www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

আকাশপাতা

বারুদবালিকা

খুব খুব শীতের সকালে কান্না পাওয়ার অনেক সুবিধে। ঠাণ্ডাতে চোখ দিয়ে জল পড়ছে বলে ধরে নেবে লোকে। আজ একটুও রোদ নেই, কেবলই হিমেল হাওয়ার রাজত্ব। তাও আমি জানলাটা খুলে দিলাম। কাউকে কৈফিয়ৎ দেওয়ার প্রশ্ন নেই, কারণ বাড়িতে আর কেউ নেই। এখন আমার হাতে ধরা বিবর্ণ একটি গ্রিটিংস কার্ড। হাতে আঁকা। কুড়ি বছর ধরে এক কবিতার বইয়ে সযত্নে রেখে দেওয়া, প্রেরিকা যার বহুকাল আগে চলে গেছেন পরপারে।

টেবলে মনিটরের স্ক্রিন থেকে ইন্টারনেট ডাকল। কিন্তু না, আজ আমি বহু পুরনো একটি ছবি ঢুকিয়েছি স্মৃতির স্ক্যানার-এ; এখন মনের স্ক্রিন জুড়ে থাকবে সে-ই, যার থাকার কথা।

— শীতকালটা আমার খুব আপন, জানলি অমল। শীতকালে আমার জন্ম, বিয়ে। মণিময়টাও জন্মাল শীতকালেই।
কুড়ি বছর আগের এক শীতের দিন ইন্ডিয়ান ম্যুজিয়মের টানা বারান্দার এক কোণে বসে বলেছিল সে। আমার সহপাঠিনী বান্ধবী মণিকুন্তলা। তখন তার বয়েস চুয়াল্লিশ। আমার? একুশ। আবার বলি? চুয়াল্লিশ আর একুশ ।
— তুই তাহলে চাষীদের মতো, কী বলিস? চাষীরা শীতকালেই ভাল থাকে। ধান কাটা হয়ে যায়, নতুন চাল, নতুন গুড়ের গন্ধ চারিদিকে, মেলা-টেলা বসে।
— দারুণ বলেছিস তো! আমাদের কৃষ্ণনগরের বাড়িতেও সে সব হতো। তোর আন্দাজি ঢিলটা একেবারে জায়গামতন লেগে গেল রে!

অতিসাধারণ কথোপকথন, তবু প্রত্যেকটি শব্দ গেঁথে ছিল মনের ভিতরে কই বুঝতে পারিনি তো! আমি ধীরে ধীরে কার্ডটা খুললাম। ডান দিকে লেখা-জোকা, বাঁ দিক থেকে মণি চেয়ে আছে আমার দিকে। লম্বা গোলাটে দুধসাদা মুখ, রুপোলি চুলের পাতাকাটা নকশায় কবেকার কুন্তলীনের কথা। পুরু চশমার পারে দুই বাঞ্ময় চোখে কৌতুক। ওঃ মণি তুই আজ যদি থাকতিস!

খাঁটি একটা দীর্ঘশ্বাস মিশে গেল হাওয়ায়। কার্ডের ডানপাশের লেখাটি আবার পড়লাম, “অমল, ঘুরে আসার পরে দেখবি তুই অন্য মানুষ হয়ে গেছিস। জিতে যাবি, দেখিস। আমি তো জিতেই চলেছি”।
গেছিলাম রে মণি। আমিও জিতে চলেছি তারপর থেকে। শুধু তোকেই সেটা জানানো হল না।

আমি একঝলক চোখ বোলালাম আমার সাম্রাজ্যের দিকে। কম্প্যুটার, স্ক্যানার, প্রিন্টার, ওয়েবক্যাম, ফ্যাক্স, আরও দুনিয়ার আধুনিকতম গ্যাজেটে ঠাসা আমার কাজের ঘরের দিকে। হ্যাঁ, জিতছি বলেই মনে হচ্ছে প্রতিদিন।

“একটুকরো কার্ড নিয়ে এত ভাবাবেগ তোমাকে মানাচ্ছে না অমল, চলে এসো, অনেক কাজ রয়েছে —” ভ্রূ পল্লবে ডাক দিয়ে মনিটরের পর্দায় বন্দিনী ব্রিটনি স্পিয়ার্স বলে উঠল তখনই।

আমি হাসলাম। আরে আবেগের শিকড় কোথায় কতদূরে যায়, সেটা আমিই বুঝে উঠতে পারলাম না আজও, তো এরা বুঝবে কী করে! মণি আর আমার মধ্যে তেইশ বছরের তফাৎ, তবু তখন বয়েসের ব্যবধান মনে হয়েছিল বায়বীয়। সেতু তৈরি হয় মনে। আর তার যত মালমশলা, ইট-কাঠ-চুন-বালি-সুরকি-লোহা, সে সব যদি ভাল হয় তো সে সেতু থেকে যাবে এক জন্মের মতো।

“এমন ব্যাপার তোমাদের ধারণার বাইরে ব্রিটনি দেবী —”

এই সব বলে-টলে যন্ত্রপুরীর হাতছানি এড়িয়ে আমি আমার অলকাপুরীতে ঢুকলাম। ফি বছর এই দিনটাতে আমি এমনই করি। ঘুমন্ত সে পুরীর ভিতরের ঘরে চারিদিকে শুধু বই আর বই, সোঁদা গন্ধ, আর তাদের মধ্যে মানুষজন সব যেন রেখায়-লেখায় বন্দী হয়ে আছে চিরকালের মতো, একটু হাতের ছোঁওয়া পেলেই যারা জেগে উঠে তৈরি করবে কান্না-হাসির ভরপুর সংসার।

ওই তো কলেজের ক্লাসরুম! সারি সারি বেঞ্চি, মলিন হলুদরঙা ঢাউস ঢাউস সাবেকি ডি.সি. ফ্যানগুলি ঘুরছে মাথার উপরে, আজ কলেজে প্রথমদিন আমার। বি.এস.সি ফার্স্ট ইয়ারের প্রথম ক্নাস এই শুরু হল বলে। ফিজিক্স স্যারও এসে গেছেন, রোলকল চলছে। অচেনা একদঙ্গল ছেলে মেয়ে একে অপরকে চেনা ও চেনানোর তাগিদে ইতিউতি ঘাড় ঘুরিয়ে যাচ্ছি ক্রমাগত।

“রোল থার্টিফোর —” ফিজিক্স স্যার গম্ভীর স্বরে ডাকলেন দ্বিতীয়বার — “মণিকুন্তলা মিত্র —”, তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে কয়েক সেকেণ্ড ক্লাসরুমে পর্যবেক্ষণ।

“ইয়েস স্যার —”।

তেজী অথচ শ্রুতিমধুর উত্তরটা কিন্তু এল ক্লাসের বাইরে থেকে। ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকাতেই চমক আর চমক, উত্তরদাত্রীর বয়েস স্যারের থেকে নিশ্চিতভাবে বেশি! আবারও তিনি বলে উঠলেন, “ ইয়েস স্যার! আয়াম মণিকুন্তলা মিত্র। মে আই কাম ইন স্যার?”

— ক্ক-কাম ইন প্লিজ!

হতচকিত স্যারের মুখ দিয়ে কথাগুলি বেরোতে কয়েক সেকেণ্ড, তার মধ্যেই ভদ্রমহিলা গটগট করে ঢুকে পড়েছেন। দ্বিতীয় সারিতে আমার পাশে জায়গা খালি ছিল, বসে পড়েছেন সেখানেই।

“জ্যামে আটকে গিয়ে…”

এ বারে সোনালি ফ্রেমের পুরু কাচের চশমার পিছনে বড় বড় চোখগুলি আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল মৃদু হেসে।

আলাপ হয়ে গেল সহজেই। রুপোলি একঢাল চুল, লম্বা হাতা লেস-এর ব্লাউজ, সঙ্গে ঠোঁটময় পান আর গান — চুয়াল্লিশ বছরের মণিকুন্তলা আমাদের চোখের মণি হয়ে উঠতে চার দিনও নিলেন না!

আমার অলকাপুরীর লাইব্রেরিতে এখন খুব ব্যস্ততা। প্রচ্ছদের পর প্রচ্ছদ যাওয়া-আসা করছে হাতে, আমি হেসে একটা সিগারেট ধরালাম। এ কী বাদল বাউল বাজে আজি এ শীতের দিনে!

“এই তোরা কেউ আবার আপনি-আজ্ঞে করবি না কিন্তু! একদম সোজাসাপটা ‘মণি’ আর ‘তুই’, ওকে?” দ্বিতীয় দিনেই তার ফরমান জারি হল আমাদের ওপর।একটু ভড়কে গেছি, তখনই তাম্বুল -বিনিন্দিত কণ্ঠস্বর ফের বেজে উঠেছে — “কী-ই যে তোরা স্মার্টনেসের বড়াই করিস!”

আমাদের ভ্যাবলা হওয়া মুখগুলিতে ফিচকে হাসি ছড়িয়ে, মুখের বলিরেখাতে তরঙ্গ তুলে এবার সে ছুঁড়ল ছড়ার বাণ —

“সখা-সখী, তোদের মনের পাতায় থুই
তোদের গোলাপজলে ধুই
প্লিজ, আমায় ডাকিস, ‘তুই’!”

সত্যিই যেন গোলাপজলে ধুয়ে গেল মনের দ্বিধা, বুঝলাম চোখের নজর বড়ই ভুল। মণি তো মনেপ্রাণে আমাদেরই একজন!

টুসকি মেরে ছাই ঝেড়ে এই মুহূর্তে ভাবলাম, ঠিক তখনই বোধহয় ‘ফর্ম’ আর ‘কনটেন্ট’-এর লড়াইয়ে ফর্মকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছিল কনটেন্ট। নয় কেন? যত নতুন-পুরনো হিন্দি-বাংলা গান, সবই ছিল তার স্টকে, মুখে মুখে সে ছড়া কাটত সমকালীন ভাষায়। আধুনিক যত সমস্যা ছিল তারও সমস্যা।

“জীবনের তীব্রতাই সবাইকে জাগিয়ে রাখে রে অমল — বলতে পারিস সংসারের ব্ল্যাক হোল থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে ওটাই হল এসকেপ ভেলোসিটি।” মণিকুন্তলা উবাচ। এমন মানুষকে তুই বলব না তো কাকে বলব?

ইতিমধ্যে কলেজে ঘটে গেছে আর এক ঘটনা। ফার্স্ট ইয়ার আর্টস-এর সুনন্দা সেনগুপ্ত ঠারেঠোরে চাউর করে ফেলেছে যে, আমাকে নাকি তার ভাল লাগে। এ দিকে আমার আবার ব্যাপারটা পছন্দ নয়। এমতাবস্থায় পয়লা এপ্রিলের দিন আমিই এক কাণ্ড বাধালাম। একটি কার্ডে ‘এপ্রিল ফুল’ লিখে খামে ভরে সেটা পাঠালাম সুনন্দার কাছে।
ভাগ্যিস পাঠিয়েছিলাম! নইলে জীবনের কী অমূল্য রতন হারাতাম! মণির সঙ্গে এত ভাব হত না, আর তা না হলে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম ঘটনাটিও ঘটত না।

এপ্রিল ফুলের বার্তাবাহী সেই কার্ড পাঠানোর দিন দুয়েক পরে হঠাৎ কলেজে মণি আমাকে আড়ালে ডেকে বলল, “তোর সঙ্গে খুব দরকারি কথা আছে। আলাদা বসতে হবে। কখন তোর সময় হবে?”
অবাক হলেও পরের দিন ক্লাসের শেষে মণির সঙ্গে গেলাম বেহালায় ওর ডেরায়। এক কামরাওয়ালা ভাড়াবাড়ি, কিন্তু কী অপরূপভাবে সাজানো! চারিদিকে রঙিন কাগজে মোড়া   র‍্যাক,  তাতে থরে থরে বই আর গানের ক্যাসেট।

তখন শেষের বিকেল, মণি আমাকে ঘরে বসিয়ে বলল, “দাঁড়া, চায়ের জলটা চড়িয়ে আসি। তিনকাপ চা হবে।”

“তিনকাপ কেন?”
“বাঃ আরও একজন আসবে যে! দেখ্ না, এখনই এসে পড়ল বলে।”
“কে, আমি কি চিনি তাকে?”
“চিনিস একটু-আধটু।”

মনে কোনও ভাবনা তৈরি হওয়ার আগেই ডোরবেল বেজেছিল আর আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলেই আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম। সুনন্দা! দু’জনেই কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তারপর আমি সরে গিয়ে ওকে ভিতরে আসার জায়গা করে দিয়েছিলাম।

ইতিমধ্যে মণি ঘরে ঢুকেছে, সুনন্দাকে দেখে একগাল হেসে বলে উঠল,

“আয় আয়। দেখ্ কাকে ধরে এনেছি।”
“মণিদি তুমি…” সুনন্দার মুখে প্রশ্নচিহ্ন দেখে বোঝা গেল সে-ও মণির মতলবের বিন্দুবিসর্গ জানে না।
“আরে ঠিক আছে। অমল তো বাঘ-ভাল্লুক কিছু নয়! বোস্ বোস্। আমি চা নিয়ে আসি।”
“মণি আমি যাচ্ছি। আরেকদিন আসব।” আমি বলে উঠলাম।
“বাব্বাঃ তুইও তো দেখছি কম ন্যাকা নোস! আসলে কী জানিস তো, তোরা সব ভিতুর ডিম। কোনও কিছুকে সামনাসামনি ফেস করতে পারিস না। বোস্! আমি চা-টা নিয়ে আসি।

ওর কথার তির্যকতায় পর্যুদস্ত হয়ে বসে পড়েছিলাম। কিন্তু না। প্রেম-ট্রেম কিছু হয়নি শেষ পর্যন্ত। মণি সে জাতীয় কোনও চেষ্টাও করেনি। শুধু তিক্ততাটুকু কাটিয়ে দিয়েছিল আমার আর সুনন্দার মধ্যে।
সে দিন সুনন্দা যাওয়ার পর মণি বলেছিল, “জানিস, প্রেম হলো এক অপূর্ব হাততালি, দুটি হাত লাগে তাতে, আর হাতদুটি যত মানানসই হয় ততই ভালো জমে ব্যাপারটা।”

“তোর জীবনে কি তাই-ই ঘটেছিল?”
“না রে। হাতের মাপে বড়ই গণ্ডগোল ছিল।” বিষণ্ন হেসে উত্তর দিয়েছিল সে, “তবে কি জানিস তো, মানুষে ভুল করে, দোষ করে না। আমিও তাই নিজেকে বা মিস্টার মিত্রকে বা আমাদের বাবা-মায়েদের কোনও দোষ দেব না।”

সেই সন্ধে হয়ে উঠল তার মনের ঝাঁপি-খোলা দিন। অনেক কথাই বলেছিল মণি, বহিরঙ্গে যার কোনও ছায়া আমরা দেখতে পাইনি কখনও। কী ভাবে রান্নাঘরের কোণে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ার বই পড়ত সে, শুধু ভবিষ্যতে পরীক্ষা দেওয়ার আশায়। কোনও কোনও দিন নেশায় আছন্ন স্বামীর এলোপাথাড়ি মার এড়িয়ে অপেক্ষা করতে হত, কখন সে ঘুমিয়ে পড়বে, তারপরে বইখাতা নিয়ে বসা।

“ইশ্!”

আমার খেদোক্তি শুনে সে ছড়া কেটেছিল,

“লাখো যোদ্ধা দিন কাটাচ্ছে শুধুই রান্নাঘরে
সুযোগ পেলে তারাও যাবে সূর্যোদয়ের পারে!”

“কিন্তু তুই ফিজিক্স নিলি কেন?” আমি প্রশ্ন করেছিলাম।
“ভালো লাগে তাই। আমি তো এমনিতেই ফিজিক্স পড়ি, বোসন-ফার্মিয়ন নিয়ে আমার কাজ করার ইচ্ছে আছে রে।”
“কিন্তু এত দেরি করে শুরু করলে..”
“আমার হিসেব অনুযায়ী একদিনও দেরি করিনি। ছেলে-বউ ব্যাঙ্গালোরে রওনা হওয়ার পরের দিন থেকেই লড়ে গেছি। আর দেখ্, ফুরিয়ে যাওয়ার একটা ভয় থাকলে কাজ শেষ করার তাগিদটা বাড়ে। আরে, অখিলবন্ধু ঘোষের ওই গানটা শুনেছিস তো — ফুরিয়ে যাবে ভেবে, এতই ব্যাকুল হই… আরে, ওটার প্রথম লাইনটা হচ্ছে, পিয়ালশাখের ফাঁকে..”

দুর্দমনীয়, অনমনীয় মণিকুন্তলা। কিন্তু এ সবই তো প্রাথমিক পরিচিতি, তার আসল অবদান রয়ে গেছে আমার গভীরে, সেটিই আজ আমার শিকড়।

শ্রমলব্ধ জীবনগল্পের শেষ অধ্যায়ে যে সুঘ্রাণ লুকিয়ে থাকে, তারই একঝলক আমাকে ছেয়ে ফেলল এইমাত্র। এখন চোখের সামনে আরও কিছু মায়াবী মুহূর্ত।

আমি দেখছি, এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় এক তরুণ বিপুল দুঃখভারে নুয়ে পড়ে একটি বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ল। দরজা খুললেন এক প্রৌঢ়া মহিলা, তাঁর দুধসাদা শাড়িটি যেন এক লহমায় হারিয়ে দিল সেই সন্ধ্যার কালিমাকে।

“কী রে, তুই? আয় আয়!”

উজ্জ্বল সেই আহ্বানে তরুণের যেন নিয়তি নির্দ্ধারিত হল তখনই, সে ভিতরে ঢুকল।

তারপর? চোখের জলে ভিজে গিয়েছিল শুকনো ধুলো যত। দারিদ্র্য, হঠাৎ অভিভাবক বিয়োগ, তাড়িয়ে বেড়ানো ভবিষ্যৎ — সেই তরুণের বুকে জমে থাকা নদীটি বইবার জায়গা পেয়ে গেল হঠাৎই।
একসময় সেই বসুন্ধরা কথা বলে উঠলেন।

“তোকে একটা কাজ দেব, ঠিকঠাক করে আসতে পারবি?”

ভঙ্গিটি এমন, যেন নিজেরই কাজ। তরুণ একটু অবাক, তবুও সে শুধোল, “কী কাজ বল্। আমার তো কোনওই কাজ নেই এখন, পারলে নিশ্চয়ই করব।”

“ভেরি গুড। শোন তোকে একটা জায়গায় যেতে হবে। এখান থেকে বেশ দূরে, অন্ধ্রপ্রদেশের বেশ ভিতরের দিকে, বুঝলি। কী রে, না বলবি না তো?”

কপর্দকহীন যুবকটি কী উত্তর দেবে ভেবে পাচ্ছে না, এমন সময়ে মহিলা আবার বলে উঠলেন, “খরচ-খরচা সব আমার। আর শোন, যে কাজটা করার কথা বলছি, সেটা কিন্তু একটু অদ্ভুত। অবশ্য সেই জন্যই তোকে বলা।”

রাহাখরচ আর একটি চলনসই ম্যাপ নিয়ে সেই তরুণ কয়েকদিন পরে পাড়ি দিল অন্ধ্রপ্রদেশে। গন্তব্য ‘সিদ্ধভাতম’ বলে একটি জায়গা। কলকাতা থেকে হায়দরাবাদ, সেখান থেকে কুড়াপা বলে একটি জায়গা, তারপর সেখান থেকে বাসে করে সিদ্ধভাতম।

কিন্তু কাজটা কী ছিল?

পলকের জন্যে বর্তমানে ফিরে এসে মৃদু হাসলাম আমি। বাড়ির ঠিক বাইরে দাঁড়ানো আমার হালফিলে কেনা কালো মাহীন্দ্রা এক্স ইউ ভি গাড়ির চালে ঝরে পড়েছে কয়েকটি বোগনভিলিয়া ফুল; কালোর মাঝে গোলাপি ফুলগুলি কী সুন্দর লাগছে!

সাযুজ্য টেনে তবে বলা যাক, সেদিন সেই তরুণের মাথার উপরের ছাদটি ছিল নিকষ কালো, আর আশার ফুল হয়ে ফুটে উঠেছিল সেই মহিলার দেওয়া কাজটিই।

ভূমিদূরত্ব আর ভাষার ব্যবধান কাটিয়ে সেই তরুণ পৌঁছেছিল সিদ্ধভাতম নামের জায়গাটিতে। এ বারে আসল কাজ। তাকে খুঁজে বার করতে হবে একটি পরিত্যক্ত কেল্লা, যার ভিতরে রয়েছে একটি সাদা পাথরের বেদী। সেই বেদীতে একটি সংস্কৃত স্তবক খোদাই করা আছে, তাকে সেই স্তবকটির পাঠোদ্ধার করতে হবে একটি নির্দিষ্ট সময়ে। অদ্ভুত না অদ্ভুত!

তারপর। লগ্নঃ গোধূলি। সময় আশ্বিনের মাঝামাঝি। পটভূমি নদীপারের সেই কেল্লা। তারই ভিতরে থাকা একটি মার্বল পাথরের বেদীর সামনে এসে দাঁড়াল সেই তরুণ। এখনই শুরু হবে তার ‘কাজ’। শান্ত মনে ওই বেদীটির মুখোমুখি মিনিট দশেক বসে থাকা।

সে অবশ্য জানত না, তার ওই কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে কারা। এইবার তারা একে একে এগিয়ে এল — ঘরে ফেরা পাখির দল, নদীর লাগোয়া ছোট্ট ঝরণার কুলুকুলু গান, দিনপোহানো হাওয়ার সঙ্গে গল্প করতে থাকা প্রবীণ গাছেরা, আর, ক্রমশ মায়াবী হতে থাকা শেষ বিকেলের আলো!

তরুণটি সংস্কৃত জানত। বেদীতে লেখা সেই স্তবকটি এ বার সে পড়ল, একবার, দু’বার, তিনবার, বারবার…। তখন সঙ্গে আনা কাগজকলম তাদের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে, চারপাশ পাখি, ঝরণা, আর হাওয়ার গানে মাখামাখি, সন্ধের কোমলতায় ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে চারপাশ…

খাঁটি রোমাঞ্চের কোনও বয়েস হয় না। নইলে আমার সর্বাঙ্গে এত শিহরণ কেন, ঠিক যেন শরীর জুড়ে ফিরে এসেছে সেই অপূর্ব বিকেলের ভাব। সত্যি। স্বার্থপর, ওপর-চালাকিময় এই ঘোলাটে সময়েও সুন্দর ঠিকই বেঁচে থাকে!

সেই বেদীতে একটিই শ্লোক লেখা ছিল —
।। নাস্তদ্যম সমো বন্ধু
যং কৃত্বা নাব সীদতি।।

অর্থাৎ, উদ্যমের সমান বন্ধু নেই। উদ্যমশীল হলে  কখনওই দুঃখ পেতে হয় না।

তারপরে সেই রাত ছিল শুধুই ভাবনাময়, দিগন্তের আলো দেখার ছটফটানিতে ভরা। এক দুর্মর বেগে তারপর থেকেই পাথরের পর পাথর সরিয়ে আমার যাবার পথ তৈরি করতে লেগেছিলাম — আজও আমি তাতেই ব্যস্ত। পাপ শুধু একটাই, মাঝে মাঝে সেই ধবলদ্যোতিনীকে ভুলে যাই — যে আমাকে বারুদ চিনিয়েছিল, দেশলাই দিয়েছিল হাতে।
যন্ত্রণাও শুধু একটাই। সিদ্ধভাতম থেকে ফিরে আর দেখা হয়নি মণির সঙ্গে। কেন দেখা হয়নি… থাক। আজ মণির জন্মদিন, আজ আমার মহাষ্টমী। এমনিতেই এখন আমার অঞ্জলির পালা।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১১৭৭ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২১/০৬/২০১৬

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast