আসামি কথন
আমজাদ মিয়ার জেষ্ঠ্য মেয়ের শুভ বিবাহ আজ। আমন্ত্রিত লোকজন প্রায় সকলেই উপস্থিত হইয়াছেন। বাড়ির লোকজনও প্রায় সকলেই প্রস্তুত। কনে সাজানোর কার্যও সম্পন্ন হইয়াছে। রাস্তায় বরযাত্রীর গাড়ি দৃশ্যমান হইয়াছে। বাড়ির সকলেই খুবই আনন্দিত। আমজাদ মিয়াও খুবই আনন্দিত। বড় মেয়ের বিয়ে বলে কথা। সকলেই নতুন পোশাক পরিধান করিয়াছে। ভাঁড়ারে খাবারও প্রস্তুত। কিন্তু যখন গাড়ি হইতে বর নামিল তখনই আমজাদ মিয়ার গোয়ালের পিছনের আমগাছ হইতে বাধন মুক্ত করিয়া বড় গরুটা ছুটিয়া আসিয়া বরের সামনে উপস্থিত সকলকে তাড়া করিয়া, ভয় দেখাইয়া একমুহুর্তে হাঙ্গামা বাধিয়া ফেলিল। ঘটনাটি আমজাদ মিয়ার সম্মানে আঘাত হানিল। নতুন জামাই, এত এত আমন্ত্রিত লোকজন ছি! ছি! সকলের কাছে আমজাদ মিয়ার নিজেকে ছোট বোধ হইল। আমজাদ মিয়ার ছেলে আর দুজন মিলিয়া লালী’কে গাছের সাথে বাধিয়া পিটাইতে শুরু করিল। কিছুক্ষণ পিটানোর পর লালী’র হাম্বা! হাম্বা! চিৎকার শুনিয়া আমজাদ মিয়ার একটু মায়া হইল। হাজার হোক, বহুদিন যাবৎ আমজাদ মিয়া লালীকে পালন করিয়া আসিতেছিলেন। তাহার সকল ভাষা আমজাদ মিয়া বোঝেন। আমজাদ মিয়া কাছে গিয়ে ছেলেকে নিষেধ করিলেন লালীকে পিটাইতে। লালী তখন আমজাদ মিয়াকে দেখিয়া এমনভাবে হাম্বা! বলিয়া চিৎকার করিল, আমজাদ মিয়া তাহার মধ্যে এমনটা বুঝিলেন, “আমাকে মারছ কেন? আমি কি অপরাধ করেছি?
আমজাদ মিয়া কর্কশ স্বরে চেঁচাইয়া উঠিলেন, আবার বলছিস, কি অপরাধ করেছিস। আমার মান-সম্মানের কিছু তো রাখিসনি। মন চাচ্ছে তোকে’’’’’’’
লালী আবার হাম্বা! বলিয়া চিৎকার করিল। এতে আমজাদ মিয়া যা বুঝিলেন, তা অনেকটা এরকম, আমাকে তোমরা মারছ এতে আমার কোন আফসোস নেই। আমার আফসোস হয় তোমাদের মানবজাতির বিবেক দেখে। তোমরা শুধু নিচু-জাতদের শোষণই করতে শিখেছ। আর তোমাদের শোষণ সইতে সইতে এখন তোমাদের উঁচু জাতদের উৎসব-আনন্দ দেখলে আমাদের সহ্য হয়না। তোমাদের যত উৎসব-আনন্দ আমাদের তত মৃত্যু আর যন্ত্রণা। আজ আমার ছেলেকে শেষ করেছ, আর তোমার ছোট মেয়ের বিয়েতে হয়তো আমাকেও শেষ করবে। এরকম বারবারই আমাদের কেও না কেও মরবে শুধু তোমাদের আনন্দ দেওয়ার জন্য। এই তো গত মাসে তোমাদের একটা ছেলে সন্তান হয়েছিল আমার একটা ছেলেকে জবাহ করেছ। কিন্তু ছয় মাস আগে আমার যখন ঐ সন্তান হয়েছিল তখন তো তার জন্ম উৎসবে এরকম আনন্দ করতে হয়নি। আর এখনই কি যেন বলছিলে, তোমার কি যেন করতে মন চাচ্ছে ! হ্যাঁ তোমাদের তো অনেক কিছুই করতে মন চায়। আর তোমাদের ইচ্ছের দাম আছে। তোমরা ইচ্ছে করলে সবই করতে পারো। আর আমাদের মতো নিচু জাতদের ইচ্ছা অনিচ্ছা সবই তোমাদের হাতে বন্দি।
আমজাদ মিয়া বলিলেন, আমি তোকে এত বছর পালতেছি, খাবার দিচ্ছি, তারপরও তুই এত মানুষের মধ্যে আমাকে অপমান করলি কেন? তুই তো শাস্তি পাবিই—
লালী তাহার নিজস্ব ভাষাতে আমজাদ মিয়াকে এমনটা বুঝাইতে চেষ্টা করিল, হ্যাঁ, আমি তো শাস্তি পাবই। আমি অপরাধ করেছি। তোমার সম্মানে আঘাত করেছি। তোমাদের সম্মান তো সমাজের অনেক উপরে। সেখানে আমার মতো নিচু-জাত হস্তক্ষেপ করেছে শাস্তি তো তাকে পেতেই হবে। তুমি অন্যায় কিছু বলোনি। কারণ তোমাদের মানবাদালত অবশ্য এটাই রায় দিবে। কারণ তোমাদের বিবেকাদালত এত নিচ পর্যন্ত খুটে দেখে সময় অপচয় করতে নারাজ। এত নিচ পর্যন্ত তোমাদের আদালতের দৃষ্টি পড়েনা। না পড়ারই কথা। যেখানে ট্যাঙ্কের গোড়ায় তালা দেওয়া থাকে সেখানে ট্যাপের মুখে পানি পৌছায় না। তোমরা উচুজাতরা ট্যাঙ্কের মুখ তো বন্ধ করে রেখেছ। তুমিতো খুব সহজেই বলে দিলে যে, তুমি বহুদিন যাবৎ আমাকে পালতেছ, খাবার দিচ্ছ। কিন্তু তুমি তো একবারও চিন্তা করে দেখনি আমি তোমার কত কাজ করে দেই! আমি তোমার হালচাষ করে দিই, তোমরা আমার দুধ খাও, মাঝে মাঝে আমি তোমার গাড়িও টানি। একবার তুলনা করে দেখ, আমি তোমাদের কত কাজ করে দিই আর তুমি আমাকে কতটুকু খাবার দাও। আর খাবারের কথা যখন বললে তো বলি, তুমি তো নিজে তুলে আমাকে খাওয়াও না। সেটা অবশ্য আমি আশাও করিনা। আমাদের মাঠে বেধে রেখে আসো, তা-ও আবার গলায় দড়ি লাগিয়ে বদ্ধ অবস্থায়। আর আমি দুধ দিই তোমার গোয়ালে এসে। আমাকে তুমি কাদা মাটির মধ্যে রাখ তাতে সমস্যা নেই অথচ তোমাদের বসার স্থানে আমাদের পায়ের একটু কাঁদা পড়লেই সমস্যা। একটু ভুল করলেই তোমরা আমাকে ইচ্ছামতো মারধর কর তাতে সমস্যা নেই অথচ প্রচন্ড রাগের বশেও যদি আমরা তোমাদের কোন ছেলেকে শিং দিয়ে গুঁতো দিই অটা আমদের অপরাধ! আসলে বিচারক তো নিজের ভুল ধরতে পারেনা। সমাজের সকল বিচারকার্য তো এই সমজ তোমাদের মতো অভিজাতদের হাতেই তুলে দিয়েছে। তাই তোমাদের তো কোন ভুল নেই। আর তোমাদের মতের বিপরীতে আমরা কোন সঠিক কাজ করলেও সেটা আমাদের ভুল। আর এটাই তোমাদের সমাজের সঠিক বিচার। তোমরা প্রতিনিয়ত আমাদের শোষণ করবে তাতে সমস্যা নেই কিন্তু প্রতিবাদ করতে গেলেই আমরা মার খাব। বাহ কি আইন! তোমাদের সমাজ এটাকেই স্বীকৃতি দিয়েছে।
লালী একটু থামিলে আমজাদ মিয়া বলিলেন, আমরা আগে তো কোনদিন তোর গায়ে হাত তুলিনি। তুই ই তো বাধ্য করেছিস। কই তুই যতদিন গোয়ালে ছিলি কেউ তো তোর গায়ে হাত তোলেনি তুই কেন এসব কান্ড বাধাতে গেলি?
লালী এবার যে সুরে হাম্বা! হাম্বা! করিল তাহাতে আমজাদ মিয়া এরকমটা বুঝিলেন যে, লালী খুব ক্ষুব্ধ স্বরে বলছে, “হ্যাঁ, আমি তোমাকে বাধ্য করেছি শাস্তি পাওয়ার জন্য। অপরাধী তো বিচারককে বাধ্য করে শাস্তি দেওয়ার জন্য। তোমাদের আদালত শুধু এটাই দেখে, ‘কি অপরাধ করল?’ কিন্তু ‘কেন অপরাধ করল?’ এই প্রশ্নের উত্তর তোমাদের আদালত খোজেনা। যদি তা-ই হয়, তবে শুনে রাখ, শাস্তি দিয়ে অপরাধীকে সাধু বানানো যায়না। আমাকে হাজার শাস্তি দিলেও আমি হয়তো আবার ঐ ভুলটা করে বসব। কারণ আমি বুঝতে পারব না কোনটা আমার ভুল। কিন্তু আমাকে যদি আমার ভুলটা ধরে দাও তাহলে আমি আমার ভুলটা ধরতে পারব। হয়তো দ্বিতীয়বার ঐ ভুলটা আর করব না। এতে তোমাদের উদ্দেশ্য হাসিল হবে। তুমি একটু আগেই আমাকে বলতেছিলে না, আমার তো গোয়ালে থাকার কথা, আমি কেন এসব কান্ড বাধাতে গেলুম! আসলে অভিজাতরা চায় নিচু-জাতরা সারাজীবন মাঠ-ক্ষেতে পুড়ে মরুক, আর তোমরা তাদেরই কাঁধে পা দিয়ে তাদেরই তৈরি অট্টালিকায় বসে বসে খাবে। তোমরা কখনো ভেবে দেখনি, যে কাঁধে পা রেখে তোমরা চলো সে কাঁধ শক্ত করার দায়িত্বও তোমাদেরই। নতুবা তোমরাই একদিন পরে যাবে। আসলে তোমরা তো এসব ভাবো না। আজ কি অপরাধ করেছি আমি এখনও বুঝলাম না, অথচ তোমাদের ছেলেরা মিলে আমাকে কি মারটাই না মারল! পূর্বে তোমরা ভালো ব্যাবহার করে কাজ করে নিতে। তখন কাজের খাতিরে হলেও একটা ভালো ব্যাবহার পেতাম। আর তোমাদের ছেলেরা অত্যাচার, জুলুম করে কাজ করে নেয়। তোমরা যেখানে বলো, ‘খাবার দিব, কাজ কর’। এমন সময় আসবে সেখানে আমাদের শুনতে হবে, ‘শাল, কাজ করবি নাকি মার খাবি?’ তোমরা ভাবছ আমরা প্রতিবাদ করছি চিরতরে মুক্তি পাওয়ার জন্য। কিন্তু না। সে আশা অনেক আগেই আমরা ত্যাগ করেছি। আন্দোলন পূর্বেও করেছে নিচু-জাতরা, কিন্তু তাতে তারা কি পেয়েছে? শুধু বঞ্চনা আর স্বজন হারানোর যন্ত্রণা। এতদিনে আমরা ছোটরা অন্তত এইটুকু বুঝেছি যে, অভিজাতদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে কোন লাভ নেই। তারা আমাদের আত্মার মৃত্যুও ঘটতে দেবেনা। কারণ, এই নিচু জাতরা মরলে তাদের কাজ করে দেবে কে? পাছে তাদেরই আবার ছোট হতে হয়। নিচু-জাতরা চিরদিন নিচুই থাকবে আর অভিজাতরা দিন দিন আরো বড় হবে।
আমজাদ মিয়া অনুতপ্ত স্বরে বলিলেন, আমি কি তোর উপর খুব অন্যায় করে ফেলেছি?
লালী তাহার আক্ষেপ মিটিয়ে বলিল, তুমি আর এমন কি করেছ। তোমাদের সমাজ যা করে তুমিই বা তার বিপরীত হবে কেন? এই যে তোমার ছেলে এতক্ষন আমাকে পিটাল এতে তোমার কি লাভ হলো। আমি অন্যায় করেছি, তোমাদের সম্মানহানি হয়েছে, মানছি। কিন্তু আমাকে মারার কারণে কি তোমার সম্মান ফিরে এসেছে? আসবেনা সেটা তুমিও জানো কিন্তু তারপরেও …………..। তবে শুনে রাখ, তোমরা বাধ্য করলেও আমরা চিরদিন তোমাদের শোষণ সহ্য করব না। হয়তো তোমাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারব না। কিন্তু সহ্যও করব না। মনে রেখ, তোমরা যাদের নিচু-জাত বলে সম্বোধন কর, তারা মোটেও তোমাদের ধারণার মতো নিচু-জাত নয়।
আমজাদ মিয়া কর্কশ স্বরে চেঁচাইয়া উঠিলেন, আবার বলছিস, কি অপরাধ করেছিস। আমার মান-সম্মানের কিছু তো রাখিসনি। মন চাচ্ছে তোকে’’’’’’’
লালী আবার হাম্বা! বলিয়া চিৎকার করিল। এতে আমজাদ মিয়া যা বুঝিলেন, তা অনেকটা এরকম, আমাকে তোমরা মারছ এতে আমার কোন আফসোস নেই। আমার আফসোস হয় তোমাদের মানবজাতির বিবেক দেখে। তোমরা শুধু নিচু-জাতদের শোষণই করতে শিখেছ। আর তোমাদের শোষণ সইতে সইতে এখন তোমাদের উঁচু জাতদের উৎসব-আনন্দ দেখলে আমাদের সহ্য হয়না। তোমাদের যত উৎসব-আনন্দ আমাদের তত মৃত্যু আর যন্ত্রণা। আজ আমার ছেলেকে শেষ করেছ, আর তোমার ছোট মেয়ের বিয়েতে হয়তো আমাকেও শেষ করবে। এরকম বারবারই আমাদের কেও না কেও মরবে শুধু তোমাদের আনন্দ দেওয়ার জন্য। এই তো গত মাসে তোমাদের একটা ছেলে সন্তান হয়েছিল আমার একটা ছেলেকে জবাহ করেছ। কিন্তু ছয় মাস আগে আমার যখন ঐ সন্তান হয়েছিল তখন তো তার জন্ম উৎসবে এরকম আনন্দ করতে হয়নি। আর এখনই কি যেন বলছিলে, তোমার কি যেন করতে মন চাচ্ছে ! হ্যাঁ তোমাদের তো অনেক কিছুই করতে মন চায়। আর তোমাদের ইচ্ছের দাম আছে। তোমরা ইচ্ছে করলে সবই করতে পারো। আর আমাদের মতো নিচু জাতদের ইচ্ছা অনিচ্ছা সবই তোমাদের হাতে বন্দি।
আমজাদ মিয়া বলিলেন, আমি তোকে এত বছর পালতেছি, খাবার দিচ্ছি, তারপরও তুই এত মানুষের মধ্যে আমাকে অপমান করলি কেন? তুই তো শাস্তি পাবিই—
লালী তাহার নিজস্ব ভাষাতে আমজাদ মিয়াকে এমনটা বুঝাইতে চেষ্টা করিল, হ্যাঁ, আমি তো শাস্তি পাবই। আমি অপরাধ করেছি। তোমার সম্মানে আঘাত করেছি। তোমাদের সম্মান তো সমাজের অনেক উপরে। সেখানে আমার মতো নিচু-জাত হস্তক্ষেপ করেছে শাস্তি তো তাকে পেতেই হবে। তুমি অন্যায় কিছু বলোনি। কারণ তোমাদের মানবাদালত অবশ্য এটাই রায় দিবে। কারণ তোমাদের বিবেকাদালত এত নিচ পর্যন্ত খুটে দেখে সময় অপচয় করতে নারাজ। এত নিচ পর্যন্ত তোমাদের আদালতের দৃষ্টি পড়েনা। না পড়ারই কথা। যেখানে ট্যাঙ্কের গোড়ায় তালা দেওয়া থাকে সেখানে ট্যাপের মুখে পানি পৌছায় না। তোমরা উচুজাতরা ট্যাঙ্কের মুখ তো বন্ধ করে রেখেছ। তুমিতো খুব সহজেই বলে দিলে যে, তুমি বহুদিন যাবৎ আমাকে পালতেছ, খাবার দিচ্ছ। কিন্তু তুমি তো একবারও চিন্তা করে দেখনি আমি তোমার কত কাজ করে দেই! আমি তোমার হালচাষ করে দিই, তোমরা আমার দুধ খাও, মাঝে মাঝে আমি তোমার গাড়িও টানি। একবার তুলনা করে দেখ, আমি তোমাদের কত কাজ করে দিই আর তুমি আমাকে কতটুকু খাবার দাও। আর খাবারের কথা যখন বললে তো বলি, তুমি তো নিজে তুলে আমাকে খাওয়াও না। সেটা অবশ্য আমি আশাও করিনা। আমাদের মাঠে বেধে রেখে আসো, তা-ও আবার গলায় দড়ি লাগিয়ে বদ্ধ অবস্থায়। আর আমি দুধ দিই তোমার গোয়ালে এসে। আমাকে তুমি কাদা মাটির মধ্যে রাখ তাতে সমস্যা নেই অথচ তোমাদের বসার স্থানে আমাদের পায়ের একটু কাঁদা পড়লেই সমস্যা। একটু ভুল করলেই তোমরা আমাকে ইচ্ছামতো মারধর কর তাতে সমস্যা নেই অথচ প্রচন্ড রাগের বশেও যদি আমরা তোমাদের কোন ছেলেকে শিং দিয়ে গুঁতো দিই অটা আমদের অপরাধ! আসলে বিচারক তো নিজের ভুল ধরতে পারেনা। সমাজের সকল বিচারকার্য তো এই সমজ তোমাদের মতো অভিজাতদের হাতেই তুলে দিয়েছে। তাই তোমাদের তো কোন ভুল নেই। আর তোমাদের মতের বিপরীতে আমরা কোন সঠিক কাজ করলেও সেটা আমাদের ভুল। আর এটাই তোমাদের সমাজের সঠিক বিচার। তোমরা প্রতিনিয়ত আমাদের শোষণ করবে তাতে সমস্যা নেই কিন্তু প্রতিবাদ করতে গেলেই আমরা মার খাব। বাহ কি আইন! তোমাদের সমাজ এটাকেই স্বীকৃতি দিয়েছে।
লালী একটু থামিলে আমজাদ মিয়া বলিলেন, আমরা আগে তো কোনদিন তোর গায়ে হাত তুলিনি। তুই ই তো বাধ্য করেছিস। কই তুই যতদিন গোয়ালে ছিলি কেউ তো তোর গায়ে হাত তোলেনি তুই কেন এসব কান্ড বাধাতে গেলি?
লালী এবার যে সুরে হাম্বা! হাম্বা! করিল তাহাতে আমজাদ মিয়া এরকমটা বুঝিলেন যে, লালী খুব ক্ষুব্ধ স্বরে বলছে, “হ্যাঁ, আমি তোমাকে বাধ্য করেছি শাস্তি পাওয়ার জন্য। অপরাধী তো বিচারককে বাধ্য করে শাস্তি দেওয়ার জন্য। তোমাদের আদালত শুধু এটাই দেখে, ‘কি অপরাধ করল?’ কিন্তু ‘কেন অপরাধ করল?’ এই প্রশ্নের উত্তর তোমাদের আদালত খোজেনা। যদি তা-ই হয়, তবে শুনে রাখ, শাস্তি দিয়ে অপরাধীকে সাধু বানানো যায়না। আমাকে হাজার শাস্তি দিলেও আমি হয়তো আবার ঐ ভুলটা করে বসব। কারণ আমি বুঝতে পারব না কোনটা আমার ভুল। কিন্তু আমাকে যদি আমার ভুলটা ধরে দাও তাহলে আমি আমার ভুলটা ধরতে পারব। হয়তো দ্বিতীয়বার ঐ ভুলটা আর করব না। এতে তোমাদের উদ্দেশ্য হাসিল হবে। তুমি একটু আগেই আমাকে বলতেছিলে না, আমার তো গোয়ালে থাকার কথা, আমি কেন এসব কান্ড বাধাতে গেলুম! আসলে অভিজাতরা চায় নিচু-জাতরা সারাজীবন মাঠ-ক্ষেতে পুড়ে মরুক, আর তোমরা তাদেরই কাঁধে পা দিয়ে তাদেরই তৈরি অট্টালিকায় বসে বসে খাবে। তোমরা কখনো ভেবে দেখনি, যে কাঁধে পা রেখে তোমরা চলো সে কাঁধ শক্ত করার দায়িত্বও তোমাদেরই। নতুবা তোমরাই একদিন পরে যাবে। আসলে তোমরা তো এসব ভাবো না। আজ কি অপরাধ করেছি আমি এখনও বুঝলাম না, অথচ তোমাদের ছেলেরা মিলে আমাকে কি মারটাই না মারল! পূর্বে তোমরা ভালো ব্যাবহার করে কাজ করে নিতে। তখন কাজের খাতিরে হলেও একটা ভালো ব্যাবহার পেতাম। আর তোমাদের ছেলেরা অত্যাচার, জুলুম করে কাজ করে নেয়। তোমরা যেখানে বলো, ‘খাবার দিব, কাজ কর’। এমন সময় আসবে সেখানে আমাদের শুনতে হবে, ‘শাল, কাজ করবি নাকি মার খাবি?’ তোমরা ভাবছ আমরা প্রতিবাদ করছি চিরতরে মুক্তি পাওয়ার জন্য। কিন্তু না। সে আশা অনেক আগেই আমরা ত্যাগ করেছি। আন্দোলন পূর্বেও করেছে নিচু-জাতরা, কিন্তু তাতে তারা কি পেয়েছে? শুধু বঞ্চনা আর স্বজন হারানোর যন্ত্রণা। এতদিনে আমরা ছোটরা অন্তত এইটুকু বুঝেছি যে, অভিজাতদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে কোন লাভ নেই। তারা আমাদের আত্মার মৃত্যুও ঘটতে দেবেনা। কারণ, এই নিচু জাতরা মরলে তাদের কাজ করে দেবে কে? পাছে তাদেরই আবার ছোট হতে হয়। নিচু-জাতরা চিরদিন নিচুই থাকবে আর অভিজাতরা দিন দিন আরো বড় হবে।
আমজাদ মিয়া অনুতপ্ত স্বরে বলিলেন, আমি কি তোর উপর খুব অন্যায় করে ফেলেছি?
লালী তাহার আক্ষেপ মিটিয়ে বলিল, তুমি আর এমন কি করেছ। তোমাদের সমাজ যা করে তুমিই বা তার বিপরীত হবে কেন? এই যে তোমার ছেলে এতক্ষন আমাকে পিটাল এতে তোমার কি লাভ হলো। আমি অন্যায় করেছি, তোমাদের সম্মানহানি হয়েছে, মানছি। কিন্তু আমাকে মারার কারণে কি তোমার সম্মান ফিরে এসেছে? আসবেনা সেটা তুমিও জানো কিন্তু তারপরেও …………..। তবে শুনে রাখ, তোমরা বাধ্য করলেও আমরা চিরদিন তোমাদের শোষণ সহ্য করব না। হয়তো তোমাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারব না। কিন্তু সহ্যও করব না। মনে রেখ, তোমরা যাদের নিচু-জাত বলে সম্বোধন কর, তারা মোটেও তোমাদের ধারণার মতো নিচু-জাত নয়।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
জামাল উদ্দিন জীবন ১৪/০৮/২০২১বেশ রচিলেন।
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ১৩/০৮/২০২১প্রবন্ধ না গল্প?