দেওয়ালে দেওয়ালে
শুরুর আগে
‘সত্যি’ কাকে বলে? খুব কঠিন প্রশ্ন... হয়তো প্রশ্নটা করতে খুব কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কিন্তু উত্তর বেজায় জটিল। উত্তর জটিল মন থেকে বেরোয় তাই হয়তো জটিল। উত্তর জটিল রাস্তা ধরে এগোয় তাই হয়তো জটিল। উত্তর জটিল ভাবে গৃহীত হয় তাই হয়তো জটিল।
এক যে ছিল দেওয়াল। না এভাবে বলা ভুল হলো। এক যে ছিল দেশ। যে সে নয়, প্রবল প্রতাপান্বিত, যুদ্ধক্ষত নিয়েও ছিল সভ্যতার শিখরে। তবুও ভয় পেত উত্তর থেকে আসা প্রবল হানাদারদের। সে দেশের রাজারা, মানে রাজার পর রাজা মিলে একটু একটু করে গড়ে তুল্লেন দেওয়াল। তারপর রাজার পর রাজা এলেন, ক্রমে রাজার দিন ও শেষ হল সেখানে।
আরেক ছিল দেশ। সে দেশ অনেক যুদ্ধজ্বালা সয়ে সয়ে ভেঙ্গে গড়ে চলতে চলতে দেখেছিল আরেক দেওয়াল তৈরি হতে। তখন হারের জ্বালা, টুকরো হওয়ার জ্বালা মেনে নিয়ে দেখতো যারা এক হয়ে তাদের হারিয়েছে, তারা এখন নিজেদের মধ্যে লড়ছে। তাদের মাঝে রয়েছে দেওয়াল, যা শুধু সেই দেশটাকেও নয়, তাদের বিজয়ীদেরও আলাদা করে রেখেছে। কখনো সামনাসামনি ঠোকাঠুকি, কোথাও পর্দার আড়ালে। কালে কালে সেই দেওয়াল ভেঙ্গে গেল। পূর্ব দিকের দেশ আর আলাদা থাকলো না, গোটা ভুখন্ডটা চলে এলো পশ্চিমের পতাকা তলে।
হয়তো এভাবেও শুরু হয়নি...
শুরুর শুরু
প্রাশিয়ার হাতে ফ্রান্সের হারের পর ১৮৭১ সালে পারি/প্যারিসে ক্ষণজীবি রাষ্ট্র প্যারিস কমিউন তৈরি হয়, এবং ধ্বসেও যায়। তার ও আগে থেকে চলছিল এক প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া। মূলত ১৭৮৯ সালে বাস্তিল পতনের পর থেকে ফরাসী সাংসদে সমাজতন্ত্রী, জাতীয়তাবাদী, সাম্যবাদী, নৈরাজ্যবাদী প্রভৃতি মানুষেরা বাম দিকে বসার জন্য বামপন্থী বলে বিবেচিত হন। পরে বহু জায়গাতেই জাতীয়তাবাদীদের ডানপন্থী গন্য করা হয়।
১৪৫৩ সালে ওটোমান/ওসমানীয় তুরকীদের হাতে কন্সটান্টিনোপলের পতনের পর থেকে ইউরোপীয়দের সমুদ্রযাত্রা বৃদ্ধি পায়। স্পেন, পর্তুগাল, ক্রমে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স লেগে পড়ে উপনিবেশ তৈরিতে। তাদের মধেও মাঝে মাঝে সংঘর্ষ (১৫৮৮ স্প্যানিশ আর্মাডা, ১৮১৫ ওয়াটারলু) হত। যোগ দেয় জার্মানি, ইতালি, অস্ট্রিয়া, রাশিয়াও। তার পরে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে উপনিবেশবাদীদের নিজেদের মধ্যে বেধে যায় এক বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ। ইংল্যান্ড/যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, জাপানের মিত্রশক্তি হারিয়ে দেয় জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরী, বুলগারিয়া, ওটোমান তুরকীদের কেন্দ্রীয় জোটকে। রাশিয়া মিত্রপক্ষে যোগ দিলেও রুশ বিপ্লবে জারতন্ত্রের পতনের পর যুদ্ধ থেকে সরে যায়। জার্মানী, তুরস্কেও পতন হয় রাজতন্ত্রের।
উনবিংশ শতকে গৃহযুদ্ধ কাটিয়ে উঠেছিল প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধ ১৭৭৬ সালে ইংল্যান্ডের শাসন থেকে বিচ্ছিন্নতা ঘোষনা করা যুক্তরাষ্ট্র। ক্রমেই পরিচিত হতে থাকে অন্যতম সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী দেশ রূপে। অন্যদিকে রুশ সাম্রাজ্যের পতনের পর একদলীয় শাসনে অন্যতম বড় শক্তি হয়ে ওঠে সোভিয়েত ইউনিয়ন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিপর্যয়ের রেশ কাটতে না কাটতে অর্থনৈতিক মন্দা আছড়ে পড়ে পশ্চিমী দেশগুলিতে। জার্মানী, ইতালীতে উগ্রজাতিবাদকে পুঁজি করে উত্থান হয় হিটলার-মুসোলিনির। জার্মানিতে হিটলারের জাতীয় সমাজতন্ত্রী(Nazi) দলের রোষের বলি হয় বহু ইহুদী। ঘটনা চক্রে বেধে যায় আরেক বিশ্বযুদ্ধ। শান্তিচুক্তি ভেঙ্গে সোভিয়েত আক্রমণের পরিণতিতে হেরে যায় জার্মানী-ইতালি-জাপানের অক্ষশক্তি। সোভিয়েত অধিকৃত অংশ মূল ভূখণ্ডের সাথে মিলতে না পেরে জন্ম নেয় উত্তর কোরিয়া, পুর্ব জার্মানির মত রাষ্ট্র। পুরনো সাম্রাজ্যবাদীরাও আর আগের শক্তিতে থাকলোনা। ১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ১৯৪৯ এ সোভিয়েতের পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার পর পৃথিবী ভাগ হয়ে যেতে লাগলো দুই শক্তির আওতায়।
অন্যদিকে প্রাচীন মহাশক্তি চীন ক্রমদুর্বল হয়ে উপনিবেশবাদীচালিত এক রাজবংশের শাসিত হতে থাকে। ১৯১১ সালের জিঙ্ঘাই বিপ্লবে রাজতন্ত্রের পতন হলেও দুর্বল কিয়দতন্ত্র(Oligocracy) প্রতিবেশী জাপানের দাপট থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৯ সালের বিপ্লবে তাইওয়ান বাদে সমগ্র চীন মাও সে তুং নেতৃত্বাধীন চীনের সাম্যবাদী দলের অধীনে আসে। চীন নাম লেখায় সাম্যবাদী শিবিরে। ফলে পুর্ব ইউরোপ, মধ্য এশিয়া, পুর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ পুর্ব এশিয়ার কিছু জায়গা জুড়ে গড়ে ওঠে একছত্র সমাজতান্ত্রিক শিবির। অন্যদিকে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন ধনতন্ত্রী শিবির।
শুরুর সময়
এরপর দুই গোষ্ঠী কখনো সরাসরী সমরে নেমে পড়ে কোরীয়া, ভিয়েতনাম এ। কখনো ছায়াযুদ্ধের করুণ সাক্ষী হয় মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার বহু জায়গা। কখনো বা এই দুই শিবিরের সমর্থনপুষ্ট রাষ্ট্ররা নেমে পড়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে, আমাদের উপমহাদেশ যার নিদারুণ সাক্ষী। কিছু জায়গায় বিবাদমান পক্ষ জোর বাড়াতে হাত ধরেছে এই দুই শিবিরের যেমন মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নি বিরোধ। কখনো এই দুই শিবিরেই ঘটে গেছে ঠান্ডা-গরম লড়াই। চীন-সোভিয়েত, মার্কিন-ফ্রান্স বিরোধ যার নমুনা। দুই শিবির থেকেই অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলিতে পছন্দসই সরকার বসানোর আর অপছন্দের সরকার ফেলে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে। আফগানিস্তানে পছন্দসই সরকার বসাতে চেয়ে সেনা পাঠানোর চরম খেসারত দিয়ে ভেঙ্গে পড়ে সোভিয়েত সঙ্ঘ। সাথে পুর্ব ইউরোপে ও আফ্রিকার কিছু জায়গায় সমাজতন্ত্রী প্রভাব শেষ হয়। কিছু কিছু দেশে মার্ক্সবাদী দল অন্যপন্থা ধরে নেয়।
এবার এখন
১৯৮৯ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে বিভিন্ন দেশে প্রতিবিপ্লবের মধ্যে পৃথিবীর ভারসাম্যের বিপুল পরিবর্তন ঘটে। কিছু জায়গায় ঘটানো ও কিছু জায়গায় আটকানো হয় এই বিপ্লব। এইজন্য যুগোস্লাভিয়া, আলজিরিয়া, চীনে বেধে যায় হিংসাত্মক ঘটনা। ইউরোপ সহ বেশ কিছু জায়গায় আসন হারাতে থাকে বাম ও মধ্যবামেরা। সোভিয়েত পতনের পর মধ্য এশিয়ায় কমবেশী স্বৈরতন্ত্র স্থাপন হয়, ককেশীয় দেশগুলিতে লেগে যায় জাতবাদী ঠোকাঠুকি, পুর্ব ইউরোপ কমবেশি মার্কিন ছাতার তলায় আশ্রয় নেয় । ইয়েলৎসিনের হাত ধরে উদারীকরনের রাস্তায় নামে ভেঙ্গে পড়া রাশিয়া। পুর্বতন সোভিয়েতের কিছু দেশ নিয়ে Commonwealth of Independent States বা CIS তৈরির চেষ্টাও খুব একটা সফল হয়নি। চেকোস্লোভাকিয়া চেক ও স্লোভাক দেশে ভেঙ্গে যায়। অন্যদিকে গৃহযুদ্ধে রক্তস্নাত হয়ে বহু টুকরোয় ভেঙ্গে পড়ে ইতিহাসের পাতায় চলে যায় যুগোস্লাভিয়া। ইরাকের মত কিছু দেশ বেঁকে বসলেও উপসাগরীয় যুদ্ধ, বেল্গ্রেড আক্রমণ জাতীয় ঘটনার বিশ্বের অপ্রতিদ্বন্দ্বী মহাশক্তিরুপে নিজেকে জাহির করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
অন্যদিকে আশির দশকের স্বৈরতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক উদারীকরণের পথ ধরে পথ চলতে থাকে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন। ঐক্যবদ্ধ জার্মানিও চলতে থাকে ধনতন্ত্রের পথ ধরে।
যা দেখতে পাচ্ছি, যা দেখছি,
“বর্তমান বিশ্বে অপ্রতিদ্বন্দ্বী মহাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যারা কর্মরফতানি করে আর যুগোস্লাভিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়াতে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। আর ইংল্যন্ড, অস্ট্রেলিয়ায় কিছু হমরা চোমরা ফিরিঙ্গি দাপাদাপি করলেও ওদের সাথে কাজ করা যায়। রাশিয়া থেকে আমাদের অস্ত্র আসে। আর আমাদের সম্পদ্গুলো কালো টাকা হয়ে জমা হয় সুইসব্যাঙ্কে। জাপান-কোরিয়ার লোকেরা Technologyতে কাঁপিয়ে দেয়। ১৯৬২তে ভারত আক্রমণকারী চীন অর্থনৈতিক সংস্কার করে এখন সস্তা মালের Supermarket যদিও সেখানের শ্ত্রুকমিউনিস্টরা অরুণাচল দাবী করে। অন্যদিকে ভারতের পশ্চিম থেকে ইউরোপের দক্ষিণ পর্যন্ত মরুপ্রধান জায়গাগুলিতে হিংসাধস্ত তৈলসম্পন্ন শেখওয়ালা মুসলমানরা থাকে। আমাদের চেয়েও গরিব লোকেরা থাকে আফ্রিকাতে। আর লাতিন আমেরিকা মানেই ঝিক্কু চিকা।
এদিকে বাংলাদেশ থেকে গাদাগুচ্ছের অনুপ্রবেশকারী আসে, নেপাল ভুটানকে তো বাদ ই দিলাম। আর পাকিস্তান নামক নরক থেকে শয়তানেরা ষড়যন্ত্র করে আর এদেশের তাদের কিছু বেরাদরের মদতে সেগুলো সফল হয়। শ্রীলঙ্কায় রাবণের বংশ ধরে ধরে তামিল মারে।”
এখনকার দুনিয়া নিয়ে মোটামোটি এই ধারণায় প্রচার করে প্রচারমাধ্যম, আর এক বিরাট অংশের লোকের ধারণাও তার খুব একটা বাইরে নয়।
যা দেখতে পাচ্ছিনা, দেখছিওনা
যা দেখি ও দেখানো হয় তাঁর বাইরেও কিছু সত্যি থেকে যায়, সোভিয়েত পতনেই যে বামপন্থার বা ঠান্ডাযুদ্ধের ইতি সে ভাবার খুব একটা কারণ নেই। ১৯৯৮ সাল থেকেই বেশ কিছু বিকল্প প্রকট হয়ে উঠতে থাকে। এই বছরই জার্মানিতে পতন হয় ডানপন্থী সরকারের। ভেনেজুয়েলায় সাভেজের জয়ের সাথে সাথে শুরু হয় নতুন যুগের। যাতে সামিল হয় ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডোর, বলিভিয়া, চিলি, পেরু, এল সাল্ভাদোর, হন্ডুরাস, মেক্সিকো, প্যারাগুয়ের মত দেশ। এইসব দেশে জাতীয়তাবাদীরাও গলা মেলান বামপন্থীদের সাথে। ২০০৫ সালে BBC র সমীক্ষা অনুযায়ী লাতিন আমেরিকার ৭৫ শতাংশ মানুষ ছয় বছর ধরে রয়েছেন বাম ছাতার তলায়। কিছু অত্যুৎসাহী রাষ্ট্র নিজেদের মধ্যে সাইমন বলিভার নামাঙ্কিত ‘বলিভারীয় জোট’ গড়েছে। এই ঘটনাক্রমকে ওয়াকিবহাল মহল Pink Tide নাম দিয়েছেন। ২০০২ এ ভেনেজুয়েলায় ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান, ২০০৮ এ হন্ডুরাস ও ২০১০ এ প্যারাগুয়েতে সরকার ফেলে দিয়েও এর যাত্রা থামানো যায়নি। চিলির নির্বাচনের সাম্প্রতিক ফলাফলই যার প্রমাণ।
অন্যদিকে Composite Index of National Capability নামক সূচক যাতে কোন দেশের শক্তি-সম্ভাবনা জানা যায় তাতেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের থেকে পিছিয়ে পড়েছে। ভারত আছে এই দুই দেশের পরেই। তার পর আসছে জাপান, রাশিয়া, ব্রিটেন, জার্মানির মত দেশ। রাশিয়া ও চীনের উদ্যোগে গঠিত হয় Shanghai Co-Operation Organisation। এতে হাত মেলায় মধ্য এশিয়ার কিছু দেশ। জুডো বিশারদ পুতিন প্রভাবিত রাশিয়া একবিংশ শতকের শুরু থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে , বেলারুশ ও ইউক্রেনেও এখন রুশ প্রভাব বিস্তার এর লক্ষণ দেখা যায়। ঠাণ্ডা যুদ্ধের প্রতিপক্ষদের মধ্যে মাঝে মাঝেই সুর চড়তে থাকে।
এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতিতে না হলেও শাসনব্যবস্থায় সমাজতন্ত্র প্রয়োগের নতুন রাস্তা দেখিয়েছে ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড এর মত নর্ডিক দেশসমুহ। কল্যাণকামী রাষ্ট্র বা Welfare State এর ধারণাকে সফলভাবে কাজে লাগিয়েছে এই দেশ। মূলত জনসংখ্যা কম হওয়ার দরুণ এই সাফল্য এসেছে। পারিবারিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের এই হস্তক্ষেপ বাইরের দেশের অনেকেরই অনভিপ্রেত। অন্যদিকে এখানকার বামদলগুলিও Euro-communism বা নতুন আঙ্গিকসম্পন্ন স্থানীয় দাবীরেখে সাম্যবাদের এর সফল উদাহরণ দেখিয়েছে। পরিবেশবাদী Green Party গুলিও যথেষ্ট সফল।
১৯৮৪ সালের মধ্যেই বিশেষত ইউরোপের রাজনীতিতে পরিবেশভাবনার জায়গা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ১৯৮৯ ও ১৯৯৪ এ ইউরোপীয় সংসদে অন্যভাবনার দলের সঙ্গে জোট বাঁধলেও পরে তারা একলা চলতে থাকে। অনেক দেশে মধ্যবাম ও কিছু দেশে বামেদের সাথে পরিবেশবাদীদের জোট বাধতে দেখা যায়। ১৯৮৯ সালের পর থেকে জাতবাদী দলগুলি ইউরোপে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে, ১৯৯৪, ১৯৯৯ ও ২০০৪ এ জায়গা না পেলেও ২০০৯ এ আবার ফিরে আসতে দেখাগেছে রক্ষণশীল পুজিবাদীদের। সমকামীতা বেশ কিছুদিন ধরে পশ্চিমিবিশ্বে রাজনৈতিক বিষয়। বেশ কিছু আন্দোলন ও সমকামীর সমাজজীবনে প্রভাব এর জন্য দায়ী। এর প্রভাব ভারতের রাজনীতি ও প্রচারমাধ্যমেও পড়েছে। মূলত সমকামীতাকে আধুনিক ও প্রগতিশীল বলে প্রচারের কারণে পরিবেশ ও পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের মত বিষয়গুলি পেছনে পড়ে যাচ্ছে।
Campaign for Nuclear Disarmament বা CND পরমাণু অস্ত্রবিরোধীরা অনেকদিন ধরেই শক্তিসালী দেশগুলোর মাথাব্যথার কারণ। এই যুদ্ধবিরোধীরা অনেক সময়ই বিরোধী রাষ্ট্রনায়কদের থেকেও বেশি বিপজ্জনক প্রমাণিত হয়েছেন বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে। গত ইরাক যুদ্ধের সময় থেকে প্রস্তাবিত সিরিয়া আক্রমণ এঁদের রাস্তায় সক্রিয় ভাবে নামতে দেখা গেছে। এঁদের প্রভাবেই মাঝে মাঝে ইউরোপিয়ান সঙ্ঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধ বাধে। এসবের সাথে যুক্ত হয়েছে তথ্যফাঁস বা Whistle blowing আন্দোলন জুলিয়ান অ্যাসেঞ্জ-এডওয়ার্ড স্নোডেনের দৌলতে ধনতন্ত্রী দুনিয়ার অনেক কেচ্ছাই ফাঁস হয়ে গেছে। Prism Project এর কুকীর্তি ‘BIG BROTHER is watching’ প্রবাদকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে। মার্কিন নজরদারি শুধু শত্রুদেশেই নয়, চলছে মিত্র জার্মানি ফ্রান্স এমনকি নিজেদের নাগরিকদের উপর ও। শাসক দল অনুযায়ী প্রয়োগের পরিবর্তন হতে পারে, পদ্ধতির পরিবর্তন হতে পারে, নীতির কোন পরিবর্তন হয়নি তা পরিষ্কার বোঝাই যাচ্ছে।
অভিবাসন সমস্যা বিংশ শতকের প্রথম দিকে পশ্চিম ইউরোপে এবং আমেরিকাতেও মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। প্রথম-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজনিত ক্ষয়ক্ষতিতে ব্যাপক মৃত্যু ও উদারনীতির প্রভাবে অভিবাসীদের জন্য দরজা খুলে দেওয়ার জন্য জনসংখ্যাজনিত অনুপাতের বেশ কিছু বদল ঘটে যার ফলশ্রুতিতে জিদান-আনেল্কাদের পাওয়া। কিন্তু তবুও বিদ্বেষ বাড়ছে, অন্যান্য ঘটনার সাথে সাথে চরম অপপ্রচারও এর কারণ। ২০০৫ সালের ফ্রান্সে দাঙ্গা তার প্রমাণ। এও প্রচার হচ্ছিল যে একসময় অভিবাসী মুসলিমদের সংখ্যা একসময় শ্বেতাঙ্গদের ছাড়িয়ে যাবে। নরওয়েতে ব্রেইভিককৃত হত্যাকাণ্ড এক ভয়াবহ অশনি সঙ্কেত দেয়। চাপা উপনিবেশবাদ আবার কোন ইন্ধন পেয়ে যেকোন সময় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে বোঝা যায়। যে ইউরোপে মধ্যবামপন্থীদের কার্যত ডানপন্থীদের মত আচরণ করতে দেখা গেছে, সেই ইউরোপ মার্কিন আগ্রাসন, অভিবাসন সমস্যা আর বর্তমান আর্থিক মন্দায় যথেষ্ট বিপন্ন বলা চলে।
হালের মুসলিম জাহানের সবচেয়ে বড় খবর আরব বসন্ত_যার নাম ১৯৬৮ সালের প্রাগ শহরের বিক্ষোভ Prague Spring এর সাথে মিলিয়ে রাখা হয়েছে। ২০১০ সালের শেষের দিকে টিউনিশিয়ার এক ফলব্যবসায়ীর আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে ঘনীভূত হওয়া বিক্ষোভে পতন ঘটে সরকারের। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলিতে। মিশরে পতন হয় মুবারকের। ইয়েমেনেও সরকার পতন হয়। অন্যদিকে লিবিয়া ও সিরিয়ায় হিংসাত্মক পরিস্থিতি তৈরি হয়। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হতে পারে এসব স্বৈরাচারী বনাম জনগণের সংঘর্ষ। কিন্তু এর মূল অনেক ভেতরে, অনেক গভীরে। সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম বিবেচ্য বিষয় হল শিয়া-সুন্নি সম্পর্ক। আরব বসন্তের পরিণতি সহ মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান অবস্থার জন্য যা দায়ী। মুসলিম জগতের কর্তৃত্ব নিয়ে শুরু হওয়া এই বিরোধ আগে অনেক রক্ত ঝরালেও হালে বিংশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত স্তিমিত ছিল। এই জন্যেই অনেক শিয়াপন্থী নেতাই পাকিস্তানের উচ্চপদে আসীন ছিলেন। এই স্তিমিত থাকার কারণ হিসেবে তৎকালীন সময়ে ক্রমবর্ধমান মার্ক্সবাদী ও Secularism/ধর্মনিরপেক্ষতার প্রভাবের কথা বলা যায়। ওটোমান শাসনের সময় থেকে আরব জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দেয় ও পতনের পর মুস্তফা কামালের সাফল্যের পর আরো প্রবল হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওটোমান অত্যাচারের অবসানের আশায় আরব নেতৃবৃন্দ মিত্রপক্ষে যোগ দেন। কিন্তু যুদ্ধশেষে উপনিবেশবাদী মিত্রপক্ষ আরব ভুখন্ডকে ভাগাভাগী করে নেয়। নেজদ-হেজাজ(পরবর্তী সৌদি আরব), ইরাকের মত কিছু কিছু অংশে নিজস্ব রাজতন্ত্রী সরকার তৈরি হলেও খুব সামান্যই সার্বভৌমত্ব প্রাপ্ত হয়। তুরস্কে মুস্তফা কামাল, আফগানিস্তানে আমানুল্লাহ খান, ইরানে রেজা শাহ, মরক্কোর আব্দুল করিম, প্রথমে জগ্লুল পাশা ও বেশ কিছু পরে মিশরে নাসেরের উদ্যোগে পশ্চিমি ধাঁচের জাতীয়তাবাদ আমদানি হয়। অন্যান্য কিছু অংশ যেমন কুয়েত, শারজা-আজমন(পরবর্তী আমিরশাহী) থাকে উপনিবেশবাদীদের আয়ত্বে। ইরাক, মিশর, সিরীয়ায় রাজতন্ত্রের পতন হলেও ওটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর আরবরাজ্য গঠন স্বপ্নভুমির মতই বিলীন হয়ে যায়। উলটে অভিবাসী ইহুদিদের স্থায়ী বাসভূমি হিসেবে ইজরায়েলের উত্থ্বান পাকা হয়ে ওঠে। ১৯৪৮এ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে, ১৯৫৬তে ব্রীটেন ও ফ্রান্সের সাথে জোট বেঁধে আর ১৯৬৭তে জোরালো হামলায় আরবজাতীয়তাবাদকে বড় ধাক্কা দেয় ইজরায়েল। ১৯৭৩ এ আনোয়ার সাদাত ‘আল্লাহু আকবর’ রণধ্বণি ফিরিয়ে এনে সীমিত সাফল্য পান। ১৯৭৯ তে ইরানে ইসলামী বিপ্লব মার্কিন-সৌদি-পাকিস্তানি মদতে সুন্নি গোঁড়ামির তোষণে প্রতিপন্ন হয় শিয়া জঙ্গিপনা রূপে। পরিণতিতে ইরান-ইরাক যুদ্ধ, হিজবুল্লাহর উত্থান শিয়া-সুন্নি সম্পর্কে চরম ফাটলগুলো ধরায় যার পেছনে বহির্শক্তির মদত অনঃস্বীকার্য। অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদ ও তথাকথিত আধুনিকতাকে সরিয়ে ইসলামী আদর্শে জাতির পুনর্জীবনের উদ্যোগও দেখা যায়। সুদানে মাহদি আন্দোলনে, সোমালিয়ায় মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহর(যাকে উপনিবেশবাদীরা ‘Mad Mullah’ নাম দেয়) লড়াই এ এধরণের উদ্যোগ দেখা যায়। উপমহাদেশ ও কিছু কিছু জায়গায় ইউরোপের “Christian Democracy”র আদলে দল গড়ার প্রবণতা দেখাযায়। অন্যদিকে উনবিংশ শতকে মুহাম্মাদ আব্দুহ, জামালুদ্দিন আফগানিরা বুদ্ধিজীবি জগতে এই ধরণের প্রচার চালাচ্ছিলেন। ১৯২২ সালে প্রতিষ্ঠা হয় জামিয়াতে ইখওয়ান আল-মুসলেমিন দলের,যাকে বহির্বিশ্ব “Muslim Brotherhood” নামে চেনে। এই দল উপনিবেশবাদীদের ও পরে সদ্য ক্ষমতায় আসা জাতীয়তাবাদীদের যারা পশ্চিমী ধাঁচে শাসন চাইছিলেন তাঁদের মাথাব্যথার কারণ হয়। অন্যদিকে পশ্চিমীদের মিত্র বিভিন্ন রাজপরিবারের মদতপুষ্ট মোল্লাতন্ত্রও, বিশেষত সালাফিতন্ত্র, এঁদের ভালোভাবে নিতে পারেনি। হাসান বান্না, সইদ কুতুবের নেতাদের মেরে ফেলে ও পরে ১৯৮২তে সিরিয়ায় ব্যাপক দমনাভিযান চালিয়েও বিশেষ দমনাভিযান চালিয়েও বিশেষ দমানো যায়নি তাঁর প্রমান পাওয়া যায় আরব বসন্তের সময়ে এঁদের উত্থানে। যে সালাফিতন্ত্র সিরিয়ায় আসাদ-বিরোধী অভিযানকে ইসলামি জিহাদ বলে চালাতে ব্যস্ত, তারাও এই সময় বিশেষ নীরব ছিল। আরব বসন্তের পর সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলগুলিতে ব্যাপক প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করে বহির্শক্তিগুলি। অন্যান্য সঙ্কটের মত মিশরে মুর্সী সরকারের পতনও এই প্রক্রিয়ারই অন্তর্গত এমতাবস্থায় আরব বসন্ত ঠাণ্ডা যুদ্ধেরই এক প্রলম্বন হয়ে উঠেছে।
এর পর????????
এর পরে কি হবে, বোঝা অত্যন্ত জটিল, ভাবাটাও। চীনের আজকের উন্নতি নব্বইএর দশকেও বোঝা যায় নি। এখনও যেমন বোঝা যায়না চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত সম্পর্ক ঠিক কি?
তেমনি অনেক কিছুই বোঝা যায়নি সে সময়। বোঝা যায়নি বার্লিন দেওয়াল ভেঙে পড়লেও জার্মানদের উপর মার্কিন নজরদারি থামবেনা। বোঝা যায়নি লাতিন আমেরিকাতেই মাথা চাড়া দেবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা। সবকিছু মিলিয়ে এটুকুই বলা যায়, ঠাণ্ডাযুদ্ধ কোন দেওয়াল ভেঙে পড়লেও থামেনা। আন্তর্জাতিক শত্রুতা চলতেই থাকে জাতীয় স্বার্থ ও আদর্শগত লক্ষ্যের বোঝা নিয়েই। যাকে অনু-শীতযুদ্ধ বা Post-Cold War বলা চলে।
আবু সঈদ আহমেদ
‘সত্যি’ কাকে বলে? খুব কঠিন প্রশ্ন... হয়তো প্রশ্নটা করতে খুব কষ্ট হওয়ার কথা নয়। কিন্তু উত্তর বেজায় জটিল। উত্তর জটিল মন থেকে বেরোয় তাই হয়তো জটিল। উত্তর জটিল রাস্তা ধরে এগোয় তাই হয়তো জটিল। উত্তর জটিল ভাবে গৃহীত হয় তাই হয়তো জটিল।
এক যে ছিল দেওয়াল। না এভাবে বলা ভুল হলো। এক যে ছিল দেশ। যে সে নয়, প্রবল প্রতাপান্বিত, যুদ্ধক্ষত নিয়েও ছিল সভ্যতার শিখরে। তবুও ভয় পেত উত্তর থেকে আসা প্রবল হানাদারদের। সে দেশের রাজারা, মানে রাজার পর রাজা মিলে একটু একটু করে গড়ে তুল্লেন দেওয়াল। তারপর রাজার পর রাজা এলেন, ক্রমে রাজার দিন ও শেষ হল সেখানে।
আরেক ছিল দেশ। সে দেশ অনেক যুদ্ধজ্বালা সয়ে সয়ে ভেঙ্গে গড়ে চলতে চলতে দেখেছিল আরেক দেওয়াল তৈরি হতে। তখন হারের জ্বালা, টুকরো হওয়ার জ্বালা মেনে নিয়ে দেখতো যারা এক হয়ে তাদের হারিয়েছে, তারা এখন নিজেদের মধ্যে লড়ছে। তাদের মাঝে রয়েছে দেওয়াল, যা শুধু সেই দেশটাকেও নয়, তাদের বিজয়ীদেরও আলাদা করে রেখেছে। কখনো সামনাসামনি ঠোকাঠুকি, কোথাও পর্দার আড়ালে। কালে কালে সেই দেওয়াল ভেঙ্গে গেল। পূর্ব দিকের দেশ আর আলাদা থাকলো না, গোটা ভুখন্ডটা চলে এলো পশ্চিমের পতাকা তলে।
হয়তো এভাবেও শুরু হয়নি...
শুরুর শুরু
প্রাশিয়ার হাতে ফ্রান্সের হারের পর ১৮৭১ সালে পারি/প্যারিসে ক্ষণজীবি রাষ্ট্র প্যারিস কমিউন তৈরি হয়, এবং ধ্বসেও যায়। তার ও আগে থেকে চলছিল এক প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া। মূলত ১৭৮৯ সালে বাস্তিল পতনের পর থেকে ফরাসী সাংসদে সমাজতন্ত্রী, জাতীয়তাবাদী, সাম্যবাদী, নৈরাজ্যবাদী প্রভৃতি মানুষেরা বাম দিকে বসার জন্য বামপন্থী বলে বিবেচিত হন। পরে বহু জায়গাতেই জাতীয়তাবাদীদের ডানপন্থী গন্য করা হয়।
১৪৫৩ সালে ওটোমান/ওসমানীয় তুরকীদের হাতে কন্সটান্টিনোপলের পতনের পর থেকে ইউরোপীয়দের সমুদ্রযাত্রা বৃদ্ধি পায়। স্পেন, পর্তুগাল, ক্রমে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স লেগে পড়ে উপনিবেশ তৈরিতে। তাদের মধেও মাঝে মাঝে সংঘর্ষ (১৫৮৮ স্প্যানিশ আর্মাডা, ১৮১৫ ওয়াটারলু) হত। যোগ দেয় জার্মানি, ইতালি, অস্ট্রিয়া, রাশিয়াও। তার পরে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে উপনিবেশবাদীদের নিজেদের মধ্যে বেধে যায় এক বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ। ইংল্যান্ড/যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, জাপানের মিত্রশক্তি হারিয়ে দেয় জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরী, বুলগারিয়া, ওটোমান তুরকীদের কেন্দ্রীয় জোটকে। রাশিয়া মিত্রপক্ষে যোগ দিলেও রুশ বিপ্লবে জারতন্ত্রের পতনের পর যুদ্ধ থেকে সরে যায়। জার্মানী, তুরস্কেও পতন হয় রাজতন্ত্রের।
উনবিংশ শতকে গৃহযুদ্ধ কাটিয়ে উঠেছিল প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধ ১৭৭৬ সালে ইংল্যান্ডের শাসন থেকে বিচ্ছিন্নতা ঘোষনা করা যুক্তরাষ্ট্র। ক্রমেই পরিচিত হতে থাকে অন্যতম সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী দেশ রূপে। অন্যদিকে রুশ সাম্রাজ্যের পতনের পর একদলীয় শাসনে অন্যতম বড় শক্তি হয়ে ওঠে সোভিয়েত ইউনিয়ন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিপর্যয়ের রেশ কাটতে না কাটতে অর্থনৈতিক মন্দা আছড়ে পড়ে পশ্চিমী দেশগুলিতে। জার্মানী, ইতালীতে উগ্রজাতিবাদকে পুঁজি করে উত্থান হয় হিটলার-মুসোলিনির। জার্মানিতে হিটলারের জাতীয় সমাজতন্ত্রী(Nazi) দলের রোষের বলি হয় বহু ইহুদী। ঘটনা চক্রে বেধে যায় আরেক বিশ্বযুদ্ধ। শান্তিচুক্তি ভেঙ্গে সোভিয়েত আক্রমণের পরিণতিতে হেরে যায় জার্মানী-ইতালি-জাপানের অক্ষশক্তি। সোভিয়েত অধিকৃত অংশ মূল ভূখণ্ডের সাথে মিলতে না পেরে জন্ম নেয় উত্তর কোরিয়া, পুর্ব জার্মানির মত রাষ্ট্র। পুরনো সাম্রাজ্যবাদীরাও আর আগের শক্তিতে থাকলোনা। ১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ১৯৪৯ এ সোভিয়েতের পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার পর পৃথিবী ভাগ হয়ে যেতে লাগলো দুই শক্তির আওতায়।
অন্যদিকে প্রাচীন মহাশক্তি চীন ক্রমদুর্বল হয়ে উপনিবেশবাদীচালিত এক রাজবংশের শাসিত হতে থাকে। ১৯১১ সালের জিঙ্ঘাই বিপ্লবে রাজতন্ত্রের পতন হলেও দুর্বল কিয়দতন্ত্র(Oligocracy) প্রতিবেশী জাপানের দাপট থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৯ সালের বিপ্লবে তাইওয়ান বাদে সমগ্র চীন মাও সে তুং নেতৃত্বাধীন চীনের সাম্যবাদী দলের অধীনে আসে। চীন নাম লেখায় সাম্যবাদী শিবিরে। ফলে পুর্ব ইউরোপ, মধ্য এশিয়া, পুর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ পুর্ব এশিয়ার কিছু জায়গা জুড়ে গড়ে ওঠে একছত্র সমাজতান্ত্রিক শিবির। অন্যদিকে থাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন ধনতন্ত্রী শিবির।
শুরুর সময়
এরপর দুই গোষ্ঠী কখনো সরাসরী সমরে নেমে পড়ে কোরীয়া, ভিয়েতনাম এ। কখনো ছায়াযুদ্ধের করুণ সাক্ষী হয় মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার বহু জায়গা। কখনো বা এই দুই শিবিরের সমর্থনপুষ্ট রাষ্ট্ররা নেমে পড়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে, আমাদের উপমহাদেশ যার নিদারুণ সাক্ষী। কিছু জায়গায় বিবাদমান পক্ষ জোর বাড়াতে হাত ধরেছে এই দুই শিবিরের যেমন মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নি বিরোধ। কখনো এই দুই শিবিরেই ঘটে গেছে ঠান্ডা-গরম লড়াই। চীন-সোভিয়েত, মার্কিন-ফ্রান্স বিরোধ যার নমুনা। দুই শিবির থেকেই অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলিতে পছন্দসই সরকার বসানোর আর অপছন্দের সরকার ফেলে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে। আফগানিস্তানে পছন্দসই সরকার বসাতে চেয়ে সেনা পাঠানোর চরম খেসারত দিয়ে ভেঙ্গে পড়ে সোভিয়েত সঙ্ঘ। সাথে পুর্ব ইউরোপে ও আফ্রিকার কিছু জায়গায় সমাজতন্ত্রী প্রভাব শেষ হয়। কিছু কিছু দেশে মার্ক্সবাদী দল অন্যপন্থা ধরে নেয়।
এবার এখন
১৯৮৯ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে বিভিন্ন দেশে প্রতিবিপ্লবের মধ্যে পৃথিবীর ভারসাম্যের বিপুল পরিবর্তন ঘটে। কিছু জায়গায় ঘটানো ও কিছু জায়গায় আটকানো হয় এই বিপ্লব। এইজন্য যুগোস্লাভিয়া, আলজিরিয়া, চীনে বেধে যায় হিংসাত্মক ঘটনা। ইউরোপ সহ বেশ কিছু জায়গায় আসন হারাতে থাকে বাম ও মধ্যবামেরা। সোভিয়েত পতনের পর মধ্য এশিয়ায় কমবেশী স্বৈরতন্ত্র স্থাপন হয়, ককেশীয় দেশগুলিতে লেগে যায় জাতবাদী ঠোকাঠুকি, পুর্ব ইউরোপ কমবেশি মার্কিন ছাতার তলায় আশ্রয় নেয় । ইয়েলৎসিনের হাত ধরে উদারীকরনের রাস্তায় নামে ভেঙ্গে পড়া রাশিয়া। পুর্বতন সোভিয়েতের কিছু দেশ নিয়ে Commonwealth of Independent States বা CIS তৈরির চেষ্টাও খুব একটা সফল হয়নি। চেকোস্লোভাকিয়া চেক ও স্লোভাক দেশে ভেঙ্গে যায়। অন্যদিকে গৃহযুদ্ধে রক্তস্নাত হয়ে বহু টুকরোয় ভেঙ্গে পড়ে ইতিহাসের পাতায় চলে যায় যুগোস্লাভিয়া। ইরাকের মত কিছু দেশ বেঁকে বসলেও উপসাগরীয় যুদ্ধ, বেল্গ্রেড আক্রমণ জাতীয় ঘটনার বিশ্বের অপ্রতিদ্বন্দ্বী মহাশক্তিরুপে নিজেকে জাহির করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
অন্যদিকে আশির দশকের স্বৈরতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক উদারীকরণের পথ ধরে পথ চলতে থাকে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন। ঐক্যবদ্ধ জার্মানিও চলতে থাকে ধনতন্ত্রের পথ ধরে।
যা দেখতে পাচ্ছি, যা দেখছি,
“বর্তমান বিশ্বে অপ্রতিদ্বন্দ্বী মহাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যারা কর্মরফতানি করে আর যুগোস্লাভিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়াতে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। আর ইংল্যন্ড, অস্ট্রেলিয়ায় কিছু হমরা চোমরা ফিরিঙ্গি দাপাদাপি করলেও ওদের সাথে কাজ করা যায়। রাশিয়া থেকে আমাদের অস্ত্র আসে। আর আমাদের সম্পদ্গুলো কালো টাকা হয়ে জমা হয় সুইসব্যাঙ্কে। জাপান-কোরিয়ার লোকেরা Technologyতে কাঁপিয়ে দেয়। ১৯৬২তে ভারত আক্রমণকারী চীন অর্থনৈতিক সংস্কার করে এখন সস্তা মালের Supermarket যদিও সেখানের শ্ত্রুকমিউনিস্টরা অরুণাচল দাবী করে। অন্যদিকে ভারতের পশ্চিম থেকে ইউরোপের দক্ষিণ পর্যন্ত মরুপ্রধান জায়গাগুলিতে হিংসাধস্ত তৈলসম্পন্ন শেখওয়ালা মুসলমানরা থাকে। আমাদের চেয়েও গরিব লোকেরা থাকে আফ্রিকাতে। আর লাতিন আমেরিকা মানেই ঝিক্কু চিকা।
এদিকে বাংলাদেশ থেকে গাদাগুচ্ছের অনুপ্রবেশকারী আসে, নেপাল ভুটানকে তো বাদ ই দিলাম। আর পাকিস্তান নামক নরক থেকে শয়তানেরা ষড়যন্ত্র করে আর এদেশের তাদের কিছু বেরাদরের মদতে সেগুলো সফল হয়। শ্রীলঙ্কায় রাবণের বংশ ধরে ধরে তামিল মারে।”
এখনকার দুনিয়া নিয়ে মোটামোটি এই ধারণায় প্রচার করে প্রচারমাধ্যম, আর এক বিরাট অংশের লোকের ধারণাও তার খুব একটা বাইরে নয়।
যা দেখতে পাচ্ছিনা, দেখছিওনা
যা দেখি ও দেখানো হয় তাঁর বাইরেও কিছু সত্যি থেকে যায়, সোভিয়েত পতনেই যে বামপন্থার বা ঠান্ডাযুদ্ধের ইতি সে ভাবার খুব একটা কারণ নেই। ১৯৯৮ সাল থেকেই বেশ কিছু বিকল্প প্রকট হয়ে উঠতে থাকে। এই বছরই জার্মানিতে পতন হয় ডানপন্থী সরকারের। ভেনেজুয়েলায় সাভেজের জয়ের সাথে সাথে শুরু হয় নতুন যুগের। যাতে সামিল হয় ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডোর, বলিভিয়া, চিলি, পেরু, এল সাল্ভাদোর, হন্ডুরাস, মেক্সিকো, প্যারাগুয়ের মত দেশ। এইসব দেশে জাতীয়তাবাদীরাও গলা মেলান বামপন্থীদের সাথে। ২০০৫ সালে BBC র সমীক্ষা অনুযায়ী লাতিন আমেরিকার ৭৫ শতাংশ মানুষ ছয় বছর ধরে রয়েছেন বাম ছাতার তলায়। কিছু অত্যুৎসাহী রাষ্ট্র নিজেদের মধ্যে সাইমন বলিভার নামাঙ্কিত ‘বলিভারীয় জোট’ গড়েছে। এই ঘটনাক্রমকে ওয়াকিবহাল মহল Pink Tide নাম দিয়েছেন। ২০০২ এ ভেনেজুয়েলায় ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান, ২০০৮ এ হন্ডুরাস ও ২০১০ এ প্যারাগুয়েতে সরকার ফেলে দিয়েও এর যাত্রা থামানো যায়নি। চিলির নির্বাচনের সাম্প্রতিক ফলাফলই যার প্রমাণ।
অন্যদিকে Composite Index of National Capability নামক সূচক যাতে কোন দেশের শক্তি-সম্ভাবনা জানা যায় তাতেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের থেকে পিছিয়ে পড়েছে। ভারত আছে এই দুই দেশের পরেই। তার পর আসছে জাপান, রাশিয়া, ব্রিটেন, জার্মানির মত দেশ। রাশিয়া ও চীনের উদ্যোগে গঠিত হয় Shanghai Co-Operation Organisation। এতে হাত মেলায় মধ্য এশিয়ার কিছু দেশ। জুডো বিশারদ পুতিন প্রভাবিত রাশিয়া একবিংশ শতকের শুরু থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে , বেলারুশ ও ইউক্রেনেও এখন রুশ প্রভাব বিস্তার এর লক্ষণ দেখা যায়। ঠাণ্ডা যুদ্ধের প্রতিপক্ষদের মধ্যে মাঝে মাঝেই সুর চড়তে থাকে।
এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতিতে না হলেও শাসনব্যবস্থায় সমাজতন্ত্র প্রয়োগের নতুন রাস্তা দেখিয়েছে ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড এর মত নর্ডিক দেশসমুহ। কল্যাণকামী রাষ্ট্র বা Welfare State এর ধারণাকে সফলভাবে কাজে লাগিয়েছে এই দেশ। মূলত জনসংখ্যা কম হওয়ার দরুণ এই সাফল্য এসেছে। পারিবারিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের এই হস্তক্ষেপ বাইরের দেশের অনেকেরই অনভিপ্রেত। অন্যদিকে এখানকার বামদলগুলিও Euro-communism বা নতুন আঙ্গিকসম্পন্ন স্থানীয় দাবীরেখে সাম্যবাদের এর সফল উদাহরণ দেখিয়েছে। পরিবেশবাদী Green Party গুলিও যথেষ্ট সফল।
১৯৮৪ সালের মধ্যেই বিশেষত ইউরোপের রাজনীতিতে পরিবেশভাবনার জায়গা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ১৯৮৯ ও ১৯৯৪ এ ইউরোপীয় সংসদে অন্যভাবনার দলের সঙ্গে জোট বাঁধলেও পরে তারা একলা চলতে থাকে। অনেক দেশে মধ্যবাম ও কিছু দেশে বামেদের সাথে পরিবেশবাদীদের জোট বাধতে দেখা যায়। ১৯৮৯ সালের পর থেকে জাতবাদী দলগুলি ইউরোপে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে, ১৯৯৪, ১৯৯৯ ও ২০০৪ এ জায়গা না পেলেও ২০০৯ এ আবার ফিরে আসতে দেখাগেছে রক্ষণশীল পুজিবাদীদের। সমকামীতা বেশ কিছুদিন ধরে পশ্চিমিবিশ্বে রাজনৈতিক বিষয়। বেশ কিছু আন্দোলন ও সমকামীর সমাজজীবনে প্রভাব এর জন্য দায়ী। এর প্রভাব ভারতের রাজনীতি ও প্রচারমাধ্যমেও পড়েছে। মূলত সমকামীতাকে আধুনিক ও প্রগতিশীল বলে প্রচারের কারণে পরিবেশ ও পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের মত বিষয়গুলি পেছনে পড়ে যাচ্ছে।
Campaign for Nuclear Disarmament বা CND পরমাণু অস্ত্রবিরোধীরা অনেকদিন ধরেই শক্তিসালী দেশগুলোর মাথাব্যথার কারণ। এই যুদ্ধবিরোধীরা অনেক সময়ই বিরোধী রাষ্ট্রনায়কদের থেকেও বেশি বিপজ্জনক প্রমাণিত হয়েছেন বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে। গত ইরাক যুদ্ধের সময় থেকে প্রস্তাবিত সিরিয়া আক্রমণ এঁদের রাস্তায় সক্রিয় ভাবে নামতে দেখা গেছে। এঁদের প্রভাবেই মাঝে মাঝে ইউরোপিয়ান সঙ্ঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধ বাধে। এসবের সাথে যুক্ত হয়েছে তথ্যফাঁস বা Whistle blowing আন্দোলন জুলিয়ান অ্যাসেঞ্জ-এডওয়ার্ড স্নোডেনের দৌলতে ধনতন্ত্রী দুনিয়ার অনেক কেচ্ছাই ফাঁস হয়ে গেছে। Prism Project এর কুকীর্তি ‘BIG BROTHER is watching’ প্রবাদকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে। মার্কিন নজরদারি শুধু শত্রুদেশেই নয়, চলছে মিত্র জার্মানি ফ্রান্স এমনকি নিজেদের নাগরিকদের উপর ও। শাসক দল অনুযায়ী প্রয়োগের পরিবর্তন হতে পারে, পদ্ধতির পরিবর্তন হতে পারে, নীতির কোন পরিবর্তন হয়নি তা পরিষ্কার বোঝাই যাচ্ছে।
অভিবাসন সমস্যা বিংশ শতকের প্রথম দিকে পশ্চিম ইউরোপে এবং আমেরিকাতেও মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। প্রথম-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজনিত ক্ষয়ক্ষতিতে ব্যাপক মৃত্যু ও উদারনীতির প্রভাবে অভিবাসীদের জন্য দরজা খুলে দেওয়ার জন্য জনসংখ্যাজনিত অনুপাতের বেশ কিছু বদল ঘটে যার ফলশ্রুতিতে জিদান-আনেল্কাদের পাওয়া। কিন্তু তবুও বিদ্বেষ বাড়ছে, অন্যান্য ঘটনার সাথে সাথে চরম অপপ্রচারও এর কারণ। ২০০৫ সালের ফ্রান্সে দাঙ্গা তার প্রমাণ। এও প্রচার হচ্ছিল যে একসময় অভিবাসী মুসলিমদের সংখ্যা একসময় শ্বেতাঙ্গদের ছাড়িয়ে যাবে। নরওয়েতে ব্রেইভিককৃত হত্যাকাণ্ড এক ভয়াবহ অশনি সঙ্কেত দেয়। চাপা উপনিবেশবাদ আবার কোন ইন্ধন পেয়ে যেকোন সময় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে বোঝা যায়। যে ইউরোপে মধ্যবামপন্থীদের কার্যত ডানপন্থীদের মত আচরণ করতে দেখা গেছে, সেই ইউরোপ মার্কিন আগ্রাসন, অভিবাসন সমস্যা আর বর্তমান আর্থিক মন্দায় যথেষ্ট বিপন্ন বলা চলে।
হালের মুসলিম জাহানের সবচেয়ে বড় খবর আরব বসন্ত_যার নাম ১৯৬৮ সালের প্রাগ শহরের বিক্ষোভ Prague Spring এর সাথে মিলিয়ে রাখা হয়েছে। ২০১০ সালের শেষের দিকে টিউনিশিয়ার এক ফলব্যবসায়ীর আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে ঘনীভূত হওয়া বিক্ষোভে পতন ঘটে সরকারের। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলিতে। মিশরে পতন হয় মুবারকের। ইয়েমেনেও সরকার পতন হয়। অন্যদিকে লিবিয়া ও সিরিয়ায় হিংসাত্মক পরিস্থিতি তৈরি হয়। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হতে পারে এসব স্বৈরাচারী বনাম জনগণের সংঘর্ষ। কিন্তু এর মূল অনেক ভেতরে, অনেক গভীরে। সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম বিবেচ্য বিষয় হল শিয়া-সুন্নি সম্পর্ক। আরব বসন্তের পরিণতি সহ মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান অবস্থার জন্য যা দায়ী। মুসলিম জগতের কর্তৃত্ব নিয়ে শুরু হওয়া এই বিরোধ আগে অনেক রক্ত ঝরালেও হালে বিংশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত স্তিমিত ছিল। এই জন্যেই অনেক শিয়াপন্থী নেতাই পাকিস্তানের উচ্চপদে আসীন ছিলেন। এই স্তিমিত থাকার কারণ হিসেবে তৎকালীন সময়ে ক্রমবর্ধমান মার্ক্সবাদী ও Secularism/ধর্মনিরপেক্ষতার প্রভাবের কথা বলা যায়। ওটোমান শাসনের সময় থেকে আরব জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দেয় ও পতনের পর মুস্তফা কামালের সাফল্যের পর আরো প্রবল হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওটোমান অত্যাচারের অবসানের আশায় আরব নেতৃবৃন্দ মিত্রপক্ষে যোগ দেন। কিন্তু যুদ্ধশেষে উপনিবেশবাদী মিত্রপক্ষ আরব ভুখন্ডকে ভাগাভাগী করে নেয়। নেজদ-হেজাজ(পরবর্তী সৌদি আরব), ইরাকের মত কিছু কিছু অংশে নিজস্ব রাজতন্ত্রী সরকার তৈরি হলেও খুব সামান্যই সার্বভৌমত্ব প্রাপ্ত হয়। তুরস্কে মুস্তফা কামাল, আফগানিস্তানে আমানুল্লাহ খান, ইরানে রেজা শাহ, মরক্কোর আব্দুল করিম, প্রথমে জগ্লুল পাশা ও বেশ কিছু পরে মিশরে নাসেরের উদ্যোগে পশ্চিমি ধাঁচের জাতীয়তাবাদ আমদানি হয়। অন্যান্য কিছু অংশ যেমন কুয়েত, শারজা-আজমন(পরবর্তী আমিরশাহী) থাকে উপনিবেশবাদীদের আয়ত্বে। ইরাক, মিশর, সিরীয়ায় রাজতন্ত্রের পতন হলেও ওটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর আরবরাজ্য গঠন স্বপ্নভুমির মতই বিলীন হয়ে যায়। উলটে অভিবাসী ইহুদিদের স্থায়ী বাসভূমি হিসেবে ইজরায়েলের উত্থ্বান পাকা হয়ে ওঠে। ১৯৪৮এ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে, ১৯৫৬তে ব্রীটেন ও ফ্রান্সের সাথে জোট বেঁধে আর ১৯৬৭তে জোরালো হামলায় আরবজাতীয়তাবাদকে বড় ধাক্কা দেয় ইজরায়েল। ১৯৭৩ এ আনোয়ার সাদাত ‘আল্লাহু আকবর’ রণধ্বণি ফিরিয়ে এনে সীমিত সাফল্য পান। ১৯৭৯ তে ইরানে ইসলামী বিপ্লব মার্কিন-সৌদি-পাকিস্তানি মদতে সুন্নি গোঁড়ামির তোষণে প্রতিপন্ন হয় শিয়া জঙ্গিপনা রূপে। পরিণতিতে ইরান-ইরাক যুদ্ধ, হিজবুল্লাহর উত্থান শিয়া-সুন্নি সম্পর্কে চরম ফাটলগুলো ধরায় যার পেছনে বহির্শক্তির মদত অনঃস্বীকার্য। অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদ ও তথাকথিত আধুনিকতাকে সরিয়ে ইসলামী আদর্শে জাতির পুনর্জীবনের উদ্যোগও দেখা যায়। সুদানে মাহদি আন্দোলনে, সোমালিয়ায় মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহর(যাকে উপনিবেশবাদীরা ‘Mad Mullah’ নাম দেয়) লড়াই এ এধরণের উদ্যোগ দেখা যায়। উপমহাদেশ ও কিছু কিছু জায়গায় ইউরোপের “Christian Democracy”র আদলে দল গড়ার প্রবণতা দেখাযায়। অন্যদিকে উনবিংশ শতকে মুহাম্মাদ আব্দুহ, জামালুদ্দিন আফগানিরা বুদ্ধিজীবি জগতে এই ধরণের প্রচার চালাচ্ছিলেন। ১৯২২ সালে প্রতিষ্ঠা হয় জামিয়াতে ইখওয়ান আল-মুসলেমিন দলের,যাকে বহির্বিশ্ব “Muslim Brotherhood” নামে চেনে। এই দল উপনিবেশবাদীদের ও পরে সদ্য ক্ষমতায় আসা জাতীয়তাবাদীদের যারা পশ্চিমী ধাঁচে শাসন চাইছিলেন তাঁদের মাথাব্যথার কারণ হয়। অন্যদিকে পশ্চিমীদের মিত্র বিভিন্ন রাজপরিবারের মদতপুষ্ট মোল্লাতন্ত্রও, বিশেষত সালাফিতন্ত্র, এঁদের ভালোভাবে নিতে পারেনি। হাসান বান্না, সইদ কুতুবের নেতাদের মেরে ফেলে ও পরে ১৯৮২তে সিরিয়ায় ব্যাপক দমনাভিযান চালিয়েও বিশেষ দমনাভিযান চালিয়েও বিশেষ দমানো যায়নি তাঁর প্রমান পাওয়া যায় আরব বসন্তের সময়ে এঁদের উত্থানে। যে সালাফিতন্ত্র সিরিয়ায় আসাদ-বিরোধী অভিযানকে ইসলামি জিহাদ বলে চালাতে ব্যস্ত, তারাও এই সময় বিশেষ নীরব ছিল। আরব বসন্তের পর সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলগুলিতে ব্যাপক প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করে বহির্শক্তিগুলি। অন্যান্য সঙ্কটের মত মিশরে মুর্সী সরকারের পতনও এই প্রক্রিয়ারই অন্তর্গত এমতাবস্থায় আরব বসন্ত ঠাণ্ডা যুদ্ধেরই এক প্রলম্বন হয়ে উঠেছে।
এর পর????????
এর পরে কি হবে, বোঝা অত্যন্ত জটিল, ভাবাটাও। চীনের আজকের উন্নতি নব্বইএর দশকেও বোঝা যায় নি। এখনও যেমন বোঝা যায়না চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত সম্পর্ক ঠিক কি?
তেমনি অনেক কিছুই বোঝা যায়নি সে সময়। বোঝা যায়নি বার্লিন দেওয়াল ভেঙে পড়লেও জার্মানদের উপর মার্কিন নজরদারি থামবেনা। বোঝা যায়নি লাতিন আমেরিকাতেই মাথা চাড়া দেবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা। সবকিছু মিলিয়ে এটুকুই বলা যায়, ঠাণ্ডাযুদ্ধ কোন দেওয়াল ভেঙে পড়লেও থামেনা। আন্তর্জাতিক শত্রুতা চলতেই থাকে জাতীয় স্বার্থ ও আদর্শগত লক্ষ্যের বোঝা নিয়েই। যাকে অনু-শীতযুদ্ধ বা Post-Cold War বলা চলে।
আবু সঈদ আহমেদ
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
এস,বি, (পিটুল) ১৬/০৫/২০১৪ধন্যবাদ কবি।
-
তাইবুল ইসলাম ১৫/০৫/২০১৪প্রথমত , আমরা সবই জানি আবার কিছুই জানিনা
..............
আর সর্ব শেষে আমরা কতটুকু জানি তাই জানিনা
একারনে যেকোন ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপই চরম আতঙ্কের
শুভেচ্ছা রইলো