www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

গঙ্গা বাঁচাতে লড়াই মার্থান্ড-বালির

গঙ্গার প্রত্যাবর্তনে লড়ছে মার্থান্ড-বালি, পাশে নাসিরুদ্দিন শাহ

চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য





ভাগিরথী-অলকানন্দা-মন্দাকিনীর তাণ্ডবলীলায় মানুষের মন যখন ভারাক্রান্ত, তখন অমা রাতের শেষে ভোরের মত আকাশে সূর্যের আভা ছিড়িয়ে দিলেন দুই ভাইবোন -- মার্থান্ড আর বালি বিন্দানা। গঙ্গার উপর নির্মিয়মান ৬০০-র বেশি ছোটো-বড় বাঁধ আর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য হিমালয়ের ডজন ডজন গ্রাম উজাড় হয়ে যাওয়া তাঁদের মনে বিষন্ন করেছিল। তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন গঙ্গাকে আগের চেহেরায় ফেরাতে। হয়তো তা বাস্তবে সম্ভব নয়, তবু তথ্যচিত্রে তা সম্ভব করার এক সংগ্রামী প্রয়াসে মেনেছেন এই ভাইবোন। ছবিটির নাম ‘রিটার্ন অফ গঙ্গা’। মহাকুম্ভের ভিড়ে সংগ্রহ করা কিছু অর্থ আর নিজেদের সামান্য সঞ্চয়ের পুঁজি নিয়েই তাঁরা ঝাঁপিয়েছেন এই অসামান্য কাজে। তারপর…? যেখান থেকে যে বা যারাই হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাঁদের দান এগিয়ে দিয়েছে তাঁদের।
তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন বলিউডের মহান পুরুষ নাসিরুদ্দিন শাহ। তথ্যচিত্রের ভাষ্যকারের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে নিয়ে তিনি বলেছেন, “রিটার্ন অফ গঙ্গা-য় আমার সামান্য যোগদান নিয়ে কোনও হৈ-হল্লার দরকার নেই। উত্তরাখণ্ডের সাম্প্রতিক বিপর্যয়ের মত ঘটনা প্রতিবছর দেশের কোথাও না কোথাও ঘটছে। সেদিকে তাকালে বুঝি যে - গণহারে বৃক্ষনিধন, পাহাড়ে লাগামহীন খননের দ্বারা রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ারদের প্রাকৃতিক সম্পদের অবাধ লুঠ চলছেই। যারা অহেতুক বাঁধ বানায়, তাঁদের প্রতিহত করে এমন ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্য আমাদেরও কিছু যৌথ দায়িত্ব আছে। ইতিমধ্যেই অনেক দেরি হয়ে গেছে, তবু চেষ্টাটুকু তো করা যাক, না হলে পরে সবাইকেই আক্ষেপ করতে হবে।”
মার্থান্ড আগে হাসপাতাল আর শিক্ষাকেন্দ্রের জন্য অ্যানিমেসন ছবি বানাতেন, বালি লিখতেন পর্যটনের ফিচার। একঘেয়ে কাজ থেকে মুক্তি পেতে ২০১২ সালে মার্থাণ্ড কাজ ছেড়ে প্রকৃতি, পাখি, নদীর ছবি তোলার ‘পাগলামি’-তে মেতে ওঠেন। এই সময়ই সংবাদ মাধ্যমে কুম্ভমেলার প্রস্তুতি উপলক্ষে বিপর্যস্ত প্রাকৃতিক ব্যবস্থার নানা সংবাদ ছাপা হয়। জানা যায়, লাগামহীন বাঁধের কারণে গঙ্গার অন্যতম জলদায়ী ধারা ‘অসিগঙ্গা’ চামোলির আগেই শুকিয়ে গেছে। অতীতে উত্তরাখণ্ড সফরে এই নদীকে কাছ থেকে দেখে আরও কোটি কোটি ভারতীয়ের মত এই নদীর প্রেমে পড়েছিলেন মার্থান্ড-বালি। মৃত অসিগঙ্গার অবিশ্বাস্য ছবি দেখে প্রায় কেঁদে ফেলেন মার্থাণ্ড। সে-কথা বলেন বালিকে। শুনেই ছবি বানানোর পরিকল্পনা করে ফেলেন বালি।
ছবি করবেন গঙ্গাকে নিয়ে, যেটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত পাঁচটি নদীর একটি। নদীর জলে বইছে বাঁধ তৈরির নানা বর্জ্য। তাঁদের মনে আসে হাজারো প্রশ্ন। নদীর উপর নির্ভ্রশীল আছেন লক্ষ লক্ষ গরীব মানুষ, আছেন প্রকৃতিপ্রেমী ও সংরক্ষণবাদীরা, ইঞ্জিনিয়ার, রাজনীতিবিদ, বাঁধ ও বিদ্যুৎ উৎপাদক সংস্থাগুলি ও তাদের পোষা স্বার্থবাদীরা, ‘উন্নয়নের’ স্লোগানদাতারা, পরিবেশবাদীরা, ভূতাত্বিকরা, ভূকম্প-বিশেষজ্ঞরা এবং অবশ্যই জড়িয়ে আছে নানা বিশ্বাস, নানা প্রবাদ, দুর্নীতির মায়াজাল ইত্যাদি ইত্যাদি। কোন বিষয়টা গুরুত্ব দেওয়া উচিৎ? এমন অবস্থায় সিদ্ধান্ত নেন, সব মত এক জায়গায় করেই, সব সুরকে একত্র করেই তাঁরা নদীকে বাঁচানোর কথা বলবেন।
বাঁধ বানানোকে চ্যালেঞ্জ না করেও তাঁরা বলতে চাইছেন, প্রয়োজনটা আসলে আরও ভাল কোনও সমাধান সন্ধানের যাতে মানুষের কোনও ক্ষতি না হয়। তখন বাঁধের পর বাঁধ তো তৈরি হচ্ছেই। দেরি করা কি সমিচীন, ভাবেন মার্থাণ্ড আর বালি। ২০১২-র শীতের মরশুমে জানলেন, কয়েকমাস পর গ্রীষ্মে উত্তরাখণ্ডের ছবির মত উপত্যকা-শহর শ্রীনগর চলে যাবে বাঁধের গ্রাসে। হাজার হাজার মানুষকে নেহাতই পালাতে বাধ্য করা হবে। “অতএব, অপেক্ষা মানেই সময় নষ্ট এবং লোকসান,” বুঝে গেলেন। কিন্তু ছবি বানাতে তো পয়সা লাগে, লাগে ক্যামেরা টিম ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছু। কোথায় সে সব? মহাকুম্ভে হাজার হাজার লোকের কাছে হাত পেতে এল কিছু। কিন্তু তাভ অতি সামান্যই। বালি আর মার্থান্ড নিজেদের সঞ্চিত অর্থ সব দিয়ে দিলেন। জোগাড় হল প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, শুরু হল কাজ।
বালি বলছিলেন, “একদিকে, গঙ্গার উপর যে ৬০০-র বেশি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির বিপদ থেকে নদীকে বাঁচাতে হবে; অন্যদিকে, পরিবর্তনশীল বিশ্বের প্রেক্ষিতেই খুজতে হবে নতুন পথে সমাধান। তাই আমাদের চিন্তায় ছিল সবার মতামতকে একত্রে এনে মানুষের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করার পথ বলা।“ মার্থান্ড বলেছেন, সেপ্টেম্বর থেকে শুরুর যাত্রা ছিল ‘প্রথমে অন্ধকারে মজার পথ চলা’। যত এগিয়েছেন, ততই সঙ্কট বেড়েছে, সমাধানও হয়েছে। পাশে এসেছেন দেশ-বিদেশের প্রকৃতি-সংরক্ষণবাদীরা আর সাধারণ মানুষ। সরকার কিন্তু ততটাই নির্লিপ্ত, সংশয়গ্রস্ত। বালি জানিয়েছেন, “বিদ্যুৎ বা গ্রামোন্নয়ন এর মত মন্ত্রকগুলি সহায়তা করছে না। আমরা সত্যিই চাই যে তাঁরা এগিয়ে আসুক, আমরা এখনই চেষ্টা করছি, কিন্তু তারা আসছে না।”
ছবির কাজের অনেকটাই শেষ, কিছুটা এখনও বাকি। তথ্যচিত্রটি হবে তিনটি পর্বে। স্ক্রিপ্ট লেখা, শ্যুটিং এর স্থান বাছা থেকে শুরু করে এডিটিং ও অন্যান্য সব কাজের ভার এই ভাইবোন নিজেদের কাঁধেই রেখেছেন। খরচের হিসাব জিজ্ঞাসা করায় বালি হাসতে হাসতে বলেছেন, “এখন পর্যন্ত যা এসেছে আর যা খরচ হয়েছে, তাতে দেনা আছে মাত্র এক লাখের মত।“ ওজন বুঝে ভোজন, আয় বুঝেই ব্যয় করছে।
কিন্তু, তথ্যের সঙ্গে সমঝোতা হচ্ছে না তো? না, তার সম্ভাবনা নেই। এবারের উত্তরাখণ্ড বিপর্যয়ের দিনেও মার্থান্ড আটকে ছিলেন উত্তরকাশিতে। ভয়াবহ সেই বিপর্যয় ধরে রেখেছেন তাঁর ক্যামেরায়। নিচে তখন বালি সহ সকলেই দুশ্চিন্তায়। সবাই যোগাযোগ রেখে৪ছেন সরযূর পাড়ে বোন বালির সঙ্গে। বালি লিখেছেন, দু-দিন আগে অন্যদের থেকে খবর পেয়েছি, আমার ভাই ভাল আছে। এখন যাতায়াতের পথ সুগম হচ্ছে। আর একটু হলেই ফিরে আসবে’। ফিরে এসেছেন মার্থান্ড, শেশঝ হতে চলেছে ‘রিটার্ন অফ গঙ্গা’।
সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে রাজি এমন মহৎ এক প্রয়াসের সফলতার জন্যে।
বিষয়শ্রেণী: সমসাময়িক
ব্লগটি ১১৭২ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৬/১০/২০১৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • সহিদুল হক ৩০/১০/২০১৩
    তথ্যসমৃদ্ধ লেখাটি খুবই সময়োপযোগী হয়েছে।
    আমাদের এই নদীমাতৃক দেশে মাকে রক্ষা করার দায়িত্ব প্রতিটি সন্তানের।
    শুভকামনা জানাই।ভাল থাকবেন।

    কলকাতা-৭০০১২৫
    ৩০/১০/২০১৩
  • ধন্যবাদ আপনার তথ্য বহুল একটি লেখার জন্য।যে বিষয়ের অবতারণা করেছেন এখানে, তার প্রভাব শুধু একটি দেশেই সীমাবদ্ধ নয়।প্রতিটি দেশেই এর প্রভাব বিদ্যমান।ভারতের কোন নদীর যেকোন প্রভাব আমাদের এই বাংলাদেশে ও সমান ভুক্তভোগী।
    • চন্দ্রশেখর ১৮/১১/২০১৩
      ামরা, মানে বাঙ্গালীরা যেহেতু নদীর শেষ প্রান্তে বাস করি, তাই আমরা সবচেয়ে বেশী ভুক্তভোগী। ঠিক বলেছেন আপনি। আমার লেখার কারণও তাই।
      এ-বছর জানুয়ারিতেই আমি ঢাকায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নদী জল বন্টন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গিয়েছিলাম। ২০১৪-এর জানুয়ারিতেও যাওয়ার ইচ্ছে আছে।
  • Înšigniã Āvî ২৬/১০/২০১৩
    tothosomridho lekha.....onek kichu jaanlaam
  • কবীর হুমায়ূন ২৬/১০/২০১৩
    গঙ্গার উপর বাঁধের কারনে শুধু উত্তরাখন্ড নয়; বাংলাদেশও তীব্রভাবে আক্রান্ত। গঙ্গা তার সনাতন রূপে ফিরে পাক তার আপনা মহিমা। আন্দোলন হোক, মননে চেতনে। শ্লোগান জাগুক- 'রিটার্ন অফ গঙ্গা'।

    ভালো ও তথ্যবহুল লেখা। ধন্যবাদ।
    • চন্দ্রশেখর ১৮/১১/২০১৩
      ধন্যবাদ কবীর। সেই জন্যেই তো লেখা।
      এবারও জানুয়ারিতে ঢাকায় যাওয়ার কথা হচ্ছে।
 
Quantcast