সবজান্তার নক্সা
এই দুনিয়ায় নানা ধরনের মানুষ বসবাস করেন। যদি তাদের সবাইকে নিয়ে লিখতে বসি, তবে তার বহরে আস্ত একটা দিন শেষ হয়ে গেলেও; লেখা শেষ হবে না। তাই আজকের এই লেখাটি আমি বিশেষ কিছু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখছি। আজকে যাদের নিয়ে আমি কথা বলব, তারা হলেন - এ দুনিয়ায় সমস্ত জ্ঞানের, সমস্ত বুদ্ধির অধিকারী বলে সদাই নিজেকে জাহির করায় ব্যস্ত কিছু মানুষ। যাদের চালু কথায় সবজান্তা বলে। এরা নিজ জীবনে কতটা সাফল্য পেয়েছে তার কোনো হদিস নেই কিন্তু লোকের সাফল্য কিংবা ব্যর্থতার সমালোচনা বা পর্যালোচনায় সদাই ব্যস্ত থাকাকে নিজেদের অধিকার মনে করে। যদি শিক্ষাবিদগণ সাফল্যের সংজ্ঞা এনাদের নিরূপণ করতে বলতেন, তবে আধুনিক শিক্ষা ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞান বলে কোনো বিষয়বস্তুর অবতারণা হোতো বলে মনে হয় না। কারন, এদের কাছে সাফল্য হোলো - খুব কম সময়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন এবং তারপর জীবনসঙ্গী নির্বাচন ইস্তক মন্থনে লিপ্ত হওয়া এবং পরবর্তী প্রজন্মের উৎপাদন করা। কিছু ক্ষেত্রে উপরোক্ত বিষয়গুলি এই সমস্ত ব্যক্তিরা অর্জন করলেও; বহু ক্ষেত্রে এরা এগুলির সমস্তকটা অর্জন করতে সমর্থ হয় না। তাই এরা একটা সময় পর মানসিক অবসাদে ভোগে এবং যার ফলশ্রুতিতে এরা পরবর্তী জীবনে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে অপরের সাফল্যকে খাটো করে দেখায় এবং ব্যর্থতা নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে। এরা কাউকে কোন বিষয়ে উৎসাহিত করা তো দুরস্থান; উল্টে তার সমালোচনা করাটাকেই রোজনামচার কাজ বলে মনে করে। আসলে, এরা প্রচন্ড ঈর্ষাকাতর এবং হিংসুটে প্রকৃতির হয়। প্রথম জীবনে অর্থ এবং যৌনতার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলেও একটা বয়স পার হওয়ার পর, এদের মধ্যে যশ, খ্যাতি, নাম, প্রতিপত্তি ইত্যাদি বিষয়গুলি অর্জনের চাহিদা জন্মায়। কিন্তু জীবনে চলার পথে এরা এত বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে যে, এসব লাভ করা আর সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। যদিও এরা নিজেদের রবীন্দ্রনাথ কিংবা বিদ্যাসাগরের থেকে কোন অংশে কম ভাবে না। এ বিষয়ে বলে রাখি যে, রবীন্দ্রনাথ কিংবা বিদ্যাসাগর জীবদ্দশায় নিজেদের কোনদিন উৎকর্ষতার চূড়ান্ত প্রতীক রূপে জাহির করেছেন বলে আমার তো জানা নেই। কিন্তু বর্তমানে, ঢোল পেটানোটাকেই কিছু মানুষ উৎকর্ষতা বলে মেনে নিয়েছে। যার ফলস্বরূপ সততার প্রতীক, বিকাশের প্রতীক, প্রভৃতি প্রতীকের আবির্ভাব এখন রোজকার খবর। মাঝে মাঝে ভাবি যে, যদি বিদ্যাসাগর বা রামমোহন এদের মত চিন্তাধারার মানুষ হতেন, তবে বাংলার বর্তমান অবস্থা কিরকম হোতো? কে জানে!
এবার আসা যাক এদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও সামাজিক উপস্থিতির বিশ্লেষনে। পরচর্চা আর পরনিন্দা হলো এদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। শিক্ষকতা, চিকিৎসা থেকে শুরু করে কৃষিকাজ সহ নানা পেশায় এরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি প্রায় প্রত্যেকের মধ্যেই কম বেশি পরিলক্ষিত হয়। জীবনে এদের মূল লক্ষ্যই টাকা উপার্জন করে মন্থন উপযোগী সঙ্গী খুঁজে যৌনচাহিদা নিবৃত্তির মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের উৎপাদন। তাই উৎকর্ষতা এদের থেকে আশাই করা যায় না। অনেকের ধারণা হতে পারে যে, শিক্ষকতা, চিকিৎসার মত পেশায় যুক্ত হয়েও কি করে একজন মানুষের মধ্যে উৎকর্ষতা অনুপস্থিত থাকতে পারে! তাদের বলি, তোতা পাখিকেও বহুদিন ধরে অভ্যাস করালে কথা বলতে পারে, তাই বলে এটা ধরে নেওয়া কী ঠিক যে, তোতাপাখি উৎকর্ষতার চূড়ান্ত নিদর্শন। যে দেশে শিক্ষা,স্বাস্থ্য,রাজনীতি সমস্ত জায়গায় সমান্তরাল ব্যবস্থা চলে। অর্থাৎ এক দল আছে যারা মেধার ভিত্তিতে সুযোগ পায় আর আরেক দল আছে যারা অর্থের ভিত্তিতে সুযোগ পায় সে দেশে উৎকর্ষতা নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করাটাই বোধহয় একটু বেশী বাড়াবাড়ি। যে দেশে সাম্যের কথা কথা বলেও সংরক্ষণ নামক বিষ দীর্ঘ ৭০ বছর ধরে খাওয়ানো হয়, সে দেশে আর যাই হোক উৎকর্ষতার কোন স্থান নেই। যে দেশে আজও রাজনৈতিক প্রভুদের অঙ্গুলিহেলনে কলেজে, স্কুলে ভর্তি প্রক্রিয়া চলে সে দেশ, উৎকর্ষতা নিয়ে গর্ব করতে পারে কি? আর সর্বোপরি যে দেশে সমাজের মেরুদন্ড গঠনকারী (শিক্ষক) বলে যাদের ভাবা হয় তাদের মধ্যে একাংশ যখন বৃত্তি অর্জন হেতু উৎকোচ কিংবা দলীয় রাজনীতির আশ্রয় নেয়, সে দেশে উৎকর্ষতা আর রসাতল দুটোই সমার্থক বলে মনে করি। যে দেশে শিক্ষামন্ত্রী, নিজের পদাধিকার বলে টুকলি করে পিএইচডি লাভ করেন, সে দেশে উৎকর্ষতা বলে কোন বস্তু আছে কি? যেদেশে গবেষণার নামে পুরনো তাত্ত্বিক বিষয়গুলির অনুসিদ্ধান্তগুলিকে তুলে ধরা হয়, সে দেশে উৎকর্ষতার অনুপস্থিতি কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। যে দেশে বহু ক্ষেত্রে স্নাতক, স্নাতকোত্তর কিংবা পিএইচডি ভর্তির সময় মেধার থেকে আনুগত্য কিংবা বাৎসল্যকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়, সেদেশে মৌলিক গবেষণা তথা উৎকর্ষতা সোনার পাথরবাটি। আর সবশেষে বলি, যে সভ্যতায় উৎকর্ষতা বলতে আজও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থাকেই মনে করা হয় এবং উৎকর্ষতার চূড়ান্ত নিদর্শন স্বরূপ পিএইচডিকেই তুলে ধরা হয়, সে দেশে আর যাই হোক উৎকর্ষতা একটি অলীক কল্পনা। মাঝেমাঝে ভাবি, এই কসমেটিক উৎকর্ষতার গেরোয় পড়লে সেদিনের লালন কিংবা রবীন্দ্রনাথ আজকের লালন ফকির কিংবা কবিগুরু হতে পারতেন কি? কে জানে!
এতক্ষণ কথা হল এদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে। এবার আসা যাক এদের কিছু ভাবনা চিন্তার প্রসঙ্গে। এরা প্রতিনিয়ত যে সমস্ত কথা বলে পরমুহূর্তে তার বিপরীত কাজেই বেশি উদ্যত হয়। এরা মুখে বলে ঠিকই যে, পৃথিবীতে কোন কাজই ছোট নয় কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ঠিক এর উল্টোটা করে। উপরিউক্ত বিষয়টি একটি উদাহরণ দিলে আরও স্পষ্ট হয়ে যাবে। ধরা যাক, এদের প্রশ্ন করা হল যে, সোনাগাছিতে যারা নগরবধূর কাজ করে তাদের কাজকে কেন সমাজ ছোট চোখে দেখে? তখন এরা সুড়সুড় করে কেটে পড়াটাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এরা কিছুতেই স্বীকার করেনা নগরবধূর বৃত্তি এই সমাজের পাশবিক লালসার একটি চিহ্ন মাত্র। আসলে এরা বাহ্যিক দিক থেকে একরকম এবং অভ্যন্তরীণ দিক থেকে ঠিক তার বিপরীত। অর্থাৎ এদের কথা এবং কাজের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ পরিলক্ষিত হয়। উৎকর্ষ ব্যক্তি তাকেই বলে যে সত্যকে সমাজের গড়পড়তা চালু দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখে; সত্যকে সত্যের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে। এবং একজন উৎকর্ষ ব্যাক্তি অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে জীবন সত্যকে উপলব্ধি করতে সক্ষম। আর যারা এটা করতে পেরেছেন তাদেরই এই সমাজ, এই দুনিয়া চিরকাল মনে রেখেছে। আর এরা এটা করতে পারা তো দূরস্থান, এই ভাবনাই এদের ভাবনায় আসে বলে আমার মনে হয় না। তাই সমাজ যাকে ভুল বলে, এরা তাকে ভুল বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে অর্থাৎ স্রোতের বিপরীতে হাঁটার মতো মজ্জা এদের নেই। আমরা জানি, একটি সারমেয় যদি চিৎকার করে তবে পুরো দল তার সাথে চিৎকার করে। এই সবজান্তারাও ঠিক এই নীতিতেই বিশ্বাসী। কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে এরা বাকি সকলের থেকে আলাদা। কিন্তু কাছ থেকে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে মনে হবে গড়পড়তা আর পাঁচটা মানুষের মতোই এদের আচরণ। শুধু একটা জায়গায় এরা বাকিদের থেকে আলাদা, সেটা হল এরা সহজ কথাকে পেঁচিয়ে বলতে বেশি ভালোবাসে। আপাতদৃষ্টিতে অত্যন্ত জ্ঞানী বলে মনে হলেও এরা মূর্খের থেকেও অধম। কোন কাজই ছোট নয় এটা ঠিক। কিন্তু আমার কাজটা যদি অপরকে ছোট করা হয়, তবে সে কাজটি দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্টতম একটি কাজ। সেটা এদের বোঝাবে কে? কারণ এরা এক অদ্ভুত বর্মের মধ্যে নিজেকে ঢুকিয়ে রাখে। এরা সবার সমালোচনা করে কিন্তু এদের কোন বিষয়ে যখনই আপনি টিপ্পনি করবেন তখনই আপনাকে শুনতে হবে - 'সমাজে বড়-ছোট জ্ঞান হারিয়ে গেছে কিংবা মানুষ আর মানুষকে সম্মান করে না...' ইত্যাদি ,ইত্যাদি।কি অদ্ভুত তাই না? মনে হচ্ছে এরা যেন একতরফাভাবে সমস্ত কিছুর সমালোচনা করার ঠিকা নিয়ে বসে আছে। কিন্তু এদের সমালোচনা করায় মানা। এই প্রসঙ্গে বলি, কিছুদিন আগে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা। কিছুকাল আগেও আমার বাড়িতে নিত্যদিনের যাতায়াত ছিল এনার। কিন্তু কোনো এক অলীক করনে গত ৩-৪ বছর যাবৎ সেই যাত্রায় ছেদ পড়েছে। তার আগে জেনে নেওয়া যাক এনার চারিত্রিক গুণাবলী সম্পর্কে। এনার গুণাবলী সম্পর্কে যতই বলা হোক না কেন; এনার গুণের অন্ত নেই। সবজান্তাদের প্রায় সমস্ত গুণগুলিই এনার মধ্যে ঠেসে ঠেসে ভরা আছে। প্রত্যেকদিন চায়ের আড্ডায় এনার, যে কোন এক প্রতিবেশী বাড়ির কেচ্ছা চাইই - চাই। আর যেদিন কেচ্ছা থাকেনা, সেদিন কাছাগুলোর উপর বেশি চাপ থাকে। কারন, কাছা টানাতেও ইনি সাবলীল এবং সিদ্ধহস্ত। এনার মতে, ভালোবাসা পাপ। এদিকে এনার দু- দুটো মেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছে, তবুও ইনি নিজের তত্ত্বে এখনও অনড়। অদ্ভুৎ না? এ আর কী দেখলেন; পড়তে থাকুন - ক্রমশ প্রকাশ্য। এনার করবার দেখলে অদ্ভুতও ভূত হয়ে যায়। ভূত, ভবিষ্যৎ সব ঘেঁটে ঘ'। আসুন আরও একটু জানি। কোন কাজই ছোট নয় - এটা এনার মূল মন্ত্র। কিন্তু দিবারাত্রি এনার প্রধান কাজ হল - ধূমপান এবং তাসের আড্ডা। এবার আসা যাক মূল বিষয়ে, আজ থেকে ৪-৫ বছর আগেও দেখা হলে ইনি আমাকে জিজ্ঞাসা করতেন, 'বাবু কেমন আছিস?' কিন্তু সেদিনের সাক্ষাতে এনার প্রথম উক্তিটি হল, 'কি করছিস এখন?' প্রথমে ভাবলাম, বাঙালির সনাতনী কর্ম অর্থাৎ গৃহশিক্ষকতা করছি; এটা বলব। কিন্তু পরমুহুর্তে ভাবলাম এনার কাজ তো সমালোচনা করা; আমি গৃহশিক্ষকতা বলি কিংবা বেকার বলি; আজ এনার চায়ের পেয়ালায় মূল চর্চার বিষয় তো আমিই। কারণ দুটোতেই তো অর্থের প্রাচুর্যতা অনুপস্থিত। তাই এনার কাছে দুটোই সমান। আমি যাই বলি না কেন, আজ চায়ের আড্ডায় আমিই এনার হট টপিক। তাই আমি কোন কথা না বলাটাকেই বেশি সমীচীন মনে করলাম। কিন্তু সবজান্তার সহজাত অভ্যাস; যায় কি করে? সঙ্গে সঙ্গে কত সহস্র জ্ঞান যে রাস্তায় নেমে এলো, তা এখানে লিখলে আজ আর এই লেখা শেষ হবে না, তবে শেষের কথাটি না লিখে পারছিনা।"এত দূর পড়াশোনা করে সময় নষ্ট করে কি লাভ হল, পার্টির ঝান্ডাটা তুলে নিলে একটা না একটা চাকুরী ঠিক জুটে যেত। অবশ্য, কিছু টাকা লাগত.........."এই কথা গুলো শুনতে শুনতে মনে কিছু প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছিল সেদিন। শেষে আর মন সায় দিলোনা, করে ফেললাম একটা প্রশ্ন : 'পড়াশোনা করেছিলাম বলেই সত্য আর ভড়ং এর মধ্যে পার্থক্যটা বুঝতে শিখেছি। পড়াশোনাই আমাকে বুঝতে শিখিয়েছে সাফল্য মানে টাকা নয়; টাকার মোহ ত্যাগ করে উৎকর্ষতা অর্জনের চেষ্টা। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগছে যে, আমি আপনার হাঁটুর বয়সী হয়েও যে কথা বুঝতে পারি বা পেরেছি আপনি তা পারেননি। সত্যিই বিস্ময়কর! যদি সাফল্যের মানে টাকাই হত তবে ক্ষুদিরাম বসু সারাজীবনে এক টাকাও উপার্জন করেননি কিন্তু স্বাধীনতা কী? এবং স্বাধীনতার মর্মার্থ কী? তা বোধহয়, তৎকালীন সময়ে ক্ষুদিরাম বসুর চেয়ে আর কেউ ভালো বোঝেননি।' সঙ্গে সঙ্গে ওনার উক্তি হল - আঙুর ফল টক। এককালে, এদের মতো মানুষদের এইসব কথা শুনে রাগ হোতো; এখন আর রাগ হয়না; করুণা হয়। তাই সেদিন আর রাগ হল না, উল্টে করুণা হল।আসলে জানা আর অজানার মধ্যে দূরত্ব শুধু 'অ' তে। তবে এতকাল এই 'অ' নির্বুদ্ধিতা আর বুদ্ধিমানের ফারাক ঠিক করে দিলেও আজ আর এর কোনো ভূমিকা নেই। কারণ এখন জানাকে অজানা গ্রাস করতে চাইছে। এখন সত্যকে ধারণা বশ করতে চাইছে। তাই আজ এই সবজান্তাদের হাতে ভারত তথা বাংলার রাশ। তাই আজ মূর্খরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর শিক্ষিতরা শ্মশানের শোভা বাড়াচ্ছে। সত্যিই বিচিত্র আমার দেশ। তবু একটাই শান্তি, যারা এখনও বেঁচে আছে তারা লড়াই ছাড়েনি।আমার আশা যে, আগামী দিনে সত্যেরই জয় হবে; হতেই হবে। তবে এই আশা বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার ফলশ্রুতি। অন্ধ বিশ্বাসের বশবর্তী নয়।
এবার আসা যাক এদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও সামাজিক উপস্থিতির বিশ্লেষনে। পরচর্চা আর পরনিন্দা হলো এদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। শিক্ষকতা, চিকিৎসা থেকে শুরু করে কৃষিকাজ সহ নানা পেশায় এরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি প্রায় প্রত্যেকের মধ্যেই কম বেশি পরিলক্ষিত হয়। জীবনে এদের মূল লক্ষ্যই টাকা উপার্জন করে মন্থন উপযোগী সঙ্গী খুঁজে যৌনচাহিদা নিবৃত্তির মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের উৎপাদন। তাই উৎকর্ষতা এদের থেকে আশাই করা যায় না। অনেকের ধারণা হতে পারে যে, শিক্ষকতা, চিকিৎসার মত পেশায় যুক্ত হয়েও কি করে একজন মানুষের মধ্যে উৎকর্ষতা অনুপস্থিত থাকতে পারে! তাদের বলি, তোতা পাখিকেও বহুদিন ধরে অভ্যাস করালে কথা বলতে পারে, তাই বলে এটা ধরে নেওয়া কী ঠিক যে, তোতাপাখি উৎকর্ষতার চূড়ান্ত নিদর্শন। যে দেশে শিক্ষা,স্বাস্থ্য,রাজনীতি সমস্ত জায়গায় সমান্তরাল ব্যবস্থা চলে। অর্থাৎ এক দল আছে যারা মেধার ভিত্তিতে সুযোগ পায় আর আরেক দল আছে যারা অর্থের ভিত্তিতে সুযোগ পায় সে দেশে উৎকর্ষতা নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করাটাই বোধহয় একটু বেশী বাড়াবাড়ি। যে দেশে সাম্যের কথা কথা বলেও সংরক্ষণ নামক বিষ দীর্ঘ ৭০ বছর ধরে খাওয়ানো হয়, সে দেশে আর যাই হোক উৎকর্ষতার কোন স্থান নেই। যে দেশে আজও রাজনৈতিক প্রভুদের অঙ্গুলিহেলনে কলেজে, স্কুলে ভর্তি প্রক্রিয়া চলে সে দেশ, উৎকর্ষতা নিয়ে গর্ব করতে পারে কি? আর সর্বোপরি যে দেশে সমাজের মেরুদন্ড গঠনকারী (শিক্ষক) বলে যাদের ভাবা হয় তাদের মধ্যে একাংশ যখন বৃত্তি অর্জন হেতু উৎকোচ কিংবা দলীয় রাজনীতির আশ্রয় নেয়, সে দেশে উৎকর্ষতা আর রসাতল দুটোই সমার্থক বলে মনে করি। যে দেশে শিক্ষামন্ত্রী, নিজের পদাধিকার বলে টুকলি করে পিএইচডি লাভ করেন, সে দেশে উৎকর্ষতা বলে কোন বস্তু আছে কি? যেদেশে গবেষণার নামে পুরনো তাত্ত্বিক বিষয়গুলির অনুসিদ্ধান্তগুলিকে তুলে ধরা হয়, সে দেশে উৎকর্ষতার অনুপস্থিতি কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। যে দেশে বহু ক্ষেত্রে স্নাতক, স্নাতকোত্তর কিংবা পিএইচডি ভর্তির সময় মেধার থেকে আনুগত্য কিংবা বাৎসল্যকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়, সেদেশে মৌলিক গবেষণা তথা উৎকর্ষতা সোনার পাথরবাটি। আর সবশেষে বলি, যে সভ্যতায় উৎকর্ষতা বলতে আজও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থাকেই মনে করা হয় এবং উৎকর্ষতার চূড়ান্ত নিদর্শন স্বরূপ পিএইচডিকেই তুলে ধরা হয়, সে দেশে আর যাই হোক উৎকর্ষতা একটি অলীক কল্পনা। মাঝেমাঝে ভাবি, এই কসমেটিক উৎকর্ষতার গেরোয় পড়লে সেদিনের লালন কিংবা রবীন্দ্রনাথ আজকের লালন ফকির কিংবা কবিগুরু হতে পারতেন কি? কে জানে!
এতক্ষণ কথা হল এদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে। এবার আসা যাক এদের কিছু ভাবনা চিন্তার প্রসঙ্গে। এরা প্রতিনিয়ত যে সমস্ত কথা বলে পরমুহূর্তে তার বিপরীত কাজেই বেশি উদ্যত হয়। এরা মুখে বলে ঠিকই যে, পৃথিবীতে কোন কাজই ছোট নয় কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ঠিক এর উল্টোটা করে। উপরিউক্ত বিষয়টি একটি উদাহরণ দিলে আরও স্পষ্ট হয়ে যাবে। ধরা যাক, এদের প্রশ্ন করা হল যে, সোনাগাছিতে যারা নগরবধূর কাজ করে তাদের কাজকে কেন সমাজ ছোট চোখে দেখে? তখন এরা সুড়সুড় করে কেটে পড়াটাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এরা কিছুতেই স্বীকার করেনা নগরবধূর বৃত্তি এই সমাজের পাশবিক লালসার একটি চিহ্ন মাত্র। আসলে এরা বাহ্যিক দিক থেকে একরকম এবং অভ্যন্তরীণ দিক থেকে ঠিক তার বিপরীত। অর্থাৎ এদের কথা এবং কাজের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ পরিলক্ষিত হয়। উৎকর্ষ ব্যক্তি তাকেই বলে যে সত্যকে সমাজের গড়পড়তা চালু দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখে; সত্যকে সত্যের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে। এবং একজন উৎকর্ষ ব্যাক্তি অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে জীবন সত্যকে উপলব্ধি করতে সক্ষম। আর যারা এটা করতে পেরেছেন তাদেরই এই সমাজ, এই দুনিয়া চিরকাল মনে রেখেছে। আর এরা এটা করতে পারা তো দূরস্থান, এই ভাবনাই এদের ভাবনায় আসে বলে আমার মনে হয় না। তাই সমাজ যাকে ভুল বলে, এরা তাকে ভুল বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে অর্থাৎ স্রোতের বিপরীতে হাঁটার মতো মজ্জা এদের নেই। আমরা জানি, একটি সারমেয় যদি চিৎকার করে তবে পুরো দল তার সাথে চিৎকার করে। এই সবজান্তারাও ঠিক এই নীতিতেই বিশ্বাসী। কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে এরা বাকি সকলের থেকে আলাদা। কিন্তু কাছ থেকে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে মনে হবে গড়পড়তা আর পাঁচটা মানুষের মতোই এদের আচরণ। শুধু একটা জায়গায় এরা বাকিদের থেকে আলাদা, সেটা হল এরা সহজ কথাকে পেঁচিয়ে বলতে বেশি ভালোবাসে। আপাতদৃষ্টিতে অত্যন্ত জ্ঞানী বলে মনে হলেও এরা মূর্খের থেকেও অধম। কোন কাজই ছোট নয় এটা ঠিক। কিন্তু আমার কাজটা যদি অপরকে ছোট করা হয়, তবে সে কাজটি দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্টতম একটি কাজ। সেটা এদের বোঝাবে কে? কারণ এরা এক অদ্ভুত বর্মের মধ্যে নিজেকে ঢুকিয়ে রাখে। এরা সবার সমালোচনা করে কিন্তু এদের কোন বিষয়ে যখনই আপনি টিপ্পনি করবেন তখনই আপনাকে শুনতে হবে - 'সমাজে বড়-ছোট জ্ঞান হারিয়ে গেছে কিংবা মানুষ আর মানুষকে সম্মান করে না...' ইত্যাদি ,ইত্যাদি।কি অদ্ভুত তাই না? মনে হচ্ছে এরা যেন একতরফাভাবে সমস্ত কিছুর সমালোচনা করার ঠিকা নিয়ে বসে আছে। কিন্তু এদের সমালোচনা করায় মানা। এই প্রসঙ্গে বলি, কিছুদিন আগে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা। কিছুকাল আগেও আমার বাড়িতে নিত্যদিনের যাতায়াত ছিল এনার। কিন্তু কোনো এক অলীক করনে গত ৩-৪ বছর যাবৎ সেই যাত্রায় ছেদ পড়েছে। তার আগে জেনে নেওয়া যাক এনার চারিত্রিক গুণাবলী সম্পর্কে। এনার গুণাবলী সম্পর্কে যতই বলা হোক না কেন; এনার গুণের অন্ত নেই। সবজান্তাদের প্রায় সমস্ত গুণগুলিই এনার মধ্যে ঠেসে ঠেসে ভরা আছে। প্রত্যেকদিন চায়ের আড্ডায় এনার, যে কোন এক প্রতিবেশী বাড়ির কেচ্ছা চাইই - চাই। আর যেদিন কেচ্ছা থাকেনা, সেদিন কাছাগুলোর উপর বেশি চাপ থাকে। কারন, কাছা টানাতেও ইনি সাবলীল এবং সিদ্ধহস্ত। এনার মতে, ভালোবাসা পাপ। এদিকে এনার দু- দুটো মেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছে, তবুও ইনি নিজের তত্ত্বে এখনও অনড়। অদ্ভুৎ না? এ আর কী দেখলেন; পড়তে থাকুন - ক্রমশ প্রকাশ্য। এনার করবার দেখলে অদ্ভুতও ভূত হয়ে যায়। ভূত, ভবিষ্যৎ সব ঘেঁটে ঘ'। আসুন আরও একটু জানি। কোন কাজই ছোট নয় - এটা এনার মূল মন্ত্র। কিন্তু দিবারাত্রি এনার প্রধান কাজ হল - ধূমপান এবং তাসের আড্ডা। এবার আসা যাক মূল বিষয়ে, আজ থেকে ৪-৫ বছর আগেও দেখা হলে ইনি আমাকে জিজ্ঞাসা করতেন, 'বাবু কেমন আছিস?' কিন্তু সেদিনের সাক্ষাতে এনার প্রথম উক্তিটি হল, 'কি করছিস এখন?' প্রথমে ভাবলাম, বাঙালির সনাতনী কর্ম অর্থাৎ গৃহশিক্ষকতা করছি; এটা বলব। কিন্তু পরমুহুর্তে ভাবলাম এনার কাজ তো সমালোচনা করা; আমি গৃহশিক্ষকতা বলি কিংবা বেকার বলি; আজ এনার চায়ের পেয়ালায় মূল চর্চার বিষয় তো আমিই। কারণ দুটোতেই তো অর্থের প্রাচুর্যতা অনুপস্থিত। তাই এনার কাছে দুটোই সমান। আমি যাই বলি না কেন, আজ চায়ের আড্ডায় আমিই এনার হট টপিক। তাই আমি কোন কথা না বলাটাকেই বেশি সমীচীন মনে করলাম। কিন্তু সবজান্তার সহজাত অভ্যাস; যায় কি করে? সঙ্গে সঙ্গে কত সহস্র জ্ঞান যে রাস্তায় নেমে এলো, তা এখানে লিখলে আজ আর এই লেখা শেষ হবে না, তবে শেষের কথাটি না লিখে পারছিনা।"এত দূর পড়াশোনা করে সময় নষ্ট করে কি লাভ হল, পার্টির ঝান্ডাটা তুলে নিলে একটা না একটা চাকুরী ঠিক জুটে যেত। অবশ্য, কিছু টাকা লাগত.........."এই কথা গুলো শুনতে শুনতে মনে কিছু প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছিল সেদিন। শেষে আর মন সায় দিলোনা, করে ফেললাম একটা প্রশ্ন : 'পড়াশোনা করেছিলাম বলেই সত্য আর ভড়ং এর মধ্যে পার্থক্যটা বুঝতে শিখেছি। পড়াশোনাই আমাকে বুঝতে শিখিয়েছে সাফল্য মানে টাকা নয়; টাকার মোহ ত্যাগ করে উৎকর্ষতা অর্জনের চেষ্টা। কিন্তু ভাবতে অবাক লাগছে যে, আমি আপনার হাঁটুর বয়সী হয়েও যে কথা বুঝতে পারি বা পেরেছি আপনি তা পারেননি। সত্যিই বিস্ময়কর! যদি সাফল্যের মানে টাকাই হত তবে ক্ষুদিরাম বসু সারাজীবনে এক টাকাও উপার্জন করেননি কিন্তু স্বাধীনতা কী? এবং স্বাধীনতার মর্মার্থ কী? তা বোধহয়, তৎকালীন সময়ে ক্ষুদিরাম বসুর চেয়ে আর কেউ ভালো বোঝেননি।' সঙ্গে সঙ্গে ওনার উক্তি হল - আঙুর ফল টক। এককালে, এদের মতো মানুষদের এইসব কথা শুনে রাগ হোতো; এখন আর রাগ হয়না; করুণা হয়। তাই সেদিন আর রাগ হল না, উল্টে করুণা হল।আসলে জানা আর অজানার মধ্যে দূরত্ব শুধু 'অ' তে। তবে এতকাল এই 'অ' নির্বুদ্ধিতা আর বুদ্ধিমানের ফারাক ঠিক করে দিলেও আজ আর এর কোনো ভূমিকা নেই। কারণ এখন জানাকে অজানা গ্রাস করতে চাইছে। এখন সত্যকে ধারণা বশ করতে চাইছে। তাই আজ এই সবজান্তাদের হাতে ভারত তথা বাংলার রাশ। তাই আজ মূর্খরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর শিক্ষিতরা শ্মশানের শোভা বাড়াচ্ছে। সত্যিই বিচিত্র আমার দেশ। তবু একটাই শান্তি, যারা এখনও বেঁচে আছে তারা লড়াই ছাড়েনি।আমার আশা যে, আগামী দিনে সত্যেরই জয় হবে; হতেই হবে। তবে এই আশা বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার ফলশ্রুতি। অন্ধ বিশ্বাসের বশবর্তী নয়।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
বিজন বেপারী ১৪/০৫/২০২০ভালো।
-
ফয়জুল মহী ১৩/০৫/২০২০Awesome