যাক দূরে যাক
ইচ্ছা ছিল না। নাঃ, চন্দ্রিমার একেবারেই ইচ্ছা ছিল না ট্রেনের জেনারেল কম্পার্টমেন্টে ওঠার। কারণটা শুধু এই নয় যে ট্রেনে ভিড় হতে পারে, আর তাতে তার বুবুনকে নিয়ে যেতে ভারী সমস্যা হবে। বরং তার চেয়েও বড় সমস্যাটা হল এই যে, এই গরমে, ভিড়ের মধ্যে দু মাসের ছেলেটা শান্তিতে টিকতে পারবে না। জুড়বে চিল চীৎকার। তখন বেজায় বিপদে পড়তে হবে চন্দ্রিমা চৌধুরীকে।
কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন নয়। চন্দ্রিমা যেই পৌছেছে প্ল্যাটফর্মে, অমনি ড্রাইভারও মেরে দিয়েছে ভোঁ। লেডিস অব্দি এগোনো দূরস্থ, এখন লাস্ট কম্পার্টমেন্টে কোনরকমে পা রাখতে পারলে হয়। যাই হোক, অবশেষে পা টা রাখা গেল কোনোমতে। যদিও এভাবে ট্রেনে ওঠা এমনিতেই রিস্কি, তার ওপর আবার কোলে বাচ্চা। বাস হলে তাও কণ্ডাক্টর বলে দিত, ‘আস্তে লেডিস, কোলে বাচ্চা’। তবু একটা ঝোঁকের বশেই চন্দ্রিমা উঠে পড়ল। আসলে এই লাইনের ট্রেনও বড় একটা নেই। একটা ছেড়ে দিলে পরেরটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও এক ঘণ্টা।
ট্রেনে উঠে বসার জায়গা নেই। কিন্তু সামনের ছেলেটা উঠে দাঁড়িয়ে ওকে বসার জায়গা করে দিল। তাও আবার জানালার ধারে, হাওয়ার দিকে। উপকারীকে থ্যাঙ্কস জানাতেই সে হেসে বলে উঠল, ‘থ্যাঙ্কস জানাবার কিছুই নেই। আমি দুটো স্টেশন পরেই নাবব’।
চন্দ্রিমা দেখল ছেলেটার বয়স বাইশ কি তেইশ। ছিপছিপে চেহারা। গায়ের রঙ যথেষ্ট কালো। চোখদুটো ছোট হলেও খুব উজ্জ্বল। বেশ আকর্ষণ করে। কপালের ডানপাশে একটা কাটা দাগ। থমকে গেল চন্দ্রিমা। একে কোথাও দেখেছে বলে মনে হল তার। অনেকদিন আগে হয়ত ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। কিন্তু কে এ? মনে আনতেই পারছে না সে। এদিকে গরমের চোটেই হোক কি অন্য কোন কারণে, বুবুন বেশ কান্না জুড়ে দিয়েছে। সে কান্না আর থামেই না। ‘কাঁদে না, কাঁদে না’ বলে কোলে নিয়ে অনেকক্ষণ নাচাল সে। তবু কান্না থামে না। বুকে জড়িয়ে আদর করতে লাগল। তাতেও তার থামবার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। এবার তাকে কোলে রেখে সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। হাওয়া এসে যাতে ওর মুখে লাগে। কিছুতেই কিছু হল না। আশেপাশের লোকজন সব তাকাচ্ছে। এ ও সে নানারকম কমেন্ট করছে, উপদেশের শেষ নেই। কেউ বলছে, গরমে চেঁচাচ্ছে, কেউ বলছে, পেটে ব্যথা হচ্ছে বলে। কেউ বলছে, ওকে দরজার কাছে নিয়ে যান, তো কেউ, কোলে করে ঘোরান।
কিন্তু চন্দ্রিমা জানে আসল কারণটা। বুবুনের খিদে পেয়েছে। সেই সকালে একবার সেরিল্যাক্স, তারপর থেকে আর তাকে একবারও খাওয়ানো হয়নি। কিন্তু এখন সে কি করে দুধ খাওয়াবে? এর থেকে লেডিসে উঠলেই ভাল হত। এতগুলো লোকের মাঝখানে বেশ অস্বস্তি করতে লাগল চন্দ্রিমার। কিন্তু বুবুনেরও কান্না আর থামে না। সামনে বসা লোকটাও কেমন যেন অসভ্যের মত তাকাচ্ছে।
অবশেষে বুকের থেকে আঁচলটা সরিয়েই ফেলল সে। ব্লাউজটাও খুলে ফেলল... বুবুন দুধ খাওয়ার সময় এক্কেবারে চুপ। আস্তে করে শাড়িটা বুকের ওপরে ফেলে দিল চন্দ্রিমা। বুবুনের মুখটাও ঢাকা পরে গেছে তাতে। ইতিমধ্যে সে দেখে সামনের সেই ছেলেটা পেছন ফিরে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে, যাতে সামনের অনেকটা জায়গা ব্লক হয়ে গেছে। যে লোকটাকে দেখে তার অস্বস্তি হচ্ছিল এতক্ষণ, সে তাকে আর সরাসরি দেখতে পাচ্ছে না। তাহলে কি ছেলেটা বুঝেশুনেই এইভাবে দাঁড়াল? একটা হাল্কা কৃতজ্ঞতার অনুভূতি ছুঁয়ে গেল চন্দ্রিমাকে। কিন্তু সে কি-ই বা বলবে ওকে?
ইতিমধ্যে স্টেশন এসে গেল। ছেলেটা ব্যাগটা বাঙ্ক থেকে নামাতে যাবে, চন্দ্রিমা ওকে জিজ্ঞাসা করেই ফেলল – ‘কিছু মনে করবেন না, আপনাকে কোথাও দেখেছি মনে হচ্ছে, আপনি কি...?’
ছেলেটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমার দাদার নাম তন্ময় মণ্ডল’। খানিকক্ষণ থেমে ছেলেটা আবার বলে, ‘জানেন, দাদা এখন মেডিকেলে ভর্তি। তাই দেখতে গিয়েছিলাম’।
চন্দ্রিমা হতবিহ্বল হয়ে জানতে চায়, ‘কি হয়েছে ওর?’
ছেলেটা বলে যায়, ‘ক্যান্সার হয়েছে দাদার। ব্রেন ক্যান্সার’। কথাগুলো বলতে ছেলেটার যে কত কষ্ট হচ্ছে তা চন্দ্রিমার কান এড়ায়নি।
কিন্তু সে আর কিছু বলল না। বা বলা ভাল বলতে চাইল না। কি দরকার পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে? সে মুখ ফিরিয়ে নিল ছেলেটার থেকে। ছেলেটা নেমে যায়।
চন্দ্রিমার মনে তখনও ঘুরছে, তন্ময়...তন্ময়। পরক্ষণেই সে সামলে নেয় নিজেকে। না না। ছি ছি। এসব নাম এখন আর মনে আনতে নেই। সে তো এখন গৌরব চৌধুরীর স্ত্রী। চৌধুরী বাড়ির বৌ। ব্যস আর কিছুর তো দরকার নেই তার। আর কোন অতীত নেই তার। আর কোন প্রয়োজন নেই ওসবে। চন্দ্রিমা আরো গাঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরল বুবুনকে। তার নধর দেহের স্পর্শে কি আরাম! ব্যস, এতেই শান্তি।
কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন নয়। চন্দ্রিমা যেই পৌছেছে প্ল্যাটফর্মে, অমনি ড্রাইভারও মেরে দিয়েছে ভোঁ। লেডিস অব্দি এগোনো দূরস্থ, এখন লাস্ট কম্পার্টমেন্টে কোনরকমে পা রাখতে পারলে হয়। যাই হোক, অবশেষে পা টা রাখা গেল কোনোমতে। যদিও এভাবে ট্রেনে ওঠা এমনিতেই রিস্কি, তার ওপর আবার কোলে বাচ্চা। বাস হলে তাও কণ্ডাক্টর বলে দিত, ‘আস্তে লেডিস, কোলে বাচ্চা’। তবু একটা ঝোঁকের বশেই চন্দ্রিমা উঠে পড়ল। আসলে এই লাইনের ট্রেনও বড় একটা নেই। একটা ছেড়ে দিলে পরেরটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও এক ঘণ্টা।
ট্রেনে উঠে বসার জায়গা নেই। কিন্তু সামনের ছেলেটা উঠে দাঁড়িয়ে ওকে বসার জায়গা করে দিল। তাও আবার জানালার ধারে, হাওয়ার দিকে। উপকারীকে থ্যাঙ্কস জানাতেই সে হেসে বলে উঠল, ‘থ্যাঙ্কস জানাবার কিছুই নেই। আমি দুটো স্টেশন পরেই নাবব’।
চন্দ্রিমা দেখল ছেলেটার বয়স বাইশ কি তেইশ। ছিপছিপে চেহারা। গায়ের রঙ যথেষ্ট কালো। চোখদুটো ছোট হলেও খুব উজ্জ্বল। বেশ আকর্ষণ করে। কপালের ডানপাশে একটা কাটা দাগ। থমকে গেল চন্দ্রিমা। একে কোথাও দেখেছে বলে মনে হল তার। অনেকদিন আগে হয়ত ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। কিন্তু কে এ? মনে আনতেই পারছে না সে। এদিকে গরমের চোটেই হোক কি অন্য কোন কারণে, বুবুন বেশ কান্না জুড়ে দিয়েছে। সে কান্না আর থামেই না। ‘কাঁদে না, কাঁদে না’ বলে কোলে নিয়ে অনেকক্ষণ নাচাল সে। তবু কান্না থামে না। বুকে জড়িয়ে আদর করতে লাগল। তাতেও তার থামবার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। এবার তাকে কোলে রেখে সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। হাওয়া এসে যাতে ওর মুখে লাগে। কিছুতেই কিছু হল না। আশেপাশের লোকজন সব তাকাচ্ছে। এ ও সে নানারকম কমেন্ট করছে, উপদেশের শেষ নেই। কেউ বলছে, গরমে চেঁচাচ্ছে, কেউ বলছে, পেটে ব্যথা হচ্ছে বলে। কেউ বলছে, ওকে দরজার কাছে নিয়ে যান, তো কেউ, কোলে করে ঘোরান।
কিন্তু চন্দ্রিমা জানে আসল কারণটা। বুবুনের খিদে পেয়েছে। সেই সকালে একবার সেরিল্যাক্স, তারপর থেকে আর তাকে একবারও খাওয়ানো হয়নি। কিন্তু এখন সে কি করে দুধ খাওয়াবে? এর থেকে লেডিসে উঠলেই ভাল হত। এতগুলো লোকের মাঝখানে বেশ অস্বস্তি করতে লাগল চন্দ্রিমার। কিন্তু বুবুনেরও কান্না আর থামে না। সামনে বসা লোকটাও কেমন যেন অসভ্যের মত তাকাচ্ছে।
অবশেষে বুকের থেকে আঁচলটা সরিয়েই ফেলল সে। ব্লাউজটাও খুলে ফেলল... বুবুন দুধ খাওয়ার সময় এক্কেবারে চুপ। আস্তে করে শাড়িটা বুকের ওপরে ফেলে দিল চন্দ্রিমা। বুবুনের মুখটাও ঢাকা পরে গেছে তাতে। ইতিমধ্যে সে দেখে সামনের সেই ছেলেটা পেছন ফিরে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে, যাতে সামনের অনেকটা জায়গা ব্লক হয়ে গেছে। যে লোকটাকে দেখে তার অস্বস্তি হচ্ছিল এতক্ষণ, সে তাকে আর সরাসরি দেখতে পাচ্ছে না। তাহলে কি ছেলেটা বুঝেশুনেই এইভাবে দাঁড়াল? একটা হাল্কা কৃতজ্ঞতার অনুভূতি ছুঁয়ে গেল চন্দ্রিমাকে। কিন্তু সে কি-ই বা বলবে ওকে?
ইতিমধ্যে স্টেশন এসে গেল। ছেলেটা ব্যাগটা বাঙ্ক থেকে নামাতে যাবে, চন্দ্রিমা ওকে জিজ্ঞাসা করেই ফেলল – ‘কিছু মনে করবেন না, আপনাকে কোথাও দেখেছি মনে হচ্ছে, আপনি কি...?’
ছেলেটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমার দাদার নাম তন্ময় মণ্ডল’। খানিকক্ষণ থেমে ছেলেটা আবার বলে, ‘জানেন, দাদা এখন মেডিকেলে ভর্তি। তাই দেখতে গিয়েছিলাম’।
চন্দ্রিমা হতবিহ্বল হয়ে জানতে চায়, ‘কি হয়েছে ওর?’
ছেলেটা বলে যায়, ‘ক্যান্সার হয়েছে দাদার। ব্রেন ক্যান্সার’। কথাগুলো বলতে ছেলেটার যে কত কষ্ট হচ্ছে তা চন্দ্রিমার কান এড়ায়নি।
কিন্তু সে আর কিছু বলল না। বা বলা ভাল বলতে চাইল না। কি দরকার পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে? সে মুখ ফিরিয়ে নিল ছেলেটার থেকে। ছেলেটা নেমে যায়।
চন্দ্রিমার মনে তখনও ঘুরছে, তন্ময়...তন্ময়। পরক্ষণেই সে সামলে নেয় নিজেকে। না না। ছি ছি। এসব নাম এখন আর মনে আনতে নেই। সে তো এখন গৌরব চৌধুরীর স্ত্রী। চৌধুরী বাড়ির বৌ। ব্যস আর কিছুর তো দরকার নেই তার। আর কোন অতীত নেই তার। আর কোন প্রয়োজন নেই ওসবে। চন্দ্রিমা আরো গাঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরল বুবুনকে। তার নধর দেহের স্পর্শে কি আরাম! ব্যস, এতেই শান্তি।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
তরীকুল ইসলাম সৈকত ০৫/০৮/২০১৫
-
অ ২৯/০৭/২০১৫সুন্দর লাগল কাহিনীটা ।
-
শান্তনু ব্যানার্জ্জী ০৮/০৭/২০১৫বাহ !! জীবনপথে চলতে চলতে স্মৃতির মণিকোঠার অনেক কিছুই ঝাপসা হয়ে যায়, তবুও এগিয়ে চলতে হয়...ধন্যবাদ আর শুভেচ্ছা।
পারলে আমার "প্রিয়তমা" কবিতাটি একবার পড়ে দেখবেন। বাংলা কবিতায় পোস্ট করা হয়েছে। -
কিশোর কারুণিক ০৫/০৭/২০১৫সত্যিই ভাল
-
অভিষেক মিত্র ০৪/০৭/২০১৫বেশ ভালো।
-
নাসিফ আমের চৌধুরী ০৩/০৭/২০১৫বেশ
-
জহরলাল মজুমদার ০১/০৭/২০১৫বা! দারুণ লিখেছেন
-
মোবারক হোসেন ০১/০৭/২০১৫সুন্দর গল্প।
-
মায়নুল হক ০১/০৭/২০১৫খুব ভালো লাগলো
সেইমুগ্ধতা!!!