মাঠের ওপারে (কৈশোরের গল্প)
পরীক্ষা শেষ। গ্রীষ্মের ছুটিও শুরু। স্কুল নেই। পড়াশুনার চাপও নেই। বাবলুর এখন অখন্ড অবসর। ছুটি-ছাটার এইসব দিনে পড়াশুনা নিয়ে বাবা-মা তাকে তেমন কোন চাপ দেয়না। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে সে একঘন্টা করে পড়াশুনা করে। বাকি সময় সে তারমত উপভোগ করে। অবসর মানে কিন্তু আসলে অবসর নয়। বাবলু খুব ব্যাস্ত। সে গল্পের বই পড়ে। ইতিমধ্যেই 'পথের পাঁচালী' অর্ধেক শেষ করে ফেলেছে। বাবা বলেছেন, এই বয়সের জন্য বইটা একটু কঠিন, কিন্তু সে সাহস করে হাত দিয়েছে। আর বাসায় আসা দৈনিক পত্রিকায় সাপ্তাহিক যে ছোটদের পাতা থাকে সেখানকার গল্প কবিতা তার চাইই। তাছাড়া তার ভালো লাগে নবীদের জীবনী, সাহাবাদের জীবনী এছাড়া অন্যান্য মহৎ মানুষদের জীবনী। ছোটদের জন্য সহজ ভাষায় লেখা এইসব বই তার জন্য শহর থেকে আনা হয়েছে। বাবা বলেন, পড়াশুনা করতে হবে আনন্দ নিয়ে। স্কুলের পড়ার বইএর বাইরের এইসব বই তাকে অনেক আনন্দ দেয়। সে অনেক জানতে পারে।
পড়ার বাইরে তার বিশাল সময় কাটে খেলাধুলায়। বাবলু ক্রিকেট খেলা খুব পছন্দ করে। বাংলাদেশ ক্রিকেটতো বটেই অন্যদেশের অনেক ক্রিকেটারদের নামও সে জানে। পত্রিকার খেলার পাতার নিয়মিত পাঠক সে। তার সবচেয়ে পছন্দের খেলোয়ার মাশরাফি আর মুশফিক। তবে এখন ক্রিকেটের সময়না। একেতো গরম, তারউপর আবার মাঝেমাঝে বৃষ্টি হয়। বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলতে তার খুব ভালো লাগে। তাছাড়া আরো কত খেলা তারা খেলে! ডাঙ্গুলি, দাড়িয়াবান্দা, গোল্লাছুট, বউছি, কিংবা বৃষ্টির দিনে ঘরে বসে লুডু বা চোর-পুলিশ।
কখনো কখনো বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বের হয়। তাদের গ্রামটা খুব ছোট। কিন্তু খুব সুন্দর। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ-ক্ষেত, তার মাঝদিয়ে বহুদুরে হারিয়ে যাওয়া মেঠো রাস্তা, এখানে সেখানে গুচ্ছগুচ্ছ বাড়িঘর, পুকুর, খাল, বাগান, আর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা রুপালী নদী। বাবলুর মনে হয়, তাদের গ্রামের চাইতে সুন্দর গ্রাম আর পৃথিবীর কোথাও নেই। অবশ্য সে এখনো পৃথিবীর তেমন কিছুই দেখেনি। বড় হলে সে পৃথিবী ঘুরে দেখবে। ‘পথের পাঁচালী’র অপুর মত অজানাকে জানতে আর ঘুরতে খুব ভালো লাগে তার। তবে বছরের শেষে একবার নানাবাড়ি ছাড়া দূরে তেমন যাওয়া হয়না। মাঝেমাঝে পাশের গ্রামগুলোতে সে তার দাদার সাথে হাটে যায়।
বন্ধু মিঠুদের বাড়ির সাথে বিশাল বাগান। একা যেতে বাবলুর ভয় লাগে। কিন্তু বন্ধুরা একসাথে গেলে ভয় নেই। কাচাপাকা আম, কাঠাল, পেয়ারা, ডেউয়া, মুরমুরি, বেতুইন আরো কি ফল আছে এই বাগানে। শহর থেকে বাবা মাঝেমাঝে আপেল কিংবা কমলা নিয়ে আসে, কিন্তু এইসব নিজেদের বাগানের ফল বাবলুর খুব ভালো লাগে। মাদার গাছের ফুল দিয়ে তেতুল ভর্তাও বেশ লাগে। তবে তা অবশ্য শীতের দিনে। মিঠুদের বাগান বাবলুদের কিশোর দলের একটা আড্ডাখানা। বাবলু তাদের মধ্যে বয়সে একটু ছোট, তারপর আবার পড়াশুনাতেও একটু বেশি ভাল। বন্ধুরা তাই বাবলুকে একটু বেশিই ভালোবাসে। আবার স্নেহও করে। বাগানের মাঝে বেশ খোলামত একটা জায়গা পরিষ্কার করে গোলপাতার একটা মাদুর বিছিয়ে তারা বসে। দুপুরের খাওয়া আর জোহরের নামাজের পরে তারা এখানে বসে। গল্প করে, হেঁড়ে গলায় গান গায়।
গল্প করতে করতে বন্ধু কাশেম প্রস্তাব দেয়
"ল, বড়খালের ওই পাড়ে যাই। মোগো খ্যাতে আউক হইছে। খাইয়া আহি"।
গ্রামের প্রান্তে বিশাল মাঠ পেরিয়ে বড়খাল। সেখানকার কথা শুনেছে বাবলু কিন্তু যাওয়া হয়নি। তার যেতে ইচ্ছে করে কিন্তু আবার ভয়ও করে। মা যদি বকে! আরেক বন্ধু জহির সাহস দেয়
"আরে ডরের কিছু নাই। ল। সন্ধ্যার আগেই আইয়া পড়মু। চাচীআম্মায় কিছু কইবনা।"
আখের রস বাবলুর ভালো লাগে। তারউপর বড়খাল দেখার বাসনা। ভয়ের উপর আগ্রহ জয়ী হয়। বাবলুদের সাত আটজনের দল বড়খালের দিকে রওনা হয়।
এখন ভাটার সময়। পানি কম। কয়েক জায়গায় একেবারে হাটুপানি। নৌকা ছাড়াই তারা পার হয়ে গেল। বড়খালের এই পারটা থেকে অন্যগ্রাম। তবে বাড়িঘর অনেক দূরে। যতদূরে চোখ যায়, ক্ষেতখামার। কাশেমদের আখের বাগান বা ক্ষেত দেখে বাবলু অবাক হয়। বাজার থেকে তার দাদা আখ কিনে আনে, কিন্তু জমিতে ফলা এরকম অজস্র আখ সে আগে দেখেনি। সুকান্ত হাতে একটা কাস্তে নিয়ে এসেছে। সে একেকটা আখের গোড়া থেকে কেটে একেকজনের হাতে ধরিয়ে দেয়। খুব মিষ্টি রস। বাবলু জানে, এই আখের রস থেকে কাশেমের বাবা গুড় বানায়। তাদের বাড়ির উঠানে বিশাল আকারের কড়াইয়ের মত কি যেন আছে যেটাকে ওরা 'তাফাল' বলে, সেটায় করে আখের রস জ্বাল দিয়ে ঘন করে গুড় বানানো হয়। কাশেমের মা তাদের বাড়িতে মাঝেমাঝেই গুড় দিয়ে যায়।
বাগান থেকে আখ কেটে নিয়ে ক্ষেতের পাশে একসাথে বন্ধুদের সাথে আখ চিবিয়ে রস বের করা ভারি আনন্দ দিল সবাইকে। পশ্চিমাকাশে সুর্য ঢলে পড়েছে অনেকটাই। দিন শেষ হতে বেশি দেরি নাই। তাদের ফিরতে হবে। আবার হইহই করে একসাথে ফিরে আসা। কিন্তু একি! খাল যে ভরে গেছে জোয়ারের পানিতে। আশেপাশে কোন নৌকা নেই। তারা কিভাবে পার হবে! কিছুক্ষন পরে ডিসিশন নেয়া হল, সাঁতরে তারা খাল পার হবে। বাবলুর কান্না পেল। সে মাত্রই এক আধটু সাঁতার শিখেছে। তাও বাড়ির পাশের ছোট খালে আর পুকুরে। এই খাল সে পার হতে পারবে বলে মনে হয়না। তাছাড়া কাপড়চোপড় ভেজা নিয়ে ফিরলে মা ধোলাইও দিতে পারে। কিন্তু অন্য উপায়ও তো নেই। সবার শার্ট বা গেঞ্জি খুলে একসাথে গিট্টূ মারা হল। তাদের মধ্যে মজিদ সবচেয়ে ভালো সাঁতার জানে। সে এক হাতে এটা কাপড়ের পুঁটলি নিয়ে পার হবে। অন্যরা যাদের পড়নে লুঙ্গী আছে তারা পানিতে নামতে নামতে আস্তে আস্তে লুঙ্গী তুলতে থাকবে। তারপর এক হাতে লুঙ্গী নিয়ে হাত উচিয়ে এমন ভাবে পার হবে যাতে লুঙ্গী না ভিজে।
কিন্তু বাবলু কি করবে? তার পরনে প্যান্ট! তাছাড়া একহাত দিয়ে সে সাঁতার কেটেও পার হতে পারবেনা। তাকে নিয়েই অন্যরা চিন্তা করতে থাকল। হঠাত তার বন্ধু রাশু নিজের লুঙ্গী খুলে তার দিকে ছুঁড়ে মেরে পানিতে ঝাপ দিল। সবাই হাসতে গিয়েও থেমে গেল। বন্ধুর জন্য বন্ধুর ত্যাগ সবার মন ভালো করে দিল। বাবলু লুঙ্গী পড়ে প্যান্ট খুলে রাশুর দিকে দিয়ে দিল। সে বাবলুর প্যান্ট হাতে নিয়ে পার হবে। আর বাবলুকে বলল "তুই লুঙ্গী ভিজা, পোব্লেম নাই।" বাবলু লুঙ্গী কাছা মেরে নিল। খুব ভয়ে ভয়ে সে পানিতে নামল। বন্ধুরা সাহস দিল। দুজন তার পেছনে থাকবে, যদি সে সমস্যায় পড়ে, তারা দেখবে। সাহস করে আল্লাহর নাম নিয়ে বাবলু সাঁতার শুরু করল। চার হাত পা দিয়ে প্রানপনে সে সামনে আগাচ্ছে। খাল বুঝি আর শেষ হয়না। এত বড় ক্যান! বাবলুর মনে হচ্ছিল সে বুঝি আর পারবেইনা, এখনই ডুবে যাবে। কিন্তু শেষ মুহুর্তপর্যন্ত সে লড়াই করে যাবে। হঠাত করেই হাতের সাথে মাটি ঠেকে। সামনে তাকিয়ে দেখে সে এপাড়ে চলে এসেছে! বাহ! এত বড় খাল কি সুন্দর ভাবেই পাড়ি দিয়ে এলো। অথচ সে কি ভয়ই না পেয়েছিল!
বাবলুর খুব ভালো লাগল। মনে হচ্ছে সে একটা মাইলফলক পার হয়েছে। সাধারন জ্ঞানের বইয়ে সে পড়েছে ব্রজেন দাশ প্রথম বাঙ্গালী হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছিলেন, যেটা কিনা ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের মধ্যকার আটলান্টিক মহাসাগরের অংশ। বাবলুর মনে হচ্ছে সে ওরকমই কিছু একটা করে ফেলেছে। বাবলু বুঝতে পারল, যেকোনো কাজে ভয় পেলে চলবেনা। আল্লাহর উপর ভরসা করে সাহস নিয়ে কাজে নেমে পড়তে হয়। তার মনে পড়ল, স্কুলে স্যার কি সুন্দর করে পড়ানঃ
"জলে না নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার
হাঁটিতে শিখে না কেহ না খেয়ে আছাড়,
সাঁতার শিখিতে হলে
আগে তব নাম জলে,
আছাড়ে করিয়া হেলা, হাঁট বার বার
পারিব বলিয়া সুখে হও আগুয়ান।"
পড়ার বাইরে তার বিশাল সময় কাটে খেলাধুলায়। বাবলু ক্রিকেট খেলা খুব পছন্দ করে। বাংলাদেশ ক্রিকেটতো বটেই অন্যদেশের অনেক ক্রিকেটারদের নামও সে জানে। পত্রিকার খেলার পাতার নিয়মিত পাঠক সে। তার সবচেয়ে পছন্দের খেলোয়ার মাশরাফি আর মুশফিক। তবে এখন ক্রিকেটের সময়না। একেতো গরম, তারউপর আবার মাঝেমাঝে বৃষ্টি হয়। বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলতে তার খুব ভালো লাগে। তাছাড়া আরো কত খেলা তারা খেলে! ডাঙ্গুলি, দাড়িয়াবান্দা, গোল্লাছুট, বউছি, কিংবা বৃষ্টির দিনে ঘরে বসে লুডু বা চোর-পুলিশ।
কখনো কখনো বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বের হয়। তাদের গ্রামটা খুব ছোট। কিন্তু খুব সুন্দর। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ-ক্ষেত, তার মাঝদিয়ে বহুদুরে হারিয়ে যাওয়া মেঠো রাস্তা, এখানে সেখানে গুচ্ছগুচ্ছ বাড়িঘর, পুকুর, খাল, বাগান, আর গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা রুপালী নদী। বাবলুর মনে হয়, তাদের গ্রামের চাইতে সুন্দর গ্রাম আর পৃথিবীর কোথাও নেই। অবশ্য সে এখনো পৃথিবীর তেমন কিছুই দেখেনি। বড় হলে সে পৃথিবী ঘুরে দেখবে। ‘পথের পাঁচালী’র অপুর মত অজানাকে জানতে আর ঘুরতে খুব ভালো লাগে তার। তবে বছরের শেষে একবার নানাবাড়ি ছাড়া দূরে তেমন যাওয়া হয়না। মাঝেমাঝে পাশের গ্রামগুলোতে সে তার দাদার সাথে হাটে যায়।
বন্ধু মিঠুদের বাড়ির সাথে বিশাল বাগান। একা যেতে বাবলুর ভয় লাগে। কিন্তু বন্ধুরা একসাথে গেলে ভয় নেই। কাচাপাকা আম, কাঠাল, পেয়ারা, ডেউয়া, মুরমুরি, বেতুইন আরো কি ফল আছে এই বাগানে। শহর থেকে বাবা মাঝেমাঝে আপেল কিংবা কমলা নিয়ে আসে, কিন্তু এইসব নিজেদের বাগানের ফল বাবলুর খুব ভালো লাগে। মাদার গাছের ফুল দিয়ে তেতুল ভর্তাও বেশ লাগে। তবে তা অবশ্য শীতের দিনে। মিঠুদের বাগান বাবলুদের কিশোর দলের একটা আড্ডাখানা। বাবলু তাদের মধ্যে বয়সে একটু ছোট, তারপর আবার পড়াশুনাতেও একটু বেশি ভাল। বন্ধুরা তাই বাবলুকে একটু বেশিই ভালোবাসে। আবার স্নেহও করে। বাগানের মাঝে বেশ খোলামত একটা জায়গা পরিষ্কার করে গোলপাতার একটা মাদুর বিছিয়ে তারা বসে। দুপুরের খাওয়া আর জোহরের নামাজের পরে তারা এখানে বসে। গল্প করে, হেঁড়ে গলায় গান গায়।
গল্প করতে করতে বন্ধু কাশেম প্রস্তাব দেয়
"ল, বড়খালের ওই পাড়ে যাই। মোগো খ্যাতে আউক হইছে। খাইয়া আহি"।
গ্রামের প্রান্তে বিশাল মাঠ পেরিয়ে বড়খাল। সেখানকার কথা শুনেছে বাবলু কিন্তু যাওয়া হয়নি। তার যেতে ইচ্ছে করে কিন্তু আবার ভয়ও করে। মা যদি বকে! আরেক বন্ধু জহির সাহস দেয়
"আরে ডরের কিছু নাই। ল। সন্ধ্যার আগেই আইয়া পড়মু। চাচীআম্মায় কিছু কইবনা।"
আখের রস বাবলুর ভালো লাগে। তারউপর বড়খাল দেখার বাসনা। ভয়ের উপর আগ্রহ জয়ী হয়। বাবলুদের সাত আটজনের দল বড়খালের দিকে রওনা হয়।
এখন ভাটার সময়। পানি কম। কয়েক জায়গায় একেবারে হাটুপানি। নৌকা ছাড়াই তারা পার হয়ে গেল। বড়খালের এই পারটা থেকে অন্যগ্রাম। তবে বাড়িঘর অনেক দূরে। যতদূরে চোখ যায়, ক্ষেতখামার। কাশেমদের আখের বাগান বা ক্ষেত দেখে বাবলু অবাক হয়। বাজার থেকে তার দাদা আখ কিনে আনে, কিন্তু জমিতে ফলা এরকম অজস্র আখ সে আগে দেখেনি। সুকান্ত হাতে একটা কাস্তে নিয়ে এসেছে। সে একেকটা আখের গোড়া থেকে কেটে একেকজনের হাতে ধরিয়ে দেয়। খুব মিষ্টি রস। বাবলু জানে, এই আখের রস থেকে কাশেমের বাবা গুড় বানায়। তাদের বাড়ির উঠানে বিশাল আকারের কড়াইয়ের মত কি যেন আছে যেটাকে ওরা 'তাফাল' বলে, সেটায় করে আখের রস জ্বাল দিয়ে ঘন করে গুড় বানানো হয়। কাশেমের মা তাদের বাড়িতে মাঝেমাঝেই গুড় দিয়ে যায়।
বাগান থেকে আখ কেটে নিয়ে ক্ষেতের পাশে একসাথে বন্ধুদের সাথে আখ চিবিয়ে রস বের করা ভারি আনন্দ দিল সবাইকে। পশ্চিমাকাশে সুর্য ঢলে পড়েছে অনেকটাই। দিন শেষ হতে বেশি দেরি নাই। তাদের ফিরতে হবে। আবার হইহই করে একসাথে ফিরে আসা। কিন্তু একি! খাল যে ভরে গেছে জোয়ারের পানিতে। আশেপাশে কোন নৌকা নেই। তারা কিভাবে পার হবে! কিছুক্ষন পরে ডিসিশন নেয়া হল, সাঁতরে তারা খাল পার হবে। বাবলুর কান্না পেল। সে মাত্রই এক আধটু সাঁতার শিখেছে। তাও বাড়ির পাশের ছোট খালে আর পুকুরে। এই খাল সে পার হতে পারবে বলে মনে হয়না। তাছাড়া কাপড়চোপড় ভেজা নিয়ে ফিরলে মা ধোলাইও দিতে পারে। কিন্তু অন্য উপায়ও তো নেই। সবার শার্ট বা গেঞ্জি খুলে একসাথে গিট্টূ মারা হল। তাদের মধ্যে মজিদ সবচেয়ে ভালো সাঁতার জানে। সে এক হাতে এটা কাপড়ের পুঁটলি নিয়ে পার হবে। অন্যরা যাদের পড়নে লুঙ্গী আছে তারা পানিতে নামতে নামতে আস্তে আস্তে লুঙ্গী তুলতে থাকবে। তারপর এক হাতে লুঙ্গী নিয়ে হাত উচিয়ে এমন ভাবে পার হবে যাতে লুঙ্গী না ভিজে।
কিন্তু বাবলু কি করবে? তার পরনে প্যান্ট! তাছাড়া একহাত দিয়ে সে সাঁতার কেটেও পার হতে পারবেনা। তাকে নিয়েই অন্যরা চিন্তা করতে থাকল। হঠাত তার বন্ধু রাশু নিজের লুঙ্গী খুলে তার দিকে ছুঁড়ে মেরে পানিতে ঝাপ দিল। সবাই হাসতে গিয়েও থেমে গেল। বন্ধুর জন্য বন্ধুর ত্যাগ সবার মন ভালো করে দিল। বাবলু লুঙ্গী পড়ে প্যান্ট খুলে রাশুর দিকে দিয়ে দিল। সে বাবলুর প্যান্ট হাতে নিয়ে পার হবে। আর বাবলুকে বলল "তুই লুঙ্গী ভিজা, পোব্লেম নাই।" বাবলু লুঙ্গী কাছা মেরে নিল। খুব ভয়ে ভয়ে সে পানিতে নামল। বন্ধুরা সাহস দিল। দুজন তার পেছনে থাকবে, যদি সে সমস্যায় পড়ে, তারা দেখবে। সাহস করে আল্লাহর নাম নিয়ে বাবলু সাঁতার শুরু করল। চার হাত পা দিয়ে প্রানপনে সে সামনে আগাচ্ছে। খাল বুঝি আর শেষ হয়না। এত বড় ক্যান! বাবলুর মনে হচ্ছিল সে বুঝি আর পারবেইনা, এখনই ডুবে যাবে। কিন্তু শেষ মুহুর্তপর্যন্ত সে লড়াই করে যাবে। হঠাত করেই হাতের সাথে মাটি ঠেকে। সামনে তাকিয়ে দেখে সে এপাড়ে চলে এসেছে! বাহ! এত বড় খাল কি সুন্দর ভাবেই পাড়ি দিয়ে এলো। অথচ সে কি ভয়ই না পেয়েছিল!
বাবলুর খুব ভালো লাগল। মনে হচ্ছে সে একটা মাইলফলক পার হয়েছে। সাধারন জ্ঞানের বইয়ে সে পড়েছে ব্রজেন দাশ প্রথম বাঙ্গালী হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছিলেন, যেটা কিনা ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের মধ্যকার আটলান্টিক মহাসাগরের অংশ। বাবলুর মনে হচ্ছে সে ওরকমই কিছু একটা করে ফেলেছে। বাবলু বুঝতে পারল, যেকোনো কাজে ভয় পেলে চলবেনা। আল্লাহর উপর ভরসা করে সাহস নিয়ে কাজে নেমে পড়তে হয়। তার মনে পড়ল, স্কুলে স্যার কি সুন্দর করে পড়ানঃ
"জলে না নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার
হাঁটিতে শিখে না কেহ না খেয়ে আছাড়,
সাঁতার শিখিতে হলে
আগে তব নাম জলে,
আছাড়ে করিয়া হেলা, হাঁট বার বার
পারিব বলিয়া সুখে হও আগুয়ান।"
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ১৬/০৫/২০১৮কিশোরগল্প।