একজন রব মিয়ার গল্প ও অন্যান্য
একজন রব মিয়ার গল্প ও অন্যান্য
টি এম আমান উল্লাহ*
এক
চারিদিকে বানের পানি থৈ থৈ করছে। এবার আগাম বন্যা হয়েছে। গ্রামের সবার ধান ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। রব মিয়ার দু’কানি জমি পানিতে ডুবে গেছে। রব মিয়ার কথায়, “ধানের থোরে পানি ঢুকছে, এহনও যদি পানি নাইম্যা যায়, তয় কিছু চিটা-মিটা পাইতাম। ধান না পাইলেও কিছু খড়-বিচালি পাইতাম, গরু দুইডা খাইয়া বাঁচত। অবশ্য বানে ডুবা ধান গাছ থেকে ভালো খড় পাওয়া যায় না, মোটা-ফাঁপা হয়, মলন দিয়েও খড় হয় না, নাড়া নাড়া হয়, গরু খাইতে চায় না।"
দুই
রব মিয়া গরীব মানুষ। বসতবাটির বাইরে তার সামান্য জমি জিরাত আছে। জমিতে সে মৌসুমে দু'বার ধান চাষ করে। তার জমিগুলোতে সবজিও চাষ করা যায়। কিন্তু সে জমিতে শুধু ধানই চাষ করে। রব মিয়ার কথায়, "সবজি ক্ষেতে ম্যালা খরচ, এক সপ্তাহ পর পর নিড়াতে হয়, সার দিতে হয়, বিষ দিতে হয়, বাঁশ কিনো বেড়া দেও...কত কী; এত টাকা পাই কনে? তার চেয়ে ধান চাষ করাই ভালো, একবারে মহাজনের থিকা টাকা নিয়া তেল-সার-বীজ কিন্না লই, ফসল কাইট্যা পরে মহাজনকে টাকা শোধ দিলেই হয়। আবার ধর যে, আমন ধানে খরচ কম। আল্লায় বাদল দিলে পানি সেচতে হয় না। খড়-জাবা গুলো গরুরে খাওয়াইয়া কিছু দুধও বিক্কিরি করতে পারি; মাইয়াডারে ইশকুলে পাঠাইতে পারি।"
তিন
দিন যায়, হপ্তা যায়, মাস পেরোয় না। রব মিয়ার বাড়িতে ওলা বিবির ন্যায় অভাব আসে। একমাত্র সম্বল গরু দুটিকে রব মিয়া মথুরাপুরের হাটে উঠায়। দু’মাস আগেও যে গরুর দাম পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা হত, তা ছাব্বিশ হাজার টাকায় বিক্রি করে। ক’কেজি চাল কিনে সবজীর দোকানে যায়। পেঁয়াজের কেজি ১২০ টাকা, কাঁচা মরিচ এক পোয়া ৪০ টাকা, বেগুন ৫৫ টাকা। কি কিনবে রব মিয়া ভেবে পায় না। পাশেই গোশতর দোকান। আলতা কসাই হাঁক-ডাক করে গোশত বিক্রি করছে। গরুর মাংশ ৩০০ টাকা, একদাম ৩০০ টাকা, দেইখ্যা নেন ৩০০ টাকা, লাল মাংস ৩০০ টাকা, তরতাজা ৩০০ টাকা। রব মিয়া অবাক হয়, ক’দিন আগেও গোশতর দোকানে মাছি ভিড়তে পারত না, প্রতি কেজি ৬০০ টাকা, নিলে নাও, না নিলে যাও। রব মিয়া হাফ কেজি গোশত, আর এক পোয়া পেঁয়াজ নিয়ে বাড়ি ফেরে।
গোশত দেখে রব মিয়ার বউ গালাগালের গোলাবারুদ ছুঁড়তে থাকে। একটু ক্লান্ত হলে ব্যাগ থেকে গোশতের পোটলা নামায়। বাজারের ব্যাগে আদা-রসুন-মসলাদি না দেখে রব মিয়ার বউ গোশতের পোটলা ছুঁড়ে মারতে উদ্যত হয়। রব মিয়া এবার রাগ সংবরণ না করতে পেরে তার বউয়ের কাঁধে-পিঠে সজোরে কতকগুলি কিল-ঘুষি দিয়ে কাঁধের ময়লা গামছার এক পাশ দিয়ে দু’ চোখের কোণা মুছে।
চার
ইশার নামাজের আযান হয়ে গেছে। রব মিয়ার বউ রেশমা বেগম তার নয় বছরের মেয়ে রোজিনাকে খেতে ডাকে। কন্যার পাতে দু’ টুকরো গোশত তুলে দিয়ে রেশমা বেগমের স্বামীর কথা মনে পড়ে। সমস্ত রাগ-অভিমান ভুলে গিয়ে রোজিনাকে বলে, “তোর বাপকে খাইতে ডাক।" “আমি পারব না, তুমি ডাকো।", মেয়ের ত্বরিত জবাব। অগত্যা রেশমা বেগম পিঁড়ি থেকে উঠে অন্ধকার ঘরখানির দরজায় দাঁড়ায়। “সে যাইব কই, ঝগড়া হইলে তো ওই বিছানায়ই গুটিসুটি হইয়া শুইয়া থাকে,” রেশমা বেগম মনে মনে ভাবতে থাকে। “ওগো হুনছেন? খাইতে আসেন,” বলতে গিয়েও রেশমা বেগমের গলা ধরে আসে। বিছানায় অন্ধকারে দু’হাত দিয়ে হাতড়িয়ে দু'টো বালিশ আর একটা ঘন সেলাইয়ের কাঁথা ছাড়া কিছু পায় না সে। চিৎকার দিয়ে মূর্ছা যায় রেশমা বেগম।
পাঁচ
অন্ধকার রাত। চারিদিকে ঘন কুয়াশা। ঝিরঝির বাতাস বইছে। ফিনফিনে চাদরে ঢাকা লিকলিকে শরীরটা কাঁপছে। রব মিয়া ঠাহর করতে পারে না, রাত কতটা পেরিয়ে গেছে। আনুমানিক দশটা বাজে। না আরও বেশী বাজে। মাত্র দশটা বাজলে তো রাস্তা-ঘাটে আরও বেশী গাড়ি-ঘোড়া থাকতো।
চান্দাইকোনার দিকে ধাবমান খানাখন্দে ভরা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে রব মিয়া। পকেটে আছে মাত্র দুশো টাকা। বিড়ির প্যাকেট হাতড়িয়ে ঠোঁটে ধরানো বিড়ির আবছা আলোতে সে দেখতে পেল দুই টাকার আরও দুটি নোট। অবশ্য চাইলে পকেট ভরা টাকা নিয়ে বের হতে পারত রব মিয়া। আজই তো সে ছাব্বিশ হাজার টাকায় গরু বিক্রি করেছে। কিন্তু হতচ্ছাড়া মহাজন তাকে ক্ষমা করে নি। বন্যায় ফসল ডুবে গেলেও তার পাওনা ষোল আনা বুঝে নিয়েছে। তাই অবশিষ্ট দুইটা পঞ্চাশ টাকার ও একটি একশ টাকার নোট নিয়ে রব মিয়া বের হয়েছে এক অনন্ত যাত্রায়।
চান্দাইকোনা বাজারের সামনে লোকাল যাত্রীর বাসস্ট্যান্ড। এলাকায় এটা মফিজ যাত্রীদের বাসস্ট্যান্ড নামেই পরিচিত। ঢাকা শহরে যারা পোশাক কারখানায় কাজ করে, অথবা যারা রিকশা চালাতে যায় তারাই এ বাসস্ট্যান্ড থেকে কম টাকায় জীবন বাজি রেখে লক্কর-ঝক্কড় বাস গুলোতে ওঠে। প্রায়ই এসব বাস এক্সিডেন্ট করে। মারা পড়ে সমাজে মূল্যহীন কতকগুলো মানুষ। এরা রানা প্লাজা ধ্বসে মরে। তাজরিনের অগ্নিকান্ডে মরে। রোডে-ঘাটেও মরে। বস্তাবন্দী হয়ে বিগলিত-বিকৃত এসব দেহের ঠাঁই হয় জুরাইনের গোরস্থানে। পেতাত্মাগুলো বিচারের আশায় রোজকেয়ামত পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের দুর্ভেদ্য দেয়ালের বাইরে ভনভন করে উড়ে বেড়ায়।
বাজারের উত্তর দিকে হোটেল 'ভোজন বিলাস'। তিন তারকা হোটেল। বিত্তশালীদের পানশালা। এখানে ডিলাক্স, সুপার ডিলাক্স, এসি, নন-এসি বাস থামে। এসব বাসের যাত্রীদের খানা-পিনা শেষ হলে বাসগুলো ছুটে চলে গন্তব্যর দিকে। রব মিয়া সেদিকে যাবার অবকাশ পায় না। দু'প্রস্থ না ভেবে সে হাঁটতে থাকে মফিজ বাসস্ট্যান্ড-এর দিকে।
ছয়
ঘণ্টা দুয়েক পেরিয়ে গেল। রাত বাড়ছে। কোন বাসের দেখা নাই। রব মিয়া ভেবেছিল ঢাকা যাবে। কিন্তু কোথায় যাবে, কার কাছে উঠবে, কি কাজ করবে--- তা সে জানে না। কাজ বলতে চাষাবাদ ছাড়া তো সে কিছু জানে না। ঢাকা শহরে সে কোন দিন যায়নি। তাই সেখানে চাষাবাদ হয় কিনা সে জানে না। অবশ্য ইট-কাঠের শহরে যে চাষাবাদের জমি থাকার কথা নয়, তা ঠাহর করতে তার অসুবিধা হয় না। ঘুমে দু’ চোখ ভেঙ্গে পড়ছে। সে কিছু ভাবতে পারছে না। এতক্ষণেও কোন বাসের দেখা নাই। নাকি সে বাসায় ফিরে যাবে? মহাজনকে বলে কিছু টাকা নিয়ে জমিতে মাসকলাই বুনলে কেমন হয়? আবার যদি বানের পানি আসে, তাহলে মহাজনের টাকা শোধ দেব কি করে? না আর একটু অপেক্ষা করি।
প্রচণ্ড প্রস্রাবের বেগ হয়েছে। সামনে একটু হেঁটে একটা নিচু জায়গায় গিয়ে প্রাকৃতিক কর্ম সারে রব মিয়া। রাস্তায় উঠে সে দেখতে পেল একটি ছাই রঙের প্রাইভেট কার। ড্রাইভার মনে হয় প্রস্রাব করতে গিয়েছে। হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল, “কোথায় যাবেন?” রব মিয়া চমকে উঠল। সে মনে মনে একটু খুশিও হল। আমতা আমতা করে সে বলল, “ঢাকা যামু।"
ড্রাইভারঃ গাড়িতে উঠে বসেন।
রব মিয়াঃ কিন্তু, ভাড়া লাগব কত?
ড্রাইভারঃ আরে বিবেচনা করে দিয়েন?
রব মিয়াঃ কিন্তু আমার কাছে তো বেশী ট্যাহা নাই।
ড্রাইভারঃ কত আছে?
রব মিয়াঃ একশ ট্যাহা। সে মনে মনে ভাবছে পথে-ঘাটে খুধা লাগলে বাকি একশ টাকা দিয়ে কিছু কিনে
খেতে পারবে। তাছাড়া বিপদ-আপদের কথাতো বলা যায় না।
ড্রাইভারঃ উঠেন, উঠেন। সামনের সিটে উঠেন। রব মিয়া গাড়ির দরজা খুলতে পারে না। ড্রাইভার দরজা খুললে সে ড্রাইভারের সাথে সামনের সিটে বসে পড়ে।
সাত
ঘন কুয়াশার আস্তর ভেদ করে ছুটে চলছে রব মিয়ার গাড়ি। পেছনে পরিবার আর সামনে অনিশ্চিত যাত্রার কথা ভাবতে ভাবতে রব মিয়া এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। সামনেই বেলতলা বাসস্ট্যান্ড। টহল পুলিশের একটি দল থামার নির্দেশ দিলে ড্রাইভার এলোমেলোভেবে গাড়ি চালিয়ে সামনে আগ্রসর হয়। পুলিশ পেছন পেছন ধাওয়া করে অষ্টরশী বাসস্ট্যান্ড-এর নিকট ধরে ফেলে। ড্রাইভার পাশে বসে থাকা রব মিয়াকে দেখিয়ে দিয়ে পাশের ঘন জঙ্গলের দিকে ভোঁদৌড় দেয়।
ক’দিন আগে নিখোঁজ হওয়া কুদ্দুস মিয়ার অপহরণকারী ও হত্যাকারী হিসেবে পুলিশ রব মিয়ার বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে।
*লেখকঃ প্রকাশনা কর্মকর্তা, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস), ঢাকা।
টি এম আমান উল্লাহ*
এক
চারিদিকে বানের পানি থৈ থৈ করছে। এবার আগাম বন্যা হয়েছে। গ্রামের সবার ধান ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। রব মিয়ার দু’কানি জমি পানিতে ডুবে গেছে। রব মিয়ার কথায়, “ধানের থোরে পানি ঢুকছে, এহনও যদি পানি নাইম্যা যায়, তয় কিছু চিটা-মিটা পাইতাম। ধান না পাইলেও কিছু খড়-বিচালি পাইতাম, গরু দুইডা খাইয়া বাঁচত। অবশ্য বানে ডুবা ধান গাছ থেকে ভালো খড় পাওয়া যায় না, মোটা-ফাঁপা হয়, মলন দিয়েও খড় হয় না, নাড়া নাড়া হয়, গরু খাইতে চায় না।"
দুই
রব মিয়া গরীব মানুষ। বসতবাটির বাইরে তার সামান্য জমি জিরাত আছে। জমিতে সে মৌসুমে দু'বার ধান চাষ করে। তার জমিগুলোতে সবজিও চাষ করা যায়। কিন্তু সে জমিতে শুধু ধানই চাষ করে। রব মিয়ার কথায়, "সবজি ক্ষেতে ম্যালা খরচ, এক সপ্তাহ পর পর নিড়াতে হয়, সার দিতে হয়, বিষ দিতে হয়, বাঁশ কিনো বেড়া দেও...কত কী; এত টাকা পাই কনে? তার চেয়ে ধান চাষ করাই ভালো, একবারে মহাজনের থিকা টাকা নিয়া তেল-সার-বীজ কিন্না লই, ফসল কাইট্যা পরে মহাজনকে টাকা শোধ দিলেই হয়। আবার ধর যে, আমন ধানে খরচ কম। আল্লায় বাদল দিলে পানি সেচতে হয় না। খড়-জাবা গুলো গরুরে খাওয়াইয়া কিছু দুধও বিক্কিরি করতে পারি; মাইয়াডারে ইশকুলে পাঠাইতে পারি।"
তিন
দিন যায়, হপ্তা যায়, মাস পেরোয় না। রব মিয়ার বাড়িতে ওলা বিবির ন্যায় অভাব আসে। একমাত্র সম্বল গরু দুটিকে রব মিয়া মথুরাপুরের হাটে উঠায়। দু’মাস আগেও যে গরুর দাম পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা হত, তা ছাব্বিশ হাজার টাকায় বিক্রি করে। ক’কেজি চাল কিনে সবজীর দোকানে যায়। পেঁয়াজের কেজি ১২০ টাকা, কাঁচা মরিচ এক পোয়া ৪০ টাকা, বেগুন ৫৫ টাকা। কি কিনবে রব মিয়া ভেবে পায় না। পাশেই গোশতর দোকান। আলতা কসাই হাঁক-ডাক করে গোশত বিক্রি করছে। গরুর মাংশ ৩০০ টাকা, একদাম ৩০০ টাকা, দেইখ্যা নেন ৩০০ টাকা, লাল মাংস ৩০০ টাকা, তরতাজা ৩০০ টাকা। রব মিয়া অবাক হয়, ক’দিন আগেও গোশতর দোকানে মাছি ভিড়তে পারত না, প্রতি কেজি ৬০০ টাকা, নিলে নাও, না নিলে যাও। রব মিয়া হাফ কেজি গোশত, আর এক পোয়া পেঁয়াজ নিয়ে বাড়ি ফেরে।
গোশত দেখে রব মিয়ার বউ গালাগালের গোলাবারুদ ছুঁড়তে থাকে। একটু ক্লান্ত হলে ব্যাগ থেকে গোশতের পোটলা নামায়। বাজারের ব্যাগে আদা-রসুন-মসলাদি না দেখে রব মিয়ার বউ গোশতের পোটলা ছুঁড়ে মারতে উদ্যত হয়। রব মিয়া এবার রাগ সংবরণ না করতে পেরে তার বউয়ের কাঁধে-পিঠে সজোরে কতকগুলি কিল-ঘুষি দিয়ে কাঁধের ময়লা গামছার এক পাশ দিয়ে দু’ চোখের কোণা মুছে।
চার
ইশার নামাজের আযান হয়ে গেছে। রব মিয়ার বউ রেশমা বেগম তার নয় বছরের মেয়ে রোজিনাকে খেতে ডাকে। কন্যার পাতে দু’ টুকরো গোশত তুলে দিয়ে রেশমা বেগমের স্বামীর কথা মনে পড়ে। সমস্ত রাগ-অভিমান ভুলে গিয়ে রোজিনাকে বলে, “তোর বাপকে খাইতে ডাক।" “আমি পারব না, তুমি ডাকো।", মেয়ের ত্বরিত জবাব। অগত্যা রেশমা বেগম পিঁড়ি থেকে উঠে অন্ধকার ঘরখানির দরজায় দাঁড়ায়। “সে যাইব কই, ঝগড়া হইলে তো ওই বিছানায়ই গুটিসুটি হইয়া শুইয়া থাকে,” রেশমা বেগম মনে মনে ভাবতে থাকে। “ওগো হুনছেন? খাইতে আসেন,” বলতে গিয়েও রেশমা বেগমের গলা ধরে আসে। বিছানায় অন্ধকারে দু’হাত দিয়ে হাতড়িয়ে দু'টো বালিশ আর একটা ঘন সেলাইয়ের কাঁথা ছাড়া কিছু পায় না সে। চিৎকার দিয়ে মূর্ছা যায় রেশমা বেগম।
পাঁচ
অন্ধকার রাত। চারিদিকে ঘন কুয়াশা। ঝিরঝির বাতাস বইছে। ফিনফিনে চাদরে ঢাকা লিকলিকে শরীরটা কাঁপছে। রব মিয়া ঠাহর করতে পারে না, রাত কতটা পেরিয়ে গেছে। আনুমানিক দশটা বাজে। না আরও বেশী বাজে। মাত্র দশটা বাজলে তো রাস্তা-ঘাটে আরও বেশী গাড়ি-ঘোড়া থাকতো।
চান্দাইকোনার দিকে ধাবমান খানাখন্দে ভরা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে রব মিয়া। পকেটে আছে মাত্র দুশো টাকা। বিড়ির প্যাকেট হাতড়িয়ে ঠোঁটে ধরানো বিড়ির আবছা আলোতে সে দেখতে পেল দুই টাকার আরও দুটি নোট। অবশ্য চাইলে পকেট ভরা টাকা নিয়ে বের হতে পারত রব মিয়া। আজই তো সে ছাব্বিশ হাজার টাকায় গরু বিক্রি করেছে। কিন্তু হতচ্ছাড়া মহাজন তাকে ক্ষমা করে নি। বন্যায় ফসল ডুবে গেলেও তার পাওনা ষোল আনা বুঝে নিয়েছে। তাই অবশিষ্ট দুইটা পঞ্চাশ টাকার ও একটি একশ টাকার নোট নিয়ে রব মিয়া বের হয়েছে এক অনন্ত যাত্রায়।
চান্দাইকোনা বাজারের সামনে লোকাল যাত্রীর বাসস্ট্যান্ড। এলাকায় এটা মফিজ যাত্রীদের বাসস্ট্যান্ড নামেই পরিচিত। ঢাকা শহরে যারা পোশাক কারখানায় কাজ করে, অথবা যারা রিকশা চালাতে যায় তারাই এ বাসস্ট্যান্ড থেকে কম টাকায় জীবন বাজি রেখে লক্কর-ঝক্কড় বাস গুলোতে ওঠে। প্রায়ই এসব বাস এক্সিডেন্ট করে। মারা পড়ে সমাজে মূল্যহীন কতকগুলো মানুষ। এরা রানা প্লাজা ধ্বসে মরে। তাজরিনের অগ্নিকান্ডে মরে। রোডে-ঘাটেও মরে। বস্তাবন্দী হয়ে বিগলিত-বিকৃত এসব দেহের ঠাঁই হয় জুরাইনের গোরস্থানে। পেতাত্মাগুলো বিচারের আশায় রোজকেয়ামত পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের দুর্ভেদ্য দেয়ালের বাইরে ভনভন করে উড়ে বেড়ায়।
বাজারের উত্তর দিকে হোটেল 'ভোজন বিলাস'। তিন তারকা হোটেল। বিত্তশালীদের পানশালা। এখানে ডিলাক্স, সুপার ডিলাক্স, এসি, নন-এসি বাস থামে। এসব বাসের যাত্রীদের খানা-পিনা শেষ হলে বাসগুলো ছুটে চলে গন্তব্যর দিকে। রব মিয়া সেদিকে যাবার অবকাশ পায় না। দু'প্রস্থ না ভেবে সে হাঁটতে থাকে মফিজ বাসস্ট্যান্ড-এর দিকে।
ছয়
ঘণ্টা দুয়েক পেরিয়ে গেল। রাত বাড়ছে। কোন বাসের দেখা নাই। রব মিয়া ভেবেছিল ঢাকা যাবে। কিন্তু কোথায় যাবে, কার কাছে উঠবে, কি কাজ করবে--- তা সে জানে না। কাজ বলতে চাষাবাদ ছাড়া তো সে কিছু জানে না। ঢাকা শহরে সে কোন দিন যায়নি। তাই সেখানে চাষাবাদ হয় কিনা সে জানে না। অবশ্য ইট-কাঠের শহরে যে চাষাবাদের জমি থাকার কথা নয়, তা ঠাহর করতে তার অসুবিধা হয় না। ঘুমে দু’ চোখ ভেঙ্গে পড়ছে। সে কিছু ভাবতে পারছে না। এতক্ষণেও কোন বাসের দেখা নাই। নাকি সে বাসায় ফিরে যাবে? মহাজনকে বলে কিছু টাকা নিয়ে জমিতে মাসকলাই বুনলে কেমন হয়? আবার যদি বানের পানি আসে, তাহলে মহাজনের টাকা শোধ দেব কি করে? না আর একটু অপেক্ষা করি।
প্রচণ্ড প্রস্রাবের বেগ হয়েছে। সামনে একটু হেঁটে একটা নিচু জায়গায় গিয়ে প্রাকৃতিক কর্ম সারে রব মিয়া। রাস্তায় উঠে সে দেখতে পেল একটি ছাই রঙের প্রাইভেট কার। ড্রাইভার মনে হয় প্রস্রাব করতে গিয়েছে। হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল, “কোথায় যাবেন?” রব মিয়া চমকে উঠল। সে মনে মনে একটু খুশিও হল। আমতা আমতা করে সে বলল, “ঢাকা যামু।"
ড্রাইভারঃ গাড়িতে উঠে বসেন।
রব মিয়াঃ কিন্তু, ভাড়া লাগব কত?
ড্রাইভারঃ আরে বিবেচনা করে দিয়েন?
রব মিয়াঃ কিন্তু আমার কাছে তো বেশী ট্যাহা নাই।
ড্রাইভারঃ কত আছে?
রব মিয়াঃ একশ ট্যাহা। সে মনে মনে ভাবছে পথে-ঘাটে খুধা লাগলে বাকি একশ টাকা দিয়ে কিছু কিনে
খেতে পারবে। তাছাড়া বিপদ-আপদের কথাতো বলা যায় না।
ড্রাইভারঃ উঠেন, উঠেন। সামনের সিটে উঠেন। রব মিয়া গাড়ির দরজা খুলতে পারে না। ড্রাইভার দরজা খুললে সে ড্রাইভারের সাথে সামনের সিটে বসে পড়ে।
সাত
ঘন কুয়াশার আস্তর ভেদ করে ছুটে চলছে রব মিয়ার গাড়ি। পেছনে পরিবার আর সামনে অনিশ্চিত যাত্রার কথা ভাবতে ভাবতে রব মিয়া এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। সামনেই বেলতলা বাসস্ট্যান্ড। টহল পুলিশের একটি দল থামার নির্দেশ দিলে ড্রাইভার এলোমেলোভেবে গাড়ি চালিয়ে সামনে আগ্রসর হয়। পুলিশ পেছন পেছন ধাওয়া করে অষ্টরশী বাসস্ট্যান্ড-এর নিকট ধরে ফেলে। ড্রাইভার পাশে বসে থাকা রব মিয়াকে দেখিয়ে দিয়ে পাশের ঘন জঙ্গলের দিকে ভোঁদৌড় দেয়।
ক’দিন আগে নিখোঁজ হওয়া কুদ্দুস মিয়ার অপহরণকারী ও হত্যাকারী হিসেবে পুলিশ রব মিয়ার বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে।
*লেখকঃ প্রকাশনা কর্মকর্তা, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস), ঢাকা।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মধু মঙ্গল সিনহা ১৯/০১/২০১৮ভালো করেছেন, ধন্যবাদ আপনাকে।
-
আরিফ নীরদ ১৬/১২/২০১৭চমৎকার
-
তরীকুল ইসলাম সৈকত ১২/১২/২০১৭সুন্দর লেখনী!!!
-
শাহানাজ সুলতানা (শাহানাজ) ১১/১২/২০১৭দারুণ
-
কামরুজ্জামান সাদ ১১/১২/২০১৭অপূর্ব
-
আব্দুল হক ০৯/১২/২০১৭সুন্দর লিখা!!