টুসিদিদি
টুসিদিদি
– রেনেসাঁ সাহা
আমার যখন ৫ বছর বয়স; বড়মামি মামাবাড়ির ওখান থেকে একটি মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন আমাদের বাড়িতে, টুকিটাকি কাজের জন্য। রোগা-পাতলা, হালকা শ্যামবর্ণ। মাথার দুদিকে লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা দু’টো বেণুণী। নাম টুসি।
আমি মা-বাবার একমাত্র মেয়ে। বাবা ইউনিভার্সিটির লেকচারার; মা’ও। বাড়িতে আগে আমাকে দেখে রাখতেন ইন্দিরাদিদা। উনি রান্নাবাড়িও সামলাতেন। বাইরের কাজ করতেন মিনুমাসি। যেমন, কাপড় ধোওয়া, বাসন মাজা, ঘড় ঝাড় দেওয়া। টুসি অনেক পড়ে আসে বাড়িতে , মূলত আমাকে দেখে রাখার জন্য। ওর বয়স তখন ৬-৭ হবে।
বাবা বলতেন মা’কে; আমি শুনতাম – “এইটুকু বয়সের মেয়ে; ক’টা পয়সার জন্য মানুষের বাড়ি থাকছে! আর আমরা কত আরামবাদী, কত বিলাসী জনগণ!” মা বলতেন –“এটাই সমাজ। তোমার কাছে এর কোনো সলিউশন আছে?এভাবেই চলবে। নাহলে তো ওরা না খেতে পেয়ে মরবে। ”
টুসি বা টুসিদের মত অনেকের অর্থনৈতিক দুরবস্থা দূর করার মত পরিস্থিতি, অর্থ, উপায় এবং স্বীকার করি, ইচ্ছেও আমাদের কোনদিনই ছিল না। সেসব দিকে তাই না যাওয়াটাই শ্রেয়। আমরা গল্পেই আসি। অল্প কিছু দিনের মাঝেই টুসিদিদি আমার খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিল। কুল চুরি করতাম পাশের বাড়ির গাছ থেকে। বাড়িতে অভিযোগ আসত টুসির নামে; আমার সাতখুন মাফ। আমরা রান্নাঘরের মিটশেফ থেকে একসাথে আচার চুরি করতাম। দু’জনে ধরা পড়লে ইন্দিরাদিদা আর মিনুমাসি টুসিদিদিকে বকা দিত, গাল পাড়ত। আমার দোষ দোষই নয়। আমি কিন্তু টুসিদিদিকে খুবই ভালোবাসতাম। যাকে বলে টুসিদিদ বলতে অজ্ঞান। ও না হলে কে আমায় রোজ অসময়ে কাঁচা আম মেখে দেবে? কে নিজে ঝুঁকি নিয়ে আচারের বাটি কিচেন থেকে সরিয়ে অর্ধেক আচার আমাকে খাওয়াবে? কে আমায় রাস্তা পেরিয়ে বেড়াতে নিয়ে যাবে? মিনুমাসি, ইন্দিরাদিদি ওকে যতই বকুক;টুসিদিদি ওদের চেয়ে আমার অনেক প্রিয় ছিল। ওঁদের তো খালি এই কোরো না, ঐ কোরো না। আর টুসিদিদি আমাকে সঙ্গে নিয়েই এই-ঐ সব করত। সন্ধ্যেবেলায় মা ফিরলে ওর নামে নালিশ যেত মা’র কাছে। মা ওকে বকে দিতেন । টুসিদি হাসত খালি বকা খেতে খেতে। কি সরল, নিষ্পাপ, ঝকঝকে হাসিটা। ওকে আমি বিকেল করে পড়াশোনা শেখাতাম।
তবে সব হ্যাপি হ্যাপি স্টোরিরই একটা এন্ডিং থাকে। সেদিন আমি স্কুল থেকে এসেই বায়না ধরলাম; আমাকে রাস্তার ওপারে ঢিপি করে রাখা পাঠরগুলোর মধ্য থেকে চকচকে-ঝকঝকে সাদা কিছু পাথর এনে দিতে হবে। দিতে হবে তো দিতেই হবে। প্যানপেনে গলায় সে কী কান্না আমার। শেষে টুসিদিদি রাজি হল। আমাকে রাস্তার এপারে রেখে ওপারে গেল পাথর নিয়ে আসতে। হঠাত আমার কী মনে হল, আমিও ওপারে যাব, ইচ্ছে হল। রাস্তা পার হওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। একটা ট্রাক এসে আমাকে প্রায় পিশেই দিচ্ছিল। অল্পের জন্য বাঁচলাম। এমন সময় দেখি মা’ও রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে, টুসিদির দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয়। ট্রাকের ড্রাইভারকাকু নেমে মাকে কথা শোনালেন। একটা বাচ্চাকে আরেকটা বাচ্চার দায়িত্বে কীভাবে কেউ ছেড়ে দেয় এসব। পাথর কুড়োনো মাথায় উঠলো। রাতে বাবার সাথে আলাপ করলেন মা অনেকক্ষণ মা এসব নিয়ে। পরদিন টুসিদিদির ব্যাগ গুছিয়ে দিলেন মা! টুসিদিদি যাবে না; মা-বাবার পা ধরে কাঁদল। আর আমি টুসিদিদি বলে দৌড়ে যেতেই, মিনুমাসি জোর করে আমাকে শক্ত করে ধরল। আমিও শরীরের শক্তি দিয়ে মিনুমাসির চোখে-মুখে খামচে দিলাম। তবু ছাড়ে না। অবশেষে কামড়ালামও। এবার বাবা-মা’ও এসে আমাকে ধরে-বেঁধে ঘরে বন্দি করলেন। টুসিদিদি চলে গেল ওর বাবার সাথে আটকাতে পারলাম না। তবে, ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠলাম শোক। চোখের পাতা শুকনো হয়ে এলো খুব তাড়াতাড়ি।
এখন আমার ২৪ বছর বয়স। চাকরি পেয়েছি সদ্য। মামাবাড়ি ঘুরতে এসেছি। বাজারের এক দোকান থেকে মামাতো বোনকে অনেকগুলি চকোলেট কিনে দিলাম। টাকা মিটিয়ে ফিরছি। বোনটি বলল- “দিদি, ঐ মেয়েটা চকোলেট চাইল, তাই দুটো দিয়েছি। ” আমি অবাক হলাম; কিছুটা রাগও হলাম। যাকে তাকে চকোলেট বিলোচ্ছে। একটু এগোলাম সামনে। হঠাৎ পিছন থেকে খুব পরিচিত কন্ঠস্বর– “কিরে রিমি, ওকে আবার চকোলেট কিনে দিতে গেলি কেন?”মুখ ফেরালাম। ওপাশে সেই পরিচিত হাসি। এতদিন পরেও আমার চিনতে একটুও অসুবিধে হল না; এতো
টুসিদিদি। অনেক কথা হল। বলল ও এখন বাপের বাড়িতেই থাকে। স্বামী অন্য মেয়েমানুষের সাথে থাকে। বলল- “এ আমার মেয়ে; ওকে লেখাপড়া শেখাতে ইস্কুলে দিয়েছি। ” মেয়েটির হাতে আমার মামাতো বোনের দেওয়া চকলেট। টুসিদিদি হাসতে হাসতে বলল- “মনে আছে তোর; আমাকে লেখাপড়া শেখাবি বলে জেদ করেছিলি?” কি সরল, নিষ্পাপ, ঝকঝকে সেই হাসিটা! আমি হাসছিলাম না। শুধু ভাবছিলাম – কীভাবে আমাদের সেইসব বন্ধুত্বের দিন, সেইসব আচার চুরির,একসাথে আমমাখা খাওয়ার, পাথর কুড়োনোর দিন আজ শুধুই একটা হাসির, একটা স্মৃতিচারণার দিনে পর্যবেসিত হয়েছে। আমি টুসিদিদির মেয়ের মাথায় হাত রাখলাম। টুসিদিদিকে বললাম -“ওকে পড়িয়ো অনেকদূর।”
– রেনেসাঁ সাহা
আমার যখন ৫ বছর বয়স; বড়মামি মামাবাড়ির ওখান থেকে একটি মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন আমাদের বাড়িতে, টুকিটাকি কাজের জন্য। রোগা-পাতলা, হালকা শ্যামবর্ণ। মাথার দুদিকে লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা দু’টো বেণুণী। নাম টুসি।
আমি মা-বাবার একমাত্র মেয়ে। বাবা ইউনিভার্সিটির লেকচারার; মা’ও। বাড়িতে আগে আমাকে দেখে রাখতেন ইন্দিরাদিদা। উনি রান্নাবাড়িও সামলাতেন। বাইরের কাজ করতেন মিনুমাসি। যেমন, কাপড় ধোওয়া, বাসন মাজা, ঘড় ঝাড় দেওয়া। টুসি অনেক পড়ে আসে বাড়িতে , মূলত আমাকে দেখে রাখার জন্য। ওর বয়স তখন ৬-৭ হবে।
বাবা বলতেন মা’কে; আমি শুনতাম – “এইটুকু বয়সের মেয়ে; ক’টা পয়সার জন্য মানুষের বাড়ি থাকছে! আর আমরা কত আরামবাদী, কত বিলাসী জনগণ!” মা বলতেন –“এটাই সমাজ। তোমার কাছে এর কোনো সলিউশন আছে?এভাবেই চলবে। নাহলে তো ওরা না খেতে পেয়ে মরবে। ”
টুসি বা টুসিদের মত অনেকের অর্থনৈতিক দুরবস্থা দূর করার মত পরিস্থিতি, অর্থ, উপায় এবং স্বীকার করি, ইচ্ছেও আমাদের কোনদিনই ছিল না। সেসব দিকে তাই না যাওয়াটাই শ্রেয়। আমরা গল্পেই আসি। অল্প কিছু দিনের মাঝেই টুসিদিদি আমার খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিল। কুল চুরি করতাম পাশের বাড়ির গাছ থেকে। বাড়িতে অভিযোগ আসত টুসির নামে; আমার সাতখুন মাফ। আমরা রান্নাঘরের মিটশেফ থেকে একসাথে আচার চুরি করতাম। দু’জনে ধরা পড়লে ইন্দিরাদিদা আর মিনুমাসি টুসিদিদিকে বকা দিত, গাল পাড়ত। আমার দোষ দোষই নয়। আমি কিন্তু টুসিদিদিকে খুবই ভালোবাসতাম। যাকে বলে টুসিদিদ বলতে অজ্ঞান। ও না হলে কে আমায় রোজ অসময়ে কাঁচা আম মেখে দেবে? কে নিজে ঝুঁকি নিয়ে আচারের বাটি কিচেন থেকে সরিয়ে অর্ধেক আচার আমাকে খাওয়াবে? কে আমায় রাস্তা পেরিয়ে বেড়াতে নিয়ে যাবে? মিনুমাসি, ইন্দিরাদিদি ওকে যতই বকুক;টুসিদিদি ওদের চেয়ে আমার অনেক প্রিয় ছিল। ওঁদের তো খালি এই কোরো না, ঐ কোরো না। আর টুসিদিদি আমাকে সঙ্গে নিয়েই এই-ঐ সব করত। সন্ধ্যেবেলায় মা ফিরলে ওর নামে নালিশ যেত মা’র কাছে। মা ওকে বকে দিতেন । টুসিদি হাসত খালি বকা খেতে খেতে। কি সরল, নিষ্পাপ, ঝকঝকে হাসিটা। ওকে আমি বিকেল করে পড়াশোনা শেখাতাম।
তবে সব হ্যাপি হ্যাপি স্টোরিরই একটা এন্ডিং থাকে। সেদিন আমি স্কুল থেকে এসেই বায়না ধরলাম; আমাকে রাস্তার ওপারে ঢিপি করে রাখা পাঠরগুলোর মধ্য থেকে চকচকে-ঝকঝকে সাদা কিছু পাথর এনে দিতে হবে। দিতে হবে তো দিতেই হবে। প্যানপেনে গলায় সে কী কান্না আমার। শেষে টুসিদিদি রাজি হল। আমাকে রাস্তার এপারে রেখে ওপারে গেল পাথর নিয়ে আসতে। হঠাত আমার কী মনে হল, আমিও ওপারে যাব, ইচ্ছে হল। রাস্তা পার হওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। একটা ট্রাক এসে আমাকে প্রায় পিশেই দিচ্ছিল। অল্পের জন্য বাঁচলাম। এমন সময় দেখি মা’ও রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে, টুসিদির দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয়। ট্রাকের ড্রাইভারকাকু নেমে মাকে কথা শোনালেন। একটা বাচ্চাকে আরেকটা বাচ্চার দায়িত্বে কীভাবে কেউ ছেড়ে দেয় এসব। পাথর কুড়োনো মাথায় উঠলো। রাতে বাবার সাথে আলাপ করলেন মা অনেকক্ষণ মা এসব নিয়ে। পরদিন টুসিদিদির ব্যাগ গুছিয়ে দিলেন মা! টুসিদিদি যাবে না; মা-বাবার পা ধরে কাঁদল। আর আমি টুসিদিদি বলে দৌড়ে যেতেই, মিনুমাসি জোর করে আমাকে শক্ত করে ধরল। আমিও শরীরের শক্তি দিয়ে মিনুমাসির চোখে-মুখে খামচে দিলাম। তবু ছাড়ে না। অবশেষে কামড়ালামও। এবার বাবা-মা’ও এসে আমাকে ধরে-বেঁধে ঘরে বন্দি করলেন। টুসিদিদি চলে গেল ওর বাবার সাথে আটকাতে পারলাম না। তবে, ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠলাম শোক। চোখের পাতা শুকনো হয়ে এলো খুব তাড়াতাড়ি।
এখন আমার ২৪ বছর বয়স। চাকরি পেয়েছি সদ্য। মামাবাড়ি ঘুরতে এসেছি। বাজারের এক দোকান থেকে মামাতো বোনকে অনেকগুলি চকোলেট কিনে দিলাম। টাকা মিটিয়ে ফিরছি। বোনটি বলল- “দিদি, ঐ মেয়েটা চকোলেট চাইল, তাই দুটো দিয়েছি। ” আমি অবাক হলাম; কিছুটা রাগও হলাম। যাকে তাকে চকোলেট বিলোচ্ছে। একটু এগোলাম সামনে। হঠাৎ পিছন থেকে খুব পরিচিত কন্ঠস্বর– “কিরে রিমি, ওকে আবার চকোলেট কিনে দিতে গেলি কেন?”মুখ ফেরালাম। ওপাশে সেই পরিচিত হাসি। এতদিন পরেও আমার চিনতে একটুও অসুবিধে হল না; এতো
টুসিদিদি। অনেক কথা হল। বলল ও এখন বাপের বাড়িতেই থাকে। স্বামী অন্য মেয়েমানুষের সাথে থাকে। বলল- “এ আমার মেয়ে; ওকে লেখাপড়া শেখাতে ইস্কুলে দিয়েছি। ” মেয়েটির হাতে আমার মামাতো বোনের দেওয়া চকলেট। টুসিদিদি হাসতে হাসতে বলল- “মনে আছে তোর; আমাকে লেখাপড়া শেখাবি বলে জেদ করেছিলি?” কি সরল, নিষ্পাপ, ঝকঝকে সেই হাসিটা! আমি হাসছিলাম না। শুধু ভাবছিলাম – কীভাবে আমাদের সেইসব বন্ধুত্বের দিন, সেইসব আচার চুরির,একসাথে আমমাখা খাওয়ার, পাথর কুড়োনোর দিন আজ শুধুই একটা হাসির, একটা স্মৃতিচারণার দিনে পর্যবেসিত হয়েছে। আমি টুসিদিদির মেয়ের মাথায় হাত রাখলাম। টুসিদিদিকে বললাম -“ওকে পড়িয়ো অনেকদূর।”
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
ফয়জুল মহী ১৭/০৪/২০১৬পরিপক্ব লেখা
-
শুভাশিষ আচার্য ২৫/১০/২০১৫বেশ লাগল।
-
তরীকুল ইসলাম সৈকত ২০/১০/২০১৫অনেক ভালো লাগল
-
মোবারক হোসেন ১৮/১০/২০১৫বরাবরের মত সুন্দর লেখা।তবে পরগাছা আজরও
মনে দুলা দেয়।ধন্যবাদ লেকককে। -
শান্তনু ব্যানার্জ্জী ১৭/১০/২০১৫বাহ !! খুব সুন্দর । অনেকটা আমার নিজের ছেলেবেলায় ফিরে গিয়েছিলাম। আমারও অনেকটা এরকম অভিজ্ঞতা আছে।
-
আহমাদ আবদুল কাইয়ুম ১৬/১০/২০১৫দামি কথা
-
নাসিফ আমের চৌধুরী ১৬/১০/২০১৫ভাল লাগল
-
তপন দাস ১৫/১০/২০১৫খুব ভালো লাগলো গল্পটা। তবে আমার মতে ফ্লাশ ব্যাকে হলে হয়তো আরো ভালো লাগতো।
আরো চাই। -
অভিষেক মিত্র ১৫/১০/২০১৫মন ছুয়ে গেল ছোট্ট গল্পটা।