www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

সব শাসকের নীতি এক

বর্তমানে আমাদের দেশ, এক অদ্ভূত পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে।এখানে শাসকের বিরুদ্ধে কিছু বলা মানেই জুটছে দেশদ্রোহীর তকমা। আবার প্রশ্নগুলো যখন মূলগত সমস্যা নিয়ে উঠছে (যেমন – কর্মসংস্থান, গরিবী), তখন সটান উত্তর/তকমা - পাকিস্তান চলে যাও/পাকিস্তানী। আর এই তকমা বা ফতোয়া জারি করার ঠিকা, আর কেউ না, নিয়েছেন স্বয়ং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তার পারিষদবর্গ। আসলে মানুষের দৃষ্টি ঘোরানোর এটি একটি প্রাচীন পদ্ধতি। চোখ - কান খোলা রেখে, চারপাশে ঘুরলে এর ভুরি ভুরি উদাহরণ পাওয়া যায়। ধরা যাক, কোন এক ব্যক্তি, কোন একটি বিষয়ে, খুব যুক্তিসংগত কথা বলছেন। কিন্তু সেটি কিছু ব্যক্তির কিংবা সমাজের আদিম স্বার্থে সরাসরি আঘাত হানছে। সঙ্গে - সঙ্গে উক্ত ব্যক্তির চরিত্র হননের তোড়জোড় শুরু হওয়া এক নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। যে করেই হোক ঐ ব্যক্তির যুক্তিগুলিকে অপ্রাসঙ্গিক করা চাই। আর এটা করতে কোনো যুক্তি লাগে না। শুধু মাত্র কিছু ভ্রান্ত ধারণাই এর জন্য কাফী। এই চরিত্রহনন বিভিন্ন ভাবে করা যায়। সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি - পাগলের আখ্যা দিয়ে দেওয়া। ব্যাস, তাহলেই ল্যাটা চুকে গেল।সেই ব্যক্তির সমস্ত কথাগুলিই তখন অপ্রাসঙ্গিক বলে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, কোনো ব্যক্তির যুক্তিপূর্ণ কথার প্রাসঙ্গিকতা নষ্ট করার জন্যই সমাজ কিংবা রাষ্ট্র বিভিন্ন তকমা দেওয়ার পন্থা অবলম্বন করে। আর ঠিক এখানেই দেশদ্রোহী, পাগল, মাওবাদী কিংবা সিপিআইএম সব এক হয়ে যায়। ব্যক্তিগত স্তরে এটি ঘটলে এর মোকাবিলা করা যায়। কিন্তু রাষ্ট্র যখন একই কাজ তার প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহারের দ্বারা করতে উদ্যত হয়, তখন যে দেশের গণতন্ত্র মহাবিপদে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এর কয়েকটি জলজ্যান্ত উদাহরণ হল - কানহাইয়া কুমার, সাহেলা রশিদ কিংবা আমির খানের ঘটনা। সমস্যাটা এখানেই সীমাবদ্ধ থাকলে ঠিক ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রের কাছে প্রশ্ন করার অপরাধে যখন গৌরী লঙ্কেশ কিংবা কালবুর্গীর মত সজ্জন ব্যক্তিদের মৃত্যুবরণ করতে হয়, তখন এটা বুঝতে আর কোন অসুবিধা থাকে না যে, দেশে স্বৈরতন্ত্র চলছে। আর এই স্বৈরতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে আমাদের সমাজের একটা অংশ জেনে কিংবা না জেনে, বুঝে কিংবা না বুঝে, যুক্ত হচ্ছে। মোদ্দাকথাটা হল - মিডিয়ার বাজারিকরন, ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটির দ্বারা সত্যের ও তথ্যের অপলাপের ফলে আজ সমাজের এক বৃহৎ অংশের মানুষের মনে ভ্রান্ত ধারণার চাষ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। আর সেটা আস্তে - আস্তে ক্যান্সারের মতো সমাজের মজ্জায় অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। যার ফলস্বরূপ আজ চারিদিকে মিথ্যা দেশ ভক্তির জিকির উঠছে। তাই কর্মসংস্থান, গরিবী এই বিষয় গুলির বদলে আজ নির্বাচনের ইস্যু হল - দেশ ভক্তি আর হিন্দু - মুসলমান। কী মজা না! ছি:!

এবার আসা যাক প্রকৃত দেশভক্তি আর আর্টিফিশিয়াল দেশ ভক্তির মধ্যে ফারাক সম্পর্কিত আলোচনায়।তার আগে কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যাক। আচ্ছা, পৃথিবীকে বিভিন্ন দেশ, মহাদেশ, রাজ্যে কারা ভাগ করেছে? উত্তর - অবশ্যই মানুষ। মানুষ যদি এই দেশ নামক কাল্পনিক ভূখণ্ডের স্রষ্টা হয়, তবে তার সংরক্ষণের জন্য, তারা কী কোন পদ্ধতির সৃষ্টি করেছে? উত্তর - হ্যাঁ। তাহলে সেই পদ্ধতিটা কী?উত্তর – দেশপ্রেম। এই দেশপ্রেমটা কী? যে মানসিক অনুভূতির ফলস্বরূপ একটি ভূখণ্ডের মানুষ নিজেদের ঐক্যবদ্ধ একটি সংস্থা মনে করে, তাকেই বলে দেশপ্রেম। এই দেশপ্রেম কোনো ছেলের হাতের মোয়া নয় যে, সব সময় সেটা হাতে নিয়ে ঘুরতে হবে; ঘুরলেই দেশপ্রেমিক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া যাবে। এটি হল মানুষের একটি অন্তর্নিহিত অনুভূতি, যা বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে অনুভূত হয়; কখনোই সবসময় নয়। তাহলে ছদ্ম দেশপ্রেম কী? যখন নিজের দেশকে বড় দেখাতে অপর কোন দেশকে ছোট করতে হয়, তাকেই বলে ছদ্ম দেশপ্রেম বা উগ্র জাতীয়তাবাদ। আবার যখন দেশের কোন নাগরিকের প্রশ্ন করার অধিকার হনন হেতু, তার উপর রাষ্ট্রের চরম অত্যাচার বা লাঞ্ছনা চলে কিংবা উক্ত ব্যক্তির উপর দেশদ্রোহীর তকমা সাটা হয়, তখন তাকে বলে ছদ্ম দেশ ভক্তি বা আর্টিফিশিয়াল ন্যাশনালিজম বা উগ্র জাতীয়তাবাদ। আর এই উগ্র জাতীয়তাবাদের ফল - বিগত শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া দু - দুটি বিশ্বযুদ্ধ। মোদ্দা কথাটা হল - দেশ গড়ে ওঠে মানুষকে নিয়ে। আর যেকোনো দেশ তখনই বাঁচে ,যখন তার মধ্যে বসবাসকারী মানুষ সুখে স্বাচ্ছন্দে বাঁচে। কিন্তু যদি কোন দেশে, মানুষের মূলগত চাহিদাগুলিকে (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান) পূরণ না করে উক্ত দেশের শাসক, জনসাধারণকে উগ্র জাতীয়তাবাদের অ্যান্টিজেন খাইয়ে পুঁজিপতিদের পদলেহন করে ও দেশের সম্পদের অবলুণ্ঠনে বা অসম বন্টনের পথ প্রশস্থ করার মাধ্যমে মনে করে 'আচ্ছে দিন' এসে গেছে, তবে দেশদ্রোহী তকমাটা কানহাইয়ার নাকি উক্ত শাসকের প্রাপ্য - সেটা আজ জনসাধারণের ভাবার সময় এসেছে। শুধুমাত্র কিছু পুঁজিপতি ও ভন্ডনেতার ব্যক্তিগত স্বার্থ পূরণ হেতু, দেশপ্রেমের মত একটি পবিত্র জিনিস, আজ বাজারি পণ্যে রূপান্তরিত। কে বা কারা এর জন্য দায়ী? হে ভদ্র! কখনও কী এ বিষয়ে নিজেকে প্রশ্ন করেছেন?

উপরিউক্ত আলোচনার প্রত্যেকটি কথাই বাংলার বর্তমান শাসকগণের ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক। কারণ দিল্লির শাসককে কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করলে জোটে দেশদ্রোহীর তকমা আর বাংলার শাসককে প্রশ্ন করলে জোটে মাওবাদী বা সিপিআইএমের তকমা। আসলে এরা একই মুদ্রার এপিঠ - ওপিঠ। পার্থক্য? শুধু ফুলে। মূলগতভাবে এরা এক এবং অদ্বিতীয়। একে অপরের পরিপূরক। বাংলায় বর্তমানে দলবদলের সমীকরণ দেখলেই এটা আরও সুস্পষ্ট হয়। যারা ভেবেছিলেন জোড়া ফুলকে জব্দ করবে কেবল এবং কেবলমাত্র সিঙ্গেল ফুল, তারা হয় এখনও ঘুমিয়ে আছেন নয়তো অন্ধ। কারন জোড়া ফুলের অর্জুন, লকেট, ভারতী, অনুপম, শঙ্কুদেব, মুকুল আজ সিঙ্গেল ফুলের সম্পদ। তাই সেদিনের 'ভাগ মুকুল ভাগ’ আজ ক্ষমতায় আসার সিঁড়ি মসৃণ করতে এবং ক্ষমতায় আসার তীব্র ইচ্ছা পূরণ হেতু হয়েছে 'আয় মুকুল আয়'। তাই আজ নীতি, আদর্শ, কোন কিছুর বালাই নেই। শুধু ফুলটাই বদলেছে। মূল কিন্তু একই আছে। আর মন্ত্র একটাই উন্নয়ন - অবশ্যই ব্যক্তিগত। কাল জোড়াফুলকে রিপ্লেস করে সিঙ্গেল ফুল বাংলায় ক্ষমতায় এলেও আমি নিশ্চিত উন্নয়নের কপিরাইটের কেবলমাত্র স্থানান্তর হবে। আজ যা আছে পিসি – ভাইপোর পকেটে, কাল তা কেবল দিলীপ মুকুলের হাতে যাবে।ব্যাস, পরিবর্তন এটুকুই। আমি আপনি যেখানে আছি সেখানেই থাকবো। শুধু ভয় একটাই - উগ্র জাতীয়তাবাদ ও হিন্দু - মুসলিম তোষণ-শোষণ যেন আমাদের সামাজিক কাঠামোটার শেষ মজ্জা টুকুকেও শেষ না করে দেয়। পরিশেষে বলি - এই দেশপ্রেমের ব্যাপারীরা কিংবা হিন্দু বা মুসলিম ধর্মের ঠিকা নেওয়া ছদ্ম ধর্মরক্ষাকারীরা দেশের তো ভালো চায়ইনা; হিন্দু বা মুসলমানের ভালো চাওয়া তো অনেক দূরের কথা। আসল কথা হল – ক্ষমতা, ক্ষমতা শুধু ক্ষমতার লালসা। আর ক্ষমতা পেতে দরকার – বিভাজন, বিভাজন, এবং বিভাজন। এটা যদি এখনও আমরা না বুঝি, তবে আর বেশি দেরি নেই; এই সভ্যতা ধ্বংস হতে। গৃহযুদ্ধ শিয়রে দাঁড়িয়ে। শুধু অপেক্ষা – ধ্বংস, ধ্বংস আর ধ্বংসের। বিষ একটু খাও বা বেশি - মৃত্যু নিশ্চিত। তাই জোড়া ফুলের নৈরাজ্য থেকে মুক্তি দেবে সিঙ্গেল ফুল - এই ভাবনা শুধু হাস্যকর নয়; শতাব্দীর সেরা ধাপ্পাবাজি। কারন, একটা পচা নর্দমার বিকল্প কখনই তার থেকেও বেশি পচা আরেকটা নর্দমা হতে পারে না।জোড়া ফুলতো পচে গলে গেছে। আর সিঙ্গেল ফুল তো বহু আগেই পচেছিল। আজ শুধু সেখানে মাছি ভিন - ভিন করছে। এই মাছি গুলো কে? তা বাংলার রাজনৈতিক আকাশে ক্রমশ প্রকাশ্য।

##লেখার কাল - ০৭/০৫/২০১৯
বিষয়শ্রেণী: সমসাময়িক
ব্লগটি ৩৬৭ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৪/১১/২০২২

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast