মহান মে দিবস ও ইসলামে শ্রমিকদের মর্যাদা
মহান মে দিবস
শ্রম ও শ্রমিকের সংজ্ঞা : যে কোন কাজ করাকেই শ্রম বলা হয়। শ্রমিককে ইংরেজিতে Labour বলা হয়, আর আরবিতে বলা হয় আমেল। সাধারণ অর্থে যারা পরিশ্রম করে তাদেরকেই শ্রমিক বলা হয়। প্রচলিত অর্থে সমাজে বা রাষ্ট্রে যারা অন্যের অধীনে অর্থের বিনিময়ে পরিশ্রম করে তাদেরকে শ্রমিক বলা হয়।
শ্রমের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে অর্থনীতিবিদ মার্শাল বলেছেন "Any exertion of mind or of body undergone partly or of wholly with a view to some good other then pleasure derived directly form the work."
বিশ্বের কোটি কোটি শ্রমজীবি মানুষের অধিকার ও দাবি আদায়ের মহান ‘মে দিবস’ আজ। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা উপযুক্ত মজুরি আর দৈনিক আট ঘন্টা কাজের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।
#কুরআন_হাদিসের আলোকে শ্রমিকের অধিকার।
১)তোমাদের অধীন ব্যক্তিরা তোমাদের ভাই, আল্লাহ যে ভাইকে তোমার অধীন করে দিয়েছেন তাকে তাই খেতে দাও যা তুমি নিজে খাও, তাকে তাই পরিধান করতে দাও যা তুমি নিজে পরিধান কর। বুখারী - আবু হুরায়রা (রাঃ)
২)) হযরত ওমর (রা:) বলেন, যৌবনকালে যে ব্যক্তি শ্রম দিয়ে রাষ্ট্র ও জনগণের খেদমত করেছেন বৃদ্ধকালে সরকার তার হাতে ভিক্ষার ঝুলি দিতে পারে না। -ইবনে মাযাহ্ ।
৩)হযরত আবুবকর (রাঃ) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, “ক্ষমতার বলে অধীন চাকর-চাকরানী বা দাস-দাসীর প্রতি মন্দ আচরণকারী বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না।” (ইবনে মাজাহ) তিনি আরো বলেন, “কেউ তার অধীন ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে এক দোররা মারলেও কেয়ামতের দিন তার থেকে এর বদলা নেয়া হবে।”
৪)শ্রমিকদের শ্রমের বিনিময়ে তিল তিল করে গড়ে উঠে শিল্প প্রতিষ্ঠান। একটি শিল্পের মালিক শ্রমিকদের শ্রম শোষণ করে অল্প সময়েই পাহাড় পরিমাণ অর্থ-বিত্তের মালিক হয়। শ্রমিকদের কম মজুরি দিয়ে, তাদের ঠকিয়ে গড়ে তোলে একাধিক শিল্প-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কারখানায় তাদের কোনো অংশিদারিত্ব থাকে না। এ ব্যাপারে মহানবী (সা.) বলেছেন, “মজুরকে তার কাজ হতে অংশ দান কর, কারণ আল্লাহর মজুরকে বঞ্চিত করা যায় না।” (মুসনাদে আহমাদ)
৪)শ্রম এবং শ্রমিকের ব্যাপারে বিশ্বমানবতার পরম সুহৃদ মহানবীর (সা.) সবচেয়ে তাৎপর্যমণ্ডিত ঘোষণাটি হলো- আল কাসিবু হাবিবুল্লাহ। অর্থাৎ শ্রমিক হচ্ছে মহান আল্লাহর বন্ধু। আমরা রাসুলকে (সা.) আল্লাহর হাবিব বা বন্ধু হিসেবে জানি। অথচ মহানবী (সা.) একজন শ্রমিককে তার শ্রমের মর্যাদা ও গুরুত্ব প্রদান করতে গিয়ে তাকে মহান আল্লাহর বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। রাসুলের (সা.) অপর তাগিদটি হলো শ্রমিকের প্রাপ্যতা নিয়ে। তিনি বলেন- শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই তার প্রাপ্য মজুরি পরিশোধ করে দাও।
৫)আবু দাউদ শরিফের হাদিস মতে, যে ব্যক্তি আয়-রোজগারের জন্য শ্রম ব্যয় করে, সে যেন আল্লাহর পথে জিহাদে মত্ত। কেউ যদি তার সন্তান বা স্ত্রী অথবা বাবা-মায়ের জীবিকা নির্বাহের জন্য কোনো কাজে লিপ্ত থাকে, তবে সে নিঃসন্দেহে আল্লাহর পথেই বিচরণ করছে। তাবরানি শরিফের মতে, ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থায় যে শ্রমিক সন্ধ্যা যাপন করে, সে নিঃসন্দেহে যাবতীয় অপরাধ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে সন্ধ্যা অতিক্রম করল। একজন শ্রমিকের জন্য এটি সর্বোত্তম এক প্রণোদনা, যা ইসলাম তাকে দিয়েছে
৬)রাসুলের (সা.) ঘোষণা- সেই খাবার সর্বোত্তম, যা স্বহস্তে অর্জিত। বুখারি শরিফের ভাষ্যমতে, রাসুল (সা.) কিয়ামতের দিবসে যাদের প্রতিপক্ষ হবেন তাদের মধ্যে এক শ্রেণি হলো, যারা শ্রমিক নিয়োগ করবে এবং শ্রমিকের দ্বারা ষোলআনা কার্যসিদ্ধি করে নেবে; কিন্তু শ্রমিককে তার প্রাপ্র্য মজুরি দেবে না। আর রাসুল (সা.) যার বা যাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেকে সাব্যস্ত করবেন তাদের অবস্থা বা পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
এখানে রাসুলের (সা.) একজন প্রিয় সাহাবি হজরত আবু মাসউদের (রা.) জীবনের একটি ঘটনার অবতারণা করা যায়। মুসলিম শরিফে বিবৃত আছে, আবু মাসউদ একদিন তার এক শ্রমিককে মারধর করেন। এরই মধ্যে তিনি শুনতে পান, হে আবু মাসউদ! তোমার শ্রমিকের ওপর তোমার যতটা ক্ষমতা আর প্রভাব রয়েছে, তোমার ওপরে তোমার প্রভুর তার চেয়েও বেশি ক্ষমতা ও প্রভাব রয়েছে। মাসউদ (রা.) পেছন ফিরে দেখেন তিনি আর কেউ নন; মানবতার পরম সুহৃদ, দয়ার নবী মুহাম্মদ (সা.)। মাসউদ (রা.) খুবই লজ্জিত হলেন এবং অধীন সেই শ্রমিককে মুক্ত করে দিলেন। দয়াল নবী (সা.) বললেন, তুমি যদি একে আজাদ না করতে তবে তুমি নিশ্চিতভাবে জাহান্নামের আগুনে প্রজ্ব্বলিত হতে। শ্রমিকবান্ধব এমন মহাপুরুষ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
৭)আবু দাউদ শরিফের হাদিস মতে, শ্রমিকের কোনো অপরাধ হলে তা ক্ষমা করে দিতে হবে। এক সাহাবি জিজ্ঞেস করেছিলেন, হে রাসুল (সা.)! শ্রমিকের অপরাধ কয়বার ক্ষমা করব? রাসুল (সা.) চুপ থাকলেন। আবারও তাঁকে প্রশ্ন করা হলো, রাসুল (সা.) আবারও চুপ থাকলেন। তৃতীয়বার যখন জিজ্ঞেস করা হলো যে, শ্রমিককে কয়বার ক্ষমা করব? রাসুল (সা.) গাম্ভীর্যের সঙ্গে তখন ঘোষণা করলেন, শ্রমিক যদি দিনে ৭০ বারও অপরাধ করে, তবে প্রতিবারই তাকে ক্ষমা করে দাও। পাশাপাশি রাসুল (সা.) শ্রমিকের ব্যাপারেও সতর্কবার্তা দিয়েছেন, শ্রমিক যেন তার মালিকের কাজে কোনো ফাঁকি না দেয়।
বরং রাসুল (সা.) বলেন, সেই শ্রমিক উত্তম, যে তার মালিকের কাজটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে থাকে। তিনি আরও বলেন, যে শ্রমিক তার মালিকের হক আদায় করবে এবং আল্লাহর হকও আদায় করবে, মহান আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ পুরস্কার দেবেন। কাজে ফাঁকি দিয়ে অথবা শুধু হাজিরা দিয়ে কাজ না করে যে শ্রমিক মজুরি গ্রহণ করবে, সে নিঃসন্দেহে গর্হিত কাজ করল। এ জন্য তার জবাবদিহি করতে হবে এবং কিয়ামতের দিন তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।
৮)একজন শ্রমিক অন্যের কাজ করে অর্থের প্রয়োজনে। তিনি তার শ্রম দিচ্ছেন নিজের জীবন পরিচালনা এবং তার পোষ্যদের ভরণ-পোষণ নির্বাহ করার জন্যে। তাই তাকে যথাযথ পারিশ্রমিক দেয়া যিনি শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করবেন তার নৈতিক দায়িত্ব।
যদি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ যথাযথ/আলোচনার ভিত্তিতে নির্ধারিত পারিশ্রমিক প্রদান না করে, তার প্রাপ্য পারিশ্রমিক কমিয়ে দেয় কিংবা ঠকিয়ে দেয় তিনি হবেন আল্লাহর দৃষ্টিতে জালিম। আর জালিমের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। তার কোন সাহায্যকারী কিয়ামতে থাকবে না। আল্লাহ বলেন-
ما للظالمين من حميم ولا شفيع يطاع “
“জালিমের জন্য কিয়ামতের দিন কোনো বন্ধু ও সুপারিশকারী থাকবে না।” আল্লাহ আরো বলেন-
” وما للظالمين من نصير.
জালিমের জন্য (কিয়ামতের দিন) কোনো সাহায্যকারী থাকবে না।”
রাসূল (সা) বলেন-
يَا عِبَادِى إِنِّى حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِى وَجَعَلْتُهُ بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا فَلاَ تَظَالَمُوا
“ ওহে আমার বান্দা! আমি আমার জন্যে কাউকে জুলুম করা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। আর এ জুলুমকে আমি তোমাদের পরস্পরের উপর করা হারাম ঘোষণা করেছি। সুতরাং তোমরা জুলুম করো না।”
اِتَّقُوا الظُّلْمَ فَإِنَّ الظُّلْمَ ظُلُمَاتٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.
“ তোমরা জুলুমকে ভয় করো। কেননা, জুলুম কিয়ামতের দিন অন্ধকার জীবনের কারণ হবে।”
যথাযথ পারিশ্রমিক বলতে কী বুঝায় তার কিছুটা ব্যাখ্যা এখানে পেশ করা যেতে পারে। সংক্ষেপে বলা যায় যে, যথাযথ পারিশ্রমিক নির্ভর করবে স্থান কাল পাত্র ভেদে। এ ক্ষেত্রে পদ পদবির আলোকে এবং দেশের প্রচলন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। ইসলামী আইনে প্রচলনের বিশাল গুরুত্ব রয়েছে।
৯)কাজ শেষে বিলম্ব ব্যতিরেকে পারিশ্রমিক পাবার অধিকার : শ্রমিককে তার মজুরী দিতে হবে পরিশ্রম শেষে অনতিবিলম্বে। অর্থাৎ শর্তানুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে পারিশ্রমিক পরিশোধ করতে হবে। কোনভাবেই তাকে হয়রানী করা যাবে না কিংবা ধোকা দেয়া যাবে না। ইসলামের বক্তব্য হলো-
শর্তানুযায়ী এবং ওয়াদা অনুযায়ী পারিশ্রমিক পরিশোধ না করলে তা মুনাফেকী। আর মুনাফেকী করা হরাম। রাসূল (সা) বলেন-
“آيَةُ الْمُنَافِقِ ثَلاَثٌ: إِذَا حَدّثَ كَذَبَ. وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ. وَإِذَا ائْتُمِنَ خَانَ”.
“মুনাফিকের নিদর্শন তিনটি। যখন সে কথা বলে মিথ্যা বলে, যখন সে ওয়াদা করে ভঙ্গ করে আর যখন তার কাছে কোনো জিনিস আমানত রাখা হয় তখন সে তাতে খেয়ানত করে। ”
১০). সাধ্যের বাইরে কাজ না করার অধিকার : শ্রমিকের একটি অধিকার হলো তাকে মািিলক পক্ষের থেকে এমন কাজ দেয়া যাবে না যা তার সাধ্য ও সামর্থ্যের বাইরে। যদি মালিকপক্ষ এমন কাজ দেয় যা তার শর্তের আওতায় নয় কিংবা শারিরীক ও মানসিকভাবে মেনে নেয়ার মতো নয় কিংবা যে কাজটি চাপিয়ে দিলে ভবিষ্যতে তার শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হবার সম্ভাবনা আছে তবে শ্রমিকে সে কাজটি না করে প্রত্যাখ্যান করার অধিকার রয়েছে। হযরত মুসা (আ) যখন হয়রত শুআইব (আ) কে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দিলেন তখন বললেন-
وما أريد أن أشق عليك “
“আমি তোমার উপর কঠিন কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না।” ইসলামের একটি মূলনীতিই হলো সাধ্যের বাইরে কোনো কিছু চাপিয়ে না দেয়া। আল্লাহ তাআলা সে কখা এভাবে বলেন-
لا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْساً إِلَّا وُسْعَهَا
“আল্লাহ কোনো ব্যক্তিকে/নফসকে তার সাধ্যেও বাইরে কোনো কিছু চাপিয়ে দেন না।”
১১). শক্তি কমে গেলেও শ্রমিককে কাজ অব্যাহত রাখার অধিকার : কোনো শ্রমিককে মালিকপক্ষ যদি যুবক থাকা অবস্থায় নিয়োগ দান করেন আর জীবনের কোনো এক পর্যায়ে বাধ্যক্যের কারণে কিংবা অসুস্থতার কারণে কাজে কিছুটা অক্ষমও হয়ে পড়ে তবে সে শ্রমিককে বিদায় দেয়ার অধিকার মালিকের নেই। শ্রমিকের সে অবস্থায়ও কাজে অব্যাহত থাকার অধিকার রয়েছে। তবে আলাপ- আলোচনার মাধ্যমে কোনো সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে কর্ম থেকে বিদায় নিতে বা দিতে কোনো অসুবিধা নেই।
এ ব্যাপারে রাসূল (সা) এর জীবকালের একটি ঘটনা প্রনিধানযোগ্য। রাসুলের যামানায় এক ব্যক্তি তার একটি উটকে যুবক থাকতে কঠিন কঠিন বোঝা চাপিয়ে দিতো। এক পর্যায়ে উটটি বৃদ্ধ হয়ে গেলে সে উটটিকে ভরণপোষণের দায় থেকে বাঁচার জন্য জবেহ করার ইচ্ছে পোষণ করলে রাসূল (সা) তাকে বললেন-
” أكلت شبابه حتى إذا عجز أردت أن تنحره “
“তুমি ওর যেীবনকাল খেয়ে ফেলেছো আর যখন বৃদ্ধ হয়েছে তখন তুমি তাকে জবেহ করতে ইচ্ছে করেছো।”
তখন ঐ ব্যক্তি উটটিকে ছেড়ে দিলো।
পবিত্র কোরআনের বাণী অনুযায়ী ইসলামের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে, মহান আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না। সুতরাং শ্রম-ঘণ্টা তথা শ্রমিকের কাজের সময়সীমার ব্যাপারেও সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের সচেতন থাকার ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। কোনোমতেই অধিক পরিশ্রম বা অধিক সময়ের শ্রম কোনো শ্রমিকের ওপরে চাপিয়ে দেওয়া ইসলামসম্মত নয়।
শ্রম ও শ্রমিকের সংজ্ঞা : যে কোন কাজ করাকেই শ্রম বলা হয়। শ্রমিককে ইংরেজিতে Labour বলা হয়, আর আরবিতে বলা হয় আমেল। সাধারণ অর্থে যারা পরিশ্রম করে তাদেরকেই শ্রমিক বলা হয়। প্রচলিত অর্থে সমাজে বা রাষ্ট্রে যারা অন্যের অধীনে অর্থের বিনিময়ে পরিশ্রম করে তাদেরকে শ্রমিক বলা হয়।
শ্রমের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে অর্থনীতিবিদ মার্শাল বলেছেন "Any exertion of mind or of body undergone partly or of wholly with a view to some good other then pleasure derived directly form the work."
বিশ্বের কোটি কোটি শ্রমজীবি মানুষের অধিকার ও দাবি আদায়ের মহান ‘মে দিবস’ আজ। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা উপযুক্ত মজুরি আর দৈনিক আট ঘন্টা কাজের দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।
#কুরআন_হাদিসের আলোকে শ্রমিকের অধিকার।
১)তোমাদের অধীন ব্যক্তিরা তোমাদের ভাই, আল্লাহ যে ভাইকে তোমার অধীন করে দিয়েছেন তাকে তাই খেতে দাও যা তুমি নিজে খাও, তাকে তাই পরিধান করতে দাও যা তুমি নিজে পরিধান কর। বুখারী - আবু হুরায়রা (রাঃ)
২)) হযরত ওমর (রা:) বলেন, যৌবনকালে যে ব্যক্তি শ্রম দিয়ে রাষ্ট্র ও জনগণের খেদমত করেছেন বৃদ্ধকালে সরকার তার হাতে ভিক্ষার ঝুলি দিতে পারে না। -ইবনে মাযাহ্ ।
৩)হযরত আবুবকর (রাঃ) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, “ক্ষমতার বলে অধীন চাকর-চাকরানী বা দাস-দাসীর প্রতি মন্দ আচরণকারী বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না।” (ইবনে মাজাহ) তিনি আরো বলেন, “কেউ তার অধীন ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে এক দোররা মারলেও কেয়ামতের দিন তার থেকে এর বদলা নেয়া হবে।”
৪)শ্রমিকদের শ্রমের বিনিময়ে তিল তিল করে গড়ে উঠে শিল্প প্রতিষ্ঠান। একটি শিল্পের মালিক শ্রমিকদের শ্রম শোষণ করে অল্প সময়েই পাহাড় পরিমাণ অর্থ-বিত্তের মালিক হয়। শ্রমিকদের কম মজুরি দিয়ে, তাদের ঠকিয়ে গড়ে তোলে একাধিক শিল্প-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কারখানায় তাদের কোনো অংশিদারিত্ব থাকে না। এ ব্যাপারে মহানবী (সা.) বলেছেন, “মজুরকে তার কাজ হতে অংশ দান কর, কারণ আল্লাহর মজুরকে বঞ্চিত করা যায় না।” (মুসনাদে আহমাদ)
৪)শ্রম এবং শ্রমিকের ব্যাপারে বিশ্বমানবতার পরম সুহৃদ মহানবীর (সা.) সবচেয়ে তাৎপর্যমণ্ডিত ঘোষণাটি হলো- আল কাসিবু হাবিবুল্লাহ। অর্থাৎ শ্রমিক হচ্ছে মহান আল্লাহর বন্ধু। আমরা রাসুলকে (সা.) আল্লাহর হাবিব বা বন্ধু হিসেবে জানি। অথচ মহানবী (সা.) একজন শ্রমিককে তার শ্রমের মর্যাদা ও গুরুত্ব প্রদান করতে গিয়ে তাকে মহান আল্লাহর বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। রাসুলের (সা.) অপর তাগিদটি হলো শ্রমিকের প্রাপ্যতা নিয়ে। তিনি বলেন- শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই তার প্রাপ্য মজুরি পরিশোধ করে দাও।
৫)আবু দাউদ শরিফের হাদিস মতে, যে ব্যক্তি আয়-রোজগারের জন্য শ্রম ব্যয় করে, সে যেন আল্লাহর পথে জিহাদে মত্ত। কেউ যদি তার সন্তান বা স্ত্রী অথবা বাবা-মায়ের জীবিকা নির্বাহের জন্য কোনো কাজে লিপ্ত থাকে, তবে সে নিঃসন্দেহে আল্লাহর পথেই বিচরণ করছে। তাবরানি শরিফের মতে, ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থায় যে শ্রমিক সন্ধ্যা যাপন করে, সে নিঃসন্দেহে যাবতীয় অপরাধ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে সন্ধ্যা অতিক্রম করল। একজন শ্রমিকের জন্য এটি সর্বোত্তম এক প্রণোদনা, যা ইসলাম তাকে দিয়েছে
৬)রাসুলের (সা.) ঘোষণা- সেই খাবার সর্বোত্তম, যা স্বহস্তে অর্জিত। বুখারি শরিফের ভাষ্যমতে, রাসুল (সা.) কিয়ামতের দিবসে যাদের প্রতিপক্ষ হবেন তাদের মধ্যে এক শ্রেণি হলো, যারা শ্রমিক নিয়োগ করবে এবং শ্রমিকের দ্বারা ষোলআনা কার্যসিদ্ধি করে নেবে; কিন্তু শ্রমিককে তার প্রাপ্র্য মজুরি দেবে না। আর রাসুল (সা.) যার বা যাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেকে সাব্যস্ত করবেন তাদের অবস্থা বা পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
এখানে রাসুলের (সা.) একজন প্রিয় সাহাবি হজরত আবু মাসউদের (রা.) জীবনের একটি ঘটনার অবতারণা করা যায়। মুসলিম শরিফে বিবৃত আছে, আবু মাসউদ একদিন তার এক শ্রমিককে মারধর করেন। এরই মধ্যে তিনি শুনতে পান, হে আবু মাসউদ! তোমার শ্রমিকের ওপর তোমার যতটা ক্ষমতা আর প্রভাব রয়েছে, তোমার ওপরে তোমার প্রভুর তার চেয়েও বেশি ক্ষমতা ও প্রভাব রয়েছে। মাসউদ (রা.) পেছন ফিরে দেখেন তিনি আর কেউ নন; মানবতার পরম সুহৃদ, দয়ার নবী মুহাম্মদ (সা.)। মাসউদ (রা.) খুবই লজ্জিত হলেন এবং অধীন সেই শ্রমিককে মুক্ত করে দিলেন। দয়াল নবী (সা.) বললেন, তুমি যদি একে আজাদ না করতে তবে তুমি নিশ্চিতভাবে জাহান্নামের আগুনে প্রজ্ব্বলিত হতে। শ্রমিকবান্ধব এমন মহাপুরুষ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
৭)আবু দাউদ শরিফের হাদিস মতে, শ্রমিকের কোনো অপরাধ হলে তা ক্ষমা করে দিতে হবে। এক সাহাবি জিজ্ঞেস করেছিলেন, হে রাসুল (সা.)! শ্রমিকের অপরাধ কয়বার ক্ষমা করব? রাসুল (সা.) চুপ থাকলেন। আবারও তাঁকে প্রশ্ন করা হলো, রাসুল (সা.) আবারও চুপ থাকলেন। তৃতীয়বার যখন জিজ্ঞেস করা হলো যে, শ্রমিককে কয়বার ক্ষমা করব? রাসুল (সা.) গাম্ভীর্যের সঙ্গে তখন ঘোষণা করলেন, শ্রমিক যদি দিনে ৭০ বারও অপরাধ করে, তবে প্রতিবারই তাকে ক্ষমা করে দাও। পাশাপাশি রাসুল (সা.) শ্রমিকের ব্যাপারেও সতর্কবার্তা দিয়েছেন, শ্রমিক যেন তার মালিকের কাজে কোনো ফাঁকি না দেয়।
বরং রাসুল (সা.) বলেন, সেই শ্রমিক উত্তম, যে তার মালিকের কাজটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে থাকে। তিনি আরও বলেন, যে শ্রমিক তার মালিকের হক আদায় করবে এবং আল্লাহর হকও আদায় করবে, মহান আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ পুরস্কার দেবেন। কাজে ফাঁকি দিয়ে অথবা শুধু হাজিরা দিয়ে কাজ না করে যে শ্রমিক মজুরি গ্রহণ করবে, সে নিঃসন্দেহে গর্হিত কাজ করল। এ জন্য তার জবাবদিহি করতে হবে এবং কিয়ামতের দিন তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।
৮)একজন শ্রমিক অন্যের কাজ করে অর্থের প্রয়োজনে। তিনি তার শ্রম দিচ্ছেন নিজের জীবন পরিচালনা এবং তার পোষ্যদের ভরণ-পোষণ নির্বাহ করার জন্যে। তাই তাকে যথাযথ পারিশ্রমিক দেয়া যিনি শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করবেন তার নৈতিক দায়িত্ব।
যদি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ যথাযথ/আলোচনার ভিত্তিতে নির্ধারিত পারিশ্রমিক প্রদান না করে, তার প্রাপ্য পারিশ্রমিক কমিয়ে দেয় কিংবা ঠকিয়ে দেয় তিনি হবেন আল্লাহর দৃষ্টিতে জালিম। আর জালিমের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। তার কোন সাহায্যকারী কিয়ামতে থাকবে না। আল্লাহ বলেন-
ما للظالمين من حميم ولا شفيع يطاع “
“জালিমের জন্য কিয়ামতের দিন কোনো বন্ধু ও সুপারিশকারী থাকবে না।” আল্লাহ আরো বলেন-
” وما للظالمين من نصير.
জালিমের জন্য (কিয়ামতের দিন) কোনো সাহায্যকারী থাকবে না।”
রাসূল (সা) বলেন-
يَا عِبَادِى إِنِّى حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِى وَجَعَلْتُهُ بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا فَلاَ تَظَالَمُوا
“ ওহে আমার বান্দা! আমি আমার জন্যে কাউকে জুলুম করা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। আর এ জুলুমকে আমি তোমাদের পরস্পরের উপর করা হারাম ঘোষণা করেছি। সুতরাং তোমরা জুলুম করো না।”
اِتَّقُوا الظُّلْمَ فَإِنَّ الظُّلْمَ ظُلُمَاتٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.
“ তোমরা জুলুমকে ভয় করো। কেননা, জুলুম কিয়ামতের দিন অন্ধকার জীবনের কারণ হবে।”
যথাযথ পারিশ্রমিক বলতে কী বুঝায় তার কিছুটা ব্যাখ্যা এখানে পেশ করা যেতে পারে। সংক্ষেপে বলা যায় যে, যথাযথ পারিশ্রমিক নির্ভর করবে স্থান কাল পাত্র ভেদে। এ ক্ষেত্রে পদ পদবির আলোকে এবং দেশের প্রচলন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। ইসলামী আইনে প্রচলনের বিশাল গুরুত্ব রয়েছে।
৯)কাজ শেষে বিলম্ব ব্যতিরেকে পারিশ্রমিক পাবার অধিকার : শ্রমিককে তার মজুরী দিতে হবে পরিশ্রম শেষে অনতিবিলম্বে। অর্থাৎ শর্তানুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে পারিশ্রমিক পরিশোধ করতে হবে। কোনভাবেই তাকে হয়রানী করা যাবে না কিংবা ধোকা দেয়া যাবে না। ইসলামের বক্তব্য হলো-
শর্তানুযায়ী এবং ওয়াদা অনুযায়ী পারিশ্রমিক পরিশোধ না করলে তা মুনাফেকী। আর মুনাফেকী করা হরাম। রাসূল (সা) বলেন-
“آيَةُ الْمُنَافِقِ ثَلاَثٌ: إِذَا حَدّثَ كَذَبَ. وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ. وَإِذَا ائْتُمِنَ خَانَ”.
“মুনাফিকের নিদর্শন তিনটি। যখন সে কথা বলে মিথ্যা বলে, যখন সে ওয়াদা করে ভঙ্গ করে আর যখন তার কাছে কোনো জিনিস আমানত রাখা হয় তখন সে তাতে খেয়ানত করে। ”
১০). সাধ্যের বাইরে কাজ না করার অধিকার : শ্রমিকের একটি অধিকার হলো তাকে মািিলক পক্ষের থেকে এমন কাজ দেয়া যাবে না যা তার সাধ্য ও সামর্থ্যের বাইরে। যদি মালিকপক্ষ এমন কাজ দেয় যা তার শর্তের আওতায় নয় কিংবা শারিরীক ও মানসিকভাবে মেনে নেয়ার মতো নয় কিংবা যে কাজটি চাপিয়ে দিলে ভবিষ্যতে তার শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হবার সম্ভাবনা আছে তবে শ্রমিকে সে কাজটি না করে প্রত্যাখ্যান করার অধিকার রয়েছে। হযরত মুসা (আ) যখন হয়রত শুআইব (আ) কে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দিলেন তখন বললেন-
وما أريد أن أشق عليك “
“আমি তোমার উপর কঠিন কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না।” ইসলামের একটি মূলনীতিই হলো সাধ্যের বাইরে কোনো কিছু চাপিয়ে না দেয়া। আল্লাহ তাআলা সে কখা এভাবে বলেন-
لا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْساً إِلَّا وُسْعَهَا
“আল্লাহ কোনো ব্যক্তিকে/নফসকে তার সাধ্যেও বাইরে কোনো কিছু চাপিয়ে দেন না।”
১১). শক্তি কমে গেলেও শ্রমিককে কাজ অব্যাহত রাখার অধিকার : কোনো শ্রমিককে মালিকপক্ষ যদি যুবক থাকা অবস্থায় নিয়োগ দান করেন আর জীবনের কোনো এক পর্যায়ে বাধ্যক্যের কারণে কিংবা অসুস্থতার কারণে কাজে কিছুটা অক্ষমও হয়ে পড়ে তবে সে শ্রমিককে বিদায় দেয়ার অধিকার মালিকের নেই। শ্রমিকের সে অবস্থায়ও কাজে অব্যাহত থাকার অধিকার রয়েছে। তবে আলাপ- আলোচনার মাধ্যমে কোনো সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে কর্ম থেকে বিদায় নিতে বা দিতে কোনো অসুবিধা নেই।
এ ব্যাপারে রাসূল (সা) এর জীবকালের একটি ঘটনা প্রনিধানযোগ্য। রাসুলের যামানায় এক ব্যক্তি তার একটি উটকে যুবক থাকতে কঠিন কঠিন বোঝা চাপিয়ে দিতো। এক পর্যায়ে উটটি বৃদ্ধ হয়ে গেলে সে উটটিকে ভরণপোষণের দায় থেকে বাঁচার জন্য জবেহ করার ইচ্ছে পোষণ করলে রাসূল (সা) তাকে বললেন-
” أكلت شبابه حتى إذا عجز أردت أن تنحره “
“তুমি ওর যেীবনকাল খেয়ে ফেলেছো আর যখন বৃদ্ধ হয়েছে তখন তুমি তাকে জবেহ করতে ইচ্ছে করেছো।”
তখন ঐ ব্যক্তি উটটিকে ছেড়ে দিলো।
পবিত্র কোরআনের বাণী অনুযায়ী ইসলামের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে, মহান আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না। সুতরাং শ্রম-ঘণ্টা তথা শ্রমিকের কাজের সময়সীমার ব্যাপারেও সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের সচেতন থাকার ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। কোনোমতেই অধিক পরিশ্রম বা অধিক সময়ের শ্রম কোনো শ্রমিকের ওপরে চাপিয়ে দেওয়া ইসলামসম্মত নয়।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
স্বপন রোজারিও (মাইকেল) ০১/০৫/২০২০আজকের সময়োপযোগী লেখা। ধন্যবাদ।
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ০১/০৫/২০২০ভালো লিখেছেন।
-
ফয়জুল মহী ৩০/০৪/২০২০দেশের শাসকগোষ্ঠী যদি মানবিক হতো । মরেও শান্তি পেতাম।