বিবেকানন্দকে আবিষ্কার করেছিল মাদ্রাজ
'আইস হাউস’ বদলে হল ‘বিবেকানন্দ ইল্লম’
চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য
শিকাগোর ধর্মসভায় সেই বিখ্যাত ভাষণ দেওয়ার আগে ক’জন ভারতবাসী চিনতেন বিবেকানন্দকে! রামকৃষ্ণ মঠই বা ছিল কোথায়! শিকাগোর একটি ঘটনাই ভারতবাসীদের আগেও যেমন নাড়া দিয়েছিল আমেরিকার নাগরিকদের, তেমনই ভারতেও বিবেকানন্দ প্রথম গণসম্বর্ধনা হেয়েছিলেন কিন্তু বাংলার বাইরেই, মাদ্রাজে৷ ১৮৯৭-র ফেব্রুয়ারি মাসে শিকাগো থেকে কলম্বো হয়ে বিবেকানন্দ ভারতে ফিরলেন৷ শিকাগোর আগে পর্যন্ত যে ভারতীয়টিকে ভারতবাসীরা সেভাবে জানতেন না, সেই বিবেকানন্দ কলম্বো থেকে পমবন, রামেশ্বরম হয়ে মাদ্রাজে (এখন নাম চেন্নাই) পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই দেখলেন, তাঁকে সম্বর্ধনা জানাতে হাজির হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ৷ এই জনতাই ভারতের ‘আপামর দরিদ্র ভারতবাসী, মুচি-মেথর-চণ্ডাল ভারতবাসী’৷ তাঁরা পেয়ে গেছেন তাঁদের মনের মানুষকে৷ তাঁর মধ্যেই তাঁরা আগামী দিনের মুক্তির আভাস পেয়েছেন৷
এতটা আশা করেন নি স্বামীজি নিজেও৷ গণ-মানুষের সেই শোভাযাত্রা তাঁকে নিয়ে গেল এক মাদ্রাজ হাই কোর্টের এক প্রতিষ্ঠিত অ্যাডভোকেট বিলিগিরি আয়েঙ্গারের বাড়িতে৷ এখনও কেউ কেউ দাবী করেন, সেদিন বিবেকানন্দকে দেওয়া স্বতঃস্ফূর্ত সম্বর্ধনা আজও ছাপিয়ে যেতে পারেনি অন্য কোনও সম্বর্ধনার সমাবেশ! বিলিগিরির বাড়িটির তখন নাম ছিল ‘আইস হাউস’৷ পঞ্চাশ বছর আগে, স্বামীজির জন্ম-শতবর্ষে তামিলনাড়ু সরকার এই বাড়িটির নতুন নামকরণ করে ‘বিবেকানন্দ ইল্লম’ অর্থাৎ বিবেকানন্দ ভবন৷
মাদ্রাজের বিখ্যাত মেরিনা বিচ-এর উপর এই সুদৃশ্য হর্ম্যটি কেবল নয়নাভিরামই নয়, এর ইতিহাসও যথেষ্টই সমৃদ্ব৷ বিবেকানন্দর ভাবধারায় বিশ্বাসীদের কাছে এই বাড়িটির গুরুত্বও অকল্পনীয়৷ তার একটি বড় কারণ, এই বাড়ি থেকেই জন্ম নেয় রামকৃষ্ণ মঠ স্হাপনের প্রথম প্রয়াস৷ বিশেষভাবে যা আজ উল্লেখের অপেক্ষা রাখে, তা হল, সেই প্রয়াস কোনও স্বামীজি বা ধর্মগুরুর দিক থেকে শুরু হয় নি। এমনকি, স্বামী বিবেকানন্দরও চিন্তায় আসেনি৷ এসেছিল তামিলনাড়ুর ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে আপামর মানুষদের ঐকান্তিক দাবির মধ্য থেকে৷ তারও কেন্দ্র এই ইল্লম৷
এই বাড়িটি, অর্থাৎ আইস হাউস বরফ রাখার গুদাম হিসাবে তৈরি হয় ১৮৪২ সালে, ১৭২ বছর আগে৷ কেবল মাদ্রাজেই নয়, বাংলা এবং মুম্বাইতেও এমন কয়েকটি বরফ গুদাম বানিয়েছিলেন ‘আইস কিং’ ফ্রেডরিক ট্যুডর৷ ব্রিটিশ ও ফরাসিরা মদ্যপান ও অন্যান্য প্রয়োজনে যেন বরফ পান, সেই জন্য বিদেশ থেকে বরফ আমদানি করে এখানে রাখা হত৷ বাড়িটি এমনভাবেই তৈরি যে, মাসের পর মাস বরফ সেখানে অবিকৃত থাকত৷ বাংলায় বরফ কারখানাটি হয়েছিল চন্দননগরে। এখনও এই জায়গাটি বরফতোলার মাঠ হিসাবে পরিচিত।
কলকাতা, মুম্বই ও মাদ্রাজ শহরে তাঁর গুদাম থাকলেও ভারতে তাঁর ব্যবসা তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন মাদ্রাজ থেকেই৷ ১৮৪২ থেকে ১৮৮০ পর্যন্ত তিনি চুটিয়ে বরফের ব্যবসা করেছেন৷ এই সময় নাগাদই চন্দননগরের বরফতোলার মাঠে স্টিমকে ব্যবহার করে বরফ বানানোর কল স্হাপিত হয়৷ দ্রুত অন্যান্য শহরেও তা তৈরি হতে থাকে৷ মন্দার ধাক্কায় ট্যুডরের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়৷
সেই সময়ে বিলিগিরি আয়েঙ্গার ছিলেন মাদ্রাজ হাই কোর্টের লব্ধপ্রতিষ্ঠ আইনজীবি৷ তিনি বাড়িটি কিনে তার চারপাশে বারান্দা বানান৷ বাড়িটিতে প্রচুর দরজা ও জানালা বানিয়ে এটিকে মানুষের বাসযোগ্য করেন৷ তাঁর বন্ধু তথা প্রখ্যাত বিচারক কেরনানের নামে বাড়িটির নতুন নাম দেন ‘ক্যাসল কেরনান’৷ নিজে আইন ব্যবসায়ী হলেও সাধারণ গরিবদের প্রতি তার বিশেষ টান ছিল৷ ক্যাসল কারনানে নিজের বসবাসের জন্য প্রয়োজনীয় অংশের বাইরে তিনি ঠাঁই দিয়েছিলেন বহু গরিব-দুঃখীকে৷ এতদ৲সত্ত্বেও, সম্ভবত সেই বাড়িতে আলো-বাতাস তেমন খেলত না বলে শেষ পর্যন্ত তিনি বাড়িটি বসবাসের অযোগ্য বলে ফাঁকা করে দিয়েছিলেন৷
শিকাগো থেকে ফেরার আগেও বিবেকানন্দ আরও একবার মাদ্রাজে এসেছিলেন৷ সেটাই ছিল তাঁর প্রথম মাদ্রাজ সফর৷ প্রথমবার তিনি যখন আসেন, তখন তাঁকে কেউ চেনেনই না৷ পরিব্রাজক হয়ে এসেছেন ১৮৯২-র ডিসেম্বরে, থেকেছেন ১৮৯৩-র এপ্রিল পর্যন্ত৷ একের পর এক ধর্মস্হান ঘুরেছেন, হিন্দু মতবাদের বিভিন্ন ধারাকে অধ্যয়ন করেছেন, কিন্তু নিজেকে প্রকাশ করেন নি৷ পরের বার আসেন ১৮৯৭-র ফেব্রুয়ারিতে, শিকাগো ধর্ম মহাসম্মেলনে পশ্চিমি দুনিয়াকে চমকে দেওয়া বেদান্তবাদী ভাষণ দিয়ে ফেরার সময়৷ তখন তিনি স্বামী বিবেকানন্দ হিসাব পরিচিতি পেয়ে গিয়েছেন৷
সেই অর্থে ভারতে মাদ্রাজ-ই প্রথম আবিষ্কার করল ‘বিবেকানন্দ’কে৷ স্বামীজিকে শিকাগো পাঠানোর ক্ষেত্রেও মুখ্য ভূমিকাও নিয়েছিলেন সেখানকার মানুষই৷ ১৮৯৭র ছয় ফেব্রুয়ারিব় তিনি মাদ্রাজে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গেই এগমোর স্টেশনে গণসম্বর্ধনার পর তাঁকে নিয়ে এক বিশাল শোভাযাত্রা পৌঁছয় বিবেকানন্দর শিষ্যত্ব নেওয়া বিলিগিরি আয়েঙ্গারের ক্যাসল কেরনান-এ৷ তাঁর সঙ্গে ছিলেন জে জে গুডউইন, সস্ত্রীক ক্যাপ্টেন সেভিয়ের, স্বামী সদানন্দ, তাঁর দুই সন্ন্যাসী ভাই স্বামী শিবানন্দ এবং স্বামী নিরঞ্জনানন্দ৷ এই বাড়িতেই তিনি ছিলেন ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ পর্যন্ত৷ এর মধ্যে মাদ্রাজেই সাতদিনে সাতটি স্হানে সাতটি অগ্নিবর্ষী ভাষণে তিনি প্রকাশ ঘটিয়়েছেন তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞা, ধীশক্তি, বিচক্ষণতা ও পাণ্ডিত্যের৷ শুনিয়েছেন ভারতের অতীত গৌরব ফেরানোর আহবান৷
১৪ ফেব্রুয়ারির সকাল৷ স্বামীজি ক্যাসল কারনান থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছেন৷ ধাপে ধাপে সিঁড়ি দিয়ে নামছেন, পিছনে বাকি সবাই৷ তাঁরে ফের ঘিরে ধরলেন মাদ্রাজে তাঁর ভাষণে উজ্জীবিত গণমানুষ৷ তাঁদের একটাই দাবি – মাদ্রাজে এই কথাগুলি শোনার মত, রামকৃষ্ণের ভাবাদর্শ প্রচারের জন্য একটি স্হায়ী কেন্দ্র বানাতেই হবে৷ এমন ভাবনা স্বামীজিরও মনে আগেই ধাক্কা দিয়েছিল কি না জানা নেই৷ না হলে, তৎক্ষণাৎ তিনি কি করে এমন একটি সিদ্ধান্ত নিলেন, যা দেশে এক নতুন মতবাদের প্রচারের সূত্রপাত ঘটিয়ে দিল! তিনি তাঁর প্রিয় ভারতবাসীদের দাবি মেনে তৎক্ষণাৎ জানালেন,মাদ্রাজেই গড়ে উঠবে সেই প্রথম কেন্দ্র৷ তার দায়িত্ব দিলেন নিজের শিষ্য স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে৷
চিন্তাবিদ এবং অসাধারণ বাগ্মী স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ মাদ্রাজে পৌঁছলেন সে-বছরই মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে৷ তাঁর সঙ্গী স্বামী সদানন্দ৷ এসে উঠলেন সেই আইস হাউস রোড-এর (এখন নাম ডঃ বেসান্ত রোড) ফ্লোরা কটেজে৷ শুরু হল দক্ষিণ ভারতে রামকৃষ্ণ ভাবাদর্শের প্রচার৷ পরে তারাও এসে উঠলেন বিলিগিরির ক্যাসল কারনান-এ৷ বিলিগিরির আর্থিক আনুকুল্যে তৈরি হল প্রথম রামকৃষ্ণ মন্দির৷ শুরু হল ভারতে তথা বিদেশে রামকৃষ্ণ ভাবাদর্শের জয়যাত্রা৷
বিলিগিরি মারা গেলেন ১৯০২ সালে, যে বছর বিবেকানন্দ পৃথিবী ছেড়ে রামকৃষ্ণলোকে গমন করছেন৷ তার পরের চার বছর এই বাড়িতে থেকেই কাজ করেছেন স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ৷ তারপর মর্টগেজ থাকা বাড়িটি নিলাম হয়ে যায়৷ ফের এই বাড়িটি রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভক্তদের কাছে ফিরে আসে পনের বছর পর, ১৯১৭ সালে, সরকার বাড়িটি অধিগ্রহণ করার পর৷ বাড়িটি সারিয়ে সেখানে এবার বিবেকানন্দর মূর্তি স্হাপন করা হয়৷
এখন এই বাড়িতে আছে বিবেকানন্দর ১৫০টি দুর্মূল্য আলোকচিত্র সব স্বামীজির জীবন ও ভারতের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিষয়ক একটি প্রদর্শনী৷ ক্যাসল কারনান নাম বদলে বিবেকানন্দ ইল্লম হল ১৯৬৩ -তে, বিবেকানন্দ-র জন্ম-শতবর্ষে৷ প্রদর্শনীর প্রথমভাগে ৪৩ টি ছবিতে বর্ণিত আছে বৈদিক যুগ থেকে রামকৃষ্ণের সময় পর্যন্ত ভারতের সাংষ্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারা৷ গোলাকার বারান্দায় আছে স্বামীজির জীবন ও কর্ম বিষয়ক ১২০টি ছবির প্রদর্শনী৷ যে কক্ষে স্বামীজি বাস করেছিলেন, সুসজ্জিত সেই কক্ষটি আছে দোতলায়৷ সেখান থেকে দেখা যায় মাদ্রাজের প্রশস্ত বেলাভূমি৷
বিবেকানন্দর জন্মের সার্ধ-শতবর্ষ পূর্তির সময়ে কলকাতায় বিবেকানন্দকে নিয়ে বাঙলার মানুষ উৎসবে মেতেছেন। এই সময়েও একবারের জন্য হলেও বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণ মঠের পিছনে মাদ্রাজের গণমানুষের অবদান মনে রাখা বোধহয় প্রয়োজন৷
চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য
শিকাগোর ধর্মসভায় সেই বিখ্যাত ভাষণ দেওয়ার আগে ক’জন ভারতবাসী চিনতেন বিবেকানন্দকে! রামকৃষ্ণ মঠই বা ছিল কোথায়! শিকাগোর একটি ঘটনাই ভারতবাসীদের আগেও যেমন নাড়া দিয়েছিল আমেরিকার নাগরিকদের, তেমনই ভারতেও বিবেকানন্দ প্রথম গণসম্বর্ধনা হেয়েছিলেন কিন্তু বাংলার বাইরেই, মাদ্রাজে৷ ১৮৯৭-র ফেব্রুয়ারি মাসে শিকাগো থেকে কলম্বো হয়ে বিবেকানন্দ ভারতে ফিরলেন৷ শিকাগোর আগে পর্যন্ত যে ভারতীয়টিকে ভারতবাসীরা সেভাবে জানতেন না, সেই বিবেকানন্দ কলম্বো থেকে পমবন, রামেশ্বরম হয়ে মাদ্রাজে (এখন নাম চেন্নাই) পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই দেখলেন, তাঁকে সম্বর্ধনা জানাতে হাজির হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ৷ এই জনতাই ভারতের ‘আপামর দরিদ্র ভারতবাসী, মুচি-মেথর-চণ্ডাল ভারতবাসী’৷ তাঁরা পেয়ে গেছেন তাঁদের মনের মানুষকে৷ তাঁর মধ্যেই তাঁরা আগামী দিনের মুক্তির আভাস পেয়েছেন৷
এতটা আশা করেন নি স্বামীজি নিজেও৷ গণ-মানুষের সেই শোভাযাত্রা তাঁকে নিয়ে গেল এক মাদ্রাজ হাই কোর্টের এক প্রতিষ্ঠিত অ্যাডভোকেট বিলিগিরি আয়েঙ্গারের বাড়িতে৷ এখনও কেউ কেউ দাবী করেন, সেদিন বিবেকানন্দকে দেওয়া স্বতঃস্ফূর্ত সম্বর্ধনা আজও ছাপিয়ে যেতে পারেনি অন্য কোনও সম্বর্ধনার সমাবেশ! বিলিগিরির বাড়িটির তখন নাম ছিল ‘আইস হাউস’৷ পঞ্চাশ বছর আগে, স্বামীজির জন্ম-শতবর্ষে তামিলনাড়ু সরকার এই বাড়িটির নতুন নামকরণ করে ‘বিবেকানন্দ ইল্লম’ অর্থাৎ বিবেকানন্দ ভবন৷
মাদ্রাজের বিখ্যাত মেরিনা বিচ-এর উপর এই সুদৃশ্য হর্ম্যটি কেবল নয়নাভিরামই নয়, এর ইতিহাসও যথেষ্টই সমৃদ্ব৷ বিবেকানন্দর ভাবধারায় বিশ্বাসীদের কাছে এই বাড়িটির গুরুত্বও অকল্পনীয়৷ তার একটি বড় কারণ, এই বাড়ি থেকেই জন্ম নেয় রামকৃষ্ণ মঠ স্হাপনের প্রথম প্রয়াস৷ বিশেষভাবে যা আজ উল্লেখের অপেক্ষা রাখে, তা হল, সেই প্রয়াস কোনও স্বামীজি বা ধর্মগুরুর দিক থেকে শুরু হয় নি। এমনকি, স্বামী বিবেকানন্দরও চিন্তায় আসেনি৷ এসেছিল তামিলনাড়ুর ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে আপামর মানুষদের ঐকান্তিক দাবির মধ্য থেকে৷ তারও কেন্দ্র এই ইল্লম৷
এই বাড়িটি, অর্থাৎ আইস হাউস বরফ রাখার গুদাম হিসাবে তৈরি হয় ১৮৪২ সালে, ১৭২ বছর আগে৷ কেবল মাদ্রাজেই নয়, বাংলা এবং মুম্বাইতেও এমন কয়েকটি বরফ গুদাম বানিয়েছিলেন ‘আইস কিং’ ফ্রেডরিক ট্যুডর৷ ব্রিটিশ ও ফরাসিরা মদ্যপান ও অন্যান্য প্রয়োজনে যেন বরফ পান, সেই জন্য বিদেশ থেকে বরফ আমদানি করে এখানে রাখা হত৷ বাড়িটি এমনভাবেই তৈরি যে, মাসের পর মাস বরফ সেখানে অবিকৃত থাকত৷ বাংলায় বরফ কারখানাটি হয়েছিল চন্দননগরে। এখনও এই জায়গাটি বরফতোলার মাঠ হিসাবে পরিচিত।
কলকাতা, মুম্বই ও মাদ্রাজ শহরে তাঁর গুদাম থাকলেও ভারতে তাঁর ব্যবসা তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন মাদ্রাজ থেকেই৷ ১৮৪২ থেকে ১৮৮০ পর্যন্ত তিনি চুটিয়ে বরফের ব্যবসা করেছেন৷ এই সময় নাগাদই চন্দননগরের বরফতোলার মাঠে স্টিমকে ব্যবহার করে বরফ বানানোর কল স্হাপিত হয়৷ দ্রুত অন্যান্য শহরেও তা তৈরি হতে থাকে৷ মন্দার ধাক্কায় ট্যুডরের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়৷
সেই সময়ে বিলিগিরি আয়েঙ্গার ছিলেন মাদ্রাজ হাই কোর্টের লব্ধপ্রতিষ্ঠ আইনজীবি৷ তিনি বাড়িটি কিনে তার চারপাশে বারান্দা বানান৷ বাড়িটিতে প্রচুর দরজা ও জানালা বানিয়ে এটিকে মানুষের বাসযোগ্য করেন৷ তাঁর বন্ধু তথা প্রখ্যাত বিচারক কেরনানের নামে বাড়িটির নতুন নাম দেন ‘ক্যাসল কেরনান’৷ নিজে আইন ব্যবসায়ী হলেও সাধারণ গরিবদের প্রতি তার বিশেষ টান ছিল৷ ক্যাসল কারনানে নিজের বসবাসের জন্য প্রয়োজনীয় অংশের বাইরে তিনি ঠাঁই দিয়েছিলেন বহু গরিব-দুঃখীকে৷ এতদ৲সত্ত্বেও, সম্ভবত সেই বাড়িতে আলো-বাতাস তেমন খেলত না বলে শেষ পর্যন্ত তিনি বাড়িটি বসবাসের অযোগ্য বলে ফাঁকা করে দিয়েছিলেন৷
শিকাগো থেকে ফেরার আগেও বিবেকানন্দ আরও একবার মাদ্রাজে এসেছিলেন৷ সেটাই ছিল তাঁর প্রথম মাদ্রাজ সফর৷ প্রথমবার তিনি যখন আসেন, তখন তাঁকে কেউ চেনেনই না৷ পরিব্রাজক হয়ে এসেছেন ১৮৯২-র ডিসেম্বরে, থেকেছেন ১৮৯৩-র এপ্রিল পর্যন্ত৷ একের পর এক ধর্মস্হান ঘুরেছেন, হিন্দু মতবাদের বিভিন্ন ধারাকে অধ্যয়ন করেছেন, কিন্তু নিজেকে প্রকাশ করেন নি৷ পরের বার আসেন ১৮৯৭-র ফেব্রুয়ারিতে, শিকাগো ধর্ম মহাসম্মেলনে পশ্চিমি দুনিয়াকে চমকে দেওয়া বেদান্তবাদী ভাষণ দিয়ে ফেরার সময়৷ তখন তিনি স্বামী বিবেকানন্দ হিসাব পরিচিতি পেয়ে গিয়েছেন৷
সেই অর্থে ভারতে মাদ্রাজ-ই প্রথম আবিষ্কার করল ‘বিবেকানন্দ’কে৷ স্বামীজিকে শিকাগো পাঠানোর ক্ষেত্রেও মুখ্য ভূমিকাও নিয়েছিলেন সেখানকার মানুষই৷ ১৮৯৭র ছয় ফেব্রুয়ারিব় তিনি মাদ্রাজে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গেই এগমোর স্টেশনে গণসম্বর্ধনার পর তাঁকে নিয়ে এক বিশাল শোভাযাত্রা পৌঁছয় বিবেকানন্দর শিষ্যত্ব নেওয়া বিলিগিরি আয়েঙ্গারের ক্যাসল কেরনান-এ৷ তাঁর সঙ্গে ছিলেন জে জে গুডউইন, সস্ত্রীক ক্যাপ্টেন সেভিয়ের, স্বামী সদানন্দ, তাঁর দুই সন্ন্যাসী ভাই স্বামী শিবানন্দ এবং স্বামী নিরঞ্জনানন্দ৷ এই বাড়িতেই তিনি ছিলেন ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ পর্যন্ত৷ এর মধ্যে মাদ্রাজেই সাতদিনে সাতটি স্হানে সাতটি অগ্নিবর্ষী ভাষণে তিনি প্রকাশ ঘটিয়়েছেন তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞা, ধীশক্তি, বিচক্ষণতা ও পাণ্ডিত্যের৷ শুনিয়েছেন ভারতের অতীত গৌরব ফেরানোর আহবান৷
১৪ ফেব্রুয়ারির সকাল৷ স্বামীজি ক্যাসল কারনান থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছেন৷ ধাপে ধাপে সিঁড়ি দিয়ে নামছেন, পিছনে বাকি সবাই৷ তাঁরে ফের ঘিরে ধরলেন মাদ্রাজে তাঁর ভাষণে উজ্জীবিত গণমানুষ৷ তাঁদের একটাই দাবি – মাদ্রাজে এই কথাগুলি শোনার মত, রামকৃষ্ণের ভাবাদর্শ প্রচারের জন্য একটি স্হায়ী কেন্দ্র বানাতেই হবে৷ এমন ভাবনা স্বামীজিরও মনে আগেই ধাক্কা দিয়েছিল কি না জানা নেই৷ না হলে, তৎক্ষণাৎ তিনি কি করে এমন একটি সিদ্ধান্ত নিলেন, যা দেশে এক নতুন মতবাদের প্রচারের সূত্রপাত ঘটিয়ে দিল! তিনি তাঁর প্রিয় ভারতবাসীদের দাবি মেনে তৎক্ষণাৎ জানালেন,মাদ্রাজেই গড়ে উঠবে সেই প্রথম কেন্দ্র৷ তার দায়িত্ব দিলেন নিজের শিষ্য স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে৷
চিন্তাবিদ এবং অসাধারণ বাগ্মী স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ মাদ্রাজে পৌঁছলেন সে-বছরই মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে৷ তাঁর সঙ্গী স্বামী সদানন্দ৷ এসে উঠলেন সেই আইস হাউস রোড-এর (এখন নাম ডঃ বেসান্ত রোড) ফ্লোরা কটেজে৷ শুরু হল দক্ষিণ ভারতে রামকৃষ্ণ ভাবাদর্শের প্রচার৷ পরে তারাও এসে উঠলেন বিলিগিরির ক্যাসল কারনান-এ৷ বিলিগিরির আর্থিক আনুকুল্যে তৈরি হল প্রথম রামকৃষ্ণ মন্দির৷ শুরু হল ভারতে তথা বিদেশে রামকৃষ্ণ ভাবাদর্শের জয়যাত্রা৷
বিলিগিরি মারা গেলেন ১৯০২ সালে, যে বছর বিবেকানন্দ পৃথিবী ছেড়ে রামকৃষ্ণলোকে গমন করছেন৷ তার পরের চার বছর এই বাড়িতে থেকেই কাজ করেছেন স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ৷ তারপর মর্টগেজ থাকা বাড়িটি নিলাম হয়ে যায়৷ ফের এই বাড়িটি রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভক্তদের কাছে ফিরে আসে পনের বছর পর, ১৯১৭ সালে, সরকার বাড়িটি অধিগ্রহণ করার পর৷ বাড়িটি সারিয়ে সেখানে এবার বিবেকানন্দর মূর্তি স্হাপন করা হয়৷
এখন এই বাড়িতে আছে বিবেকানন্দর ১৫০টি দুর্মূল্য আলোকচিত্র সব স্বামীজির জীবন ও ভারতের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিষয়ক একটি প্রদর্শনী৷ ক্যাসল কারনান নাম বদলে বিবেকানন্দ ইল্লম হল ১৯৬৩ -তে, বিবেকানন্দ-র জন্ম-শতবর্ষে৷ প্রদর্শনীর প্রথমভাগে ৪৩ টি ছবিতে বর্ণিত আছে বৈদিক যুগ থেকে রামকৃষ্ণের সময় পর্যন্ত ভারতের সাংষ্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারা৷ গোলাকার বারান্দায় আছে স্বামীজির জীবন ও কর্ম বিষয়ক ১২০টি ছবির প্রদর্শনী৷ যে কক্ষে স্বামীজি বাস করেছিলেন, সুসজ্জিত সেই কক্ষটি আছে দোতলায়৷ সেখান থেকে দেখা যায় মাদ্রাজের প্রশস্ত বেলাভূমি৷
বিবেকানন্দর জন্মের সার্ধ-শতবর্ষ পূর্তির সময়ে কলকাতায় বিবেকানন্দকে নিয়ে বাঙলার মানুষ উৎসবে মেতেছেন। এই সময়েও একবারের জন্য হলেও বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণ মঠের পিছনে মাদ্রাজের গণমানুষের অবদান মনে রাখা বোধহয় প্রয়োজন৷
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
এফ সাকি ১৩/০১/২০১৪হ্যাঁ!তা প্রয়োজন বটে।