www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

কান্না

আমি বরাবরই হাবাগোবা টাইপের কেউ।বাড়াবাড়ি আমাকে দিয়ে খুব কমই হয়। অতিরিক্ত কিছুই ভালোনা। সেটা আমি ভালো করেই জানি।আমি নিজেই কবিতা বানিয়েছি 'অতি মানে ক্ষতি'। তবু আমি অতিরিক্ত আতেঁল টাইপের।দিন শেষে রাত হয়,রাত শেষে দিন। এভাবে সময় এগিয়ে চলে,আমি বড় হতে থাকি।আমার স্বভাবের কোনো পরিবর্তন হয় না। পদে পদে আমার অতি আতেলামির ফল ভোগ করি। বাসায় কেউ আমায় তেমন গুরুত্ব দেয় না,হয়তো আমি গুরুত্ব পেতে জানিনা। কিন্তু আমার কাছে আমি বরাবরই বড্ড চালাক চতুর কেউ। সব সময় মনে হয় আমি তো ভালো পথেই আছি,বুদ্ধির পথেই আছি।মাথায় সবসময় আজগুবি সব চিন্তা ভাবনা ভর করে! মানুষ মানুষকে কেন খুন করে,কেউ বস্তিতে আবার কেউ দালানে,কেউ সভ্য কেউ অসভ্য। মানুষে মানুষে কত তফাত। এসব আজগুবি চিন্তা ভাবনা গুলো আমার মাথায় নিত্য খেলা করে। আমি এগুলো ছেড়ে বের হতে পারিনা।

রাবেয়ার শাশুড়বাড়িতে গিয়েছিলাম। পরিবারে একমাত্র রাবেয়া ই আমার পক্ষের লোক। অবশ্য রাবেয়ার স্বামীও কখনো আমার বিপক্ষে কথা বলেনা। তবে সবার মতো ওনিও আমাকে নিয়ে উদ্বিঘ্নে থাকেন।আমার বেশ কিছু টাকার দরকার ছিলো,রাবেয়াকে বলেছি। সে ই আমার শেষ এবং একমাত্র ভরসা। কিন্তু সে দিতে অস্বীকৃতি জানায়,পাছে ওর কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমি কাউকে দিয়ে ফেলি।শেষ পর্যন্ত তাকে বুঝালাম আমার একটা মেয়ে বন্ধু হয়েছে।এই প্রথম কোনো মেয়ে আমার বন্ধু হয়েছে।কোন মতলব নিয়ে সে আমার বন্ধু হয়েছে তা আমার ভাবনায় আসেনা।তাকে আমার একটা আইফোন উপহার দিতে ইচ্ছে করছে। রাবেয়া সেটা হেসে উড়িয়ে দেয়।

রাবেয়ার শাশুড়বাড়ি থেকে ফিরতে রাত হয়ে গেছে। সে আমাকে একা বের হতে দিতে চায়নি। দেশের নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করার পরও কি আমি একটু রাত হলে বাসায় ফিরতে পারবোনা? এটা আত্মসম্মানে লাগলো আমার। তাই একপ্রকার রাগ করেই রাবেয়ার বাসা থেকে বের হই। রাবেয়ার বাসা লালখান বাজার। সেখান থেকে দশ নম্বর বাসে ওঠে মুরাদপুর পর্যন্ত আসলাম। মুরাদপুর থেকে অক্সিজেন আসা হলো তিন নম্বর বাসে। এই মাঝরাতে সময় মতো বাস পেয়ে যাবো ভাবিনি।বাসায় পৌছাতে অক্সিজেন থেকে পূর্ব দিকে সাত মিনিট হাটতে হবে। ইচ্ছা করলেই রিকশা নেওয়া যেতো। কিন্তু ইদানিংকার রিক্সাওয়ালাদের যা ভাব,তাছাড়াও রাতের বেলায় পনেরো টাকার ভাড়া ত্রিশ টাকা চেয়ে বসে। তার চেয়ে বরং হেটে গেলেই ভালো হয়। তাই হাটা আরম্ভ করলাম। আমার সাথে সম্ভল বলতে একটা এনড্রয়েট মোবাইল আর পকেটের ৬০ টাকা।তিন মিনিট হাটার পর একটি চিপা গলি দিয়ে দিয়ে যেতে হয়। আর এই মাঝরাতে লোকজনের আনাগোনাও কম এদিকে।সোজা গিয়ে ডানে মোড় নিতেই চিপা গলিটার শুরু। আমি গলিটাতে পা দিতেই পথরোধ করে দাড়ালো দুজন। দুজনই একই সময়ে বলে ওঠলো আমার যা যা আছে কোনো কথা না বলে যেনো তাদের দিয়ে দিই,অন্যথায় সমস্য হবে। বুঝতে বাকি রইলোনা আমি ছিনতাইকারির কবলে পড়ছি। তবে ঘটনাক্রমে দুজনকেই চিনে ফেললাম। একজন মোরশেদ, আমাদের বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলায় থাকে । অন্যজন আকবর, পাশের বিল্ডিংয়ে থাকে। ওর বাবা সাংবাদিক মানুষ। আমাকে খুবই স্নেহ করেন। বিশেষ করে আমি যে কবিতা লিখি তা ওনার খুবই পছন্দ। এ ছাড়াও আমার অধিকাংশ কবিতার প্রথম পাঠক ওনি।ওনার ছেলে রাত বিরাতে এই অকাম কুকাম করে বেড়াবে সেটা আমার ভাবনাইও আসেনি কখনো। তবে মোরশেদের ব্যাপারে আমার সন্দেহ হতো,অনেক সময় তার চোখ লাল দেখা যেতো। আমার ধারনা যাদের চোখ লাল হয়,তারা নেশা করে,আর যারা নেশা করে তারা কখনো ভালো মানুষ হয়না।যাক সে কথা,
আমি তাদের নাম ধরে ডাক দিয়ে জিঙ্গাস করলাম এতো রাতে এখানে কী করে। কিন্তু তারা কোনো উত্তর দিলোনা। পরক্ষণেই কানে কানে দুজনে কী যেন বললো। হয়তো বলছে এই হাবাগোবাকে একটু আগেও চিনতে পারলে এতো মূল্যবান সময় নষ্ট করতে হতোনা আমাদের,উল্টা বিপদে পড়তে হলো। আমার ধারণা তারা বিপদে আছে এখন। একটু পরই আমার ধারণা ভুল বলে মনে হলো,যখন দেখলাম আকবর পেছন থেকে একটা চাকু বের করে মোরশেদের ডান কাধের একটু নিচে আঘাত করল। একটু পরেই টের পেলাম সেটা দুজনের সমাজোতার মাধ্যমেই হয়েছে। এর পরেই আকবর আমাকে পেছন থেকে ধরে রেখে ছিনতাইকারি বলে চিৎকার করতে থাকে। সাথে সাথে অনেকগুলো মানুষ জড়ো হয়ে যায়। আর আমার দোষের সত্যতা কিংবা নাম ধাম না জেনেই সবাই কিল-ঘুশি আরম্ভ করে দিলো। আমি যতই চিৎকার করি,আমার কথা কেউ শোনেনা।আমাকে সবাই মিলে চোরের মতো ধরে বাসার নিচে নেওয়া হলো। আমি তখন চিন্তা করছি ঘটনার আকষ্মীকতার কথা। কত দ্রুতই না সব কিছু ঘটে গেলো। আমার বাবা মা কে ডাকা হলো।বাবা শিক্ষক মানু্ষ, তার কথা ভেবে আমার খুবই কষ্ট হলো। আমাকে চোরের মতো করে বসানো হলো সবার সামনে। বাবা দুটো থাপ্পর দিয়ে বললেন, “এটাই কি তোর স্নাতকোত্তরের মান?” ততক্ষণে মায়ের কপলদেশ দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে। চিৎকার করে অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছা হলো আমার,কিন্তু কিছুই বলা হলোনা। বললেও একমাত্র রাবেয়া ছাড়া কেউ হয়তো বিশ্বাস করবেনা। কিন্তু রাবেয়া এখানে অনুপস্থিত। তবে এটা নিশ্চিত যে এতোক্ষণে রাবেয়ার কান পর্যন্ত চলে গেছে এ কথা। ততক্ষণে কাউন্সিলর সাহেব এসে গেছেন। আমাকে দেখা মাত্রই চিনলেন । ওনি অতিথি থাকা অনেক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি কেরছি,সে সুবাদে ওনার সাথে মোটামুটি ভালো সম্পর্ক আমার। তাই হয়তো আমাকে ছিনতাইয়ের অপরাধে কোনো কঠিন শাস্তি দিলেন না।অথচ গত কয়েকমাস ধরে এলাকায় অর্ধশতের মতো ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। সে অনুযায়ী ছিনতাইকারি হিসেবে আমার কঠিন শাস্তি ই হওয়ার কথা।তবে অনেকে বাবাকে বিভিন্ন কথা বলে অপমান করছে। কেউ কেউ মৃদুস্বরে বলতে লাগলেন এরকম সিধেসাদা টাইপের ছেলে গুলোই ভিতরে ভিতরে এই অকাম কুকাম করে বেড়ায়। অনেকে কানাকানি করে বিভিন্ন ধরনের কথা বলতে লাগলেন যা আমার কান পর্যন্ত স্পষ্টভাবে পৌছাচ্ছেনা।তবে সেদিকে আমার ভ্রুক্ষেপ নেই,এই মুহূর্তে আমার সব চিন্তা ভাবনা রাবেয়াকে নিয়ে। সে আমাকে বিশ্বাস করবে তো? নাকি অন্য সবার মতো সেও ভুল বুঝবে?অবশেষে শাস্তি হিসেবে মোরশেদের চিকিৎসার খরচ বাবাকে বহন করতে বলা হলো। বাবাও মাথা পেতে মেনে নিলেন। সবাই চলে যাওয়ার পর বাবা আমাকে বাসায় যেতে না করেন। আমি অনেক বুঝাতে চেয়েছি বাবাকে, কিন্তু আমাকে কোনো কথা বলার সুযোগই দেওয়া হয়নি। এক পা দু পা করে রাস্তার বেরিয়ে আসি। এই সন্ধ্যা রাতে হাইওয়ে ছাড়া বাকী রাস্তা গুলো একদম ফাঁকা বললেই চলে। আমি রাস্তার ধারে বসে পড়লাম। কিছু দূরেই তিনটা কুকুর শুয়ে আছে রাস্তার মাঝ বরাবর,আর মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে গর্জন করছে। কে জানে, জঞ্জালে ভরা এই দুনিয়া থেকে মুক্তির পথ চাইছে হয়তো স্রষ্টার কাছে। মাঝে মাঝে হাইওয়ে থেকে দ্রুত গতির গাড়ির হর্নের শব্দ আসছে। চারদিকে সুনসান নিরবতা।আমি সবকিছু চোখ বন্ধ করে একবার ভাবলাম। নিজের অজান্তেই চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো।কাঁদলে নাকি মন হালকা হয়,তাই প্রাণ খুলে কেঁদে নিলাম কিছুক্ষন। রাবেয়াকে ফোন দিই, সাধারণত রাবেয়া এতোরাতে ফোন রিসিভ করেনা। আমি জানি আজ রিসিভ করবে। ফোন দেওয়া মাত্রই সে রিসিভ করে বলে, " টাকা কি তোর এতই দরকার ছিলো?" আমি চিৎকার দিয়ে কেঁদে ওঠে বললাম আমি কোনো দোষ করিনি ববু,আমি কোনো দোষ করিনি।রাবেয়াকে বুবু বলেই ডাকি আমি। ফোনের ওপার থেকে ভেসে আসে, আমি জানতাম রবো,তুই এটা করতে পারস না। সব ঠিক হয়ে যাবে রবো (রাবেয়া আমাকে ছোটবেলা থেকে 'রবো' ডাকতো ) ,সব ঠিক হয়ে যাবে।প্রতিরাতের মতো আজকের রাতও শেষ হয়ে যাবে। একটু পরেই ফজরের আজান দেবে,সকালে সূর্য ওঠবে নব উদ্যমে। সকলে সকলের কর্মব্যস্ততায় ছুটে বেড়াবে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। শুধু রবি নামে একটি ছেলের দিন শুরু হবে অন্যরকম ভাবে,কলঙ্কিত হয়ে,সমাজ তাকে ছিনতাইকারি হিসেবে চিনবে এখন থেকে। তার দোষের সত্যতা খুঁজার মতো বোকামি কেউ ভুলেও করবেনা। ফোনের এ প্রান্তে আমি চিৎকার করে কাঁদতে থাকি। আর ও প্রান্ত থেকে ভেসে আসে মৃদু কান্নার শব্দ।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৬৯১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৪/১১/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast