পাই
সাইরা কিউস
যীশুখ্রিস্টের জন্মের প্রায় আড়াইশো বছর আগের কথা। গ্রীস দেশের সিসিলি দ্বীপে একটা ছোট্ট শহর সাইরা কিউস। সাইরা কিউসের পশ্চিম প্রান্তে সবুজ গাছ গাছালি দিয়ে ঘেরা বাড়িটার প্রায়ান্ধকার একটা ঘরে মোমবাতির আলোর সামনে বসে আছেন এক বৃদ্ধ। গভীর চিন্তায় মগ্ন। টেবিলের প্রান্তে সাদা চিনেমাটির পাত্রে রাখা হালকা লাল রঙের পানীয়। একটা হাত মাথার সাদা চুলগুলো নাড়াচাড়া করছে। আর একটা হাতে কাঠকয়লার পেন্সিল। কাঠের টেবিলের ওপর মোটা একটা কাগজে বৃদ্ধ একের পর এক জ্যামিতিক আকার এঁকে চলেছেন আর তার পাশে পাশে রোমান অক্ষরে কিছু লেখা ,কিছু সংখ্যা। একটা বড়ো বৃত্ত আঁকা ঠিক মাঝখানে , আরো কিছু ছোট ছোট বৃত্ত। মাঝে মাঝে পেন্সিলটা রেখে ডানহাতের তর্জনী বৃত্তগুলোর ওপর পরম আদরে বোলাচ্ছেন আর বিড় বিড় করে কিছু বলছেন।
রাত বেড়ে চলে। বৃদ্ধের ছটফটানি তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। গায়ের চাদরটা ছুঁড়ে দিলেন ঘরের কোণে। টেবিলের ওপর রাখা পানপাত্রটা মেঝেয় পড়ে গিয়ে লাল রঙের তরল ছিটকে পড়লো চারিদিকে। ওনার কিন্তু কোনো হুঁশ নেই। মেঝের ওপর কালো রঙের একটা বৃত্ত এঁকে তার পরিধি বরাবর হাঁটতে লাগলেন। বৃত্তের কেন্দ্রে এক অদৃশ্য মানুষ যেন বসে আছেন। তাকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে বলছেন ................." diámetro tou kýklou ! diámetro !! diámetro !! diámetro !! "
লেবুতলা
আমি ইসাবেলা রায়। ইতিহাসের ছাত্রী, আর আমার আগ্রহের বিষয় এই বাংলার প্রায় ভুলে যাওয়া নগর সভ্যতা - যা গড়ে উঠেছিল বিদ্যাধরী নদীর কিনারায়। অনেকদিন ধরে যাবো যাবো করেও যাওয়া হচ্ছিলো না। শেষমেশ একদিন বেরিয়ে পড়লাম , একাই।
বাড়ি থেকে ট্যাক্সি করে শিয়ালদা। শিয়ালদা থেকে হাসনাবাদ লোকাল ট্রেন ধরে মিনিট চল্লিশের মধ্যেই ছোট্ট একটা রেল স্টেশন লেবুতলা। এখন দুপুর প্রায় তিনটে। দু চারজন যাত্রী নেমে পায়ে হেঁটে স্টেশন চত্তর থেকে বেরিয়ে যেতেই স্টেশনটা একদম ফাঁকা। আশেপাশে লোকজনও কম , কেমন যেন ঘুমন্ত জায়গাটা। স্টেশন থেকে বেরিয়ে রাস্তাটা পুবমুখী। রাস্তার ধারে চায়ের দোকান , কয়েকজন বসে আছেন। পরনে লুঙ্গি , খালি গা। জিজ্ঞেস করি , " আচ্ছা , দেগঙ্গা শহরটা কোন দিকে ?"
বেঞ্চের ওপর বসা মাঝের ভদ্রলোক বিড়ি ধরিয়ে , ভাঁড়ের চায়ে চুমুক দিয়ে হাতটা সোজা দেখিয়ে দিলেন কোনো কথা না বলে। জিন্স টি শার্ট পরা মহিলা দেখে একটু যেন সন্দিগ্ধ।
" কত দূর এখান থেকে ?", আবার জিজ্ঞেস করি।
পাশের বেঁটে মতো ছেলেটি জবাব দেয় ," দু তিন মাইল হবে। যাবেন কোথায় ?"
একটু থেমে বলি , " ওই দেগঙ্গা শহরের কাছেই। "
ছেলেটি বললো ," ওই তো , চলে যান সোজা। তারপর নিবারণের চালের আড়ৎ থেকে বাঁ দিকের রাস্তা দিয়ে বড়োজোর দশ মিনিট। "
কাছাকাছি কোনো রিক্সা বা কোনো যানবাহন চোখে পড়ছে না। অগত্যা হাঁটা লাগলাম পূর্বদিকের রাস্তা ধরে। দোকান বাড়িগুলো শেষ হতেই রাস্তার দুপাশে ধানক্ষেত , পুকুর। বড়ো মনোরম দৃশ্য। মাথার ওপর সূয্যিদেব ততক্ষনে বেশ তেজিয়ান। ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে হালকা বাতাসের ঢেউ , শিরশির শব্দ। কোকিলের ডাক। হঠাৎ হঠাৎ মালপত্র নিয়ে প্রকৃতির নীরবতা ভাঙিয়ে ছুটে যায় ভ্যান রিক্সা।
আমার ভাবনা নিমেষে হাজার হাজার বছরের পার। কেমন ছিল এই অঞ্চল আড়াই হাজার বছর আগে ? ঘন জঙ্গল ? বন্য জন্তুদের আসা যাওয়ার পথ হয়তো ঠিক এখান দিয়েই। কেমন ছিল মানুষ জন ? তাদের পোশাক আশাক , ভাষা ? কি কাজ করতো তারা ? আর কোথায় গেলো সেই নদী ? যার তীরে এসে ভিড়তো পালতোলা বিশাল আকারের জাহাজ ? রাজপ্রাসাদ কোথায় ছিল ? রাজা ,রানী ,রাজকুমারী আর রাজকুমার ....কেমন ছিল তারা ?
" কোথায় যাবেন ম্যাডাম ?" হঠাৎ যেন মাটি ফুঁড়ে উঠে এলো লোকটি।
বয়েস বছর তিরিশেক হবে। মাথার চুল বাদামি , অনেকটা লম্বা। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা। পেশীবহুল কঠিন শরীর , কিন্তু মনে ভয় ধরায় না। কেমন যেন নরম চোখের দৃষ্টি। পরনে পাঠানদের মতো কালো রঙের পোশাক , গলায় রংবেরঙের পুঁতির মালা। একটা কানে তামার তৈরী দুল। বাঁ হাতের কব্জির ঠিক ওপরে একটা অদ্ভুত আকারের উল্কি আঁকা গাঢ় বেগুনি রঙের কালি দিয়ে। পায়ে বিবর্ণ চামড়ার জুতো। মনে হোলো , প্রাচীন ইতিহাসের পাতা থেকে এক চরিত্র হঠাৎ আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। হতে পারে অদ্ভুত দর্শন , কিন্তু আমার কোনো ভয় করছে না।
"বলছি , যাবেন কোথায় ? ", যুবক আবার প্রশ্ন করে।
" মানে .....এই কাছেই। " আমি যুবককে খোলসা করিনা। কেনই বা বলতে যাবো এক সম্পূর্ণ অপরিচিতকে ?
যুবক একটু দূরত্ব রেখে আমার পাশে পাশেই হাঁটতে থাকে।
আমার কি এবার ভয় পাওয়া উচিত ? অপরিচিত জায়গায় মহিলাদের বিপদ অনেক। পরিচিত জায়গাতেই কত কিছু ঘটে যায় ! একটু জোরে পা চালাই।
"ম্যাডাম কি ভয় পাচ্ছেন আমাকে ?", যুবক ঠিক আমার ডান দিকের কাঁধের পাশ থেকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয়।
" ন ...ন .. না তো , ভয় পাবো কেন ?" আমি একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলি, "আমার একটু তাড়া আছে। "
"হ্যাঁ , তো চলুন না আমি পৌঁছে দিচ্ছি। আমার রাজশাহী ঘোড়াগাড়ি আছে। এ তল্লাটে একমাত্র আমার কাছেই আছে ম্যাডাম। "
"না , না , লাগবে না। এই তো কাছেই। আমি হেঁটেই যাবো। "
"ম্যাডাম , এখনো পাঁচ কিলোমিটার। আমি জানি আপনি কোথায় যাবেন। "
আমি চমকে উঠে বোকার মতো বলি , "কোথায় ?"
"বেড়াচাঁপা "
বেড়াচাঁপা
ঘোড়াদুটো গাঢ় তামাটে রঙের , বেশ তেজি। গাড়িটা ভিক্টোরীয় যুগের ব্রউঘাম ক্যারেজ ধরণের। দেখেই বোঝা যায় বহু পুরোনো কিন্তু ঘষামাজা করে পরিষ্কার এবং পরিচ্ছন্ন রাখা হয়েছে। বাইরেটা কালো রং করা। ভেতরে বসার একটা সিট , কাঠের ওপরে চামড়ার গদি মোড়া। ক্যারেজের জোড়গুলো পেতলের কারুকাজ করা কব্জা দিয়ে তৈরী। গাড়ির নাম "রাজশাহী ", গাড়ির চালক সেই অদ্ভুত দর্শন যুবক। নাম জিজ্ঞেস করতে বললো " ম্যাডাম , আমার নাম ধূমকেতু। কেতু বলে ডাকবেন। "
যেমন অদ্ভুত দেখতে , তেমনই অদ্ভুত নাম। ধূমকেতুর কণ্ঠস্বর অস্বাভাবিক রকমের ভারী , যেন কোন অতীতের গর্ভ থেকে উঠে আসছে। ভাষার বাঁধুনি বেশ পরিণত গাইডের মতো।
ঢিমে তালে চলছে ঘোড়ার গাড়ি। আশেপাশের লোকজন বোধহয় দেখে অভ্যস্ত , তাই কেউ ঠিক লক্ষ্য করছেনা। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এই ঘোড়াগাড়ি , ওই যুবক, এই নরম সূর্যের আলোয় মাখা কালো পিচের রাস্তা , দুধারের ধানক্ষেত ....সবই কেমন যেন বেমানান , বাকি সবকিছুর সঙ্গে মিলছেনা, মিলছেনা।
মিলছেনা, কিন্তু আমি চলেছি রাজশাহীতে সওয়ার হয়ে । কাচের খোলা জানলা দিয়ে সুগদ্ধি ধানের সুবাসযুক্ত বাতাস আমার চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে।
গাড়ি দেগঙ্গা শহর ছাড়িয়ে ডান দিকে টাকি রোড ধরে চলছে এখন। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আর কতক্ষণ ? সন্ধে নামতে আর বেশি দেরি নেই। অন্ধকারে তো কিছুই দেখা যাবে না। জায়গাটা দেখে আজই সন্ধেবেলার ট্রেন ধরে বাড়ি ফেরার কথা।
" ম্যাডাম, আপনি যা দেখতে এসেছেন আমি আপনাকে ঘুরিয়ে দেখাবো। অনেকগুলো গ্রামের অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, সময় লাগবে।আমরা যাবো শানপুকুর , দেবালয় , হাদীপুর , বেড়াচাঁপা , ইটখোলা ........ আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে এখানে ছিল এক বিশাল সাম্রাজ্য, চন্দ্রকেতুগড়। মহারাজ চন্দ্রকেতু সেই সাম্রাজ্যের অধীশ্বর। ওনার মতো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শাসক বাংলার ইতিহাসে কখনো আসেনি , আসবেও না। কয়েক মাইল দীর্ঘ মূল দুর্গের প্রাচীর। প্রবেশপথে ছিল বিশাল তোরণ ....এখান থেকেই শুরু হয়েছে দুর্গের প্রাচীর। দেখুন পোড়ামাটির ইঁটের চওড়া শক্ত গাঁথনি। "
"আর কতক্ষণ লাগবে ?" আমি একটু অসহিষ্ণু। গলাটা কি একটু রুক্ষ শোনালো ? কে জানে !
"এসেই গেছি ম্যাডাম। আমরা মহারাজ চন্দ্রকেতুর দুর্গে প্রবেশ করছি। বলুন, জয় মহারাজ চন্দ্রকেতুর জয় !"
এ তো পাগল মনে হচ্ছে। পোড়া মাটির ইঁট দিয়ে তৈরী কিছু ঢিবি ছাড়া তো কিছুই দেখছি না।
"এটা খনা-মিহিরের ঢিবি। যদিও এই ঢিবি তৈরী হয়েছিল অনেকটা পরে, তখন মহারাজ বিক্রমাদিত্যের শাসন চলছে বাংলায়। ম্যাডাম, খনা এই বাংলার বিস্ময়কর প্রতিভা। অঙ্ক শাস্ত্রে এমন পারদর্শিনী মহিলা গোটা পৃথিবীতে বিরল। মিহিরের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল কিন্তু বড়ো দুঃখের সেই কাহিনী। আবার যদি কখনো আসেন , বলবো সেই কথা। " , যুবক তার বিক্ষিপ্ত তামাটে রঙের চুলগুলো হাতের আঙুল দিয়ে বাগে আনার চেষ্টা করতে করতে বললো।
খনার কথা শুনেছি বটে ,কিন্তু বিশেষ কিছুই জানিনা বলে একটু লজ্জাও লাগলো। এই অদ্ভুত দর্শন যুবক ধূমকেতু ক্রমশই আমাকে অবাক করছে। বুকের ভেতরে কি একটা যেন ড্রাম বাজছে , ভয় আর আনন্দ দুটোই মিলেমিশে। দ্রুত অন্ধকার হয়ে আসছে , আমাকে ফিরতে হবে। সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় ততোধিক অচেনা এক যুবকের ঘোড়াগাড়িতে আমি চলেছি প্রাগৈতিহাসিক এক শহরের আবিষ্কারে। এটা কি সত্যিই ঘটছে ?
চন্দ্রকেতুগড়
কিছুক্ষন আগেই সূর্য অস্ত গেছে দূরের হলুদ সর্ষে ক্ষেতের ওপর শেষ আভাটুকু ছড়িয়ে দিয়ে। আমরা এসে দাঁড়িয়েছি এক বিশাল মন্দির চত্বরে। রাজশাহী থেকে নেমে দাঁড়ালাম। আশেপাশের অনেকটা অংশ জুড়ে বড়ো বড়ো গাছ। উত্তর-পূর্ব দিকের আকাশে ঘন গাছের ফাঁক দিয়ে হঠাৎ চেয়ে দেখি রুপোলি আলোয় ভাসিয়ে চাঁদ উঠেছে। আজ কি পূর্ণিমা ? জায়গাটা প্রায় একশো ফুট লম্বায় আর প্রায় আশি ফুট চওড়ায়। মূল মন্দিরের প্রবেশপথে পোড়ামাটির তৈরী দেবদেবীর মূর্তি। হাতি ঘোড়ায় চড়ে মানুষজন চলেছে উৎসবের আঙিনায়। মন্দিরের চার কোনায় মশাল জ্ব্লছে। চারিদিকে প্রদীপের আলো। মন্দিরের চূড়ায় বিশাল পেতলের কলস , চন্দ্রকেতুগড়ের নীলবর্ণ পতাকা উড়ছে। ভেতরে ঘন্টাধ্বনি ....দেবী মায়ের পূজো ......গম্ভীর স্বরে সমবেত কণ্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ। আজ নাকি রাজা স্বয়ং আসবেন মাঘী পূর্ণিমায় দেবী মায়ের পুজো দিতে .....কত বিচিত্র সাজের নারী পুরুষ ..... কি ভাষায় কথা বলছে ওরা .....
ধূমকেতু কোথায় গেলো ? অনেক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না।
"এই মন্দিরের ঠিক সামনে দিয়ে বয়ে যেত বিদ্যাধরী নদী। " চমকে উঠে পেছনে তাকিয়ে দেখি ধূমকেতু দূরে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে বলছে , " আর একটু দূরে রায়মঙ্গল। এই নদী পথে বঙ্গোপসাগর , ভূমধ্যসাগরের পারের দেশ গ্রীস, রোম-এর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল চন্দ্রকেতুগড়ের। বিশাল পালতোলা জাহাজ এসে ভিড়তো নদীবন্দরে ....ঝকঝকে জ্যোৎস্নার আলোয় আকাশ ছোঁয়া সাদা রঙের পাল .....সাদা মেঘের মতো ......ইউরোপ মহাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল এই বাংলার .....চন্দ্রকেতুগড়ে রীতিমতো বিজ্ঞান চর্চা হতো , গণিতের চর্চা হতো ......অনেকটাই উন্নত মানের ......সেই সময়কার বিখ্যাত গ্রীক মনীষীদের কাজকর্মের সঙ্গে পরিচিত ছিল বাংলার চন্দ্রকেতুগড় .......আপনি ঘুরে দেখুন ম্যাডাম, আমি একটু আসছি। "
আমি একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছি .....যা দেখছি, শুনছি .....সেগুলো কি বাস্তবে ঘটছে ? কে এই ধূমকেতু ? আমাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে এই ঝাঁকড়া চুলের যুবক ! আমার বোধ বুদ্ধি , শরীর ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসছে। কিন্তু .....কিন্তু .....আমাকে যে ফিরতে হবে .......রাত সাড়ে দশটায় শেষ শেয়ালদা লোকাল ......
সিসিলি
গ্রীসের ছোট্ট এই দ্বীপটার ওপর রোমানদের নজর বরাবরই। সমুদ্রপথে বাণিজ্য করতে গেলে এর গুরুত্ব অপরিসীম। দু বছর হতে চললো এই দ্বীপের সাইরা কিউস শহরটাকে কিছুতেই বাগে আনতে পারছে না দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ রোমান সৈন্যবাহিনী। শহরের সুউচ্চ প্রাচীর বরাবর ছাউনি বানিয়ে ঘিরে রেখেছে হাজার হাজার রোমান সৈন্য। কিন্তু সাইরা কিউসের যোদ্ধাদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সঙ্গে কিছুতেই পেরে উঠছেনা। রোমান সেনাধ্যক্ষ মার্সেলাস এক বিখ্যাত যুদ্ধ-বিজ্ঞানী। মার্সেলাস দিনরাত নতুন নতুন যুদ্ধকৌশল নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সাইরা কিউসে নাকি এক পাগল বৃদ্ধ আছে .... সে নাকি নতুন নতুন যুদ্ধাস্ত্র তৈরীতে সিদ্ধহস্ত। সে সূর্যের আলোকে একত্রিত করে জ্বালিয়ে দিচ্ছে গোটা সামরিক সাজ সরঞ্জাম, বিশাল পাথরের খন্ড পাহাড়ের ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ছে , সমুদ্রে রোমান জাহাজগুলো মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তীক্ষ্ণ লোহার ফলার আঘাতে।
এ কে ? ম্যাজিসিয়ান না অশরীরী আত্মা ?
শেষমেশ দু বছর পরে এক কনকনে ঠান্ডার রাতে ভেঙে পড়লো সাইরা কিউসের প্রতিরোধ। শহরের প্রাচীর ভেঙে রোমান সৈন্য ঢুকে পড়লো ভেতরে। তলোয়ারের আঘাতে মারা গেলো হাজার হাজার মানুষ , ধ্বংসলীলা চললো রাতদিন।
না, খবর এসে পৌঁছয়নি শহরের পশ্চিম প্রান্তে সেই ছোট্ট বাড়িটিতে।
বৃদ্ধ তখনও বসে ঘরের মেঝের ওপর। এক বিশাল বৃত্ত আঁকা পাথরের মেঝেতে। কালিঝুলি মাখা হাতে বৃত্তের পরিধির ওপর মাপ নিচ্ছিলেন ......
এমন সময় দরজায় ধাক্কা। প্রথমে মৃদু , তারপর জোরে জোরে লাথি মারার শব্দ। কে যেন খুলে দিলো দরজাটা। হাতে চকচকে তলোয়ার নিয়ে ভেতরে ঢুকলো এক রোমান ক্যাভালিয়ার। পায়ের বুটের ধাক্কায় সবকিছু ওলোটপালোট করে দিয়ে সে সোজা এসে ঢুকলো সেই ঘরটিতে যেখানে তখনও বৃদ্ধ পরিধির মাপ নিয়ে চলেছেন।
" শোনো , রোমানরা শহরের দখল নিয়ে নিয়েছে। মহাধিপতি মার্সেলাস আর একটু পরেই শহরবাসীকে সম্বোধন করবেন। সবাই চলো অ্যাম্ফিথিয়েটার। ", রোমান সৈন্যটি চেঁচিয়ে বলে।
কিন্তু বৃদ্ধ যেতে অস্বীকার করে বললো , "আমার এক্ষুনি এই জ্যামিতিক মাপগুলো নিয়ে ফেলতে হবে। এই সংখ্যাটা মহাজগতের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা। আমি পৌঁছে গেছি প্রায়। আমাকে জ্বালাতন করোনা। তুমি যাও। "
এই ধৃষ্টতা সহ্য করা অসম্ভব ! বিজয়ী সেনার তরুণ সৈন্য খাপ থেকে তলোয়ার বের করে বৃদ্ধের হাত ধরে টেনে বললো , "এই মুহূর্তে যদি না যাও , তোমার গর্দান আলাদা হয়ে যাবে। ওঠো .....ওঠো !!"
"না .... বৃদ্ধ দৃঢ স্বরে বললো , " আমার এই বৃত্তগুলোকে নষ্ট করোনা , দয়া করে। "
রোমান সৈন্যটি বুটের তলায় সেই বৃত্তগুলোকে পিষে তলোয়ারের ধারালো ফলা বৃদ্ধের বুকে বসিয়ে দিলো মুহূর্তে। লুটিয়ে পড়লো বৃদ্ধের দেহ।
বৃদ্ধ বিড় বিড় করে বলছেন ......." min enochleíte tous kýklous mou. perímetros katá diámetro eínai katholikí statherá .... katholikí statherá. "
" নষ্ট কোরোনা আমার বৃত্তগুলোকে ......পরিধিকে ব্যাস দিয়ে ভাগ করলে যে সংখ্যাটা পাওয়া যায় .....সেটা এই মহাজগতের একটা অপরিবর্তিত ধ্রুবক ! "
দেবালয়
"আসুন , ম্যাডাম। " , কখন যে এসে দাঁড়িয়েছে ধূমকেতু , খেয়াল করিনি।
এই দীর্ঘকায় বলশালী যুবকের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছলাম মন্দিরের ঠিক পেছনের অংশটাতে। একটা বিশাল আয়তাকার প্রাঙ্গন।
" আড়াই হাজার বছর আগে নরনারীর প্রেমকে চন্দ্রকেতুগড় কি ভাবে অমর করে গেছে , তার কাহিনী বলবো আপনাকে। " ,আমি উৎসুক। ধূমকেতু কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। রাত তখন কটা , কে জানে। আকাশে ফুটফুটে জ্যোৎস্না। কোথা থেকে যেন হাস্নুহানার গন্ধ ভেসে এলো।
কে এই যুবক ? ও কি সত্যিই বাস্তবের কেউ ? না কি আমিই কল্পনায় স্বপ্নরাজ্যে পৌঁছে গেছি ?
"চন্দ্রকেতুগড়ের গণিতজ্ঞরা গ্রীস দেশের বৈজ্ঞানিকদের বৃত্তের ওপর গবেষণার সঙ্গে পরিচিত ছিল। এই যে আয়তাকার অংশটা দেখছেন , এটা বাইশটা সমান বর্গাকার পাথর দিয়ে তৈরী। প্রত্যেকটা সমান মাপে কাটা। এবার দেখুন এই পুরো আয়তাকার অংশটার ওপরে আরও একটা সাদা পাথরের স্তর। ওপরের স্তরটা ঠিক সাতটা পাথর খন্ড দিয়ে তৈরী। তাহলে প্রত্যেকটা খন্ড হলো বাইশ ভাগের সাত ভাগ .....এই সংখ্যাটা মহাজগতের একটা সার্বজনীন ধ্রুবক সংখ্যা, পাই-এর খুব কাছাকাছি। "
"এর সঙ্গে নরনারীর প্রেমের কি সম্পর্ক ?" , আমি জিজ্ঞেস করি।
"ম্যাডাম , চন্দ্রকেতুগড়ের প্রেমিক প্রেমিকারা বিস্বাস করতো প্রেমের এই মহাকাশে তাদের প্রেম চিরকালীন সত্য হয়ে ধ্রুবতারার মতো জ্বলতে থাকবে ....এক অবিনশ্বর সার্বজনীন ধ্রুবকের মতো। তারা মাঘী পূর্ণিমার রাতে হাত ধরে এসে দাঁড়াতো এই পাথর খণ্ডগুলোর ওপর ......
চারিদিক নিস্তব্ধ ..... আকাশে আলোর বন্যা .....গাছের মাথাগুলো অতিকায় দানবের মতো জেগে আছে। উত্তুরে বাতাস পাশের বাঁশ গাছের পাতায় ঝিরি ঝিরি শব্দ তুলে বয়ে চলেছে।
হঠাৎ দেখি ধূমকেতু এসে দাঁড়িয়েছে আমার ঠিক পাশে ....আমরা দুজনে দাঁড়িয়ে আছি একটা সাদা পাথরের ওপর।
যীশুখ্রিস্টের জন্মের প্রায় আড়াইশো বছর আগের কথা। গ্রীস দেশের সিসিলি দ্বীপে একটা ছোট্ট শহর সাইরা কিউস। সাইরা কিউসের পশ্চিম প্রান্তে সবুজ গাছ গাছালি দিয়ে ঘেরা বাড়িটার প্রায়ান্ধকার একটা ঘরে মোমবাতির আলোর সামনে বসে আছেন এক বৃদ্ধ। গভীর চিন্তায় মগ্ন। টেবিলের প্রান্তে সাদা চিনেমাটির পাত্রে রাখা হালকা লাল রঙের পানীয়। একটা হাত মাথার সাদা চুলগুলো নাড়াচাড়া করছে। আর একটা হাতে কাঠকয়লার পেন্সিল। কাঠের টেবিলের ওপর মোটা একটা কাগজে বৃদ্ধ একের পর এক জ্যামিতিক আকার এঁকে চলেছেন আর তার পাশে পাশে রোমান অক্ষরে কিছু লেখা ,কিছু সংখ্যা। একটা বড়ো বৃত্ত আঁকা ঠিক মাঝখানে , আরো কিছু ছোট ছোট বৃত্ত। মাঝে মাঝে পেন্সিলটা রেখে ডানহাতের তর্জনী বৃত্তগুলোর ওপর পরম আদরে বোলাচ্ছেন আর বিড় বিড় করে কিছু বলছেন।
রাত বেড়ে চলে। বৃদ্ধের ছটফটানি তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। গায়ের চাদরটা ছুঁড়ে দিলেন ঘরের কোণে। টেবিলের ওপর রাখা পানপাত্রটা মেঝেয় পড়ে গিয়ে লাল রঙের তরল ছিটকে পড়লো চারিদিকে। ওনার কিন্তু কোনো হুঁশ নেই। মেঝের ওপর কালো রঙের একটা বৃত্ত এঁকে তার পরিধি বরাবর হাঁটতে লাগলেন। বৃত্তের কেন্দ্রে এক অদৃশ্য মানুষ যেন বসে আছেন। তাকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে বলছেন ................." diámetro tou kýklou ! diámetro !! diámetro !! diámetro !! "
লেবুতলা
আমি ইসাবেলা রায়। ইতিহাসের ছাত্রী, আর আমার আগ্রহের বিষয় এই বাংলার প্রায় ভুলে যাওয়া নগর সভ্যতা - যা গড়ে উঠেছিল বিদ্যাধরী নদীর কিনারায়। অনেকদিন ধরে যাবো যাবো করেও যাওয়া হচ্ছিলো না। শেষমেশ একদিন বেরিয়ে পড়লাম , একাই।
বাড়ি থেকে ট্যাক্সি করে শিয়ালদা। শিয়ালদা থেকে হাসনাবাদ লোকাল ট্রেন ধরে মিনিট চল্লিশের মধ্যেই ছোট্ট একটা রেল স্টেশন লেবুতলা। এখন দুপুর প্রায় তিনটে। দু চারজন যাত্রী নেমে পায়ে হেঁটে স্টেশন চত্তর থেকে বেরিয়ে যেতেই স্টেশনটা একদম ফাঁকা। আশেপাশে লোকজনও কম , কেমন যেন ঘুমন্ত জায়গাটা। স্টেশন থেকে বেরিয়ে রাস্তাটা পুবমুখী। রাস্তার ধারে চায়ের দোকান , কয়েকজন বসে আছেন। পরনে লুঙ্গি , খালি গা। জিজ্ঞেস করি , " আচ্ছা , দেগঙ্গা শহরটা কোন দিকে ?"
বেঞ্চের ওপর বসা মাঝের ভদ্রলোক বিড়ি ধরিয়ে , ভাঁড়ের চায়ে চুমুক দিয়ে হাতটা সোজা দেখিয়ে দিলেন কোনো কথা না বলে। জিন্স টি শার্ট পরা মহিলা দেখে একটু যেন সন্দিগ্ধ।
" কত দূর এখান থেকে ?", আবার জিজ্ঞেস করি।
পাশের বেঁটে মতো ছেলেটি জবাব দেয় ," দু তিন মাইল হবে। যাবেন কোথায় ?"
একটু থেমে বলি , " ওই দেগঙ্গা শহরের কাছেই। "
ছেলেটি বললো ," ওই তো , চলে যান সোজা। তারপর নিবারণের চালের আড়ৎ থেকে বাঁ দিকের রাস্তা দিয়ে বড়োজোর দশ মিনিট। "
কাছাকাছি কোনো রিক্সা বা কোনো যানবাহন চোখে পড়ছে না। অগত্যা হাঁটা লাগলাম পূর্বদিকের রাস্তা ধরে। দোকান বাড়িগুলো শেষ হতেই রাস্তার দুপাশে ধানক্ষেত , পুকুর। বড়ো মনোরম দৃশ্য। মাথার ওপর সূয্যিদেব ততক্ষনে বেশ তেজিয়ান। ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে হালকা বাতাসের ঢেউ , শিরশির শব্দ। কোকিলের ডাক। হঠাৎ হঠাৎ মালপত্র নিয়ে প্রকৃতির নীরবতা ভাঙিয়ে ছুটে যায় ভ্যান রিক্সা।
আমার ভাবনা নিমেষে হাজার হাজার বছরের পার। কেমন ছিল এই অঞ্চল আড়াই হাজার বছর আগে ? ঘন জঙ্গল ? বন্য জন্তুদের আসা যাওয়ার পথ হয়তো ঠিক এখান দিয়েই। কেমন ছিল মানুষ জন ? তাদের পোশাক আশাক , ভাষা ? কি কাজ করতো তারা ? আর কোথায় গেলো সেই নদী ? যার তীরে এসে ভিড়তো পালতোলা বিশাল আকারের জাহাজ ? রাজপ্রাসাদ কোথায় ছিল ? রাজা ,রানী ,রাজকুমারী আর রাজকুমার ....কেমন ছিল তারা ?
" কোথায় যাবেন ম্যাডাম ?" হঠাৎ যেন মাটি ফুঁড়ে উঠে এলো লোকটি।
বয়েস বছর তিরিশেক হবে। মাথার চুল বাদামি , অনেকটা লম্বা। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা। পেশীবহুল কঠিন শরীর , কিন্তু মনে ভয় ধরায় না। কেমন যেন নরম চোখের দৃষ্টি। পরনে পাঠানদের মতো কালো রঙের পোশাক , গলায় রংবেরঙের পুঁতির মালা। একটা কানে তামার তৈরী দুল। বাঁ হাতের কব্জির ঠিক ওপরে একটা অদ্ভুত আকারের উল্কি আঁকা গাঢ় বেগুনি রঙের কালি দিয়ে। পায়ে বিবর্ণ চামড়ার জুতো। মনে হোলো , প্রাচীন ইতিহাসের পাতা থেকে এক চরিত্র হঠাৎ আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। হতে পারে অদ্ভুত দর্শন , কিন্তু আমার কোনো ভয় করছে না।
"বলছি , যাবেন কোথায় ? ", যুবক আবার প্রশ্ন করে।
" মানে .....এই কাছেই। " আমি যুবককে খোলসা করিনা। কেনই বা বলতে যাবো এক সম্পূর্ণ অপরিচিতকে ?
যুবক একটু দূরত্ব রেখে আমার পাশে পাশেই হাঁটতে থাকে।
আমার কি এবার ভয় পাওয়া উচিত ? অপরিচিত জায়গায় মহিলাদের বিপদ অনেক। পরিচিত জায়গাতেই কত কিছু ঘটে যায় ! একটু জোরে পা চালাই।
"ম্যাডাম কি ভয় পাচ্ছেন আমাকে ?", যুবক ঠিক আমার ডান দিকের কাঁধের পাশ থেকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয়।
" ন ...ন .. না তো , ভয় পাবো কেন ?" আমি একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলি, "আমার একটু তাড়া আছে। "
"হ্যাঁ , তো চলুন না আমি পৌঁছে দিচ্ছি। আমার রাজশাহী ঘোড়াগাড়ি আছে। এ তল্লাটে একমাত্র আমার কাছেই আছে ম্যাডাম। "
"না , না , লাগবে না। এই তো কাছেই। আমি হেঁটেই যাবো। "
"ম্যাডাম , এখনো পাঁচ কিলোমিটার। আমি জানি আপনি কোথায় যাবেন। "
আমি চমকে উঠে বোকার মতো বলি , "কোথায় ?"
"বেড়াচাঁপা "
বেড়াচাঁপা
ঘোড়াদুটো গাঢ় তামাটে রঙের , বেশ তেজি। গাড়িটা ভিক্টোরীয় যুগের ব্রউঘাম ক্যারেজ ধরণের। দেখেই বোঝা যায় বহু পুরোনো কিন্তু ঘষামাজা করে পরিষ্কার এবং পরিচ্ছন্ন রাখা হয়েছে। বাইরেটা কালো রং করা। ভেতরে বসার একটা সিট , কাঠের ওপরে চামড়ার গদি মোড়া। ক্যারেজের জোড়গুলো পেতলের কারুকাজ করা কব্জা দিয়ে তৈরী। গাড়ির নাম "রাজশাহী ", গাড়ির চালক সেই অদ্ভুত দর্শন যুবক। নাম জিজ্ঞেস করতে বললো " ম্যাডাম , আমার নাম ধূমকেতু। কেতু বলে ডাকবেন। "
যেমন অদ্ভুত দেখতে , তেমনই অদ্ভুত নাম। ধূমকেতুর কণ্ঠস্বর অস্বাভাবিক রকমের ভারী , যেন কোন অতীতের গর্ভ থেকে উঠে আসছে। ভাষার বাঁধুনি বেশ পরিণত গাইডের মতো।
ঢিমে তালে চলছে ঘোড়ার গাড়ি। আশেপাশের লোকজন বোধহয় দেখে অভ্যস্ত , তাই কেউ ঠিক লক্ষ্য করছেনা। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এই ঘোড়াগাড়ি , ওই যুবক, এই নরম সূর্যের আলোয় মাখা কালো পিচের রাস্তা , দুধারের ধানক্ষেত ....সবই কেমন যেন বেমানান , বাকি সবকিছুর সঙ্গে মিলছেনা, মিলছেনা।
মিলছেনা, কিন্তু আমি চলেছি রাজশাহীতে সওয়ার হয়ে । কাচের খোলা জানলা দিয়ে সুগদ্ধি ধানের সুবাসযুক্ত বাতাস আমার চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে।
গাড়ি দেগঙ্গা শহর ছাড়িয়ে ডান দিকে টাকি রোড ধরে চলছে এখন। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আর কতক্ষণ ? সন্ধে নামতে আর বেশি দেরি নেই। অন্ধকারে তো কিছুই দেখা যাবে না। জায়গাটা দেখে আজই সন্ধেবেলার ট্রেন ধরে বাড়ি ফেরার কথা।
" ম্যাডাম, আপনি যা দেখতে এসেছেন আমি আপনাকে ঘুরিয়ে দেখাবো। অনেকগুলো গ্রামের অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, সময় লাগবে।আমরা যাবো শানপুকুর , দেবালয় , হাদীপুর , বেড়াচাঁপা , ইটখোলা ........ আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে এখানে ছিল এক বিশাল সাম্রাজ্য, চন্দ্রকেতুগড়। মহারাজ চন্দ্রকেতু সেই সাম্রাজ্যের অধীশ্বর। ওনার মতো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শাসক বাংলার ইতিহাসে কখনো আসেনি , আসবেও না। কয়েক মাইল দীর্ঘ মূল দুর্গের প্রাচীর। প্রবেশপথে ছিল বিশাল তোরণ ....এখান থেকেই শুরু হয়েছে দুর্গের প্রাচীর। দেখুন পোড়ামাটির ইঁটের চওড়া শক্ত গাঁথনি। "
"আর কতক্ষণ লাগবে ?" আমি একটু অসহিষ্ণু। গলাটা কি একটু রুক্ষ শোনালো ? কে জানে !
"এসেই গেছি ম্যাডাম। আমরা মহারাজ চন্দ্রকেতুর দুর্গে প্রবেশ করছি। বলুন, জয় মহারাজ চন্দ্রকেতুর জয় !"
এ তো পাগল মনে হচ্ছে। পোড়া মাটির ইঁট দিয়ে তৈরী কিছু ঢিবি ছাড়া তো কিছুই দেখছি না।
"এটা খনা-মিহিরের ঢিবি। যদিও এই ঢিবি তৈরী হয়েছিল অনেকটা পরে, তখন মহারাজ বিক্রমাদিত্যের শাসন চলছে বাংলায়। ম্যাডাম, খনা এই বাংলার বিস্ময়কর প্রতিভা। অঙ্ক শাস্ত্রে এমন পারদর্শিনী মহিলা গোটা পৃথিবীতে বিরল। মিহিরের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল কিন্তু বড়ো দুঃখের সেই কাহিনী। আবার যদি কখনো আসেন , বলবো সেই কথা। " , যুবক তার বিক্ষিপ্ত তামাটে রঙের চুলগুলো হাতের আঙুল দিয়ে বাগে আনার চেষ্টা করতে করতে বললো।
খনার কথা শুনেছি বটে ,কিন্তু বিশেষ কিছুই জানিনা বলে একটু লজ্জাও লাগলো। এই অদ্ভুত দর্শন যুবক ধূমকেতু ক্রমশই আমাকে অবাক করছে। বুকের ভেতরে কি একটা যেন ড্রাম বাজছে , ভয় আর আনন্দ দুটোই মিলেমিশে। দ্রুত অন্ধকার হয়ে আসছে , আমাকে ফিরতে হবে। সম্পূর্ণ অচেনা জায়গায় ততোধিক অচেনা এক যুবকের ঘোড়াগাড়িতে আমি চলেছি প্রাগৈতিহাসিক এক শহরের আবিষ্কারে। এটা কি সত্যিই ঘটছে ?
চন্দ্রকেতুগড়
কিছুক্ষন আগেই সূর্য অস্ত গেছে দূরের হলুদ সর্ষে ক্ষেতের ওপর শেষ আভাটুকু ছড়িয়ে দিয়ে। আমরা এসে দাঁড়িয়েছি এক বিশাল মন্দির চত্বরে। রাজশাহী থেকে নেমে দাঁড়ালাম। আশেপাশের অনেকটা অংশ জুড়ে বড়ো বড়ো গাছ। উত্তর-পূর্ব দিকের আকাশে ঘন গাছের ফাঁক দিয়ে হঠাৎ চেয়ে দেখি রুপোলি আলোয় ভাসিয়ে চাঁদ উঠেছে। আজ কি পূর্ণিমা ? জায়গাটা প্রায় একশো ফুট লম্বায় আর প্রায় আশি ফুট চওড়ায়। মূল মন্দিরের প্রবেশপথে পোড়ামাটির তৈরী দেবদেবীর মূর্তি। হাতি ঘোড়ায় চড়ে মানুষজন চলেছে উৎসবের আঙিনায়। মন্দিরের চার কোনায় মশাল জ্ব্লছে। চারিদিকে প্রদীপের আলো। মন্দিরের চূড়ায় বিশাল পেতলের কলস , চন্দ্রকেতুগড়ের নীলবর্ণ পতাকা উড়ছে। ভেতরে ঘন্টাধ্বনি ....দেবী মায়ের পূজো ......গম্ভীর স্বরে সমবেত কণ্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ। আজ নাকি রাজা স্বয়ং আসবেন মাঘী পূর্ণিমায় দেবী মায়ের পুজো দিতে .....কত বিচিত্র সাজের নারী পুরুষ ..... কি ভাষায় কথা বলছে ওরা .....
ধূমকেতু কোথায় গেলো ? অনেক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না।
"এই মন্দিরের ঠিক সামনে দিয়ে বয়ে যেত বিদ্যাধরী নদী। " চমকে উঠে পেছনে তাকিয়ে দেখি ধূমকেতু দূরে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে বলছে , " আর একটু দূরে রায়মঙ্গল। এই নদী পথে বঙ্গোপসাগর , ভূমধ্যসাগরের পারের দেশ গ্রীস, রোম-এর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল চন্দ্রকেতুগড়ের। বিশাল পালতোলা জাহাজ এসে ভিড়তো নদীবন্দরে ....ঝকঝকে জ্যোৎস্নার আলোয় আকাশ ছোঁয়া সাদা রঙের পাল .....সাদা মেঘের মতো ......ইউরোপ মহাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল এই বাংলার .....চন্দ্রকেতুগড়ে রীতিমতো বিজ্ঞান চর্চা হতো , গণিতের চর্চা হতো ......অনেকটাই উন্নত মানের ......সেই সময়কার বিখ্যাত গ্রীক মনীষীদের কাজকর্মের সঙ্গে পরিচিত ছিল বাংলার চন্দ্রকেতুগড় .......আপনি ঘুরে দেখুন ম্যাডাম, আমি একটু আসছি। "
আমি একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছি .....যা দেখছি, শুনছি .....সেগুলো কি বাস্তবে ঘটছে ? কে এই ধূমকেতু ? আমাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে এই ঝাঁকড়া চুলের যুবক ! আমার বোধ বুদ্ধি , শরীর ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসছে। কিন্তু .....কিন্তু .....আমাকে যে ফিরতে হবে .......রাত সাড়ে দশটায় শেষ শেয়ালদা লোকাল ......
সিসিলি
গ্রীসের ছোট্ট এই দ্বীপটার ওপর রোমানদের নজর বরাবরই। সমুদ্রপথে বাণিজ্য করতে গেলে এর গুরুত্ব অপরিসীম। দু বছর হতে চললো এই দ্বীপের সাইরা কিউস শহরটাকে কিছুতেই বাগে আনতে পারছে না দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ রোমান সৈন্যবাহিনী। শহরের সুউচ্চ প্রাচীর বরাবর ছাউনি বানিয়ে ঘিরে রেখেছে হাজার হাজার রোমান সৈন্য। কিন্তু সাইরা কিউসের যোদ্ধাদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সঙ্গে কিছুতেই পেরে উঠছেনা। রোমান সেনাধ্যক্ষ মার্সেলাস এক বিখ্যাত যুদ্ধ-বিজ্ঞানী। মার্সেলাস দিনরাত নতুন নতুন যুদ্ধকৌশল নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
সাইরা কিউসে নাকি এক পাগল বৃদ্ধ আছে .... সে নাকি নতুন নতুন যুদ্ধাস্ত্র তৈরীতে সিদ্ধহস্ত। সে সূর্যের আলোকে একত্রিত করে জ্বালিয়ে দিচ্ছে গোটা সামরিক সাজ সরঞ্জাম, বিশাল পাথরের খন্ড পাহাড়ের ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ছে , সমুদ্রে রোমান জাহাজগুলো মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তীক্ষ্ণ লোহার ফলার আঘাতে।
এ কে ? ম্যাজিসিয়ান না অশরীরী আত্মা ?
শেষমেশ দু বছর পরে এক কনকনে ঠান্ডার রাতে ভেঙে পড়লো সাইরা কিউসের প্রতিরোধ। শহরের প্রাচীর ভেঙে রোমান সৈন্য ঢুকে পড়লো ভেতরে। তলোয়ারের আঘাতে মারা গেলো হাজার হাজার মানুষ , ধ্বংসলীলা চললো রাতদিন।
না, খবর এসে পৌঁছয়নি শহরের পশ্চিম প্রান্তে সেই ছোট্ট বাড়িটিতে।
বৃদ্ধ তখনও বসে ঘরের মেঝের ওপর। এক বিশাল বৃত্ত আঁকা পাথরের মেঝেতে। কালিঝুলি মাখা হাতে বৃত্তের পরিধির ওপর মাপ নিচ্ছিলেন ......
এমন সময় দরজায় ধাক্কা। প্রথমে মৃদু , তারপর জোরে জোরে লাথি মারার শব্দ। কে যেন খুলে দিলো দরজাটা। হাতে চকচকে তলোয়ার নিয়ে ভেতরে ঢুকলো এক রোমান ক্যাভালিয়ার। পায়ের বুটের ধাক্কায় সবকিছু ওলোটপালোট করে দিয়ে সে সোজা এসে ঢুকলো সেই ঘরটিতে যেখানে তখনও বৃদ্ধ পরিধির মাপ নিয়ে চলেছেন।
" শোনো , রোমানরা শহরের দখল নিয়ে নিয়েছে। মহাধিপতি মার্সেলাস আর একটু পরেই শহরবাসীকে সম্বোধন করবেন। সবাই চলো অ্যাম্ফিথিয়েটার। ", রোমান সৈন্যটি চেঁচিয়ে বলে।
কিন্তু বৃদ্ধ যেতে অস্বীকার করে বললো , "আমার এক্ষুনি এই জ্যামিতিক মাপগুলো নিয়ে ফেলতে হবে। এই সংখ্যাটা মহাজগতের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা। আমি পৌঁছে গেছি প্রায়। আমাকে জ্বালাতন করোনা। তুমি যাও। "
এই ধৃষ্টতা সহ্য করা অসম্ভব ! বিজয়ী সেনার তরুণ সৈন্য খাপ থেকে তলোয়ার বের করে বৃদ্ধের হাত ধরে টেনে বললো , "এই মুহূর্তে যদি না যাও , তোমার গর্দান আলাদা হয়ে যাবে। ওঠো .....ওঠো !!"
"না .... বৃদ্ধ দৃঢ স্বরে বললো , " আমার এই বৃত্তগুলোকে নষ্ট করোনা , দয়া করে। "
রোমান সৈন্যটি বুটের তলায় সেই বৃত্তগুলোকে পিষে তলোয়ারের ধারালো ফলা বৃদ্ধের বুকে বসিয়ে দিলো মুহূর্তে। লুটিয়ে পড়লো বৃদ্ধের দেহ।
বৃদ্ধ বিড় বিড় করে বলছেন ......." min enochleíte tous kýklous mou. perímetros katá diámetro eínai katholikí statherá .... katholikí statherá. "
" নষ্ট কোরোনা আমার বৃত্তগুলোকে ......পরিধিকে ব্যাস দিয়ে ভাগ করলে যে সংখ্যাটা পাওয়া যায় .....সেটা এই মহাজগতের একটা অপরিবর্তিত ধ্রুবক ! "
দেবালয়
"আসুন , ম্যাডাম। " , কখন যে এসে দাঁড়িয়েছে ধূমকেতু , খেয়াল করিনি।
এই দীর্ঘকায় বলশালী যুবকের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছলাম মন্দিরের ঠিক পেছনের অংশটাতে। একটা বিশাল আয়তাকার প্রাঙ্গন।
" আড়াই হাজার বছর আগে নরনারীর প্রেমকে চন্দ্রকেতুগড় কি ভাবে অমর করে গেছে , তার কাহিনী বলবো আপনাকে। " ,আমি উৎসুক। ধূমকেতু কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। রাত তখন কটা , কে জানে। আকাশে ফুটফুটে জ্যোৎস্না। কোথা থেকে যেন হাস্নুহানার গন্ধ ভেসে এলো।
কে এই যুবক ? ও কি সত্যিই বাস্তবের কেউ ? না কি আমিই কল্পনায় স্বপ্নরাজ্যে পৌঁছে গেছি ?
"চন্দ্রকেতুগড়ের গণিতজ্ঞরা গ্রীস দেশের বৈজ্ঞানিকদের বৃত্তের ওপর গবেষণার সঙ্গে পরিচিত ছিল। এই যে আয়তাকার অংশটা দেখছেন , এটা বাইশটা সমান বর্গাকার পাথর দিয়ে তৈরী। প্রত্যেকটা সমান মাপে কাটা। এবার দেখুন এই পুরো আয়তাকার অংশটার ওপরে আরও একটা সাদা পাথরের স্তর। ওপরের স্তরটা ঠিক সাতটা পাথর খন্ড দিয়ে তৈরী। তাহলে প্রত্যেকটা খন্ড হলো বাইশ ভাগের সাত ভাগ .....এই সংখ্যাটা মহাজগতের একটা সার্বজনীন ধ্রুবক সংখ্যা, পাই-এর খুব কাছাকাছি। "
"এর সঙ্গে নরনারীর প্রেমের কি সম্পর্ক ?" , আমি জিজ্ঞেস করি।
"ম্যাডাম , চন্দ্রকেতুগড়ের প্রেমিক প্রেমিকারা বিস্বাস করতো প্রেমের এই মহাকাশে তাদের প্রেম চিরকালীন সত্য হয়ে ধ্রুবতারার মতো জ্বলতে থাকবে ....এক অবিনশ্বর সার্বজনীন ধ্রুবকের মতো। তারা মাঘী পূর্ণিমার রাতে হাত ধরে এসে দাঁড়াতো এই পাথর খণ্ডগুলোর ওপর ......
চারিদিক নিস্তব্ধ ..... আকাশে আলোর বন্যা .....গাছের মাথাগুলো অতিকায় দানবের মতো জেগে আছে। উত্তুরে বাতাস পাশের বাঁশ গাছের পাতায় ঝিরি ঝিরি শব্দ তুলে বয়ে চলেছে।
হঠাৎ দেখি ধূমকেতু এসে দাঁড়িয়েছে আমার ঠিক পাশে ....আমরা দুজনে দাঁড়িয়ে আছি একটা সাদা পাথরের ওপর।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সুসঙ্গ শাওন ১৫/০৯/২০২২সুন্দর লিখেছেন কবি
-
মোঃ বুলবুল হোসেন ১২/০৯/২০২২সুন্দর