ক্লেশ
নির্জন পথ। সমস্ত পথ জুড়ে নিটন একা। জনশুন্য পথ। চৈত্রের এই প্রখর রোদে রাস্তাতে কারো না থাকার-ই কথা। ঘামে সমস্থ শরীর ভিজে একাকার হয়ে গেছে। খালাতো ভাই মিঠু, রুম থেকে গুটি গুটি পায়ে এগুচ্ছে বাড়ীর দিকে। হঠাৎ একটা মেয়েলি কন্ঠ ভেসে আসে। নিটন ভাই। ডাকটা ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে একটু কড়া। থমকে দাড়ায় নিটন। মনের গভীর থেকে প্রশ্ন, কে এই নির্জন পথে আমাকে ডাকছে? ভীষন আগ্রহে পিছন ঘুরে তাকায়। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না মেয়েটিকে। কেননা যেখানটাতে দাড়িয়ে নিটন, মেয়েটি সেখান থেকে বেশ কিছুটা দূরে। মিলার মত দেখাচ্ছে। পাশে ছোট একটা ছেলে। হাত উঠিয়ে সাদা রংয়ের কি যেন একটা দেখালো। সেটা ছেলেটাকে দিয়ে ইশারায় বললো নিতে। ছেলেটা কাছাকাছি আসতেই নিটন আবারও চমকে ওঠে। খুব সুন্দর সাদা কগজ দিয়ে তৈরী একটা চিঠির খাম। খামটা নিয়ে সরাসরি রুমে চলে আসতেই মনে ভাবনার রোল চলছে। কি আছে এর মধ্যে? চিঠি ! কিন্তু কি লেখা চিঠিতে? এসে প্যান্ট-শার্ট না ছেড়েই খামটা খুলল। আশ্চর্য ! অদ্ভুত রংয়ের সাজানো একটা কাগজ। ভারি অবাক লাগছে, কাগজ রং দিয়ে এত সুন্দর করে সাজানো সম্ভব! গোটা গোটা লেখা ¬¬¬দু/তিনটি লাইন,
কেমন আছ? জানার অধিকার নেই। তাই অধিকারটা নিতে চাই।
ভালোবাসি-তোমাকে, ভালোবাসি। আজ এটুকুই।
চিঠিটা বুকে চেঁপে ধরে আনন্দ ভূবনে শুয়ে আছে নিটন। জীবনের সব আনন্দই আজ যেন ওর হৃদয়ে। আজ এখনও খাওয়া-গোসল কিছুই হয়নি ওর। টেবিল ঘরির দিকে দৃষ্টি যেতেই চমকে উঠে। পাঁচটা বেজেছে। যাবতীয় কাজ সেরে বেড়িয়ে পড়ল বন্ধুদের সাথে। নিটনদের প্রতিদিনের আড্ডা মিলাদের এলাকায়। ওরা সবাই খুশি মনে হাঁটছে। কিন্তু নিটনের খুশিটা অন্যরকম। সে মনে মনে ভাবছে আজ মিলাকে দেখতে পাবে কিনা। মিলা নীল শাড়ীতে নিজের সমস্ত শরীরটাকে আকাশের নীল এর সাথে বেঁধে বসে আছে। নিটন থেমে যায়। মিলার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নিটনের বন্ধুরা যার যার মনে হাটছে। তারা কেউ জানেনা নিটন আজ কোন ভূবনে আছে। ওর মনে আজ কোন আনন্দ খেলা করছে। বুন্ধুরা পিছন দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো, নিটন পলক বিহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিলার দিকে। বন্ধুদের ডাক। চমকে উঠে নিটন।
নিটন! কি দেখছিস ?
নাহ্ কিছু না।
তবে ওভাবে দাড়িয়ে আছিস কেন ? কি হয়েছে?
না, কিছু হয় নি।
কিছু হয়নি, তবে মুর্তির মত দাড়িয়ে আছিস কেন? চল ওখানে বসি।
যেখানে ওরা বসে সেখান থেকে মিলাদের বাড়ীর পিছনের খোলা দিকটা ষ্পষ্ট দেখা যায়।
চারিদিকে খোলা মাঠ। মিষ্টি বাতাস, বিকেলের পরন্ত রোদ। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা খেলা করছে। সব মিলেয়ে সুন্দর একটা পরিবেশ তৈরী হয়েছে। আনন্দের নীলিমা নিটনের চোখে মুখে। নিটনের চোখ দুটো এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছে মিলার খোঁজে। মিলাদের ছাদের দিকে চোখ যেতেই মিলাকে দেখতে পেল। নীল রংয়ের শাড়ী গায়ে জড়িয়ে ছাদের রেলিং ঘেষে নিটনের দিকে তাকিয়ে আছে।
সূর্য্য তার দিনের দায়িত্বটা সেরে প্রতিদিনের মত আজও বিদায় নিল পশ্চিমাকাশে।
ফোনের মিউজিকে ঘুম ভাঙ্গল নিটনের । রিসিভারটা কানে ধরতেই মিষ্টি একটা কণ্ঠ-
হ্যালো।
ঘুম ভেঙ্গিয়ে বিরক্ত করলাম। শুভ সকাল।
কোকিল গুন্জন এই ভোরে কে ফোন করেছে তা নিটনের বোঝা হয়ে গেছে। তারপরও নিটন জানতে চাইল-
প্লিজ, কে বলছিলেন ?
আমি মিলা।
নিটন আনন্দে বাক হারা হয়ে বসে আছে।
কি হলো কথা বলছেন না কেন ?
স্বপ্ন দেখছি।
জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছেন!
হ্যাঁ।
মানুষ জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে?
জানিনা, আমি দেখি।
কি দেখছেন ?
তোমাকে দেখছি।
আমাকে [ মন ভোলানো হাসি মিলার ]
হাসছ কেন?
আপনার কথা শুনে।
এই সকালে ফোন কেন?
ভালোবাসি বলে। রাখি কলেজে দেখা হবে।
রিসিভারটা রাখার শব্দে নিটনের মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল।
মাহাবুব স্যারের ক্লাস। বাংলার টিচার। বাংলা ক্লাসটা তিনি খুব সুন্দর করে নেন। অন্যান্য ক্লাশে ছাত্র-ছাত্রী উপস্থিত না থাকলেও মাহাবুব স্যারের ক্লাসে উপস্থিত থাকে। হাসি-ঠাট্টা তার ক্লাসে একটা অংশ। সে সকলের কাছ থেকে বুদ্ধির মাধ্যমে পড়া আদায় করে নেন। নিটনের প্রিয় টিচার হলেন মাহাবুব স্যার। মাহাবুব স্যারের ক্লাস নিটনের করা চাই প্রতিদিন। ক্লাসে নিটন প্রতিদিন একই জায়গাতেই বসে। আজও বসেছে। স্যার ক্লাসে উপস্থিত হলেন-
আস্সালামু আলাইকুম স্যার।
ওয়ালাইকুম আস্সালাম, বাছারা।
মাহাবুব স্যারের আবার একটা মুদ্রা দোষ আছে। সে প্রতি কথার মাঝে ‘‘ বাছারা” শব্দটা ব্যবহার করেন। ক্লাসে আজ মন বসছেনা নিটনের। মনের মধ্যে একটা উরু উরু ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। মাহাবুব স্যারের চোখ পড়ল নিটনের উপর-
নিটন, নিটন-
জ্বি স্যার
তুমি কি কোন স্বপ্ন রাজ্যে বাস করছ এই মূহুর্তে বাছা।
জ্বিনা স্যার
তবে তোমাকে অন্য মনস্ক লাগছে কেন। ক্লাসে তোমার মন নেই কেন?
স্যারের চোখের কাছে ধরা পড়েগেছে নিটন। বাঁচার কোন উপায় নেই। তারপরও সে জানে তাকে স্যারের প্রশ্নের জবাব দিতেই হবে। কিন্তু সে স্যারের প্রশ্নের জবাব দিতে পারছে না। সে একটা দ্বিধার মধ্যে পড়ে গেছে। কি আর করার প্রশ্নের জবাব তো তাকে দিতেই হবে।
জ্বি না স্যার। আমার মন ক্লাসেই আছ এবং আমি অন্যমনস্কও নই।
তুমি কিছু একটা ভাবছ সেটা তোমার চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বাছা। সম্ভাবত তুমি নতুন প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছ।
স্যারের কথায় ক্লাসের সবাই নিটনের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল। লজ্জায় নিটনে চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। সে আর কিছু বলতে পারলো না। ঝিম মেরে দাড়িয়ে রইল। ক্লাস শেষে হওয়ার ওয়ার্নিং দিল পিয়ন। নিটন আজ একা একাই হাটছে। মিলার সাথে দেখা করবে বলে সে একা একাই হাটছে। নিটনদের কলেজের চারপাশের পরিবেশটা চমৎকার সুন্দর। সুন্দর দুটি সাজানো ফুলের বাগান। একটি খেলার মাঠ। মাঠের অপর দিকে ঘাট বাঁধানো পুকুর। পুকুরের মাঝে লাল, সাদা-নীল পদ্মের মেলা। নিটন পুকুর ঘাটে এসে বসল। পদ্মের মেলা তার দু'চোখে প্রেম ভাবনার বিস্তার ঘটালো। গভীর ভাবনায় সে যখন ডুবে গেল ঠিক তখনই মিলা নিটনের কাঁধে হাত রাখল। নিটন চমকে উঠল। নিটন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিলার দিকে-
কি দেখছ ?
নীল পদ্মটাকে ।
সে তো পুকুরের মাঝে। আমার দিকে নয়।
না, সে আমার পাশেই বসে আছে। নীল পোশাকে জড়িয়েছ তোমার ঐ সুন্দর দেহটাকে। তাইতো তুমি একটি নীল পদ্ম আমার চোখে।
খুব সুন্দর করে কথা বল। আর এ ভাবে তাকিয়ে আছো কেন? কি দেখছ?
তোমাকে, তোমাকে দেখছি।
আমাকে-
হ্যাঁ, তোমাকে।
কেন?
ভালোলাগে এবং ভালবাসি বলে। মিলা আমি তোমাকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসি।
আমিও তোমাকে ভালোবেসেছি অন্তর দিয়ে। তাইতো ছুটে এসেছি তোমার কাছে। রেখেছি হাত তোমার হাতে। নিটন তোমার এ হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখো সারাটি জীবন। ছেড়ে যেওনা আমাকে কভূ। কথা দাও, কথা দাও।
কথা দিলাম। মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত জড়িয়ে রাখবো তোমাকে আমার বুকে।
নিরাবতায় বসে আছে। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল। কারো মুখেই কোন কথা নেই। দু’জনেই মনে মনে ভালোবাসার রঙ্গিন কাগজে ভালোবাসার ছবি আঁকছে। রোদের আলো গাছের ফাঁকা দিয়ে এসে মিলার চোখে পড়াতেই মিলা ঘুরে বসলো নিটনের দিকে। মিলা আল্ত করে নিটনের হাতে হাত রাখল। নরম কোমল হাতের ছোঁয়াতে নিটন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলো। মনোরম একটা পরিবেশে মিলা যখন নিটনের হাত ধরল খুব সুন্দর একটা অনুভূতি বিরাজ করল নিটনের মনে। মূহুর্তেই ভালোবাসার রঙ্গিন জগতে হারিয়ে গেল-নিটন।
নিটন-
হুঁ, বল।
নিজের অজান্তে তোমাকে ভালোবেসেছি। কখন যে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি নিজেও জানিনা। নিটন তোমাকে একটা প্রশ্ন করি।
কি প্রশ্ন ?
তুমি কি এভাবে ভালোবেসে আগলে রাখবে তোমার হৃদয়ের মাঝে আমাকে।
হাসছ কেন ?
তোমার কথা শুনে।
আহ্ বলনা ।
যদি বলি না এভাবে ধরে রাখব না তোমাকে। তোমাকে কিছুদিন পরে ভুলে যাব এবং অন্য আর একজনকে ভালোবাসব। তাহলে কি হবে।
মরে যাব।
কেন মরে যাবে?
কারন এই প্রথম যে কাউকে ভালোবেসেছি। আর সেই যদি ভুলে যায় কিংবা দুঃখ দেয় তবে বেঁচে থাকব কিভাবে।
তাই-।
হ্যাঁ তাই।
তুমি এতটা ভালোবাস আমায়।
হ্যাঁ, তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি। আমার জীবনের চেয়েও বেশী ভালোবাসি।
আচ্ছা যদি বলি সারাটি জীবন তোমাকে আমার বুকের মাঝে রাখব।
আনন্দে মাথা রাখব তোমার বুকে।
তাই-
হ্যাঁ তাই।
মিলা, এই প্রথম যে আমিও তোমাকেই ভালোবেসেছি। তোমাকে বসিয়েছি আমার হৃদয়ের কোঠরে। বিধাতা যদি তোমাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় আমার কাছ থেকে তাহলেও তুমি থাকবে আমার এই হৃদয়ের কোঠরেই।
মিলা বাচ্ছা শিশুর মত লুটিয়ে পড়ল নিটনের বুকে। কিছুক্ষন শক্ত করে ধরে রাখল নিটনকে। বুক থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে নিটনের চোখের দিকে ভালোবাসার রঙ্গিন চোখ দিয়ে তাকিয়ে রইল। মিলার চোখ ভরা ভালোবাসায় নিটন হারিয়ে গেল প্রেম সাগরে। ভালোবাসায় যে কতটা সুখ তা নিটন উপলদ্ধি করে নি। আজ সে তা উপলদ্ধি করল। নিরাবতায় দুজনে আবার।
মিলা তোমাকে একটা কবিতা বলি, মনোযোগ দিয়ে শুনো-
হ্যাঁ বল-
আমার ভালোবাসার প্রিয় ফুল,
করিনু অর্পন,
তোমার স্নেহের অপূর্ব হাতে।
যতন করিও তাকে,
তোমার সুন্দর কোমল হাতে।
দেখিও তাকে,
তোমার অপূর্ব মায়াবী চোখে।
রাখিও তাকে,
তোমার স্নেহময়ী আচল তলে।
আমার ভালোবাসার প্রিয় ফুল,
করিনু অর্পন,
তোমার স্নেহের অপূর্ব হাতে।
ভালোবেস তাকে,
তোমার মমতাময়ী হৃদয় দিয়ে ॥
শুনেছ-
হ্যাঁ! শুনেছি।
কিছু বুঝলে এ থেকে।
ঠিক বুঝতে পারলাম না।
বুঝতে পারনি, শোন তবে- কবি তাঁর প্রিয় ফুল বলেছেন, তাঁর সন্তানকে। আর আমি বুঝিয়েছি আমার হৃদয়কে। আর তাই তোমার কাছে চাওয়া-তুমি কখনো আমার এ হৃদয়কে ব্যাথা দিও না।
নিটন, আমার ভালোবাসার উপর বিশ্বাস রাখ। তোমাকে আমার ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে রাখব। আর তুমিও আমাকে ব্যাথা দিওনা।
মিলা ঘড়ির দিকে তাকিয়েই উঠে দাড়ালো। মনে মনে বলল বারোটা বেজে গেছে।
কি হলো ? উঠে দাড়ালে যে।
আজ চলো।
কেন, আর একটু বসি।
না-আর বসা সম্ভব হবে না।
কিন্তু তোমাকে ছাড়তে যে ইচ্ছে করছে না।
আমারও তোমাকে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু তারপরও যে যেতে হবে।
আচ্ছা কেন আমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না।
কারন তুমি একটা আঠা। আঠা দিয়ে যে ভাবে কাগজ লাগায় তেমনি তুমিও আমাকে তোমার সাথে লাগিয়েছ। কটা বাজে দেখেছ।
দেখেছি । একটা ত্রিশ।
দু’টায় ক্লাস শেষ। মা নিতে আসবেন।
এত বড় মেয়েকে এখনও মা নিতে আসেন।
হ্যাঁ নিতে আসেন।
কেন তোমার মার ধারনা তার রুপসী কন্যাকে কেউ কিড্নাফ করবে।
জ্বি না ।
তবে কি ?
মা আমাকে খুব বেশী ভালোবাসেন।
যাও । আবার দেখা হবে কবে।
কেন তোমার সাথেতো প্রতিদিনই দেখা হবে।
আমি এভাবে দেখা হবার কথা বলিনি।
তবে--! কোন ভাবে ?
আমরা অন্য কোথাও বেড়াতে যাব।
অন্য কোথাও !
হ্যাঁ । পনের তারিখে কলেজে একটা অনুষ্ঠান আছে। তা কি জান?
হ্যাঁ-জানি।
ঐ দিনই বেড়াতে যাব।
আচ্ছা ঠিক আছে।
ভোরের সোনালী রোদের মিষ্টি রশ্মি জানালার কাঁচ ভেদ করে মিলার আঁদো ঘুম চোখে পড়ল। মিলাকে ঘুম থেকে ওঠার জন্যে। চোখ মেলে ঘড়ির দিকে তাকালো। ৭টা বাজে। ভোরের মিষ্টি রোদের একটু ছোয়া পেতে বিছানায় একটু গড়াগড়ি খেয়ে উঠে পড়ল। সিড়ি বেয়ে ছাদে আসলো।মায়ের ডাকে সাড়া দিতে নেমে এল মিলা।
টেবিলে নাস্তা দেয়া হয়েছে, খেতে আয়।
আসছি মা।
আজ শুক্রবার। তাই প্রতিদিনের থেকে একটু আলাদা ধরনের নাস্তা তৈরী করা হয়েছে। অবশ্য এ নাস্তাটা মিলার সবচেয়ে প্রিয়।
মিলা
জ্বি-মা, কিছু বলবে ?
হ্যাঁ আমি বাড়িতে যাব। তোমাকে দু-তিন দিন একা থাকতে হবে। পারবে না।
পারব। কিন্তু কেন যাবে, আসবে কবে ?
দু-তিন দিন পরেরই আসব। খবর পেলাম তোমার নানু অসুস্থ, তাকে দেখতে যাব।
আবুল একটা ট্যাক্সি নিয়ে আয়।
জ্বি যাচ্ছি।
মিলা, মাকে এগিয়ে দিতে বাড়ির গেটের কাছে এল। মাকে ট্যাক্সিতে তুলে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। যদিও দীর্ঘশ্বাসটা ছিল আনন্দের। মিলা ঘরে প্রবেশ করেই রিসিভারটা তুলে নিল নিটনকে রিং দেবার জন্য।রিসিভারটা তুলতেই মিষ্টি একটা কন্ঠ নিটনের মনের গভীরে সুখের পরশ বুলিয়ে দিল।
কেমন আছ ?
প্রভাতে তোমার ফোন, ভালো না থেকে কি আর পারি।এখন ফোন করেছ কেন ?
কেন তোমার কাছে ফোন করতে সময় লাগবে নাকি ?
ঠিক তা নয়----।
তবে কি ?
এত সকালেতো তুমি আমাকে রিং দাওনা, তাই।
ও একথা। আজ দিলাম, তোমাকে একটা সু-সংবাদ দিব বলে।
কি এমন সু-সংবাদ যা এই সকালে দিতে হবে।
মা আজ বাড়ী গেছেন।
এটা কোন সু-সংবাদ হলো।
হ্যাঁ , হয়েছে। কারন আজ ঘুরতে যাব।
আজ কেন ?
আমার মন আজ যেতে চাচ্ছে।
ঠিক আছে। কখন এবং কোথায় আসবে।
কেন তুমিই তো বলেছ আমাকে নিয়ে সুন্দর একটা জায়গায় যাবে।
আজ সেখানে যাব না। আজ অন্য কোথাও যাব।
মিলা ফোন রেখে নিজের ঘরে যেতে যেতে কাজের বুয়াকে গোসলের পানি দিতে বলল। মিলা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল ঠিক করতে লাগল। মনে মনে ভাবতে লাগল তার জীবনের সব কথা গুলো নিটনকে বলবে। কিন্তু তার মনের মধ্যে একটা ভয় কাজ করছে। তারপরও মনে মনে ঠিক করে রাখল জীবনের সব কথা গুলো নিটনকে বলবে। মিলা একা একা দাড়িয়ে আছে। দু’টা দশ। নিটন এখনও আসছে না। যত লোক বেড়াতে আসছে ধানমন্ডি লেকে তারা প্রায় সবাই একবার তাকাচ্ছে মিলার দিকে। মিলার খুব অসস্থিকর লাগছে। রাগে সমস্ত শরীর পুরে যাচ্ছে মিলার। মনে মনে বলতে লাগল আমাকে কি খুব বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে। না কি আমি একটা চিড়িয়াখানার পশু। কেন লোকজন এভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছে ? মিলার চোখ পড়ল রাস্তার বিপরীত পার্শ্বে দাড়ানো একটা লোকের উপর।লোকটা কালো, মোটা, চোখ দু'টো বড় বড়। রাক্ষুসে দু'টো চোখে তাকিয়ে আছে লোকটা। আশ্চর্য, লোকটা এভাবে তাকিয়ে আছে কেন ? একটাও পলক দিচ্ছে না চোখে। মনে হচ্ছে এখনি খেয়ে ফেলবে আমাকে। নিটন তুমি কোথায়, চলে এস এখনি। এসে উদ্ধার কর আমায়, তানা হলে তোমার প্রিয়াকে ও খেয়ে ফেলবে।
একটা রিক্সা এসে দাড়ালো মিলার সামনে। রিক্সায় নিটন কে দেখে মিলার মনে একটু সস্তি এবং সাহস এল। মিলা ফিরে পেল তার চলার শক্তি। তবে ভয়টা তার চোখ-মুখ থেকে বিদায় নিচ্ছে না। তার মধ্যেও যে অভিমানটা কাজ করছে নিটনের উপর তাকেও সামাল দিতে পারছে না। নিটন রিক্সা বিদায় দিয়ে মিলাকে নিয়ে লেকের পাশ ধরে হাটছে। দু’জনের কারো মুখেই কোন কথা নেই। নিশ্চুপ ভাবেই হাটতে লাগল তারা। মিলার হাত ধরল নিটন।দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল মিলা। নিটনের দিকে তাকাতেই অভিমানের সব কথা ভুলে গেল মিলা। কিছুই বলতে পারল না তাকে। ভালোবাসার মানুষকে কাছে পেলে সব কিছুই ভুলে যায়, এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। আর সেটাই ঘটেছে মিলার বেলাতেও।
মিলা, চল ওখানটাতে বসি।
নিটন- ভালোবাসার রং কি ?
জানিনা, তুমি বল।
নীল।
নীল ! নীল কেন ? অন্য কোন রং হতে পারে না।
না, পারে না। কেননা বিষের রং নীল।
বিষের রং নীল তাতে ভালোবাসার রং নীল হবে কেন ?
এজন্যেই হবে যে, মানুষকে যখন কোন বিষাক্ত প্রানী ধ্বংশন করে তখন তার সমস্ত শরীর বিষে নীল হয়ে যায়।
হু, বুঝতে পেরেছি। তা বিশ্লেষনী নারী হঠাৎ এ ধরনের প্রশ্ন আপনার মনে জাগল কেন ?
এ কারনেই জেগেছে যে, আজ আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন একটা কথা তোমাকে জানাব। সেটা জনা তোমার খুবই প্রয়োজন এবং আমার তোমাকে বলাটাও খুবই প্রয়োজন। আর তাই এধরনের প্রশ্ন করা।
তোমার জীবনের এমন কি কথা যেটা বলার প্রথমে এ ধরনের প্রশ্নটা করতে হলো।
কথা গুলো জানার পরে যদি তুমি আমাকে ভুলে যাও, তাহলে ভালোবাসার বেদনার বিষে আমার সমস্ত শরীর নীল হয়ে থাকবে সারা জীবন।
তাহলে কথা গুলো না বললেই তো হয়।
না-বলাই ভালো -
আমি খুব সাধারন মধ্যবৃত্ত ঘরের মেয়ে। তুমি যাকে আমার মা হিসাবে জান সে আমার সত্যি কারের মা নয়। আমি তার পাল্লক মেয়ে।
কি বলছ তুমি ?
হ্যাঁ, যা সত্যি তাই বলছি।
তাহলে তোমার মা--!
আমার মা উনি পাগল। আমি যখন আমার মায়ের গর্ভে, তখন আমার বাবা মাকে রেখে চলে যান। মানে উনি অন্য মহিলাকে বিয়ে করেছেন। তারপর থেকেই আমার মা মেন্টালী অসুস্থ হয়ে পরেন। সে অবস্থায় আমার জন্ম হয় হাসপাতালের বারান্দায়। সেখান থেকে আমাকে নিয়ে আসেন আমার মা (এই ভদ্র মহিলা, যার কৃপায় আমি বেঁচে আছি) øেহ, মায়া-মমতা দিয়ে আমাকে বড় করেছেন। কখনই বুঝতে দেননি মায়ের অভাব, বাবার অনুপস্থিতিতা।
কান্না ধরে রাখতে না পেরে মিলা বাচ্চা মেয়ের মত কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। নিটন তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল-
মিলা আমি তোমার অতীতকে ভালোবাসিনি, তোমার বর্তমান এবং ভবিষ্যতকেও না, আমি ভালোবাসি তোমাকে শুধু তোমাকে।
নিটন তুমি আমাকে কখনো ভুলে যেওনা, ফেলে দিওনা তোমার বুক থেকে। এভাবে রেখ সারা জীবন।
তোমাকে আমার বুকের মাঝে রাখব যতদিন এই পৃথিবীতে বেঁচে আছি। মিলা তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?
কি--
আচ্ছা তোমার মা এখন কোথায় ?
মা- মা আমাকে রেখে অনেক দূরে গেছেন। যেখানে গেলে কেউ আর কখনো ফিরে আসতে পারে না। জান আমি বড় একটা ব্যাথা বুকে নিয়ে এই পৃথিবীতে বাস করছি।আমার চেয়ে দুঃখি এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই। যখন এই পৃথিবীতে পা রাখলাম তখনই মা বিদায় নিলেন পৃথিবী থেকে।
তোমার বাবা-মায়ের এই কথা গুলো তুমি জানলে কি করে?
যাকে এখন আমি মা বলে জানি। তার ডায়রীর পাতা থেকে।
ওটাতো অন্য কারও হতে পারে।
না ওটা আমার। কেননা ওখানে আমার নাম উল্লেখ করা আছে। আর তাছাড়া লেখাটা পড়ার পড়ে আমি মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। আমাকে বলেছেন তিনি। যাই হোক চল, আজ আর বসব না।
দু’জনে পাশাপাশি হাটতে লাগল। নিটন মিলার হাত চেপে ধরল আর বলল-
ওটা তোমার জীবনের একটা দুর্ঘটনা। এজন্যে আমি তোমাকে কোন দোষ দেই না। মানুষের জীবনে অনেক ধরনের ঘটনা ঘটে। তাই বলে আমি তোমাকে ছেড়ে যাব, না তা নয়। তুমি যেনে রাখ আমি তোমাকে ভালোবাসি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।
চয়ন নীলিমার দিকে গম্ভির চোখে তাকিয়ে বলল- আমি তোমাকে ভালোবাসিনা।
কেন চয়ন ! তুমি আমাকে ভালোবাসনা।
মন চায়না তাই।
মন চায়না ! কেন মন চায় না ? আমার কি রূপ-যৌবন, নাকি আমার বাবার অর্থ সম্পদ নেই।
না, তা ঠিক না। তোমাদের সবই আছে।
তবে আমাকে ভালোবাসতে দোষ কোথায়?
দোষ একটাই ।
দোষটা কোথায় বলো।
শুনতে চাও দোষটা কোথায়-
হ্যাঁ আমি শুনতে চাই।
তবে শোন- এ কারনেই আমি ভালোবাসতে পারি না তোমাকে, ভালোবাসার যে কত মূল্য তা আমার মত সাধারন পরিবারের ছেলেদের পক্ষে দেয় সম্ভব না।
কেন দিতে পারনা ।তোমার কি মন বলতে কিছু নেই ?
মন থাকলেও আজ আর ভালোবাসা হয় না।
কেন হয় না ?
ভালোবাসা আজ খেলা ঘর তাই।
মিথ্যে। ভালোবাসা আজও বেঁচে আছে। সে খেলা ঘর নয়।
হ্যাঁ বেঁচে আছে। কিন্তু তা টাকা ওয়ালাদের জন্য। আমাদের জন্য নয়।
চয়ন আর সব লোকদের মাঝে আমাকে দেখনা। আমি তোমাকে ভালোবাসি আর তোমাকে ভালোবাসা দেব।
ভালোবাসা দিতে চাইলেই কি গ্রহন করা যায়।
তুমি এমন করছ কেন?
আমি করছি না, বর্তমান সমাজ করছে।
তুমি বর্তমান সমাজের প্রতি এত দূর্বল কেন ?
না শুনে তুমি ছাড়বে না ?
আমাকে শুনতেই হবে।
শোন- আজ-কালকার মেয়েরা শুধু একজনের সাথে প্রেম করে না। সর্ব নিু চার জনের সাথে প্রেম করে। তারপর এই চার জনের মধ্যে যার জীবনে উজ্জ্বল প্রদীপ জ্বলতে থাকে তার সাথে ঐ সুন্দরী রমনী সুখের স্বর্গে হারিয়ে যায়। আর ঐ পুরুষ গুলো হয় সমাজ বিরোধী। আর এই প্রেম আমি করিনা। এটা নিয়ে তুমি ভাবতে পার আমি পারিনা।
তোমার লেকচার শেষ।
হ্যাঁ-তবে লেকচার নয় এটাই বস্তব কথা এবং সত্যি।
চয়ন, তোমাকে আগেই বলেছি অন্যান্য মেয়েদের সাথে আমাকে তুলনা করো না।
কেন করব না। তোমার গ্রান্টি কি ?
আমার গ্রান্টি আমার ভালোবাসা।
তোমার ভালোবাসা !
হ্যাঁ। তুমি একবার বলো তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমাকে হাজার সিকুরিটি দিব। তোমাকে কোন দিন ভুলবো না। তোমার হয়েই থাকব সারা জীবন। আর যদি তা না হয় তবে এই সুন্দর পৃথিবী থেকে চলে যাব।
কিন্তু আজ ভালোবেসে যে সুখ তুমি আমাকে দিবে সে সুখ কি আমাকে তুমি চিরদিন দেবে নীলিমা।
হ্যাঁ চয়ন তোমাকে সারাটি জীবন আমার সব ভালোবাসা দিব।
সত্যি বলছ নীলিমা।
হ্যাঁ সত্যি বলছি। আর আজ থেকে আমি তোমাকে ভালোবাসি। চয়ন তুমি আমাকে ভালোবাস।
হ্যাঁ- তোমাকে ভালোবাসি। তবে তুমি কোনদিন আমাকে দু:খ দিওনা।
নীলিমা আনন্দে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাগানে চয়নকে জড়িয়ে ধরে ঘাসের উপরে জড়াজড়ি করার পরে চয়নের গালে-মুখে চুমুতে চুমুতে প্রেমের নেশায় ভরে তুলল। সহসা চয়ন নীলিমাকে বুকের সাথে দু’হাত দিয়ে চেপে ধরল।
চয়ন আজ তুমি আমাকে ভালোবাসা দিয়ে অনেক দিনের সাধনার ফল দিয়েছ। তাতে পেয়েছি অনেক সুখের সন্ধান। যা আমি কোনদিন ভুলতে পারব না।
ওদের কথার ফাঁকে ক্লাসের কয়েক জন বন্ধু এসে মৃদু হেঁসে বলল-
এই দেখ দেখ ওরা নতুন প্রেম জমিয়েছে।
মিলা, তোরা বুঝি প্রেম-ভালোবাসা জমাস না।
হ্যাঁ জমাই।
তবে আমাদের বেলায় দোষটা কোথায়।
দোষটা কোথাও না। রাগ করিস না বন্ধু। চল আমরা সবাই মিলে একটু বানিজ্য মেলায় আড্ডা দিয়ে আসি।
তা মন্দ বলনি। চলো চয়ন ঘুরে আসি।
চয়ন একনজর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বানিজ্য মেলায় ঘুরতে গেল। ধানমন্ডি লেকের কিনারায় বেশ কয়েক জন এক অনন্ত সুখের হাস্য-রহস্য গল্পে মেতে উঠেছে। বেশ ভালোই লাগছে। বহুদিন পর মনভোলানো সবাইকে ভালোবেসে যাওয়া দক্ষিনা হাওয়া কোথা থেকে যেন এসে অমৃত স্বাদ সবাইকে দিয়ে গেল। আর তাই এই ভালোলাগার মাঝে নীলিমার ইচ্ছা জাগলো চয়নকে তার বাড়ীতে নিয়ে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার।
চয়ন তোমাকে আমার সাথে একটা জায়গায় যেতে হবে।
কোথায় ! কোথায় নিয়ে যাবে ?
যেখানে ইচ্ছা। তুমি যাবেনা আমার সাথে।
যাবনা কেন, তবে তোমার মাথা ঠিক আছেতো।
নীলিমা বলার আগেই মিলা বলল-
নতুন প্রেমে পড়লে কারো মাথা কি ঠিক থাকে।
সবাই হা-হা করে হেসে উঠল। আর ওমনি নীলিমা বলল-
এই মিলা, আমার ভালোবাসা নিয়ে তোরা কিন্তু বেশী কথা বলছিস। আর যদি কখনো রসিকতা করিস তাহলে কিন্তু-------
কি হলো, তাহলে কি করবি ?
তাহলে--- মানে, তাহলে তোদের সবাইকে আমাদের বিয়ের দাওয়াত খেতে হবে।
এ কথায় সবাই আরো আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ল। নীলিমা চয়নের হাত ধরে উঠে পড়ল।
চয়ন চলো আমরা যাই।
নিটন ফট করে বলল-
আরে তোরা কোথায় যাচ্ছিস। এখনই কি বিয়ের কাজ সেরে ফেলবি।
আরে বোকা না। অন্য একটা কাজে যাচ্ছি।
কাজে যাও আর যাই কর আমাদের না বলে কিন্তু তোরা বিয়ের পিড়িতে বসিস না।
ঠিক আছে, তোদের না জানিয়ে কিছুই করব না।
লেক থেকে বের হয়ে রিক্সা নিয়ে পান্থ পথ মোড়ে একটা বাড়ির সামনে দাড়ালো। রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে ওরা দু’জন নেমে দাড়ালো। চয়ন বিরক্ত মুখে জিজ্ঞেস করল-
এখানে নিয়ে এলে কেন ?
কেন আমার ভালোবাসার মানুষকে যেখানে খুশি নিয়ে যাব। নাকি তাতে কোন সমস্যা আছে।
তা পার। তাতে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু এখানে কেন ?
ঐযে বাড়ীটা ওটা আমাদের। আর বাড়ীতে নিয়ে এসেছি এ কারনেই যে, আমার বাবা-মায়ের সাথে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে।
কি বলে পরিচয় করিয়ে দিবে ?
কেন, তাদের বলবো- মা-বাবা ও আমার বন্ধু এবং আমি ওকে ভালোবাসি।
ঠাট্টা করনা। আমার ভয় লাগছে।
চয়ন ঠাট্টা করছি না। আমার ভালোবাসার মানুষ আমার বাড়িতে আসবে না এটা কি করে হয়।
হ্যাঁ তা ঠিক আছে। কিন্তু-----
কিন্তু কি ?
কেউ কি কখনো এই দুপুরে কারো বাড়ীতে আসে ? আর তাছাড়া তোমার বাবা-মাই বা কি ভাববেন।
নীমা। নীলিমার ছোট বোন। খুব চটপটে ধরনের মেয়ে।
আপু এখানে দাড়িয়ে আছিস কেন ?
ও নীমা, কোথা থেকে এলি ?
আপু উনিকে ?
ও--ও, আমার বন্ধু। আমরা এক সাথে পড়ি। আর চয়ন ও আমার ছোট বোন-নীমা।
সালামালাইকুম ভাইয়া । কেমন আছেন ?
হ্যাঁ ভালো। আপনি ?
ভালো। আমাকে নাম ধরে বললেই হবে। আপনি করে বলার কোন দরকার নেই।
এখানে দাড়িয়ে আছিস কেন আপু, ঘরে চল।
ও যেতে চাচ্ছে না ?
কেন লজ্জা করছে। ও সব লজ্জা টজ্জা রেখে চলুন, ঘরে চলুন।
এই বলে নীমা পরিচিত লোকের মত চয়নের হাত ধরে বাসায় নিয়ে গেল। নীলিমার রুমে বসিয়ে বলল-
ভাইয়া আপুর সাথে কথা বলেন আমি আসছি।
নীমা মিষ্টি হেসে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। আর নীলিমা চয়নকে জড়িয়ে ধরে বলল-
কি ব্যাপার আমি এত বললাম তখন এলে না। আর হবু শালিকা হাত ধরতেই চলে এলে যে, ব্যাপার কি একবার দেখেই কি পছন্দ হয়ে গেল নাকি। শোন তোমাকে বলে দিচ্ছি আমাকে রেখে আবার ওর সাথে প্রেম করনা।
শত হলেও সেতো আমার শালী তার কথার অমান্য করি কিভাবে।
হু- তা বুঝলাম কিন্তু সাহেব অন্য দিকে যেন মোর না নেয়।
দেখ তুমি কিন্তু একটু বেশী বাড়াবাড়ী করছ।
রাগ করনা প্লিজ। ঠট্টা করলাম।
না এভাবে ঠাট্টা করবে না। তুমি চুপ থাক।
আচ্ছা ঠিক আছে এই চুপ থাকলাম।
নীলিমা অভিমানি দৃষ্টি ভঙ্গিতে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল। চয়ন কিছু পরে দেখে নীলিমার গাল দুটো আপেলের মত লাল টল টল করছে। অভিমানী সুখের বনটাতে ওর দৃষ্টি যেতেই দেখে প্রিয়ার বুকে ওড়না নেই। তাতে ওর চোখ যেন যৌন নেশায় ঝলসে যাচ্ছে। এমন পাহাড় উঁচু পাশা-পাশি দু’টো টকবকে কমলা চক্কর দিলে কেউ কি গভীর যৌন বনে হারিয়ে না যেয়ে পারে। চয়ন আস্তে আস্তে নীলিমার দিকে ঝুঁকে চেয়ারের সাথে চেপে দুই গালে চুমু খেতেই নীমার আগমন। সহসা দুজন দুদিকে সরে যেয়ে এটা-সেটা বলাবলী করতে লাগল। নীমা কোক হাতে মৃদু হাসি মুখে টেবিলে রাখল। একটি গ্লাস চয়নের হাতে দিতেই চয়ন বলে উঠল-
এগুলো করতে গেলে কেন ?
এ, এমন কি করলাম। তাছাড়া একটু গরমে একটু ঠান্ডা না হলে কি হয়।
ওরা খাওয়ার মাঝে একটু আনন্দ গল্প করছে। এর মধ্যেই নীলিমার বাবা-মা বাইরে থেকে এসে নীলিমার রুমে প্রবেশ করল। চয়নকে দেখে নীলিমা ও নীমার দিকে তাকালো। নীলিমা তা বুঝতে পেরে সহসা বলল-
বাবা-মা ও চয়ন। আমরা এক সাথে পড়াশুনা করি ।
ও-আচ্ছা।
চয়ন, আমার বাবা-মা।
সালামালাইকুম ।
উনারা অতি সহজ ভাবে সালামের উত্তর দিলেন। আর বললেন- তোমরা গল্প কর।
না-আঙ্কেল আজ উঠি । অন্য আর এক দিন আসব।
না সে কি করে হয়। এই দুপুরে কি কেউ কারও বাড়ি থেকে না খেয়ে যায়। দুপুরে খেয়ে যাবে।
না আঙ্কেল আর একদিন খাব।
তাদের কথার মাঝে নীমা বলে উঠল-
ভাইয়া আপনি কিন্তু বাবা-মায়ের কথা রাখছেন না।
না বোন আমি তা বলছি না । কিন্তু--------।
আর কোন কথা বলা চলবে না। আপনি আজ আমাদের সাথে দুপুরের খাওয়া খেয়ে যাবেন।
নীলিমা কম্পিউটার ছেড়ে দাও, ও গান শুনুক। না হলে তোমরা গল্প কর।
বাবা-মা এবং নীমা চলে গেল যার যার রুমে। আনন্দে এক ঝলক হাসি হেসে নীলিমা বলল-
কি ব্যাপার সাহেব- না পারলে হবু শালিকার হাত ছাড়তে, না পারলে হবু শ্বশুড়-শ্বাশুড়ীর কথা ফেলতে।
চয়ন কোন কথা না বলে নীলিমার হাত ধরে এক টানে বুকের সাথে চেপে ধরে দু’গালে কয়েকটা চুমু খেলো।
প্রভাতের সূর্য্য তার মিষ্টি আলো জানালা থেকে মিলার চোখের উপর পরশ বুলাল। মিলার ঘুম ঙেঙ্গে গেল। মিলা জানালার কাছে গিয়ে দাড়িয়ে রইল। বান্ধবী নীলিমা পিছন থেকে তার গায়ে হাত দেয়াতে নিরাবতা কেটে গেল। চমকে উঠল। ঘুরে তাকাতেই আরো চমকে উঠল। এক দৃষ্টিতে নীলিমার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন এই প্রথম কোন অচেনা মানুষ তার সামনে এসে দাড়িয়েছে।
কি হলো, এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন ?
তুই এত সকালে..!
এত সকাল.. কটা বাজে দেখেছিস।
কটা বাজে ?
ন’টা বাজে।
কিন্তু তোকে এভাবে দেখাচ্ছে কেন ?
তোর সাথে কিছু কথা আছে।
আচ্ছা তুই একটু বস, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
নীলিমা অবহেলিত নারীর মতো, অসহায় ভাবে বসে আছে। দু'চোখে পানি টলমল করছে। প্রচন্ড কষ্টে তার বুক ঙেঙ্গে যাচ্ছে।
কি বলবি বল?
মিলা-আমার একটা সমস্যা হয়েছে।
কি সমস্যা- চয়নের সাথে কিছু হয়েছে?
না-ওর সাথে কিছু হয়নি।
তবে-কি ?
চয়নের সাথে আমার সম্পর্কের কথা বাবা-মা জেনে গেছেন।
তারপর-
বাবা-মা আমাকে খুব বকাবকী দিয়েছেন এবং এও বলেছেন বাবা তাঁর কোন এক বন্ধুর ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছেন, আমাকে সেখানেই বিয়ে করতে হবে।
তুই কি বলেছিস?
আমি তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছি চয়নকে ছাড়া আমি কাউকেই বিয়ে করব না। কিন্তু তারা একথা শুনতে চাচ্ছেন না। তারা বলছেন, তাদের পছন্দের জায়গাতেই বিয়ে করতে হবে।
হ্যাঁ, এতো কঠিন সমস্যা। আচ্ছা, তুই চয়নকে জানিয়েছিস?
হ্যাঁ, জানিয়েছি।
ও কি বললো?
ও তোর সাথে এ ব্যপারে কথা বলতে চায়।
ঠিক আছে ওকে কাল কলেজে আসতে বল।
ঠিক আছে, আমি এখন আসি।
সেকি , দুপুরে খেয়ে যাবি।
না-আজ থাকব না, অন্যদিন খেয়ে যাব।
নীলিমা একরাশ ব্যাথা বুকে নিয়ে চলছে। পৃথিবীর সব কিছুই তার কাছে অর্থহীন মনে হচ্ছে। চয়ন তার জীবন থেকে হারিয়ে যাবে একথা কিছুতেই সে মেনে নিতে পারছেনা। তার সব স্বপ্ন গুলো ঙেঙ্গে যাচ্ছে।
নীলিমা- এই নীলিমা, এখানে বসে আছিস, কি হয়েছে, এই অবেলায় শুয়ে আছিস যে;
না- কিছু হয়নি মা- মাথাটা একটু ব্যাথা করছে তাই শুয়ে আছি।
চল- খেয়ে নিবি।
আমি পরে খাব, তোমরা খেয়ে নেও।
আচ্ছা- তোর কি মন খারাপ, কিন্তু কেন ?
মা তোমাকে একটা কথা বলি-
কি কথা, বল-
মা তোমরা কি আমার ভালো চাও, আমাকে কি তোমরা সুখি দেখতে চাও?
হ্যাঁ- চাই
তাহলে আমি চয়নকেই বিয়ে করব। মা চয়নকে না পেলে আমি বাঁচব না।
চয়ন-চয়ন-চয়ন ; তোর মাথা থেকে “চয়ন” নামটা ফেলে দে। আমরা যার সাথে বিয়ে ঠিক করেছি সে চয়নের থেকে অনেক ভালো। তারচেয়ে বড় কথা হলো- ছেলে শিক্ষিত এবং অনেক বড় চাকুরী করে।
তাহলে তোমাদের কথাই ঠিক থাকছে।
হ্যাঁ, এ কথাই থাকবে।
মা- আমার কথাটাও শুনে রাখ- যদি বিয়ে করতে হয় চয়নকেই বিয়ে করব। আর যদি ওকে আমার জীবনের সাথে না জড়াতে পারি তাবে এ পৃথিবীতে আমি থাকব না।
এই বলে নীলিমা তার ঘরের দরজা বন্ধ করে কাঁদতে রলই।
আফা.. ও আফা... (শেফা কাজের মেয়ে)
কি হয়েছে ; এত চেচাচ্ছিস কেন?
তাড়াতাড়ি আহেন, খালাম্মা যেন কেমন করতাছেন-
মিলা তার ঘর থেকে দৌড়ে মায়ের ঘরের দিকে এলো। প্রচন্ড ব্যাথায় বিছানার এপাশ-ওপাশ করছেন।
মা কি হয়েছে তোমার, এরকম করছ কেন?
বুকের প্রচন্ড ব্যাথা, নিশ্বাস নিতে পারছি না- খুব কষ্ট হচ্ছে।
শেফা ; মায়ের কাছে বস, আমি ডাক্তারকে ফোন করে আসি।
ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি করেন-
ডাক্তার আংকেল------
চিন্তা করনা, ইনজেকশনে ঘুমের ঔষধ দিয়েছি। সকালে এসে দেখব, যদি ভালো মনে করি তাহলে বাসায় ফুলরেষ্টে থাকবে, তা না হলে হাসপাতালে নিতে হবে।
কিন্তু কি হয়েছে মায়ের ?
এখনো বুঝা যাচ্ছে না-
আংকেল, যেভাবেই হোক মাকে সুস্থ করতে হবে। মা ছাড়া পৃথিবীতে আমার কেউ নেই।
হাসপাতালের বারান্ধায় বিষন্ন মনে হাটছে মিলা। মা খুব অসুস্থ। তাকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে। ডাক্তার কিছু পরীক্ষা করতে দিয়েছেন। মিলা একাই সব কিছু করছে। মিলা- তার ভাই এবং নিটনকে ফোন করেছে। রকিব (মিলার ভাই) এর আসতে একদিন দেরী হবে। নিটন চলে এসেছে।
খালার অবস্থা কি ?
মাকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে।
ডাক্তার কি বলেছেন।
ব্লাড টেষ্ট, এক্সেরে, ই.সি.জি করতে বলেছেন।
ও-গুলো করা হয়েছে।
হ্যাঁ, করা হয়েছে, এখনো রিপোর্ট দেয় নি।
রিপোর্ট আনার জন্য নিটন বের হলো। মিরা তার মায়ের পাশে বসা। ডাক্তার কেবিনে আসল।
রিপোর্ট গুলো আনা হয়েছে-
জ্বি না। রিপোর্টের জন্য পাঠানো হয়েছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই নিয়ে আসবে।
রিপোর্ট নিয়ে এলে আমার রুমে আসবেন।
জ্বি-। মার কি হয়েছে?
রিপোর্ট না এলে কিছুই বলা যাচ্ছে না। তবে সুবিধা মনে হচ্ছে না।
রাত ৮ টা বেজেছে। নিটন ও মিরা ডাক্তারের রুমে গেল। ডাক্তার রিপোর্ট গুলো যতœ সহকাওে দেখছেন। রিপোর্ট গুলো টেবিলে রাখল, নিরুপায় চোখে ডাক্তার মিলার দিকে তাকালেন।
আপনার বাবা কোথায় ?
বাবা নেই। উনি অনেক আগেই এ পৃথিবী থেকে চলে গেছেন।
আর কেউ নেই?
আছেন, আমার বড় ভাই। চিটাগং এ থাকেন। ফোন করা হয়েছে। সকালে চলে আসবেন।
মিলাকে দেখতে খুব অসহায় মনে হলো ডাক্তারের। কিন্তু কোন উপায়ও নেই, ডাক্তারকে তো বলতেই হবে ওর মার কি হয়েছে। আর এও বলতে হবে যে, তার মা বেশী সময় এই পৃতিবীতে থাকবেন না।
মার কি হয়েছে?
ওনার হার্ট ব্লোক করেছে। আর------
আর কি ! থেমে গেলেন কেন?
উনি সম্ভাবত ২/১ দিন বাচঁবেন।
মিলার চোখ থেকে টপ টপ করে পানি ঝড়তে থাকে। নির্বাক মুখে মিলা মায়ের পাশে বসল। নিটন ও বাসায় যায়নি। রকিব এসেছে। মিলা রকিবকে দেখে শিশুর মত জড়িয়ে ধওে কাদঁতে লাগল আর বলতে লাগল- ভাইয়া ডাক্তার বলেছেন মা ২/১ দিন বাচঁবেন। মায়ের জ্ঞান ফিরেছে। রকিব, মিলা এবং নিটন মায়ের পাশেই বসা। মা রকিবকে কাছে ডেকে বলল-
রকিব-বাবা, মিলা তোর আপন বোন না, কিন্তু ওকে কোন দিন আমি কষ্ট পেতে দেইনি। তুইও ওকে কষ্ট পেতে দিবি না। ও নিটনকে ভালোবাসে। ওকে নিটনের হাতে তুলে দিস।
চিরদিনের জন্য নিশ্চুপ হয়ে গেলেন মা। দুই ভাই-বোনের কান্না নিটনের বুকে প্রচন্ড জোরে আঘাত হানে। নিটনের মুখে কোন শান্তনা বনি নেই। সে অবুঝ শিশুর মত, নির্বাক মুখে দাড়িয়ে আছে।
নীলিমাকে নিয়ে মিরা তার এক দূরসম্পর্কের খালার বাড়ীতে উঠল। খুব বিশাল বাগান চার পাশে বিভিন্ন ধরনের গাছ-পালায় সাজানো একটা বাড়ী, চারটা রুমের একটা বাড়ী। এখানে খালা একাই থাকেন। তার কোন ছেলে-মেয়ে নেই। স্বামী মালেশিয়াতে থাকেন। খালা তার ঘরে শুয়ে আছেন।
খালা.. ও খালা, কোথায় তুমি।
কে-- ?
আমি, মিলা--
মিলা ! কোথা থেকে এলি। এরা-------
বাড়ী থেকে। আর ওরা আমার বন্ধু।
নীলিমা, চয়ন আমার খালা।
খালা তোমার সাথে কিছু কথা আছে।
কথা আছে তো বলবি। এখন ওদেরকে নিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে বিশ্রাম নে। পরে শোনা যাবে।
মিলা একা একা বাগানের দিকে হাটতে লাগল। একা বাগানে হাটতে মিলার ভালোই লাগছে। খুব সুন্দর একটা গন্ধ বাতাসের সাথে ভেসে আসছে। কিসের গন্ধ ! জানার ইচ্ছা জাগল মিলার মনে। খালা বলেছিলেন- বাগানে একটা হাছনাহেনা ফুলের গাছ আছে। ফুলের গন্ধটা খুব সুন্দর। সম্ভাবত সেই ফুলেরই গন্ধ। মিলা সামনের দিকে হাটতে লাগল। মাঝারি ধরনের একটা গাছ। গাছটার চারিদিকে ডাল-পালা ছড়িয়ে আছে। প্রতিটা ডালে ছোট ছোট থোকে সাদা রংয়ের ফুল ফুটে আছে। গাছটা দেখতে মিলার চোখে খুব সুন্দর। গাছের নিচে দাড়ালো মিলা। তবে তার একটু একটু ভয়ও করছে। কেননা সে জানে যে গাছের ফুলের গন্ধ খুব মিষ্টি সে গাছে বিষাক্ত ধরনের সাপ থাকে। তারপরও মিলা গাছের পাশ ঘেঁষে দাড়ালো। নিটনের কথা মিলার খুব মনে পড়লো এবং নিজের মন থেকে জানতে চাইল- নিটন তুমি কোথায় ? আমার পাশে তুমি এখন যদি থাকতে তুমিও উপভোগ করতে পারতে এই সুন্দুর মূহুর্তটাকে। সন্ধা হয়ে আসছে। মিলা ঘরের দিকে আসল। খালা চা-নাস্তা নিয়ে আসছেন। চা-নাস্তা খেতে খেতে মিলা নীলিমা ও চয়ন সম্পর্কে সব কথা খালাকে খুলে বলল।
ঠিক আছে, কোন সমস্যা নেই। ওরা আমার কাছেই থাকবে। আর আমিও তো এই নির্জন বাড়ীতে একাই থাকি। ওরা থাকালে আমার ভালোই হবে।
চয়ন নির্জন বাগানে একা একা হাটছে। নীলিমা চয়নকে একটু ভয় দেখানোর চেষ্টা করল। কিন্তু চয়ন ভয় পেলনা। নীলিমার উপস্থিতি তাকে উৎসাহিতও করল না। সে চিন্তিত মনে হাটছে।
চয়ন তোমাকে এরকম চিন্তিত লাগছে কেন?
কোথায়--- চিন্তিত লাগবে কেন ?
তবে কি তোমার শরীর খারাপ ?
না-- তাও না। ভাবছি অনেক দিন হল আমরা খালার উপর পরে আছি। অনেক চেষ্টা করলাম কোন কাজ যোগার করতে পারলাম না।
হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছি।
ঘরে ওদের না দেখে খালা বাগানের দিকে আসল।
তোমরা এখানে কি করছ? আমি সব জায়গায় তোমাদেরকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। সন্ধা নেমে আসা সময় এই নির্জন বাগানে কি কেউ থাকে। চল চা দেয়া হয়েছে। চয়ন মিলা তোমাদের কিছু বলে গেছে ও কবে আসবে এরকম।
জ্বি খালা, সে আগামী মাসের প্রথম দিকে আসবে।
খালা শুয়ে আছেন তার ঘরে। চয়ন এবং নীলিমা টিভি দেখছে। এমন সময় মিলার উপস্থিতি। চয়ন, নীলিমা দুজনেই মিলার দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে।
কি হলো- এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? আমাকে কি নতুন দেখছিস।
না তুই এ সময় !
কেন ? কোন সমস্যা করলাম।
না তোর তো এমাসের শেষের দিকে আসার কথা ছিল।
হ্যাঁ- কিন্তু ভালো লাগছে না তাই চলে এলাম। আচ্ছা খালা কোথায়?
রুমে আছেন।
মিলা খালার ঘরের দিকে গেল। খালা খাটের উপর বসে কোরআন পড়ছেন। মিলা খাটে বসল নিশ্চুপ ভঙ্গিতে। কোরআন পাঠের সময় কথা বলতে হয় না। তাই মিলা কোন কথা বলছেনা। খালা কোরআন পাঠ শেষ করে মিলার দিকে ঘুরে বসলেন।
কেমন আছ ?
জ্বি-ভালো। তুমি কেমন আছ খালা।
ভালো, তোর ভাই-ভাবী কেমন আছে?
ভালো আছে।
তা এই সন্ধায় এলি যে, আরো আগে আসলিনা কেন?
বিকেলের মধ্যেই আসতাম। কিন্তু পথে একটু ঝামালা হলো তাই আসতে দেরি হয়েছে।
কি ঝামেলা?
তেমন কিছু না। গাড়ীর চাকা পান্চার হয়েছিল।
ও-আচ্ছা।
খালা, ওদের দ্বারা তোমার কোন সমস্যা হয়নি তো।
না-কি সমস্যা হবে। বরং ওরা থাকাতে আমার সময়টা ভালো কাটছে। আচ্ছা এ কথা কেন বললি।
না মানে হুট করে ওদের কে রেখে গেলাম কিনা।
আচ্ছা তুই ওদের সাথে গল্প কর। রাতের রান্নাটা শেষ করি। তারপর কথা হবে।
ঠিক আছে, খালা শোন চয়নের জন্য একটা চাকরি ঠিক হয়েছে। তুমি ওদের কে এখন বলোনা কিন্তু। রাতে খাবারের সময় ওদেরকে একটা সার্প্রাইজ দেব।
ঠিক আছে, আমি রান্না ঘরে গেলাম।
কিরে কি করছিস তোরা।
কি আর করব। টিভি দেখা ছাড়া আর কোন কাজ নেই।
মিলা তোরা গল্প কর। আমি খালাকে একটু রান্নার কাজে সাহায্য করি।
চয়ন সাহেব আপনার খবর বলেন আর এখানে কেমন লাগছে। কি হলো। এভাবে বসে আছ কেন? তোমাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে যে।
কি আর করব। চিন্তা ছাড়া আর কিইবা করার আছে।
কেন! এত টেনশন করার কি আছে।
এত দিন হলো কোন চাকরী পাচ্ছিনা। আর উপরে আবার পড়ে আছি খালার কাছে। খালা কি মনে করছেন কে যানে।
দুর পাগল, তুমি খালাকে চেন না। উনি কিছুই মনে করছেন না। তাছাড়া তোমরা থাকাতে তার আরো সময় ভালো কাটছে।
তারপরও, আমার যেন কেমন লাগছে।
লাগা-লাগী বাদ দাও। এখন শোন আমি যার জন্য এখানে এসেছি।
কেন আসছ?
এখন তো বলা যাবে না। খাবার সময় সবাইকে একসঙ্গেই কথাটা বলব।
এখন বলা যাবে না কেন?
জ্বি না স্যার। এখন বললে যে আনন্দটা হবে, তারচেয়ে বেশী আনন্দ হবে সবাইকে সামনে রেখে বললে।
তুমি বস। আমি একটু ঘুরে আসি।
ঠিক আছে যাও। তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।
চয়ন বাজারের দিকে গেল। মিলা একা একা টিভি দেখছে। পলক বিহীন চোখে মিলা টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই খেতে বসলো, কিন্তু খালা আসছে না।
নিলীমা- খালা কোথায়?
নামাজ পরছেন।
তোমাদের জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
সারপ্রাইজ ----!
জ্বি বন্ধু সারপ্রাইজ।
সেটা কি জানতে পারি।
অবশ্যই জানতে পার, তবে একটু ধর্য্য ধরতে হবে।
নামাজ শেষ করে খালা ডাইনিং এ এলো।
কি ব্যাপার, সবাই বসে আছ কেন?
তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
আমার জন্য অপেক্ষা করছ কেন? খেয়ে নিলেই তো পারতে।
বাহ! তোমার বাড়ীতে আসছি, আর তোমাকে ছাড়াই খেয়ে নেব তা কি হয়। তাছাড়া এখানে তো একটা মজার কথা হবে, যা তুমি না থাকলে আনন্দটা হবে না।
খবরটা কি যা এতই আনন্দের ।
চয়নের জন্য একটা চাকুরী ঠিক করেছি।
তুমি কি করে চাকরী ঠিক করলে।
ভাইয়াকে বলেছিলাম। সেই ব্যবস্থা করেছে।
কথাটা শুনে চয়নের দুচোখ বেয়ে ঝর্না ধারায় পানি ঝড়ছে। এক দৃষ্টিতে মিলার দিকে তাকিয়ে আছে চয়ন। মনে মনে কয়েক বার মিলার পা ছুঁয়ে সালাম করল।
খালা দেখ, আনন্দের একটা সংবাদ। কোথায় একটু হাসি আনন্দ করবে তা রেখে বোকার মত চোখের পানি ফেলছে। এই কি হয়েছে, কাদঁছ কেন?
আনন্দে। খুব বেশী আনন্দেই মানুষের চোখ থেকে পানি পড়ে। মিলা তুমি আমাদের জন্য অনেক করেছ। অনেক ঋণ তোমার কাছে আমাদের। কি দিয়ে এই ঋণ শোধ করব তা আমি ভেবে পাচ্ছি না।
হয়েছে আর ন্যাকামো করতে হবে না। আগামী দুই দিনের মধ্যেই তোমাকে কাজে যোগ দিতে হবে।
নতুন চাকরী। চয়ন খুব আনন্দের সাথেই অফিস করছে। প্রথম মাসের মাইনের টাকায় মিলাকে খুব সুন্দর শাড়ী উপহার দিল ।
জামান, এই জামান ওঠ।
এত চিল্লাচ্ছিস কেন?
আজ মিলার জন্ম দিন। তোকেতো বলেছি, ওর জন্য কিছু কিনব। তাড়াতাড়ি চল।
রিক্সা নিয়ে মার্কেটের দিকে চলল দুই বন্ধু। নিটন নিশ্চুপ ভঙ্গিতে বসে আছে রিক্সায়। দু'চোখে অবিরাম স্বপ্ন বয়ে চলছে। প্রতি বছরই নিটনের পক্ষ থেকে কিছু না কিছু উপহার মিলার জন্য থাকে। আজ নিটনের মনে খুব আনন্দ লাগছে। জামান নিটনের মধ্যে একটা অস্থিরতা লক্ষ্য করছে-
নিটন-তোর কি হয়েছে?
কি হবে। কিছুই হয়নি।
তোকে এ রকম লাগছে কেন?
জামান বলতো ওর জন্য কি নেয়া যায়।
তোর যা ইচ্ছা তাই নেয়া যায়।
নিটনের চোখে খুব সন্দর একটা পুতুল পড়ল। কোন দাম-দর করেই পুতুলটা নিয়ে নিয়ে নিল। রাস্তার দু’পাশ থেকে শো-শো করে গাড়ী চলছে। নিটন এবং জামাল রিক্সায় নিশ্চুপ ভাবে বসে আছে। একটা ঘাতক ট্রাক নিটনকে চাপা দিয়ে চলে যায়।
মিলা ওর রুমে বসে আছে। আজ ওর তেমন ভালো লাগছে না। কেমন যেন চারদিক নিস্তব্ধ মতে হচ্ছে। মিলার মনে প্রচন্ড ভয় কাজ করছে। ভয় কাটাবার জন্য একটা কবিতার বই নিয়ে পড়ছে। বইটার কবিতাগুলোর মধ্যে একটা কবিতা ওর খুব অপছন্দনীয়। কেমন যে আজ ওটাই পড়তে ইচ্ছা করছে মিলার-
“ যে দিকেই চাই আমি
সে দিকেই শূন্য হয়,
এ-কি শুধু মোর
ললাটের লেখা।
যে দিকেই দৃষ্টি আমার
সে দিকেই অন্ধকার
বুঝিনিতো মোর জীবন
হবে এত চমৎকার।
জানি নিতো মোর জীবন
হবে এতো সুন্দর।
আঘাত আর ব্যাথা নিয়ে
চলব কি চিরকাল।
যে আশাতেই হাত বাড়াই সে আশাই ব্যর্থ হয়,
বুঝিনি-তো কি পাপে মোর সর্ব আশা শূন্য হয়”
দোলন চেয়ারে গা এলিয়ে মৃদু ভাবে দোলছে। আজ কেন এরকম লাগছে। বুকের মধ্যে অজানা একটা ব্যাথা। সমস্ত শরীর কাঁপছে। মানুষের শেষ মূহুর্তটা কি এরকমই হয়। আমার কি পৃথিবীতে বসবাসের সময় ফুরিয়ে এসেছে। না কি কোন বিপদ সংবাদ কেউ বয়ে নিয়ে আসছে। উহ্- আর পারছি না।
চোখ বন্ধ করে বসে আছে মিলা। কলিং বেলের শব্দ মিলার কানে ভেসে আসে। শব্দটাও খুব বিদঘুটে লাগছে। মিলা উঠে এসে দরজা খুলতেই জামান কে দেখলো। সমস্ত শরীরে রক্ত।
জামান এ অবস্থা কেন? কি হয়েছে তোমার।
জামানের চোখ থেকে অশ্র“ গড়িয়ে পড়ছে। অশ্র“র ফোটা শরীরের রক্তের সাথে মিশে লাল হয়ে ঝড়ছে।
মিলা-নিটন আর আমাদের মাঝে নেই।
মিলার চোখ থেকে এখন আর কোন অশ্র“ ঝরছে না। সে নির্বাক মুখে জামানের দিকে তাকিয়ে আছে। জামানকে সে খুব সহজ ভাবে বলল-
ওকে কোথায় রেখে এসেছ। আমাকে ওর কাছে নিয়ে চল।
নিটনের মরদেহ জড়িয়ে ধরে মিলার আত্ম চিৎকার। চারপাশে লোক জন দাড়িয়ে আছে। কারো মুখে সান্তোনা দেবার মত কোন ভাষা নেই।
নিটন তোমরা আমাকে কি পেয়েছ, তোমরা একে একে সবাই আমাকে এই কঠিন পৃথিবীতে রেখে চলে যাচ্ছ। কিন্তু কেন? তুমিতো বলেছিলে, আমাকে রেখে তুমি কোথাও যাবে না। তবে কেন গেলে, কেন গেলে-। আল্লাহ্ তুমি কেন আমার প্রিয় জনকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাচ্ছ। আমি তো কোন অন্যায় করিনি, কোন পাপ করিনি। তুমি এত বড় শাস্তি আমাকে কেন দিচ্ছ।
মিলা বেদনার পাহার বুকে নিয়ে চলছে। মিলা ভেঙ্গে পড়ে না। সে দেখতে চায় আর কত দুঃখ, কষ্ট তাকে গ্রাস করে।
মিলা বারান্দায় হাটু ভেঙ্গে দেয়ালের সাথে এলিয়ে বসে আছে। সে বিধাতার কাছে প্রশ্ন করছে- বিধাতা কেন এত বড় শাস্তির মধ্যে আমাকে রেখেছ? আমার জন্য কি তুমি কোন সুখ রাখনি? কিন্তু কেন? নিটন তুমি চলে গেছ। দেখে যাও আমি কিভাবে বাস করছি। দুঃখ, বেদনাগুলো এখন আমার চিরসাথী হয়েছে। এই পৃথিবীতে যত সুখ রয়েছে তা আমার ভোগের জন্য নয়, যত দুঃখ রয়েছে সেগুলোই আমার প্রাপ্য। মিলার চোখ বেয়ে বেদনার অশ্র“ ঝড়ছে। ভাবীর উপস্থিতি তার ভাবনা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
মিলা একা একা কি করছ। আমি তোমাকে সব জায়গায় খুঁজে বেড়াচ্ছি।
ওড়না দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে মিলা বলল-
বসে আছি ।
এভাবে অন্ধকারের মধ্যে বসে আছ কেন? সেকি তোমার চোখে জল কেন?
ভাবী চোখের জলইতো এখন আমার সম্বল। ভাবী আর কত দুঃখ আমাকে সইতে হবে, কখনও কি কোন সুখ দেখতে পারব না।
এই বলে ভাবীকে জড়িয়ে ধরে মিলা কাঁদতে রইল। আর বলল- ভাবী আমার জীবনটা এরকম কেন? কোন উত্তর দিতে না পেরে নির্বাক মুখে বোকার মত দাড়িয়ে আছে ভাবী। সে নিজেকে সামলে নিয়ে মিলাকে বলল-
চল খেতে যাবে, তোমার ভাইয়া তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
আমার ক্ষিদে নেই, তোমরা খেয়ে নেও।
তুমি কিন্তু কিছুদিন ধরে খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম করছ। এভাবে করলে পথ চলবে কিভাবে। তোমাকে যে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। অতিতের কথা ভুলে যাও, নতুন করে পথ চলতে শুরু কর।
ভাবী, কি কখনো সম্ভব?
কেন সম্ভব হবে না। অসম্ভবকেই সম্ভব করতে হবে। আর আমার বিশ্বাস তুমি পারবে।
হ্যাঁ আমাকে পারতেই হবে। তবে এজীবনের সাথে কাউকেই জড়িয়ে নয়, আমাকে একা একাই পথ চলতে হবে। দেখতে হবে এ জীবন চলার পথে আর কত দুঃখ রয়েছে।
মিলা তোমার শরীর কেমন?
জ্বি ভালো।
কোন অসুবিধা নেইতো।
না-।
মিলা, তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।
কি কথা ভাইয়া, বল।
তোমার বিয়ে ঠিক করেছি, এখন তোমার মতের প্রয়োজন।
ভাইয়া আমি বিয়ে করবো না। আমি এভাবেই থাকতে চাই, আমাকে আমার মতো করে থাকতে দাও।
মিলা- আমি বুঝি তুমি কেন এ কথা বলছ। তারপরও বলছি, বাস্তবকে মেনে নেয়া ছাড়া কোন উপায় নেই।
ভাইয়া যে কটা দিন বেচে থাকব সে কটা দিন একাই থাকতে চাই। এ জীবনটার সাথে কাউকে জড়াতে চাই না।
মিলা নিজের রুমের দিকে চলে গেল। কলিং বেলের শব্দ । কলিং বেলের শব্দ মিলার কাছে এখন আর ভালো লাগে না। কেননা তার ধারনা কলিং বেল শুধু অশুভ সংবাদের বানী নিয়ে চলে। কলিং বেলটা বেজে ওঠার সাথে সাথে মিলার হার্ডবিট বেড়ে উঠেছে। দরজা খুলতেই চয়নকে দেখতে পেল। আশ্চর্য চয়নকে চেনা যায় না। চেহারার কি অবস্থা হয়েছে। মনে হচ্ছে যেন কতদিন না খেয়ে আছে সে। মনে হচ্ছে একটা জীবন্ত কংকাল। চয়নের কোলে ছোট্ট একটি মেয়ে। মেয়েটি দেখতে খুব সুন্দর।
ভিতরে আস। কোথা থেকে এলে এতদিন পরে। কেমন আছ।
বাড়ী থেকে এসেছি।
নীলিমা কোথায়, ওকে নিয়ে এলেনা কেন?
নীলিমার কথা বলতেই চয়নের চোখ থেকে বেদনা অশ্র“ ঝড়ছে।
নীলিমা নেই। এই যে মেয়েটিকে দেখছ। আমার মেয়ে। একে আমার কাছে রেখে নীলিমা চির মুক্তি নিয়েছে।
কি বলছ।
হ্যাঁ মিলা যা সত্যি তাই বলছি। এই মেয়েকে কিভাবে লালন-পালন করব। সে সারাদিন শুধু কাঁদতে থাকে। তাই ওকে তোমার কাছে রেখে যেতে চাই।
ঠিক আছে, কিন্তু তুমি কোথায় যাবে।
জানিনা- কোথায় যাব।
মিলা মেয়েটিকে কোলে তুলে নিতে নিতে বলল-
আয় মা। আমার কাছে আয়। এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই আর তোরও কেউ নেই। আজ থেকে আমি তোর তুই আমার। আমরা দু’জন একই ভাগ্যের মানুষ। তাই আল্লাহ তোকে আমার কাছেই পাঠিয়েছেন।
মিলা মেয়েটিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। এভাবেই চলতে থাকে মিলার দিন কাল। অন্যের মেয়েকে নিজের মেয়ে করে গড়তে থাকে। মা-মেয়ের জীবন ধারা চলতে থাকে সাভাবিক ভাবেই। কোন চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাংঙ্খা নেই তাদের মনে। মিলা বাড়ীর ছাদে দাড়িয়ে আছে। মিলা মেয়ের নাম রেখেছে নিলা। তার নিজের এবং বান্ধবির নামের সাথে মিলিয়ে মেয়ের নাম রেখেছে। নিলা মাকে না দেখে ছাদের দিকে উঠে এসে দেখে- মা ছাদের এক কোনে দাড়িয়ে আকাশে ভেসে ওঠা সন্ধা তারার দিকে তাকিয়ে আছে।
মা--।
কে, নিলা।
হ্যাঁ মা। কি করছ এখানে।
কিছুনা, ভাল লাগছে না তাই দাড়িয়ে আছি।
মা, তোমাকে একটা কথা বলি--
কি, বল।
প্রাই তুমি সন্ধার দিকে ছাদের এই জায়গাতে দাড়িয়ে এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাক, কিন্তু কেন মা ?
কেন থাকি, ঐ যে সন্ধা তারাটা দেখছ ওখানে ঘুমিয়ে আছে আমার জীবনের সব আশা-আকাংঙ্খা, ঘুমিয়ে আছে আমার ভালোবাসা।
“ভালবাসা জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয় গৌরব। কিন্তু ভালবাসা মিলাকে কি দিলো? তাকে দিলো দাহ। যে আগুন আলো দেয় না, শুধু দহন করে, সেই আলোবিহীন অগ্নির দহনে দগ্ধ হলো মিলার জীবন”।
কেমন আছ? জানার অধিকার নেই। তাই অধিকারটা নিতে চাই।
ভালোবাসি-তোমাকে, ভালোবাসি। আজ এটুকুই।
চিঠিটা বুকে চেঁপে ধরে আনন্দ ভূবনে শুয়ে আছে নিটন। জীবনের সব আনন্দই আজ যেন ওর হৃদয়ে। আজ এখনও খাওয়া-গোসল কিছুই হয়নি ওর। টেবিল ঘরির দিকে দৃষ্টি যেতেই চমকে উঠে। পাঁচটা বেজেছে। যাবতীয় কাজ সেরে বেড়িয়ে পড়ল বন্ধুদের সাথে। নিটনদের প্রতিদিনের আড্ডা মিলাদের এলাকায়। ওরা সবাই খুশি মনে হাঁটছে। কিন্তু নিটনের খুশিটা অন্যরকম। সে মনে মনে ভাবছে আজ মিলাকে দেখতে পাবে কিনা। মিলা নীল শাড়ীতে নিজের সমস্ত শরীরটাকে আকাশের নীল এর সাথে বেঁধে বসে আছে। নিটন থেমে যায়। মিলার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নিটনের বন্ধুরা যার যার মনে হাটছে। তারা কেউ জানেনা নিটন আজ কোন ভূবনে আছে। ওর মনে আজ কোন আনন্দ খেলা করছে। বুন্ধুরা পিছন দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো, নিটন পলক বিহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিলার দিকে। বন্ধুদের ডাক। চমকে উঠে নিটন।
নিটন! কি দেখছিস ?
নাহ্ কিছু না।
তবে ওভাবে দাড়িয়ে আছিস কেন ? কি হয়েছে?
না, কিছু হয় নি।
কিছু হয়নি, তবে মুর্তির মত দাড়িয়ে আছিস কেন? চল ওখানে বসি।
যেখানে ওরা বসে সেখান থেকে মিলাদের বাড়ীর পিছনের খোলা দিকটা ষ্পষ্ট দেখা যায়।
চারিদিকে খোলা মাঠ। মিষ্টি বাতাস, বিকেলের পরন্ত রোদ। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা খেলা করছে। সব মিলেয়ে সুন্দর একটা পরিবেশ তৈরী হয়েছে। আনন্দের নীলিমা নিটনের চোখে মুখে। নিটনের চোখ দুটো এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছে মিলার খোঁজে। মিলাদের ছাদের দিকে চোখ যেতেই মিলাকে দেখতে পেল। নীল রংয়ের শাড়ী গায়ে জড়িয়ে ছাদের রেলিং ঘেষে নিটনের দিকে তাকিয়ে আছে।
সূর্য্য তার দিনের দায়িত্বটা সেরে প্রতিদিনের মত আজও বিদায় নিল পশ্চিমাকাশে।
ফোনের মিউজিকে ঘুম ভাঙ্গল নিটনের । রিসিভারটা কানে ধরতেই মিষ্টি একটা কণ্ঠ-
হ্যালো।
ঘুম ভেঙ্গিয়ে বিরক্ত করলাম। শুভ সকাল।
কোকিল গুন্জন এই ভোরে কে ফোন করেছে তা নিটনের বোঝা হয়ে গেছে। তারপরও নিটন জানতে চাইল-
প্লিজ, কে বলছিলেন ?
আমি মিলা।
নিটন আনন্দে বাক হারা হয়ে বসে আছে।
কি হলো কথা বলছেন না কেন ?
স্বপ্ন দেখছি।
জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছেন!
হ্যাঁ।
মানুষ জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে?
জানিনা, আমি দেখি।
কি দেখছেন ?
তোমাকে দেখছি।
আমাকে [ মন ভোলানো হাসি মিলার ]
হাসছ কেন?
আপনার কথা শুনে।
এই সকালে ফোন কেন?
ভালোবাসি বলে। রাখি কলেজে দেখা হবে।
রিসিভারটা রাখার শব্দে নিটনের মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল।
মাহাবুব স্যারের ক্লাস। বাংলার টিচার। বাংলা ক্লাসটা তিনি খুব সুন্দর করে নেন। অন্যান্য ক্লাশে ছাত্র-ছাত্রী উপস্থিত না থাকলেও মাহাবুব স্যারের ক্লাসে উপস্থিত থাকে। হাসি-ঠাট্টা তার ক্লাসে একটা অংশ। সে সকলের কাছ থেকে বুদ্ধির মাধ্যমে পড়া আদায় করে নেন। নিটনের প্রিয় টিচার হলেন মাহাবুব স্যার। মাহাবুব স্যারের ক্লাস নিটনের করা চাই প্রতিদিন। ক্লাসে নিটন প্রতিদিন একই জায়গাতেই বসে। আজও বসেছে। স্যার ক্লাসে উপস্থিত হলেন-
আস্সালামু আলাইকুম স্যার।
ওয়ালাইকুম আস্সালাম, বাছারা।
মাহাবুব স্যারের আবার একটা মুদ্রা দোষ আছে। সে প্রতি কথার মাঝে ‘‘ বাছারা” শব্দটা ব্যবহার করেন। ক্লাসে আজ মন বসছেনা নিটনের। মনের মধ্যে একটা উরু উরু ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। মাহাবুব স্যারের চোখ পড়ল নিটনের উপর-
নিটন, নিটন-
জ্বি স্যার
তুমি কি কোন স্বপ্ন রাজ্যে বাস করছ এই মূহুর্তে বাছা।
জ্বিনা স্যার
তবে তোমাকে অন্য মনস্ক লাগছে কেন। ক্লাসে তোমার মন নেই কেন?
স্যারের চোখের কাছে ধরা পড়েগেছে নিটন। বাঁচার কোন উপায় নেই। তারপরও সে জানে তাকে স্যারের প্রশ্নের জবাব দিতেই হবে। কিন্তু সে স্যারের প্রশ্নের জবাব দিতে পারছে না। সে একটা দ্বিধার মধ্যে পড়ে গেছে। কি আর করার প্রশ্নের জবাব তো তাকে দিতেই হবে।
জ্বি না স্যার। আমার মন ক্লাসেই আছ এবং আমি অন্যমনস্কও নই।
তুমি কিছু একটা ভাবছ সেটা তোমার চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বাছা। সম্ভাবত তুমি নতুন প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছ।
স্যারের কথায় ক্লাসের সবাই নিটনের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল। লজ্জায় নিটনে চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। সে আর কিছু বলতে পারলো না। ঝিম মেরে দাড়িয়ে রইল। ক্লাস শেষে হওয়ার ওয়ার্নিং দিল পিয়ন। নিটন আজ একা একাই হাটছে। মিলার সাথে দেখা করবে বলে সে একা একাই হাটছে। নিটনদের কলেজের চারপাশের পরিবেশটা চমৎকার সুন্দর। সুন্দর দুটি সাজানো ফুলের বাগান। একটি খেলার মাঠ। মাঠের অপর দিকে ঘাট বাঁধানো পুকুর। পুকুরের মাঝে লাল, সাদা-নীল পদ্মের মেলা। নিটন পুকুর ঘাটে এসে বসল। পদ্মের মেলা তার দু'চোখে প্রেম ভাবনার বিস্তার ঘটালো। গভীর ভাবনায় সে যখন ডুবে গেল ঠিক তখনই মিলা নিটনের কাঁধে হাত রাখল। নিটন চমকে উঠল। নিটন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিলার দিকে-
কি দেখছ ?
নীল পদ্মটাকে ।
সে তো পুকুরের মাঝে। আমার দিকে নয়।
না, সে আমার পাশেই বসে আছে। নীল পোশাকে জড়িয়েছ তোমার ঐ সুন্দর দেহটাকে। তাইতো তুমি একটি নীল পদ্ম আমার চোখে।
খুব সুন্দর করে কথা বল। আর এ ভাবে তাকিয়ে আছো কেন? কি দেখছ?
তোমাকে, তোমাকে দেখছি।
আমাকে-
হ্যাঁ, তোমাকে।
কেন?
ভালোলাগে এবং ভালবাসি বলে। মিলা আমি তোমাকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসি।
আমিও তোমাকে ভালোবেসেছি অন্তর দিয়ে। তাইতো ছুটে এসেছি তোমার কাছে। রেখেছি হাত তোমার হাতে। নিটন তোমার এ হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখো সারাটি জীবন। ছেড়ে যেওনা আমাকে কভূ। কথা দাও, কথা দাও।
কথা দিলাম। মৃত্যুর পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত জড়িয়ে রাখবো তোমাকে আমার বুকে।
নিরাবতায় বসে আছে। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল। কারো মুখেই কোন কথা নেই। দু’জনেই মনে মনে ভালোবাসার রঙ্গিন কাগজে ভালোবাসার ছবি আঁকছে। রোদের আলো গাছের ফাঁকা দিয়ে এসে মিলার চোখে পড়াতেই মিলা ঘুরে বসলো নিটনের দিকে। মিলা আল্ত করে নিটনের হাতে হাত রাখল। নরম কোমল হাতের ছোঁয়াতে নিটন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলো। মনোরম একটা পরিবেশে মিলা যখন নিটনের হাত ধরল খুব সুন্দর একটা অনুভূতি বিরাজ করল নিটনের মনে। মূহুর্তেই ভালোবাসার রঙ্গিন জগতে হারিয়ে গেল-নিটন।
নিটন-
হুঁ, বল।
নিজের অজান্তে তোমাকে ভালোবেসেছি। কখন যে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি নিজেও জানিনা। নিটন তোমাকে একটা প্রশ্ন করি।
কি প্রশ্ন ?
তুমি কি এভাবে ভালোবেসে আগলে রাখবে তোমার হৃদয়ের মাঝে আমাকে।
হাসছ কেন ?
তোমার কথা শুনে।
আহ্ বলনা ।
যদি বলি না এভাবে ধরে রাখব না তোমাকে। তোমাকে কিছুদিন পরে ভুলে যাব এবং অন্য আর একজনকে ভালোবাসব। তাহলে কি হবে।
মরে যাব।
কেন মরে যাবে?
কারন এই প্রথম যে কাউকে ভালোবেসেছি। আর সেই যদি ভুলে যায় কিংবা দুঃখ দেয় তবে বেঁচে থাকব কিভাবে।
তাই-।
হ্যাঁ তাই।
তুমি এতটা ভালোবাস আমায়।
হ্যাঁ, তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি। আমার জীবনের চেয়েও বেশী ভালোবাসি।
আচ্ছা যদি বলি সারাটি জীবন তোমাকে আমার বুকের মাঝে রাখব।
আনন্দে মাথা রাখব তোমার বুকে।
তাই-
হ্যাঁ তাই।
মিলা, এই প্রথম যে আমিও তোমাকেই ভালোবেসেছি। তোমাকে বসিয়েছি আমার হৃদয়ের কোঠরে। বিধাতা যদি তোমাকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় আমার কাছ থেকে তাহলেও তুমি থাকবে আমার এই হৃদয়ের কোঠরেই।
মিলা বাচ্ছা শিশুর মত লুটিয়ে পড়ল নিটনের বুকে। কিছুক্ষন শক্ত করে ধরে রাখল নিটনকে। বুক থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে নিটনের চোখের দিকে ভালোবাসার রঙ্গিন চোখ দিয়ে তাকিয়ে রইল। মিলার চোখ ভরা ভালোবাসায় নিটন হারিয়ে গেল প্রেম সাগরে। ভালোবাসায় যে কতটা সুখ তা নিটন উপলদ্ধি করে নি। আজ সে তা উপলদ্ধি করল। নিরাবতায় দুজনে আবার।
মিলা তোমাকে একটা কবিতা বলি, মনোযোগ দিয়ে শুনো-
হ্যাঁ বল-
আমার ভালোবাসার প্রিয় ফুল,
করিনু অর্পন,
তোমার স্নেহের অপূর্ব হাতে।
যতন করিও তাকে,
তোমার সুন্দর কোমল হাতে।
দেখিও তাকে,
তোমার অপূর্ব মায়াবী চোখে।
রাখিও তাকে,
তোমার স্নেহময়ী আচল তলে।
আমার ভালোবাসার প্রিয় ফুল,
করিনু অর্পন,
তোমার স্নেহের অপূর্ব হাতে।
ভালোবেস তাকে,
তোমার মমতাময়ী হৃদয় দিয়ে ॥
শুনেছ-
হ্যাঁ! শুনেছি।
কিছু বুঝলে এ থেকে।
ঠিক বুঝতে পারলাম না।
বুঝতে পারনি, শোন তবে- কবি তাঁর প্রিয় ফুল বলেছেন, তাঁর সন্তানকে। আর আমি বুঝিয়েছি আমার হৃদয়কে। আর তাই তোমার কাছে চাওয়া-তুমি কখনো আমার এ হৃদয়কে ব্যাথা দিও না।
নিটন, আমার ভালোবাসার উপর বিশ্বাস রাখ। তোমাকে আমার ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে রাখব। আর তুমিও আমাকে ব্যাথা দিওনা।
মিলা ঘড়ির দিকে তাকিয়েই উঠে দাড়ালো। মনে মনে বলল বারোটা বেজে গেছে।
কি হলো ? উঠে দাড়ালে যে।
আজ চলো।
কেন, আর একটু বসি।
না-আর বসা সম্ভব হবে না।
কিন্তু তোমাকে ছাড়তে যে ইচ্ছে করছে না।
আমারও তোমাকে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু তারপরও যে যেতে হবে।
আচ্ছা কেন আমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না।
কারন তুমি একটা আঠা। আঠা দিয়ে যে ভাবে কাগজ লাগায় তেমনি তুমিও আমাকে তোমার সাথে লাগিয়েছ। কটা বাজে দেখেছ।
দেখেছি । একটা ত্রিশ।
দু’টায় ক্লাস শেষ। মা নিতে আসবেন।
এত বড় মেয়েকে এখনও মা নিতে আসেন।
হ্যাঁ নিতে আসেন।
কেন তোমার মার ধারনা তার রুপসী কন্যাকে কেউ কিড্নাফ করবে।
জ্বি না ।
তবে কি ?
মা আমাকে খুব বেশী ভালোবাসেন।
যাও । আবার দেখা হবে কবে।
কেন তোমার সাথেতো প্রতিদিনই দেখা হবে।
আমি এভাবে দেখা হবার কথা বলিনি।
তবে--! কোন ভাবে ?
আমরা অন্য কোথাও বেড়াতে যাব।
অন্য কোথাও !
হ্যাঁ । পনের তারিখে কলেজে একটা অনুষ্ঠান আছে। তা কি জান?
হ্যাঁ-জানি।
ঐ দিনই বেড়াতে যাব।
আচ্ছা ঠিক আছে।
ভোরের সোনালী রোদের মিষ্টি রশ্মি জানালার কাঁচ ভেদ করে মিলার আঁদো ঘুম চোখে পড়ল। মিলাকে ঘুম থেকে ওঠার জন্যে। চোখ মেলে ঘড়ির দিকে তাকালো। ৭টা বাজে। ভোরের মিষ্টি রোদের একটু ছোয়া পেতে বিছানায় একটু গড়াগড়ি খেয়ে উঠে পড়ল। সিড়ি বেয়ে ছাদে আসলো।মায়ের ডাকে সাড়া দিতে নেমে এল মিলা।
টেবিলে নাস্তা দেয়া হয়েছে, খেতে আয়।
আসছি মা।
আজ শুক্রবার। তাই প্রতিদিনের থেকে একটু আলাদা ধরনের নাস্তা তৈরী করা হয়েছে। অবশ্য এ নাস্তাটা মিলার সবচেয়ে প্রিয়।
মিলা
জ্বি-মা, কিছু বলবে ?
হ্যাঁ আমি বাড়িতে যাব। তোমাকে দু-তিন দিন একা থাকতে হবে। পারবে না।
পারব। কিন্তু কেন যাবে, আসবে কবে ?
দু-তিন দিন পরেরই আসব। খবর পেলাম তোমার নানু অসুস্থ, তাকে দেখতে যাব।
আবুল একটা ট্যাক্সি নিয়ে আয়।
জ্বি যাচ্ছি।
মিলা, মাকে এগিয়ে দিতে বাড়ির গেটের কাছে এল। মাকে ট্যাক্সিতে তুলে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। যদিও দীর্ঘশ্বাসটা ছিল আনন্দের। মিলা ঘরে প্রবেশ করেই রিসিভারটা তুলে নিল নিটনকে রিং দেবার জন্য।রিসিভারটা তুলতেই মিষ্টি একটা কন্ঠ নিটনের মনের গভীরে সুখের পরশ বুলিয়ে দিল।
কেমন আছ ?
প্রভাতে তোমার ফোন, ভালো না থেকে কি আর পারি।এখন ফোন করেছ কেন ?
কেন তোমার কাছে ফোন করতে সময় লাগবে নাকি ?
ঠিক তা নয়----।
তবে কি ?
এত সকালেতো তুমি আমাকে রিং দাওনা, তাই।
ও একথা। আজ দিলাম, তোমাকে একটা সু-সংবাদ দিব বলে।
কি এমন সু-সংবাদ যা এই সকালে দিতে হবে।
মা আজ বাড়ী গেছেন।
এটা কোন সু-সংবাদ হলো।
হ্যাঁ , হয়েছে। কারন আজ ঘুরতে যাব।
আজ কেন ?
আমার মন আজ যেতে চাচ্ছে।
ঠিক আছে। কখন এবং কোথায় আসবে।
কেন তুমিই তো বলেছ আমাকে নিয়ে সুন্দর একটা জায়গায় যাবে।
আজ সেখানে যাব না। আজ অন্য কোথাও যাব।
মিলা ফোন রেখে নিজের ঘরে যেতে যেতে কাজের বুয়াকে গোসলের পানি দিতে বলল। মিলা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল ঠিক করতে লাগল। মনে মনে ভাবতে লাগল তার জীবনের সব কথা গুলো নিটনকে বলবে। কিন্তু তার মনের মধ্যে একটা ভয় কাজ করছে। তারপরও মনে মনে ঠিক করে রাখল জীবনের সব কথা গুলো নিটনকে বলবে। মিলা একা একা দাড়িয়ে আছে। দু’টা দশ। নিটন এখনও আসছে না। যত লোক বেড়াতে আসছে ধানমন্ডি লেকে তারা প্রায় সবাই একবার তাকাচ্ছে মিলার দিকে। মিলার খুব অসস্থিকর লাগছে। রাগে সমস্ত শরীর পুরে যাচ্ছে মিলার। মনে মনে বলতে লাগল আমাকে কি খুব বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে। না কি আমি একটা চিড়িয়াখানার পশু। কেন লোকজন এভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছে ? মিলার চোখ পড়ল রাস্তার বিপরীত পার্শ্বে দাড়ানো একটা লোকের উপর।লোকটা কালো, মোটা, চোখ দু'টো বড় বড়। রাক্ষুসে দু'টো চোখে তাকিয়ে আছে লোকটা। আশ্চর্য, লোকটা এভাবে তাকিয়ে আছে কেন ? একটাও পলক দিচ্ছে না চোখে। মনে হচ্ছে এখনি খেয়ে ফেলবে আমাকে। নিটন তুমি কোথায়, চলে এস এখনি। এসে উদ্ধার কর আমায়, তানা হলে তোমার প্রিয়াকে ও খেয়ে ফেলবে।
একটা রিক্সা এসে দাড়ালো মিলার সামনে। রিক্সায় নিটন কে দেখে মিলার মনে একটু সস্তি এবং সাহস এল। মিলা ফিরে পেল তার চলার শক্তি। তবে ভয়টা তার চোখ-মুখ থেকে বিদায় নিচ্ছে না। তার মধ্যেও যে অভিমানটা কাজ করছে নিটনের উপর তাকেও সামাল দিতে পারছে না। নিটন রিক্সা বিদায় দিয়ে মিলাকে নিয়ে লেকের পাশ ধরে হাটছে। দু’জনের কারো মুখেই কোন কথা নেই। নিশ্চুপ ভাবেই হাটতে লাগল তারা। মিলার হাত ধরল নিটন।দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল মিলা। নিটনের দিকে তাকাতেই অভিমানের সব কথা ভুলে গেল মিলা। কিছুই বলতে পারল না তাকে। ভালোবাসার মানুষকে কাছে পেলে সব কিছুই ভুলে যায়, এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। আর সেটাই ঘটেছে মিলার বেলাতেও।
মিলা, চল ওখানটাতে বসি।
নিটন- ভালোবাসার রং কি ?
জানিনা, তুমি বল।
নীল।
নীল ! নীল কেন ? অন্য কোন রং হতে পারে না।
না, পারে না। কেননা বিষের রং নীল।
বিষের রং নীল তাতে ভালোবাসার রং নীল হবে কেন ?
এজন্যেই হবে যে, মানুষকে যখন কোন বিষাক্ত প্রানী ধ্বংশন করে তখন তার সমস্ত শরীর বিষে নীল হয়ে যায়।
হু, বুঝতে পেরেছি। তা বিশ্লেষনী নারী হঠাৎ এ ধরনের প্রশ্ন আপনার মনে জাগল কেন ?
এ কারনেই জেগেছে যে, আজ আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন একটা কথা তোমাকে জানাব। সেটা জনা তোমার খুবই প্রয়োজন এবং আমার তোমাকে বলাটাও খুবই প্রয়োজন। আর তাই এধরনের প্রশ্ন করা।
তোমার জীবনের এমন কি কথা যেটা বলার প্রথমে এ ধরনের প্রশ্নটা করতে হলো।
কথা গুলো জানার পরে যদি তুমি আমাকে ভুলে যাও, তাহলে ভালোবাসার বেদনার বিষে আমার সমস্ত শরীর নীল হয়ে থাকবে সারা জীবন।
তাহলে কথা গুলো না বললেই তো হয়।
না-বলাই ভালো -
আমি খুব সাধারন মধ্যবৃত্ত ঘরের মেয়ে। তুমি যাকে আমার মা হিসাবে জান সে আমার সত্যি কারের মা নয়। আমি তার পাল্লক মেয়ে।
কি বলছ তুমি ?
হ্যাঁ, যা সত্যি তাই বলছি।
তাহলে তোমার মা--!
আমার মা উনি পাগল। আমি যখন আমার মায়ের গর্ভে, তখন আমার বাবা মাকে রেখে চলে যান। মানে উনি অন্য মহিলাকে বিয়ে করেছেন। তারপর থেকেই আমার মা মেন্টালী অসুস্থ হয়ে পরেন। সে অবস্থায় আমার জন্ম হয় হাসপাতালের বারান্দায়। সেখান থেকে আমাকে নিয়ে আসেন আমার মা (এই ভদ্র মহিলা, যার কৃপায় আমি বেঁচে আছি) øেহ, মায়া-মমতা দিয়ে আমাকে বড় করেছেন। কখনই বুঝতে দেননি মায়ের অভাব, বাবার অনুপস্থিতিতা।
কান্না ধরে রাখতে না পেরে মিলা বাচ্চা মেয়ের মত কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। নিটন তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল-
মিলা আমি তোমার অতীতকে ভালোবাসিনি, তোমার বর্তমান এবং ভবিষ্যতকেও না, আমি ভালোবাসি তোমাকে শুধু তোমাকে।
নিটন তুমি আমাকে কখনো ভুলে যেওনা, ফেলে দিওনা তোমার বুক থেকে। এভাবে রেখ সারা জীবন।
তোমাকে আমার বুকের মাঝে রাখব যতদিন এই পৃথিবীতে বেঁচে আছি। মিলা তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?
কি--
আচ্ছা তোমার মা এখন কোথায় ?
মা- মা আমাকে রেখে অনেক দূরে গেছেন। যেখানে গেলে কেউ আর কখনো ফিরে আসতে পারে না। জান আমি বড় একটা ব্যাথা বুকে নিয়ে এই পৃথিবীতে বাস করছি।আমার চেয়ে দুঃখি এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই। যখন এই পৃথিবীতে পা রাখলাম তখনই মা বিদায় নিলেন পৃথিবী থেকে।
তোমার বাবা-মায়ের এই কথা গুলো তুমি জানলে কি করে?
যাকে এখন আমি মা বলে জানি। তার ডায়রীর পাতা থেকে।
ওটাতো অন্য কারও হতে পারে।
না ওটা আমার। কেননা ওখানে আমার নাম উল্লেখ করা আছে। আর তাছাড়া লেখাটা পড়ার পড়ে আমি মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। আমাকে বলেছেন তিনি। যাই হোক চল, আজ আর বসব না।
দু’জনে পাশাপাশি হাটতে লাগল। নিটন মিলার হাত চেপে ধরল আর বলল-
ওটা তোমার জীবনের একটা দুর্ঘটনা। এজন্যে আমি তোমাকে কোন দোষ দেই না। মানুষের জীবনে অনেক ধরনের ঘটনা ঘটে। তাই বলে আমি তোমাকে ছেড়ে যাব, না তা নয়। তুমি যেনে রাখ আমি তোমাকে ভালোবাসি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি।
চয়ন নীলিমার দিকে গম্ভির চোখে তাকিয়ে বলল- আমি তোমাকে ভালোবাসিনা।
কেন চয়ন ! তুমি আমাকে ভালোবাসনা।
মন চায়না তাই।
মন চায়না ! কেন মন চায় না ? আমার কি রূপ-যৌবন, নাকি আমার বাবার অর্থ সম্পদ নেই।
না, তা ঠিক না। তোমাদের সবই আছে।
তবে আমাকে ভালোবাসতে দোষ কোথায়?
দোষ একটাই ।
দোষটা কোথায় বলো।
শুনতে চাও দোষটা কোথায়-
হ্যাঁ আমি শুনতে চাই।
তবে শোন- এ কারনেই আমি ভালোবাসতে পারি না তোমাকে, ভালোবাসার যে কত মূল্য তা আমার মত সাধারন পরিবারের ছেলেদের পক্ষে দেয় সম্ভব না।
কেন দিতে পারনা ।তোমার কি মন বলতে কিছু নেই ?
মন থাকলেও আজ আর ভালোবাসা হয় না।
কেন হয় না ?
ভালোবাসা আজ খেলা ঘর তাই।
মিথ্যে। ভালোবাসা আজও বেঁচে আছে। সে খেলা ঘর নয়।
হ্যাঁ বেঁচে আছে। কিন্তু তা টাকা ওয়ালাদের জন্য। আমাদের জন্য নয়।
চয়ন আর সব লোকদের মাঝে আমাকে দেখনা। আমি তোমাকে ভালোবাসি আর তোমাকে ভালোবাসা দেব।
ভালোবাসা দিতে চাইলেই কি গ্রহন করা যায়।
তুমি এমন করছ কেন?
আমি করছি না, বর্তমান সমাজ করছে।
তুমি বর্তমান সমাজের প্রতি এত দূর্বল কেন ?
না শুনে তুমি ছাড়বে না ?
আমাকে শুনতেই হবে।
শোন- আজ-কালকার মেয়েরা শুধু একজনের সাথে প্রেম করে না। সর্ব নিু চার জনের সাথে প্রেম করে। তারপর এই চার জনের মধ্যে যার জীবনে উজ্জ্বল প্রদীপ জ্বলতে থাকে তার সাথে ঐ সুন্দরী রমনী সুখের স্বর্গে হারিয়ে যায়। আর ঐ পুরুষ গুলো হয় সমাজ বিরোধী। আর এই প্রেম আমি করিনা। এটা নিয়ে তুমি ভাবতে পার আমি পারিনা।
তোমার লেকচার শেষ।
হ্যাঁ-তবে লেকচার নয় এটাই বস্তব কথা এবং সত্যি।
চয়ন, তোমাকে আগেই বলেছি অন্যান্য মেয়েদের সাথে আমাকে তুলনা করো না।
কেন করব না। তোমার গ্রান্টি কি ?
আমার গ্রান্টি আমার ভালোবাসা।
তোমার ভালোবাসা !
হ্যাঁ। তুমি একবার বলো তোমাকে ভালোবাসি। আমি তোমাকে হাজার সিকুরিটি দিব। তোমাকে কোন দিন ভুলবো না। তোমার হয়েই থাকব সারা জীবন। আর যদি তা না হয় তবে এই সুন্দর পৃথিবী থেকে চলে যাব।
কিন্তু আজ ভালোবেসে যে সুখ তুমি আমাকে দিবে সে সুখ কি আমাকে তুমি চিরদিন দেবে নীলিমা।
হ্যাঁ চয়ন তোমাকে সারাটি জীবন আমার সব ভালোবাসা দিব।
সত্যি বলছ নীলিমা।
হ্যাঁ সত্যি বলছি। আর আজ থেকে আমি তোমাকে ভালোবাসি। চয়ন তুমি আমাকে ভালোবাস।
হ্যাঁ- তোমাকে ভালোবাসি। তবে তুমি কোনদিন আমাকে দু:খ দিওনা।
নীলিমা আনন্দে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাগানে চয়নকে জড়িয়ে ধরে ঘাসের উপরে জড়াজড়ি করার পরে চয়নের গালে-মুখে চুমুতে চুমুতে প্রেমের নেশায় ভরে তুলল। সহসা চয়ন নীলিমাকে বুকের সাথে দু’হাত দিয়ে চেপে ধরল।
চয়ন আজ তুমি আমাকে ভালোবাসা দিয়ে অনেক দিনের সাধনার ফল দিয়েছ। তাতে পেয়েছি অনেক সুখের সন্ধান। যা আমি কোনদিন ভুলতে পারব না।
ওদের কথার ফাঁকে ক্লাসের কয়েক জন বন্ধু এসে মৃদু হেঁসে বলল-
এই দেখ দেখ ওরা নতুন প্রেম জমিয়েছে।
মিলা, তোরা বুঝি প্রেম-ভালোবাসা জমাস না।
হ্যাঁ জমাই।
তবে আমাদের বেলায় দোষটা কোথায়।
দোষটা কোথাও না। রাগ করিস না বন্ধু। চল আমরা সবাই মিলে একটু বানিজ্য মেলায় আড্ডা দিয়ে আসি।
তা মন্দ বলনি। চলো চয়ন ঘুরে আসি।
চয়ন একনজর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বানিজ্য মেলায় ঘুরতে গেল। ধানমন্ডি লেকের কিনারায় বেশ কয়েক জন এক অনন্ত সুখের হাস্য-রহস্য গল্পে মেতে উঠেছে। বেশ ভালোই লাগছে। বহুদিন পর মনভোলানো সবাইকে ভালোবেসে যাওয়া দক্ষিনা হাওয়া কোথা থেকে যেন এসে অমৃত স্বাদ সবাইকে দিয়ে গেল। আর তাই এই ভালোলাগার মাঝে নীলিমার ইচ্ছা জাগলো চয়নকে তার বাড়ীতে নিয়ে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার।
চয়ন তোমাকে আমার সাথে একটা জায়গায় যেতে হবে।
কোথায় ! কোথায় নিয়ে যাবে ?
যেখানে ইচ্ছা। তুমি যাবেনা আমার সাথে।
যাবনা কেন, তবে তোমার মাথা ঠিক আছেতো।
নীলিমা বলার আগেই মিলা বলল-
নতুন প্রেমে পড়লে কারো মাথা কি ঠিক থাকে।
সবাই হা-হা করে হেসে উঠল। আর ওমনি নীলিমা বলল-
এই মিলা, আমার ভালোবাসা নিয়ে তোরা কিন্তু বেশী কথা বলছিস। আর যদি কখনো রসিকতা করিস তাহলে কিন্তু-------
কি হলো, তাহলে কি করবি ?
তাহলে--- মানে, তাহলে তোদের সবাইকে আমাদের বিয়ের দাওয়াত খেতে হবে।
এ কথায় সবাই আরো আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ল। নীলিমা চয়নের হাত ধরে উঠে পড়ল।
চয়ন চলো আমরা যাই।
নিটন ফট করে বলল-
আরে তোরা কোথায় যাচ্ছিস। এখনই কি বিয়ের কাজ সেরে ফেলবি।
আরে বোকা না। অন্য একটা কাজে যাচ্ছি।
কাজে যাও আর যাই কর আমাদের না বলে কিন্তু তোরা বিয়ের পিড়িতে বসিস না।
ঠিক আছে, তোদের না জানিয়ে কিছুই করব না।
লেক থেকে বের হয়ে রিক্সা নিয়ে পান্থ পথ মোড়ে একটা বাড়ির সামনে দাড়ালো। রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে ওরা দু’জন নেমে দাড়ালো। চয়ন বিরক্ত মুখে জিজ্ঞেস করল-
এখানে নিয়ে এলে কেন ?
কেন আমার ভালোবাসার মানুষকে যেখানে খুশি নিয়ে যাব। নাকি তাতে কোন সমস্যা আছে।
তা পার। তাতে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু এখানে কেন ?
ঐযে বাড়ীটা ওটা আমাদের। আর বাড়ীতে নিয়ে এসেছি এ কারনেই যে, আমার বাবা-মায়ের সাথে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে।
কি বলে পরিচয় করিয়ে দিবে ?
কেন, তাদের বলবো- মা-বাবা ও আমার বন্ধু এবং আমি ওকে ভালোবাসি।
ঠাট্টা করনা। আমার ভয় লাগছে।
চয়ন ঠাট্টা করছি না। আমার ভালোবাসার মানুষ আমার বাড়িতে আসবে না এটা কি করে হয়।
হ্যাঁ তা ঠিক আছে। কিন্তু-----
কিন্তু কি ?
কেউ কি কখনো এই দুপুরে কারো বাড়ীতে আসে ? আর তাছাড়া তোমার বাবা-মাই বা কি ভাববেন।
নীমা। নীলিমার ছোট বোন। খুব চটপটে ধরনের মেয়ে।
আপু এখানে দাড়িয়ে আছিস কেন ?
ও নীমা, কোথা থেকে এলি ?
আপু উনিকে ?
ও--ও, আমার বন্ধু। আমরা এক সাথে পড়ি। আর চয়ন ও আমার ছোট বোন-নীমা।
সালামালাইকুম ভাইয়া । কেমন আছেন ?
হ্যাঁ ভালো। আপনি ?
ভালো। আমাকে নাম ধরে বললেই হবে। আপনি করে বলার কোন দরকার নেই।
এখানে দাড়িয়ে আছিস কেন আপু, ঘরে চল।
ও যেতে চাচ্ছে না ?
কেন লজ্জা করছে। ও সব লজ্জা টজ্জা রেখে চলুন, ঘরে চলুন।
এই বলে নীমা পরিচিত লোকের মত চয়নের হাত ধরে বাসায় নিয়ে গেল। নীলিমার রুমে বসিয়ে বলল-
ভাইয়া আপুর সাথে কথা বলেন আমি আসছি।
নীমা মিষ্টি হেসে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। আর নীলিমা চয়নকে জড়িয়ে ধরে বলল-
কি ব্যাপার আমি এত বললাম তখন এলে না। আর হবু শালিকা হাত ধরতেই চলে এলে যে, ব্যাপার কি একবার দেখেই কি পছন্দ হয়ে গেল নাকি। শোন তোমাকে বলে দিচ্ছি আমাকে রেখে আবার ওর সাথে প্রেম করনা।
শত হলেও সেতো আমার শালী তার কথার অমান্য করি কিভাবে।
হু- তা বুঝলাম কিন্তু সাহেব অন্য দিকে যেন মোর না নেয়।
দেখ তুমি কিন্তু একটু বেশী বাড়াবাড়ী করছ।
রাগ করনা প্লিজ। ঠট্টা করলাম।
না এভাবে ঠাট্টা করবে না। তুমি চুপ থাক।
আচ্ছা ঠিক আছে এই চুপ থাকলাম।
নীলিমা অভিমানি দৃষ্টি ভঙ্গিতে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল। চয়ন কিছু পরে দেখে নীলিমার গাল দুটো আপেলের মত লাল টল টল করছে। অভিমানী সুখের বনটাতে ওর দৃষ্টি যেতেই দেখে প্রিয়ার বুকে ওড়না নেই। তাতে ওর চোখ যেন যৌন নেশায় ঝলসে যাচ্ছে। এমন পাহাড় উঁচু পাশা-পাশি দু’টো টকবকে কমলা চক্কর দিলে কেউ কি গভীর যৌন বনে হারিয়ে না যেয়ে পারে। চয়ন আস্তে আস্তে নীলিমার দিকে ঝুঁকে চেয়ারের সাথে চেপে দুই গালে চুমু খেতেই নীমার আগমন। সহসা দুজন দুদিকে সরে যেয়ে এটা-সেটা বলাবলী করতে লাগল। নীমা কোক হাতে মৃদু হাসি মুখে টেবিলে রাখল। একটি গ্লাস চয়নের হাতে দিতেই চয়ন বলে উঠল-
এগুলো করতে গেলে কেন ?
এ, এমন কি করলাম। তাছাড়া একটু গরমে একটু ঠান্ডা না হলে কি হয়।
ওরা খাওয়ার মাঝে একটু আনন্দ গল্প করছে। এর মধ্যেই নীলিমার বাবা-মা বাইরে থেকে এসে নীলিমার রুমে প্রবেশ করল। চয়নকে দেখে নীলিমা ও নীমার দিকে তাকালো। নীলিমা তা বুঝতে পেরে সহসা বলল-
বাবা-মা ও চয়ন। আমরা এক সাথে পড়াশুনা করি ।
ও-আচ্ছা।
চয়ন, আমার বাবা-মা।
সালামালাইকুম ।
উনারা অতি সহজ ভাবে সালামের উত্তর দিলেন। আর বললেন- তোমরা গল্প কর।
না-আঙ্কেল আজ উঠি । অন্য আর এক দিন আসব।
না সে কি করে হয়। এই দুপুরে কি কেউ কারও বাড়ি থেকে না খেয়ে যায়। দুপুরে খেয়ে যাবে।
না আঙ্কেল আর একদিন খাব।
তাদের কথার মাঝে নীমা বলে উঠল-
ভাইয়া আপনি কিন্তু বাবা-মায়ের কথা রাখছেন না।
না বোন আমি তা বলছি না । কিন্তু--------।
আর কোন কথা বলা চলবে না। আপনি আজ আমাদের সাথে দুপুরের খাওয়া খেয়ে যাবেন।
নীলিমা কম্পিউটার ছেড়ে দাও, ও গান শুনুক। না হলে তোমরা গল্প কর।
বাবা-মা এবং নীমা চলে গেল যার যার রুমে। আনন্দে এক ঝলক হাসি হেসে নীলিমা বলল-
কি ব্যাপার সাহেব- না পারলে হবু শালিকার হাত ছাড়তে, না পারলে হবু শ্বশুড়-শ্বাশুড়ীর কথা ফেলতে।
চয়ন কোন কথা না বলে নীলিমার হাত ধরে এক টানে বুকের সাথে চেপে ধরে দু’গালে কয়েকটা চুমু খেলো।
প্রভাতের সূর্য্য তার মিষ্টি আলো জানালা থেকে মিলার চোখের উপর পরশ বুলাল। মিলার ঘুম ঙেঙ্গে গেল। মিলা জানালার কাছে গিয়ে দাড়িয়ে রইল। বান্ধবী নীলিমা পিছন থেকে তার গায়ে হাত দেয়াতে নিরাবতা কেটে গেল। চমকে উঠল। ঘুরে তাকাতেই আরো চমকে উঠল। এক দৃষ্টিতে নীলিমার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন এই প্রথম কোন অচেনা মানুষ তার সামনে এসে দাড়িয়েছে।
কি হলো, এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন ?
তুই এত সকালে..!
এত সকাল.. কটা বাজে দেখেছিস।
কটা বাজে ?
ন’টা বাজে।
কিন্তু তোকে এভাবে দেখাচ্ছে কেন ?
তোর সাথে কিছু কথা আছে।
আচ্ছা তুই একটু বস, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
নীলিমা অবহেলিত নারীর মতো, অসহায় ভাবে বসে আছে। দু'চোখে পানি টলমল করছে। প্রচন্ড কষ্টে তার বুক ঙেঙ্গে যাচ্ছে।
কি বলবি বল?
মিলা-আমার একটা সমস্যা হয়েছে।
কি সমস্যা- চয়নের সাথে কিছু হয়েছে?
না-ওর সাথে কিছু হয়নি।
তবে-কি ?
চয়নের সাথে আমার সম্পর্কের কথা বাবা-মা জেনে গেছেন।
তারপর-
বাবা-মা আমাকে খুব বকাবকী দিয়েছেন এবং এও বলেছেন বাবা তাঁর কোন এক বন্ধুর ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছেন, আমাকে সেখানেই বিয়ে করতে হবে।
তুই কি বলেছিস?
আমি তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছি চয়নকে ছাড়া আমি কাউকেই বিয়ে করব না। কিন্তু তারা একথা শুনতে চাচ্ছেন না। তারা বলছেন, তাদের পছন্দের জায়গাতেই বিয়ে করতে হবে।
হ্যাঁ, এতো কঠিন সমস্যা। আচ্ছা, তুই চয়নকে জানিয়েছিস?
হ্যাঁ, জানিয়েছি।
ও কি বললো?
ও তোর সাথে এ ব্যপারে কথা বলতে চায়।
ঠিক আছে ওকে কাল কলেজে আসতে বল।
ঠিক আছে, আমি এখন আসি।
সেকি , দুপুরে খেয়ে যাবি।
না-আজ থাকব না, অন্যদিন খেয়ে যাব।
নীলিমা একরাশ ব্যাথা বুকে নিয়ে চলছে। পৃথিবীর সব কিছুই তার কাছে অর্থহীন মনে হচ্ছে। চয়ন তার জীবন থেকে হারিয়ে যাবে একথা কিছুতেই সে মেনে নিতে পারছেনা। তার সব স্বপ্ন গুলো ঙেঙ্গে যাচ্ছে।
নীলিমা- এই নীলিমা, এখানে বসে আছিস, কি হয়েছে, এই অবেলায় শুয়ে আছিস যে;
না- কিছু হয়নি মা- মাথাটা একটু ব্যাথা করছে তাই শুয়ে আছি।
চল- খেয়ে নিবি।
আমি পরে খাব, তোমরা খেয়ে নেও।
আচ্ছা- তোর কি মন খারাপ, কিন্তু কেন ?
মা তোমাকে একটা কথা বলি-
কি কথা, বল-
মা তোমরা কি আমার ভালো চাও, আমাকে কি তোমরা সুখি দেখতে চাও?
হ্যাঁ- চাই
তাহলে আমি চয়নকেই বিয়ে করব। মা চয়নকে না পেলে আমি বাঁচব না।
চয়ন-চয়ন-চয়ন ; তোর মাথা থেকে “চয়ন” নামটা ফেলে দে। আমরা যার সাথে বিয়ে ঠিক করেছি সে চয়নের থেকে অনেক ভালো। তারচেয়ে বড় কথা হলো- ছেলে শিক্ষিত এবং অনেক বড় চাকুরী করে।
তাহলে তোমাদের কথাই ঠিক থাকছে।
হ্যাঁ, এ কথাই থাকবে।
মা- আমার কথাটাও শুনে রাখ- যদি বিয়ে করতে হয় চয়নকেই বিয়ে করব। আর যদি ওকে আমার জীবনের সাথে না জড়াতে পারি তাবে এ পৃথিবীতে আমি থাকব না।
এই বলে নীলিমা তার ঘরের দরজা বন্ধ করে কাঁদতে রলই।
আফা.. ও আফা... (শেফা কাজের মেয়ে)
কি হয়েছে ; এত চেচাচ্ছিস কেন?
তাড়াতাড়ি আহেন, খালাম্মা যেন কেমন করতাছেন-
মিলা তার ঘর থেকে দৌড়ে মায়ের ঘরের দিকে এলো। প্রচন্ড ব্যাথায় বিছানার এপাশ-ওপাশ করছেন।
মা কি হয়েছে তোমার, এরকম করছ কেন?
বুকের প্রচন্ড ব্যাথা, নিশ্বাস নিতে পারছি না- খুব কষ্ট হচ্ছে।
শেফা ; মায়ের কাছে বস, আমি ডাক্তারকে ফোন করে আসি।
ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি করেন-
ডাক্তার আংকেল------
চিন্তা করনা, ইনজেকশনে ঘুমের ঔষধ দিয়েছি। সকালে এসে দেখব, যদি ভালো মনে করি তাহলে বাসায় ফুলরেষ্টে থাকবে, তা না হলে হাসপাতালে নিতে হবে।
কিন্তু কি হয়েছে মায়ের ?
এখনো বুঝা যাচ্ছে না-
আংকেল, যেভাবেই হোক মাকে সুস্থ করতে হবে। মা ছাড়া পৃথিবীতে আমার কেউ নেই।
হাসপাতালের বারান্ধায় বিষন্ন মনে হাটছে মিলা। মা খুব অসুস্থ। তাকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে। ডাক্তার কিছু পরীক্ষা করতে দিয়েছেন। মিলা একাই সব কিছু করছে। মিলা- তার ভাই এবং নিটনকে ফোন করেছে। রকিব (মিলার ভাই) এর আসতে একদিন দেরী হবে। নিটন চলে এসেছে।
খালার অবস্থা কি ?
মাকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে।
ডাক্তার কি বলেছেন।
ব্লাড টেষ্ট, এক্সেরে, ই.সি.জি করতে বলেছেন।
ও-গুলো করা হয়েছে।
হ্যাঁ, করা হয়েছে, এখনো রিপোর্ট দেয় নি।
রিপোর্ট আনার জন্য নিটন বের হলো। মিরা তার মায়ের পাশে বসা। ডাক্তার কেবিনে আসল।
রিপোর্ট গুলো আনা হয়েছে-
জ্বি না। রিপোর্টের জন্য পাঠানো হয়েছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই নিয়ে আসবে।
রিপোর্ট নিয়ে এলে আমার রুমে আসবেন।
জ্বি-। মার কি হয়েছে?
রিপোর্ট না এলে কিছুই বলা যাচ্ছে না। তবে সুবিধা মনে হচ্ছে না।
রাত ৮ টা বেজেছে। নিটন ও মিরা ডাক্তারের রুমে গেল। ডাক্তার রিপোর্ট গুলো যতœ সহকাওে দেখছেন। রিপোর্ট গুলো টেবিলে রাখল, নিরুপায় চোখে ডাক্তার মিলার দিকে তাকালেন।
আপনার বাবা কোথায় ?
বাবা নেই। উনি অনেক আগেই এ পৃথিবী থেকে চলে গেছেন।
আর কেউ নেই?
আছেন, আমার বড় ভাই। চিটাগং এ থাকেন। ফোন করা হয়েছে। সকালে চলে আসবেন।
মিলাকে দেখতে খুব অসহায় মনে হলো ডাক্তারের। কিন্তু কোন উপায়ও নেই, ডাক্তারকে তো বলতেই হবে ওর মার কি হয়েছে। আর এও বলতে হবে যে, তার মা বেশী সময় এই পৃতিবীতে থাকবেন না।
মার কি হয়েছে?
ওনার হার্ট ব্লোক করেছে। আর------
আর কি ! থেমে গেলেন কেন?
উনি সম্ভাবত ২/১ দিন বাচঁবেন।
মিলার চোখ থেকে টপ টপ করে পানি ঝড়তে থাকে। নির্বাক মুখে মিলা মায়ের পাশে বসল। নিটন ও বাসায় যায়নি। রকিব এসেছে। মিলা রকিবকে দেখে শিশুর মত জড়িয়ে ধওে কাদঁতে লাগল আর বলতে লাগল- ভাইয়া ডাক্তার বলেছেন মা ২/১ দিন বাচঁবেন। মায়ের জ্ঞান ফিরেছে। রকিব, মিলা এবং নিটন মায়ের পাশেই বসা। মা রকিবকে কাছে ডেকে বলল-
রকিব-বাবা, মিলা তোর আপন বোন না, কিন্তু ওকে কোন দিন আমি কষ্ট পেতে দেইনি। তুইও ওকে কষ্ট পেতে দিবি না। ও নিটনকে ভালোবাসে। ওকে নিটনের হাতে তুলে দিস।
চিরদিনের জন্য নিশ্চুপ হয়ে গেলেন মা। দুই ভাই-বোনের কান্না নিটনের বুকে প্রচন্ড জোরে আঘাত হানে। নিটনের মুখে কোন শান্তনা বনি নেই। সে অবুঝ শিশুর মত, নির্বাক মুখে দাড়িয়ে আছে।
নীলিমাকে নিয়ে মিরা তার এক দূরসম্পর্কের খালার বাড়ীতে উঠল। খুব বিশাল বাগান চার পাশে বিভিন্ন ধরনের গাছ-পালায় সাজানো একটা বাড়ী, চারটা রুমের একটা বাড়ী। এখানে খালা একাই থাকেন। তার কোন ছেলে-মেয়ে নেই। স্বামী মালেশিয়াতে থাকেন। খালা তার ঘরে শুয়ে আছেন।
খালা.. ও খালা, কোথায় তুমি।
কে-- ?
আমি, মিলা--
মিলা ! কোথা থেকে এলি। এরা-------
বাড়ী থেকে। আর ওরা আমার বন্ধু।
নীলিমা, চয়ন আমার খালা।
খালা তোমার সাথে কিছু কথা আছে।
কথা আছে তো বলবি। এখন ওদেরকে নিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে বিশ্রাম নে। পরে শোনা যাবে।
মিলা একা একা বাগানের দিকে হাটতে লাগল। একা বাগানে হাটতে মিলার ভালোই লাগছে। খুব সুন্দর একটা গন্ধ বাতাসের সাথে ভেসে আসছে। কিসের গন্ধ ! জানার ইচ্ছা জাগল মিলার মনে। খালা বলেছিলেন- বাগানে একটা হাছনাহেনা ফুলের গাছ আছে। ফুলের গন্ধটা খুব সুন্দর। সম্ভাবত সেই ফুলেরই গন্ধ। মিলা সামনের দিকে হাটতে লাগল। মাঝারি ধরনের একটা গাছ। গাছটার চারিদিকে ডাল-পালা ছড়িয়ে আছে। প্রতিটা ডালে ছোট ছোট থোকে সাদা রংয়ের ফুল ফুটে আছে। গাছটা দেখতে মিলার চোখে খুব সুন্দর। গাছের নিচে দাড়ালো মিলা। তবে তার একটু একটু ভয়ও করছে। কেননা সে জানে যে গাছের ফুলের গন্ধ খুব মিষ্টি সে গাছে বিষাক্ত ধরনের সাপ থাকে। তারপরও মিলা গাছের পাশ ঘেঁষে দাড়ালো। নিটনের কথা মিলার খুব মনে পড়লো এবং নিজের মন থেকে জানতে চাইল- নিটন তুমি কোথায় ? আমার পাশে তুমি এখন যদি থাকতে তুমিও উপভোগ করতে পারতে এই সুন্দুর মূহুর্তটাকে। সন্ধা হয়ে আসছে। মিলা ঘরের দিকে আসল। খালা চা-নাস্তা নিয়ে আসছেন। চা-নাস্তা খেতে খেতে মিলা নীলিমা ও চয়ন সম্পর্কে সব কথা খালাকে খুলে বলল।
ঠিক আছে, কোন সমস্যা নেই। ওরা আমার কাছেই থাকবে। আর আমিও তো এই নির্জন বাড়ীতে একাই থাকি। ওরা থাকালে আমার ভালোই হবে।
চয়ন নির্জন বাগানে একা একা হাটছে। নীলিমা চয়নকে একটু ভয় দেখানোর চেষ্টা করল। কিন্তু চয়ন ভয় পেলনা। নীলিমার উপস্থিতি তাকে উৎসাহিতও করল না। সে চিন্তিত মনে হাটছে।
চয়ন তোমাকে এরকম চিন্তিত লাগছে কেন?
কোথায়--- চিন্তিত লাগবে কেন ?
তবে কি তোমার শরীর খারাপ ?
না-- তাও না। ভাবছি অনেক দিন হল আমরা খালার উপর পরে আছি। অনেক চেষ্টা করলাম কোন কাজ যোগার করতে পারলাম না।
হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছি।
ঘরে ওদের না দেখে খালা বাগানের দিকে আসল।
তোমরা এখানে কি করছ? আমি সব জায়গায় তোমাদেরকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। সন্ধা নেমে আসা সময় এই নির্জন বাগানে কি কেউ থাকে। চল চা দেয়া হয়েছে। চয়ন মিলা তোমাদের কিছু বলে গেছে ও কবে আসবে এরকম।
জ্বি খালা, সে আগামী মাসের প্রথম দিকে আসবে।
খালা শুয়ে আছেন তার ঘরে। চয়ন এবং নীলিমা টিভি দেখছে। এমন সময় মিলার উপস্থিতি। চয়ন, নীলিমা দুজনেই মিলার দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে।
কি হলো- এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? আমাকে কি নতুন দেখছিস।
না তুই এ সময় !
কেন ? কোন সমস্যা করলাম।
না তোর তো এমাসের শেষের দিকে আসার কথা ছিল।
হ্যাঁ- কিন্তু ভালো লাগছে না তাই চলে এলাম। আচ্ছা খালা কোথায়?
রুমে আছেন।
মিলা খালার ঘরের দিকে গেল। খালা খাটের উপর বসে কোরআন পড়ছেন। মিলা খাটে বসল নিশ্চুপ ভঙ্গিতে। কোরআন পাঠের সময় কথা বলতে হয় না। তাই মিলা কোন কথা বলছেনা। খালা কোরআন পাঠ শেষ করে মিলার দিকে ঘুরে বসলেন।
কেমন আছ ?
জ্বি-ভালো। তুমি কেমন আছ খালা।
ভালো, তোর ভাই-ভাবী কেমন আছে?
ভালো আছে।
তা এই সন্ধায় এলি যে, আরো আগে আসলিনা কেন?
বিকেলের মধ্যেই আসতাম। কিন্তু পথে একটু ঝামালা হলো তাই আসতে দেরি হয়েছে।
কি ঝামেলা?
তেমন কিছু না। গাড়ীর চাকা পান্চার হয়েছিল।
ও-আচ্ছা।
খালা, ওদের দ্বারা তোমার কোন সমস্যা হয়নি তো।
না-কি সমস্যা হবে। বরং ওরা থাকাতে আমার সময়টা ভালো কাটছে। আচ্ছা এ কথা কেন বললি।
না মানে হুট করে ওদের কে রেখে গেলাম কিনা।
আচ্ছা তুই ওদের সাথে গল্প কর। রাতের রান্নাটা শেষ করি। তারপর কথা হবে।
ঠিক আছে, খালা শোন চয়নের জন্য একটা চাকরি ঠিক হয়েছে। তুমি ওদের কে এখন বলোনা কিন্তু। রাতে খাবারের সময় ওদেরকে একটা সার্প্রাইজ দেব।
ঠিক আছে, আমি রান্না ঘরে গেলাম।
কিরে কি করছিস তোরা।
কি আর করব। টিভি দেখা ছাড়া আর কোন কাজ নেই।
মিলা তোরা গল্প কর। আমি খালাকে একটু রান্নার কাজে সাহায্য করি।
চয়ন সাহেব আপনার খবর বলেন আর এখানে কেমন লাগছে। কি হলো। এভাবে বসে আছ কেন? তোমাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে যে।
কি আর করব। চিন্তা ছাড়া আর কিইবা করার আছে।
কেন! এত টেনশন করার কি আছে।
এত দিন হলো কোন চাকরী পাচ্ছিনা। আর উপরে আবার পড়ে আছি খালার কাছে। খালা কি মনে করছেন কে যানে।
দুর পাগল, তুমি খালাকে চেন না। উনি কিছুই মনে করছেন না। তাছাড়া তোমরা থাকাতে তার আরো সময় ভালো কাটছে।
তারপরও, আমার যেন কেমন লাগছে।
লাগা-লাগী বাদ দাও। এখন শোন আমি যার জন্য এখানে এসেছি।
কেন আসছ?
এখন তো বলা যাবে না। খাবার সময় সবাইকে একসঙ্গেই কথাটা বলব।
এখন বলা যাবে না কেন?
জ্বি না স্যার। এখন বললে যে আনন্দটা হবে, তারচেয়ে বেশী আনন্দ হবে সবাইকে সামনে রেখে বললে।
তুমি বস। আমি একটু ঘুরে আসি।
ঠিক আছে যাও। তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।
চয়ন বাজারের দিকে গেল। মিলা একা একা টিভি দেখছে। পলক বিহীন চোখে মিলা টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই খেতে বসলো, কিন্তু খালা আসছে না।
নিলীমা- খালা কোথায়?
নামাজ পরছেন।
তোমাদের জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
সারপ্রাইজ ----!
জ্বি বন্ধু সারপ্রাইজ।
সেটা কি জানতে পারি।
অবশ্যই জানতে পার, তবে একটু ধর্য্য ধরতে হবে।
নামাজ শেষ করে খালা ডাইনিং এ এলো।
কি ব্যাপার, সবাই বসে আছ কেন?
তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
আমার জন্য অপেক্ষা করছ কেন? খেয়ে নিলেই তো পারতে।
বাহ! তোমার বাড়ীতে আসছি, আর তোমাকে ছাড়াই খেয়ে নেব তা কি হয়। তাছাড়া এখানে তো একটা মজার কথা হবে, যা তুমি না থাকলে আনন্দটা হবে না।
খবরটা কি যা এতই আনন্দের ।
চয়নের জন্য একটা চাকুরী ঠিক করেছি।
তুমি কি করে চাকরী ঠিক করলে।
ভাইয়াকে বলেছিলাম। সেই ব্যবস্থা করেছে।
কথাটা শুনে চয়নের দুচোখ বেয়ে ঝর্না ধারায় পানি ঝড়ছে। এক দৃষ্টিতে মিলার দিকে তাকিয়ে আছে চয়ন। মনে মনে কয়েক বার মিলার পা ছুঁয়ে সালাম করল।
খালা দেখ, আনন্দের একটা সংবাদ। কোথায় একটু হাসি আনন্দ করবে তা রেখে বোকার মত চোখের পানি ফেলছে। এই কি হয়েছে, কাদঁছ কেন?
আনন্দে। খুব বেশী আনন্দেই মানুষের চোখ থেকে পানি পড়ে। মিলা তুমি আমাদের জন্য অনেক করেছ। অনেক ঋণ তোমার কাছে আমাদের। কি দিয়ে এই ঋণ শোধ করব তা আমি ভেবে পাচ্ছি না।
হয়েছে আর ন্যাকামো করতে হবে না। আগামী দুই দিনের মধ্যেই তোমাকে কাজে যোগ দিতে হবে।
নতুন চাকরী। চয়ন খুব আনন্দের সাথেই অফিস করছে। প্রথম মাসের মাইনের টাকায় মিলাকে খুব সুন্দর শাড়ী উপহার দিল ।
জামান, এই জামান ওঠ।
এত চিল্লাচ্ছিস কেন?
আজ মিলার জন্ম দিন। তোকেতো বলেছি, ওর জন্য কিছু কিনব। তাড়াতাড়ি চল।
রিক্সা নিয়ে মার্কেটের দিকে চলল দুই বন্ধু। নিটন নিশ্চুপ ভঙ্গিতে বসে আছে রিক্সায়। দু'চোখে অবিরাম স্বপ্ন বয়ে চলছে। প্রতি বছরই নিটনের পক্ষ থেকে কিছু না কিছু উপহার মিলার জন্য থাকে। আজ নিটনের মনে খুব আনন্দ লাগছে। জামান নিটনের মধ্যে একটা অস্থিরতা লক্ষ্য করছে-
নিটন-তোর কি হয়েছে?
কি হবে। কিছুই হয়নি।
তোকে এ রকম লাগছে কেন?
জামান বলতো ওর জন্য কি নেয়া যায়।
তোর যা ইচ্ছা তাই নেয়া যায়।
নিটনের চোখে খুব সন্দর একটা পুতুল পড়ল। কোন দাম-দর করেই পুতুলটা নিয়ে নিয়ে নিল। রাস্তার দু’পাশ থেকে শো-শো করে গাড়ী চলছে। নিটন এবং জামাল রিক্সায় নিশ্চুপ ভাবে বসে আছে। একটা ঘাতক ট্রাক নিটনকে চাপা দিয়ে চলে যায়।
মিলা ওর রুমে বসে আছে। আজ ওর তেমন ভালো লাগছে না। কেমন যেন চারদিক নিস্তব্ধ মতে হচ্ছে। মিলার মনে প্রচন্ড ভয় কাজ করছে। ভয় কাটাবার জন্য একটা কবিতার বই নিয়ে পড়ছে। বইটার কবিতাগুলোর মধ্যে একটা কবিতা ওর খুব অপছন্দনীয়। কেমন যে আজ ওটাই পড়তে ইচ্ছা করছে মিলার-
“ যে দিকেই চাই আমি
সে দিকেই শূন্য হয়,
এ-কি শুধু মোর
ললাটের লেখা।
যে দিকেই দৃষ্টি আমার
সে দিকেই অন্ধকার
বুঝিনিতো মোর জীবন
হবে এত চমৎকার।
জানি নিতো মোর জীবন
হবে এতো সুন্দর।
আঘাত আর ব্যাথা নিয়ে
চলব কি চিরকাল।
যে আশাতেই হাত বাড়াই সে আশাই ব্যর্থ হয়,
বুঝিনি-তো কি পাপে মোর সর্ব আশা শূন্য হয়”
দোলন চেয়ারে গা এলিয়ে মৃদু ভাবে দোলছে। আজ কেন এরকম লাগছে। বুকের মধ্যে অজানা একটা ব্যাথা। সমস্ত শরীর কাঁপছে। মানুষের শেষ মূহুর্তটা কি এরকমই হয়। আমার কি পৃথিবীতে বসবাসের সময় ফুরিয়ে এসেছে। না কি কোন বিপদ সংবাদ কেউ বয়ে নিয়ে আসছে। উহ্- আর পারছি না।
চোখ বন্ধ করে বসে আছে মিলা। কলিং বেলের শব্দ মিলার কানে ভেসে আসে। শব্দটাও খুব বিদঘুটে লাগছে। মিলা উঠে এসে দরজা খুলতেই জামান কে দেখলো। সমস্ত শরীরে রক্ত।
জামান এ অবস্থা কেন? কি হয়েছে তোমার।
জামানের চোখ থেকে অশ্র“ গড়িয়ে পড়ছে। অশ্র“র ফোটা শরীরের রক্তের সাথে মিশে লাল হয়ে ঝড়ছে।
মিলা-নিটন আর আমাদের মাঝে নেই।
মিলার চোখ থেকে এখন আর কোন অশ্র“ ঝরছে না। সে নির্বাক মুখে জামানের দিকে তাকিয়ে আছে। জামানকে সে খুব সহজ ভাবে বলল-
ওকে কোথায় রেখে এসেছ। আমাকে ওর কাছে নিয়ে চল।
নিটনের মরদেহ জড়িয়ে ধরে মিলার আত্ম চিৎকার। চারপাশে লোক জন দাড়িয়ে আছে। কারো মুখে সান্তোনা দেবার মত কোন ভাষা নেই।
নিটন তোমরা আমাকে কি পেয়েছ, তোমরা একে একে সবাই আমাকে এই কঠিন পৃথিবীতে রেখে চলে যাচ্ছ। কিন্তু কেন? তুমিতো বলেছিলে, আমাকে রেখে তুমি কোথাও যাবে না। তবে কেন গেলে, কেন গেলে-। আল্লাহ্ তুমি কেন আমার প্রিয় জনকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাচ্ছ। আমি তো কোন অন্যায় করিনি, কোন পাপ করিনি। তুমি এত বড় শাস্তি আমাকে কেন দিচ্ছ।
মিলা বেদনার পাহার বুকে নিয়ে চলছে। মিলা ভেঙ্গে পড়ে না। সে দেখতে চায় আর কত দুঃখ, কষ্ট তাকে গ্রাস করে।
মিলা বারান্দায় হাটু ভেঙ্গে দেয়ালের সাথে এলিয়ে বসে আছে। সে বিধাতার কাছে প্রশ্ন করছে- বিধাতা কেন এত বড় শাস্তির মধ্যে আমাকে রেখেছ? আমার জন্য কি তুমি কোন সুখ রাখনি? কিন্তু কেন? নিটন তুমি চলে গেছ। দেখে যাও আমি কিভাবে বাস করছি। দুঃখ, বেদনাগুলো এখন আমার চিরসাথী হয়েছে। এই পৃথিবীতে যত সুখ রয়েছে তা আমার ভোগের জন্য নয়, যত দুঃখ রয়েছে সেগুলোই আমার প্রাপ্য। মিলার চোখ বেয়ে বেদনার অশ্র“ ঝড়ছে। ভাবীর উপস্থিতি তার ভাবনা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
মিলা একা একা কি করছ। আমি তোমাকে সব জায়গায় খুঁজে বেড়াচ্ছি।
ওড়না দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে মিলা বলল-
বসে আছি ।
এভাবে অন্ধকারের মধ্যে বসে আছ কেন? সেকি তোমার চোখে জল কেন?
ভাবী চোখের জলইতো এখন আমার সম্বল। ভাবী আর কত দুঃখ আমাকে সইতে হবে, কখনও কি কোন সুখ দেখতে পারব না।
এই বলে ভাবীকে জড়িয়ে ধরে মিলা কাঁদতে রইল। আর বলল- ভাবী আমার জীবনটা এরকম কেন? কোন উত্তর দিতে না পেরে নির্বাক মুখে বোকার মত দাড়িয়ে আছে ভাবী। সে নিজেকে সামলে নিয়ে মিলাকে বলল-
চল খেতে যাবে, তোমার ভাইয়া তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
আমার ক্ষিদে নেই, তোমরা খেয়ে নেও।
তুমি কিন্তু কিছুদিন ধরে খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম করছ। এভাবে করলে পথ চলবে কিভাবে। তোমাকে যে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। অতিতের কথা ভুলে যাও, নতুন করে পথ চলতে শুরু কর।
ভাবী, কি কখনো সম্ভব?
কেন সম্ভব হবে না। অসম্ভবকেই সম্ভব করতে হবে। আর আমার বিশ্বাস তুমি পারবে।
হ্যাঁ আমাকে পারতেই হবে। তবে এজীবনের সাথে কাউকেই জড়িয়ে নয়, আমাকে একা একাই পথ চলতে হবে। দেখতে হবে এ জীবন চলার পথে আর কত দুঃখ রয়েছে।
মিলা তোমার শরীর কেমন?
জ্বি ভালো।
কোন অসুবিধা নেইতো।
না-।
মিলা, তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।
কি কথা ভাইয়া, বল।
তোমার বিয়ে ঠিক করেছি, এখন তোমার মতের প্রয়োজন।
ভাইয়া আমি বিয়ে করবো না। আমি এভাবেই থাকতে চাই, আমাকে আমার মতো করে থাকতে দাও।
মিলা- আমি বুঝি তুমি কেন এ কথা বলছ। তারপরও বলছি, বাস্তবকে মেনে নেয়া ছাড়া কোন উপায় নেই।
ভাইয়া যে কটা দিন বেচে থাকব সে কটা দিন একাই থাকতে চাই। এ জীবনটার সাথে কাউকে জড়াতে চাই না।
মিলা নিজের রুমের দিকে চলে গেল। কলিং বেলের শব্দ । কলিং বেলের শব্দ মিলার কাছে এখন আর ভালো লাগে না। কেননা তার ধারনা কলিং বেল শুধু অশুভ সংবাদের বানী নিয়ে চলে। কলিং বেলটা বেজে ওঠার সাথে সাথে মিলার হার্ডবিট বেড়ে উঠেছে। দরজা খুলতেই চয়নকে দেখতে পেল। আশ্চর্য চয়নকে চেনা যায় না। চেহারার কি অবস্থা হয়েছে। মনে হচ্ছে যেন কতদিন না খেয়ে আছে সে। মনে হচ্ছে একটা জীবন্ত কংকাল। চয়নের কোলে ছোট্ট একটি মেয়ে। মেয়েটি দেখতে খুব সুন্দর।
ভিতরে আস। কোথা থেকে এলে এতদিন পরে। কেমন আছ।
বাড়ী থেকে এসেছি।
নীলিমা কোথায়, ওকে নিয়ে এলেনা কেন?
নীলিমার কথা বলতেই চয়নের চোখ থেকে বেদনা অশ্র“ ঝড়ছে।
নীলিমা নেই। এই যে মেয়েটিকে দেখছ। আমার মেয়ে। একে আমার কাছে রেখে নীলিমা চির মুক্তি নিয়েছে।
কি বলছ।
হ্যাঁ মিলা যা সত্যি তাই বলছি। এই মেয়েকে কিভাবে লালন-পালন করব। সে সারাদিন শুধু কাঁদতে থাকে। তাই ওকে তোমার কাছে রেখে যেতে চাই।
ঠিক আছে, কিন্তু তুমি কোথায় যাবে।
জানিনা- কোথায় যাব।
মিলা মেয়েটিকে কোলে তুলে নিতে নিতে বলল-
আয় মা। আমার কাছে আয়। এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই আর তোরও কেউ নেই। আজ থেকে আমি তোর তুই আমার। আমরা দু’জন একই ভাগ্যের মানুষ। তাই আল্লাহ তোকে আমার কাছেই পাঠিয়েছেন।
মিলা মেয়েটিকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। এভাবেই চলতে থাকে মিলার দিন কাল। অন্যের মেয়েকে নিজের মেয়ে করে গড়তে থাকে। মা-মেয়ের জীবন ধারা চলতে থাকে সাভাবিক ভাবেই। কোন চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাংঙ্খা নেই তাদের মনে। মিলা বাড়ীর ছাদে দাড়িয়ে আছে। মিলা মেয়ের নাম রেখেছে নিলা। তার নিজের এবং বান্ধবির নামের সাথে মিলিয়ে মেয়ের নাম রেখেছে। নিলা মাকে না দেখে ছাদের দিকে উঠে এসে দেখে- মা ছাদের এক কোনে দাড়িয়ে আকাশে ভেসে ওঠা সন্ধা তারার দিকে তাকিয়ে আছে।
মা--।
কে, নিলা।
হ্যাঁ মা। কি করছ এখানে।
কিছুনা, ভাল লাগছে না তাই দাড়িয়ে আছি।
মা, তোমাকে একটা কথা বলি--
কি, বল।
প্রাই তুমি সন্ধার দিকে ছাদের এই জায়গাতে দাড়িয়ে এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাক, কিন্তু কেন মা ?
কেন থাকি, ঐ যে সন্ধা তারাটা দেখছ ওখানে ঘুমিয়ে আছে আমার জীবনের সব আশা-আকাংঙ্খা, ঘুমিয়ে আছে আমার ভালোবাসা।
“ভালবাসা জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয় গৌরব। কিন্তু ভালবাসা মিলাকে কি দিলো? তাকে দিলো দাহ। যে আগুন আলো দেয় না, শুধু দহন করে, সেই আলোবিহীন অগ্নির দহনে দগ্ধ হলো মিলার জীবন”।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
ফয়জুল মহী ১৩/০৫/২০২০Very good..