জীবন নামের বায়োস্কোপ
-অবন্তী, অ-ব-ন্তী।
-জী মা মনি।
-কোথায় তুমি? স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হও। আজ আমি অফিসে যাব না। রহিম চাচা তোমাকে স্কুলে দিয়ে আসবে।
-আচ্ছা, মা।
ড্রইং রুমে বসে শ্রাবন্তী তার ১০ বছরের মেয়ে অবন্তীকে কথা গুলো বলেই রহিম চাচা কে ডাকে।
-রহিম চাচা, ও রহিম চাচা।
ডাক শুনে রহিম চাচা রান্না ঘর হতে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দৌড়ে এসহসে শ্রাবন্তীর সামনে দাঁড়ায়।
- চাচা, তুমি আজ অবন্তী কে স্কুলে নিয়ে যাবে, ফেরার পথে বাজার নিয়ে আসবে। এই ধর বাজারের লিষ্ট।
রহিম চাচা হাত বাড়িয়ে বাজারের লিষ্টটি নিয়ে নেয়। শ্রাবন্তী বুঝিয়ে দেয় আজ কি কি বাজার করতে হবে। আজকে একটা বিশেষ দিন, তাই একটা লম্বা লিষ্ট করেছে। রহিম চাচা মনোযোগ দিয়ে শ্রাবন্তীর কথা শুনতে শুনতেই হাতের চায়ের কাপের অবশিষ্ট চা টুকুতে তার দৈনন্দিনের রীতি মতোই আয়েশী শব্দ করে শেষ চুমুকটি দেয়। অতি অপছন্দের চা খাওয়ার এই অদ্ভুদ আওয়াজ শুনা মাত্রই শ্রাবন্তীর মনের সাগরে এক অজানা ঢেউ আছড়ে পড়ে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে রহিম চাচার চা খাওয়া দেখতে থাকে। স্মৃতি পটে ভেসে উঠে কিছু জীবন্ত স্মৃতি, যা আঁকরে ধরে বেঁচে আছে শ্রাবন্তী। স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠে রাতুলে চা খাওয়া দৃশ্য----
-এইসব কি?
-কি?
-তুমি আবারো আওয়াজ করে চা খাচ্ছো?
-কি করব পুরনো অভ্যাস, বললেই তো আর বদলানো যায়না।
-আওয়াজ না করেও তো চা খাওয়া যায়, কি যায়না?
-যায় কিন্তু প্রতিটা চুমুকে আওয়াজ করে খাওয়ার যে মজা ঐটা পাওয়া যাবেনা। চা খেয়ে পেট ভরলেও মন ভরে না। মনেরও তো একটা ক্ষুধা আছে না! তাকেও কিছুতো দিতে হবে।
-উফফ্ তোমাকে manner শেখাতে শেখাতে ই বিয়ের ৩ বছর কেটে গেল।
-হেহেহে।
-হাসবে না বলে দিলাম।
-আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি আমাকে দুইটা বিস্কিট দিয়ে যাও, চায়ে চুবিয়ে চুবিয়ে খাই।
-কিচ্ছু পাবেনা, এই চা টা শেষ করে বাজারে যাও। অফিস বন্ধ পেলেই হল, সারাদিন একেক ফরমায়েশ থাকে তোমার।
-তুমিও তো মনে মনে অধীর অপেক্ষায় থাকো আমার ঐ ফরমায়েশ গুলোর জন্য, সারক্ষন চিন্তায় থাকো কিভাবে আমার ফরমায়েশ গুলো পূরন করবে?
-অসভ্য কোথাকার! (লজ্জায় মুখ লাল হয়ে যায় শ্রাবন্তীর)
-হ্যা, আমি অসভ্য, আমার ভালবাসা কানায় কানায় আদায় করে নিতে আরো অসভ্য হতে পারি আমি। হা হা হা।
-হয়েছে লক্ষীটি, এখন যাও, কষ্ট করে বাজার গুলো এনে দাও। অনেক বেলা হয়ে গেল, একটু পড়ইতো পেটের ক্ষুধা চাঙ্গা হয়ে উঠবে, তখন তোমার সব রোমান্টিকতা জানালা দিয়ে পালাবে।
-আচ্ছা, তবে চলনা আজ সারাদিন দু'জনে বাইরে কাটিয়ে আসি।
শ্রাবন্তী পেটের দিকে দেখিয়ে বলে-
-যেতাম, তবে চলাফেরায় ডাক্তারের নিষেধ আছে, এত তারাতারিই ভুলে গেলে?
রাতুল সম্বিত ফিরে পেয়ে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, আর কোন কথা না বলে দ্রুত রেডি হয়ে নেয়।
-আজ তোমার ছুটি, কোন কাজ করতে হবে না। আজ আমি রান্না করব, আমার সেই বিখ্যাত ব্যাচেলর খিচুড়ি, সাথে স্পেশাল ডিম উইথ আলু ভর্তা। উহ্ জিহ্বায় পানি চলে আসছে।
যথারীতি শ্রাবন্তী বাজারের লিষ্টটি রাতুলের পকেটে ডুকিয়ে দেয়। দরজা খুলে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রাতুল জুতা পড়ে শ্রাবন্তীর দিকে না তাকিয়েই চলে যাওয়ার ভাব দেখায়। শাবন্তী একটু এগিয়ে এসে রাতুলের শার্টের কলার চেপে ধরে টান দিয়ে কাছে নিয়ে আসে। প্রতিদিনের মত মনে মনে একটি দোয়া পড়ে রাতুলের বুকে ফুঁ দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাতুলের দিকে মুখ এগিয়ে দেয়। রাতুল শ্রাবন্তীর মাথা ধরে আরো কাছে নিয়ে এসে আলতো করে ঠোটে একটা চুমু দেওয়ার সময় ইচ্ছে করে দাঁত দিয়ে ঠোটে হালকা ব্যাথা দেয়। ছেড়ে দিয়ে হাসতে হাসতে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামতে থাকে। শ্রাবন্তী রাগান্বিত স্বরে বলে ওঠে-
-অসভ্য কোথাকার, বাজার থেকে আসো, তোমার জন্য কঠিন শাস্তি রেডি করে রাখছি।
-তা-ই, তাহলে বাজারেই না যাই, তোমার পানিসমেন্টের লোভ সামলাতে পারছি না।
শ্রাবন্তী জিব বের করে তার বহু বিখ্যাত ভেংচি কাটে। রাতুল হাসতে হাসতে এক এক করে সিড়ি দিয়ে নীচের দিকে নামতে থাকে।
নীচে নেমে রাতুল ছোট্র দোকান থেকে একটা সিগারেট নেয়। সিগারেট ধরিয়ে লম্বা একটা টান দিয়ে ভাবতে থাকে ফেলে আসা দিন গুলোর কথা-
শ্রাবন্তী আর রাতুল ভালবেসে বিয়ে করেছে। বিয়ের বয়স ৩ বছর। বিয়েটা তারা নিজেরাই করেছে। পরিবর্তিতে দুই পরিবারই মেনে নিয়েছে। দু'জনে খুব ছোট্র একটা সুখের ঘর বেঁধেছে। এত সুখের মাঝেও একটা অপরিপূর্ণতা রয়ে গেছে। বিয়ের বয়স তিন বছর হলেও তাদের সংসার আলো করে কোন বাচ্চা আসেনি আজও। অথচ সেই প্রেমের শুরুতেই কত স্বপ্ন দেখে রেখেছে দু'জনে। ক্লাশের ফাকে জাঁরুল তলায় রোমান্স করতে বসে ছেলে হবে না মেয়ে হবে, এটা নিয়ে কত ঝগড়া করেছে দু'জনে! রাতুল চাইতো মেয়ে হোক, যুক্তিও দ্বার করতো অদ্ভুত অদ্ভুত। --
-ছেলে হলে একটু বড় হয়েই আমার পকেট থেকে টাকা মারতে শুরু করবে, বন্ধুদের নিয়ে গার্লস স্কুলের সামনে দাড়িয়ে বিড়ি টানবে, আর মেয়েদের ডিস্টার্ব করবে। প্রতিদিন পাড়ার সকল মেয়েদের বাবা-মা বিচার নিয়ে আসবে তোমার কাছে। অথচ ঘরে সারাক্ষন আমাদের ঝগড়াতে তোমার পক্ষ নিবে। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে একটা বিড়ি পর্যন্ত খেতে পারবো না। নালিশ লাগাবে তোমার কাছে,"মা, পাপা বারান্দায় লুকিয়ে লুকিয়ে বিড়ি টানছে"। আর মেয়ে হলে স্কুলের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে আমার জন্য একটা প্রিয় বেন্ডের বিড়ি কিনে আনবে। লুকিয়ে লুকিয়ে টানারও ব্যবস্থা করে দিবে। পাহাড়া দিবে দাঁড়িয়ে যেন জল্লাদের চোখে না পরি।
-ইস্ আমার ছেলে তোমার মত অসভ্য হবে না।
-এই জন্যই তো বেশি ভয়। আমার মত হলে তো আর কোন কথাই ছিল না।
বলেই হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে শ্রাবন্তীর গায়ের উপর। আর শ্রাবন্তী ধুম ধুম করে কিল মারতে থাকে রাতুলের পিঠে।
নামও ঠিক করে রেখেছে দু'জনে। ছেলে হলে রাতুল নাম দিবে কুদ্দুস্যা, আর শ্রাবন্তীকে ডাকবে 'ও কুদ্দুস্যার মা' বলে। আর মেয়ে হলে নাম রাখবে অবন্তী, শ্রাবন্তীর নামের সাথে মিল রেখে। শ্রাবন্তীও রাতুলের দেখাদেখি বলে মেয়ে হলে নাম দিবে কুদ্দুসী, রাতুল কে ডাকবে 'ও কুদ্দুসীর বাপ' বলে। আর ছেলে হলে নাম দিবে অতুল।
এরই মধ্যে মোবাইল বেজে উঠে রাতুলের-
-হ্যালো।
-হ্যা বলো।
-কই তুমি?
-বাজারে আসলাম তো।
-মিথ্যাবাদী। রাস্তায় দাঁড়িয়ে তোমার ছেলের মত বিড়ি টানছো আর মেয়ে দেখছো?
রাতুল উপরের দিকে তাকিয়ে দেখে। রাস্তা থেকে রাতুলের বারান্দা দেখা যায় না। হাতের ইশারায় একটা রিক্সা ডেকে লাফ দিয়ে উঠে পরে।
-ও শোন সাবধানে থেকো, রাস্তা ঘাটের অবস্থা ভালো না।
-হাহাহা আচ্ছা জানু।
-তাড়াতাড়ি এসো।
-কি দেরি সইতে পারছো না, জান?
-অসভ্য।
বলেই লাইন কেটে দেয় শ্রাবন্তী।
গত এক বছর ধরে চিকিৎসা চলছে শ্রাবন্তীর। আত্নীয় স্বজনের পরামর্শে দু'জনেরই শারিরীক পরীক্ষা করা হয়। মেডিকেল চেক-আপে শ্রাবন্তীর সমস্যা ধরা পড়ে। রেজাল্ট জানতে পেরে শ্রাবন্তী খুব ভেঙ্গে পরে। একদিন রাতুলের বুকে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলে, 'তুমি আর একটা বিয়ে করো, আমি তোমাকে তোমার প্রিয় উপহার দিতে পারবো না। কেউ তোমার জন্য টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে বিড়ি গিফ্ট করবে না। আমাকে নালিশও করবে না কেউ কোন দিন'। রাতুল হালকা করে শ্রাবন্তীর মাথায় থাপ্পর মেরে বলে-'ইদানীং কি বাংলা সিনেমা বেশি দেখো? শাবানা হতে চাও? হু, আমার ভালবাসা অবশ্য সাগরের মত অসীম, শুধু একজন কে দিয়ে শেষ করতে পারছি না, এই ভালবাসা নেওয়ায় যদি তোমার অক্ষমতা থাকে তবে একটা মেয়ে খোজ, নিস্পাপ আলমগীরের মত আরেকটা শাদী করে ফেলি।' শ্রাবন্তী ধুম করে একটা ঘুষি মেরে রাতুলের বুকে মুখ গুজে পরে থাকে। রাতুলও শক্ত করে বুকে ধরে রাখে তাকে।
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যানে ও ডাক্তারদের এক বছরের অসীম চেষ্টার ফলে শ্রাবন্তীর মুখে হাসি ফোটে। তিন মাস আগে খুশির খবরটি রাতুল কে সে জানায় এভাবে-'তোমার জন্য একটা দুঃসংবাদ, তোমার কপাল পুড়লো, বাংলা সিনেমার আলমগীর হতে পারলে না তুমি, আমাকেও শাবানা হতে হবে না আর।' রাতুল বুঝতে পেরে শ্রাবন্তীকে কোলে তুলে খুশিতে নাচতে থাকে, সিনেমার মতই সবাই কে বলতে থাকে, মিষ্টি খাওয়াতে থাকে।
লিস্ট অনুযায়ী সব কেনা কাটা করে ফেলে রাতুল। আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারী, বিশ্ব ভালবাসা দিবস। তাছাড়া রাতুল-শ্রাবন্তীর কাছে আরও একটা বিষেশত্ব আছে আজকের দিনটি। আজকের এই দিনটাতেই রাতুলের প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছিল শ্রাবন্তী।
কিন্তু সকাল হতে দু'জনের কেউই ইচ্ছে করে প্রকাশ করছে না, ভুলে যাওয়ার অভিনয় করে যাচ্ছে। কোন্ অজুহাতে উইস করবে ঠিক করা নেই, রাতুল এমন ভাব দেখায় যেন শ্রাবন্তী মনে করে দেওয়ায়ই উইস করছে। ভুলে যে যায়নি তার প্রমান দেওয়ার জন্য অবশ্য বছর হিসেব করে তত সংখ্যক গোলাপ উপহার দেবে। রাতুলের যুক্তি সময়ের সাথে সাথে ভালবাসা বাড়তে থাকে, তাই প্রথম বছর একটি গোলাপ দিয়ে উইস করেছিল। এবার সাতটি গোলাপ কিনতে হবে। বাসার কাছেই ফুলের দোকানে এক সপ্তাহ আগে অর্ডার দিয়ে রেখেছে স্পেশাল সাতটি গোলাপের জন্য। আর ছোট্র একটা কাঠের পুতুল পছন্দ করে রেখেছে আসন্ন অতিথির জন্য। বাসায় ফেরার পথে রিক্সা থেকে নেমে নিয়ে নেবে।
এদিকে রাতুল ঘর থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই শ্রাবন্তী সাজুগুজু করার জন্য ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে যায়। ঠোটে লিপিষ্টিক লাগাতে গিয়েই সাত বছর আগের কথা মনে পড়ে যায়। আয়নায় নিজের চেহারার দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই হেসে ফেলে, লজ্জায় লাল হয়ে যায়। কতটা নির্লজ্জ! প্রথম দিনেই এমন কথা কেউ বলে! সাত বছর আগে ঠিক এই দিনেই খুব সুন্দর করে সেজে রাতুলের সাথে দেখা করেছিল শ্রাবন্তী। লজ্জায় মাথা তুলতে পারছিল তারপর আবার লম্পটটার বাদরামিতে লজ্জায় চোখে পানি আসার উপক্রম হয়েছিল। শ্রাবন্তী কে দেখেই রাতুল দৌড়ে সামনে এসে দাড়িয়েই বলা শুরু করে-
- হি হি হি, শ্রাবন্তী, তোমাকে একেবারে প্রেত্নীর মত লাগছে। এত সাজুগুজু করেছো কেন?
-সত্যিই আমাকে খুব বিশ্রি লাগছে?
-অবশ্যই, এত গাঢ় করে লিপিষ্টিক দিয়েছো কেন? তুমি জানো না লিপিষ্টিক দিলে কিস্ করতে খুব অসুবিধা হয়, ডায়রিয়াও হয়ে যেতে পারে। তুমি কি চাও আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি? কাল আমার পরীক্ষা।
-অসভ্য। বলে শ্রাবন্তী হাতের ফুলের তোরা রাতুলের দিকে ছুড়ে মারে। ব্যাগ থেকে টিসু বের করে লিপিষ্টিক মুছতে যায়, অমনি রাতুল বাধা দিয়ে বলে-
-প্লিজ শ্রাবন্তী, মুছো না। তোমাকে দারুন লাগছে, মনে হচ্ছে আকাশ থেকে জীবন্ত একটা পরী নেমে এসেছে। শিল্পী হলে একটা ছবি একে ফেলতাম, ছবি অবশ্য একে ফেলেছি, হৃদয়ে, শত বছরেও এ ছবি মুছবে না। তোমার জবাব আমি পেয়ে গেছি শ্রাবন্তী, চোখ দিয়ে ব্যক্ত ভাষাতে।
শ্রাবন্তীও রাতুলের মত পাগলামি করে। আজ ওর জন্য অদ্ভুত একটি গিফ্ট কিনে এনেছে। অনেক লজ্জা উপেক্ষা করে দোকান থেকে একটা সিগারেট কিনে এনেছে। বাসায় ফিরলেই আর নিজেকে ধরে রাখতে পারবে না সে। রাতুলের উপহার নিয়েই সুন্দর প্যাকেটে মোরানো সিগারেটটা ধরিয়ে দিবে। প্রথম বারতো প্যাকেট খুলে মহা আশ্চার্য হয়ে গিয়েছিল। খুলে বলেছিল-
-একটা কেন? এক প্যাকেট দিতে। -আমার ভালবাসা তোমার মত ঐ বিশাল সাগের মত নয়, ছোট্র, ঠিক আমার হৃদয়ের মতই অতি ক্ষুদ্র যা শুধু তোমাকে দিয়েই শেষ করে ফেলেছি। যে টুকু অবশিষ্ট আছে তা প্রকাশ করতে এই একটা সিগারেটই যথেষ্ট। হা হা হা। সোফায় শ্রাবন্তীর কোলের উপর মাথা রেখে আয়েশ করে সিগারেট টা টেনেছিল রাতুল। এত সহজে ভালবাসার মানুষটিকে খুশি করতে পেরে শ্রাবন্তী খুবই উপভোগ করেছিল।
-সিগারেট কোম্পানীকে অনুরোধ করবো যেন লম্বা একটা সিগারেট বানায়, যেন অনন্তকাল টানলেও শেষ না হয়। সুখের সময় গুলো খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়, তাই না?
এবার শ্রাবন্তী দু'টো সিগারেট কিনেছে, রাতুল কে অবাক করে দেওয়ার জন্য, ওর জন্য একটা, আরেকটা কুদ্দুস্যার জন্য, এটায় হাত দিতে পারবে না ওয়ার্নিং লেখা আছে, ১৮ বছর পর খুলতে হবে। এই সামান্য গিফ্ট কিনতে কত না ঝামেলা পোহাতে হয়েছে! দোকান খুজতে হয়েছে, দোকানে অপেক্ষা করতে হয়েছে কখন খালি হবে, লজ্জা ফেলে দোকানদার কে সিগারেটের কথা বলা মাত্র হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেছে শ্রাবন্তীর দিকে। প্রতিবছরই একবার করে এমন ঝামেলায় পরতে হয় তাকে। এতেও এক ধরনের আনন্দ খুজে পায় শ্রাবন্তী। বান্ধবীরা কত শত দোকান ঘুরে কত বাছাই করে হাসবেন্ডকে খুশি করার জন্য গিফ্ট কেনে! অথচ সে কত অনায়াসেই চয়েজ করে ফেলে। গিফ্ট পছন্দ হয়েছে কিনা জিজ্ঞাসাও করতে হয় না, চোখে অনাবিলা আনন্দ ভেসে ওঠে অনায়াসেই।
বাইরে হঠাৎ বিকট শব্দ হওয়ায় শ্রাবন্তী দৌড়ে বারান্দায় যায় কি ঘটলো দেখার জন্য। কিছুই বুঝতে পারে না। শুধু কিছু মানুষের চিৎকার ভেসে আসে। কিছুক্ষন পর মোবাইলের রিং টোন শুনে দৌড়ে এসে রাতুলের কল দেখেই রিসিভ করে।
-হ্যালো, রাতুল? তুমি কোথায়? কি হয়েছে বাইরে?
অপর পাশ থেকে অপরিচিত একটি কন্ঠ শুনতে পায় শ্রাবন্তী-
-হ্যালো, ম্যাডাম, আমি রাতুল নই। একজন রিক্সা ওয়ালা। উনি আমার রিক্সায়ই ছিল। ফুলের দোকানের সামনে আমাকে দাঁড় করিয়ে দোকানে ডুকে। এরপরই একটি মটর সাইকেল এসে দোকানে বোমা মেরে পালিয়ে যায়.....
আর কিছুই শুনতে পারে না শ্রাবন্তী। দড়জা খুলে দৌড়াতে থাকে ফুলের দোকানের দিকে। হাপাতে হাপাতে ভিড় ঠেলে দোকানের ভেতর ডুকে দেখে রাতুলের নিথর দেহ মাটিতে পরে আছে। একহাতে সাতটি গোলাপ আর অন্য হাতে ছোট্র একটি কাঠের পুতুল, পুতুল ধরা হাতটি বুকের উপর।
শ্রাবন্তী চোখে আর কিছুই দেখতে পায় না। কিছু বলতেও পারে না, রাতুলের শরীরের উপর লুটিয়ে পড়ে যায়, জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
-মা, আমি রেডি, রহিম নানু কোথায়?
অবন্তীকে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে-
-আজ তোকে স্কুলে যেতে হবে না। আজও হরতাল চলছে। পথে কখন কোন্ বিপদ আসে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। আমাদের এই দেশ আমাদের কে স্বাধীনতা দিতে পারেনি আজও, সামান্যতম নিরাপত্তাও দিতে পারেনি জীবনের। ঘর হতে বের হলে সুস্থ-স্বাভাবিক ভাবে ফিরতে পারবে বলে কেউ মনে করতে পারে না। তাই এ ঘরই আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের নিরাপত্তাও। আজ আমরা এই ঘরের মধ্যেই দিনটি উৎযাপন করবো।
আমরা আজ রান্না করবো, স্পেশাল রান্না, ব্যাচেলর খিচুরী, আলু ভর্তা উইথ ডিম, থ্রী ইন ওয়ান। হা হা হা....
-না মা, তোমাকে আজ আমি ঐ স্পেশাল রান্না করতে দেব না। তোমার চোখের পানি আমি সইতে পারি না। যতক্ষন তোমার এই রান্না চলে, ততক্ষন তোমার চোখ দিয়ে পানি ঝড়তে থাকে। খেতে বসে একটা দানাও মুখে দাও না, শুধু হাত দিয়ে নাড়তে থাকো।
আজ আমি রান্না করবো, আমার প্রিয় খাবার আইসক্রিম আর চিকেন ফ্রাই।
কখন যে চোখের পাতা ভিজে গেছে বুঝতে পারেনা শ্রাবন্তী। মেয়েকে আড়াল করে শাড়ীর আঁচল দিয়ে চোখ মোছে আর মনে মনে বলে, 'আর কখনও কাঁদবো না পাগলটার জন্য, অবন্তীই এখন আমার দুনিয়া, ওকে নিয়েই ভাববো, আনন্দ করবো, ও বুঝতে শিখেছে। ওকে আমার এ কষ্ট বুঝতে দেওয়া ঠিক হবে না।' সকল দঃখ চাপা রেখে চেহারায় কৃত্রিম হাসি নিয়ে আসে শ্রাবন্তী।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সবুজ আহমেদ কক্স ০৩/০৩/২০১৫খুব ভালো লাগলো ........................।
-
অ ০২/০৩/২০১৫ভালো ।।
-
কপিল দেব ০২/০৩/২০১৫ভাল লাগলো !