন কারো সাথে অস্ট্রেলিয়ার খেলা হলে অস্ট্রেলিয়ানরা ছাড়া সবাই বিপক্ষ দলের সাপোর্ট! এমন কি বিভেদ ভুলে ভারত পাকিস্থানের মানুষজনও একে অন্যের সাপোর্ট করা শুরু করত। কিন্তু মিঠু একটু চিন্তায় পড়ে। এর আগে তারা খেলে এসেছে আনন্দ নিয়ে। জিতলে খুব ভালো, না জিতলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু তারা কি পারবে এই বিশাল দর্শক আর এলাকাবাসীর আশার চাপ সামলাতে?
দেখা যাক, কি হয়! মাইকে তার নাম ডাকছে। ভাবনায় ছেদ পড়ল। টস করতে হবে। বন্ধুরা পিঠ চাপড়ে দেয়। “অল দ্যা বেস্ট”। কিন্তু টসে হারে সে। তার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে রেইনবোর অধিনায়ক মোস্তাক ভাই আম্পায়ারকে জানান ‘ব্যাটিং’, আর ফিরতে ফিরতে মিঠুকে বলেন, “তোরা ফার্স্ট ডিফিট খেলি, টস হারলি, দেখিস আজকে তোদের কমসে কম একশ রানে হারাবো”। মিঠুও এক চিলতে হেসে বলে “মাঠেই দেখা হবে বড়ভাই। টসে হেরেও হারিনি। ফিল্ডিং নেয়াই ছিল উদ্দেশ্য।“
(৩)
মাঠে নেমে আর চাপটাপ অনুভব করেনা মিঠু। বন্ধুদের বলে "কিচ্ছু চিন্তা করিসনা। আগের ম্যাচগুলো যেভাবে গেছে সেভাবেই নে সবাই। ওদের শক্তির দিকেও তাকাস না। ওরা ফাইনালিস্ট, আমরাও ফাইনালিস্ট। সমান সমান। আল্লাহ ভরসা।" সবাই একবার হাতে হাত দিয়ে গোল হয়ে দাঁড়ায়। রুমেল পরহেযগার মানুষ। সে আয়াতুল কুরসী পড়ে ফু দেয়।
ফিল্ডার সাজিয়ে বল হাতে নেয় মিঠু। সে’ই ওপেন করে। কিন্তু এ’কি! ব্যাটসম্যান কে? তার জন্য বিশাল বিস্ময়! সে জানত রেইনবো ঢাকা থেকে দু’জন খেলোয়ার এনেছে। কিন্তু এর মধ্যে একজন অর্ক! সে প্রিমিয়ার ডিভিশন খেলে। পিঞ্চ হিটার। সে যদি ওভার দশেক টিকে যায়, খবর আছে। এরা পচিশ ওভারে তিনশ বানিয়ে ফেলবে। আর তাদের মত গ্রামের আনকোরা ছেলেদের বল পিটিয়ে ছাতু করে দেয়ার ক্ষমতা অর্কের আছে।
বোলিং এর জন্য দৌড় শুরু করার আগে মিঠু ঘাবড়িয়ে যায়, অর্কের স্ট্যান্স দেখে। বামহাতি। কালো চেহারা। মনে হয় জয়সুরিয়া দাঁড়িয়ে আছে। মিঠু মনে মনে উচ্চারন করে “ফাবি আইয়ে আ’লা ই’রব্বিকুমা তুকাজ্জিবান”। ‘অতএব তোমরা স্বীয় প্রভুর কোন কোন নেয়ামতকে অস্বীকার করবে!’ “আল্লাহ, আপাতত অর্কের উইকেটটাই নেয়ামত হিসেবে দাও!”
বল ছাড়ার ঠিক আগমুহুর্তে মিঠু দেখে অর্ক অফস্ট্যাম্পের দিকে একপা সরে এসেছে। প্রথম বলেই অ্যাটাকে যাওয়ার ইচ্ছে। সর্বশক্তি দিয়ে অর্কের পায়ের গোড়ালি বরাবর বল ছোড়ে মিঠু। পারফেক্ট ইয়র্কার! ঠিক প্রথম বলেই এমন একটা বল এক গ্রাম্য কিশোরের কাছ থেকে অর্ক আশা করেনি। ব্যাট আর পায়ের ব্যালেন্স হারিয়ে সে পিচের উপর পরে গেল। উল্লাসিত জনতার চিৎকার আর সেই সাথে উইকেট কিপার আলফাজের উল্লাসের মাঝে সে দেখতে পেল লেগস্ট্যাম্প বাকা হয়ে আছে। প্রথম বলেই ঢাকার প্রিমিয়ার ডিভিশনে খেলা অর্ককে বোল্ড করে দিয়েছে মিঠু! নাহ! তারা এই ম্যাচ এমনি এমনি ছেড়ে দেবেনা!
ওয়ান ডাউনে মাসুদ ভাই। সে তাদের এই এলাকার অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। দ্বিতীয় বল। আবার ইয়র্কার। আবার বোল্ড! মিঠুর বিশ্বাসই হচ্ছেনা, কি হয়ে গেল আর কি হতে যাচ্ছে! হ্যাট্রিক চান্স। কিন্তু হলনা। জাকির ভাই ঠেকিয়ে দিলেন। সে ‘কুল প্লেয়ার’। ধীরেধীরে রেইনবো গুছিয়ে নিয়েছে। কিন্তু প্রথম দুই বলের ধাক্কা তারা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। টুর্নামেন্টের কোন খেলায় রেইনবো প্রথমে ব্যাট করে পচিশ ওভারে একশ আশির নিচে করেনি। আর আজ তারা শেষ ওভারে অলআউট হওয়ার আগে করেছে একশ চুয়াল্লিশ। মিঠু তিনটি উইকেট নিয়েছে। বাকি সবাই কমবেশি ভালো বল করেছে। রান আটকে রেখেছে, একটা দুটো উইকেটও নিয়েছে।
(৪)
অন্য খেলায়, বিরতিতে তাদের খাওয়া চুইংগাম আর পানি। আজকে তাদের জন্য বিরিয়ানি এসেছে চেয়ারম্যান সাহেবের পক্ষ থেকে। এই কিশোরদের খেলা তাকে মুগ্ধ করেছে। তবে খেলার মাঝখানে এত ভারি খাবার খাওয়া ঠিকনা। তারা প্যাকেটের অর্ধেক করে খেয়ে বাকিটুকু এলাকার ছোটছোট ছেলে, যারা খেলা দেখতে এসেছে, তাদের ভাগ করে দিয়েছে। হারকিপটা বলে পরিচিত আজগর মেম্বার ঘোষনা দিয়ে দিলেন, জিততে পারলে রাতে তার বাড়িতে বিরাট খাওয়াদাওয়া হবে। এলাকার ধনাঢ্য ক্রীড়ানুরাগী সালাম সাহেব ঘোষনা দিলেন, আজকের ফাইনাল জিততে পারলে তিনি দুরন্ত দুর্বার সংঘের জন্য ক্লাবঘর আর ক্রিকেটের সরঞ্জাম কিনে দেবেন। মিঠু দেখে বাবাও চলে এসেছেন খেলা দেখতে। মুখে হাসি তার। বাহ! মারের থেকে বোধহয় বাচা গেল। মিঠুর খুব ভালো লাগে।
ওপেনিং জুটিতে ভালো শুরু এনে দিয়েছে শাহেদ আর রাশেদ। ওয়ান ডাউনে আলফাজও বেশ কিছু রান করেছে। কিন্তু ভরসার মিডলঅর্ডার হঠাত করেই ভেঙ্গে গেছে। পনেরো ওভারে একানব্বই। কিন্তু উইকেট চলে গেছে ছয়টা। রুমেল তেমন নির্ভর করার মত ব্যাটসম্যান না। কিন্তু পেশিতে জোর আছে। কোত্থেকে পরপর দুইটা ছক্কা মেরে দিল সে। তাও রেইনবোর মোস্তাক ভাইয়ের বলে! কিন্তু শেষরক্ষা বুঝি হয়না! মিঠু যখন ক্রিজে নামে। তখন তিন ওভারে রান লাগে সতেরো। হাতে মাত্র দুই উইকেট। সে তেমন ভালো ব্যাটসম্যান না, তবে প্রয়োজনে রান আনতে পারে। টুকটুক করে এগিয়ে পরিসংখ্যান দাঁড়ায় বারো বলে এগারো। হাতে দুই উইকেট। আরেক ওভার যায়। ছয় রান আসে। কিন্তু উইকেটও যায় নয় নম্বরেরটা। এক ওভারে পাচ দরকার। মিঠু ব্যাটিংএ। বুক তার দুরু দুরু করে। বোলিংএ আসে ইমরুল। সে ঢাকার খেলোয়ার। ভালো পেস আছে বলে। মিডল অর্ডারে দুই উইকেট নিয়ে সে’ই মিঠুদের কোমর ভেঙ্গেছে।
প্রথম বল গুড লেংথে পড়ে অফস্ট্যাম্পের বাইরে দিয়ে কোমর সমান উচ্চতায় চলে যায়। মিঠু লাগাতে পারেনি। পাঁচ বলে পাঁচ। পরের বল একই লাইনে। আবারো মিস। উফ, কি বল করছে রে! মনে হচ্ছে ম্যাকগ্রা। তৃতীয় বল ছাড়ার সময় মিঠু একটু অফের দিকে সরে আসে। সে জানে বোলার একই রকম বল দিতে পারে। হুক করার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু ইমরুল অভিজ্ঞ পাকা খেলোয়ার। দুর্দান্ত একটা ইয়র্কার দিয়ে বসে। মিঠু বুঝতে পারে সে শেষ! কিন্তু আল্লাহ বাচিয়ে দিয়েছেন। শেষ মুহুর্তে ব্যাট নামিয়ে কোনরকমে সে তার উইকেট বাঁচায়! তিন বলে পাঁচ। চতুর্থ বল সে ব্যাটে লাগায় কিন্তু রান নেয়ার সুযোগ পায়না। পঞ্চম বল বাউন্সার। কানের পাশ দিয়ে ‘সুইইইইইইই’ শব্দ তুলে বল তীব্র বেগে বেরিয়ে যায়। পুরো মাঠ স্তব্ধ। নন-স্ট্রাইকিংএ দাঁড়িয়ে থাকা রনির চোখে সে হতাশা আর ক্ষোভের সংমিশ্রণ দেখে। বোলার তার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। মিঠুর কান্না পায়। এক বলে এখন পাঁচ দরকার। শেষ ওভারে সে একটা রানও করতে পারলনা! আল্লাহ, আরেকটা ‘নেয়ামত’ দরকার। একটা ছক্কা মাত্র।
(৫)
বোলার তার জায়গায় তৈরি দৌড়ানোর জন্য। মিঠু সামনে তাকায়। লং অনের দিকে হঠাত কি যেন নড়ে ওঠে লাল রঙের। মাঠের পরে যে দোতলা বাড়ি আছে, সেখানে বারান্দায় লালরঙের কাপড় পড়া একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। আরে ওটা তো উর্মিদের বাড়ি! ভালো করে তাকিয়ে বুঝতে পারে ওটা উর্মিই।
উর্মির প্রতি তার একটুখানি দুর্বলতা আছে। কিন্তু ওটুকুই। সে কখনো সাহস করে সামনে দাড়াতেও পারেনি। মিঠুর মনে পড়ে, ক’দিন আগে ইন্টার-ক্লাস খেলা হচ্ছিল তাদের স্কুলের সামনের ছোট মাঠে। সে ব্যাটিংএ। পাশের ক্লাসবিল্ডিংএর বারান্দা দিয়ে উর্মি হেটে যাচ্ছিল। সে বোধহয় তার দিকে তাকিয়ে একটু আনমনা হয়ে গিয়েছিল। ফল কি হল? সে বোল্ড আউট! ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সে উর্মির দিকে তাকাতেই দেখে মেয়েটা হাসছে। তাচ্ছিল্যের হাসি। মিঠুর খুব মন খারাপ হয়েছিল সেদিন।
বোলার দৌড়াতে শুরু করেছে। মিঠুর চোখ তড়িত গতিতে বোলারকে মাপছে আর উর্মিদের বাড়ির দিক থেকে ঘুরে আসছে। বল ছাড়ার ঠিক আগমুহুর্তে মিঠু জানে, এই বলটা বোলার ইয়র্কার দেবে। নিমিষেই দুপা সামনে এগিয়ে আসে সে। ইয়র্কার হয়ে যায় লো-ফুলটস। থার্ডম্যানের দিক থেকে আড়াআড়ি টেনে আনা ব্যাট ধেয়ে আসা বলকে সোজা লংঅনের ওপর দিয়ে উড়িয়ে দেয়। ‘টার্গেট ফিক্সড অ্যান্ড অ্যাচিভড’। ঝনঝন করে ভেঙ্গে পড়ে উর্মির পেছনের জানালার কাচ। ছক্কা! কানে তালা লাগানোর মত শব্দে যেগে ওঠে চারদিক। মিঠুরা জিতে গেছে। তারা, কয়েকটি কিশোরের দল এখন উপজেলার চ্যাম্প্যিয়ন! কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখে কারা কারা যেন তাকে কোলে আর কাধে উঠিয়ে নিয়েছে। একই অবস্থা তার সহখেলোয়ার বন্ধুদেরও। এ যে অভাবনীয় বিজয়!
(৬)
তারপর, মিঠুদের ক্লাব দাঁড়িয়ে গেছে। এসএসসি’র পরে মাস দুই তারা চুটিয়ে খেলা উপভোগ করেছে। কলেজে পড়ার জন্য তারা বন্ধুরা একেক এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। ছুটিছাটায় বাড়িতে এলে আবার খেলাধুলা করেছে।
কিন্তু হয়েছে কি, সেই জানালা ভাঙ্গার কারনেই কিনা, এরপরে যতবার উর্মির সাথে মিঠুর দেখা হয়েছে, কথাতো দূরে থাক, মিঠুকে দেখলেই সে মুখচোখ কুচকে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেছে।
বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে পা টিপে টিপে বের হয় মিঠু। মা রান্নাঘরে আছে। কোনভাবে তার চোখ এড়িয়ে বাইরে বেরিয়েই ভোঁ দৌড়। বাইরের ঘরে বাবা বসে আছেন। ভাবছেন, মিঠু তার রুমে বসে অংক কষছে। সে যে বেড়িয়েছে, বুঝতে বাবার বেশ কিছুটা সময় লাগবে। তারপর তার মুখের কি অবস্থা হবে ভেবেই মিঠু হেসে দেয়। আজ রাতে তার ধোলাই হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কাল রাতে বাবা অবশ্য মুখে একচোট ঝেড়ে দিয়েছেন।
তা মিঠু ধোলাই খাওয়ার উপযুক্তই বটে! মাত্র দেড়মাস পরে তার এসএসসি পরীক্ষা। আর সে কিনা এ সময়ে মেতে আছে ক্রিকেট নিয়ে! না মেতেই বা তার উপায় কি? বছরে একটা মাত্র টুর্নামেন্ট। আর এবার তাদের ‘দুরন্ত দুর্বার সংঘ’ ফাইনালে! ভাবা যায়! যেখানে বেশিরভাগ দলেরই দু-চারটে হায়ার করা খেলোয়ার আছে, সেখানে তারা একেবারেই স্থানীয় এবং বয়সের হিসেবে সবচেয়ে নবীন। তারা প্রায় সবাই স্কুলের নাইন-টেনের ছাত্র। তাদের কোন স্পনসর কিংবা অর্থনৈতিক সাহায্য ছিলনা। স্রেফ নিজেরা চাঁদা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করিয়েছিল। মিঠু এবং তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা আগেকার বছরের টুর্নামেন্টে বিভিন্ন দলে খেললেও এবারে নিজেরাই ‘দুরন্ত দুর্বার সংঘ’ নামে ক্লাব খুলে অংশ নিয়েছে।
বাড়ি থেকে অনেকটা এসে দৌড় থামিয়ে হাটা ধরে মিঠু। বাবা-মা শুধু শুধু চিন্তা করেন! সে কি আর পড়া বাদ দিয়ে খেলে! যতই খেলুক, সে ঠিকই ভালো রেজাল্ট আদায় করে নেবে। সে খুবই নিয়মিত ছেলে। ভাবতে ভাবতে বাজারের মধ্যে ঢুকে মিঠু। মজিদদের দোকানের পেছনে যে খালি রুমটা আছে, সেটাই তাদের আপাতত ক্লাব। অনেকেই এসে গেছে এরি মধ্যে। মেঝেতে ব্যাট দিয়ে খুটাতে খুটাতে রাশেদ ইঙ্গিতে বলে, “আজকে টসে জিতলে যাতে বোলিং করা হয় আগে”। মিঠুর ভালো লাগে। রাশেদের সাথে তার কথা বন্ধ। মাঝেমাঝেই এটা তাদের মধ্যে হয়। ছোটখাটো কোন বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি, দুদিনের জন্য কথা বন্ধ। তারপর আবার আগের মতই। সে ক্যাপ্টেন। টসে জিতলে কি নেয়া হবে, তা সে এখনই আলোচনা করতে চেয়েছিল। রাতে কুয়াশা ভালো পড়েছে। এখন রোদ উঠলেও পীচ একটু ভেজা থাকবে। পেসবোলিংএ তারা খুবই ভালো। সুবিধাটা নেয়া যাবে। তাছাড়া পরে রোদ উঠলে ব্যাটিংটাও ভালো হবে। নয়টার মধ্যেই ওরা বেড়িয়ে পড়ে হই হই করে।
(২)
মাঠে ঢুকতেই মিঠুর কেমন যেন নার্ভাস লাগে। ফাইনাল উপলক্ষে বিশাল প্যান্ডেল সাজানো হয়েছে। আজকে নাকি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আসবেন ফাইনাল দেখতে আর পুরষ্কার দিতে। দর্শক উপচে পড়ছে। ফাইনাল বলতে কথা! মিঠু অবাক হয়ে দেখল, দর্শকরা তাদের টিমের নাম ধরেই বেশি চেচাচ্ছে। সে তার পাশের মিনহাজকে জিজ্ঞাসা করল, “কিরে ব্যাপার কি? আজ হঠাত এত বেশি দর্শক আমাদের হয়ে গেল যে!” মিনহাজ কিছু বলার আগেই যুবসংঘের মুহিত ভাই এসে বললেন “কাপ কিন্তু তোদের জিততেই হবে মিঠু। চালিয়ে যা। আমরা আছি তোদের সাথে”। আসলে তারা ছিল আন্ডারডগ। কেউ তেমন পাত্তা দেয়নি। কেউ ভাবতেই পারেনি, হাইস্কুল পড়ুয়া এই টিম ফাইনাল খেলবে! তাদের প্রতিপক্ষ ‘রেইনবো স্পোর্টিং ক্লাব’ খুবই শক্তিশালী। যা হয় আর কি! টুর্নামেন্টের অন্যতম শক্তিশালী দলের সাথে যদি কোন আন্ডারডগের খেলা পরে, তাও যদি হয় আবার ফাইনাল, তাহলে বাকি সবাই আন্ডারডগের সাপোর্টে চলে আসে। ঐ যে ছিলনা, অস্ট্রেলিয়া যখন টানা ক’বছর এক নম্বর, তখন কারো সাথে অস্ট্রেলিয়ার খেলা হলে অস্ট্রেলিয়ানরা ছাড়া সবাই বিপক্ষ দলের সাপোর্ট! এমন কি বিভেদ ভুলে ভারত পাকিস্থানের মানুষজনও একে অন্যের সাপোর্ট করা শুরু করত। কিন্তু মিঠু একটু চিন্তায় পড়ে। এর আগে তারা খেলে এসেছে আনন্দ নিয়ে। জিতলে খুব ভালো, না জিতলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু তারা কি পারবে এই বিশাল দর্শক আর এলাকাবাসীর আশার চাপ সামলাতে?
দেখা যাক, কি হয়! মাইকে তার নাম ডাকছে। ভাবনায় ছেদ পড়ল। টস করতে হবে। বন্ধুরা পিঠ চাপড়ে দেয়। “অল দ্যা বেস্ট”। কিন্তু টসে হারে সে। তার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে রেইনবোর অধিনায়ক মোস্তাক ভাই আম্পায়ারকে জানান ‘ব্যাটিং’, আর ফিরতে ফিরতে মিঠুকে বলেন, “তোরা ফার্স্ট ডিফিট খেলি, টস হারলি, দেখিস আজকে তোদের কমসে কম একশ রানে হারাবো”। মিঠুও এক চিলতে হেসে বলে “মাঠেই দেখা হবে বড়ভাই। টসে হেরেও হারিনি। ফিল্ডিং নেয়াই ছিল উদ্দেশ্য।“
(৩)
মাঠে নেমে আর চাপটাপ অনুভব করেনা মিঠু। বন্ধুদের বলে "কিচ্ছু চিন্তা করিসনা। আগের ম্যাচগুলো যেভাবে গেছে সেভাবেই নে সবাই। ওদের শক্তির দিকেও তাকাস না। ওরা ফাইনালিস্ট, আমরাও ফাইনালিস্ট। সমান সমান। আল্লাহ ভরসা।" সবাই একবার হাতে হাত দিয়ে গোল হয়ে দাঁড়ায়। রুমেল পরহেযগার মানুষ। সে আয়াতুল কুরসী পড়ে ফু দেয়।
ফিল্ডার সাজিয়ে বল হাতে নেয় মিঠু। সে’ই ওপেন করে। কিন্তু এ’কি! ব্যাটসম্যান কে? তার জন্য বিশাল বিস্ময়! সে জানত রেইনবো ঢাকা থেকে দু’জন খেলোয়ার এনেছে। কিন্তু এর মধ্যে একজন অর্ক! সে প্রিমিয়ার ডিভিশন খেলে। পিঞ্চ হিটার। সে যদি ওভার দশেক টিকে যায়, খবর আছে। এরা পচিশ ওভারে তিনশ বানিয়ে ফেলবে। আর তাদের মত গ্রামের আনকোরা ছেলেদের বল পিটিয়ে ছাতু করে দেয়ার ক্ষমতা অর্কের আছে।
বোলিং এর জন্য দৌড় শুরু করার আগে মিঠু ঘাবড়িয়ে যায়, অর্কের স্ট্যান্স দেখে। বামহাতি। কালো চেহারা। মনে হয় জয়সুরিয়া দাঁড়িয়ে আছে। মিঠু মনে মনে উচ্চারন করে “ফাবি আইয়ে আ’লা ই’রব্বিকুমা তুকাজ্জিবান”। ‘অতএব তোমরা স্বীয় প্রভুর কোন কোন নেয়ামতকে অস্বীকার করবে!’ “আল্লাহ, আপাতত অর্কের উইকেটটাই নেয়ামত হিসেবে দাও!”
বল ছাড়ার ঠিক আগমুহুর্তে মিঠু দেখে অর্ক অফস্ট্যাম্পের দিকে একপা সরে এসেছে। প্রথম বলেই অ্যাটাকে যাওয়ার ইচ্ছে। সর্বশক্তি দিয়ে অর্কের পায়ের গোড়ালি বরাবর বল ছোড়ে মিঠু। পারফেক্ট ইয়র্কার! ঠিক প্রথম বলেই এমন একটা বল এক গ্রাম্য কিশোরের কাছ থেকে অর্ক আশা করেনি। ব্যাট আর পায়ের ব্যালেন্স হারিয়ে সে পিচের উপর পরে গেল। উল্লাসিত জনতার চিৎকার আর সেই সাথে উইকেট কিপার আলফাজের উল্লাসের মাঝে সে দেখতে পেল লেগস্ট্যাম্প বাকা হয়ে আছে। প্রথম বলেই ঢাকার প্রিমিয়ার ডিভিশনে খেলা অর্ককে বোল্ড করে দিয়েছে মিঠু! নাহ! তারা এই ম্যাচ এমনি এমনি ছেড়ে দেবেনা!
ওয়ান ডাউনে মাসুদ ভাই। সে তাদের এই এলাকার অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। দ্বিতীয় বল। আবার ইয়র্কার। আবার বোল্ড! মিঠুর বিশ্বাসই হচ্ছেনা, কি হয়ে গেল আর কি হতে যাচ্ছে! হ্যাট্রিক চান্স। কিন্তু হলনা। জাকির ভাই ঠেকিয়ে দিলেন। সে ‘কুল প্লেয়ার’। ধীরেধীরে রেইনবো গুছিয়ে নিয়েছে। কিন্তু প্রথম দুই বলের ধাক্কা তারা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। টুর্নামেন্টের কোন খেলায় রেইনবো প্রথমে ব্যাট করে পচিশ ওভারে একশ আশির নিচে করেনি। আর আজ তারা শেষ ওভারে অলআউট হওয়ার আগে করেছে একশ চুয়াল্লিশ। মিঠু তিনটি উইকেট নিয়েছে। বাকি সবাই কমবেশি ভালো বল করেছে। রান আটকে রেখেছে, একটা দুটো উইকেটও নিয়েছে।
(৪)
অন্য খেলায়, বিরতিতে তাদের খাওয়া চুইংগাম আর পানি। আজকে তাদের জন্য বিরিয়ানি এসেছে চেয়ারম্যান সাহেবের পক্ষ থেকে। এই কিশোরদের খেলা তাকে মুগ্ধ করেছে। তবে খেলার মাঝখানে এত ভারি খাবার খাওয়া ঠিকনা। তারা প্যাকেটের অর্ধেক করে খেয়ে বাকিটুকু এলাকার ছোটছোট ছেলে, যারা খেলা দেখতে এসেছে, তাদের ভাগ করে দিয়েছে। হারকিপটা বলে পরিচিত আজগর মেম্বার ঘোষনা দিয়ে দিলেন, জিততে পারলে রাতে তার বাড়িতে বিরাট খাওয়াদাওয়া হবে। এলাকার ধনাঢ্য ক্রীড়ানুরাগী সালাম সাহেব ঘোষনা দিলেন, আজকের ফাইনাল জিততে পারলে তিনি দুরন্ত দুর্বার সংঘের জন্য ক্লাবঘর আর ক্রিকেটের সরঞ্জাম কিনে দেবেন। মিঠু দেখে বাবাও চলে এসেছেন খেলা দেখতে। মুখে হাসি তার। বাহ! মারের থেকে বোধহয় বাচা গেল। মিঠুর খুব ভালো লাগে।
ওপেনিং জুটিতে ভালো শুরু এনে দিয়েছে শাহেদ আর রাশেদ। ওয়ান ডাউনে আলফাজও বেশ কিছু রান করেছে। কিন্তু ভরসার মিডলঅর্ডার হঠাত করেই ভেঙ্গে গেছে। পনেরো ওভারে একানব্বই। কিন্তু উইকেট চলে গেছে ছয়টা। রুমেল তেমন নির্ভর করার মত ব্যাটসম্যান না। কিন্তু পেশিতে জোর আছে। কোত্থেকে পরপর দুইটা ছক্কা মেরে দিল সে। তাও রেইনবোর মোস্তাক ভাইয়ের বলে! কিন্তু শেষরক্ষা বুঝি হয়না! মিঠু যখন ক্রিজে নামে। তখন তিন ওভারে রান লাগে সতেরো। হাতে মাত্র দুই উইকেট। সে তেমন ভালো ব্যাটসম্যান না, তবে প্রয়োজনে রান আনতে পারে। টুকটুক করে এগিয়ে পরিসংখ্যান দাঁড়ায় বারো বলে এগারো। হাতে দুই উইকেট। আরেক ওভার যায়। ছয় রান আসে। কিন্তু উইকেটও যায় নয় নম্বরেরটা। এক ওভারে পাচ দরকার। মিঠু ব্যাটিংএ। বুক তার দুরু দুরু করে। বোলিংএ আসে ইমরুল। সে ঢাকার খেলোয়ার। ভালো পেস আছে বলে। মিডল অর্ডারে দুই উইকেট নিয়ে সে’ই মিঠুদের কোমর ভেঙ্গেছে।
প্রথম বল গুড লেংথে পড়ে অফস্ট্যাম্পের বাইরে দিয়ে কোমর সমান উচ্চতায় চলে যায়। মিঠু লাগাতে পারেনি। পাঁচ বলে পাঁচ। পরের বল একই লাইনে। আবারো মিস। উফ, কি বল করছে রে! মনে হচ্ছে ম্যাকগ্রা। তৃতীয় বল ছাড়ার সময় মিঠু একটু অফের দিকে সরে আসে। সে জানে বোলার একই রকম বল দিতে পারে। হুক করার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু ইমরুল অভিজ্ঞ পাকা খেলোয়ার। দুর্দান্ত একটা ইয়র্কার দিয়ে বসে। মিঠু বুঝতে পারে সে শেষ! কিন্তু আল্লাহ বাচিয়ে দিয়েছেন। শেষ মুহুর্তে ব্যাট নামিয়ে কোনরকমে সে তার উইকেট বাঁচায়! তিন বলে পাঁচ। চতুর্থ বল সে ব্যাটে লাগায় কিন্তু রান নেয়ার সুযোগ পায়না। পঞ্চম বল বাউন্সার। কানের পাশ দিয়ে ‘সুইইইইইইই’ শব্দ তুলে বল তীব্র বেগে বেরিয়ে যায়। পুরো মাঠ স্তব্ধ। নন-স্ট্রাইকিংএ দাঁড়িয়ে থাকা রনির চোখে সে হতাশা আর ক্ষোভের সংমিশ্রণ দেখে। বোলার তার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। মিঠুর কান্না পায়। এক বলে এখন পাঁচ দরকার। শেষ ওভারে সে একটা রানও করতে পারলনা! আল্লাহ, আরেকটা ‘নেয়ামত’ দরকার। একটা ছক্কা মাত্র।
(৫)
বোলার তার জায়গায় তৈরি দৌড়ানোর জন্য। মিঠু সামনে তাকায়। লং অনের দিকে হঠাত কি যেন নড়ে ওঠে লাল রঙের। মাঠের পরে যে দোতলা বাড়ি আছে, সেখানে বারান্দায় লালরঙের কাপড় পড়া একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। আরে ওটা তো উর্মিদের বাড়ি! ভালো করে তাকিয়ে বুঝতে পারে ওটা উর্মিই।
উর্মির প্রতি তার একটুখানি দুর্বলতা আছে। কিন্তু ওটুকুই। সে কখনো সাহস করে সামনে দাড়াতেও পারেনি। মিঠুর মনে পড়ে, ক’দিন আগে ইন্টার-ক্লাস খেলা হচ্ছিল তাদের স্কুলের সামনের ছোট মাঠে। সে ব্যাটিংএ। পাশের ক্লাসবিল্ডিংএর বারান্দা দিয়ে উর্মি হেটে যাচ্ছিল। সে বোধহয় তার দিকে তাকিয়ে একটু আনমনা হয়ে গিয়েছিল। ফল কি হল? সে বোল্ড আউট! ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সে উর্মির দিকে তাকাতেই দেখে মেয়েটা হাসছে। তাচ্ছিল্যের হাসি। মিঠুর খুব মন খারাপ হয়েছিল সেদিন।
বোলার দৌড়াতে শুরু করেছে। মিঠুর চোখ তড়িত গতিতে বোলারকে মাপছে আর উর্মিদের বাড়ির দিক থেকে ঘুরে আসছে। বল ছাড়ার ঠিক আগমুহুর্তে মিঠু জানে, এই বলটা বোলার ইয়র্কার দেবে। নিমিষেই দুপা সামনে এগিয়ে আসে সে। ইয়র্কার হয়ে যায় লো-ফুলটস। থার্ডম্যানের দিক থেকে আড়াআড়ি টেনে আনা ব্যাট ধেয়ে আসা বলকে সোজা লংঅনের ওপর দিয়ে উড়িয়ে দেয়। ‘টার্গেট ফিক্সড অ্যান্ড অ্যাচিভড’। ঝনঝন করে ভেঙ্গে পড়ে উর্মির পেছনের জানালার কাচ। ছক্কা! কানে তালা লাগানোর মত শব্দে যেগে ওঠে চারদিক। মিঠুরা জিতে গেছে। তারা, কয়েকটি কিশোরের দল এখন উপজেলার চ্যাম্প্যিয়ন! কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখে কারা কারা যেন তাকে কোলে আর কাধে উঠিয়ে নিয়েছে। একই অবস্থা তার সহখেলোয়ার বন্ধুদেরও। এ যে অভাবনীয় বিজয়!
(৬)
তারপর, মিঠুদের ক্লাব দাঁড়িয়ে গেছে। এসএসসি’র পরে মাস দুই তারা চুটিয়ে খেলা উপভোগ করেছে। কলেজে পড়ার জন্য তারা বন্ধুরা একেক এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। ছুটিছাটায় বাড়িতে এলে আবার খেলাধুলা করেছে।
কিন্তু হয়েছে কি, সেই জানালা ভাঙ্গার কারনেই কিনা, এরপরে যতবার উর্মির সাথে মিঠুর দেখা হয়েছে, কথাতো দূরে থাক, মিঠুকে দেখলেই সে মুখচোখ কুচকে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেছে।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
কামরুজ্জামান সাদ ২৩/০৫/২০১৮দারুণ গল্প।মিঠু উর্মির রসায়নটা জমতে দেওয়া উচিত ছিল।
-
রেজাউল রেজা (নীরব কবি) ২০/০৫/২০১৮Darun!
-
মোঃ হারুন-অর-রশীদ ১৯/০৫/২০১৮চমৎকার রচনা।
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ১৯/০৫/২০১৮দারুন।
-
সেলিম রেজা সাগর ১৮/০৫/২০১৮চালিয়ে যান, ভাল হবে।