হিসেব
খবরটা শোনার পর নিশাদের বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। বই থেকে চোখই সরলো না।মনযোগ যে কিঞ্চিত নষ্ট হয়নি তা নয়। বই পড়া পুরোনো অভ্যাস তার। কিন্তু ইদানিং সবকিছুর চাপে এই অভ্যেসটা ছাড়তে হয়েছে। শেষ কবে একটি বই পুরোপুরি পড়ে শেষ করেছে তার মনে নেই। তাই এই বইটা পড়ে শেষ করা চাই তার। যদিও প্রথম সন্তানের জনক হওয়ার সংবাদটা বিশেষ, তবু তার কাছে তা স্বাভাবিক হিসেবে ঠেকলো।যেন এমনটাই হওয়ার কথা ছিলো। অথচ হলো উল্টোটি,সে মনে মনে ফুটফুটে একটা ছেলে সন্তানই আশা করেছিলো। অবশ্য মেয়ে সন্তান জন্ম নেয়াতে তার কোনো আক্ষেপ নাই। তাই বলে চাইলেই আনন্দে লাফালাফি করা যাবেনা। নিশাদ গো-বেচারা টাইপের লোক। বেশি লাফালাফি করলে পরিবারের সকলের কাছে বিশেষ তাচ্ছিল্যের বস্তু হয়ে যাবে তাতে সন্দেহ নাই। কারণ এর মধ্যে এটা স্পষ্ট যে পরিবারের কেউই তার স্ত্রীর কন্যা সন্তান জন্ম দেয়াটা স্বাভাবিক ভাবে নেবে না।
নিশাদের স্ত্রী বিদ্যা, চেহেরাটা গাঢ় শ্যামলা বর্ণের ঠিকই, কিন্তু বাবার বাড়ীর সম্পত্তি কিংবা নিজের বিদ্যাবল কোনাটাতেই কম নয়। শহরে জেলাপরিষদের বিপরীত পাশে পরিপাটি দুটি বিল্ডিংই তার বাবার হাতে গড়া সম্পত্তি। তাছাড়া নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্সে ফাস্ট ক্লাশ সেকেন্ড হওয়া স্টুডেন্ট সে।বাবার আপত্তিতে ভালো চাকরী পেয়েও হাতছাড়া করতে হয়েছে। গাঢ় শ্যামলা বর্ণের কারনেই নিশাদের পরিবারের মতো এই মধ্যবিত্ত রক্ষণশীল পরিবারে তার বিয়ে হয়েছে। নিশাদের মা মেয়ে জন্ম দিয়েছে দেখে বিদ্যার আশেপাশেও ঘেঁসছেননা। ‘ছাড় দিবো কেন, আগেই তো সব নিয়মকানুন পুঙ্খানুপুঙ্খ করে বলে দিয়েছিলাম। বাপের বেটি, সেসব নিয়মের ইয়াত্তা রাখেনি। এত এত নিষেধ করার পরও বার বার তলা কাচানো খেয়েছে,জমজ কলা খেয়েছে। শাশুড়িকে তার মানুষ বলেও মনে হয় না, তাই তার কথা মানে না। লেখাপড়া করিনি তো কি হয়েছে,কথায় কাজে কখনো ফেলতে পারবে নাকি কেউ,অথচ এই কালো অলক্ষুণে দামড়ি তো পাত্তাই দিতে চায় না আমাকে। মেয়ে হয়েছে, একদম ভালো হয়েছে,বিষ কমবে এবার। তাতে দোষ তার নিজেরই। শাস্তি তাকে পেতেই হবে।কত ধানে কত চাল এবার হাড়ে হাড়ে টের পাবে বাপের বেটি।’ নিজে নিজে বিড়বিড় করে এসব বলে চলছেন নিশাদের মা। এই ভদ্রমহিলা বিগত কয়েক বছর শহরে বসবাস করলেও মানসিকতার ন্যনূতম পরিবর্তন হয়নি।বিদ্যা মেয়ে সন্তান জন্ম দেয়ায় তার বাবার বাড়ি থেকে গরু পাওয়া যাবেনা ভাবতেই ভদ্রমহিলা তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠলেন মনে মনে।
বিদ্যা ভালো করে জানে মেয়ে জন্ম দেয়ার দায়ে বাড়ির সবাই তাকে কথা শোনাবে। এতে তার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নাই। ব্যাপার খানা এমন যেন ‘যার বিয়ে তার খবর নাই পাড়া পড়শির ঘুম নাই’। আড়ালে সবাই কানাকানি শুরু করে দিয়েছে। নিশাদের বড় বোন তো সবার সামনে বেশ বড় বড় করে বলে দিয়েছে, "যতই লেখাপড়া করুক,হাস্তর না মানলে এসব লেখাপড়ার কোনো দাম থাকেনা। এ বাড়ির কেউ কখনো হাস্তর না মেনে পারেনি। কিন্তু এই অলক্ষ্মী কোথাকার লেখা পড়ার দোহায় দিয়ে এ হাস্তর মানেনি বলেই মেয়ে হয়েছে।" তার ভাবসাব এমন যে এ অন্যায়ের একটা বিহিত করা অতিশয় জরুরী। নইলে এ ঘরে যে অলক্ষ্মী ঢুকেছে তা আর নিদন হবেনা।। একবার অলক্ষ্মী আসর করলে আর রক্ষা নাই। সব শেষ হয়ে যাবে। তার স্পষ্ট মনে আছে তারা যে গ্রামে থাকতো তার পাশের গাঁয়ের রজন আলীর ঘরে যেবার মেয়ে জন্মেছিলো সেবার তাদের এগারো কানি জমির ধান সব লাল ব্যারামে শেষ করে দিয়েছিলো। সেই যে বাড়িটা জাহান্নামে গেলো আজও উঠে দাড়াতে পারেনি। রজনের বউও শিক্ষিতা ছিলো কিনা...।
বিদ্যা সদ্য মা হওয়ার আনন্দে আত্মহারা। তার চিন্তায় দুনিয়ার এসব জঞ্জাল স্থান পায়নি। কে খুশি হলো না হলো তা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই,কিন্তু নিশাদার মা মহিলাটা প্রতি মুহূর্তেই মেয়ের মা হওয়ায় কথা শোনাবে। এসব তার মোটেও ভালো লাগেনা,তবে এসব কখনো গায়েও মাখেনা সে। এই ভদ্রমহিলার জন্য দীর্ঘ নয় মাসে একবার ডাক্তার পর্যন্ত দেখাতে পারেনি সে,আল্ট্রাসোনোগ্রাপি তো দূরের কথা।
নিশাদের ছোট বোন নিনা। আট মাসের সন্তানসম্ভবা। দীর্ঘদেহ,শরীরের গঠন বেশ উন্নত। চেহেরা যেমন সুন্দর তেমন মায়াময়ী। এই মায়াময়ী চেহেরার কারনেই ধনী ঘরের বউ হতে পেরেছে। সব সন্তানের জন্য ধনী পরিবারের সাথে সম্পর্ক গড়েছে বলে নিশাদের মায়ের গর্বের শেষ নেই। নিনা মায়ের মতো খুবই রক্ষণশীল।গাঁয়ের বাজার স্কুল থেকে মানবিক বিভাগ নিয়ে মেট্রিক পাশ করেছে। সে ই বাড়ির একমাত্র মেয়ে যে কিনা মেট্রিক পাশ করা। নিশাদের শ্বশুরঘর থেকে যে নোকিয়া-১২১০ মডেলের ফোনটি তার মাকে উপহার দেয়া হয়েছে, সেটা এখন কিছুটা হলেও চালাতে জানেন তিনি। ফোন দেয়া হলো নিনাকে। তিনি সমূহ ঘটনা বর্ণনা করে শুনালেন এবং হাস্তর মানার ব্যাপারে বারবার সতর্ক করলেন। কারন এরই মধ্যে আট মাস শেষ, সময় প্রায় কাছিয়ে এসেছে। শ্বশুড়বাড়ির লোকজন বেশ কয়েকবার আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করাতে চাইলেও নিনা রাজি হননি,তার মায়ের কড়া নিষেধ আছে এ ব্যাপারে। তবুও নিনার বর একদিন তার এক ডাক্তার বন্ধুকে বাড়িতে এনেছিলেন নিনাকে দেখানোর জন্য।নিনা লজ্জায় সেই ডাক্তারের সাথে দেখা পর্যন্ত করেনি। সে, কিছুটা হলেও লেখাপড়া জানা মেয়ে। এসব হাস্তর মাস্তর তার পুরোপুরি বিশ্বাস হয়না। সে ভাবে বড়দার বউ তো উচ্চশিক্ষিত,তাছাড়া তার বাপ পাঁচপদ দিয়েই মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। তবুও মেয়ের মা হওয়ার দায়ে সবাই তাকে কত কথাই না শোনাচ্ছে। কিন্তু তাকে তো তার বাপের বাড়ি থেকে একটা ছেড়া সুতাও দিতে পারেনি। সে যদি মেয়ে জন্ম দেয়? তখন কী হবে? তখন শ্বশুরভবাড়ির সবাইকে কীভাবে মুখ দেখাবে? তার বুক কেঁপে ওঠে।শ্বশুরঘরের সবাই তাকে কী কী কথা শোনাতে পারে তা ভেবে গা কাঁটা দিয়ে ওঠে ।
কিছুদিন পর নিনার শ্বশুরঘর থেকে ফোন এলো। নিশাদের মা এই ফোনটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। তিনি এক রকমের ভয় নিয়ে ফোন রিসিভ করে কানে দিতেই ওপাশ থেকে নিনার শাশুড়ি বললেন, "সুসংবাদ বেয়াইন! আপনি নানী হয়েছেন। পরিবারে নতুন মেহমান আসায় বাড়িতে খুশির বন্যা বইছে। তাছাড়া বাড়িতে আগামী সপ্তাহের প্রথম দিন গরু জবাই করে একটা বড় অনুষ্ঠান হবে,সেই অনুষ্ঠানে আপনাদের পুরো পরিবারের নিমন্ত্রণ রইলো। আর হ্যাঁ, সঙ্গে কিন্তু কোনো ধরণের উপহার আনা যাবেনা। এক কথায়, কোনো ধরণের উপহার গ্রহণযোগ্য নয়।" এতোক্ষণে নিশাদের মায়ের বুঝতে বাকী নেই নিনা পুত্র সন্তান জন্ম দিয়েছে। তিনি বলেই দিলেন, ‘আমি জানতাম আমার নিনা ছেলের মা ই হবে। সে তো আমার মেয়ে, আমার কথা শোনে সব নিয়ম পালন করেছে। কিন্তু দেখেন, আমার ছেলের বউ, সে আমায় পাত্তাই দিতে চায় না। এখন বেশ হয়েছে, ক'দিন আগে মেয়ের মা হয়েছে সে। আমি তো ঘিনে এখনও মুখ পর্যন্ত দেখিনাই তার মেয়ের।পোড়াকপালির ভাগ্য ভালো যে আমার চাঁদের মতো ছেলেকে বর পেয়েছে। নয়তো এতোদিনে বিয়েও হতো না।’
তার এসব কথায় নিনার শাশুড়ি খুবই বিরক্ত হলেন। তার মনোভাবটা এরকম বলে খুব একটা মেলামেশাও করেননা তিনি। অনেকটা বিরক্ত হয়েই জানালেন, নিনা ছেলে নয়,মেয়ে সন্তানেরই মা হয়েছে। নিশাদের মা ফোন কেটে দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য নিরব হয়ে গেলেন। তার কোথায় যেন হিসাব মিলছেনা। তিনি নিঃশব্দে নিশাদের ঘরে ঢুকে তার শিশু কন্যাকে কোলে তোলে নিয়ে কপালে চুমু খেলেন। নিশাদের শিশু কন্যা খিলখিল করে হেঁসে ওঠলো। তিনি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সেই হাঁসি দেখতে লাগলেন আর মনে মনে বললেন, ‘হে আরশের মালিক! এই হাসি যেন জারি থাকে অনন্তকাল’।
নিশাদের স্ত্রী বিদ্যা, চেহেরাটা গাঢ় শ্যামলা বর্ণের ঠিকই, কিন্তু বাবার বাড়ীর সম্পত্তি কিংবা নিজের বিদ্যাবল কোনাটাতেই কম নয়। শহরে জেলাপরিষদের বিপরীত পাশে পরিপাটি দুটি বিল্ডিংই তার বাবার হাতে গড়া সম্পত্তি। তাছাড়া নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্সে ফাস্ট ক্লাশ সেকেন্ড হওয়া স্টুডেন্ট সে।বাবার আপত্তিতে ভালো চাকরী পেয়েও হাতছাড়া করতে হয়েছে। গাঢ় শ্যামলা বর্ণের কারনেই নিশাদের পরিবারের মতো এই মধ্যবিত্ত রক্ষণশীল পরিবারে তার বিয়ে হয়েছে। নিশাদের মা মেয়ে জন্ম দিয়েছে দেখে বিদ্যার আশেপাশেও ঘেঁসছেননা। ‘ছাড় দিবো কেন, আগেই তো সব নিয়মকানুন পুঙ্খানুপুঙ্খ করে বলে দিয়েছিলাম। বাপের বেটি, সেসব নিয়মের ইয়াত্তা রাখেনি। এত এত নিষেধ করার পরও বার বার তলা কাচানো খেয়েছে,জমজ কলা খেয়েছে। শাশুড়িকে তার মানুষ বলেও মনে হয় না, তাই তার কথা মানে না। লেখাপড়া করিনি তো কি হয়েছে,কথায় কাজে কখনো ফেলতে পারবে নাকি কেউ,অথচ এই কালো অলক্ষুণে দামড়ি তো পাত্তাই দিতে চায় না আমাকে। মেয়ে হয়েছে, একদম ভালো হয়েছে,বিষ কমবে এবার। তাতে দোষ তার নিজেরই। শাস্তি তাকে পেতেই হবে।কত ধানে কত চাল এবার হাড়ে হাড়ে টের পাবে বাপের বেটি।’ নিজে নিজে বিড়বিড় করে এসব বলে চলছেন নিশাদের মা। এই ভদ্রমহিলা বিগত কয়েক বছর শহরে বসবাস করলেও মানসিকতার ন্যনূতম পরিবর্তন হয়নি।বিদ্যা মেয়ে সন্তান জন্ম দেয়ায় তার বাবার বাড়ি থেকে গরু পাওয়া যাবেনা ভাবতেই ভদ্রমহিলা তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠলেন মনে মনে।
বিদ্যা ভালো করে জানে মেয়ে জন্ম দেয়ার দায়ে বাড়ির সবাই তাকে কথা শোনাবে। এতে তার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নাই। ব্যাপার খানা এমন যেন ‘যার বিয়ে তার খবর নাই পাড়া পড়শির ঘুম নাই’। আড়ালে সবাই কানাকানি শুরু করে দিয়েছে। নিশাদের বড় বোন তো সবার সামনে বেশ বড় বড় করে বলে দিয়েছে, "যতই লেখাপড়া করুক,হাস্তর না মানলে এসব লেখাপড়ার কোনো দাম থাকেনা। এ বাড়ির কেউ কখনো হাস্তর না মেনে পারেনি। কিন্তু এই অলক্ষ্মী কোথাকার লেখা পড়ার দোহায় দিয়ে এ হাস্তর মানেনি বলেই মেয়ে হয়েছে।" তার ভাবসাব এমন যে এ অন্যায়ের একটা বিহিত করা অতিশয় জরুরী। নইলে এ ঘরে যে অলক্ষ্মী ঢুকেছে তা আর নিদন হবেনা।। একবার অলক্ষ্মী আসর করলে আর রক্ষা নাই। সব শেষ হয়ে যাবে। তার স্পষ্ট মনে আছে তারা যে গ্রামে থাকতো তার পাশের গাঁয়ের রজন আলীর ঘরে যেবার মেয়ে জন্মেছিলো সেবার তাদের এগারো কানি জমির ধান সব লাল ব্যারামে শেষ করে দিয়েছিলো। সেই যে বাড়িটা জাহান্নামে গেলো আজও উঠে দাড়াতে পারেনি। রজনের বউও শিক্ষিতা ছিলো কিনা...।
বিদ্যা সদ্য মা হওয়ার আনন্দে আত্মহারা। তার চিন্তায় দুনিয়ার এসব জঞ্জাল স্থান পায়নি। কে খুশি হলো না হলো তা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই,কিন্তু নিশাদার মা মহিলাটা প্রতি মুহূর্তেই মেয়ের মা হওয়ায় কথা শোনাবে। এসব তার মোটেও ভালো লাগেনা,তবে এসব কখনো গায়েও মাখেনা সে। এই ভদ্রমহিলার জন্য দীর্ঘ নয় মাসে একবার ডাক্তার পর্যন্ত দেখাতে পারেনি সে,আল্ট্রাসোনোগ্রাপি তো দূরের কথা।
নিশাদের ছোট বোন নিনা। আট মাসের সন্তানসম্ভবা। দীর্ঘদেহ,শরীরের গঠন বেশ উন্নত। চেহেরা যেমন সুন্দর তেমন মায়াময়ী। এই মায়াময়ী চেহেরার কারনেই ধনী ঘরের বউ হতে পেরেছে। সব সন্তানের জন্য ধনী পরিবারের সাথে সম্পর্ক গড়েছে বলে নিশাদের মায়ের গর্বের শেষ নেই। নিনা মায়ের মতো খুবই রক্ষণশীল।গাঁয়ের বাজার স্কুল থেকে মানবিক বিভাগ নিয়ে মেট্রিক পাশ করেছে। সে ই বাড়ির একমাত্র মেয়ে যে কিনা মেট্রিক পাশ করা। নিশাদের শ্বশুরঘর থেকে যে নোকিয়া-১২১০ মডেলের ফোনটি তার মাকে উপহার দেয়া হয়েছে, সেটা এখন কিছুটা হলেও চালাতে জানেন তিনি। ফোন দেয়া হলো নিনাকে। তিনি সমূহ ঘটনা বর্ণনা করে শুনালেন এবং হাস্তর মানার ব্যাপারে বারবার সতর্ক করলেন। কারন এরই মধ্যে আট মাস শেষ, সময় প্রায় কাছিয়ে এসেছে। শ্বশুড়বাড়ির লোকজন বেশ কয়েকবার আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করাতে চাইলেও নিনা রাজি হননি,তার মায়ের কড়া নিষেধ আছে এ ব্যাপারে। তবুও নিনার বর একদিন তার এক ডাক্তার বন্ধুকে বাড়িতে এনেছিলেন নিনাকে দেখানোর জন্য।নিনা লজ্জায় সেই ডাক্তারের সাথে দেখা পর্যন্ত করেনি। সে, কিছুটা হলেও লেখাপড়া জানা মেয়ে। এসব হাস্তর মাস্তর তার পুরোপুরি বিশ্বাস হয়না। সে ভাবে বড়দার বউ তো উচ্চশিক্ষিত,তাছাড়া তার বাপ পাঁচপদ দিয়েই মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। তবুও মেয়ের মা হওয়ার দায়ে সবাই তাকে কত কথাই না শোনাচ্ছে। কিন্তু তাকে তো তার বাপের বাড়ি থেকে একটা ছেড়া সুতাও দিতে পারেনি। সে যদি মেয়ে জন্ম দেয়? তখন কী হবে? তখন শ্বশুরভবাড়ির সবাইকে কীভাবে মুখ দেখাবে? তার বুক কেঁপে ওঠে।শ্বশুরঘরের সবাই তাকে কী কী কথা শোনাতে পারে তা ভেবে গা কাঁটা দিয়ে ওঠে ।
কিছুদিন পর নিনার শ্বশুরঘর থেকে ফোন এলো। নিশাদের মা এই ফোনটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। তিনি এক রকমের ভয় নিয়ে ফোন রিসিভ করে কানে দিতেই ওপাশ থেকে নিনার শাশুড়ি বললেন, "সুসংবাদ বেয়াইন! আপনি নানী হয়েছেন। পরিবারে নতুন মেহমান আসায় বাড়িতে খুশির বন্যা বইছে। তাছাড়া বাড়িতে আগামী সপ্তাহের প্রথম দিন গরু জবাই করে একটা বড় অনুষ্ঠান হবে,সেই অনুষ্ঠানে আপনাদের পুরো পরিবারের নিমন্ত্রণ রইলো। আর হ্যাঁ, সঙ্গে কিন্তু কোনো ধরণের উপহার আনা যাবেনা। এক কথায়, কোনো ধরণের উপহার গ্রহণযোগ্য নয়।" এতোক্ষণে নিশাদের মায়ের বুঝতে বাকী নেই নিনা পুত্র সন্তান জন্ম দিয়েছে। তিনি বলেই দিলেন, ‘আমি জানতাম আমার নিনা ছেলের মা ই হবে। সে তো আমার মেয়ে, আমার কথা শোনে সব নিয়ম পালন করেছে। কিন্তু দেখেন, আমার ছেলের বউ, সে আমায় পাত্তাই দিতে চায় না। এখন বেশ হয়েছে, ক'দিন আগে মেয়ের মা হয়েছে সে। আমি তো ঘিনে এখনও মুখ পর্যন্ত দেখিনাই তার মেয়ের।পোড়াকপালির ভাগ্য ভালো যে আমার চাঁদের মতো ছেলেকে বর পেয়েছে। নয়তো এতোদিনে বিয়েও হতো না।’
তার এসব কথায় নিনার শাশুড়ি খুবই বিরক্ত হলেন। তার মনোভাবটা এরকম বলে খুব একটা মেলামেশাও করেননা তিনি। অনেকটা বিরক্ত হয়েই জানালেন, নিনা ছেলে নয়,মেয়ে সন্তানেরই মা হয়েছে। নিশাদের মা ফোন কেটে দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য নিরব হয়ে গেলেন। তার কোথায় যেন হিসাব মিলছেনা। তিনি নিঃশব্দে নিশাদের ঘরে ঢুকে তার শিশু কন্যাকে কোলে তোলে নিয়ে কপালে চুমু খেলেন। নিশাদের শিশু কন্যা খিলখিল করে হেঁসে ওঠলো। তিনি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সেই হাঁসি দেখতে লাগলেন আর মনে মনে বললেন, ‘হে আরশের মালিক! এই হাসি যেন জারি থাকে অনন্তকাল’।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।