ঘৃণা নয় আমি জানি মুম্বাই ভালবাসে
মুম্বাইয়ের মসজিদ বন্দরের একটি হোটেল। হিন্দু হোটেল। নামটা ঠিক মনে পড়ছে না। এলাকাটা মূলত মুসলিম অধ্যুসিত। হিন্দুও অনেক। রেল স্টেশনের কাছে বেশ কিছু হোটেল আছে হিন্দুদের। লেখাও থাকে সাইনবোর্ডে 'অমুক হিন্দু হোটেল, তমুক হিন্দু হোটেল'। মুসলমান মালিকানাধীন অনেক হোটেলেও আবার 'মুসলিম হোটেল' নির্দিষ্ট করে লেখা থাকে। এ প্রবণতা কোলকাতাতেও দেখেছি। আমাদের দেশেও সীমিত পরিসরে হলেও আছে। যাই হোক এরকম একটি হোটেলে বসে ক্যারামেল খাচ্ছিলাম। মসজিদ স্টেশনে ঢোকার মুখেই হোটেলটার অবস্থান। ছোট হলেও তুলনামূলক বেশ অভিজাত। পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আলোকসজ্জাওও দারুণ মমনোমুগ্ধকর। ক্যাফের মতো আলোআঁধারি। বিশেষ করে রাতে হোটেলটি মনোলোভা হয়ে ওঠে এর আলোআঁধারি আলোকসজ্জার কারণে। রাস্তা ধরে আরও ভিতরদিকে গেলে এরকম বহু ছোটখাটো হোটেল পাওয়া যাবে, সেখানে ফুল এক কাপ চায়ের দাম পড়বে দশ থেকে বার রুপির মধ্যেই। কিন্তু ওই বিশেষ হোটেলে সেই একই মানের চা খেয়েছি আঠার রুপি দিয়ে। খানিকটা বোধহয় উন্নত। তারপরও অল্প কিছু দূরত্বের কারণে দ্বিগুণ দাম কিছুতেই হজম হতে চায় না। মুম্বাইয়ের নিয়মই এমন। স্থান ভেদে খাবারের দামে বড় ধরণের রকমফের হয়ে থাকে। পার্থক্যটা অন্য দেশ থেকে এসে আমার কাছে খুব দৃষ্টিকটু ঠেকেছিল। যেমন আন্ধেরিতে এর থেকেও নিম্ন মানের একটি হোটেলে এর থেকেও সাধারণ মানের এক কাপ চা খেয়েছি পচিশ রুপি দিয়ে। হঠাৎ সেখানে চায়ের দাম পচিশ রুপি শুনে ভিরমি খেয়েছিলাম। বলে কি, এই ছোট, নোংরা হোটেলে এক কাপ চা পচিশ রুপি! পরে বুঝেছিলাম, আসল কথা হলো জায়গা। আন্ধেরি মুম্বাইয়ের অন্যতম অভিজাত এলাকা। ওখানে জিনিসপত্র, খাবারদাবারের দামও আগুন।
উহু আরেকদিকে চলে যাচ্ছি। যেখানে ছিলাম সেখানেই বরং ফিরে আসি। দুপুরবেলা। আনুমানিক আড়াইটা বা আরও কিছুটা বেশি বেজে থাকবে। ক্যারামেল নিয়ে বসেছি। ক্যারামেল খাবারটা অবিকল পুডিঙের মতো। দেখতে ও অনেকটা খেতেও। তবে মিষ্টি অনেকটাই বেশি। হতে পারে হয়তো পুডিংকেই ওখানে ক্যারামেল বলা হয়! প্রায় অবিকল একই রকম দুটো খাবার। ছোট পিংপং বলের সাইজের একটুকরো ক্যারামেল প্রিচের মতো ছোট প্লেটে। বসে আছি বিরস মুখে ত্রিশ রুপি দামের ক্যারামেল নিয়ে। খুব ধীরে ধীরে সময় নিয়ে খাচ্ছি। বাইরে গনগনে রোদ তখন। আমি বেশ ক্লান্ত ছিলাম। ক্যারামেল খাওয়ার থেকেও আসলে তখন আমার সেই হোটেলে বসার মূল উদ্দেশ্য ছিল ফ্যানের নিচে কিছুক্ষণ বসে জিড়িয়ে নেয়া।
আমার ঠিক সামনে সেসময় একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক বিরাট একটা ভাতের থালি নিয়ে বসেছে। কোলকাতার মতো মুম্বাইয়েও ভাত প্যাকেজ হিসেবে বিক্রি হয়। মুম্বাইয়ে এমনিতে ভাতের তেমন একটা প্রচলন নেই। অনেক হোটেলে পাওয়াও যায় না। শুধু ভালো মানের হোটেলগুলোতেই দেখেছি ভাত বিক্রি হতে প্যাকেজ বা থালি সিস্টেমে। ভেজ, ননভেজ থালি। দামও অনেক চড়া। ওই হোটেলে ভেজ থালি বোধহয় ছিল, একশো বিশ রুপি আর ননভেজ দেড়শ। খাইনি যদিও। ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করে দাম জেনেছিলাম। ওখানকার সাধারণ গরীব মানুষের জন্য এই থালি মোটেও ক্রয়সাধ্য নয়। ভাতকে ওখানে অনেকটাই অভিজাত, ধনাঢ়্য মানুষের খাবার হিসেবে দেখা হয়। আগেই বলেছি ভাতের তেমন একটা প্রচলন নেই মুম্বাইয়ে।
ভাতের থালির দাম শুনতে হয়তো খানিকটা অস্বাভাবিক শোনাচ্ছে। কিন্তু থালিগুলো দেখলে দামের ব্যাপারটা অনেকটাই সহনীয় মনে হবে। বিরাট গোলাকার একটি প্লেটে প্রায় আট থেকে দশ পদের তরকারি, চাটনি, ডাল ইত্যাদি দিয়ে পরিবেশিত হয় থালিগুলো। মাঝখানে ভাত, আর চারিদিকে একের পর এক তরকারি ছোট ছোট বাটিতে। কী নেই সেখানে! আমার সামনের ভদ্রলোক বোধহয় ভেজ থালি নিয়ে বসেছিল। দেখলাম কয়েক পদের সবজি, ডালেরও দুতিন পদ, কয়েক রকম চাটনি, সালাদ। আমার সামনে একেবারে শিশুর মতো গাপুসগুপুস করে খাচ্ছিলেন উনি। খাওয়া তখন প্রায় শেষ তার।
'আপ ক্যায়া খা রাহা হ্যায় (আপনি কি খাচ্ছেন)?' খেতে খেতে আচমকা আমাকে প্রশ্ন করে বসলেন ভদ্রলোক।
আমি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। ভাবিনি হঠাৎ আমার সাথে কথা বলবেন। মিনিট পাঁচেকের মতে দুজন একত্রে বসে আছি। আমার আগে থেকে খাচ্ছিলেন উনি।
'ইয়ে ক্যারামেল হ্যায় (এটা ক্যারামেল)।' উপস্থিত অপ্রস্তুতভাব কাটিয়ে জবাবে ভদ্রলোককে বললাম আমি।
'খানে মে কেয়সি হে (খেতে কেমন)?' জানতে চাইলেন ভদ্রলোক।
মিথ্যে বলবো না, লোকটার অমন গা'য়ে পড়ে গল্প জমানোটা মোটেও ভালো লাগছিল না আমার।
'আচ্ছি হে (ভালোই)।' ছোট করে সমাজ রক্ষার্থে জবাবে বললাম।
'আপ কাহা কা রহেনেয়ালা হো (আপনি কোথায় থেকে এসেছেন)?' অপ্রাসঙ্গিক ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে বসলেন ভদ্রলোক। বিরক্ত হলাম বেশ। ঠিক সেসময় অপরিচিত কারও সাথে এসব গল্প করার মতো প্রস্তুত ছিলাম না মানসিক ও শারীরিকভাবেও। তারপরও আমার থেকে বয়সে বেশ বড় একজন মানুষ কিছু জিজ্ঞেস করলে উপেক্ষাও তো করা যায় না।
'ম্যায় বাংলাদেশ কা রহেনেয়ালা হু (আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি)।' যথাসম্ভব হাসি হাসি মুখ করে জবাবে বললাম আমি।
আমার একথা শুনে তৎক্ষণাৎ দেখলাম ভদ্রলোকের অভিব্যক্তি সম্পূর্ণরূপে পাল্টে গেল। ভদ্রলোকসুলভ হাসি খুশিভাব সরে যেয়ে সেখানে ফুটে উঠলো ঘৃণা ও অবজ্ঞার ছায়া। তারপর কঠোর, মারমুখী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রাজ্যের ঘৃণা নিয়ে আক্রমণাত্মক ভাঙ্গিতে সে তখন আমাকে বললো, 'তুম লোগ ক্যায়া সন্ত্রাস কারনে কে লিয়ে আয়ে হো ইহা (তোমরা কি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করার জন্য এখানে এসেছ নাকি)!'
'নেহি ঘুমনে আয়া হু (না বেড়াতে এসেছি)।' বললাম আমি। যথাসম্ভব নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করলাম। একে তো গা'য়ে পড়ে গল্প শুরু করেছে। তার ওপর আবার দেশের নাম শুনে অকারণ দুর্ব্যবহার শুরু করেছে। ইচ্ছে করছিল একটা ঘুসি মেরে দাঁত ভেঙে দেই। 'যাইয়ে আপ আপনা কাম মে যাইয়ে (যান আপনি আপনার কাজে যান)।' বললাম বিরক্তির সাথে।
বয়স্ক না হলে সেদিন লোকটাকে আরও অপমান করতাম। আমি শতভাগ নিশ্চিত ছিলাম, আশেপাশের লোকজন সকলে আমার পক্ষেই কথা বলতো। মুম্বাইয়ের মানুষ অনেক ভালো, অনেক সমঝদার। আমি নিশ্চিত ছিলাম, বুঝিয়ে বললে লোকটা যতো প্রভাবশালীই হোক না কেন কেউ তার পক্ষ নিয়ে কথা বলবে না। পাশে একটা ছোট পুলিশ ফারিও আছে। মারধোর করারও প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। যদি প্রয়োজন পড়ে, তবে ছেড়ে কথা বলবো না।
তবে লোকটা আর ঘাটাল না আমাকে। বোধহয় আমার চেহারাও তখন বিশেষ সুবিধার লাগেনি তার কাছে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আবার হিতে বিপরীত হবে ভেবে কিঞ্চিৎ ভয়ও পেয়েছিলেন হয়তো। তারপর রাজ্যের ঘৃণা, অবজ্ঞা নিয়েই উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে।
মিথ্যে বলবো না, আমি নিজে তৎক্ষণাৎ সেখানে কিছুটা ভয়ই পেয়েছিলাম এই ভেবে যে, আরও বিপদজনক কিছু আবার না করে বসে লোকটা! মানে লোকজন ডেকে এনে বাংলাদেশি বলে আমাকে আবার লাঞ্ছিত না করে বসে! হা হা হা। সত্যি তাই; সেদিন লোকটার আকস্মিক অমন উগ্র, আক্রমণাত্মক ব্যবহারে বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। যতো যাই হোক আমি মুম্বাইয়ে সম্পূর্ণরূপে একজন বিদেশী। আমার পূর্ব পুরুষদেরও কেউ কখনও মনে হয় না, মুম্বাইয়ে কোনদিন এসেছিল। বিদেশ বিঁভুইয়ে স্থানীয় মানুষজনদের প্রতি এক ধরণের বাড়তি সমীহ রয়েই যায়। এটা শুধু আমার একার নয়, সকলেরই। আমি ভাবছিলাম যে লোকটা হয়তো এখানেই ক্ষান্ত দিবে না, আরও উল্টাপাল্টা কিছু করে বসবে!
না, শেষমেশ আর কিছু হলো না, ব্যাপারটা ওখানেই শেষ হলো। লোকটা উঠে বিল মিটিয়ে দিয়ে চলে গেল সেখান থেকে। আমিও আগের মতোই ফ্যানের নিচে বসে ক্যারামেল খেতে লাগলাম।
যদিও মিষ্টি ক্যারামেলটা ঠিক সেসময় বিঁষের মতো তেতো লাগছিল। গা'য়ে পড়ে আলাপ জমাতে এসে, মনমেজাজ খারাপ করে দিয়ে গেল সেই ভদ্রলোক। তারপরও তার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র কোনও ক্ষোভ নেই। তখনও ছিল না, এখনও নেই। কারণ যেসময় আমি মুম্বাইয়ে ছিলাম, সেসময় প্রায় প্রতিদিনই আন্তর্জাতিক মিডিয়ার প্রধান খবর ছিলো, বাংলাদেশের বরিশাল, পাবনা, কুড়িগ্রাম ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে প্রত্যেকদিন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজনকে বিনা কারণে একের পর এক নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে। এদের মধ্যে আছেন বেশকিছু নিরীহ ধর্মীয় মানুষজন, যেমন পুরোহিত, মন্দিরের কর্মচারী ইত্যাদি। আজকের পৃথিবীকে বলা হয়ে থাকে একটি গ্রাম, 'গ্লোবাল ভিলেজ'। কেউ আমরা আজ কারও থেকে বিচ্ছিন্ন নই। কোথায় মুম্বাই থেকে আড়াই, তিন হাজার কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের কোনও এক জেলার অজ পাড়াগাঁয়ে একজন হিন্দুকে হত্যা করা হলো। তার জবাবদিহি আজ আমাকে করতে হচ্ছে আমারও বাড়ি থেকে আড়াই তিন হাজার কিলোমিটার দূরের মানুষজনের কাছে! বাংলাদেশে হিন্দু হত্যা, সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিক্রিয়ায় তাদের মধ্যেও জন্ম নিচ্ছে ঘৃণা ও বিদ্বেষ। বিশ বছর আগে এরকমটা হতো না। হওয়া সম্ভবও ছিল না। ঢাকার কোনও খবর তৎক্ষণাৎ মুম্বাইয়ে বসে পাওয়ার কোনও সুযোগ ছিল না, স্যাটেলাইট, ইন্টারনেট আজকের মতো এতো ব্যাপক ও সহজলভ্য ছিল না। কিন্তু আজ আর তা নেই। আজ অবাধ সহজলভ্য তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে আমরা পরস্পরের খুব কাছে চলে এসেছি। সেদিন সেই হোটেলের মধ্যবয়সী ভদ্রলোকই শুধু নয়, ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাসে মুম্বাই রেলের একজন কর্মকর্তাও আমার বাংলাদেশি পরিচয় পেয়ে খুব আফসোস করেছিলেন এই বলে যে, 'প্রত্যেকদিন আপনাদের বাংলাদেশে একের পর এক নিরীহ হিন্দুকে অকারণে হত্যা করা হচ্ছে!' উনি অবশ্য চমৎকার একজন মানুষ ছিলেন। বেশ মিশুক ও হাসি খুশি। দারুণ আন্তরিক ব্যবহার করেছিলেন আমার সাথে। আর ব্যাপারটা নিয়ে তিনি প্রকৃতই বেদনাহত। শুধু জানার জন্য জিজ্ঞাসা করা নয়। তিনি ব্যাপারটা গভীরভাবে উপলব্ধি করেন ও এর সমাধান চান। আমি তাকে জানিয়েছিলাম, এসব খবর আপনাকে যেমন এখানে মর্মাহত করে, তেমনি ওখানে আমাকেও। কতিপয় জগদ্দল ধর্মোন্মাদ ঘৃণ্য নরপশুই বাংলাদেশের শেষ কথা নয়, বাংলাদেশে এমন অনেকেই আছে, যারা এইসব সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরু ভেদাভেদ নয়, মানুষ পরিচয়ে সকল মানুষকে নিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাস করে। আমি তাদের একজন। তাকে জানিয়েছিলাম আমি।
সেদিন হোটেলে ক্যারামেল খেতে খেতে লোকটার আচমকা এহেন দুর্ব্যবহারে আমি বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। এছাড়াও হোটেল খুঁজতে গিয়ে জেনেছি, মুম্বাই পুলিশ পাকিস্তানের সাথে সাথে বাংলাদেশকেও কালো তালিকাভুক্ত করেছে। এই দুই দেশের নাগরিকদের হোটেলে রাখতে হলে আলাদাভাবে একটি প্রোফাইল করে থানায় জমা দিতে হয়। এবং পরবর্তীতে পুলিশ হোটেলে এসেও সেই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে। এসব ঝামেলা নিতে চায় না সিংহভাগ হোটেল কর্তৃপক্ষ। মুম্বাইয়ে হোটেল পাওয়ার ক্ষেত্রে যে তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম, সেটা নিয়েও একটা পৃথক পোস্ট লেখার ইচ্ছা রইলো। সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বেশ কিছু স্থানে আমি আর আমার বাংলাদেশি পরিচয় দেবার সাহস পাইনি! মুম্বাইয়ের লোকাল মানে মারাঠিদের নিয়ে ইন্টারনেটে পড়েছি যে, তারা ভারতীয়দের মধ্যে স্বভাবে সবচেয়ে উগ্র, বর্ণবিদ্বেষী, আক্রমণাত্মক ধরণের ইত্যাদি ইত্যাদি। ওখানে ওরা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের সাথে উগ্র বর্ণবৈষম্য করে থাকে। এরকম বিস্তর ঘটনা জেনেছি প্রচারমাধ্যমের বদৌলতে। যদিও আমার অভিজ্ঞতা মুম্বাইয়ে মোটেও খারাপ নয়। বরং এর উল্টো। আমি স্থানীয় বেশ কিছু মারাঠি মানুষের সংস্পর্শে এসেছি যারা একেবারে মাটির মানুষ। খুবই ভালো মানুষ। তাই অকপটে বলবো, ওই মধ্যবয়সী ভদ্রলোকই মুম্বাইয়ের শেষ কথা নয়। আমি মুম্বাইয়ের আরও অনেকের সান্নিধ্য পেয়েছি, যারা অত্যন্ত সহজসরল, সাধারণ ভালো মানুষ। ঘৃণা নয়, আমি জানি মুম্বাই ভালবাসে। আমি সেইসব ভাল মানুষদের নিয়েও লিখবো। লেখা উচিতও। অবশ্যই লিখবো।
উহু আরেকদিকে চলে যাচ্ছি। যেখানে ছিলাম সেখানেই বরং ফিরে আসি। দুপুরবেলা। আনুমানিক আড়াইটা বা আরও কিছুটা বেশি বেজে থাকবে। ক্যারামেল নিয়ে বসেছি। ক্যারামেল খাবারটা অবিকল পুডিঙের মতো। দেখতে ও অনেকটা খেতেও। তবে মিষ্টি অনেকটাই বেশি। হতে পারে হয়তো পুডিংকেই ওখানে ক্যারামেল বলা হয়! প্রায় অবিকল একই রকম দুটো খাবার। ছোট পিংপং বলের সাইজের একটুকরো ক্যারামেল প্রিচের মতো ছোট প্লেটে। বসে আছি বিরস মুখে ত্রিশ রুপি দামের ক্যারামেল নিয়ে। খুব ধীরে ধীরে সময় নিয়ে খাচ্ছি। বাইরে গনগনে রোদ তখন। আমি বেশ ক্লান্ত ছিলাম। ক্যারামেল খাওয়ার থেকেও আসলে তখন আমার সেই হোটেলে বসার মূল উদ্দেশ্য ছিল ফ্যানের নিচে কিছুক্ষণ বসে জিড়িয়ে নেয়া।
আমার ঠিক সামনে সেসময় একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক বিরাট একটা ভাতের থালি নিয়ে বসেছে। কোলকাতার মতো মুম্বাইয়েও ভাত প্যাকেজ হিসেবে বিক্রি হয়। মুম্বাইয়ে এমনিতে ভাতের তেমন একটা প্রচলন নেই। অনেক হোটেলে পাওয়াও যায় না। শুধু ভালো মানের হোটেলগুলোতেই দেখেছি ভাত বিক্রি হতে প্যাকেজ বা থালি সিস্টেমে। ভেজ, ননভেজ থালি। দামও অনেক চড়া। ওই হোটেলে ভেজ থালি বোধহয় ছিল, একশো বিশ রুপি আর ননভেজ দেড়শ। খাইনি যদিও। ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করে দাম জেনেছিলাম। ওখানকার সাধারণ গরীব মানুষের জন্য এই থালি মোটেও ক্রয়সাধ্য নয়। ভাতকে ওখানে অনেকটাই অভিজাত, ধনাঢ়্য মানুষের খাবার হিসেবে দেখা হয়। আগেই বলেছি ভাতের তেমন একটা প্রচলন নেই মুম্বাইয়ে।
ভাতের থালির দাম শুনতে হয়তো খানিকটা অস্বাভাবিক শোনাচ্ছে। কিন্তু থালিগুলো দেখলে দামের ব্যাপারটা অনেকটাই সহনীয় মনে হবে। বিরাট গোলাকার একটি প্লেটে প্রায় আট থেকে দশ পদের তরকারি, চাটনি, ডাল ইত্যাদি দিয়ে পরিবেশিত হয় থালিগুলো। মাঝখানে ভাত, আর চারিদিকে একের পর এক তরকারি ছোট ছোট বাটিতে। কী নেই সেখানে! আমার সামনের ভদ্রলোক বোধহয় ভেজ থালি নিয়ে বসেছিল। দেখলাম কয়েক পদের সবজি, ডালেরও দুতিন পদ, কয়েক রকম চাটনি, সালাদ। আমার সামনে একেবারে শিশুর মতো গাপুসগুপুস করে খাচ্ছিলেন উনি। খাওয়া তখন প্রায় শেষ তার।
'আপ ক্যায়া খা রাহা হ্যায় (আপনি কি খাচ্ছেন)?' খেতে খেতে আচমকা আমাকে প্রশ্ন করে বসলেন ভদ্রলোক।
আমি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। ভাবিনি হঠাৎ আমার সাথে কথা বলবেন। মিনিট পাঁচেকের মতে দুজন একত্রে বসে আছি। আমার আগে থেকে খাচ্ছিলেন উনি।
'ইয়ে ক্যারামেল হ্যায় (এটা ক্যারামেল)।' উপস্থিত অপ্রস্তুতভাব কাটিয়ে জবাবে ভদ্রলোককে বললাম আমি।
'খানে মে কেয়সি হে (খেতে কেমন)?' জানতে চাইলেন ভদ্রলোক।
মিথ্যে বলবো না, লোকটার অমন গা'য়ে পড়ে গল্প জমানোটা মোটেও ভালো লাগছিল না আমার।
'আচ্ছি হে (ভালোই)।' ছোট করে সমাজ রক্ষার্থে জবাবে বললাম।
'আপ কাহা কা রহেনেয়ালা হো (আপনি কোথায় থেকে এসেছেন)?' অপ্রাসঙ্গিক ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে বসলেন ভদ্রলোক। বিরক্ত হলাম বেশ। ঠিক সেসময় অপরিচিত কারও সাথে এসব গল্প করার মতো প্রস্তুত ছিলাম না মানসিক ও শারীরিকভাবেও। তারপরও আমার থেকে বয়সে বেশ বড় একজন মানুষ কিছু জিজ্ঞেস করলে উপেক্ষাও তো করা যায় না।
'ম্যায় বাংলাদেশ কা রহেনেয়ালা হু (আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি)।' যথাসম্ভব হাসি হাসি মুখ করে জবাবে বললাম আমি।
আমার একথা শুনে তৎক্ষণাৎ দেখলাম ভদ্রলোকের অভিব্যক্তি সম্পূর্ণরূপে পাল্টে গেল। ভদ্রলোকসুলভ হাসি খুশিভাব সরে যেয়ে সেখানে ফুটে উঠলো ঘৃণা ও অবজ্ঞার ছায়া। তারপর কঠোর, মারমুখী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রাজ্যের ঘৃণা নিয়ে আক্রমণাত্মক ভাঙ্গিতে সে তখন আমাকে বললো, 'তুম লোগ ক্যায়া সন্ত্রাস কারনে কে লিয়ে আয়ে হো ইহা (তোমরা কি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করার জন্য এখানে এসেছ নাকি)!'
'নেহি ঘুমনে আয়া হু (না বেড়াতে এসেছি)।' বললাম আমি। যথাসম্ভব নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করলাম। একে তো গা'য়ে পড়ে গল্প শুরু করেছে। তার ওপর আবার দেশের নাম শুনে অকারণ দুর্ব্যবহার শুরু করেছে। ইচ্ছে করছিল একটা ঘুসি মেরে দাঁত ভেঙে দেই। 'যাইয়ে আপ আপনা কাম মে যাইয়ে (যান আপনি আপনার কাজে যান)।' বললাম বিরক্তির সাথে।
বয়স্ক না হলে সেদিন লোকটাকে আরও অপমান করতাম। আমি শতভাগ নিশ্চিত ছিলাম, আশেপাশের লোকজন সকলে আমার পক্ষেই কথা বলতো। মুম্বাইয়ের মানুষ অনেক ভালো, অনেক সমঝদার। আমি নিশ্চিত ছিলাম, বুঝিয়ে বললে লোকটা যতো প্রভাবশালীই হোক না কেন কেউ তার পক্ষ নিয়ে কথা বলবে না। পাশে একটা ছোট পুলিশ ফারিও আছে। মারধোর করারও প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। যদি প্রয়োজন পড়ে, তবে ছেড়ে কথা বলবো না।
তবে লোকটা আর ঘাটাল না আমাকে। বোধহয় আমার চেহারাও তখন বিশেষ সুবিধার লাগেনি তার কাছে। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আবার হিতে বিপরীত হবে ভেবে কিঞ্চিৎ ভয়ও পেয়েছিলেন হয়তো। তারপর রাজ্যের ঘৃণা, অবজ্ঞা নিয়েই উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে।
মিথ্যে বলবো না, আমি নিজে তৎক্ষণাৎ সেখানে কিছুটা ভয়ই পেয়েছিলাম এই ভেবে যে, আরও বিপদজনক কিছু আবার না করে বসে লোকটা! মানে লোকজন ডেকে এনে বাংলাদেশি বলে আমাকে আবার লাঞ্ছিত না করে বসে! হা হা হা। সত্যি তাই; সেদিন লোকটার আকস্মিক অমন উগ্র, আক্রমণাত্মক ব্যবহারে বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। যতো যাই হোক আমি মুম্বাইয়ে সম্পূর্ণরূপে একজন বিদেশী। আমার পূর্ব পুরুষদেরও কেউ কখনও মনে হয় না, মুম্বাইয়ে কোনদিন এসেছিল। বিদেশ বিঁভুইয়ে স্থানীয় মানুষজনদের প্রতি এক ধরণের বাড়তি সমীহ রয়েই যায়। এটা শুধু আমার একার নয়, সকলেরই। আমি ভাবছিলাম যে লোকটা হয়তো এখানেই ক্ষান্ত দিবে না, আরও উল্টাপাল্টা কিছু করে বসবে!
না, শেষমেশ আর কিছু হলো না, ব্যাপারটা ওখানেই শেষ হলো। লোকটা উঠে বিল মিটিয়ে দিয়ে চলে গেল সেখান থেকে। আমিও আগের মতোই ফ্যানের নিচে বসে ক্যারামেল খেতে লাগলাম।
যদিও মিষ্টি ক্যারামেলটা ঠিক সেসময় বিঁষের মতো তেতো লাগছিল। গা'য়ে পড়ে আলাপ জমাতে এসে, মনমেজাজ খারাপ করে দিয়ে গেল সেই ভদ্রলোক। তারপরও তার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র কোনও ক্ষোভ নেই। তখনও ছিল না, এখনও নেই। কারণ যেসময় আমি মুম্বাইয়ে ছিলাম, সেসময় প্রায় প্রতিদিনই আন্তর্জাতিক মিডিয়ার প্রধান খবর ছিলো, বাংলাদেশের বরিশাল, পাবনা, কুড়িগ্রাম ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে প্রত্যেকদিন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজনকে বিনা কারণে একের পর এক নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে। এদের মধ্যে আছেন বেশকিছু নিরীহ ধর্মীয় মানুষজন, যেমন পুরোহিত, মন্দিরের কর্মচারী ইত্যাদি। আজকের পৃথিবীকে বলা হয়ে থাকে একটি গ্রাম, 'গ্লোবাল ভিলেজ'। কেউ আমরা আজ কারও থেকে বিচ্ছিন্ন নই। কোথায় মুম্বাই থেকে আড়াই, তিন হাজার কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের কোনও এক জেলার অজ পাড়াগাঁয়ে একজন হিন্দুকে হত্যা করা হলো। তার জবাবদিহি আজ আমাকে করতে হচ্ছে আমারও বাড়ি থেকে আড়াই তিন হাজার কিলোমিটার দূরের মানুষজনের কাছে! বাংলাদেশে হিন্দু হত্যা, সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিক্রিয়ায় তাদের মধ্যেও জন্ম নিচ্ছে ঘৃণা ও বিদ্বেষ। বিশ বছর আগে এরকমটা হতো না। হওয়া সম্ভবও ছিল না। ঢাকার কোনও খবর তৎক্ষণাৎ মুম্বাইয়ে বসে পাওয়ার কোনও সুযোগ ছিল না, স্যাটেলাইট, ইন্টারনেট আজকের মতো এতো ব্যাপক ও সহজলভ্য ছিল না। কিন্তু আজ আর তা নেই। আজ অবাধ সহজলভ্য তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে আমরা পরস্পরের খুব কাছে চলে এসেছি। সেদিন সেই হোটেলের মধ্যবয়সী ভদ্রলোকই শুধু নয়, ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাসে মুম্বাই রেলের একজন কর্মকর্তাও আমার বাংলাদেশি পরিচয় পেয়ে খুব আফসোস করেছিলেন এই বলে যে, 'প্রত্যেকদিন আপনাদের বাংলাদেশে একের পর এক নিরীহ হিন্দুকে অকারণে হত্যা করা হচ্ছে!' উনি অবশ্য চমৎকার একজন মানুষ ছিলেন। বেশ মিশুক ও হাসি খুশি। দারুণ আন্তরিক ব্যবহার করেছিলেন আমার সাথে। আর ব্যাপারটা নিয়ে তিনি প্রকৃতই বেদনাহত। শুধু জানার জন্য জিজ্ঞাসা করা নয়। তিনি ব্যাপারটা গভীরভাবে উপলব্ধি করেন ও এর সমাধান চান। আমি তাকে জানিয়েছিলাম, এসব খবর আপনাকে যেমন এখানে মর্মাহত করে, তেমনি ওখানে আমাকেও। কতিপয় জগদ্দল ধর্মোন্মাদ ঘৃণ্য নরপশুই বাংলাদেশের শেষ কথা নয়, বাংলাদেশে এমন অনেকেই আছে, যারা এইসব সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরু ভেদাভেদ নয়, মানুষ পরিচয়ে সকল মানুষকে নিয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাস করে। আমি তাদের একজন। তাকে জানিয়েছিলাম আমি।
সেদিন হোটেলে ক্যারামেল খেতে খেতে লোকটার আচমকা এহেন দুর্ব্যবহারে আমি বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। এছাড়াও হোটেল খুঁজতে গিয়ে জেনেছি, মুম্বাই পুলিশ পাকিস্তানের সাথে সাথে বাংলাদেশকেও কালো তালিকাভুক্ত করেছে। এই দুই দেশের নাগরিকদের হোটেলে রাখতে হলে আলাদাভাবে একটি প্রোফাইল করে থানায় জমা দিতে হয়। এবং পরবর্তীতে পুলিশ হোটেলে এসেও সেই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে। এসব ঝামেলা নিতে চায় না সিংহভাগ হোটেল কর্তৃপক্ষ। মুম্বাইয়ে হোটেল পাওয়ার ক্ষেত্রে যে তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম, সেটা নিয়েও একটা পৃথক পোস্ট লেখার ইচ্ছা রইলো। সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বেশ কিছু স্থানে আমি আর আমার বাংলাদেশি পরিচয় দেবার সাহস পাইনি! মুম্বাইয়ের লোকাল মানে মারাঠিদের নিয়ে ইন্টারনেটে পড়েছি যে, তারা ভারতীয়দের মধ্যে স্বভাবে সবচেয়ে উগ্র, বর্ণবিদ্বেষী, আক্রমণাত্মক ধরণের ইত্যাদি ইত্যাদি। ওখানে ওরা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের সাথে উগ্র বর্ণবৈষম্য করে থাকে। এরকম বিস্তর ঘটনা জেনেছি প্রচারমাধ্যমের বদৌলতে। যদিও আমার অভিজ্ঞতা মুম্বাইয়ে মোটেও খারাপ নয়। বরং এর উল্টো। আমি স্থানীয় বেশ কিছু মারাঠি মানুষের সংস্পর্শে এসেছি যারা একেবারে মাটির মানুষ। খুবই ভালো মানুষ। তাই অকপটে বলবো, ওই মধ্যবয়সী ভদ্রলোকই মুম্বাইয়ের শেষ কথা নয়। আমি মুম্বাইয়ের আরও অনেকের সান্নিধ্য পেয়েছি, যারা অত্যন্ত সহজসরল, সাধারণ ভালো মানুষ। ঘৃণা নয়, আমি জানি মুম্বাই ভালবাসে। আমি সেইসব ভাল মানুষদের নিয়েও লিখবো। লেখা উচিতও। অবশ্যই লিখবো।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মোহন দাস (বিষাক্ত কবি) ১১/০৩/২০২০ভালো ।
-
কামরুজ্জামান সাদ ২৭/০৭/২০১৭আর্টিকেলটা ভাল লাগলো।