www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

শাসন (কৈশোরের গল্প)

(১)
আজ সকাল থেকেই মেজাজ গরম হয়ে আছে সাজিদের। থানার পশ্চিমপাড়ার ট্যাপলা ক্রিকেট খেলার চ্যালেঞ্জ দিয়ে গেছে। বলে কিনা “তোগো এইবার পিডাইয়া হোয়াইয়া হালামু!” অথচ স্কুলের ছাত্র হয়ে সাজিদরা কলেজের টিমকে হারায়। ছোট এই শহরের বাৎসরিক টুর্নামেন্টে প্রতিবারই তাদের বন্ধুরা বিভিন্ন দলের হয়ে গত দুতিন বছর ধরে খেলে আসছে। সাজিদদের ইচ্ছে এবার তারা নিজেরাই একটা দল বানাবে। তাদের অবশ্য একটা ক্লাব আছে। তবে নামেই ক্লাব। দুটা ব্যাট আর সুপারি গাছের ‘কাঠ’ দিয়ে বানানো ছয়টা স্ট্যাম্প। তারা অবশ্য মাসে দশ টাকা করে চাদা দেয়। সেটা দিয়ে টেনিস বল আর স্কচটেপ কেনা হয়। টেনিস বলে টেপ পেচিয়ে তারা ক্রিকেট খেলে। আসল ক্রিকেট বল, ব্যাট, প্যাড, গ্লাভস ইত্যাদি কেনার কথা তারা স্বপ্নেও ভাবেনা।

তা পরে দেখা যাবে। আপাতত তারা এই টেপটেনিসের ক্রিকেটে এই এলাকার ‘জুনিয়র বস’। তাদের শহরের চ্যম্পিয়ন টিমও তাদের সম্মান দিয়ে কথা বলে। অথচ তাদেরই কিনা হুমকি দেয় ট্যাপলা! বিকেলে স্কুলের মাঠের এককোনায় বসে তারা বন্ধুরা আলোচনা করে।
“চল কাইলই অগো লগে খেলি”
“হ। এক্কেরে ভস্কাইয়া দিমু”
“আইচ্ছা, অরা হঠাৎ কইরা আমাগো লগে খেলতে চাইল ক্যান? অ্যার আগে তো একবারও জিততে পারেনাই। হেরপরও এমন সাহস দেহানোর কারন কি?”
সবাই মাথা চুলকায়। কিন্তু ট্যাপলাদের হঠাৎ সাহসের কারন খুজে পায়না।

জুলহাস বলে উঠে, “বুঝছি। মুরাদগো বাড়ি ঢাকাত্থে মেহমান আইছে অনেক। কয়েকটা পোলাপান আছে আমাগো বয়সী। কাইল বিয়ালে দেখছিলাম অরা কোলার মইধ্যে খেলতাছে। মনে হয় অরা ভালো খ্যালে। এইল্লিগ্যাই খ্যালতে চাইতাছে”
হমম। চিন্তার বিষয়। ঢাকা থেকে যদি কয়েকজন ছেলে এসে থাকে যারা ভালো খেলে, তাদের সাথে খেলতে যাওয়া রিস্কি। যদি হেরে যায়! লজ্জার ব্যাপার! তার উপর আবার আগামী সপ্তাহে তাদের বার্ষিক পরীক্ষা। নাহ, খেলা বাদ।

(২)
তারা যখন মনস্থির করেই ফেলল যে, এখন খেলা যাবেনা পরীক্ষার জন্য, তখন দেখা গেল ওপাড়ার পটলা এসেছে। ট্যাপলার বন্ধু। আসলে ‘ট্যাপলা’ ‘পটলা’ ইত্যাদি নাম দেয়া হয়েছে ওদের আকার আকৃতির জন্য। যেমন পটলা একটু ছোটখাটো নাদুসনুদুস। ওদের আরেকজন আছে, লম্বা এবং শুকনা। সে আবার ফার্স্ট বোলিং করে। তার নাম ‘ঢ্যাঙ্গা’। এই নামে ডাকতে ডাকতে ওদের আসল নাম ভুলে গেছে সবাই। সাজিদের অবশ্য খারাপ লাগে। মসজিদের ইমাম সাহেব বলেছেন, কাউকে বিকৃত নামে ডাকলে গুনাহ হয়। সাজিদ ভাবছে ওদের আর এসব নামে ডাকবেনা। ভালো নামে ডাকবে। কিন্তু এই নাম শুনতে শুনতে ওরা নিজেরাই হয়ত ওদের আসল নাম ভুলে গেছে!
পটলা এসেই আবার মেজাজ খারাপ করে দিল।
“কবে খেলবি ক! যহন তহন আমরা রেডি”
সাজিদের বন্ধু রেজা ওদের বোঝানোর চেষ্টা করল
“দ্যাখ ভাই, আমাগো পরীক্ষা। এই মুহুর্তে খেলা যাইবনা। আগামী মাসে খেলি”
নাহ! ওরা শুনবেনা। বদের হাড্ডি একেকটা!
সাজিদ রাগ করে খেলা ফাইনাল করে ফেলে
“যাহ! খেলব কালকে। দেখব, কত পারোস! কালকে শুক্রবার, এই মাঠে খেলা”
কথাতো ফাইনাল হল। কিন্তু পরীক্ষার আগে খেলাটা মনে হয় ঠিক হলোনা।
রেজোয়ান বলল “ এক বিকালই তো! আইজ রাইতে একটু বেশি পড়মু আবার কাইল রাইতে। প্রবলেম হইবনা”
সকলে সায় দেয়। ঠিক আছে, কালকেই তাহলে খেলা হোক।

(৩)
ট্যাপলাদের দলের দিকে তাকিয়ে সাজিদরা চমকে উঠল। ওরা মাত্র চারজন স্থানীয়। বাকি সাতজনই বাইরের, মানে ‘ঢাকাইয়া’। এবং ওদের দেখলে মনে হয় নিয়মিত ব্যায়ামট্যায়াম, খেলাধুলা করে। বেশ পেশীবহুল শরীর। এদের সাথে জেতার কথা ভাবা যায়না!
যাইহোক। সাজিদরা টসে জিতে গেল। বিশ ওভারের খেলা। তারা করল একশ পচিশ রান। সাজিদ করেছে আটাশ আর মুহিত করেছে সর্বোচ্চ সাইত্রিশ।
ওদের ঢাকাইয়া বোলাররা তেমন পাত্তা পায়নি।
কিন্তু সাজিদরা আসল খেলা দেখালো বোলিংএ। তাদের একেরপর এক আক্রমনে ট্যাপলারা একেবারে নাস্তানাবুদ হয়ে গেল। পনের ওভার শেষ ওরা রান করেছে মাত্র পঞ্চান্ন। উইকেট গেছে আটটা। সাজিদ উইকেট পেয়েছে চারটা, আর জাহিদ দুটো। খেলা বলতে গেলে শেষ। নয় আর দশ নাম্বার ব্যাটসম্যান এখন ক্রিজে। সাজিদরা একেকটা বল করে, ‘সাঁই’ শব্দ করে বল উইকেট আর ব্যাটের মাঝখান দিয়ে চলে যায়।
সাজিদদের উইকেট কিপার রাশু বলে
“দে তো, আমারে একখান ওভার দে। এমন মোয়া ব্যাটসম্যান আর পামুনা”
রাশু ভালো কিপার। কিন্তু বলটল সাধারনত করেনা। সেই রাশুকে দিয়ে বল করিয়েই আজ এদের শেষ করবে। মজা লোটার পালা এখন!
রাশু বল করতে গেল। কিন্তু প্রথম বল ওয়াইড। অনেকদিন পরে বল করতে গেলে যা হয় আর কি! পরের দুটো বল সে ভালো করেছে। ব্যাটসম্যান একটাও লাগাতে পারেনি।
সাজিদরা সবাই রাশুকে উৎসাহ দিতে লাগল। সে একেকটা বল করে, আর সবাই একযোগে চেচিয়ে ওঠে “ভস্কা-----”।
উইকেট কিপারের জায়গা থেকে সাজিদ উৎসাহ দেয়
“দে , আইজ অগো ভস্কাইয়া দে”
হঠাৎ কানের পাশে কে যেন হুংকার দিয়ে উঠল
“দাড়া, আগে তোগো ভস্কাই” !
কে! ঘার ঘুরিয়ে দেখার আগেই তার পশ্চাদদেশে সপাং করে বেতের বাড়ি পড়ল।
হেডমাস্টার স্যার!

তৎক্ষণাৎ মাথায় কাজ করল সাজিদের- ‘দৌড়’। এই মুহুর্তে দৌড় ছাড়া উপায় নেই। উর্ধশ্বাসে সে দৌড় শুরু করল। হেডমাস্টার স্যারও পেছন পেছন দৌড় শুরু করলেন। কিছুপরে সাজিদ পেছনে তাকিয়ে দেখল পুরো মাঠ ধরে স্যার বেত নিয়ে দৌড়াচ্ছেন আর যাকে পাচ্ছেন, তাকে ধরেই দু-চার ঘা বসিয়ে দিচ্ছেন।
ব্যাপারটা এমন মনে হচ্ছে, কতগুলো বেয়ারা গরুছাগল মাঠে ঘোরাঘুরি করছে আর পেছনে লাঠি নিয়ে রাখাল বালক তাড়া করছে।
দুমিনিটের মাথায় মাঠ ফাঁকা। মাঠের বাইরে এসে ঝোপের আড়ালে সব লুকিয়ে পড়ল। সাজিদ শুনতে পেলো, স্যার গজগজ করছেন
“বদমাইশের দল! দুইদিন পরে পরীক্ষা, আর এই গুলা ল্যাখাপড়া বাদ দিয়া খ্যালতে আইছে! পিডাইয়া পিঠের চামড়া উঠাইয়া ফালানো উচিৎ”
সাজিদ লক্ষ করল, সে যেখানে লুকিয়ে আছে সেটা আসলে হেডমাস্টার স্যারের ঢেঁড়সের বাগান। রাগে আর দুঃখে সে একটার পর একটা ঢেঁড়স ছিড়তে লাগল আর কচ কচ করে চিবিয়ে খাওয়া শুরু করল। আহারে! পশ্চদদেশ এখনো জ্বলছে।

(৪)
সবুজ শবজি খেলে নাকি বুদ্ধি হয়। ঢেঁড়স চাবানোর পরে সাজিদেরও বুদ্ধি বাড়ল। সে ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখল, স্যার যা করেছেন, ঠিকই করেছেন। খেলার সময় খেলা, পড়ার সময় পড়া। পরীক্ষার আগমুহুর্তে তারা কেন খেলতে এলো! সে ঝোপের মধ্য থেকে বেড়িয়ে এলো। অন্য বন্ধুদের ডাকল। সবাইকে বুঝিয়ে বলল যে আসলে তারাই ভুল করেছে। স্যার তাদের পিটিয়ে বরং ভালোই করেছেন। স্কুলের সীমানার মধ্যেই মাঠের পাশে স্যারের বাসা। তারা সবাই সেখানে গিয়ে স্যারের সামনে গিয়ে কেঁদে ফেলল।
“স্যার, আমাদের ভুল হয়ে গেছে। লেখাপড়া বাদদিয়ে আমাদের এখন খেলতে আসা উচিৎ হয়নি। আমাদের ক্ষমা করে দেন। আর এরকম করবনা”
স্যার প্রসন্নমুখে বললেন “দ্যাখ, তোরাইতো আমার আশা ভরসা। তোরা যাতে পরীক্ষায় ভালো করস, বড় হইয়া মানুষ হস, সেইটাইতো আমাগো চাওয়া আর চেষ্টা। আর শোন, পিটানিতে ব্যাথা লাগছেনি?”
সাজিদ হেসে বলে “না স্যার। এ তো আপনাদের শাসন। শিক্ষকদের শাসন তো আমাদের জীবনের জন্য আশীর্বাদ”। বলেই তার চোখ ভিজে ওঠে। সে লক্ষ করল, স্যারের চোখও বুঝি একটু ছলছল করে উঠল।
স্যার ঘরের ভেতরের দিকে হাক দিয়ে বললেন “এই কেডা আছোস, এগো লাইগ্যা পিঠা লইয়া আয়।”
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৭৮১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৭/০৫/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • জীবনের গল্প
    দারুণ
    ধন্যবাদ
    • অনেক ধন্যবাদ
  • ন্যান্সি দেওয়ান ১৮/০৫/২০১৮
    Very nice.
  • বেশ ভালো ॥
  • fahmida bari ১৮/০৫/২০১৮
    চমতকার গল্প। ডায়লগগুলো দারুণ মজা লেগেছে।
 
Quantcast