পরিবর্তনের ডাক
বিবেকের তাড়নায় আজ আমি আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। জাতি যেখানে বিভক্তির চরমে, নেতৃত্ব যেখানে লক্ষ্যভ্রষ্ট, আমি সেখানে চুপ থাকতে পারিনি। যে সমস্ত বিষয় প্রতিনিয়ত আমাকে ভাবায়, আমাকে তাড়া করে, আজ আমি সেগুলো আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই। আমার ভাবনাগুলো আজ আপনাদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই। আপনাদের বিবেক আর আবেগকে নাড়া দিতে চাই। আমার বিশ্বাস আজকের এই ভাষণ একটি সুন্দর গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা পালন করবে।
প্রিয় দেশবাসী,
আমি নেতা হতে আসিনি। আমি নেতৃত্বকে জাগ্রত করতে এসেছি। আজ ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে নেতুত্বের যে শূণ্যতা সৃষ্টি হয়েছে সে শূণ্যতা পূরণে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে এসেছি। আসুন আমরা সবাই মিলে নেতৃত্ব দিই। পরিবর্তনের নেতৃত্ব। একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব। আমি যে পরিবর্তনের কথা বলছি, সে পরিবর্তন কারো একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সতেরো কোটি মানুষের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ। প্রত্যেককে যার যার অবস্থান থেকে পরিবর্তনের জন্য উদ্যোগী হতে হবে। নেতৃত্বের বিকাশ ঘটাতে হবে নিজেকে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। আসুন আজ আমরা পরিবর্তনের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হই। তাহলেই আমাদের জীবন হবে আরো সহজ, আরো সুন্দর।
বন্ধুগণ, আজ অত্যন্ত দুঃখের সহিত বলতে হয়, বিশ্ব যেখানে অশ্ববেগে সম্মুখগামী আমরা সেখানে কচ্ছপের মত ক্ষীণপায়ে এলোমেলো হাটছি। স্বাধীনতার ৪২ বছরেও আমরা আমাদের গন্তব্য ঠিক করতে পারিনি। আমরা যে যে দিকে পারছি সেদিকে ছুটছি। ভোগ বিলাসে ভাসিয়ে রেখেছি গা। ন্যায় অন্যায়ের বিশ্লেষণ আমাদের কাছে আজ অতি তুচ্ছ। আমরা সত্য ও সুন্দর থেকে সরিয়ে ফেলেছি নিজেদেরকে। আমাদের বিবেক বোধ আর জাতীয়তা বোধ শূণ্যে নেমে এসেছে। কিন্তুু এ অবস্থায় একটি জাতি চলতে পারে না। এখনই আমাদেরকে ঘুরে দাড়াতে হবে। আর বিলম্ব করার সুযোগ নেই। পরিবর্তনের প্রত্যয় নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। আমাদেরকে ভুলে গেলে চলবেনা – আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাসের কথা। আমরা যে চাইলেই যে কোন কিছু করতে পারি তার প্রমান কিন্তু আমরা যুগে যুগে করে এসেছি। আমরা ৪৭ শে দেখেছি, আমরা ৫২ তে দেখেছি, আমরা ৭১ এ দেখেছি আমরা কি পারি। আমরা সবই পারি। যে কোন ক্রান্তিতে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারি, বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারি। অতএব এবারও আমাদেরকে পারতে হবে। আমাদেরকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিজয় অর্জন করতে হবে। প্রত্যেককে উপলব্ধি করতে হবে যে এর বিকল্প কোন পথ আমাদের জন্য খোলা নেই। আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য একমাত্র পথ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিজয় অর্জন করা। আমি আগেই বলেছি, এর জন্য প্রয়োজন সতেরো কোটি মানুষের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ। আর সকলের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণই আমাদের বিজয় নিশ্চিত করতে পারে। অতএব আসুন আজ আমরা বিজয়ের লক্ষ্যে আমাদের করণীয়গুলো ঠিক করি অতঃপর সেই অনুযায়ী কার্যারম্ভ করি।
জাতীয় নেতৃবৃন্দকে বলছি। আপনারা ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, চীন ও রাশিয়ার দিকে তাকান। দেখুন সঠিক নেতৃত্ব একটি জাতিকে কোথায় পৌঁছে দিতে পারে। অতএব, আমার অনুরোধ, আপনারা আপনাদের দায়ীত্বটুকু ভালভাবে বুঝুন এবং সঠিকভাবে পালন করুণ। আপনাদের দায়ীত্ব হল একটি সুন্দর জাতীয় লক্ষ্য স্থির করা যার মধ্যে জনগণের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। অর্থাৎ আপনারা ঠিক করবেন, আজ থেকে দশ বছর পর জাতীয় উন্নয়নের চলকগুলোকে কোন পর্যায়ে দেখতে চান। যেমন – দশ বছর পর বাংলাদেশের জনসংখ্যা কত হবে, শিক্ষিতের হার ও দক্ষ জনশক্তির হার কত হবে, তথ্যপ্রযুক্তি, আভ্যন্তরিণ যোগাযোগ ও অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন কিরূপ হবে, মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবা কোথায় পৌঁছে দেওয়া হবে, কৃষির আধুনিকায়ন ও শিল্পের উন্নয়ন কতখানি হবে, রপ্তানী লক্ষ্যমাত্রা কত হবে, নতুন কর্ম সংস্থান কত হবে, জিডিপি কোথায় উন্নীত করতে হবে, প্রবৃদ্ধির হার কত হবে ইত্যাদি। তাছাড়াও আপনাদেরকে ঠিক করতে হবে- আমাদের আন্তর্জাতিক নীতি কি হবে, বিশ্ব রাজনীতিতে ও বিশ্ব অথনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান কি হবে এবং কোন পর্যায়ে বাংলাদেশ নেতৃত্ব দিবে। দেশে প্রতিটি বিষয়ের উপর গবেষক এবং বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। তারা আমাদের জাতীয় সম্পদ। জাতীয় লক্ষ্য ও নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে আপানারা তাদের পরামর্শ নিবেন। তাছাড়াও সাধারণ জনগণের প্রত্যাশার উপর একটি নমুনা জরিপ করে নেয়া প্রয়োজন যাতে লক্ষ্য নির্ধারণ বা পরিকল্পনা প্রণয়নে তাদের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব হয়। গবেষক এবং বিশেষজ্ঞগণ এ ক্ষেত্রে আপনাদেরকে সহযোগিতা করবেন। এরপর কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে কার্য-করণ ঠিক করতে হবে। মনে রাখতে হবে – কোন একটি গোষ্ঠি, কোন একটি সম্প্রদায় অথবা কোন একটি দলের পক্ষে জাতীয় লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। বরং এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন সতের কোটি মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ। আমার বিশ্বাস, সতের কোটি কন্ঠের একসঙ্গে স্লোগান আকাশ পাতাল প্রকম্পিত করতে পারে; আর চৌত্রিশ কোটি হাত একসাথে ধুলিস্যাৎ করে দিতে পারে পৃথিবীর যে কোন বাধা। তবে এই সতের কোটি মানুষকে একত্রিত করার এবং উজ্জীবিত করার দায়িত্ব জাতীয় নেতৃবৃন্দের। আপনারা গণসংযোগ ও প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে সকলকে উজ্জীবিত করতে পারেন। আপনারা স্মরণ করুণ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের কথা। স্মরণ করুণএকটি মাত্র ভাষণ কিভাবে সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে একত্রিত করে স্বাধীনতা অর্জনের নিমিত্তে রনাঙ্গনে উপস্থিত করেছিল। আজ এমন একজন নেতার প্রয়োজনীয়তা জাতি মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করছে। অতএব কেউ একজন দায়ীত্ব গ্রহণ করুণ। সতের কোটি মানুষকে স্বপ্ন দেখানোর দায়ীত্ব, উজ্জিবিত করার দায়ীত্ব, একত্রিত করার দায়ীত্ব। দেখবেন লক্ষ্য অর্জন কত সহজ। প্রিয় নেতৃবৃন্দ, আপনারা যে লক্ষ্য ও নীতি সমূহ স্থির করবেন তা জনগণকে জানিয়ে দিবেন। জনগণ সেই লক্ষ্য ও নীতি বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ শ্রম দিবে। অপনারা শুধু খেয়াল রাখবেন এদেশের প্রত্যেকটি মানুষ যেন সম্মিলিত শ্রমের সুফল ভোগ করতে পারে। আমার দেশের সাধারণ মানুষ যেন যার যার প্রাপ্য থেকে চুল পরিমান বঞ্চিত না হয়। আপনারা অরো খেয়াল রাখবেন – কোন স্বার্থান্বেষী মহল যেন সাধারণ মানুষের শ্রম শোষণ করে আয়েশের অট্টালিকা গড়তে না পারে। তাহলেই দেখবেন- সাধারণ মানুষের কাজের গতি দ্বিগুণ তিনগুণ হয়ে গেছে; আর জাতি পৌঁছে গেছে তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে।
প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা কর্মচারিদেরকে বলছি। আপনারা আপনাদের সরকারী পদ ও দায়ীত্বসমূহ ভালভাবে বুঝুন। আপনারা ভুলে যাবেন না যে আপনারা জনগণের প্রশাসক নন, বরং জনগণের সাহায্যকারী; জনগণের সেবক। জনগণের টেক্সের টাকার উপর আপনাদের জীবিকা নির্ভরশীল। সুতরাং, জাতীয় লক্ষ্য ও নীতি বাস্তবায়নে জনগণকে সহযোগিতা করুণ। আপনাদের জীবিকাটুকু পবিত্র রাখুন। আপনাদের আয় রোজগারের উপর আপনাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জীবিকাও নির্ভরশীল। অতএব তাদেরকেও পবিত্র রাখুন। আপনারা শিক্ষিত মানুষ, আশা করি আমার কথাগুলো আপনাদের বুঝতে অসুবিধা হবেনা। দয়া করে উল্টো অর্থ বানিয়ে গায়ে মেখে নিজেদের নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিবেন না। আসুন আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই – আজ থেকে আমরা দুর্ণীতি করবনা, দুর্ণীতিকে প্রশ্রয়ও দেবনা। আপনাদের দৃঢ় প্রত্যয় দূর্ণীতি মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য যথেষ্ট। জনগণ আপনাদেরকে সহযোগিতা করবেন।
জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা কর্মচারী ব্যতীত অন্যান্যদেরকে বলছি। আপনাদের চেষ্টা ও শ্রমের উপর এদেশের অর্থনীতি দাড়িয়ে আছে। দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হলে আপনাদের জীবন যাত্রার মান উন্নত হবে। আজ অত্যন্ত দুঃখের সহিত বলতে হয় – স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ বছরেও আমরা আমাদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারিনি। এখনও চিকিৎসার অভাবে, শীত বস্ত্রের অভাবে মানুষের মৃত্যু হয়। খোলা আকাশের নিচে এখনো মানুষ রাত্রি যাপন করে। আমার দেশের বিশাল জনগোষ্ঠি এখনো শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। এখনো অর্ধাহারে অনাহারে দিনাতিবাহিত করে অসংখ্য মানুষ। এই ব্যর্থতা কার? আমি বলব – এই ব্যর্থতা আমাদের সকলের। সরকারের উপর দোষ চাপিয়ে কোন লাভ নেই। মনে রাখবেন- সরকার চাইলেই সবকিছু করতে পারেনা কিন্তু জনগণ চাইলেই পারে। সরকার কোন কাজ করতে চাইলে অর্থ বরাদ্ধের প্রয়োজন হয়। জনগণ চাইলে অর্থের প্রয়োজন হয়না। প্রয়োজন হয় উদ্যোগের। আসুন গ্রাম পর্যায়ের ও ইউনিয়ন পর্যায়ের রাস্তা-ঘাট তৈরির জন্য নিজেরা হাড়ি কোদাল হাতে নিই। দেখি রাস্তা ঘাট হয় কিনা। দেশে আজ ৬৫ শতাংশ মানুষ অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন। আসুন একজন অক্ষর জ্ঞান সম্পন মানুষ একজন নিরক্ষর মানুষকে অক্ষর শেখানোর দায়ীত্ব নিই। দেখি জাতি শিক্ষিত হয় কিনা। আসুন আমাদের বাড়ির এবং আশেপাশের পতিত জায়গাগুলোতে ফল ফসলাদি ফলানোর দায়ীত্ব নিই। খালে-বিলে ও ডোবা-নালায় মাছের চাষ করি। দেখি জাতি আর অপুষ্টিতে ভোগে কিনা। এসব উন্নয়নের জন্য সরকারী বরাদ্ধের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু উদ্যোগের। তাছাড়া আমরা চাইলে সরকারও সহযোগিতা করতে বাধ্য থাকবে। সুতরাং, নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য নিজেদেরকেই উদ্যোগী হতে হবে, নিজেদেরকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। অতএব আর বিলম্ব নয়। আসুন পরিবর্তন আনায়ন ও লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে এখনই আমরা কাজে নেমে পড়ি। প্রিয় দেশবাসী, আমাদের সব কাজের আগের কাজ নিজেদের মানষিকতা পরিবর্তন করা। আজ আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, আপনারা সত্য ও ন্যায়ের পথকে আকড়ে ধরুন, অন্যায় ও অসত্যকে পরিহার করুন। আত্মকেন্দ্রিকতা ও ভোগবাদী চিন্তা চেতনা থেকে বেড়িয়ে আসুন। দয়া করে নিজেদের অকল্যান হয় এমন কাজ আপনারা করবেননা। আপনারা ভুলে যাবেন না যে আপনাদেরকে একদিন বিচারের মুখোমুখি হতে হবে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য। সুতরাং আসুন, সবাই মিলে সমাজে ভাল কাজের প্রতিযোগিতা তৈরি করি। একে অন্যের সহযোগিতায় এগিয়ে আসি। আর তাতে আপনার নিজের যেমন কল্যান হবে, তেমনি উপকৃত হবে আপনার পরিবার, আপনার সমাজ এবং আপনার জাতি। বন্ধুগণ, আপনারা যদি সমাজ, দেশ ও জাতির কথা নাও ভাবেন, শুধু নিজের কল্যানের কথাই যদি ভাবেন তাহলেও যথেষ্ঠ। কিন্তু, আজ অত্যন্ত দুঃখের সহিত বলতে হয় – আমরা বাঙালিরা, নিজের ভাল-মন্দ বুঝার ক্ষমতাটুকু রাখিনা। যার ফলে এ জাতি আজ একটি পশ্চাদপদ ও হাস্যকর জাতি হিসেবে পরিনত হয়েছে। গরীব দেশ হিসেবে আমাদেরকে প্রভাবশালী অনেক দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার উপদেশ-তিরস্কার শুনতে হয়। কারণ একটিই। আর তা হল আমাদের মেরুদন্ড দুর্বল। সাহায্যের জন্য আমাদেরকে তাদের কাছে হাত পাততে হয়। অথচ আমরা যদি ব্যাক্তিক পর্যায়ে সচেষ্ট হই তাহলে জাতি কারো কাছে হাতও পাততে হয়না কারো উপদেশ-তিরস্কারও শুনতে হয় না। কারণ আমরা আছি সতের কোটি মানুষ। আমাদের আছে চৌত্রিশ কোটি হাত। আর আছে ১৪৭৫৭০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের একটি অতি উর্বর ভূখন্ড। চৌত্রিশ কোটি হাত যদি এই ভূখন্ডে সঠিকভাবে কাজ করে, তাহলে এখানে সোনা ফলানো সম্ভব।
প্রিয় দেশবাসী,
আমার কথা মনযোগ দিয়ে শ্রবণ করুন। আর তাতে আপনাদেরই মঙ্গল হবে। আপনারা আপনাদের জীবিকাটুকু পবিত্র রাখুন। অধিক পরিশ্রমের মাধ্যমে আয় রোজগার বৃদ্ধি করুণ। আর তাতে আপনাদের দেহ ও মন পবিত্র থাকবে, জীবন যাত্রার মান উন্নত হবে। দয়া করে অন্যায় পথে পা বাড়াবেন না। কারণ এর পরিনাম কখনই ভাল হয় না। এমনকি অপবিত্র দেহ ও মন নিয়ে প্রার্থনা করলে, প্রার্থনা পর্যন্ত কবুল হয় না। সুতরাং সাবধান হউন। নিজে পবিত্র থাকুন এবং আপনার আয় রোজগারের উপর যাদের জীবিকা নির্ভরশীল তাদেরকেও পবিত্র রাখুন। আপনারা ভুলে যাবেন না যে আপনাদেরকে একদিন বিচারের মুখোমুখি হতে হবে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য। আমি আশা করছি আমাদের সবার বিবেক জাগ্রত হবে। সবাই মিলে ঝাপিয়ে পড়বেন ব্যক্তিগত ও জাতীয় কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে। এই মর্মে আপনাদেরকে আজ আমি কিছু কর্ম করণীয় সম্পর্কে বলব। আপনারা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের জনগণের দিকে তাকান। তাদের কাছ থেকে দেশপ্রেম শিখুন। তাদের কাছ থেকে গণতন্ত্র শিখুন। নিজকে ভালবাসুন, নিজের দেশকে ভালবাসুন, দেশের মানুষকে ভালবাসুন, প্রত্যেকের মতামতকে সম্মান করুন, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে গ্রহণ করুন, পেশী শক্তিকে বিদায় জানান। মনে রাখবেন, সবগুলো একই সূত্রে গাঁথা। একটি বাদ দিয়ে অপরটি কল্পনা করা যায় না। আপনাদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনে প্রত্যেকটি পর্যায়ে গণতান্ত্রিক উপায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন। নিজেদেরকে একটি নিয়মের আওতায় এনে জীবন যাপন করুন। দেখবেন জীবন কত সুশৃঙ্খল ও সুন্দর। আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, আপনারা আর ঊশৃঙ্খল ও অসুন্দর জীবন চর্চা করে নিজেদের নির্বুদ্ধিতা জাহির করবেনা, কষ্ট ডেকে আনবেননা।
প্রিয় দেশবাসী,
আমাদের জাতিকে শতভাগ শিক্ষিত হতে হবে। শিক্ষা ব্যতীত জাতীয় অগ্রগতি অসম্ভব। পৃথিবীতে যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতির মানষিকতা তত উন্নত। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ শ্রীলংকা এবং মালদ্বীপ যদি শতভাগ শিক্ষিত হতে পারে, তাহলে আমরা পারবনা কেন? আমাদের আরো আগেই পারা উচিত ছিল। যাহোক, আর বিলম্ব করার সুযোগ নেই। যারা শিক্ষিত আছেন, তারা বাকিদের দায়ীত্ব নিন। আপনাদের মধ্যে যারা বিত্তশালী তারা শিক্ষার জন্য অবকাঠামো তৈরিতে অবদান রাখুন। সরকারকে সহযোগিতা করুন। আর যারা বিত্তশালী নন অথচ শিক্ষিত তারা পাঠদান কার্যক্রমে অংশ নিন। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় – যে যেই পর্যায়ে শিক্ষাদানে সামর্থ রাখেন, সেখানে একটু সময় দিন। জাতিকে শিক্ষিত করার লক্ষ্যে সপ্তাহে অন্তত একটি ঘন্টা সময় ব্যয় করুন। যাদের হাতে সময় আছে তাদেরকে একটু বেশি সময় দেয়্ার জন্য অনুরোধ করছি। আপনাদের এই অবদান সরকারের শিক্ষা কার্যক্রমকে বেগবান করবে।
অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রেও আমি একই ধরণের পরামর্শ দেব। গ্রাম এবং ইউনিয়ন পর্যায়ের সড়কগুলো আপনারা নিজেরা তৈরি করে নিন। আপনারা নিজেদের ধানি জমি দিতে পারেন, আর দুই কোদাল মাটি মাথায় নিতে না পারার কোন কারণ আছে বলে আমি মনে করিনা। যে রাস্তার উপর দিয়ে নিজেরা হাটবেন, নিজেদের যানবাহন চলাচল করবে সে রাস্তার মাটি মাথায় বহন করা লজ্জাজনক নয়, বরং সম্মানজনক। যারা গ্রামে গ্রামে মারামারিতে, মিছিলে ও মামলা মোকাদ্দমায় নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন, তাদেরকে অনুরোধ করছি, আপনারা এসব বাদ দিয়ে গঠনমূলক কাজে নেতৃত্ব দিন। তাহলেই দেখবেন ৮৬ হাজার গ্রাম সমানভাবে উন্নত হবে। আর মহাসড়ক, ব্রিজ, কালভার্ট ও রেলপথ নির্মাণে সরকার আপনাদেরকে সহায়তা করবে।
প্রিয় দেশবাসী,
আমাদের অর্থনীতি কৃষি নির্ভর অর্থনীতি। এদেশের ৮৪ শতাংশ মানুষ কৃষি কাজের সাথে সম্পৃক্ত যারা গ্রামে বসবাস করেন। কিন্তু এই বিশাল জনগোষ্ঠী বছরের প্রায় চার মাস সময়ই কর্মহীন থাকেন যখন সারা দেশে বর্ষা থাকে। আমাদেরকে এই সময়টুকু কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে। হস্ত ও কুটির শিল্পের প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেরা পারিবারিক পরিসরে ব্যবসায় শুরু করতে পারেন। তাতে আপনাদের আয় রোজগার বৃদ্ধি পাবে, জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে এবং গ্রামীন অর্থনীতি শক্তিশালী হবে। সর্বোপরি দেশের উন্নয়ন হবে। সরকার বিনামূল্যে অথবা স্বল্পমূল্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে আপনাদের সহযোগিতা করবেন। আর কৃষি যেহেতু আমাদের অর্থনীতির মূল ভিত্তি সেহেতু কৃষির উন্নয়নে সবাইকে আরো বেশি কাজ করতে হবে। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারকে কৃষি গবেষণার উপর আরো জোর দিতে হবে। প্রতিনিয়ত শস্য ও ফসলের উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করতে হবে। সরকারকে এ সংক্রান্ত আরেকটি বিষয়ের উপর কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে। আর তা হল কৃষকের ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা। অন্যথায় কৃষক এবং কৃষি কোনটিকেই বাচাঁনো সম্ভব হবেনা।
প্রিয় দেশবাসী,
আমাদের অর্থনীতি কৃষি নির্ভর হলেও শিল্প-বানিজ্যের গুরুত্ব এখানে কম নয়। দেশীয় চাহিদা মেটাতে এবং আমদানীর উপর নির্ভরশীলতা কমাতে শিল্পের উন্নয়ন ঘটানোর কোন বিকল্প নেই। বন্ধুগণ, বাংলাদেশ হল শিল্প-বানিজ্যের জন্য একটি অপার সম্ভানাময় দেশ। এখানে আছে সতের কোটি মানুষের বিশাল বাজার। আমরা যদি রপ্তানি করতে নাও পারি, শুধু মাত্র আভ্যন্তরীণ বাজারে নিজেদের পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারি তাহলেই শিল্প প্রতিষ্ঠান টিকে থাকার জন্য যথেষ্ঠ। আমাদের শিল্প পণ্যের চাহিদা দেশীয় উৎপাদনের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব হয়না বলেই কিন্তু প্রত্যেক বছর আমাদেরকে হাজার হাজার কোটি টাকার শিল্প পণ্য আমাদানি করতে হয়। অথচ চেষ্টা করলেই এসব পণ্য আমরা আমাদের দেশে উৎপাদন করতে পারি। বিশেষজ্ঞগণের মতে, শিল্প কারখানা স্থাপন ও এর বিকাশ ঘটানোর জন্য বাংলাদেশ একটি অতিশয় উপযোগী দেশ। বিশাল বাজারের পাশাপাশি প্রচুর পরিমানে শিল্পের কাঁচামাল, অনুকূল জলবায়ূ, সস্থা শ্রম এবং নিজস্ব সমুদ্র বন্দরসহ সকল সুবিধাই এখানে বিদ্যমান। এখন প্রয়োজন শুধু উদ্যোগের। সাহস করে ব্যবসায়ে নেমে পড়লেই হয়। মনে রাখবেন ভাগ্য সাহসীদের অনুকূলে থাকে। যারা শুরু করেছে, তারা কিন্তু সফল হয়েছে। আর এই দৃষ্টান্ত দেখার জন্য বেশি দূর যেতে হয়না। আমাদের দেশের সফল শিল্পপতিদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সত্যটুকু জানতে পারবেন যা আপনাদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। যার আজকে দেশে প্রতিষ্ঠিত শিল্পোদ্যোক্তা, যাদের প্রতিষ্ঠানে এখন হাজার হাজার কর্মী কাজ করে, তাদের অধিকাংশেরই ব্যবসা শুরু হয়েছিল ক্ষুদ্র পরিসরে। নিজের মেধা ও শ্রম কাজে লাগিয়ে তারা আজ সফল। এমন অনেক সফল শিল্পোদ্যোক্তা আছেন যাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের সুযোগটুকু হয়নি অথচ বড় হওয়ার অদম্য ইচ্ছা তাদেরকে সফল করে তুলেছে। বন্ধুগণ, আমার অত্যন্ত কষ্ট হয় যখন দেখি আমার দেশের মেধাবী ছেলেরা মেয়েরা লেখা পড়া শেষ করে একটি সরকারী চাকুরী পাবার জন্য তেত্রিশ জোড়া জুতার তলা ক্ষয় করে আর নষ্ট করে যৌবনের অতি মূল্যবান সময়। আবার তাদের অনেকে মোটা অঙ্কের ঘুষের টাকাও পকেটে নিয়ে ঘুরে; শুধুমাত্র সরকারী চাকুরীর জন্য। আর এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে কতিপয় সরকারী আমলা ও রাজনীতিক অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ছে। আজ তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, এই কাজ আপনাদের শোভা পায় না। আপনাদেরকে অনুরোধ করছি- দয়া করে অন্যায় করবেন না, অন্যায়ের সুযোগও তৈরি করে দেবেন না। ঘুষের টাকা পকেটে নিয়ে চাকুরীর পিছনে না ছুটে, সেই টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করুন। আপনারা শিক্ষিত মানুষ। আপনারা অনেক ভাল করবেন। যারা শিক্ষিত অথচ বেকার তাদের কাছে আমার অনুরোধ, আপনারা আপনাদের মেধাটুকু কাজে লাগান। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে কাজের ক্ষেত্র কিন্তু অহরহ। অনলাইনে অনেক ধরনের কাজ আছে। আপনার ঘরে যদি একটি কম্পিউটার থাকে, তাহলে বিশ্বব্যপী হতে পারে আপনার বাজার। ঘরে বসেই আপনি ব্যবসা করতে পারেন পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের মানুষের সাথে। বেশি পুঁজিরও দরকার হয় না। তাই আপনাদের প্রতি আমার পরামর্শ, চাকুরীর পেছনে ঘুরে সময় নষ্ট না করে ছোট একটি প্রশিক্ষণ নিয়ে আরম্ভ করে দিন সাবলম্বী হওয়ার অভিযান, উপার্জন করুন বৈদেশিক মুদ্রা। যারা শুরু করেছে তারা কিন্তু আজ সফল। এখন তারা মোটা অঙ্কের টাকা রোজগার করছে। সুতরাং আপনারাও শুরু করুন, দেখবেন সফল একদিন হবেনই। আপনারাই পারবেন দেশ থেকে বেকারত্বকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে। আশা করি আমার পরামর্শটুকু সবাই গুরুত্বের সহিত বিবেচনা করবেন এবং সরকারও এই ক্ষেত্রটির দিকে সুনজর দিবে।
প্রিয় দেশবাসী,
দেশীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগও আমাদের অর্থনৈতিক উৎকর্ষের জন্য অতিশয় গুরুত্ত্বপূর্ণ। দেশে অধিক পরিমানে বিদেশী বিনিয়োগ আনা সম্ভব হলে অধিক পরিমানে কর্মের সংস্থান করা সম্ভব হবে, মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে এবং অর্থনীতিতে অধিক মাত্রায় গতি আসবে। আর এই বিদেশী বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতে হলে এখানে বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা আবশ্যক। বন্ধুগণ, আমাদের আকর্ষণীয় মানব সম্পদ আর লোভনীয় সস্তা শ্রম বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের নজর এড়ায়নি। কেবলমাত্র রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আমাদেরকে বাইপাস করে তা চলে যাচ্ছে ভারত, চীন, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম সহ এশিয়ার অন্যান্য দেশে। অথচ সেদিকে আমাদের কোন খেয়াল নেই, আমরা আছি অন্তঃকলহে লিপ্ত। বন্ধুগণ, আপনারাই বলুন এই কলহ আমাদেরকে কি দিয়েছে? আশা করি দেখানোর মত কিছু নেই আমাদের কাছে। সুতরাং এই কলহ টিকিয়ে রেখে কি লাভ বলুন? আজ আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, আসুন আমরা এদেশ থেকে হরতাল, ভাংচুর, জ্বালাও পোড়াও কে চিরদিনের জন্য বিদায় জানাই। আমাদের রাজনীতি হোক দেশের উন্নয়নের জন্য, দেশ ধ্বংসের জন্য নয়। আসুন এই মর্মে সর্বস্তরের জনগণ এবং রাজনৈতিক দলসমূহকে একসঙ্গে কাজ করি। আজ আমরা প্রতিজ্ঞা করি যে দেশে কোন অযৌক্তিক কারণে এক ঘন্টার জন্যও পারিবহন বন্ধ রাখবনা, দোকানপাট বন্ধ রাখবনা, কলকারখানা বন্ধ রাখবনা। এখন থেকে এই ভূখন্ডে চব্বিশ ঘন্টা উন্নয়ন কর্মকান্ড চলবে; এক শিফ্ট – এর পরিবর্তে তিন শিফ্ট চালু হবে। তাহলে আমরা আমাদের জনসম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারব। তখন দেখবেন আমাদের জিডিপি ও প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে যাবে। পাশাপাশি মানুষের আয় রোজগার ও ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। আর অচিরে আমরা আমাদের দেশকে দেখতে পাব একটি মধ্যম আয়ের দেশে হিসেবে।
প্রিয় দেশবাসী,
আপনাদের সামনে আমি একটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে চাই। আমাদের নিকটবর্তী দেশ মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর স্বাধীন হয়েছিল আমাদের থেকে মাত্র কয়েক বছর আগে। আজ ওদের অর্থনীতির সাথে আমাদের অর্থনীতির তুলনা করুন। আপনারাই বিবেচনা করুন ওরা কোথায় আর আমরা কোথায়। দেখুন, সেখানকার দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতৃত্ব আর জনগণের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সে সব দেশ আজ কোথায় পৌঁছে গেছে। আমাদের বোধোদয় হওয়া উচিৎ। আমরা চাইলে আমরাও পারতাম। সমান না হলেও কাছাকাছি থাকতে পারতাম। যাক, পেছনের কথা মনে করে আর দুঃখের বোঝা ভারী করতে চাইনা। আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই। আজ, এই মূহুর্ত থেকে শুরু হোক আমাদের নতুন করে পথ চলা। পরিবর্তন আমাদের আনতেই হবে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা অর্থনীতি, প্রত্যেকটি জায়গায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনব আমরা। আমরা এদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করব, দেশ থেকে দুর্ণীতি দূর করব এবং অর্থনৈতিকভাবে সয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করব। আজকের দিনে এই হোক আমাদের অঙ্গিকার। সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেষ করছি। বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে। ততদিন পর্যন্ত ভাল থাকবেন সবাই।
লেখকঃ কবি ও সমাজ কর্মী
Email: [email protected]
প্রিয় দেশবাসী,
আমি নেতা হতে আসিনি। আমি নেতৃত্বকে জাগ্রত করতে এসেছি। আজ ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে নেতুত্বের যে শূণ্যতা সৃষ্টি হয়েছে সে শূণ্যতা পূরণে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে এসেছি। আসুন আমরা সবাই মিলে নেতৃত্ব দিই। পরিবর্তনের নেতৃত্ব। একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব। আমি যে পরিবর্তনের কথা বলছি, সে পরিবর্তন কারো একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন সতেরো কোটি মানুষের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ। প্রত্যেককে যার যার অবস্থান থেকে পরিবর্তনের জন্য উদ্যোগী হতে হবে। নেতৃত্বের বিকাশ ঘটাতে হবে নিজেকে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। আসুন আজ আমরা পরিবর্তনের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হই। তাহলেই আমাদের জীবন হবে আরো সহজ, আরো সুন্দর।
বন্ধুগণ, আজ অত্যন্ত দুঃখের সহিত বলতে হয়, বিশ্ব যেখানে অশ্ববেগে সম্মুখগামী আমরা সেখানে কচ্ছপের মত ক্ষীণপায়ে এলোমেলো হাটছি। স্বাধীনতার ৪২ বছরেও আমরা আমাদের গন্তব্য ঠিক করতে পারিনি। আমরা যে যে দিকে পারছি সেদিকে ছুটছি। ভোগ বিলাসে ভাসিয়ে রেখেছি গা। ন্যায় অন্যায়ের বিশ্লেষণ আমাদের কাছে আজ অতি তুচ্ছ। আমরা সত্য ও সুন্দর থেকে সরিয়ে ফেলেছি নিজেদেরকে। আমাদের বিবেক বোধ আর জাতীয়তা বোধ শূণ্যে নেমে এসেছে। কিন্তুু এ অবস্থায় একটি জাতি চলতে পারে না। এখনই আমাদেরকে ঘুরে দাড়াতে হবে। আর বিলম্ব করার সুযোগ নেই। পরিবর্তনের প্রত্যয় নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। আমাদেরকে ভুলে গেলে চলবেনা – আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাসের কথা। আমরা যে চাইলেই যে কোন কিছু করতে পারি তার প্রমান কিন্তু আমরা যুগে যুগে করে এসেছি। আমরা ৪৭ শে দেখেছি, আমরা ৫২ তে দেখেছি, আমরা ৭১ এ দেখেছি আমরা কি পারি। আমরা সবই পারি। যে কোন ক্রান্তিতে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারি, বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারি। অতএব এবারও আমাদেরকে পারতে হবে। আমাদেরকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিজয় অর্জন করতে হবে। প্রত্যেককে উপলব্ধি করতে হবে যে এর বিকল্প কোন পথ আমাদের জন্য খোলা নেই। আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য একমাত্র পথ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিজয় অর্জন করা। আমি আগেই বলেছি, এর জন্য প্রয়োজন সতেরো কোটি মানুষের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ। আর সকলের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণই আমাদের বিজয় নিশ্চিত করতে পারে। অতএব আসুন আজ আমরা বিজয়ের লক্ষ্যে আমাদের করণীয়গুলো ঠিক করি অতঃপর সেই অনুযায়ী কার্যারম্ভ করি।
জাতীয় নেতৃবৃন্দকে বলছি। আপনারা ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, চীন ও রাশিয়ার দিকে তাকান। দেখুন সঠিক নেতৃত্ব একটি জাতিকে কোথায় পৌঁছে দিতে পারে। অতএব, আমার অনুরোধ, আপনারা আপনাদের দায়ীত্বটুকু ভালভাবে বুঝুন এবং সঠিকভাবে পালন করুণ। আপনাদের দায়ীত্ব হল একটি সুন্দর জাতীয় লক্ষ্য স্থির করা যার মধ্যে জনগণের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। অর্থাৎ আপনারা ঠিক করবেন, আজ থেকে দশ বছর পর জাতীয় উন্নয়নের চলকগুলোকে কোন পর্যায়ে দেখতে চান। যেমন – দশ বছর পর বাংলাদেশের জনসংখ্যা কত হবে, শিক্ষিতের হার ও দক্ষ জনশক্তির হার কত হবে, তথ্যপ্রযুক্তি, আভ্যন্তরিণ যোগাযোগ ও অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন কিরূপ হবে, মানসম্মত স্বাস্থ্য সেবা কোথায় পৌঁছে দেওয়া হবে, কৃষির আধুনিকায়ন ও শিল্পের উন্নয়ন কতখানি হবে, রপ্তানী লক্ষ্যমাত্রা কত হবে, নতুন কর্ম সংস্থান কত হবে, জিডিপি কোথায় উন্নীত করতে হবে, প্রবৃদ্ধির হার কত হবে ইত্যাদি। তাছাড়াও আপনাদেরকে ঠিক করতে হবে- আমাদের আন্তর্জাতিক নীতি কি হবে, বিশ্ব রাজনীতিতে ও বিশ্ব অথনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান কি হবে এবং কোন পর্যায়ে বাংলাদেশ নেতৃত্ব দিবে। দেশে প্রতিটি বিষয়ের উপর গবেষক এবং বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। তারা আমাদের জাতীয় সম্পদ। জাতীয় লক্ষ্য ও নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে আপানারা তাদের পরামর্শ নিবেন। তাছাড়াও সাধারণ জনগণের প্রত্যাশার উপর একটি নমুনা জরিপ করে নেয়া প্রয়োজন যাতে লক্ষ্য নির্ধারণ বা পরিকল্পনা প্রণয়নে তাদের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব হয়। গবেষক এবং বিশেষজ্ঞগণ এ ক্ষেত্রে আপনাদেরকে সহযোগিতা করবেন। এরপর কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে কার্য-করণ ঠিক করতে হবে। মনে রাখতে হবে – কোন একটি গোষ্ঠি, কোন একটি সম্প্রদায় অথবা কোন একটি দলের পক্ষে জাতীয় লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। বরং এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন সতের কোটি মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ। আমার বিশ্বাস, সতের কোটি কন্ঠের একসঙ্গে স্লোগান আকাশ পাতাল প্রকম্পিত করতে পারে; আর চৌত্রিশ কোটি হাত একসাথে ধুলিস্যাৎ করে দিতে পারে পৃথিবীর যে কোন বাধা। তবে এই সতের কোটি মানুষকে একত্রিত করার এবং উজ্জীবিত করার দায়িত্ব জাতীয় নেতৃবৃন্দের। আপনারা গণসংযোগ ও প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে সকলকে উজ্জীবিত করতে পারেন। আপনারা স্মরণ করুণ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের কথা। স্মরণ করুণএকটি মাত্র ভাষণ কিভাবে সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে একত্রিত করে স্বাধীনতা অর্জনের নিমিত্তে রনাঙ্গনে উপস্থিত করেছিল। আজ এমন একজন নেতার প্রয়োজনীয়তা জাতি মর্মে মর্মে উপলদ্ধি করছে। অতএব কেউ একজন দায়ীত্ব গ্রহণ করুণ। সতের কোটি মানুষকে স্বপ্ন দেখানোর দায়ীত্ব, উজ্জিবিত করার দায়ীত্ব, একত্রিত করার দায়ীত্ব। দেখবেন লক্ষ্য অর্জন কত সহজ। প্রিয় নেতৃবৃন্দ, আপনারা যে লক্ষ্য ও নীতি সমূহ স্থির করবেন তা জনগণকে জানিয়ে দিবেন। জনগণ সেই লক্ষ্য ও নীতি বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ শ্রম দিবে। অপনারা শুধু খেয়াল রাখবেন এদেশের প্রত্যেকটি মানুষ যেন সম্মিলিত শ্রমের সুফল ভোগ করতে পারে। আমার দেশের সাধারণ মানুষ যেন যার যার প্রাপ্য থেকে চুল পরিমান বঞ্চিত না হয়। আপনারা অরো খেয়াল রাখবেন – কোন স্বার্থান্বেষী মহল যেন সাধারণ মানুষের শ্রম শোষণ করে আয়েশের অট্টালিকা গড়তে না পারে। তাহলেই দেখবেন- সাধারণ মানুষের কাজের গতি দ্বিগুণ তিনগুণ হয়ে গেছে; আর জাতি পৌঁছে গেছে তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে।
প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা কর্মচারিদেরকে বলছি। আপনারা আপনাদের সরকারী পদ ও দায়ীত্বসমূহ ভালভাবে বুঝুন। আপনারা ভুলে যাবেন না যে আপনারা জনগণের প্রশাসক নন, বরং জনগণের সাহায্যকারী; জনগণের সেবক। জনগণের টেক্সের টাকার উপর আপনাদের জীবিকা নির্ভরশীল। সুতরাং, জাতীয় লক্ষ্য ও নীতি বাস্তবায়নে জনগণকে সহযোগিতা করুণ। আপনাদের জীবিকাটুকু পবিত্র রাখুন। আপনাদের আয় রোজগারের উপর আপনাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জীবিকাও নির্ভরশীল। অতএব তাদেরকেও পবিত্র রাখুন। আপনারা শিক্ষিত মানুষ, আশা করি আমার কথাগুলো আপনাদের বুঝতে অসুবিধা হবেনা। দয়া করে উল্টো অর্থ বানিয়ে গায়ে মেখে নিজেদের নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিবেন না। আসুন আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই – আজ থেকে আমরা দুর্ণীতি করবনা, দুর্ণীতিকে প্রশ্রয়ও দেবনা। আপনাদের দৃঢ় প্রত্যয় দূর্ণীতি মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য যথেষ্ট। জনগণ আপনাদেরকে সহযোগিতা করবেন।
জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা কর্মচারী ব্যতীত অন্যান্যদেরকে বলছি। আপনাদের চেষ্টা ও শ্রমের উপর এদেশের অর্থনীতি দাড়িয়ে আছে। দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হলে আপনাদের জীবন যাত্রার মান উন্নত হবে। আজ অত্যন্ত দুঃখের সহিত বলতে হয় – স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ বছরেও আমরা আমাদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারিনি। এখনও চিকিৎসার অভাবে, শীত বস্ত্রের অভাবে মানুষের মৃত্যু হয়। খোলা আকাশের নিচে এখনো মানুষ রাত্রি যাপন করে। আমার দেশের বিশাল জনগোষ্ঠি এখনো শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। এখনো অর্ধাহারে অনাহারে দিনাতিবাহিত করে অসংখ্য মানুষ। এই ব্যর্থতা কার? আমি বলব – এই ব্যর্থতা আমাদের সকলের। সরকারের উপর দোষ চাপিয়ে কোন লাভ নেই। মনে রাখবেন- সরকার চাইলেই সবকিছু করতে পারেনা কিন্তু জনগণ চাইলেই পারে। সরকার কোন কাজ করতে চাইলে অর্থ বরাদ্ধের প্রয়োজন হয়। জনগণ চাইলে অর্থের প্রয়োজন হয়না। প্রয়োজন হয় উদ্যোগের। আসুন গ্রাম পর্যায়ের ও ইউনিয়ন পর্যায়ের রাস্তা-ঘাট তৈরির জন্য নিজেরা হাড়ি কোদাল হাতে নিই। দেখি রাস্তা ঘাট হয় কিনা। দেশে আজ ৬৫ শতাংশ মানুষ অক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন। আসুন একজন অক্ষর জ্ঞান সম্পন মানুষ একজন নিরক্ষর মানুষকে অক্ষর শেখানোর দায়ীত্ব নিই। দেখি জাতি শিক্ষিত হয় কিনা। আসুন আমাদের বাড়ির এবং আশেপাশের পতিত জায়গাগুলোতে ফল ফসলাদি ফলানোর দায়ীত্ব নিই। খালে-বিলে ও ডোবা-নালায় মাছের চাষ করি। দেখি জাতি আর অপুষ্টিতে ভোগে কিনা। এসব উন্নয়নের জন্য সরকারী বরাদ্ধের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু উদ্যোগের। তাছাড়া আমরা চাইলে সরকারও সহযোগিতা করতে বাধ্য থাকবে। সুতরাং, নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য নিজেদেরকেই উদ্যোগী হতে হবে, নিজেদেরকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। অতএব আর বিলম্ব নয়। আসুন পরিবর্তন আনায়ন ও লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে এখনই আমরা কাজে নেমে পড়ি। প্রিয় দেশবাসী, আমাদের সব কাজের আগের কাজ নিজেদের মানষিকতা পরিবর্তন করা। আজ আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, আপনারা সত্য ও ন্যায়ের পথকে আকড়ে ধরুন, অন্যায় ও অসত্যকে পরিহার করুন। আত্মকেন্দ্রিকতা ও ভোগবাদী চিন্তা চেতনা থেকে বেড়িয়ে আসুন। দয়া করে নিজেদের অকল্যান হয় এমন কাজ আপনারা করবেননা। আপনারা ভুলে যাবেন না যে আপনাদেরকে একদিন বিচারের মুখোমুখি হতে হবে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য। সুতরাং আসুন, সবাই মিলে সমাজে ভাল কাজের প্রতিযোগিতা তৈরি করি। একে অন্যের সহযোগিতায় এগিয়ে আসি। আর তাতে আপনার নিজের যেমন কল্যান হবে, তেমনি উপকৃত হবে আপনার পরিবার, আপনার সমাজ এবং আপনার জাতি। বন্ধুগণ, আপনারা যদি সমাজ, দেশ ও জাতির কথা নাও ভাবেন, শুধু নিজের কল্যানের কথাই যদি ভাবেন তাহলেও যথেষ্ঠ। কিন্তু, আজ অত্যন্ত দুঃখের সহিত বলতে হয় – আমরা বাঙালিরা, নিজের ভাল-মন্দ বুঝার ক্ষমতাটুকু রাখিনা। যার ফলে এ জাতি আজ একটি পশ্চাদপদ ও হাস্যকর জাতি হিসেবে পরিনত হয়েছে। গরীব দেশ হিসেবে আমাদেরকে প্রভাবশালী অনেক দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার উপদেশ-তিরস্কার শুনতে হয়। কারণ একটিই। আর তা হল আমাদের মেরুদন্ড দুর্বল। সাহায্যের জন্য আমাদেরকে তাদের কাছে হাত পাততে হয়। অথচ আমরা যদি ব্যাক্তিক পর্যায়ে সচেষ্ট হই তাহলে জাতি কারো কাছে হাতও পাততে হয়না কারো উপদেশ-তিরস্কারও শুনতে হয় না। কারণ আমরা আছি সতের কোটি মানুষ। আমাদের আছে চৌত্রিশ কোটি হাত। আর আছে ১৪৭৫৭০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের একটি অতি উর্বর ভূখন্ড। চৌত্রিশ কোটি হাত যদি এই ভূখন্ডে সঠিকভাবে কাজ করে, তাহলে এখানে সোনা ফলানো সম্ভব।
প্রিয় দেশবাসী,
আমার কথা মনযোগ দিয়ে শ্রবণ করুন। আর তাতে আপনাদেরই মঙ্গল হবে। আপনারা আপনাদের জীবিকাটুকু পবিত্র রাখুন। অধিক পরিশ্রমের মাধ্যমে আয় রোজগার বৃদ্ধি করুণ। আর তাতে আপনাদের দেহ ও মন পবিত্র থাকবে, জীবন যাত্রার মান উন্নত হবে। দয়া করে অন্যায় পথে পা বাড়াবেন না। কারণ এর পরিনাম কখনই ভাল হয় না। এমনকি অপবিত্র দেহ ও মন নিয়ে প্রার্থনা করলে, প্রার্থনা পর্যন্ত কবুল হয় না। সুতরাং সাবধান হউন। নিজে পবিত্র থাকুন এবং আপনার আয় রোজগারের উপর যাদের জীবিকা নির্ভরশীল তাদেরকেও পবিত্র রাখুন। আপনারা ভুলে যাবেন না যে আপনাদেরকে একদিন বিচারের মুখোমুখি হতে হবে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য। আমি আশা করছি আমাদের সবার বিবেক জাগ্রত হবে। সবাই মিলে ঝাপিয়ে পড়বেন ব্যক্তিগত ও জাতীয় কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে। এই মর্মে আপনাদেরকে আজ আমি কিছু কর্ম করণীয় সম্পর্কে বলব। আপনারা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের জনগণের দিকে তাকান। তাদের কাছ থেকে দেশপ্রেম শিখুন। তাদের কাছ থেকে গণতন্ত্র শিখুন। নিজকে ভালবাসুন, নিজের দেশকে ভালবাসুন, দেশের মানুষকে ভালবাসুন, প্রত্যেকের মতামতকে সম্মান করুন, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে গ্রহণ করুন, পেশী শক্তিকে বিদায় জানান। মনে রাখবেন, সবগুলো একই সূত্রে গাঁথা। একটি বাদ দিয়ে অপরটি কল্পনা করা যায় না। আপনাদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনে প্রত্যেকটি পর্যায়ে গণতান্ত্রিক উপায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন। নিজেদেরকে একটি নিয়মের আওতায় এনে জীবন যাপন করুন। দেখবেন জীবন কত সুশৃঙ্খল ও সুন্দর। আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, আপনারা আর ঊশৃঙ্খল ও অসুন্দর জীবন চর্চা করে নিজেদের নির্বুদ্ধিতা জাহির করবেনা, কষ্ট ডেকে আনবেননা।
প্রিয় দেশবাসী,
আমাদের জাতিকে শতভাগ শিক্ষিত হতে হবে। শিক্ষা ব্যতীত জাতীয় অগ্রগতি অসম্ভব। পৃথিবীতে যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতির মানষিকতা তত উন্নত। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ শ্রীলংকা এবং মালদ্বীপ যদি শতভাগ শিক্ষিত হতে পারে, তাহলে আমরা পারবনা কেন? আমাদের আরো আগেই পারা উচিত ছিল। যাহোক, আর বিলম্ব করার সুযোগ নেই। যারা শিক্ষিত আছেন, তারা বাকিদের দায়ীত্ব নিন। আপনাদের মধ্যে যারা বিত্তশালী তারা শিক্ষার জন্য অবকাঠামো তৈরিতে অবদান রাখুন। সরকারকে সহযোগিতা করুন। আর যারা বিত্তশালী নন অথচ শিক্ষিত তারা পাঠদান কার্যক্রমে অংশ নিন। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় – যে যেই পর্যায়ে শিক্ষাদানে সামর্থ রাখেন, সেখানে একটু সময় দিন। জাতিকে শিক্ষিত করার লক্ষ্যে সপ্তাহে অন্তত একটি ঘন্টা সময় ব্যয় করুন। যাদের হাতে সময় আছে তাদেরকে একটু বেশি সময় দেয়্ার জন্য অনুরোধ করছি। আপনাদের এই অবদান সরকারের শিক্ষা কার্যক্রমকে বেগবান করবে।
অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রেও আমি একই ধরণের পরামর্শ দেব। গ্রাম এবং ইউনিয়ন পর্যায়ের সড়কগুলো আপনারা নিজেরা তৈরি করে নিন। আপনারা নিজেদের ধানি জমি দিতে পারেন, আর দুই কোদাল মাটি মাথায় নিতে না পারার কোন কারণ আছে বলে আমি মনে করিনা। যে রাস্তার উপর দিয়ে নিজেরা হাটবেন, নিজেদের যানবাহন চলাচল করবে সে রাস্তার মাটি মাথায় বহন করা লজ্জাজনক নয়, বরং সম্মানজনক। যারা গ্রামে গ্রামে মারামারিতে, মিছিলে ও মামলা মোকাদ্দমায় নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন, তাদেরকে অনুরোধ করছি, আপনারা এসব বাদ দিয়ে গঠনমূলক কাজে নেতৃত্ব দিন। তাহলেই দেখবেন ৮৬ হাজার গ্রাম সমানভাবে উন্নত হবে। আর মহাসড়ক, ব্রিজ, কালভার্ট ও রেলপথ নির্মাণে সরকার আপনাদেরকে সহায়তা করবে।
প্রিয় দেশবাসী,
আমাদের অর্থনীতি কৃষি নির্ভর অর্থনীতি। এদেশের ৮৪ শতাংশ মানুষ কৃষি কাজের সাথে সম্পৃক্ত যারা গ্রামে বসবাস করেন। কিন্তু এই বিশাল জনগোষ্ঠী বছরের প্রায় চার মাস সময়ই কর্মহীন থাকেন যখন সারা দেশে বর্ষা থাকে। আমাদেরকে এই সময়টুকু কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে। হস্ত ও কুটির শিল্পের প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেরা পারিবারিক পরিসরে ব্যবসায় শুরু করতে পারেন। তাতে আপনাদের আয় রোজগার বৃদ্ধি পাবে, জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে এবং গ্রামীন অর্থনীতি শক্তিশালী হবে। সর্বোপরি দেশের উন্নয়ন হবে। সরকার বিনামূল্যে অথবা স্বল্পমূল্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে আপনাদের সহযোগিতা করবেন। আর কৃষি যেহেতু আমাদের অর্থনীতির মূল ভিত্তি সেহেতু কৃষির উন্নয়নে সবাইকে আরো বেশি কাজ করতে হবে। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারকে কৃষি গবেষণার উপর আরো জোর দিতে হবে। প্রতিনিয়ত শস্য ও ফসলের উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করতে হবে। সরকারকে এ সংক্রান্ত আরেকটি বিষয়ের উপর কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে। আর তা হল কৃষকের ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা। অন্যথায় কৃষক এবং কৃষি কোনটিকেই বাচাঁনো সম্ভব হবেনা।
প্রিয় দেশবাসী,
আমাদের অর্থনীতি কৃষি নির্ভর হলেও শিল্প-বানিজ্যের গুরুত্ব এখানে কম নয়। দেশীয় চাহিদা মেটাতে এবং আমদানীর উপর নির্ভরশীলতা কমাতে শিল্পের উন্নয়ন ঘটানোর কোন বিকল্প নেই। বন্ধুগণ, বাংলাদেশ হল শিল্প-বানিজ্যের জন্য একটি অপার সম্ভানাময় দেশ। এখানে আছে সতের কোটি মানুষের বিশাল বাজার। আমরা যদি রপ্তানি করতে নাও পারি, শুধু মাত্র আভ্যন্তরীণ বাজারে নিজেদের পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারি তাহলেই শিল্প প্রতিষ্ঠান টিকে থাকার জন্য যথেষ্ঠ। আমাদের শিল্প পণ্যের চাহিদা দেশীয় উৎপাদনের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব হয়না বলেই কিন্তু প্রত্যেক বছর আমাদেরকে হাজার হাজার কোটি টাকার শিল্প পণ্য আমাদানি করতে হয়। অথচ চেষ্টা করলেই এসব পণ্য আমরা আমাদের দেশে উৎপাদন করতে পারি। বিশেষজ্ঞগণের মতে, শিল্প কারখানা স্থাপন ও এর বিকাশ ঘটানোর জন্য বাংলাদেশ একটি অতিশয় উপযোগী দেশ। বিশাল বাজারের পাশাপাশি প্রচুর পরিমানে শিল্পের কাঁচামাল, অনুকূল জলবায়ূ, সস্থা শ্রম এবং নিজস্ব সমুদ্র বন্দরসহ সকল সুবিধাই এখানে বিদ্যমান। এখন প্রয়োজন শুধু উদ্যোগের। সাহস করে ব্যবসায়ে নেমে পড়লেই হয়। মনে রাখবেন ভাগ্য সাহসীদের অনুকূলে থাকে। যারা শুরু করেছে, তারা কিন্তু সফল হয়েছে। আর এই দৃষ্টান্ত দেখার জন্য বেশি দূর যেতে হয়না। আমাদের দেশের সফল শিল্পপতিদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সত্যটুকু জানতে পারবেন যা আপনাদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। যার আজকে দেশে প্রতিষ্ঠিত শিল্পোদ্যোক্তা, যাদের প্রতিষ্ঠানে এখন হাজার হাজার কর্মী কাজ করে, তাদের অধিকাংশেরই ব্যবসা শুরু হয়েছিল ক্ষুদ্র পরিসরে। নিজের মেধা ও শ্রম কাজে লাগিয়ে তারা আজ সফল। এমন অনেক সফল শিল্পোদ্যোক্তা আছেন যাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের সুযোগটুকু হয়নি অথচ বড় হওয়ার অদম্য ইচ্ছা তাদেরকে সফল করে তুলেছে। বন্ধুগণ, আমার অত্যন্ত কষ্ট হয় যখন দেখি আমার দেশের মেধাবী ছেলেরা মেয়েরা লেখা পড়া শেষ করে একটি সরকারী চাকুরী পাবার জন্য তেত্রিশ জোড়া জুতার তলা ক্ষয় করে আর নষ্ট করে যৌবনের অতি মূল্যবান সময়। আবার তাদের অনেকে মোটা অঙ্কের ঘুষের টাকাও পকেটে নিয়ে ঘুরে; শুধুমাত্র সরকারী চাকুরীর জন্য। আর এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে কতিপয় সরকারী আমলা ও রাজনীতিক অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ছে। আজ তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, এই কাজ আপনাদের শোভা পায় না। আপনাদেরকে অনুরোধ করছি- দয়া করে অন্যায় করবেন না, অন্যায়ের সুযোগও তৈরি করে দেবেন না। ঘুষের টাকা পকেটে নিয়ে চাকুরীর পিছনে না ছুটে, সেই টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করুন। আপনারা শিক্ষিত মানুষ। আপনারা অনেক ভাল করবেন। যারা শিক্ষিত অথচ বেকার তাদের কাছে আমার অনুরোধ, আপনারা আপনাদের মেধাটুকু কাজে লাগান। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে কাজের ক্ষেত্র কিন্তু অহরহ। অনলাইনে অনেক ধরনের কাজ আছে। আপনার ঘরে যদি একটি কম্পিউটার থাকে, তাহলে বিশ্বব্যপী হতে পারে আপনার বাজার। ঘরে বসেই আপনি ব্যবসা করতে পারেন পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের মানুষের সাথে। বেশি পুঁজিরও দরকার হয় না। তাই আপনাদের প্রতি আমার পরামর্শ, চাকুরীর পেছনে ঘুরে সময় নষ্ট না করে ছোট একটি প্রশিক্ষণ নিয়ে আরম্ভ করে দিন সাবলম্বী হওয়ার অভিযান, উপার্জন করুন বৈদেশিক মুদ্রা। যারা শুরু করেছে তারা কিন্তু আজ সফল। এখন তারা মোটা অঙ্কের টাকা রোজগার করছে। সুতরাং আপনারাও শুরু করুন, দেখবেন সফল একদিন হবেনই। আপনারাই পারবেন দেশ থেকে বেকারত্বকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে। আশা করি আমার পরামর্শটুকু সবাই গুরুত্বের সহিত বিবেচনা করবেন এবং সরকারও এই ক্ষেত্রটির দিকে সুনজর দিবে।
প্রিয় দেশবাসী,
দেশীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগও আমাদের অর্থনৈতিক উৎকর্ষের জন্য অতিশয় গুরুত্ত্বপূর্ণ। দেশে অধিক পরিমানে বিদেশী বিনিয়োগ আনা সম্ভব হলে অধিক পরিমানে কর্মের সংস্থান করা সম্ভব হবে, মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে এবং অর্থনীতিতে অধিক মাত্রায় গতি আসবে। আর এই বিদেশী বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করতে হলে এখানে বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা আবশ্যক। বন্ধুগণ, আমাদের আকর্ষণীয় মানব সম্পদ আর লোভনীয় সস্তা শ্রম বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের নজর এড়ায়নি। কেবলমাত্র রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আমাদেরকে বাইপাস করে তা চলে যাচ্ছে ভারত, চীন, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম সহ এশিয়ার অন্যান্য দেশে। অথচ সেদিকে আমাদের কোন খেয়াল নেই, আমরা আছি অন্তঃকলহে লিপ্ত। বন্ধুগণ, আপনারাই বলুন এই কলহ আমাদেরকে কি দিয়েছে? আশা করি দেখানোর মত কিছু নেই আমাদের কাছে। সুতরাং এই কলহ টিকিয়ে রেখে কি লাভ বলুন? আজ আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, আসুন আমরা এদেশ থেকে হরতাল, ভাংচুর, জ্বালাও পোড়াও কে চিরদিনের জন্য বিদায় জানাই। আমাদের রাজনীতি হোক দেশের উন্নয়নের জন্য, দেশ ধ্বংসের জন্য নয়। আসুন এই মর্মে সর্বস্তরের জনগণ এবং রাজনৈতিক দলসমূহকে একসঙ্গে কাজ করি। আজ আমরা প্রতিজ্ঞা করি যে দেশে কোন অযৌক্তিক কারণে এক ঘন্টার জন্যও পারিবহন বন্ধ রাখবনা, দোকানপাট বন্ধ রাখবনা, কলকারখানা বন্ধ রাখবনা। এখন থেকে এই ভূখন্ডে চব্বিশ ঘন্টা উন্নয়ন কর্মকান্ড চলবে; এক শিফ্ট – এর পরিবর্তে তিন শিফ্ট চালু হবে। তাহলে আমরা আমাদের জনসম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারব। তখন দেখবেন আমাদের জিডিপি ও প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে যাবে। পাশাপাশি মানুষের আয় রোজগার ও ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। আর অচিরে আমরা আমাদের দেশকে দেখতে পাব একটি মধ্যম আয়ের দেশে হিসেবে।
প্রিয় দেশবাসী,
আপনাদের সামনে আমি একটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে চাই। আমাদের নিকটবর্তী দেশ মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর স্বাধীন হয়েছিল আমাদের থেকে মাত্র কয়েক বছর আগে। আজ ওদের অর্থনীতির সাথে আমাদের অর্থনীতির তুলনা করুন। আপনারাই বিবেচনা করুন ওরা কোথায় আর আমরা কোথায়। দেখুন, সেখানকার দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতৃত্ব আর জনগণের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সে সব দেশ আজ কোথায় পৌঁছে গেছে। আমাদের বোধোদয় হওয়া উচিৎ। আমরা চাইলে আমরাও পারতাম। সমান না হলেও কাছাকাছি থাকতে পারতাম। যাক, পেছনের কথা মনে করে আর দুঃখের বোঝা ভারী করতে চাইনা। আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই। আজ, এই মূহুর্ত থেকে শুরু হোক আমাদের নতুন করে পথ চলা। পরিবর্তন আমাদের আনতেই হবে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা অর্থনীতি, প্রত্যেকটি জায়গায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনব আমরা। আমরা এদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করব, দেশ থেকে দুর্ণীতি দূর করব এবং অর্থনৈতিকভাবে সয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করব। আজকের দিনে এই হোক আমাদের অঙ্গিকার। সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেষ করছি। বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে। ততদিন পর্যন্ত ভাল থাকবেন সবাই।
লেখকঃ কবি ও সমাজ কর্মী
Email: [email protected]
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
ইঞ্জিনিয়ার সজীব ইমাম ০৪/১১/২০১৪ভাই আপনার সাথে একমত পােষন না করার কোনো কারন নেই। কিন্তু ইস্যু টা সমগ্র বাঙ্গালির। যেখানে সকলকে একসাথে উপলদ্ধি করতে হবে এবং একসাথে আগুয়ান হতে হবে। তবেই হবে মিথ্যার পরাজয়।