করোনায় একজন প্রবাসী।
করোনায় একজন প্রবাসী।
৪৬তম পর্ব।
মিশরের শাসক মনে করে কাতার তাদের বিরোধী বিভিন্ন প্রচারের পাশাপাশি মুসলিম ব্রাদারহুড় নেতা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। আরো একটা বিষয় সামনে আসছে তা হলো সৌদি যুবরাজ মোহাম্মাদ বিন সালমান আর আরব আমিরাতের যুবরাজ বিন জায়েদের মত বিরোধ শুরু হয়েছে নানা বিষয় নিয়ে। এক নাম্বার হলো ২০১৫ সালে ইয়েমেনে শুরু করা যুদ্ধ। ইমেয়েন যুদ্ধে নেতৃত্ব কার আওতায় রয়েছে তা নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। ইয়েমেনের দক্ষিণা অংশ দখলে রয়েছে আমিরাতের অর্থায়ানে পরিচালিত মিলিশিয়া বাহিনীর হাতে অপর দিকে উত্তরাংশে সৌদি আরব লড়াইরত হুতি বিদ্রোহীদের সাথে। আরেকটি ইস্যু হলো ইসরায়েল, আমিরাত ইতিমধ্যে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছে।এই দিকে বাহারাইনও ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে পরিণত হয়েছে ঘনিষ্ঠ মিত্রে। তাদের মধ্যে দহরম-মহরম সৌদির ও মিশরের ভিতর এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত নিজেকে এক নাম্বার মিত্র দাবি করে থাকে তা সৌদি যুবরাজ নিজের জন্য সমস্যা তৈরী করতে পারে বলে মনে করে।
আসলে কাতারের সাথে তড়িঘড়ি করে সম্পর্ক পুনরায় স্থাপনের পিছনে সৌদি যুবরাজে অন্য মতলব হলো আমেরিকার নতুন প্রশাসনের সাথে সম্পর্কের উন্নতি ঘটানোর চেষ্টা মাত্র। আরেকটি সুপ্ত ইচ্ছা হলো কাতারের বহুল প্রচারিত টিভি চ্যানাল আল জাজিরার সমর্থন আদায় করা। আর এর সমর্থন ফেলে আল জাজিরার মাধ্যমে যুবরাজ নিজের প্রচার করে মুসলিম বিশ্বে নিজেকে জনপ্রিয় করতে পারবে বলে মনে করে। মধ্যপাচ্যের জনগণ ব্যাপকভাবে আল জাজিরা আরবী দেখে থাকে কারণ আল জাজিরা স্বাধীনভাবে সত্য তথ্য তুলে ধরতে পারে। সৌদি আরব, মিশর কিংবা আমিরাতের চ্যানালগুলি অকাট্য সত্য তুলে ধরতে পারে না কারণ তা সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকে। তাই যুবরাজ মোহাম্মদ আল জাজিরার এই গ্রহণযোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে চান। তিনি তার পিতা সালমানকে অতি তাড়াতাড়ি ক্ষমতা হতে সরিয়ে নিজেই ক্ষমতার আসনে বসতে চান। তারপর ইসরায়েলের সাথে কূটনীতি সম্পর্ক স্থাপন জোরদার করতে চান এবং ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে চান। তবে অনেকে মনে করে ফিলিস্তিনের ন্যায্য অধিকার তার কাছে গুরত্বহীন ।
যুবরাজ ক্ষমতার চেয়ারে বসার জন্য প্রচণ্ড উতলা হয়ে আছেন। তাই তিনি ইসরায়েল এবং আমেরিকার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে চলেন। জিসিসি সম্মিলনে এই প্রথম আমেরিকার কোন লোক উপস্থিত ছিলেন আর উনি হলেন ট্রাম্প জামাতা ইহুদী কুশনার আর এটা অনেকের মাঝে কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে রাজ পরিবারে মতানৈক্য নেই এমকি পিতা পুত্রের মাঝেও দ্বন্দ্ব। রাজ পরিবারের নীতি নির্ধারক অনেকেই ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে নারাজ বিশেষ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও বাদশাহ ফিলিস্তিনের অধিকার রহিত করে ইসরায়েলের সাথে আলাপ করতেও রাজি নয়। সৌদি জনগণও ইসরায়েলের সাথে সৌদির উষ্ণ সম্পর্ক মেনে নিতে নারাজ। যুবরাজ চান ইসরায়েল নিয়ে তার কাজকর্ম মিড়িয়ায় যেন প্রচার কম হয়। বিশেষ করে আল জাজিরা যেন তাকে নিয়ে সরব না থাকে তাই বিনা শর্তে কাতারের অবরোধ তুলে নিয়ে কাতারকে সাথে রাখতে চান।
যুবরাজ মনে করে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিলে খুশি হবে জো বাইডেন কিন্তু তাতে আরব বিশ্বে যে খারাপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে তা ভাবছেন না। এতে মুসলিম বিশ্বে সৌদি আরবের সম্মান কমবে মনে করে বাদশাহ সালমান। এবং ফিলিস্তিন অধিকার রহিত করে পূর্ববতী বাদশাহরা কেউ ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দানের চিন্তাও করেনি, বর্তমান বাদশাহও সেই পথ অনুসরণ করে ফিলিস্তিনের স্বার্থ আদায় দৃঢ় থাকতে চান।
(চলবে)।
করোনায় একজন প্রবাসী।
৪৭তম পর্ব।
অনেকের ধারণা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশ্রয় পেয়ে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান কোন কিছুই তোয়াক্কা করেনি। ইয়েমেন যুদ্ধ, কাতারের উপর অবরোধ এবং ইসরায়েলের সাথে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা সবই হয়েছে ট্রাম্পের জানামতে। ট্রাম্পের সাথে প্রশ্নবোধক ঘনিষ্ঠতায় তিনি শুধু ইসরায়েলের সাথে গভীর যোগাযোগই স্থাপন করেননি আরো মুসলিম দেশকে চাপ দিয়েছেন ইসরায়েলকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য। আমেরিকান ঘনিষ্ঠতার দম্ভে আরব দেশের সম্পর্ককে ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলছেন। কিন্তু নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন উনাকে প্রশ্রয় দিবেন না তা বুঝাই যাচ্ছে। ইতিমধ্যে জো বাইডেন বলে দিয়েছেন আমরা সৌদি হতে গঠনমূলক আচরণ আশা করি, যদি বেপরোয় আচরণ করে এর পরিণাম অপেক্ষা করছে। মোহাম্মদের দমন নিপীড়নের আরো কিছু ঘটনা যোগ হয়েছে যার কারণে সৌদিকে সমাজচ্যুত ও যুবরাজকে ভয়ংকর মানুষ ভাবতে শুরু করেছে বিশ্ব।
এইতো মাত্র কয়েকদিন আগে সৌদি মানব অধিকার কর্মী লুজাইন আল হাথুরুলকে ছয় বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। মানবাকার কর্মীর এই সাজা জো বাইডেনের সাথে সম্পর্কের অবনতি হতে পারে কারণ এই সাজায় যুবরাজের ইচ্ছার প্রতিফলন রয়েছে। তাকে সৌদি সন্ত্রাস বিরোধী আইনে ছয় বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে বলে সৌদি সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে। ৩১বছর বয়সী এই মানবাধিকার কর্মীর বিরূদ্ধে সৌদি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে পাল্টানো চেষ্টা এবং জাতীয় নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার অভিযোগ করা হয়। আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর আদালত তাঁকে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেয়। রায় ঘোষণার সময় তিনি অঝোরে কান্নায় থেকে বলেন উচ্চ আদালতে আপিল করবেন। তাঁর বোন এক বিবৃতি দিয়ে বলেন আমার বোন সন্ত্রাসী নয় উনি মানবাধিকার কর্মী। এই সাজার মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয় যুবরাজ এবং রাজবংশ যে বলে সৌদিতে ব্যাপক পরিবর্তনের যে কথা তা আসলে মুখের পাকা বুলি। এর মধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দফতর বলেছেন হাথুরুলের এই সাজার প্রতি যুক্তরাষ্ট্র নজর রাখছে এবং এই ধরনের সাজায় তাঁরা চিন্তিত।
বাইডেনের সরকারের যোগ দেওয়া এক কর্মকর্তা বলেছেন বিশ্ব জুড়ে মানবাধিকারকে বাইডেন সরকার বেশী গুরত্ব দিবে। মানব অধিকার চর্চার জন্য সাজা দেওয়া অন্যায় এবং অগ্রহণযোগ্য,আমরা এখনো বলছি বিশ্বের যেখানেই মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে বাইডেন সরকার সেখানেই দাঁড়াবে। জাতীয় সংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ হাথরুলের রায়কে জালিয়াতিপূর্ণ বলে মত দিয়েছেন এবং এটাকে গভীর উদ্বেগজনক বলে দ্রুত মুক্তির দাবি জানিয়েছেন। এই মানবাধিকার কর্মী একজন নয় এমন শত শত রাজনৈতিক বন্দী রয়েছেন যাদের মিথ্যা অভিযোগে বিচারের মুখামুখি করেছে সৌদি । রিয়াদের যে আদালতে হাথরুলকে সাজা দিয়েছে সে বিশেষ আদালতে প্রভাবশালী মানবাধিকার কর্মী সালমান আলা উদাহর অবস্থা বর্ণনা করেছেন তাঁর ছেলে সৌদি স্কালার ও মানবাধিকার কর্মী আবদুল্লাহ আলা উদাহ। তিনি অভিযোগ করেন মে হতে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উনার বাবাকে পরিবারের সাথে কথা বলতে দেয়নি এমনকি ফোনও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। অনেক চেষ্টার পর যখন দেখা করার অনুমতি পান তখন কাচের দেয়ালে আবদ্ধ রাখা ছিলেন বাবা।
তিনি বলেন ইসলামে পিএইচডি করা স্কালার ৬৪ বছর বয়সী আমার পিতাকে ২০১৭ সালে নির্জন কারাবাসে পাঠানো হয়। সৌদি আরব, সংযুক্ত আমিরাত, মিশর ও বাহারাইন যখন কাতারকে অবরোধ দেয় তখন এখানে জনগণ উত্তেজিত হয়ে পড়ে তা ভালো চোখে দেখেননি আমার বাবা। তিনি এক টুইটে এই অবরোধের সমালোচনা করে সব দেশের মধ্য ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের আগ্রহ প্রকাশ করেন। ঠিক এর কয়েক মাস পর তাকে পুলিশী হেফাজতে নেয়া হয়।
(চলবে)।
করোনায় একজন প্রবাসী।
৪৮তম পর্ব।
কোন অভিযোগ ছাড়াই এক বছর আটকে রাখে তারপর বেশ কিছু অভিযোগ দায়ের করে বিশেষ কতৃপক্ষ। ২০১৮ সালে সেপ্টেম্বরে গোপন কামরায় আদালত বসে রিয়াদে বিচার শুরু হয়। জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে উসকে দেওয়া এবং নিষিদ্ধ বই রাখাসহ কয়েকটি অভিযোগ ছিলো। ৩৭টি অভিযোগের জন্য এটনি জেনারেল সৌদ আল মুজিব আমার বাবার মৃত্যুদণ্ড চান আদালতে। ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের আবেদনে যে হাজার হাজার সৌদি নাগরিক স্বাক্ষর করেন আমার বাবা তার হাই প্রৌফাইল সমর্থক ছিলেন। এই জন্য তার বিদেশে ভ্রমণেও নিষেধাজ্ঞা ছিলো। সালমান বাদশাহ হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার তিন মাস পর তাঁর ছেলে ক্রাউন পিন্স মোহাম্মদ ভিশন ২০৩০ ঘোষণা করে প্রচুর সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের কথা বলেন। এরপর ২০১৭ সালে যখন মোহাম্মদ বিন সালমান নিজেকে পূর্ণাঙ্গ পিন্স অধিষ্ঠিত করেন তখন হতে মানবতা- মানবাধিকার যেন হাওয়ায় উঠে যায়।
সর্বপ্রথমে বিশাল রাজ পরিবারে দমন-পীড়ন করে ন বিরোধীদের শায়েস্তা করে নিজ ক্ষমতা অগাধ করেন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ধুলোয় মিশিয়ে দেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বে ইয়েমেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন সৌদি আরব এবং তাঁর ইচ্ছায় কাতারে অবরোধ দেওয়া হয়। মানবাধিকার কর্মী আলা উদাহকে যখন জেল হতে আদালতে তোলা হয় তখন তিনি এতই দুর্বল ছিলেন যে দাঁড়াতে পারছিলেন না। তিনি চোখে কম দেখতে ছিলেন এবং কেমন যেন উদভ্রান্ত ছিলেন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ চিন্তা করে সব কিছুতে সায় দিচ্ছিলেন, অত্যাচারে বাধ্য হয়ে তিনি হয়তো শাসকের কোন শিখানো কথা মেনে নিয়েছেন। নির্যাতন আর একাকীত্বের কারণে আলা উবাদাহর মন ও শরীর ভেঙে পড়ে ছিলো। কারাগার হতে জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে আনা নেওয়ার সময় কারা রক্ষীরা তাঁর হাতে পায়ে শক্ত লোহার শিকলে বেঁধে রাখতেন এমনকি চোখও বাধা থাকতো যেন আশপাশ না দেখেন।
আলা উবাদাহ পরিবারকে জানিয়েছেন জিজ্ঞাসাবাদকারি তাকে ঘুমাইতে দেন না ঔষধ নিতে দেন না। কারাগার মানে নির্যাতনের স্টিম রোলার, ঔষধ নিতে না দেওয়া ও দুর্বব্যহার সৌদি কারাগারের সাধারণ বিষয়। ২০২০ সালের এপ্রিলে বিখ্যাত সংস্কারবাদি আবদুল্লাহ আল হামিদকে নির্যাতন করে হত্যার জন্য এই যুবরাজকে দায়ী করা হয়। জেলে নির্মম নির্যাতনে তিনি কোমায় চলে যান এবং কিছুদিন পর মৃত্যু বরণ করেন। তিনি যে জটিল রোগে আক্রান্ত হয়েছেন তা অস্বীকার করেন জেল কতৃপক্ষ। রিয়াদের জেলে থাকাকালীন তিনি মেঝেতে পড়ে যান এবং কয়েক ঘন্টা সেখানে ছিলেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা অ্যামিনিস্ট ইন্টারন্যাশনালকে জানিয়েছেন। এরপর এক বিখ্যাত সাংবাদিক জেল হতে মুক্তি পেয়ে কয়েক মাস পর মারা যান। এই সাংবাদিককে ২০১৮ সালে গ্রেফতার করা হয়, তিনি নাকি রাজ পরিবার এবং যুবরাজের দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট করেন পেপারে। রাজকীয় আদালতের সমালোচনা করেছেন তাই তাকেও পাঁচ বছর সাজা দেওয়া হয়ে ছিলো। কারাগারের এমনভাবে নির্যাতন করা হয় তাতে গভীর ও দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব পড়ে যার ফলে বন্দী ধীরে ধীরে মৃত্যুর কবলে ঢলে পড়ে।
কেউ খবরও রাখে না খাওয়া ও ঔষধপত্রের বিষয়। এই অবস্থায় সৌদির মানবাধিকার কর্মীরা একজোট হয়ে বিশ্বের কাছে আবেদন করেছেন যেন সৌদি নিয়ে নজর দেয়। শত শত রাজনৈতিক ও মানবাধিকার কর্মীর মুক্তির জন্য বিশ্বের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। যুবরাজের নানা বিতর্কিত কাজে ট্রাম্পের সমর্থন নিয়ে দেশটিতে কিংবা বিশ্বে মুখরোচক আলোচনা চালু আছে। জামাল খাসোগি হত্যায় ট্রাম্প উচ্চ-বাচ্য করলেও তার ইহুদী জামাতা কুশনারের সাথে যুবরাজ আলোচনা করার পর তা অন্যদিকে মোড় নেয়। এরপর সাদ আল জাবেরকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। তারপরও ট্রাম্প যুবরাজকে দায়ীমুক্তি দিতে চায় এবং তা বাইডেন ক্ষমতায় আসার আগেই যেন করে যায় ট্রাম্প। এই দায়ীমুক্তি যুবরাজকে বাঁচিয়ে দিবে সকল অন্যায় অবিচার হতে। এখন দেখার বিষয় আমেরিকার ভবিষ্যৎ প্রশাসন সৌদিকে কি করে কারণ বর্তমানে সৌদির আদি ভাবগম্ভীর ভাবও যেন যুবরাজের হাত ধরে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। তাই মুসলিম বিশ্ব চিন্তিত ইসলামের এই খাদেমকে নিয়ে।
(চলবে)।
করোনায় একজন প্রবাসী।
৪৯তম পর্ব।
গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় মধ্যপাচ্যের দেশগুলির মাটির তলায় আবিষ্কার হয় তরল সোনা। তারপর দেশগুলি যেন আঙ্গুল ফুলে কলা গাছে পরিনত হয়। এতে এইসব দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি শুধু হয়ে উঠে গরিব দেশের লোকদের কাজের ক্ষেত্র। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও নেপাল তথা দক্ষিন এশিয়ার মানুষের আয়ের প্রধান উৎস। আবার এই তরল সোনার দেলের আশপাশের দেশগুলির যেমন বিপুল পরিমাণ লোক কাজ করে তেমনি আফ্রিকা মহাদেশের লোকও কাজ করে টাকা রোজগার করতে পারছে। কিন্তু মাটির নিচের এই সম্পদ একদিন ফুরিয়ে যাবে তখন কি হবে এইসব দেশের। এই ভাবনা হতে আমিরাত নিজেকে সাজিয়ে নিয়েছে। সৌদি আরবেও তাই যুবরাজ মোহাম্মদ তেল নির্ভর অর্থনীতি হতে অন্য দিকে মনোযোগী হচ্ছেন। তাই তিনি পর্যটন খাতের দিকে নজর দিয়েছেন বলে সৌদিকে প্রথমে রক্ষণশীল সমাজ হতে বের করে আনতে বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন।
নারী চালাতে পারে গাড়ি, চালু করেছেন সিনেমা হল,থাকছে লৌহিত সাগরে বিকিনি পরে সাতার কাটা। ইতিমধ্যে বিশ্বের নামকরা গায়ক ও ব্যান্ডদল অনুষ্ঠান করা এবং সিনেমা তৈরীর প্রসিদ্ধ জায়গা করে গঠে তোলা হচ্ছে। এই জন্য গঠে তোলা হচ্ছে পর্যটন শহর নিওম। আর এই ক্ষেত্রে আরবের মডেল সংযুক্ত আরব আমিরাত। তাই আমিরাত উপসাগরিয় অঞ্চলে অর্থনীতি নতুন দিগন্ত। দেশটির শাসক মোহাম্মদ বিন জায়েদকে সৌদি শাসকের উপদেষ্টা মনে করা হয়। কিন্তু হঠাৎ করে এরা কেন তেল নির্ভর অর্থনীতি হতে সরে আসতে চাইতেছে। বিশ বছর আগে সৌদি তেল বিশেষজ্ঞ সাদাত আল হৌসাইনি দেখিয়েন ১৯০০ সালে যেখানে উৎপাদন হতো এক মিলিয়ন ব্যারেলের সামান্য কিছু বেশী সেখানে এখন উৎপাদন হয় ৮৫ মিলিয়ন ব্যরেলেরও বেশী। আর এই বেশী উৎপাদন একদিন থমকে দাঁড়াতে বাধ্যই। আমদানিকারক দেশগুলি যেভাবে রিজার্ভ তেলের প্রতি হাত বাড়াচ্ছে তাতে একদিন তেল নিঃশেষ হবেই তাই আগেভাগে প্রস্তুত থাকতে হবে। আর যদি না থাকি তাহলে তেল শূণ্য একটা বিপদ জন্য অপেক্ষা করছে।
হতে পারে সেটা যুদ্ধকালীন কিংবা কোন মহামারীর সময় আর তখন সেটা ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে তেল সমৃদ্ধ দেশের অর্থনীতিতে। ওপেক এর হিসাব মতে ২০২০ সালে বিশ্বে তেলের চাহিদা ২৯৮ মিলিয়ন ব্যারেল আর ২০৪০ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়াবে ৩৭১ মিলিয়ন ব্যারেল। অনেক কোম্পানি স্বীকার করেছে তেলের উৎপাদন সেই পরিমান আদৌ বাড়বে না বিশেষ করে চীন, জাপান ও ভারতের মত শিল্প প্রধান দেশগুলির তেলের চাহিদা বেড়ে চলেছে হু হু করে। পরিস্থিতি যাই হোক একটা ভবিষ্যৎ বাণী প্রায় সত্য হয়ে উঠেছে সস্তা তেলের দিন শেষ। অতীত হতে কিছু যদি শিখে থাকে তাহলে ধরতে পারবে ভবিষ্যৎ অন্ধকারকে। সত্তর দশকে যখন আরব দেশের তেল কোম্পানিগুলি নিষেধাজ্ঞা জারি করে ছিলো তখন তেলের তৃষ্ণায় মরিয়া হয়ে পড়ে ছিলো মার্কিনী নীতি নির্ধারকেরা। তখন তারা সামরিক অভিযান চালিয়ে মধ্যপাচ্যের তেল কুপগুলি দখল করার পরিকল্পনা পর্যন্ত করে ছিলো।
পরে মধ্যপাচ্যে সামরিক অভিযান নিয়ে কাজ করেছে তেল রাজনীতি ও কূটনীতি। বিশ্বের তেল বাণিজ্যের ৭৫ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে সৌদিসহ ওপেক সদস্যরা। তাদের তেলের রিজার্ভ কমতে শুরু করবে তেল সমৃদ্ধ অন্যান্য দেশের পরে তাই তাদের এখন হতে ভাবতে হচ্ছে তেল বিহীন অর্থনীতি নিয়ে। তাই মধ্যপাচ্যে তেল নির্ভর অর্থনীতির ধনী দেশগুলির বিলাসী জীবনের অন্ধকার আচড় লাগবে বলে এখন হতে ভীত ও সেই ভয়ে সব যেন এলোমেলো করে ফেলছেন। কোনটা আগে আর কোনটা পরে করতে হবে বুঝে উঠতে পারছেন না। দেশের মানুষ যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন তা করতে হচ্ছে কাটছাঁট এতে ভয় আছে শাসকের ক্ষোভে পড়ার। এই ক্ষোভের সামন্য নমুনা গত আরব বসন্তে সারা বিশ্ব দেখেছে। তাই তরল সোনার দেশগুলি এখন মরিয়া হয়ে পড়েছে বাকি মজুত নিয়ন্ত্রণ করার।
(চলবে)।
করোনায় একজন প্রবাসী।
৫০তম পর্ব।
তেল অর্থনীতি মাথায় রেখে সৌদি আরব পুরো শাসনের কৌশল বদলাতে চাইছেন। এই পরিস্থিতিতে পুরো সমাজ ব্যবস্থা ও পররাষ্ট্র নীতি সব কিছুর উপর প্রভাব পড়তেছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন সৌদিসহ এই অঞ্চলেের দেশগুলি ইসরায়েল প্রভাবিত নীতি কাজ করছে তেল নির্ভর অর্থনীতি হতে বের হয়ে আসার পরিকল্পনা। অনেক দেশ এখন ইসরায়েলের প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি আর পর্যটন শিল্প বিকশিত করতে চাইতেছে। ট্রাম্পের তথাকথিত আব্রাহাম শান্তি চুক্তি সেই পথে হাঁটতে শুরু করছে। শেষ বিচারে এই অঞ্চলে হয়তো রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টিও হতে পারে। তেলের উৎপাদন কমে গেলে এই অঞ্চলে পরিস্থিতি কেমন হবে করোনা মহামারীতে তা পুরো দুনিয়া দেখেছে। হঠাৎ করে তেলের চাহিদা কমে যায় আর তখন উৎপাদনও কমে যায়। ফলে সৌদি আরবকে তখন ব্যয় কমানোর নীতি গ্রহণ করতে হয়। এই মহামারীর সময় সৌদি সরকার ভ্যাট বাড়ানোর ঘোষণা দেয় যা শতে আগে ছিল পাঁচ পারশেন্ট তা বাড়িয়ে করা হয় পনর পারশেন্ট। অর্থাৎ তেল কমে গেলে তেল নির্ভর এইসব ধনী দেশ কতটা বিপদে পড়বে একটু আচ করা গিয়েছে মহামারীতে।
আরব দেশে সবচে বড় অর্থনীতির দেশে সৌদি আরব। আর এই দেশটির দিকে তাকিয়ে পর্যালোচনা করলে বুঝা যাবে সৌদির অর্থনীতি ক্রমেই নিম্নগামী হচ্ছে। আর এর প্রভাব পড়ছে দেশী-বিদেশী জনগণের উপর। এভাবে চলতে থাকলে দিন দিন মানুষের ভিতর ক্ষোভ বাড়বে। সৌদিতে বিভিন্ন দেশের মানুষ কাজ করে ইকামা নবায়ন করতেও বৈষম্য কারো ৬ শ রিয়াল কারো ১২০০০ রিয়াল আবার কারো কারো ২৫/৩০ হাজার রিয়াল খরচ করতে হয়। বাদশাহ সালমান যখন ২০১৫ সালে ২৩শে জানুয়ারি ক্ষমতায় আসেন তখন সৌদির বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভ ছিল ৭৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আস্তে আস্তে সেটা কমতে থাকে ২০২০ সালে সৌদির বৈদেশিক মু্দ্রার রির্জাভ এসে দাঁড়ায় ৪৯২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এই হিসাব সৌদিয়ান মনিটরিং অথ্ররিটির। অপর দিকে বিশ্ব ব্যাংক বলেছে সৌদি মাথাপিছু আয় ২০১২ সালে ২৫২৪৩ মার্কিন ডলার কমে ২০১৮ সালে এসে দাঁড়ায় ২৩৩৩৮ মার্কিন ডলারে। এতে চাপ পড়া শুরু হয়েছে ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করা অর্থে।
আইএমএফ আভাস দিয়েছে সৌদির ঋণের পরিমান দাঁড়াবে জিড়িপির ১৯ শতাংশ এবং এই বছর ২৭ শতাংশ। করোনা এবং মুদ্রা স্ফীতির কারণে ২০২২ সালে তা বেড়ে দাড়াবে জিড়িপির অর্ধেকে। সৌদি আরবের অর্থনীতির এই নিম্নগামীর বহু কারণ আছে। ইয়েমেন যুদ্ধসহ সিরিয়া এবং লিবিয়া যুদ্ধে অর্থ যোগান, আশপাশের দেশগুলিতে অযথা হস্তক্ষেপ, মিশরে সামরিক ক্রুর সাথে জড়িত। এবং সামর্থ্যের বাহিরে গিয়ে আমেরিকা হতে বার বার অস্ত্র কেনা, উচ্চ ব্যয় বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা। এর বাহিরে সবচে বড় অপচয় রাজ পরিবারের বিলাসিতা পিছনে অগাধ অর্থ ব্যয় করাতো আছেই। আইএমএফ হিসাব কষে দেখিয়েছে তেলের দাম ব্যারল প্রতি ৫৫ হতে ৫০ ডলার কমে যাবে তখন সৌদির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে তা দিয়ে তাদের মাত্র ৫ মাসের আমদানি ব্যয় মিটানো যাবে। সৌদির অর্থনীতি সচল রাখতে কথা ছিল রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানির ৫ শতাংশ শেয়ার বিদেশী স্টক এক্সসেঞ্জে তালিকাভুক্ত করিয়ে বিদেশী বিনিয়োগ নিয়ে আসবে কিন্তু সেই আশা ভেস্তেও যায়।
এরপর পিএফআই নামে একটা তহবিল গঠন করে তেল বিহীন অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়া করোনা মহামারী ঝড়ের কবলে পড়ে সেটিও তছনছ হয়ে গিয়ে। তাই আভ্যন্তরীণ নানা জটিলতা দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে তৈরী হচ্ছে ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। সৌদি আরব যখন তেল নির্ভর অর্থনীতি হতে বের হয়ে যাবে তখন সৌদিয়ানদের অবশ্যই কাজের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে এবং সরকার জনগণকে চাপ দিবে কাজ করাতে আর এতে বিদেশী লোকদের নিম্নতর কাজ ছাড়া অন্য কাজ হতে বাদ দিতে হবে। তখন বিদেশী পেশাজীবি বেকার হয়ে দেশে ফিরতে হবে। সাথে সাথে নিম্নতর শ্রমিকদের রোজগারও কমে যাবে। তবে এইসব একদিনে না হলেও ধীরে ধীরে তা দৃশ্যমান হচ্ছে কিংবা হবে। এর বিরুপ প্রভাব পড়বে রেমিটান্স আহরণকারি প্রত্যেক দেশের উপর।
তেলের দিন শেষ হলে এর প্রভাব দীর্ঘ মেয়াদি হবে। সৌদি আরবসহ উপসাগরিয় দেশে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের বহু শ্রমিক কাজ করে আর এদের পাঠানো রেমিটান্স এইসব দেশের অর্থনীতির প্রাণ সঞ্চার করে এই কারণে এইসব দেশ অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। আরো সবচে দুঃখজনক হবে অর্থনীতি মন্দা হলে মধ্যপাচ্যের দান খয়রাত করাও কমে যাবে। মধ্যপাচ্যের শাসকেরা প্রতি মিনিটে কয়েক মিলিয়ন দান করার ক্ষমতা রাখেন। অবশ্য অতীত ইতিহাস তাই বলে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান এর উদাহরণ। নাম প্রকাশ না করেও শত শত কোটি টাকা সাহায্যের খবর সামনে হয়তো আর আসবে না।
(চলবে)।
৪৬তম পর্ব।
মিশরের শাসক মনে করে কাতার তাদের বিরোধী বিভিন্ন প্রচারের পাশাপাশি মুসলিম ব্রাদারহুড় নেতা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে। আরো একটা বিষয় সামনে আসছে তা হলো সৌদি যুবরাজ মোহাম্মাদ বিন সালমান আর আরব আমিরাতের যুবরাজ বিন জায়েদের মত বিরোধ শুরু হয়েছে নানা বিষয় নিয়ে। এক নাম্বার হলো ২০১৫ সালে ইয়েমেনে শুরু করা যুদ্ধ। ইমেয়েন যুদ্ধে নেতৃত্ব কার আওতায় রয়েছে তা নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। ইয়েমেনের দক্ষিণা অংশ দখলে রয়েছে আমিরাতের অর্থায়ানে পরিচালিত মিলিশিয়া বাহিনীর হাতে অপর দিকে উত্তরাংশে সৌদি আরব লড়াইরত হুতি বিদ্রোহীদের সাথে। আরেকটি ইস্যু হলো ইসরায়েল, আমিরাত ইতিমধ্যে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছে।এই দিকে বাহারাইনও ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে পরিণত হয়েছে ঘনিষ্ঠ মিত্রে। তাদের মধ্যে দহরম-মহরম সৌদির ও মিশরের ভিতর এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত নিজেকে এক নাম্বার মিত্র দাবি করে থাকে তা সৌদি যুবরাজ নিজের জন্য সমস্যা তৈরী করতে পারে বলে মনে করে।
আসলে কাতারের সাথে তড়িঘড়ি করে সম্পর্ক পুনরায় স্থাপনের পিছনে সৌদি যুবরাজে অন্য মতলব হলো আমেরিকার নতুন প্রশাসনের সাথে সম্পর্কের উন্নতি ঘটানোর চেষ্টা মাত্র। আরেকটি সুপ্ত ইচ্ছা হলো কাতারের বহুল প্রচারিত টিভি চ্যানাল আল জাজিরার সমর্থন আদায় করা। আর এর সমর্থন ফেলে আল জাজিরার মাধ্যমে যুবরাজ নিজের প্রচার করে মুসলিম বিশ্বে নিজেকে জনপ্রিয় করতে পারবে বলে মনে করে। মধ্যপাচ্যের জনগণ ব্যাপকভাবে আল জাজিরা আরবী দেখে থাকে কারণ আল জাজিরা স্বাধীনভাবে সত্য তথ্য তুলে ধরতে পারে। সৌদি আরব, মিশর কিংবা আমিরাতের চ্যানালগুলি অকাট্য সত্য তুলে ধরতে পারে না কারণ তা সরকারি নিয়ন্ত্রণে থাকে। তাই যুবরাজ মোহাম্মদ আল জাজিরার এই গ্রহণযোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে চান। তিনি তার পিতা সালমানকে অতি তাড়াতাড়ি ক্ষমতা হতে সরিয়ে নিজেই ক্ষমতার আসনে বসতে চান। তারপর ইসরায়েলের সাথে কূটনীতি সম্পর্ক স্থাপন জোরদার করতে চান এবং ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে চান। তবে অনেকে মনে করে ফিলিস্তিনের ন্যায্য অধিকার তার কাছে গুরত্বহীন ।
যুবরাজ ক্ষমতার চেয়ারে বসার জন্য প্রচণ্ড উতলা হয়ে আছেন। তাই তিনি ইসরায়েল এবং আমেরিকার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে চলেন। জিসিসি সম্মিলনে এই প্রথম আমেরিকার কোন লোক উপস্থিত ছিলেন আর উনি হলেন ট্রাম্প জামাতা ইহুদী কুশনার আর এটা অনেকের মাঝে কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে রাজ পরিবারে মতানৈক্য নেই এমকি পিতা পুত্রের মাঝেও দ্বন্দ্ব। রাজ পরিবারের নীতি নির্ধারক অনেকেই ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে নারাজ বিশেষ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও বাদশাহ ফিলিস্তিনের অধিকার রহিত করে ইসরায়েলের সাথে আলাপ করতেও রাজি নয়। সৌদি জনগণও ইসরায়েলের সাথে সৌদির উষ্ণ সম্পর্ক মেনে নিতে নারাজ। যুবরাজ চান ইসরায়েল নিয়ে তার কাজকর্ম মিড়িয়ায় যেন প্রচার কম হয়। বিশেষ করে আল জাজিরা যেন তাকে নিয়ে সরব না থাকে তাই বিনা শর্তে কাতারের অবরোধ তুলে নিয়ে কাতারকে সাথে রাখতে চান।
যুবরাজ মনে করে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিলে খুশি হবে জো বাইডেন কিন্তু তাতে আরব বিশ্বে যে খারাপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে তা ভাবছেন না। এতে মুসলিম বিশ্বে সৌদি আরবের সম্মান কমবে মনে করে বাদশাহ সালমান। এবং ফিলিস্তিন অধিকার রহিত করে পূর্ববতী বাদশাহরা কেউ ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দানের চিন্তাও করেনি, বর্তমান বাদশাহও সেই পথ অনুসরণ করে ফিলিস্তিনের স্বার্থ আদায় দৃঢ় থাকতে চান।
(চলবে)।
করোনায় একজন প্রবাসী।
৪৭তম পর্ব।
অনেকের ধারণা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশ্রয় পেয়ে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান কোন কিছুই তোয়াক্কা করেনি। ইয়েমেন যুদ্ধ, কাতারের উপর অবরোধ এবং ইসরায়েলের সাথে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা সবই হয়েছে ট্রাম্পের জানামতে। ট্রাম্পের সাথে প্রশ্নবোধক ঘনিষ্ঠতায় তিনি শুধু ইসরায়েলের সাথে গভীর যোগাযোগই স্থাপন করেননি আরো মুসলিম দেশকে চাপ দিয়েছেন ইসরায়েলকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য। আমেরিকান ঘনিষ্ঠতার দম্ভে আরব দেশের সম্পর্ককে ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলছেন। কিন্তু নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন উনাকে প্রশ্রয় দিবেন না তা বুঝাই যাচ্ছে। ইতিমধ্যে জো বাইডেন বলে দিয়েছেন আমরা সৌদি হতে গঠনমূলক আচরণ আশা করি, যদি বেপরোয় আচরণ করে এর পরিণাম অপেক্ষা করছে। মোহাম্মদের দমন নিপীড়নের আরো কিছু ঘটনা যোগ হয়েছে যার কারণে সৌদিকে সমাজচ্যুত ও যুবরাজকে ভয়ংকর মানুষ ভাবতে শুরু করেছে বিশ্ব।
এইতো মাত্র কয়েকদিন আগে সৌদি মানব অধিকার কর্মী লুজাইন আল হাথুরুলকে ছয় বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। মানবাকার কর্মীর এই সাজা জো বাইডেনের সাথে সম্পর্কের অবনতি হতে পারে কারণ এই সাজায় যুবরাজের ইচ্ছার প্রতিফলন রয়েছে। তাকে সৌদি সন্ত্রাস বিরোধী আইনে ছয় বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে বলে সৌদি সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে। ৩১বছর বয়সী এই মানবাধিকার কর্মীর বিরূদ্ধে সৌদি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে পাল্টানো চেষ্টা এবং জাতীয় নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার অভিযোগ করা হয়। আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর আদালত তাঁকে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেয়। রায় ঘোষণার সময় তিনি অঝোরে কান্নায় থেকে বলেন উচ্চ আদালতে আপিল করবেন। তাঁর বোন এক বিবৃতি দিয়ে বলেন আমার বোন সন্ত্রাসী নয় উনি মানবাধিকার কর্মী। এই সাজার মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয় যুবরাজ এবং রাজবংশ যে বলে সৌদিতে ব্যাপক পরিবর্তনের যে কথা তা আসলে মুখের পাকা বুলি। এর মধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দফতর বলেছেন হাথুরুলের এই সাজার প্রতি যুক্তরাষ্ট্র নজর রাখছে এবং এই ধরনের সাজায় তাঁরা চিন্তিত।
বাইডেনের সরকারের যোগ দেওয়া এক কর্মকর্তা বলেছেন বিশ্ব জুড়ে মানবাধিকারকে বাইডেন সরকার বেশী গুরত্ব দিবে। মানব অধিকার চর্চার জন্য সাজা দেওয়া অন্যায় এবং অগ্রহণযোগ্য,আমরা এখনো বলছি বিশ্বের যেখানেই মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে বাইডেন সরকার সেখানেই দাঁড়াবে। জাতীয় সংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ হাথরুলের রায়কে জালিয়াতিপূর্ণ বলে মত দিয়েছেন এবং এটাকে গভীর উদ্বেগজনক বলে দ্রুত মুক্তির দাবি জানিয়েছেন। এই মানবাধিকার কর্মী একজন নয় এমন শত শত রাজনৈতিক বন্দী রয়েছেন যাদের মিথ্যা অভিযোগে বিচারের মুখামুখি করেছে সৌদি । রিয়াদের যে আদালতে হাথরুলকে সাজা দিয়েছে সে বিশেষ আদালতে প্রভাবশালী মানবাধিকার কর্মী সালমান আলা উদাহর অবস্থা বর্ণনা করেছেন তাঁর ছেলে সৌদি স্কালার ও মানবাধিকার কর্মী আবদুল্লাহ আলা উদাহ। তিনি অভিযোগ করেন মে হতে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উনার বাবাকে পরিবারের সাথে কথা বলতে দেয়নি এমনকি ফোনও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। অনেক চেষ্টার পর যখন দেখা করার অনুমতি পান তখন কাচের দেয়ালে আবদ্ধ রাখা ছিলেন বাবা।
তিনি বলেন ইসলামে পিএইচডি করা স্কালার ৬৪ বছর বয়সী আমার পিতাকে ২০১৭ সালে নির্জন কারাবাসে পাঠানো হয়। সৌদি আরব, সংযুক্ত আমিরাত, মিশর ও বাহারাইন যখন কাতারকে অবরোধ দেয় তখন এখানে জনগণ উত্তেজিত হয়ে পড়ে তা ভালো চোখে দেখেননি আমার বাবা। তিনি এক টুইটে এই অবরোধের সমালোচনা করে সব দেশের মধ্য ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের আগ্রহ প্রকাশ করেন। ঠিক এর কয়েক মাস পর তাকে পুলিশী হেফাজতে নেয়া হয়।
(চলবে)।
করোনায় একজন প্রবাসী।
৪৮তম পর্ব।
কোন অভিযোগ ছাড়াই এক বছর আটকে রাখে তারপর বেশ কিছু অভিযোগ দায়ের করে বিশেষ কতৃপক্ষ। ২০১৮ সালে সেপ্টেম্বরে গোপন কামরায় আদালত বসে রিয়াদে বিচার শুরু হয়। জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে উসকে দেওয়া এবং নিষিদ্ধ বই রাখাসহ কয়েকটি অভিযোগ ছিলো। ৩৭টি অভিযোগের জন্য এটনি জেনারেল সৌদ আল মুজিব আমার বাবার মৃত্যুদণ্ড চান আদালতে। ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের আবেদনে যে হাজার হাজার সৌদি নাগরিক স্বাক্ষর করেন আমার বাবা তার হাই প্রৌফাইল সমর্থক ছিলেন। এই জন্য তার বিদেশে ভ্রমণেও নিষেধাজ্ঞা ছিলো। সালমান বাদশাহ হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার তিন মাস পর তাঁর ছেলে ক্রাউন পিন্স মোহাম্মদ ভিশন ২০৩০ ঘোষণা করে প্রচুর সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের কথা বলেন। এরপর ২০১৭ সালে যখন মোহাম্মদ বিন সালমান নিজেকে পূর্ণাঙ্গ পিন্স অধিষ্ঠিত করেন তখন হতে মানবতা- মানবাধিকার যেন হাওয়ায় উঠে যায়।
সর্বপ্রথমে বিশাল রাজ পরিবারে দমন-পীড়ন করে ন বিরোধীদের শায়েস্তা করে নিজ ক্ষমতা অগাধ করেন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ধুলোয় মিশিয়ে দেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বে ইয়েমেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন সৌদি আরব এবং তাঁর ইচ্ছায় কাতারে অবরোধ দেওয়া হয়। মানবাধিকার কর্মী আলা উদাহকে যখন জেল হতে আদালতে তোলা হয় তখন তিনি এতই দুর্বল ছিলেন যে দাঁড়াতে পারছিলেন না। তিনি চোখে কম দেখতে ছিলেন এবং কেমন যেন উদভ্রান্ত ছিলেন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ চিন্তা করে সব কিছুতে সায় দিচ্ছিলেন, অত্যাচারে বাধ্য হয়ে তিনি হয়তো শাসকের কোন শিখানো কথা মেনে নিয়েছেন। নির্যাতন আর একাকীত্বের কারণে আলা উবাদাহর মন ও শরীর ভেঙে পড়ে ছিলো। কারাগার হতে জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে আনা নেওয়ার সময় কারা রক্ষীরা তাঁর হাতে পায়ে শক্ত লোহার শিকলে বেঁধে রাখতেন এমনকি চোখও বাধা থাকতো যেন আশপাশ না দেখেন।
আলা উবাদাহ পরিবারকে জানিয়েছেন জিজ্ঞাসাবাদকারি তাকে ঘুমাইতে দেন না ঔষধ নিতে দেন না। কারাগার মানে নির্যাতনের স্টিম রোলার, ঔষধ নিতে না দেওয়া ও দুর্বব্যহার সৌদি কারাগারের সাধারণ বিষয়। ২০২০ সালের এপ্রিলে বিখ্যাত সংস্কারবাদি আবদুল্লাহ আল হামিদকে নির্যাতন করে হত্যার জন্য এই যুবরাজকে দায়ী করা হয়। জেলে নির্মম নির্যাতনে তিনি কোমায় চলে যান এবং কিছুদিন পর মৃত্যু বরণ করেন। তিনি যে জটিল রোগে আক্রান্ত হয়েছেন তা অস্বীকার করেন জেল কতৃপক্ষ। রিয়াদের জেলে থাকাকালীন তিনি মেঝেতে পড়ে যান এবং কয়েক ঘন্টা সেখানে ছিলেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা অ্যামিনিস্ট ইন্টারন্যাশনালকে জানিয়েছেন। এরপর এক বিখ্যাত সাংবাদিক জেল হতে মুক্তি পেয়ে কয়েক মাস পর মারা যান। এই সাংবাদিককে ২০১৮ সালে গ্রেফতার করা হয়, তিনি নাকি রাজ পরিবার এবং যুবরাজের দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট করেন পেপারে। রাজকীয় আদালতের সমালোচনা করেছেন তাই তাকেও পাঁচ বছর সাজা দেওয়া হয়ে ছিলো। কারাগারের এমনভাবে নির্যাতন করা হয় তাতে গভীর ও দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব পড়ে যার ফলে বন্দী ধীরে ধীরে মৃত্যুর কবলে ঢলে পড়ে।
কেউ খবরও রাখে না খাওয়া ও ঔষধপত্রের বিষয়। এই অবস্থায় সৌদির মানবাধিকার কর্মীরা একজোট হয়ে বিশ্বের কাছে আবেদন করেছেন যেন সৌদি নিয়ে নজর দেয়। শত শত রাজনৈতিক ও মানবাধিকার কর্মীর মুক্তির জন্য বিশ্বের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। যুবরাজের নানা বিতর্কিত কাজে ট্রাম্পের সমর্থন নিয়ে দেশটিতে কিংবা বিশ্বে মুখরোচক আলোচনা চালু আছে। জামাল খাসোগি হত্যায় ট্রাম্প উচ্চ-বাচ্য করলেও তার ইহুদী জামাতা কুশনারের সাথে যুবরাজ আলোচনা করার পর তা অন্যদিকে মোড় নেয়। এরপর সাদ আল জাবেরকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। তারপরও ট্রাম্প যুবরাজকে দায়ীমুক্তি দিতে চায় এবং তা বাইডেন ক্ষমতায় আসার আগেই যেন করে যায় ট্রাম্প। এই দায়ীমুক্তি যুবরাজকে বাঁচিয়ে দিবে সকল অন্যায় অবিচার হতে। এখন দেখার বিষয় আমেরিকার ভবিষ্যৎ প্রশাসন সৌদিকে কি করে কারণ বর্তমানে সৌদির আদি ভাবগম্ভীর ভাবও যেন যুবরাজের হাত ধরে পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। তাই মুসলিম বিশ্ব চিন্তিত ইসলামের এই খাদেমকে নিয়ে।
(চলবে)।
করোনায় একজন প্রবাসী।
৪৯তম পর্ব।
গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় মধ্যপাচ্যের দেশগুলির মাটির তলায় আবিষ্কার হয় তরল সোনা। তারপর দেশগুলি যেন আঙ্গুল ফুলে কলা গাছে পরিনত হয়। এতে এইসব দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি শুধু হয়ে উঠে গরিব দেশের লোকদের কাজের ক্ষেত্র। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও নেপাল তথা দক্ষিন এশিয়ার মানুষের আয়ের প্রধান উৎস। আবার এই তরল সোনার দেলের আশপাশের দেশগুলির যেমন বিপুল পরিমাণ লোক কাজ করে তেমনি আফ্রিকা মহাদেশের লোকও কাজ করে টাকা রোজগার করতে পারছে। কিন্তু মাটির নিচের এই সম্পদ একদিন ফুরিয়ে যাবে তখন কি হবে এইসব দেশের। এই ভাবনা হতে আমিরাত নিজেকে সাজিয়ে নিয়েছে। সৌদি আরবেও তাই যুবরাজ মোহাম্মদ তেল নির্ভর অর্থনীতি হতে অন্য দিকে মনোযোগী হচ্ছেন। তাই তিনি পর্যটন খাতের দিকে নজর দিয়েছেন বলে সৌদিকে প্রথমে রক্ষণশীল সমাজ হতে বের করে আনতে বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন।
নারী চালাতে পারে গাড়ি, চালু করেছেন সিনেমা হল,থাকছে লৌহিত সাগরে বিকিনি পরে সাতার কাটা। ইতিমধ্যে বিশ্বের নামকরা গায়ক ও ব্যান্ডদল অনুষ্ঠান করা এবং সিনেমা তৈরীর প্রসিদ্ধ জায়গা করে গঠে তোলা হচ্ছে। এই জন্য গঠে তোলা হচ্ছে পর্যটন শহর নিওম। আর এই ক্ষেত্রে আরবের মডেল সংযুক্ত আরব আমিরাত। তাই আমিরাত উপসাগরিয় অঞ্চলে অর্থনীতি নতুন দিগন্ত। দেশটির শাসক মোহাম্মদ বিন জায়েদকে সৌদি শাসকের উপদেষ্টা মনে করা হয়। কিন্তু হঠাৎ করে এরা কেন তেল নির্ভর অর্থনীতি হতে সরে আসতে চাইতেছে। বিশ বছর আগে সৌদি তেল বিশেষজ্ঞ সাদাত আল হৌসাইনি দেখিয়েন ১৯০০ সালে যেখানে উৎপাদন হতো এক মিলিয়ন ব্যারেলের সামান্য কিছু বেশী সেখানে এখন উৎপাদন হয় ৮৫ মিলিয়ন ব্যরেলেরও বেশী। আর এই বেশী উৎপাদন একদিন থমকে দাঁড়াতে বাধ্যই। আমদানিকারক দেশগুলি যেভাবে রিজার্ভ তেলের প্রতি হাত বাড়াচ্ছে তাতে একদিন তেল নিঃশেষ হবেই তাই আগেভাগে প্রস্তুত থাকতে হবে। আর যদি না থাকি তাহলে তেল শূণ্য একটা বিপদ জন্য অপেক্ষা করছে।
হতে পারে সেটা যুদ্ধকালীন কিংবা কোন মহামারীর সময় আর তখন সেটা ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে তেল সমৃদ্ধ দেশের অর্থনীতিতে। ওপেক এর হিসাব মতে ২০২০ সালে বিশ্বে তেলের চাহিদা ২৯৮ মিলিয়ন ব্যারেল আর ২০৪০ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়াবে ৩৭১ মিলিয়ন ব্যারেল। অনেক কোম্পানি স্বীকার করেছে তেলের উৎপাদন সেই পরিমান আদৌ বাড়বে না বিশেষ করে চীন, জাপান ও ভারতের মত শিল্প প্রধান দেশগুলির তেলের চাহিদা বেড়ে চলেছে হু হু করে। পরিস্থিতি যাই হোক একটা ভবিষ্যৎ বাণী প্রায় সত্য হয়ে উঠেছে সস্তা তেলের দিন শেষ। অতীত হতে কিছু যদি শিখে থাকে তাহলে ধরতে পারবে ভবিষ্যৎ অন্ধকারকে। সত্তর দশকে যখন আরব দেশের তেল কোম্পানিগুলি নিষেধাজ্ঞা জারি করে ছিলো তখন তেলের তৃষ্ণায় মরিয়া হয়ে পড়ে ছিলো মার্কিনী নীতি নির্ধারকেরা। তখন তারা সামরিক অভিযান চালিয়ে মধ্যপাচ্যের তেল কুপগুলি দখল করার পরিকল্পনা পর্যন্ত করে ছিলো।
পরে মধ্যপাচ্যে সামরিক অভিযান নিয়ে কাজ করেছে তেল রাজনীতি ও কূটনীতি। বিশ্বের তেল বাণিজ্যের ৭৫ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে সৌদিসহ ওপেক সদস্যরা। তাদের তেলের রিজার্ভ কমতে শুরু করবে তেল সমৃদ্ধ অন্যান্য দেশের পরে তাই তাদের এখন হতে ভাবতে হচ্ছে তেল বিহীন অর্থনীতি নিয়ে। তাই মধ্যপাচ্যে তেল নির্ভর অর্থনীতির ধনী দেশগুলির বিলাসী জীবনের অন্ধকার আচড় লাগবে বলে এখন হতে ভীত ও সেই ভয়ে সব যেন এলোমেলো করে ফেলছেন। কোনটা আগে আর কোনটা পরে করতে হবে বুঝে উঠতে পারছেন না। দেশের মানুষ যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন তা করতে হচ্ছে কাটছাঁট এতে ভয় আছে শাসকের ক্ষোভে পড়ার। এই ক্ষোভের সামন্য নমুনা গত আরব বসন্তে সারা বিশ্ব দেখেছে। তাই তরল সোনার দেশগুলি এখন মরিয়া হয়ে পড়েছে বাকি মজুত নিয়ন্ত্রণ করার।
(চলবে)।
করোনায় একজন প্রবাসী।
৫০তম পর্ব।
তেল অর্থনীতি মাথায় রেখে সৌদি আরব পুরো শাসনের কৌশল বদলাতে চাইছেন। এই পরিস্থিতিতে পুরো সমাজ ব্যবস্থা ও পররাষ্ট্র নীতি সব কিছুর উপর প্রভাব পড়তেছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন সৌদিসহ এই অঞ্চলেের দেশগুলি ইসরায়েল প্রভাবিত নীতি কাজ করছে তেল নির্ভর অর্থনীতি হতে বের হয়ে আসার পরিকল্পনা। অনেক দেশ এখন ইসরায়েলের প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি আর পর্যটন শিল্প বিকশিত করতে চাইতেছে। ট্রাম্পের তথাকথিত আব্রাহাম শান্তি চুক্তি সেই পথে হাঁটতে শুরু করছে। শেষ বিচারে এই অঞ্চলে হয়তো রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টিও হতে পারে। তেলের উৎপাদন কমে গেলে এই অঞ্চলে পরিস্থিতি কেমন হবে করোনা মহামারীতে তা পুরো দুনিয়া দেখেছে। হঠাৎ করে তেলের চাহিদা কমে যায় আর তখন উৎপাদনও কমে যায়। ফলে সৌদি আরবকে তখন ব্যয় কমানোর নীতি গ্রহণ করতে হয়। এই মহামারীর সময় সৌদি সরকার ভ্যাট বাড়ানোর ঘোষণা দেয় যা শতে আগে ছিল পাঁচ পারশেন্ট তা বাড়িয়ে করা হয় পনর পারশেন্ট। অর্থাৎ তেল কমে গেলে তেল নির্ভর এইসব ধনী দেশ কতটা বিপদে পড়বে একটু আচ করা গিয়েছে মহামারীতে।
আরব দেশে সবচে বড় অর্থনীতির দেশে সৌদি আরব। আর এই দেশটির দিকে তাকিয়ে পর্যালোচনা করলে বুঝা যাবে সৌদির অর্থনীতি ক্রমেই নিম্নগামী হচ্ছে। আর এর প্রভাব পড়ছে দেশী-বিদেশী জনগণের উপর। এভাবে চলতে থাকলে দিন দিন মানুষের ভিতর ক্ষোভ বাড়বে। সৌদিতে বিভিন্ন দেশের মানুষ কাজ করে ইকামা নবায়ন করতেও বৈষম্য কারো ৬ শ রিয়াল কারো ১২০০০ রিয়াল আবার কারো কারো ২৫/৩০ হাজার রিয়াল খরচ করতে হয়। বাদশাহ সালমান যখন ২০১৫ সালে ২৩শে জানুয়ারি ক্ষমতায় আসেন তখন সৌদির বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভ ছিল ৭৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আস্তে আস্তে সেটা কমতে থাকে ২০২০ সালে সৌদির বৈদেশিক মু্দ্রার রির্জাভ এসে দাঁড়ায় ৪৯২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এই হিসাব সৌদিয়ান মনিটরিং অথ্ররিটির। অপর দিকে বিশ্ব ব্যাংক বলেছে সৌদি মাথাপিছু আয় ২০১২ সালে ২৫২৪৩ মার্কিন ডলার কমে ২০১৮ সালে এসে দাঁড়ায় ২৩৩৩৮ মার্কিন ডলারে। এতে চাপ পড়া শুরু হয়েছে ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করা অর্থে।
আইএমএফ আভাস দিয়েছে সৌদির ঋণের পরিমান দাঁড়াবে জিড়িপির ১৯ শতাংশ এবং এই বছর ২৭ শতাংশ। করোনা এবং মুদ্রা স্ফীতির কারণে ২০২২ সালে তা বেড়ে দাড়াবে জিড়িপির অর্ধেকে। সৌদি আরবের অর্থনীতির এই নিম্নগামীর বহু কারণ আছে। ইয়েমেন যুদ্ধসহ সিরিয়া এবং লিবিয়া যুদ্ধে অর্থ যোগান, আশপাশের দেশগুলিতে অযথা হস্তক্ষেপ, মিশরে সামরিক ক্রুর সাথে জড়িত। এবং সামর্থ্যের বাহিরে গিয়ে আমেরিকা হতে বার বার অস্ত্র কেনা, উচ্চ ব্যয় বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা। এর বাহিরে সবচে বড় অপচয় রাজ পরিবারের বিলাসিতা পিছনে অগাধ অর্থ ব্যয় করাতো আছেই। আইএমএফ হিসাব কষে দেখিয়েছে তেলের দাম ব্যারল প্রতি ৫৫ হতে ৫০ ডলার কমে যাবে তখন সৌদির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে তা দিয়ে তাদের মাত্র ৫ মাসের আমদানি ব্যয় মিটানো যাবে। সৌদির অর্থনীতি সচল রাখতে কথা ছিল রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানির ৫ শতাংশ শেয়ার বিদেশী স্টক এক্সসেঞ্জে তালিকাভুক্ত করিয়ে বিদেশী বিনিয়োগ নিয়ে আসবে কিন্তু সেই আশা ভেস্তেও যায়।
এরপর পিএফআই নামে একটা তহবিল গঠন করে তেল বিহীন অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়া করোনা মহামারী ঝড়ের কবলে পড়ে সেটিও তছনছ হয়ে গিয়ে। তাই আভ্যন্তরীণ নানা জটিলতা দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে তৈরী হচ্ছে ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। সৌদি আরব যখন তেল নির্ভর অর্থনীতি হতে বের হয়ে যাবে তখন সৌদিয়ানদের অবশ্যই কাজের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে এবং সরকার জনগণকে চাপ দিবে কাজ করাতে আর এতে বিদেশী লোকদের নিম্নতর কাজ ছাড়া অন্য কাজ হতে বাদ দিতে হবে। তখন বিদেশী পেশাজীবি বেকার হয়ে দেশে ফিরতে হবে। সাথে সাথে নিম্নতর শ্রমিকদের রোজগারও কমে যাবে। তবে এইসব একদিনে না হলেও ধীরে ধীরে তা দৃশ্যমান হচ্ছে কিংবা হবে। এর বিরুপ প্রভাব পড়বে রেমিটান্স আহরণকারি প্রত্যেক দেশের উপর।
তেলের দিন শেষ হলে এর প্রভাব দীর্ঘ মেয়াদি হবে। সৌদি আরবসহ উপসাগরিয় দেশে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও নেপালের বহু শ্রমিক কাজ করে আর এদের পাঠানো রেমিটান্স এইসব দেশের অর্থনীতির প্রাণ সঞ্চার করে এই কারণে এইসব দেশ অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। আরো সবচে দুঃখজনক হবে অর্থনীতি মন্দা হলে মধ্যপাচ্যের দান খয়রাত করাও কমে যাবে। মধ্যপাচ্যের শাসকেরা প্রতি মিনিটে কয়েক মিলিয়ন দান করার ক্ষমতা রাখেন। অবশ্য অতীত ইতিহাস তাই বলে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান এর উদাহরণ। নাম প্রকাশ না করেও শত শত কোটি টাকা সাহায্যের খবর সামনে হয়তো আর আসবে না।
(চলবে)।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
আমজাদ ১৯/০১/২০২১বেশ লিখেছেন।পরের পর্বের আশায়
-
তানভীর আজীমি ১৮/০১/২০২১ভালো লাগলো আগামি পর্বের আশায় রইলাম
-
বোরহানুল ইসলাম লিটন ১৮/০১/২০২১পরের পর্বের আশায় রইলাম।
শুভেচ্ছা রইল প্রিয় কবি। -
সাইয়িদ রফিকুল হক ১৭/০১/২০২১সব তিনিই ভাল জানেন।