www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

পরিচ্ছন্ন জীবন।

স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিজের বিদায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলের সামনে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তা আজও সেদিনের উপস্থিত সকলের হৃদয়ে গাঁথা রহিয়াছে। স্যার মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতার এক পর্যায়ে থামিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া, দুঃখ প্রকাশ করিয়া বলিলেন, কিছুদিন আগে, স্কুলে না আসলে আমাকে জবাবদিহি করতে হতো। অথচ আজকের পর থেকে এই স্কুলে আসার জন্য কেউ বলবেনা আমাকে। বরং আসতে নিষেধ করা হবে। এটাই নিয়ম। আমার পূর্বেও অনেকের সাথে এরকম ঘটেছে, আজ আমার সাথে ঘটছে, পরবর্তীতে আরও অনেকের সাথে ঘটবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আসলে একটা সত্য কথা হলো এই যে, আমরা যতই অন্যের কঠিন পরিস্থিতিতে সান্ত্বনা দিই, নিজের কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সত্যই অনেক কঠিন ব্যাপার।
আসলে বিদায় শব্দটাই হৃদয়-যন্ত্রণাদায়ক শব্দ। এটাকে এভাবে বলা যায়, বি+দায়। বা, বেদনা+ দায়ক। ছোটবেলায় যখন প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিদায় নিয়েছি তখন অনেক কষ্ট হলেও পরক্ষণেই মনে সান্ত্বনা পেয়েছি যে নতুন স্কুলে যাব। আবার যখন মাধ্যমিক থেকে বিদায় নিয়েছি তখন অনেক কষ্টের পরেও সান্ত্বনা পেয়েছি যে কলেজ আছে। যখন ছাত্রজীবন শেষ হয়েছে তখনও আনন্দ হয়েছে কর্মজীবনে আরেক নতুন অভিজ্ঞতা আছে। এভাবে যখনই একটা থেকে বিদায় নিয়েছি তখনই আরেকটার আগাম ঘ্রাণ পেয়েছি। কিন্তু আজ যখন কর্মজীবনও শেষ হতে চলেছে তখন আর সান্ত্বনা পাব কিসে? মৃত্যুর উপর তো আর সত্য নেই। বিদায়টা একদিন চিরবিদায়ে পরিণত হবে।
এতদিন পর্যন্ত আমার চাকুরী ছিল, আমি এই স্কুলের শিক্ষক ছিলাম, আমার অনেক ছাত্র ছিল, সহকর্মী ছিল এই বৃদ্ধ বয়সে স্কুলের কাজ যতটুকুই করি অন্তত নিজের সময় কাটাতে পারতাম। আর এখন আমার ছাত্র, সহকর্মী শিক্ষকবৃন্দ সকলেই থাকবে কিন্তু দেখা হলে দূর দিয়ে পথ হাটার চেষ্টা করবে পাছে গল্প করে সময় নষ্ট হয়। জগতে সকলেই মহাব্যাস্ত। একদিন আমিও হয়তো এরকম ব্যাস্ত ছিলাম একসময় কাজের চাপে অবকাশ পেলে যে আমি মহা খুশি হতাম সেই আমি আজ জীবনের সামনের এত দীর্ঘ অবকাশ দেখে ভীত।
আমাদের সমাজটা বড় অদ্ভুত। সমাজ আমাদের খাওয়ায়ও না পড়ায়ও না তারপরেও এই সমাজের নিতী মেনে চলতে আমরা সকলেই বাধ্য। আর এই নিতীতে কারো আপত্তি, অভিযোগ বা আপিল কার্যকর হয় না। দুবেলা না খেয়ে থাকলে এ সমাজ দেখতে আসবে না। অথচ ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে কেউ চুরি করলেই এ সমাজ ছুটে আসবে বিচার করতে। এমনি সব নিয়ম এ সমাজের। হলেও কিছু করার নেই আমাদের। প্রকৃতি যা বেধে দিয়েছে তা মানতে আমরা সকলেই বাধ্য।
তারপরেও আমাদের শিক্ষকদের জীবন একটু অন্যরকম। দৈনন্দিন প্রতিটা কাজ আমাদের খুব গুরুত্ব দিয়ে করতে হয়। একটা কাজ করবার পূর্বে তা দশবার ভাবতে হয়। কারন, দশটা ছাত্র আমাদের অনুসরণ করে, দশটা অভিভাবক আমাদের লক্ষ্য করে আর এই সমাজের দশটা মানুষও আমদের পরীক্ষা করে। দশটা ভালো কাজ করলে আমাদের কেউ পুরস্কৃত করতে আসেনা অথচ কোনকারনে যদি একটা ভুল হয়ে যায় তাহলে পিছনে হাজারো সমালোচনা শুরু হয়ে যায়, হাজারটা লোকের কাছে আমাদের কৈফিয়ত দিতে হয়। সবাই বলবে আপনারা শিক্ষিত মানুষ, আপনারা এ ধরনের ভুল কেন করবেন?
তবে এইটুকু অন্তত গর্ব করে বলতে পারি এই শিক্ষিত সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে আমাদের বড় ভূমিকা রয়েছে। আবার পরক্ষণেই মনে হয় তাতে আমাদের লাভ কোথায়? আমরা এই সমাজ গড়ি আবার আমরা এই সমাজের দ্বারাই নির্যাতিত হই।
আচ্ছা, ভাবুন তো আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যে সকল অফিসাররা আছেন তারাও তো একদিন ছাত্র ছিলেন। আমাদের মতো শিক্ষকদের কাছ থেকেই তারা শিক্ষা লাভ করেছেন। সেই সুত্রে তারা তো আমাদেরও ছাত্র। অথচ তারা আমাদের কাছে দায়বদ্ধ নয়, আমরাই তাদের কাছে দায়বদ্ধ। হ্যাঁ, মানছি তারা নিজ যোগ্যতাবলে তাদের পদে গিয়েছেন কিন্তু তাদের ঐ যোগ্যতার পিছনেও আমাদের মতো শিক্ষকেরই অবদান আছে। আমরা আমাদের ছাত্রদের কাছে দায়বদ্ধ। আমরা শিক্ষক, আমাদের অভিভাবকও আমরাই তৈরি করি।
এসব তো গেলই। যদি আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের কথা বলি, তাহলে দিনশেষে আমরা কৃপণ। কিন্তু কাউ এটুকু বোঝেনা যা আমরা কৃপণ হতে বাধ্য। আমাদের মতো স্কুল-শিক্ষকদের চেয়ে একটা মুদি দোকানের দোকানদার মাসে অনেক বেশি রোজগার করে। অথচ, যখন মহল্লার কোণ কাজের জন্য চাঁদা উঠানো হয় তখন আমাদেরই বেশি চাঁদা দিতে হয়। কারণ সবলোকে শুধু এটাই দেখে আমরা সরকারের-অধীনে চাকুরী করি। কিন্তু এটাও কারো চোখে পড়েনা আমাদের আয় এমনিতেই কম আবার খরচটাও অনেক বেশি। কোন নিমন্ত্রণ অনুষ্ঠানে একজন দোকানদার বা একজন ছোট ব্যবসায়ী লুঙ্গি-গেঞ্জি পরিধান করেও অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারে। কিন্তু আমাদের পোশাক পরিধানের ক্ষেত্রেও বাঁধাধরা নিয়ম দিয়েছে এই সমাজ। আবার ঐ অনুষ্ঠানেই যদি ঐ ব্যাক্তি এক হাজার টাকা উপহার দেয় তাহলে আমরা যদি সেখানে কমপক্ষে দুই হাজার টাকা উপহার না দিই তাহলে সেটিও লোকচক্ষু ফাকি দেয় না। ব্যবসা এমনকি কিছু চাকুরীতেও অসৎ উপায়ে টাকা কামানোর অনেক পন্থা রয়েছে। কিন্তু আমাদের শিক্ষকতা পেশায় অসৎ উপার্জনের উদ্দেশ্যে কেউ আসেনা। আমার মনে হয়, কেউ চাইলেও বোধ হয় সেই সুযোগটা এখানে নেই।
মহল্লার একজন সাধারণ ব্যবসায়ীরও বড় বাড়ি, গাড়ি আছে। এক বছর ভালো ব্যবসা করলে তাদের পাঁচ বছর বসে বসে খাওয়ার সামর্থ্য হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের মতো শিক্ষকদের স্কুল থেকে ফিরে বিকেলে কৃষকদের সাথে মাঠে গিয়ে চাষ করতে হয়। আর যার বাবা পর্যাপ্ত জমি রেখে যায়নি, তার তো দশ বছর চাকুরী করেও এক শতক জমি কিনবার সামর্থ্য হয় না। আয় বুঝে ব্যয় করতে গিয়ে আমরা তো আর সাধে কৃপণ হই না। বড়রা তো বলে গেছেন আয় বুঝে ব্যয় করতে। তবে আমি এটুকু বলতে পারি আমাদের মতো যাদের আয় তারা যদি আয় বুঝে ব্যয় করেন, তাহলে আমাদের চেয়ে পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করতে পারবেন এমন মানুষ খুব কম আছে।
আশেপাশের লোকজন মনে করেন আমরা অনেক টাকা রোজগার করি আর তাই আমরা অনেক সুখেও আছি। আসলে আমরা অনেক টাকা রোজগার করতে না পারলেও সুখে জীবন যাপন করতে পারি। এই মন্ত্রটা আমরা জানি। অল্প আয়ের মধ্যে, অনেক বাধ্যবাধকতার ভিতরেও আমরা একটি সুন্দর জীবনের প্রতিনিধিত্ব করি। আমরা এই সমাজকে অন্তত এইটুকু দেখাতে সক্ষম হয়েছি যে, অল্প টাকার মধ্যেও একটা পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করা যায়। একজন অশিক্ষিত ব্যবসায়ী, যিনি মাসে আমাদের চেয়ে তিনগুণ রোজগার করেন তিনি মোটেও আমাদের চেয়ে তিনগুন সুখে জীবন যাপন করতে পারেন না। বরং আমরাই তাদের চেয়ে বেশি সুখী আর সুন্দর জীবন যাপন করি। আমাদের তবু পথিমাঝে দশটা লোকে সালাম দেয়। এটা আমার অহংকার নয়, মানুষ মানুষকে সালাম দিয়েই থাকে। কিন্তু ছাত্ররা যখন শিক্ষকদের সালাম দেয় তখন ‘আসসালামু আলাইকুম’ এর পরে সম্মানযুক্ত ‘স্যার’ কথাটার ব্যাবহার হয়। আমরা দেশের কোণ মন্ত্রী-আমলাও নয়, আবার তাদের সমপর্যায়ের কোণ অফিসারও নায়। তারপরেও আমাদের স্যার বলে ডাকা হয়। আমার গর্ব হয় আমার পেশা নিয়ে।তবে এটাও সত্য, বর্তমানে কিছু অসৎ শিক্ষকদের জন্য সকল শিক্ষকদের সম্মান ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। যদি তাই হয় তাহলে বলে রাখি, ওরা শিক্ষক নয়। যে দেশে স্কুল খুলে ব্যবসা করা হয়, সে দেশে শিক্ষক সাজাও যায়।
অল্প আয়ের মধ্যে একটি গোছালো জীবন, হাজারো ধরাবাঁধা নিয়মের মধ্যে একটি গোছালো জীবন, ছোট পদে থেকে বড় সম্মানিত জীবন। হ্যাঁ, এটাই একজন শিক্ষকের জীবন।
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ৪৬১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৮/১০/২০২১

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • ড. সুলতান আশরাফী ২৪/১১/২০২১
    সাবলীল, সুন্দর উপস্থাপন।
  • আশরাফুল হক মহিন ১১/১১/২০২১
    ভালো লাগলো
  • সুন্দর।
  • সুন্দর ভাবনার প্রকাশ
  • ভাল।
 
Quantcast