www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

করোনা ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ জয়ের গল্প গীতিকবি মীর মামুন হোসেন।

বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে এখন জীবন থেমে গেছে। বন্দিদশায় করোনা আতঙ্ক উদ্বেগ আর উৎকন্ঠার মধ্যে দিন কাটে। রোজা রেখে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়, আল্লাহ বিল্লাহ করে সময়ের যথার্ত ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি। অঢেল সময় কাজ কর্ম নাই। দিনে বেশি সময় কাটে মোবাইল নিয়ে। মোবাইল না থাকলে কি যে করতো মানুষ?এবারের রমজানে মসজিদে সালাত আদায় ছাড়া, রমজান মাসের পবিএতা বজায় রেখে ইসলামী অনুশাসন মেনে যথাযথ ভাবে রোজা রাখতে পেরে বেশ ভালো লেগেছিল।

      ২৭শে রমজান ২০ শে মে প্রতিদিনের ন্যায় নিজ হাতে ইফতারি বানিয়ে ছিলাম। কিছু সময়ের জন্য শরীর চর্চা করে ছিলাম।  বিশ্রাম নিয়ে গোসল সারতে বাথরুমে ঢুকে

ছিলাম। পানি নাড়তে পানি খুব ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভুত হয়েছিল। শরীর কেমন যেনো ম্যাচ ম্যাচ করছিল।  ইফতারির পর ঝেপে জ্বর এসেছিল সাথে শরীর ভীষণ ব্যাথা ছিল। ভেবেছিলাম  ব্যায়াম বেশি করে ফেলেছি। তাই শরীরটা এত ব্যাথা লাগছে। একটা প্যানাড্রেক্স ট্যাবলেট খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ঘুম ঘুম ভাব এমন সময়  দরজায় নক। চোখ মেলে বললাম ভিতরে আসেন। সাহাবুল ভাই বলল কি ব্যপার নামাজ পড়তে হবেনা। তৎক্ষনে শরীরটা ভালো মনে হচ্ছে। উঠে পড়লাম করোনা কালে ভাইরাসটির সংক্রমন রোধে সরকার মসজিদ বনধ করে দিয়েছে। তাই উপায়ন্তর না পেয়ে পাশের দু রুমের তিনজন মিলে আমার রুমে আমি সহ চারজন প্রতিদিন জামায়াতে সালাত আদায় করি। আমি ওযু করতে  গেলাম, ওযু সেরে এসে দেখি বাকি দুজন চলে এসেছে। চারজন মিলে যথানিয়মে  সালাত আদায় করলাম। মসজিদে সালাত আদায় না করতে পারলেও এবারে রমজানে ঘরে তারাবীহ নামাজ ও রোজা রেখে কেনো যেনো আত্মতৃপ্তি বোধ করছি। যা  আগে কখনও মনে হয়নি।

      রাতের খাবার সেরে বসে আছি, মাথা কেমন যেন চিনচিনিয়ে ব্যাথা করছে। জ্বর এলে আমার কখনও মাথা ব্যাথা করেনা। পাশের রুমে গেলাম ক্যাফেইন ও প্যারাসিটামল কম্বিনেশন ট্যাবলেটর খোজে, এইচ প্লাস ট্যাবলেট পেলাম। দুটো এক সাথে খেয়ে নিলাম। বসে থাকতে পারছিলাম না। রুমে এসে এসি ছেড়ে দিয়ে লাইট বন্ধ করে, শুয়ে পড়লাম। সমস্ত শরীর ব্যাথা, যেনো বাঁশ দিয়ে পিটিয়েছে। দুই পা ঝিন ঝিন করছে অবশ মনে হচ্ছে। পায়ের তালু দিয়ে গরম বের হচ্ছে, পা নড়াতেও কষ্ট হচ্ছে। চিত হয়ে মৃত মানুষের মত পড়ে রইলাম, ঘুম আসছিলনা। রমজান মাস জুড়ে এ রাতে ঘুম আসেনা সাহরী খেয়ে ফজরের সালাত আদায় করে শুলে একটু ঘুম আসে। বয়স হচ্ছে দিন দিন ঘুম কমছে, আগের মত আর ঘুম হয়না। মোবাইলে সাহরী খাওয়ার এলার্ম বেজে উঠলো। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। তরকারি গরমে দিলাম, শসা কাটলাম, টমেটো কাটলাম, সাহরী খেলাম। শরীরে উচ্চ তাপমাত্রা না থাকলেও ব্যাথা সহ জ্বর আছে। বছরের এ সময়ে মাঝে মাঝে মাথা ভারী সহ জ্বর আসে। নাপা ও প্লেন কট্রিম খেলে সেরেও যায়। এবার দেশ থেকে আসার সময় প্লেন কন্ট্রিম আনা হয়নি। তাই সিপ্রোফ্লক্সাসিন গ্রুপের সিপ ৫০০ এর অধেক ও এইচ প্লাস খেয়ে নিলাম।  কিছুক্ষন মোবাইল চাপতেই ফজরের আযান কানে আসলো। ওযু সেরে ফজরের সালাত আদায় করে, আল্লাহর নামে শুয়ে পড়লাম। ১১টার দিকে ঘুম থেকে উঠলাম মাথা ব্যাথা নেই তবে মাথাটা ভারী ভারী লাগছে। শরীরটা একটু হালকা মনে হচ্ছে জ্বর কিছুটা কম। তিন দিন ধরে এভাবে চলতে থাকলো।

      শরীর ব্যাথা সহ জ্বর সাথে যুক্ত হয়েছে শুক্ন কাশি। কাশির জন্য সিরাপ খাচ্ছি তবুও কমছেনা। বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। ধীরে ধীরে করোনার উপসর্গ গুলো আমার মাঝে দেখা দিতে শুরু করলো। মনে মনে ভাবছিলাম কিভাবে কোথা থেকে আমি করোনায় আক্রান্ত হলাম। আমি তো রুম থেকে কোথাও যায় না। করোনার প্রাদুর্ভাব দেখে ময়লা আওয়ালা ময়লা নিতে আসেনা। আমি ভয়ে পাঁচতলা থেকে ময়লা ফেলতে নিচে পর্যন্ত নামিনা। সপ্তাহে একবার শরীরে রোদ লাগাতে নিচে নামি, তখন ময়লা গুলো নিয়ে যায় এটুকুই।  ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত কারফিউ  সিথিল, হাটা হাটির জন্য, তাও যায়না। অনেক লোক রাস্তায় হাটাহাটি করে, কিসে কি হয়ে যায় সেই ভয়ে। তবে ২৬রোজার রাতে পাশের রুমে গিয়ে একটি লেবান খেয়ে ছিলাম। খাওয়ার সাথে সাথে গলা খুশ খুশ করতে আরম্ভ হয়। মাঝে মাঝে কাশি হচ্ছিল। রাজু হাসপাতালে ডিউটি করে সেখান থেকে লেবান, খেজুর জুস গুলো সংগ্রহ করে দিয়েছে। কত হাত বদল হয়েছে তার কি কোন ঠিক আছে। ঐ লেবান খেয়ে আমার আজ এই দশা। 

    করোনার কাছে হেরে, যেতে হবে সব ছেড়ে। এ কথা ভাবতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আগে ভাড়া বাসায় থাকতাম করোনার কারনে কাজ কর্ম সব বন্ধ বেগতিক অবস্থা দেখে কোম্পানীর ব্যারাকে উঠেছি। পাশের রুমে সাজ্জাদ আদান হাসপাতালে চাকুরী করে। সেও বেশ কিছুদিন যাবৎ ঠান্ডা জ্বরে ভুগছে। দেখতে গেলাম ওকে ডাক্তার কি ঔষধ দিয়েছে। করোনার উপসর্গ দেখে ডাক্তার করোনার চিকিৎসা দিয়েছে। তিন বেলা প্যানাডেক্স খাচ্ছে দু বেলা এন্টিবায়োট্রিক কালাসিড সাথে কাঁশির সিরাপ। আমি ওর কাছ থেকে দশটা কালাসিড ট্যাবলেট নিয়ে আসলাম। আমিও করোনার চিকিৎসা অনুযায়ী ওষুধ খেতে থাকলাম। নিয়মিত লবঙ্গো, দারুচিনি, আদা, লেবু পানির ভাপ নিতে থাকলাম। সাথে আবার শরীর চর্চা শুরু করলাম। হঠাৎ করে পাতলা পায়খানা শুরু হল। প্রতিবার পাতলা পায়খানার সাথে সাথে স্যালাইন বানিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। বেশামাল অবস্থার ভিতর পড়ে গেলাম। দিন যেমন তেমন রাত যায় খুব কষ্টে। নানা চিন্তা ভর করে মনের মাঝে। মনে হয় আমি আর বাঁচবনা মরে যাবো। এভাবে চলে যেতে হবে। প্রিয় মানুষ গুলোর মুখগুলো ভেসে উঠে চোখে সামনে। রাত হলে করোনার উপসর্গ গুলো শরীর উপর প্রভাব বিস্তার করে। মানসিক ভাবে তখন দুর্বল হয়ে পড়ি। রাত যেনো আর কাটতেই চাইনা।  এপাশ ওপাশ করতে থাকি। জীবনের কত পথ বাকী এভাবে মাঝ পথে থেমে যেতে হবে। ছোট খালার মৃত্যুতে মা ভেঙ্গে পড়েছিল দেখে ছিলাম। আর আজ যদি আমি চলে যায় মা'তো আমার পাগল হয়ে যাবে। আব্বা খুব শক্ত মনের মানুষ কিন্তু  নিজের ভাই বোনের কিছু হলে সহ্য করতে পারেনা। টেনশনে হর্ড বেড়ে স্টোক করার মত হয়ে যায়। আব্বাই বা কিভাবে সয়বে এ বিয়োগ বেদনা। পৃথিবীর সব চেয়ে ভারি বাবার কাঁদে সন্তানের লাশ। এখন কুয়েত মরা লাশটাও পাঠাবে না দেশে।

কত আশা কত স্বপ্ন ছিলো জীবনে। সেই জীবন প্রদীপ আজ হাওয়ায় নিভু নিভু করছে। এভাবে সব রেখে হঠাৎ করে চলে যেতে হবে তা ভাবতে পারছি না। জীবনের কত কাজ বাকী তার কোনটা শেষ করতে পারলাম না। বাবা মা আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব সব ছেড়ে এভাবে চলে যেতে হবে এ অবেলায় এ কথা কি ভাবা যায়। আল্লাহ'র কাছে লাখকোটি শুকরিয়া আল্লাহ আমাকে যে প্রতিভা দিয়েছে তা অনেকে সাধনা করে পাইনা। কিন্তু সে প্রতিভার আলোয় অলোকিত করতে পারলামনা নিজেকে, পারলাম বাংলা সংস্কৃতিতে অবদান রাখতে। এ অল্প সময়ে না পরলাম নিজের জন্য কিছু করতে না পারলাম পরিবার, সমাজ রাষ্টের জন্য কিছু করতে। বুক ভেঙ্গে কান্না আসে অবুঝ ছেলেটার কথা ভেবে। আমি চলে গেলে তো ছেলে আমার এতিম হয়ে যাবে। পাগলী বউটারই বা কি হবে।  রিমঝিম বৃষ্টিতে হাত ধরে ভিজবার খুব শখ ছিলো সুখপাখিটার। ৯টি বর্ষা চলে গেলো তা আর হয়ে ওঠেনি। এমন কত শখ আল্লাদ অপূর্ণ রয়ে গেছে পাগলীটার। আমি ব্ড্ড অবিচার করেছি ওর উপর। জীবন দশায় ওকে সে ভাবে সময় দেওয়া হলোনা। আমি মরে গেলে কি হবে ওর। আমার এ সংসার বাবা মা ভাই বোন আত্মিয় স্বজনদের যে ভাবে ও আপন করে নিয়েছে। তাতে হয়তো কেউ ওকে দূরে ঠেলে দেবেনা। হয়তো ভালই থাকবে, স্বামী ছাড়া বিধবা নারী যেমন থাকে। ঢাকার বড় চাচা বড় মা খোকন চাচা, খুকি ফুপু হয়তো ওর একটা ব্যবস্থা করবে।  জীবনমান উন্নয়নের নামে অর্থের জন্য সামাজিক এ অসমপ্রতিযোগীতার দৌড়ে নিজের অজান্তে কখন যে দৌড় শুরু করেছি  বুঝতেই পারিনি। প্রায় পাঁচ বছর আজ প্রবাস নামের জেল খানাতে কাটিয়ে দিলাম। স্ত্রী সন্তান বাবা মা ভাই বোন পরিবার পরিজন নিয়ে ইচ্ছে করলে নুনভাত খেয়ে দেশেই বেশ কেটে যেতো। কিন্তু জীবন মান উন্নয়নের জন্য বিদেশে এসেছি। জীবনের পাওয়া না পাওয়ার হিসাব মেলে না কিছুতে। রাতে ঘুম আসেনা নানা চিন্তা মনকে ঘিরে ধরে কি করলাম কি হলো। যখন অতিরিক্ত কাঁশি শুরু হয়, শরীর জ্বরে পোড়ে ভেতর ভেতরে অসহ্য যন্ত্রনা মন আর স্থীর রাখতে পারিনা। ভাবি সকাল হলে হসপিটালে যাবো, ভর্তি হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নাই।  কখন সকাল হবে এমন ভাবনায় এপাশ ওপাশ করতে যখন রাত ভোর হতে শুরু করে তখন চোখ ঝেপে ঘুম আসে। ঘুম থেকে উঠে দেখি শরীরটা একটু  একটু ভালো লাগছে। তখন হাসপাতালে যাওয়ার কথা ভুলে যায়।

        মনবল আর বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছা শক্তি কাজে লাগিয়ে শুরু করলাম করোনা যুদ্ধ। এখানে হসপিটালে করোনা রোগীর তেমন কোন চিকিৎসা হচ্ছেনা। তাই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার চেয়ে রুমে থেকে চিকিৎসা নেওয়াটায় উত্তম। মন শক্ত করে রুমে থাকলাম উপসর্গ ভেদে ঔষধ খেতে থাকলাম। গ্রামে থাকতে পল্লী চিকিৎসক হিসাবে বেশ সুনাম ছিলো। আমার বাবার ঔষধের দোকান আছে। সেখানে সকাল বিকাল বসতাম। বিদেশে আসার আগে প্রায় তিন বছর কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজ হসপিটাল ময়মনসিংহ এ নিরাময় ক্ষুদ্র স্বাস্থ্যবীমায় চাকুরী করেছি। অভিজ্ঞতার ঝুলিটাও কম না। সেই অভিজ্ঞতা ও মানসিক শক্তি পুঁজি করে শুরু করলাম করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। বাবা মা পরিবার পরিজনের দোয়া ও আল্লাহ অশেষ কৃপাই বরকতে যথাযথ নিয়ম মেনে। শরীরে ইউমেন সিস্টেমকে কাজে লাগিয়ে আজ আমি পুরোপুরি সুস্থ্য। করোনা ভাইরাস নামের আজরাইলকে পরাজিত করে নতুন জীবন পেলাম। আল্লাহর কাছে লাখোকোটি শুখরিয়া। তিনি আমাকে আবার নতুন করে বাঁচার সুযোগ করে দিলেন।
বিষয়শ্রেণী: অভিজ্ঞতা
ব্লগটি ৭৪৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ৩০/০৭/২০২০

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast