‘টাইগার বয়’ চেন্দ্রু আজ অসাড়
টাইগার বয়’ চেন্দ্রু আজ অসাড়
চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য
চেন্দ্রু মান্ডবী একজন মুরিয়া গোন্ড। বয়স এখন ৭৮। একবছর যাবৎ তিনি খুব অসুস্থ, প্যারালিটিক স্ট্রোক হয়েছে। বস্তারের নারায়ণপুর জেলার গান্দবেঙ্গল গ্রামের এই বাসিন্দাকে প্রথমে জেলা হাসপাতালে তারপর সেখান থেকে ভিলাইয়ের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। মহকুমা শাসক প্রকাশ কুমারের দেওয়া এই খবরে আপনার কেন গোটা ভারতের কারোরই কিছু আসে যায় না। চেন্দ্রুর নিজের অবশ্য চিকিৎসা করানোর মত কোনও পয়সাকড়ি নেই।
ভারতের অন্যতম আদিম আদিবাসী গোষ্ঠী মুরিয়া গোন্ডদের রোজগারের কোনও ব্যবস্থাই নেই। এখনও তাঁদের সমাজ ‘ঘোটুল’ বা গণ-বাসায় বাস করে। কৈশোর প্রাপ্ত হলেই ছেলেরা ও মেয়েরা আর মা-বাবার সঙ্গে থাকে না, চলে যায় গণবাসায়। এই সমাজে নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করায়, মেলামেশায় বা বিয়ের আগে যৌন সংসর্গে কোনও বাধা নেই। সমানাধিকারের ভিত্তিতে পরিচালিত তাঁদের সমাজ আজও মাতৃতান্ত্রিক।
এ-কথা জানার পরও কিন্তু চেন্দ্রুর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকার খবর আমার-আপনার কাছে খুব গুরুত্ববাহী নয়। গতবছর স্থানীয় কত্রি নদীর বন্যায় তাঁর ঘর ভেসে যায়। তাঁর পরিবারের বাকি তিন সদস্যও সেই বন্যায় ভেসে গেছেন। এটা জানার পরও কিন্তু বলাই যায়, এ-সব জেনে কি হবে? তবুও জানুন, জাপান থেকে জার্মান মহিলা ফেঙ্কো এমানুলি চেন্দ্রুর চিকিৎসার জন্যে জেলাশাসকের কাছে ১.১৭ লাখ টাকা পাঠিয়েছেন।
এমানুলি কোনওদিন ছত্তিশগড়ের চেন্দ্রুকে দেখেন নি, তবে তাঁর কথা পড়েছেন। সুইডিশ চলচ্চিত্রনির্মাতা আরনি সাকসড্রোফ-এর স্ত্রী অ্যাস্ট্রিড-এর লেখা একটি বই পড়ে চেন্দ্রুর কথা জেনেছেন। ১৯৫৯-এ আরনি আর তাঁর স্ত্রী অ্যাস্ট্রিড ছত্তিশগড়ের বস্তারে গিয়ে চেন্দ্রুর খোঁজ পেয়ে তাঁর গ্রামে যান। সেখানে বেশ কয়েকদিন তাঁর কুটিরেই ছিলেন। প্রথমে ভীষণ ভয়ে ভয়ে ছিলেন। তারপর চেন্দ্রুর ঘরে সহবাসকারীকে আর তাঁরা ভয় পেতেন না। বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল – এবং সেটাও চেন্দ্রুর সুবাদেই। ভয়ের কারণ, চেন্দ্রুর সেই রুম পার্টনার যে মানুষ নয়, একটি পূর্ণবয়স্ক বাঘ। হ্যাঁ, বাঘ, মানে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার।
সেই খবর পেয়েই তো আরনি সাকসড্রোফ সস্ত্রীক গিয়েছিলেন নারায়ণগড়ের গান্দবেঙ্গল গ্রামে, থেকেছেন চেন্দ্রুর ঘরেই, বাঘের সঙ্গে। একসঙ্গে নদীতে স্নানও করেছেন। আর সেই সব দৃশ্য ধরেছেন তাঁর মুভি ক্যামেরায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন চেন্দ্রুর। তারপর ১৯৬০-এ প্রকাশ করেন তাঁর বিখ্যাত তথ্যচিত্র ‘এ জাঙ্গল টেল’। চেন্দ্রু একদিন অবুঝমাড়ের ঘন জঙ্গলে একটি আহত ব্যাঘ্রশাবককে পায়। সুশ্রুষা করে সে তাঁর প্রাণ বাঁচায়। নাম রাখে টাম্বু। এমনিতে ছত্তিশগড়ের বাঘ মানুষখেকো নয়, তবে মানুষের রক্তের স্বাদ পেলে সে আর নিরীহ থাকে না। তাই গোন্ড, মুরিয়াদের কাছেও বাঘ শত্রুই। বাঘকে তাঁরা জঙ্গলের রাজা মনে করে। আহত সেই বাঘকে চেন্দ্রু কিন্তু মেরে ফেলেনি, বাঁচিয়েছিল। বস্তারের আদিবাসীদের এটাই রীতি।
তথ্যচিত্রটি সেই দশকে সারা পৃথিবীতেই আলোড়ন ফেলেছিল। টারজানের কাহিনী নেহাতই গল্প কথা, চেন্দ্রুর কাহিনী বাস্তব। চেন্দ্রু আর তাঁর বাঘের সঙ্গে ঘরকন্যার কাহিনী সবিস্তারে ছাপেন আরনির স্ত্রী অ্যাস্ট্রিড তাঁর ‘চেন্দ্রু – দ্য বয় অ্যান্ড দ্য টাইগার’ বইয়ে। তাতে জুড়ে দেন তাঁদের ক্যামেরায় তোলা একগুচ্ছ ছবি। বেস্টসেলার হয়ে যায় সেই বই, যেটি এমানুলিও পড়েছিলেন। তথ্যচিত্রে আর বই পড়ে লন্ডন প্যালেসের বিখ্যাত চিত্রগ্রাহক স্টেফান জেমসও চলে এসেছিলেন সোজা নারায়ণপুরের গান্দবেঙ্গল গ্রামে। চেন্দ্রু আর তাঁর বাঘের মানবিক সম্পর্ক নিয়ে এক অনন্যসাধারণ ফটোফিচার করেছিলেন তিনি।
মাওবাদীদের অতর্কিত হানায় বস্তারের সরকারি মদতপুষ্ট ঘাতক বাহিনীর প্রধান মহেন্দ্র কর্মার মৃত্যুর পর কোনও কোনও মহল তাঁকে ‘টাইগার অফ বস্তার’ বলে আখ্যায়িত করছিল। তারা মনেই রাখেনি এই বস্তারেরই এক অখ্যাত গ্রামে একটি মুরিয়া গোন্ড কিশোর সেই ১৯৫৯ থেকে একটি বাঘকে নিয়ে ঘরগেরস্তি করেছে, কিন্তু কাউকে হত্যা করেনি। সেই প্রকৃতিপ্রেমিক আদিবাসী আজ বৃদ্ধ। একসময় যে শরীর বাঘের সঙ্গে খেলেছে, আজ তা অসাড়। তাঁর চিকিৎসার কথা কেউ ভাবছে না।
চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য
চেন্দ্রু মান্ডবী একজন মুরিয়া গোন্ড। বয়স এখন ৭৮। একবছর যাবৎ তিনি খুব অসুস্থ, প্যারালিটিক স্ট্রোক হয়েছে। বস্তারের নারায়ণপুর জেলার গান্দবেঙ্গল গ্রামের এই বাসিন্দাকে প্রথমে জেলা হাসপাতালে তারপর সেখান থেকে ভিলাইয়ের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। মহকুমা শাসক প্রকাশ কুমারের দেওয়া এই খবরে আপনার কেন গোটা ভারতের কারোরই কিছু আসে যায় না। চেন্দ্রুর নিজের অবশ্য চিকিৎসা করানোর মত কোনও পয়সাকড়ি নেই।
ভারতের অন্যতম আদিম আদিবাসী গোষ্ঠী মুরিয়া গোন্ডদের রোজগারের কোনও ব্যবস্থাই নেই। এখনও তাঁদের সমাজ ‘ঘোটুল’ বা গণ-বাসায় বাস করে। কৈশোর প্রাপ্ত হলেই ছেলেরা ও মেয়েরা আর মা-বাবার সঙ্গে থাকে না, চলে যায় গণবাসায়। এই সমাজে নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করায়, মেলামেশায় বা বিয়ের আগে যৌন সংসর্গে কোনও বাধা নেই। সমানাধিকারের ভিত্তিতে পরিচালিত তাঁদের সমাজ আজও মাতৃতান্ত্রিক।
এ-কথা জানার পরও কিন্তু চেন্দ্রুর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকার খবর আমার-আপনার কাছে খুব গুরুত্ববাহী নয়। গতবছর স্থানীয় কত্রি নদীর বন্যায় তাঁর ঘর ভেসে যায়। তাঁর পরিবারের বাকি তিন সদস্যও সেই বন্যায় ভেসে গেছেন। এটা জানার পরও কিন্তু বলাই যায়, এ-সব জেনে কি হবে? তবুও জানুন, জাপান থেকে জার্মান মহিলা ফেঙ্কো এমানুলি চেন্দ্রুর চিকিৎসার জন্যে জেলাশাসকের কাছে ১.১৭ লাখ টাকা পাঠিয়েছেন।
এমানুলি কোনওদিন ছত্তিশগড়ের চেন্দ্রুকে দেখেন নি, তবে তাঁর কথা পড়েছেন। সুইডিশ চলচ্চিত্রনির্মাতা আরনি সাকসড্রোফ-এর স্ত্রী অ্যাস্ট্রিড-এর লেখা একটি বই পড়ে চেন্দ্রুর কথা জেনেছেন। ১৯৫৯-এ আরনি আর তাঁর স্ত্রী অ্যাস্ট্রিড ছত্তিশগড়ের বস্তারে গিয়ে চেন্দ্রুর খোঁজ পেয়ে তাঁর গ্রামে যান। সেখানে বেশ কয়েকদিন তাঁর কুটিরেই ছিলেন। প্রথমে ভীষণ ভয়ে ভয়ে ছিলেন। তারপর চেন্দ্রুর ঘরে সহবাসকারীকে আর তাঁরা ভয় পেতেন না। বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল – এবং সেটাও চেন্দ্রুর সুবাদেই। ভয়ের কারণ, চেন্দ্রুর সেই রুম পার্টনার যে মানুষ নয়, একটি পূর্ণবয়স্ক বাঘ। হ্যাঁ, বাঘ, মানে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার।
সেই খবর পেয়েই তো আরনি সাকসড্রোফ সস্ত্রীক গিয়েছিলেন নারায়ণগড়ের গান্দবেঙ্গল গ্রামে, থেকেছেন চেন্দ্রুর ঘরেই, বাঘের সঙ্গে। একসঙ্গে নদীতে স্নানও করেছেন। আর সেই সব দৃশ্য ধরেছেন তাঁর মুভি ক্যামেরায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন চেন্দ্রুর। তারপর ১৯৬০-এ প্রকাশ করেন তাঁর বিখ্যাত তথ্যচিত্র ‘এ জাঙ্গল টেল’। চেন্দ্রু একদিন অবুঝমাড়ের ঘন জঙ্গলে একটি আহত ব্যাঘ্রশাবককে পায়। সুশ্রুষা করে সে তাঁর প্রাণ বাঁচায়। নাম রাখে টাম্বু। এমনিতে ছত্তিশগড়ের বাঘ মানুষখেকো নয়, তবে মানুষের রক্তের স্বাদ পেলে সে আর নিরীহ থাকে না। তাই গোন্ড, মুরিয়াদের কাছেও বাঘ শত্রুই। বাঘকে তাঁরা জঙ্গলের রাজা মনে করে। আহত সেই বাঘকে চেন্দ্রু কিন্তু মেরে ফেলেনি, বাঁচিয়েছিল। বস্তারের আদিবাসীদের এটাই রীতি।
তথ্যচিত্রটি সেই দশকে সারা পৃথিবীতেই আলোড়ন ফেলেছিল। টারজানের কাহিনী নেহাতই গল্প কথা, চেন্দ্রুর কাহিনী বাস্তব। চেন্দ্রু আর তাঁর বাঘের সঙ্গে ঘরকন্যার কাহিনী সবিস্তারে ছাপেন আরনির স্ত্রী অ্যাস্ট্রিড তাঁর ‘চেন্দ্রু – দ্য বয় অ্যান্ড দ্য টাইগার’ বইয়ে। তাতে জুড়ে দেন তাঁদের ক্যামেরায় তোলা একগুচ্ছ ছবি। বেস্টসেলার হয়ে যায় সেই বই, যেটি এমানুলিও পড়েছিলেন। তথ্যচিত্রে আর বই পড়ে লন্ডন প্যালেসের বিখ্যাত চিত্রগ্রাহক স্টেফান জেমসও চলে এসেছিলেন সোজা নারায়ণপুরের গান্দবেঙ্গল গ্রামে। চেন্দ্রু আর তাঁর বাঘের মানবিক সম্পর্ক নিয়ে এক অনন্যসাধারণ ফটোফিচার করেছিলেন তিনি।
মাওবাদীদের অতর্কিত হানায় বস্তারের সরকারি মদতপুষ্ট ঘাতক বাহিনীর প্রধান মহেন্দ্র কর্মার মৃত্যুর পর কোনও কোনও মহল তাঁকে ‘টাইগার অফ বস্তার’ বলে আখ্যায়িত করছিল। তারা মনেই রাখেনি এই বস্তারেরই এক অখ্যাত গ্রামে একটি মুরিয়া গোন্ড কিশোর সেই ১৯৫৯ থেকে একটি বাঘকে নিয়ে ঘরগেরস্তি করেছে, কিন্তু কাউকে হত্যা করেনি। সেই প্রকৃতিপ্রেমিক আদিবাসী আজ বৃদ্ধ। একসময় যে শরীর বাঘের সঙ্গে খেলেছে, আজ তা অসাড়। তাঁর চিকিৎসার কথা কেউ ভাবছে না।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
কামরুজ্জামান সাদ ১২/০১/২০১৮মর্মান্তিক
-
দীপঙ্কর বেরা ১৮/০৯/২০১৩Samabedana railo. Onek kichu janlam.
-
Înšigniã Āvî ১৪/০৯/২০১৩আমিও সমবেদনা জানালাম ।
-
সালমান মাহফুজ ১৩/০৯/২০১৩আমার পক্ষ থেকে সমবেদনা ।