ঘটনাটি ১৯৯৭ সালের
ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর ক্লাসের ছেলেদের নাম শুনে খুব নিরাশ হলাম একিরে বাবা রহিম কুদ্দুস এগুলো কেমন নাম।জানিনা কেন অনার্স এর তিন বছর এদের সাথে কোন বন্ধুত্বই গড়ে উঠলোনা আমাদের।স্কুলের বাচ্চাদের মত মেয়েরা এক রোতে আর ছেলেরা আরেক রোতে বসতাম। ক্লাসে অনেকবার ঝগড়াও হয়েছে আমাদের।মাস্টার্সে উঠার পর হঠাৎ একদিন শুনি আমাদের স্টাডি ট্যুর হবে সিলেটে।আমি সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলাম কিন্তু বাগড়া সাধলো আমার কতিপয় বান্ধবীরা। তাদের এক কথা এই ছেলেদের সাথে ট্যুর অসম্ভব। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা যাবোই ট্যুরে কেউ নাগেলে আমি একাই যাবো। অবশেষে একজন একজন করে আমার সব বান্ধবীরাই যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো তবে এর পেছনে আমার ক্লসের ছেলে বন্ধুদের অবদানই সবচেয়ে বেশি বিশেষ করে কায়সার, মতি ,নৌশিন এদের নাম না বললেই না কেননা তারাই সবাইকে রাজি করাতে পেরেছিল। কিন্তু হায় বিধি বাম ট্রুরের দিন সকালে এসে শুনি ট্রুর হবেনা কারন সিলেটের মালনীছড়ার গ্যাসফিল্ডে আগুন লেগেছে। পরে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো ট্রুর অবশ্যই হবে তবে সিলেট নয় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে। যথারীতি আমরা কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম বাসে উঠামাত্র সবার সাথে কিভাবে যেন বন্ধুত্ব হয়েগেল। যে ছেলেদের সাথে তিন বছরে কথাবলাতো দূরে থাক ছায়াও মারাইনি তাদের সাথে একই বাসে সিট ভাগাভাগি করে যাচ্ছি হাসি তামাশা করছি মসকরা করছি দুষ্টামি করছি ভাবাই যায়না।আমাদের ক্লাসে ভীষন দুষ্ট ছেলেগুলো নাম এই ফাঁকে বলে নেই মকসুদ ,মিঠু, অরু,কালাম অন্যতম যারা ট্যুরের প্রতিটা মূহূর্তকে আমাদের জন্য আনন্দদায়ক করেছে। আমাদের সাথে আবার একটা কাপল্ ও ছিল অলকা + মাহমুদ তাদের জন্য একটা রুম আমাদের ছেড়ে দিতে হয়েছে। লাভ বার্ড ছিল মনির + শিউলি এখন তারা বিবাহিত এবং যার যার জায়গায় সুপ্রতিষ্ঠিত। সালমা যার নাম না বললেই নয় সালমার বাবা আমাদের শ্রদ্ধেয় শামসুল হক স্যার কোন অবস্থায় সালমাকে ট্যুরে যেতে দিবেননা আমরা ফ্রেন্তরা অনেক কাকুতি মিনতি করে স্যারকে রাজী করিয়েছিলাম। তখন কি জানতাম সালমার ছোট্র জীবনে এরকম মূহূর্ত আর কখনই ফিরে আসবেনা।সালমা এখন আর আমাদের মধ্যে নেই চলে গেছে আমাদের ছেড়ে পরপারে। এক অদৃশ্য মায়ার বাঁধনে সবাই যেন কেমন জড়িয়ে যাচ্ছিলাম। সারা রাস্তা হি হি হা হা করতে কখন যে চট্রগ্রাম ছাড়িয়ে চকড়িয়ায় চলে এসেছি টেরই পাইনি সম্বিৎ ফিরে পেলাম যখন কেউ একজন বলল আর যাওয়া হবেনা কালভার্ট ভাঙ্গা।আমাদের সাথে ছিলেন জিনাত আরা নাজনীন ম্যাডাম তিনি বললেন গাড়ী ঘুড়াও ঢাকায় ব্যাক করো। আমরা নাছোড় বান্দা কোনো অবস্থায় ঢাকায় ফিরে যেতে রাজি হলাম না। শেষ পর্যন্ত গ্রামের লোকদের সহযোগীতায় কার্লভার্টের উপর তক্তা ফেলে তার উপর দিয়ে যে ছেলেবন্ধুদের সাথে এতদিন কথা পর্যন্ত বলিনাই ঠিক ভাবে তাদের হাত ধরেই পরম নিশ্চিন্তে সেদিন রাতে পিচ্ছিল তক্তার পুল পাড়ি দিয়েছিলাম । লক্ষ্য একটাই যে কোন উপায়ে ট্যুরটাকে সফল করতে হবে। পুলের ওই পারে আমাদের জন্য আরেকটি বাসের ব্যাবস্থা করে রাখা হয়েছিল সেই বাসে করে রাত দশটায় আমরা কক্সবাজার পৌঁছুলাম। নিরিবিলি নামক একঠি হোটেলে উঠলাম তখন বীচের কাছে এত হোটেল ছিলনা। এরপর আমি অসংখ্যবার কক্সবাজার গেছি থ্রি স্টার ফাইভ স্টার হোটেলে থেকেছি কিন্তু এখনো নিরিবিলি হোটিলটাকে দেখলে এক অন্যরকম টান অনুভব করি। হোটেলে পৌছে যার যার মত ফ্রেস হয়ে খেয়ে দেয়ে সবাই যখন ভাবছি সমুদ্র দেখতে যাব ঠিক তখনই ম্যাডাম বললেন সবাই যার যার রুমে যাও রাতে বীচে যাওয়া চলবে না। আমরা মেয়েরা সবাই রুমে চলে গেলাম কিন্তু ছেলেরা স্যার ম্যাডামদের রুমের লাইট বন্ধ হতেই তাদের রুমের তালা এনে স্যার ম্যাডামদের রুমে মেরে সমুদ্র দেখার জন্য বীচে চলে গেল আমরা অবশ্য রাতে কিছুই বুঝতে পারিনি সকালে শুনেছি। সকাল হতেই বীচে চলে গেলাম সমুদ্র যে এত সুন্দর একবার কাছে গেলে বারবারই যে ডাকে তা নিজের চোখে না দেখলে বলে বুঝানো যাবেনা। সারাদিন সমুদ্রের কাছে পিঠে ঘুরে আমাদের সময় চলে গেল। পরদিন আমরা চলে গেলাম টেকনাফ তখন টেকনাফের রাস্তা এখনকার মত এত মসৃন ছিলনা। টেকনাফের বীচে ঘুরলাম এত সুন্দর নীল সমুদ্রসৈকত যতদূর চোখযায় নীল আর নীল এএক অদ্ভুত দৃশ্য। যাওয়ার পথে পাহাড়ের কোল ঘেষে দাঁড়ানো খাড়া পিচ ঢালা রাস্তায় নেমে আমরা বন্ধুরা সমানে ছবিতুললাম নীচে নাফ নদী দূরে মায়ানমার কি অদ্ভুত। যা দেখছি যা করছি সবই ভালো লাগছে কেউ শাসন করার নাই কেউ বকুনি দেবার নেই আছে শুধু বন্ধু বন্ধু আর বন্ধু। টেকনাফ থেকে যত দুই নম্বর জিনিস পত্র কিনে ব্যাগ বোঝাই করে ফেললাম। পরে বাসায় এসে দেখলাম যা কিছু কসমেটিক্স কিনেছি সব নকল। আবার কক্সবাজার ফিরে আসলাম। বীচের দোকান গুলোতে ঘুরতে ভীষণ মজা লাগতো ছেলেরা শর্ট প্যান্ট কিনে সমুদ্রে ঝাপাঝাপি করল কিন্তু আমাদের পা বাঁধা পানিতে নামবোনা এই শর্তেই ট্রুরে আসার পারমিশন পেয়েছিলাম।কেউযে নামেনি তা নয় আমাদের কিছু সাহসী বন্ধু নিপু, সুখি, আদিবা এদের গ্রুপটা নেমেছিল পানিতে এখন ছবিগুলো দেখলে খুব আফসোস লাগে কেনযে নামলাম না। আমাদের আরেক বন্ধু সেলিম তার বাড়ী কক্সবাজারেই সে একরাতে আমাদের সকলকে খাওয়ালো ঝাউবন রেস্তোরায় সুটকী, চান্দা ফ্রাই ইযাম্মি..। আমরা বার্মিস মার্কেট ঘুরে ঘুরে রাতের প্রোগ্রামের জন্য গিফট কিনলাম কারন পরদিনই আমরা ঢাকায় ফিরে আসবো তাই আগের রাতটাকে সবাই মেমোরেবল করে রাখতে চেয়েছিলাম সবাই মিলে ভীষন মজা কললাম এই তিনটি দিন। পরদিন সকালে যখন রওয়ানা হলাম মনে হচ্ছিল আর যদি কখনও না ফিরতে হত কি যেন ফেলে গেলাম এখানে।ট্রুর থেকে ফেরার পর সবাই এত ভলো বন্ধু হয়ে গেলাম এই বন্ধুদের ছাড়া থাকাটাই কেমন কষ্টকর হতে লাগলো সবাই ছবি ওয়াশ করছি আর দেখছি ছবি দেখা যেন আর শেষ হয় না আমাদের সময় ডিজিটাল ক্যামেরা ছিলনা। কত স্মৃতি ট্যুরটা যেমন অনেক বন্ধু তৈরী করে দিয়েছির আবার অনেক কে হারিয়েও ছিলাম। আসল মজা জমে উঠলো ট্যুর থেকে আসার পর সমগ্র মাস্টার্সের স্টুডেন্টরা দুই ব্লগে ভাগ হয়ে গেলাম এক ব্লগ যারা ট্রুরে গিয়েছিল আরেক ব্লগ যারা যায়নি। কয়দিন পর মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলেই সবাই আলাদা হয়ে যাব কে কোথায় চলে যাব ভাবতেই পারছিলাম না এই বিচ্ছেদ চরম বেদনা দায়ক।অবশেষে পরীক্ষা শেষ সবাই যারযার মত আলাদাও হয়ে গেলাম ইউনিভার্সিটি ছেড়ে সবাইকেই চলে যেতে হল কিন্তু সাথে করে নিয়ে গেলাম জীবনের কিছু আনন্দময় ঘটনা কিছু মধুর স্মৃতি। চলবে...
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
পলাশ ০৩/১২/২০১৩ভালো লাগলো ।
-
Md.Shariful Islam Rahid ২০/১১/২০১৩It was a memorable event keeps me in nostalgia. I really miss it.
-
ইসমাত ইয়াসমিন ১০/১১/২০১৩মলি খুব সুন্দর লিখেছ, তোমাদের সাথে কক্সবাজারে যাবারসৌভাগ্য আমার হয়নি। হলের কোন মেয়েই মনে হয় যায়নি আর বাসা থেকে পারমিশন মেলেনি। তবে পরে মজিদ আর অন্যান্য সবার কাছ থেকে গল্প শুনে আফসোস হচ্ছিল। যা হোক শুভকামন তোমার জন্য।
-
সহিদুল হক ১০/১১/২০১৩ছাত্র-জীবনের স্মৃতি সত্যিই ভোলা যায় না।খুব ভাল লাগলো। ভাল থাকবেন। শুভ কামনা।
-
সুমাইয়া বরকতউল্লাহ্ ১০/১১/২০১৩অনেক মজার স্মৃতি। অনেক ভালো লেগেছে।
প্যারা রাখলে আরো সুন্দর হতো আপু। ধন্যবাদ। -
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী. ১০/১১/২০১৩আসলেই ছাত্রজীবনের এই ধরনের আনন্দময় স্মৃতি গুলো মানুষকে নষ্টালজিক করে তোলে। আপনার লেখা পড়তে পড়তে কখন নিজেই যে সেই ছাত্রজীবনে ফিরে গেলাম টেরই পেলাম না। ধন্যবাদ আপা ভালো একটি সুখস্মৃতি উপহার দেওয়ার জন্য।
-
suman ১০/১১/২০১৩খুউব ভালো লেগেছে ...সাবলীল স্বচ্ছন্দ ...