করোনায় একজন প্রবাসী ।
করোনায় একজন প্রবাসী ।
১ম পর্ব।
অনেক লম্বা সামনাসামনি দুইটা দালান । মাঝখানে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ফাঁকা গলি । একটা দালান গুদাম ঘরের মত আরেকটা শ্রমিক শ্রেণী লোকদের আবাস স্থল । একটু দুরে রাস্তার উপর সোড়িয়াম বাতির ঝলমল আলো। তবে গলিটা আবছা আবছা অন্ধকার । আবাসস্থলের দরজার বাহিরে বাতিগুলি নষ্ট হওয়ার পর আর লাগানো হয়নি। শীতকালে যখন বৃষ্টি হয় দুই দালানের পানি এই গলিতে হাটু সমান হয়। বৃষ্টির পানি এবং বার্থরুমের পানি মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকার ঘরে ঢুকে হাটু ডুবে। যেমন বাংলাদেশে বর্ষার সময় পিছ করা কালো রাস্তায় নৌকা চলে। আবুল কালাম তখন বিছানাপত্র ভাজ করে পা তুলে বসে থাকে । আর ভাবে কেমন আছে পরিবার ।
কয়েক মাসের প্রবাস জীবন আমি আবুল কালামের। নিজ গ্রামের মোস্তাক মিয়া ভিসার কারবারী । তার হতে ভিসা নিয়ে পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে সৌদি প্রবাসী আমি । দেশে আগে ঢাকায় বাদামতলিতে সবজির আড়তে চাকরী করতাম । মোস্তাক মিয়া আগে কাতার থেকে গিয়েছে , আরবী ভাষায় যেমন পারদর্শী তেমন মিথ্যা বলার শিল্পী । সৌদি আরব মোস্তাক মিয়ার ছেলে থাকে । সে ভিসা পাঠায় আর মোস্তাক মিয়া কথার রংয়ে সাজিয়ে তা বিক্রি করে। তবে মোস্তাক মিয়ার ছেলে ভিসার কারবারে ক্ষুদ্র কণা। এমপি পাপুলের মত শত শত দালাল আছে সৌদি আরবে ভিসার ব্যবসা সাইনবোর্ড লাগিয়ে মানব পাচারকারী। যাদের এক হাত আছে বাংলাদেশ দুতাবাসে আরেক হাত আছে এরাবিক দুর্নীতিগ্রস্ত বড় বড় লোকদের সাথে। আবুল কালাম দুই বছরে আরবী শিখেছে দশ / বার টা। কথায় কথায় এরাবিয়ানদের সাথে বাংলা বলে । তারা কিছু না বুঝে হাসে আর তখন আবুল কালাম বলে “দুর শালার ঘরের শালারা”। বাংলা শিখো, বাংলা ।
রিয়াদ বিমানবন্দরে আলোর ঝলকানিতে আবুল কালাম ভাবে ফরমালিনযুক্ত পচা সবজির গন্ধ আজ অনেক দুরে। ইস ! এত সুন্দর দেশের খেজুরে আমরা তেল মবিল ফরমালিন ঢেলেও মাছি মারি। আপেল বাগান নাই বলে আইনস্টন জন্ম হয়নি ঠিকই প্রচুর সরিষা-গাছ হয় বলে তেলবাজের জন্ম ঠিকই আমার দেশের গলিতে গলিতে । এত বাতি জ্বলে যেন দিনের মত আলো। আবুল কালাম ভাবে এই আলোতে জীবন জীবিকা সফে দিতে হবে। প্রথম মাসেই কিছু টাকা পাঠিয়ে চাচা হতে বসতবাড়ির দলিল নিতে হবে । না হয় চাচা আমার মা বাপকে গালি দিবে , বলবে টাকা দাও নাহয় জায়গা ছেড়ে দাও। তারপর কুমোদ বাবুর সুদের টাকা তারপর আঁশা হতে নেওয়া কিস্তি । মা বাপ আর বউ বাচ্চা , তাদের জন্য কিছু কিছু দিবো খরচের টাকা । এতে জমা হবে টাকা আর তাতে ঘরটা দালান করা যাবে।
চার / পাঁচ জনের থাকার ঘরে আমরা পনর জন গাদাগাদি করে ঢালাও বিছানায় ঘুমাই। কয়েকজন আছে ছয় মাস ধরে এখানে পড়ে আছে । থাকার কষ্টে , খাওয়ার কষ্টে নেই কোন চাকরীর খবর। এমনি কি নিদিষ্ট তিন মাস পার হওয়ার পরও দেয়নি ইকামা (পরিচয় পত্র )। আমাকে মোস্তাক মিয়া তাহলে কি মিথ্যা বলেছে। বলেছে তার ছেলে কাজ নিয়ে দিবে, এক সপ্তাহ এর ভিতর সৌদি মালিক ইকামা বানিয়ে দিবে। তবে তার জন্য সরকারী ফ্রী বাবত সব টাকা পয়সা মোস্তাক মিয়ার ছেলে বহন করবে। আর সেই টাকা মোস্তাক মিয়া দেশে আমার হতে নিয়ে নিয়েছে। এবং আমি যে কোন কাজ করতে পারবো । যেটাকে আমরা বলি ফ্রী ভিসা। তবে সৌদিতে এসে বুঝলাম এই ফ্রী ভিসার আইনগত কোন বৈধতা নাই। যে এরাবিয়ানের নামে যে এলাকায় এবং যে কাজের জন্য ভিসা ইস্যু হয়েছে ঠিক সেই এরাবিয়ানের সেই এলাকায় যথাযথভাবে সেই কাজই করতে হবে । এইটাই আইন এখানের । এর ব্যতিক্রম হলে জেল জরিমানা এবং দেশে ফেরত পাঠায়। মোস্তাক মিয়ারা ভিসা বিক্রির জন্য এবং লাভ বেশী করার জন্য ফ্রী নামক শব্দের ব্যবহার করে। তবে সবচেয়ে প্রতারক হলো সৌদি নাগরিক। সে ভুয়া লাইসেন্স দিয়ে ঘুষ দিয়ে প্রয়োজনের অধিক ভিসার জন্য আবেদন করে। আর এতে টাকা পয়সা ও বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করে এমপি পাপুলের মত শত শত ভিসার দালাল। যাদের ক্ষমতা এবং টাকা পাথরের পাহাড় এর মত। একটা ভিসা বাবত সরকারি ফিস মাত্র দুই হাজার রিয়েল ( প্রায় ৪৫ হাজার টাকা ) । তাহলে বাংলাদেশী একজন শ্রমিক সৌদি যেতে পাঁচ হতে সাত লাখ টাকা কেন খরচ লাগে । একটা ভিসায় এরাবিয়ান লাভ করে , এরপর সৌদিস্ত বাংলাদশী দালাল লাভ করে , রিকুটিং এজেন্ট এবং তাদের গ্রাম্য দালাল লাভ করে। এমনও হয় একটা ভিসা সৌদিতেই ছয় সাত বার বিক্রি হওয়ার পর বাংলাদেশ আসে। এই বিক্রির প্রক্রিয়া এমনও হয় সৌদি মালিকই জানে না তার ভিসা কতবার বিক্রি হলো। কয়েক মাস পরে বাংলাদেশের সৌদি দুতাবাস যোগাযোগ করলে মালিক জানতে পারে তার ভিসা প্রসেস হচ্ছে । এরাবিয়ানদের কাজ না থাকলেও লোভে পড়ে ভিসা বাহির করে তাই খরিদদারের সাথে মুখের একটা চুক্তি করে যে লোক আসলে টাকা দিলে ইকামা বানিয়ে দিবো এবং সে অন্যের কাজ করবে তবে মাসিক একটা লভ্যাংশ আমাকে দিতে হবে। এই হলো ফ্রী ভিসা যার কোন সরকারি বৈধতা নেই। এবং সরকার অন্যত্র কাজ করা লোকের ব্যাপারে খুবই কঠোর । আরো ভয়ংকর হলো এক রাজ্যের ভিসা অন্য রাজ্যে বিক্রি করে দেশীয় দালালেরা। অনেক সময় সমস্যা হলে মালিক কোন সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে না। কারণ তারা অবৈধ পন্থায় ভিসা বাহির করে লোক অন্যত্র ছেড়ে দিয়েছে বলে জেল জরিমানার ভয়ে থাকে। এবং যারা ভিসা বাহির করে তারা সরকারি সুবিধা পায় না। তাই অনেক সময় এই সুবিধার জন্যও শ্রমিক যাওয়ার কিছুদিন পর শ্রমিককে এক্সজিটও করে দেয়।
মোস্তাক মিয়ার ছেলে এই ধরনের ভিসা কিনেই দেশে পাঠায় । আর এইটা অমুক কোম্পানির ,ভালো বেতন , থাকা খাওয়া কোম্পানির এইসব বলে মোস্তাক মিয়া ভিসা বিক্রি করে । আসলে সবই এক বিশাল মিথ্যার জমিন। চাষ করবেন আপনি ফল খাবে মোস্তাক মিয়ারা। মানুষও মিথ্যার কাননে মালি হয় পরিবারের সুখের জন্য। এই রকম ভিসায় আমি আবুল কালাম সৌদি প্রবাসী । কয়েক মাস ধরে যারা পড়ে আছে তাদের দেশে টাকা পয়সা বাকি বকেয়া আছে । এবং কিছু লোককে কাজ না দিয়ে শাস্তিমূলকও ফেলে রেখেছে কারণ দেশে মোস্তাক মিয়াকে গালি দিয়ে ছিল। এবং এখনো তাদের পরিবার হতে চাপ অব্যাহত রেখেছে কাজের জন্য । অথচ মোস্তাক মিয়ার ছেলে এইসব কেয়ার করে না। এক সপ্তাহ পরে আমরা পাঁচ জনকে বিক্রি করে দেয় মদিনায় যা রিয়াদ হতে হাজার মাইল দুরে। এক খাওয়ার হোটেলের পরিচ্ছন্ন কর্মী হিসাবে । বলে রাখা দরকার , নতুন অবস্থায় তিন মাসের ভিতর কাজ ফেলে মালিক পরিবর্তন করার সরকারি আইন আছে। সেই কাজের মালিক সরকারি ফিস এবং সমস্ত অফিসিয়াল আনুষ্ঠানিকা বজায় রেখে মালিক পরিবর্তন করে এবং ইকামা বানায় । যার ভিসায় আসা হয় তা পরিবর্তন হয়ে নতুন মালিকের অধিনে ইকামা হয় আর নতুন মালিক ক্ষেত্র বিশেষ সমস্ত খরচও বহন করে। এতে দালাল যে দেশে ইকামার টাকা বাড়তি নেয় সেটাও তার লাভ থাকে। এই জন্য লোক আসে জমা হয় এবং কাজ খুজতে থাকে।
মসজিদে নবীর নিকটে আমার হোটেল । বার ঘন্টা ডিউটি দুঃখ নাই , কাজ পেয়েছি । থাকা খাওয়া ফ্রী , এবার যা বেতন দেয়। সৌদি আরবের অর্থনৈতিক যে হাহাকার চলছে তাতে আমার স্বপ্ন মরুদ্বীপের সুর্য কিরণে ভেসে উঠা জলপ্রপাত । এই জল পান করতে গেলে অতিদুরে আবার সেই রকম জল দেখা যায়। তবুও মন্দের ভালো কাজ করতে পারি। মা বাপ এবং বউ বাচ্চার সাথে ফোন করে সান্তনা দিতে পারছি । সকাল সাতটা হতে কাজ শুরু হয় চলে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত । থালা -বাসন, পাতিল ধৌতকরণে দিন যায় আসে রাত। মাঝারি সাইজের পাতিল ধুয়ে ঝকঝক করতে হয় । কারণ এইসব পাতিলে ভাত রান্না করে । হোটেলটাও চব্বিশ ঘন্টা কাস্টোমারে ভরপুর থাকে। হোটেল মালিক ভালো লোক । মদিনা ছাড়াও মক্কা , তায়েব এবং আল কাছিম আরো হোটেল আছে । কখনো কখনো মালিক আসে শ্রমিকদের সাথে কৌশল বিনিময় করে। খাওয়া থাকায় কোন সমস্যা আছে কিনা জানতে চায়। এতে সবাই খুশি মনে কাজ করে। বিশ বাইশ দিন কাজে হয়ে যায়। পুরাতন বাঙ্গালী শ্রমিকদের কেউ কেউ সহযোগীতা করে কেউ কেউ নিজের কাজ করাতে চায়। ভাষা না জানার দুর্বলতার সুযোগে ফোর ম্যানের কাছে নালিশ করে।
একমাস পরেই আমাকে নিয়ে যায় আল কাছিম। আমার কোন আপত্তি ছিল না কারণ কাজ চাই ,টাকা চাই। এখানে আমাদের দেশের মত বাসি পচা খাবার নেই । প্রত্যেকটি কর্মী পোষাক আষাকে পরিপাটি । হাতের নখ ছোট থাকে মাথায় টুপি পরতে হয় যেন চুল না পড়ে খাবারে। সরকারি কঠোর তদারকি নিত্য দিনের কাজ। মাছি তেলাপোকা দেখিনি কখনো। সাদা ধবধবে টাইলস সাবানের পানি দিয়ে জীবাণু মুক্ত করতে হয় সবসময়। আমি খুশি মনে নেচে গেয়ে কাজ করি মন প্রাণ উজাড় করে। মালিক এসে মাঝে মাঝে বলে আবুল কালাম মিয়া মিয়া ( একশতে একশত) । আমি মাথা নেড়ে বলি কোয়েছ (ভালো)।এইভাবে চলতে চলতে একদিন দুপুরে মালিক এসে বলে আবুল কালাম মুশকিল । আমি বুঝলাম কোন সমস্যা হয়েছে। একজন ভাষা জানা লোক জিজ্ঞাসা করলো কি সমস্যা হয়ছে। মালিক বললো আমি সরকারি অফিস গিয়েছি আবুল কালামকে রিলিজ করে ইকামা করার জন্য পরামর্শ করতে । তখন জানতে পারি তার কপিল (মালিক) তাকে হুরুপ (প্রাথমিক এক্সজিট ) দিয়ে রাখছে । এখন তাকে রিলিজ করা এবং তার ইকামা করা যাবে না । তাকে দেশে ফেরত যেতে হবে। সে এখন সৌদিতে অবৈধ । তাকে সৌদি থাকা কঠিন হবে। যে তাকে ভিসা দিয়েছে সে হয়তো আবুল কালামের কপিলের সাথে কোন যোগাযোগই করেনি। ইকামা করতে না পারলে , রিলিজ করতে না পারলে তাকে কাজে রাখা সম্ভব না । অবৈধ লোক রাখলে হোটেলের সমস্যা হবে। দোভাষি বাঙ্গালী আমাকে সব বুঝিয়ে বলার পর আমি হাউমাউ করতে থাকি। ফোন করি মোস্তাক মিয়ার ছেলেকে । নাম্বার বন্ধ পাই , অর্থাৎ পুরাতন নাম্বার ফেলে দিয়েছে। সেই দিনই সুস্থ স্বাভাবিক আবুল কালামের মরণ হয়। তারপরই জিন্দা লাশ আবুল কালাম দেহ নিয়ে ছুটে কাজ পেতে।
হোটেল মালিক আমার অসহায়ত্বের কথা শুনে তার বন্ধুর খামারে পাঠায় কাজে। সুনশান নিরব মরুভূমিতে ভেড়া পালকের রাখাল হিসাবে।(চলবে)।
করোনায় একজন প্রবাসী ।
২য় পর্ব।
জনমানবশূন্য মরুপান্তর । আমি আর আমার সাথে ভেড়ার পাল। যেন আমি শিক্ষক ওরা আমার ছাত্র। মোটা তারের বেড়া দিয়ে আবদ্ধ ভেড়ার সাথে ছাগলও আছে কয়েকটা । পাশে তাবু আমার থাকার ঘর। প্রচন্ড গরমে মনে হয় সূর্যটা দৃষ্টি সীমানার পান্ত শেষে। পানির তৃষ্ণায় শুকনো গলায় কথার বাহির হচ্ছে না। গাড়ি হতে নেমে কাপড়ের ব্যাগ রাখলাম তাবুতে। বালুর ভিতর একটা কার্পেট বিছানো । সৌদি আমাকে বসতে বললো । আমি অবনত মাথায় নিরীহ নির্বাক । সাত চল্লিশ ডিগ্রী তাপমাত্রায় দপ করে মুখটা জ্বলে উঠলো। হৃদয়ে ভেসে উঠলো তিন বছরের মেয়েটার কথা । টাকা নেই তার জন্য যে দুধ কিনবে। মায়ের শ্বাসকষ্টের ঔষধ ফুরিয়ে আসছে। এনজিও আঁশা এবং চাচা আছে পিছনে পিছনে তবে কমুদ বাবু মেনে গিয়েছে । বলেছে তোর সুবিধা মত টাকা দিস তবে তাড়াতাড়ি দিলে সুদ কম হবে। তাবুতে আমার দিন রাত মাঝখানে ভেড়ার খেদমত। ইস! এই টাকায় প্রবাসীদের বউ চোখে কালো চমশা পরে টাউনে গিয়ে দোকানে দোকানে সৌন্দর্য বিলি করে। ভাইটা পড়ার নাম করে টাকা নিয়ে নিজের এ্যাকাউন্টে জমা করছে । ক্ষমতাশালী রাজনীতি করে চাঁদা নিয়ে মাদক ও নারীতে মগ্ন থাকে । ছোট বোন রাত জেগে ন্যাটে ছবি দেখে । মা বাপ কখনো কখনো চোখের নেত্র বিসর্জন দেয়। ছোট ছোট শিশু সন্তান বলে বাবা কখন আসবে বাড়িতে। তারের বেড়ায় লোহার উপর হাত রাখতে চ্যাত করে উঠে। ফোসকা পড়ে যায় হাতের তালুতে। য়ে দিকে তাকাই স্বচ্ছ আকাশ আর আকাশ । এই দেশে শীতকালে বৃষ্টি হয় আর গরম কালে রৌদে আগুন ধরে।
স্বর্গে ডানে বামে সামনে পিছনে সুন্দরী হুর থাকবে খেদমতে। না চাইলেও থাকবে তারা । আর এখন আমি শিশুর দুধ কিনতে পারছি না । কি আজব রহস্য মরণের পর হুরের গন্ধে আমি হবো মাতোয়ারা আর এখন এক অযোগ্য বাবা । যাকে তুমি আরব দেশের রাখল বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছো। সাদা , হলুদ গোলাপী রংয়ের হুরের সাথে সুরা হাতে এরাবিক নৃত্য হবে , মাঝে জয় জয় বলে চিৎকার করবো । নেশাগ্রস্ত হয়ে লুটিয়ে পড়লে হুর আমাকে চুমা দিয়ে শিহরিত করবে আর এখন আমি মায়ের হাঁপানির ঔষধ কিনতে না পারা অযোগ্য সন্তান। তুমি কি জানো ঈশ্বর আমার মা আমার কাছে স্বর্গ । যে চাঁদ আলো দিয়ে অন্ধকার পৃথিবী জ্যোৎস্নাময় করে সেই চাঁদ হতেও আমার মা বেশি জ্যোৎস্নাময়। আজ তাঁর হতে অনেক দুরে ধুধুবালু পান্তরে সৌদি আরবের গভীর জঙ্গলে মেষপালক আমি। মায়ের সন্তান প্রসব করার সময় যে ব্যথা হয় তার সামন্য পরিমাণও যদি পুরুষদের দেওয়া হয় তাহলে মেরুদণ্ডের বাইশটা হাড় ভেঙ্গে চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে যাবে। তুমি সেই মা‘য়ের ঔষধ ও দুধ কিনতে আমাকে অপরাগ কেন করে রাখবে হে অধিপতি । আমার দেশে শত শত লোক হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে ব্যাংকে জমা করছে। তাদের সন্তানেরা বিদেশে উন্নত জীবনযাপন করছে । আর আমার সন্তান দুধ ভাতও পায় না । আমজনতার হোক মেরে খাওয়া লোক কত আরাম আয়াস করে আর তুমি আমাকে শাস্তি দিতে ব্যস্ত । দেশের শাসকও বৈষম্য তৈরি করে শিক্ষা চিকিৎসা ও আইনে আমাদের সেবা দেয় তুমিও তাই করছো।
সৌদিয়ান একজন ভারতীয় বাঙ্গালী সাথে করে নিয়ে ফেরত আসে। গায়ে সাদা লম্বা জামা তবে গামছা দিয়ে মুখ বাঁধা যাতে রোদ না লাগে। উনি এসেই বাংলা বলায় আমার আর কথা বলতে বেগ পেতে হলো না। কথা বলে বুঝা গেল কাজের পারদর্শী সে। কেমন আছো বাপু। আমি ফকির শাহ। পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদ বাড়ি। অনেক দিন আছি এখানে , সৌদি লোকটা ভালো । তুমি মন লাগিয়ে কাজ করো আস্তে আস্তে সব ভালো লাগবে। আর এখানে নিরাপদ থাকবা। আমি নিরব হয়ে তার কথা শুনি । সৌদিয়ান পঞ্চাশ রিয়েল আমাকে দিয়ে চলে যায়। পাশে রেস্ট হাউজে কাজ করে ফকির শাহ। আমি তার পিছে পিছে চলি। দরকারের চেয়ে একটু বেশী বলে ফকির শাহ । প্রাচীর ঘেরা রেস্ট হাউজ যেন রাজ প্রাসাদ। নানা জাতের ছোট বড় অসংখ্য খেজুর গাছ। পানির কৃত্রিম লেক , কুপ এবং ঝর্ণায় সজ্জিত । গেইট রাস্তায় কিংবা ঘর সব নিরাপত্তায় ঢাকা । সিসি ক্যামরা ও নিরাপত্তা ঘন্টা দেওয়া আছে। তাবুতে চা গাওয়া (কফি) খায় । এবং মেহমান আসলে বসে। লিপটন , কুব্বুস, শ্রীলষ্কান চায়ের পাশে ফ্রাসী ,তুর্কী আমেরিকান এবং মালাই , কোন কফি নাই তাদের । সবই আছে সাজানো আর বানানোর কারিগর ফকির শাহ।
ফকির শাহ কাজ করে রেস্ট হাউজে । তার জন্য আলাদা থাকার ঘর আছে । সেই ঘরে যাবতীয় সরঞ্জাম আছে। ভেড়া দেখার লোক ছুটিতে তাই সে ভেড়ার পালকে খাবার পানি দেয়। আমি তার কথা শুনি আর মাথা ডান বাম করি । ফ্রীজ হতে মোরগ বাহির করতে করতে বলে আজ মোরগটা ভালো করে রান্না দিতে হবে গো। আমি তার কোন কথায় মন দিতেছি না । আমার নাকে ঘুরে ভেড়ার বিচ্ছিরি গন্ধ। সকাল বিকাল খাবার দেওয়া । পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করতে হবে । রোগ জীবাণু হলে সেবা করতে হবে । সবচেয়ে বড় কথা হলো ভেড়া হতে দুধ বাহির করতে হয়। এরাবিয়ানদের কাছে উট , ভেড়া এবং ছাগলের দুধ খুবই প্রিয়। এমনকি দুধ হতে মাখন বানিয়ে বিক্রিও করে । এমন অনেক এরাবিয়ান আছে যাদের কাছে শত শত ভেড়া কিংবা উট আছে। এইটা এদের কৃষি কাজ । সরকার এই কৃষিকাজে উচ্চ হারে ভুতুর্কি দেয়। গম এবং কাঁচা ঘাস উট ও ভেড়ার খাদ্য। সীমানা হীন মরুভূমিতে বাঙ্গালীরাই কৃষি কাজে জড়িত। বার্থরুমে ঢুকে পানির ঝর্ণা ছেড়ে দিই মাথার উপর । দশ মিনিটের গন্ধ সহ্য হচ্ছে না অথচ মানুষ শত দিন হাজার দিন এই কাজে নিয়োজিত । অার আমি! আমার কান্নার জল ঝর্ণার জলে মিশে হারিয়ে যায়। কাজ করতেই হবে , কাজ পারতেই হবে। ভয় পেলে পুরুষ কিসের। (চলবে)।
করোনায় একজন প্রবাসী ।
৩য় পর্ব।
আমার এলাকার এক হাই স্কুলের শিক্ষক সৌদিতে এসে ভেড়া পালনের কাজে পড়ে ভিসা দালালের মিথ্যার কারণে। সৌদিতে গিয়ে কাজের কথা শুনে উনি হতবাক । পরে অনেক দেন দরবার করে উনার সাবেক ছাত্ররা টাকা দিয়ে টিকেট কেটে দেশে ফেরত পাঠায়। উনার সৌদি মালিক কিছুতেই উনাকে রিলিজ দিতে কিংবা দেশে যেতে দিতে রাজি না । সৌদিয়ান বলে আমি ভিসা দিতে কোন টাকা পয়সা দাবি করি নাই । কারণ যে আসবে সে কষ্ট করবে তাই ভিসা বিনা পয়সায় দিয়েছি যাতে একজন মিসকিন কৃষক আসতে পারে। শিক্ষক কেন এই ভিসায় সৌদিতে আসলো। এইটা শিক্ষকের ভুল , আমার না। তাকে বুঝানো গেল না ভিসার দালাল মিথ্যা বলেছে। সৌদিয়ান বলে তোরা সবাই বাঙ্গালী মিথ্যাবাদী । যেহেতু আমার ভিসা নষ্ট হয়েছে এবং কাজের জন্য লোকও নাই তাই এখন এই কাজ করতেই হবে। ঊনি এর বাসায় ওর বাসায় পালিয়ে থেকেছেন কিছু দিন পরে এক পূলিশ অফিসারের সহযোগিতায় দেশে আসেন । এখনো উনি হাই স্কুলের শিক্ষকায় নিয়োজিত। আসলে গরিবের জন্য শিক্ষাটাই অত্যন্ত উপকারী সম্পদ। যে কোন সময় এইটা বিক্রি করে আপনি খেয়ে পরে চলতে পারবেন। হয় আপনার কাছে অগাধ টাকা পয়সা থাকতে হবে না হয় যথেষ্ট শিক্ষা থাকতে হবে। আপনি অশিক্ষিত দীনহীন সময় পার করেছেন । তবুও মা বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই। তাদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দোয়া কামনা করেন । কিন্তু বর্তমানের সন্তান বলবে কেমন মা বাবা যারা আমাকে পড়াশোনাও করতে দেয়নি সম্পদও রেখে যায়নি। তাদের ভুলের কারণে আজ আমি অশিক্ষিত , তাই আমি খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে কষ্ট পাচ্ছি । এই জন্য সন্তানকে আধুনিক বিজ্ঞান সম্মত কর্মময় শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চেষ্টা করুণ। যাতে সন্তান শিক্ষার সুফল পায় ।
ভাই তোমার নাম জানা হলো না। আমি আর তুমি এক ভাষার মানুষ। মন খুলে চলবা আমার সাথে। আমি আবুল কালাম । বাংলাদেশে কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি আমার বাড়ি।
এই লও বিড়ি খাও। পাতার বিড়ি এইটা । এত দিন একজন কথার বলার লোকও ছিল না । এখন তুমি আসায় ভালো লাগছে। চলো , ঘরের ভিতর দেখো। আমার মালিক লোক ভালো টাকা পয়সা ঝামেলা করে না । বৃহস্পতিবার বিকালে আসে পুরা পরিবার আবার শনিবার রাতে চলে যায়। এই দুই দিন আমার কাজ বেশী থাকে । দম ফেলতে পারি না । সে সরকারি বড় অফিসার তাই বিভিন্ন লোক আসে । খাওয়া - দাওয়া হয় প্রচুর । অনেকে আমাকে বকশিস দেয়।
আমি মন দিয়ে ফকির শাহর কথা শুনি । বাড়ির ভিতর সব কিছু এত দামি দামি যে চোখ ধাঁধানো। মনে হয় যেন রাজার মহল এইটা । দালানে রংয়ের কারুকর্ম , বাহারি বাতি , দামী ফার্নিচার । এইটাইতো স্বর্গ গরিবের জন্য ।
দুইটা মেয়ে বিয়ের বয়স পার হয়েছে । এখনো বিয়ে দিতেছে না ছোট একটা পোলা আছে সেই বিরক্ত করে। ছেলেমেয়েদের পিছনে বেতনের অর্ধেক টাকা পনর দিনে শেষ করে। দামি দামি পোষাক কসমেটিক্স কিনে । এরপরও বিউটি পার্লারে যায় দুইবোন। বড় লোকের মেয়ে বড় লোকের কাছে বিয়ে দিবে । মোহরানাও অনেক বেশী দাবি করে । এমনিতে বিয়ে করতে হলে একজন লোকের বাড়ি গাড়ি সংসার খরচ যাবতীয় পরিপূর্ণ থাকতে হয়। এই মেয়েদের বিয়ের কথা হলে তাদের বাবা এক লাখ রিয়েল মোহরানা দাবি করে । আমাদের দেশে মোহরানার কথা, বিয়ের পরে আর কারো খবরই থাকে না । এইখানে কলমা পড়ার আগেই তার লেনদেন শেষ হয়। যাদের টাকা পয়সা বেশী থাকে বহু বিবাহ করে। এইটা ইসলামের সুন্নত । অথচ নামাজে অনেকে সুন্নত পড়েই না। আর বহু বিবাহ করে সুন্নত পালন করে। সবচেয়ে আচার্য্য কথা বৃদ্ধ বয়সেও যুবতী মেয়ে বিয়ে করে বাচ্চার বাপ হয়। ঘরের ভিতর নারীর নূন্যতম মর্যাদা নেই । তবে বাহিরে কেউ চোখ তুলেও তাকাতে পারে না । একসাথে কয়েকটা মেয়ে কালো বোরখা পরে চললে মনে হয় পেঙ্গুনের দেশ।
অথচ এই এরাবিয়ানই গরিব দেশ হতে গৃহকর্মী নিয়ে আসে বেশীর ভাগ যৌন কাজের জন্য। ফিলিপাইন , শ্রীলংষ্কা, ইন্দোনেশিয়া এবং বাংলাদেশ হতে আসে এইসব গৃহকর্মী। ফিলিপানের বিধর্মী মেয়েরা আসার সময় সেই রকম প্রস্তুতি নিয়েই আসে। আবার সৌদিয়ান প্রচুর ফিলিপাইন ভ্রমনেও যায়। এইসব গৃহকর্মীদের বরাতে বিয়েও করে । থালা বাসন ধোঁয়া হতে ঘরের সমস্ত কাজ করতে হয়। ঘর পরিষ্কার , কাপড় পরিষ্কার , শিশুদের দেখাশোনা এবং ঘরের পাশে গ্রোসারি দোকানে যেতে হয় খরিদদার হয়ে। খুব কম সময় মিলে ঘুমানোর জন্য । ঘুমানোর জায়গা হয় রান্না ঘর কিংবা স্যাঁতসেঁতে অস্বাস্থ্যকর ঘরের কোণা । এর ফাঁকে ঘরের যুবকের যৌন লালসায় পড়তে হয়। বাপ বেড়া উভয়ের কুনজর থাকে গৃহকর্মীর উপর। প্রাপ্তবয়স্ক বয়স্ক পুরুষ মানে কাদ্দমা (গৃহকর্মী) ভোগ । আর এর পরিমাণ হয়তো শতকরা আশি জনের ঘরে। প্রতিবাদ করলে নির্যাতন নেমে আসে বর্বরোচিতভাবে । যেমন আমাদের দেশে বড়লোকের বউরা করে ছোট গৃহকর্মীদের উপর। খবুই কম সৌদি পরিবার আছে গৃহকর্মীদের যৌনসংগমে বিরত থাকে।এবং হাদিস কোরানে প্রভাবিত হয়। তবে ঘরের বাহিরে এদের চলাফেরা দেখলে মনে হবে না এরা এমন বর্বর। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ শতকরা ৯৮জন লোকই পড়ে। এবং সুযোগ পেলে কোরান তেলায়াতও করে। চীনের নকল পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার এই সৌদি । আবার এরা হালাল হারাম খাবার খুজে চীনে গিয়ে। আজব কথা হলো এইসব গৃহকর্মীদের কোন আজনবী ( সৌদিয়ান নয়) এর সাথে কথা বলতে দেখলে তারা খুব রাগ করে । বলে এইটা হারাম , ইসলাম অবমাননা । প্রেম ভালোবাসায় জড়ালে পড়তে হয় ইসলামি আইনের ম্যারপ্যাচে । হয় জেল জুলুম এবং অবশেষে নিজ দেশে ফেরত।
হাসপাতালের আয়া কিংবা নার্সের কাজে যারা আছে তারা ভালো আছে। নার্সের জায়গা ফিলিপাইনের দখলে আর আয়ার দখলে বাংলাদেশ। রাস্তা ঝাড়ু , অফিস আদালত ঝাড়ু , বিমান বন্দর ঝাড়ু কিংবা বার্থরুম ঝাড়ু সব বাংলাদেশের পরিচ্ছন্ন কর্মীর দখলে। অথচ বাংলাদেশের রাজনীতিক নেতারা কথায় কথায় বলে দেশ অনেক উন্নত যে কানাডার মত। এইসব ঝাড়ুদারের রেমিটান্স পাঠানো টাকায় রাজনৈতিক নেতারা নিজ পরিবার কানাডায় রাখে বলে তারা স্বপ্নিল থাকে। হাসপাতালের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা ভালোবাসার মধু পান করতে গিয়ে করে অনৈতিক কাজ। এবং কখনো কখনো সীমাহীন প্রতারিত হয় মেয়েটা । যেমন এখন বাচ্চাসহ এক বছর ধরে জেলবাসী নোয়াখালীর জেসমিন। তার সহকর্মী কুমিল্লার ছেলের সাথে প্রেম তারপর বিয়ে । (চলবে)।
করোনায় একজন প্রবাসী।
৪র্থ পর্ব।
জেসমিন রিয়াদ হতে আটশ কিলোমিটার দুরে গ্রাম এলাকায় এক হাসপাতালের আয়া। বাপ মরা মেয়েটা সৌদি আসে মা এবং অন্যান্যদের সুখের আশায়। ভালোই দিন যেতে লাগল । ওই যে বলে না “ সুখে থাকলে ভূতে কিলায় ” জেসমিনের বেলায়ও তাই হলো। পরিচয় গাঢ় হলো তারই কলিগ কুমিল্লা নিবাসী এক ছেলের সাথে । তারপর আর কি - প্রেম ফিরিত অবশেষে বিয়ে। মৌলভীর মুখে মুখে কলমা পড়ে কবুল বললেই শুধু বিয়ে হয়না । বিয়ে প্রমাণের জন্য লিখিত কাগজপত্র লাগে। বিয়ে নামক খেলা খেলতে গিয়ে একত্রে বসবাস শুরু করে জেসমিনেরা। এমনি এক পর্যায় জেসমিনকে অবৈধ সেক্স করার দায় পুলিশ হাসপাতাল হতে গ্রেফতার করে। হয়তো কেউ তাদের তথ্য পুলিশকে দিয়েছে ! এখানে আবার বাংলাদেশীদের রাজনীতি ও রেষারেষির শেষ নাই। জেসমিন ধরা পড়ার পর পরই গা ঢাকা দেয় জেসমিনের স্বামী । স্বামীর বড় ভাই পরিচয় দিত না ভয়ে। তবে নিরক্ষর জেসমিন কাবিন ছাড়া বিয়ে হয় না , ছেলেটা যে তাকে প্রতারিত করেছে চৌদ্দ মাস জেলে থেকে তারপর বুঝতে পারে। জেসমিন যখন ধরা পড়ে তখন সে গর্ভবতী । জেলে গিয়ে ফুটফুটে একটা ছেলের মা হয়। এইসব মামলায় বাংলাদেশ দূতাবাস চোখে টিনের চশমা পরে কানে তালা মারে। আইনী লড়াইয়ে হারতে থাকে কাগজপত্রহীন বিয়ে করায়। এক পর্যায় দেশ হতে কাবিন করে নিয়ে দেখিয়ে অবৈধ সেক্স করার অপবাদ হতে পার পায়। এই পর্যন্ত লড়তে সাহায্য করে সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশী সাংবাদিক ও কমিনিটি। কিন্তু তারপরও তার মুক্তি মিলে না কারণ কোম্পানি তাকে স্বিকার করে না । এমনকি পাসপোর্টও হারিয়ে ফেলে । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক প্রচার হওয়ার পর দূতাবাস খোজ নিতে যায় জেসমিনের। এবং পাসপোর্ট করার আনুষঙ্গিক তথ্য সংগ্রহ করে । এই করোনা সব উলটপালট করে দেয়। জেসমিন দুধের বাচ্চা নিয়ে জেলে মানবেতর জীবন পার করছে।
গুটি কিছু বাংলাদেশী লোক মাঝে মাঝে নারীঘটিত ঝামেলায় জড়িয়েছে। যাহা হিসাবেও পড়ে না। নারী নিয়ে লোভ তেমন নেই বললে চলে। কিন্তু এর বিপরীত দেশে, তাহলে কি সব ভালো লোক সৌদিতে যায়। তা না , বরঞ্চ বেকার মামলা মোকদ্দমার আসামি বিদেশে পাড়ি দেয়। সেখানের আইনের কঠোর প্রয়োগ দেখে ভয়ে নারী নিয়ে উৎসাহ দেখায় না। আর বাংলাদেশ হতে গৃহকর্মী গিয়ে নিজের ইজ্জত আব্রু তুলে দিচ্ছে বর্বর হায়নাদের হাতে। ঢাকায় গৃহকর্মীর ভিসার দালাল আছে । এই দালালেরা মহিলা ভিসার নাম দিয়েছে গাই (গাভী) ভিসা। সৌদির অনেক গৃহকর্মী সরবরাহ অফিস আছে তারা গ্রুপ ভিসা ঢাকায় পাঠায়। আর ঢাকার রিকুয়েটিং অফিস গাই খোজে লিপ্ত হয় । আর এই গাই সেখানে গিয়ে দুধ দিতে না পারলে জীবন নিয়ে ফিরতে কষ্ট হয় । আর এইসব গাই খেতে পারে না । ভয়ে বাহিরে যেতে পারে না । আইনের আশ্রয় নিতে পারে না।
বড় একটা হল রুম যেটাকে সৌদি ভাষায় দেওয়ানিয়া বলে। রাজ প্রাসাদের সব চেয়ে চমক এই হল রুম। দেয়ালে অপরূপ কারুকর্ম । বাদশা আজিজের ছবি এবং তার সাথে বর্তমান রাজার ছবিও দেয়ালে লাগনো। মেঝে বিছানো তুর্কীস্থানের সবচেয়ে দামি কার্পেট । এক কোণায় ডিস লাইনের রিসিভার বসানো। মাঝখানে ছোট ট্রি টেবিলে ফ্রাসের ছোট ছোট চায়ের পাত্র সাজানো । তবে কোন চেয়ার টেবিল নাই , সবাই চারিদিকে নিচে বসেই আলাপ করে। এখানে যারা আসে সরকারি বড় বড় অফিসার, আসে বড় বড় পয়সাওলা লোক। নারীদের জন্য আলাদা দেওয়ানিয়া (হল রুম ) আছে। গাড়ি হতে নেমে আলাদা দরজা দিয়ে মহিলা রুমে চলে যায় । সৌদিতে প্রত্যেক বাড়ি হোটেল , মোটেল এবং রেস্ট হাউজ সব জায়গায় মহিলার জন্য সংরক্ষিত দরজা আছে। সদর দরজার সাথে রুমের দরজা সংযোগ যাতে পুরুষ না দেখে । মহিলাদের পর্দা রক্ষায় এই নিয়ম মেনে চলতে হয়। প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিটি নারী ঘরের বাহিরে বোরখা পরা বাধ্যতামূলক । তবে এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে । নারীরা গাড়ি চালাতে পারে , গ্যালারিতে বসে ফুটবল খেলা দেখে , গ্যাল্যারিতে বসে ছবি দেখে । বাদশা সুলতান বিন আবদুল আজিজ ব্যাপকভাবে আধুনিকীকরণ করেছে সমাজ এবং অর্থনীতিকে। এই সৌদি প্রাচীন কাল হতে কঠোর ধর্মীয় বিধিনিষেধ মেনে চলা একটা দেশ। এখানে এখন ললনা স্বল্প বসনে সমুদ্র স্নান করে । বাহিরের লোক মহিলা পুরুষ বন্ধু হলেও হোটেলে রাত যাপন করতে নিষেদ নেই । যা আগে অবৈধ যৌনমিলন বলে ইসলামি শরিয়া মোতাবেক কঠোর অপরাধ ছিল।
বেশীর ভাগ পরিবারে গৃহকর্মী এবং পারিবারিক ড্রাইভার থাকে । এই ড্রাইভারদেরও অনেক অসহনীয় কষ্ট এবং অপমান সহ্য করে কাজ করতে হয়। ড্রাইভারের নিদিষ্ট কোন সময় থাকে না কাজের । রাতে এবং দিনে যখনি প্রয়োজন তখনি তাদের কাজের ডাক পড়ে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই ড্রাইভারের সাথে গৃহকর্মীর কিংবা সৌদি মেয়েদের সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠে । যা প্রকাশ হয় খুবই খুবই কম। আর প্রকাশ হলে রেহাই নাই। শুনেছি সৌদি মেয়েদের সাথে সম্পর্ক নিয়ে সন্দেহ করে ড্রাইভারকে দেশে ফেরত পাঠাতে। এই জন্য পারিবারিক ড্রাইভারের বয়স চল্লিশ বছর হতে হয় , বিবাহিত হতে হয়। এবং মহিলাদের কাপড় সেলাই করা ট্রেইলারদের বয়সও চল্লিশ বছর বয়স হতে হয়। এইসব ট্রেইলার দোকানে সবকিছু সংরক্ষিত হয় । মহিলা দোকানে গেলে নিজেকে নিরাপদ দূরত্ব রেখে ট্রেইলারের সাথে কথা বলতে হয়। জনবহুল এলাকায় এইসব মহিলা ট্রেইলারিং দোকান কম হয় । তবে এখন মহিলারা প্রচণ্ড পর্দা থেকে চাকরী , ব্যবসা বাণিজ্য , দোকান পাট সবই করতেছে। তবে আমাদের দেশের মত নারী আন্দোলন , নারী নির্যাতন , ধর্ষণ হত্যা কোন কিছুই নেই। আছে অগণিত তালাক । আর সৌদিয়ান ঘরের নারীকে অত্যন্ত মূল্যহীন মনে করে । পুরুষদের ইচ্ছাই সব কিছু। এরা ছোট বড় সবাইকে নাম ধরে ডাকে। তবে সন্তান থাকলে বড় ছেলের নাম ধরে বলে অমুকের বাপ। মেয়ে বড় হলেও মেয়ের নাম বলে না । যেমন এই সৌদিয়ানের দুই মেয়ে বড়, ছেলে ছোট তবুও লোকজন উনাকে আবু আবদুল্লা (আবদুল্লার বাবা) বলে । (চলবে)।
করোনায় একজন প্রবাসী ।
৫ম পর্ব।
কালেমা লিখা , তলোয়ার এবং খেজুর গাছ খচিত পতাকা দেয়ালে সাঁটানো । সবাই ভক্তি শ্রদ্ধা করে পতাকাকে এইটাই নিয়ম । কিন্তু এদের মত এমন করে ঘরে সাঁটানো রাখে না। সরকার যা বলে তা সৌদি জনগণ শুনে । কারণ জনগণের চাহিদা সরকার মিটিয়ে থাকে। আগে রাজা মারা গেলে রাজার বয়সে ছোট ভাই রাজা হয়ে ক্ষমতাপ্রদান হতেন । এখন রাজতন্ত্রের এইদেশে রাজা মরলে উনার ছেলেই রাজা হবে । আমাদের দেশের রাজনীতির হাওয়া লেগেছে কিছুটা । বুঝে নিবেন , বেশী বলা যাবে না । বিখ্যাত সাংবাদিক জামাল খাশোগী বেশী বলতে গিয়ে লাশও পায়নি ।পালিয়ে থাকা খাশোগীকে তুরস্কে হত্যা করে লাশ পর্যন্ত পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে । এমন কি নিজের পরিবারের অনেক জনকে জেল জুলুম দিয়ে এবং দুই/একজনকে মেরে সিংহাসনে বসার পথ পরিস্কার এখন রাজার বড় ছেলের । তবে জনগণের এইসব নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই। সিংহাসনে কে বসলো তা নিয়ে তাদের কোন কিছু আসে যায় না। দুর্নীতি দমনের নামে রাজার ছেলের প্রতিদ্বন্দ্বী নিজ পরিবাবার লোকজন কিংবা সন্দেহভাজন বড় বড় কর্মকর্তাকে জেল জুলুম দিয়ে প্রচণ্ড হেনস্থা করা হয়েছে। তবে বাদশাহ ফয়সাল , খালেদ কিংবা আবদুল্লাহর শাসন আমলে বাহিরের লোক সবদিকে ভালো ছিল। ইকামার ফিস কম ছিল , কাজের চাহিদা ছিল । তাদের আমলে শুধু ধর্মীয় কঠোর বিধান মেনে চলতে হয়েছে। সীমান্তবর্তী সব দেশের সাথে মোটামুটি সদ্ভাব ছিল । আর আজ ইয়েমেন ও সিরীয়া যুদ্ধে জড়িত সৌদি । মধ্যপাচ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো শিয়া এবং সুন্নি মতবাদ অথচ উভয় মুসলিম । আর মুসলিম হয়ে শিয়া সুন্নির প্রভাব বিস্তারে ব্যস্ত ইরান এবং সৌদি । হত্যা করছে লাখ লাখ নিরহ মানুষ কে। ইরান শিয়াদের দেশ আর সৌদি সুন্নি । ফিলিস্তিনে হাজারো মুসলিম হত্যা করছে ঈজরাল নামক সার্বভৌমত্বহীন একটা ইহুদী রাষ্ট্র । অথচ মুসলিমদের তীর্থস্থান চুপ । কাতারের সাথে চলছে অর্থনৈতিক অবরোধ। সৌদি আরব, আরব আমিরাত , বাহারাইন কুয়েত এবং মিশর মিলে কাতারকে করে এক ঘরে। আর তখন তুরস্ক এগিয়ে আসে কাতারের পাশে । নিত্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিস যেমন রান্না ঘর হতে বার্থরুম পর্যন্ত , এমনকি জীবন ধারণের যা প্রয়োজন তা সরবরাহ নিশ্চিত করে তুরস্ক। এই অপরিপক্ব রেষারেষিতে কাতার হল স্বাভলম্বী । দুর্ভিক্ষ অনাহার এবং বোমার আঘাতে রোজ রোজ সিরীয়া এবং ইয়েমেনে শিশু মহিলা পুরুষ অকাতরে মরতেছে । মুলত ইগো ক্ষমতার বলয় বিস্তারে আমেরিকার পদলেহনে এইসব পাপে লিপ্ত মক্কা মদিনার মালিক।
অথচ আমরা কাঁদি রোহিঙ্গা মুসলিম বলে। আমরা কাঁদি দিল্লী এবং কাশ্মীরের মানুষ মুসলিম বলে । আর আমাদের দেশের শাসকের চেয়ার পাকা পোক্ত হয় দিল্লীর অমুসলিমদের ইশারায়। ওরে বাবা ! কি আজব পলিট্রিক্স। মধ্যপাচ্যে ক্ষমতার পালা বদল হয় আমেরিকা ইচ্ছাতে। পৃথিবীর সবচেয়ে শৃঙ্খলাপূর্ণ রেশন ব্যবস্থা ছিল ইরাকে । সেটা আজ অতীত আমেরিকার চালে। পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিশালী টিভি চ্যানেল ইহুদীদের। সবচেয়ে বড় প্রসাধনী কোম্পানি ইহুদীদের । সবচেয়ে বড় পানীয় কোম্পানি ইহুদীদের। অথচ কুয়েত পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী টাকার মানধারী মুসলিম রাষ্ট্র । পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী তেল উত্তলোন হয় সৌদিতে । সৌদি আরব, বাহারাইন , আরব আমিরাত , ওমান , কুয়েত এবং কাতার ইচ্ছে করলে পুরা দুনিয়ায় নির্যাতিত মুসলিমদের পাশে দাঁড়াতে পারে। অথচ তারা নিজের পাশের দেশে যুদ্ধে লিপ্ত। এইসব দেশ একজোট হলে ফিলিস্তিন একের একের জায়গা হারাতে হতো না। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পেত মুসলিম জনগণ। আর এখন যাযাবর একটি জাতি গলা চেপে ধরেছে মুসলমানদের । এর পিছনে আছে এইসব রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ইন্ধন । একদিনে এই ঈসরাল দানবে পরিনত হয়নি । আজকে তারা শিক্ষা দীক্ষা ,জ্ঞান গরিমায় , বিজ্ঞান এবং আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত এক বিশাল মহীরুহ । পুরা দুনিয়ার ইহুদী ঈসরালকে টাকা পয়সা দিয়ে প্রথম হতে সাহায্য করেছে। স্কুল কলেজ গড়ে তুলেছে যাতে তারা শিক্ষিত হয়ে দেশ গঠনে মনোযোগ দেয়। ঈসরালের সেনাবাহিনীতে নারীরাও পৃথিবীর সেরা সৈনিক । রাস্তা ঘাট এবং আধুনিক স্থাপত্য ও গবেষণা দুনিয়ার মানুষকে অবাক করবে।ইয়েমেন এবং সিরীয়ায় যুদ্ধের কারণে শত শত শিশু দুধের অভাবে মরছে । অবরোধ চলছে ইয়েমেন সিরীয়া ইরান কাতারে এই সৌদি আরবের তত্বাবধানে। আমি আপনি কাশ্মীর কিংবা রোহিঙ্গা নিয়ে চোখের জল হাস্যকর তেমনি মুসলিমদের রক্তে স্নান করা সৌদি কালেমা খচিত পতাকা দেয়ালে সাঁটানোও হাস্যকর । ছোট ছোট শিশু শিয়া নয় , সুন্নি নয় , ইহুদী কিংবা মুসলিম নয়। কাশ্মীর রোহিঙ্গা ও ফিলিস্তিন তোমরা মানব সন্তান । প্রতিবাদ হোক লাল রক্তের সাগরে টেউ বন্ধে। প্রতিবাদ হোক গরিব মিসকিন ও ভূমিহীন মানব পাচারের । বিশ্ব হোক এক পাসপোর্টের । বিচার হোক যারা বাংলাদেশের পাসপোর্টকে কলুষিত করে মানহীন করছে।
ফকির শাহ দেওয়ানিয়া হতে বাহির হয় । দুপুর একটার উপরে বাজে আমি মনে করেছি ভাত খেতে যাবে ফকির শাহ। তা না গিয়ে পানির পাইপ হাতে নিয়ে দুর্বাঘাসে পানি দিচ্ছে। দেয়ালের পাশে একটা আঙ্গুর এবং একটা ডালিম গাছ আছে। রৌদে আঙ্গুর গাছের পাতা মরে গিয়েছে। কয়েকটা ডালিম আছে গাছে। ফকির শাহ গাছগুলিতে পানি দিয়ে দেয়। খেইমা (তাবু) যেতেই আমি বলি ভাই চলো খেতে যাই। ফকির শাহ স্মিত মুখ করে । এটাও আড্ডাখানা তবে বাড়তি হলো হুক্কা পানের জায়গা। বার-বি কিউ করার সরজ্ঞামও পড়ে আছে। এরা মাছ মাংস পুড়ে খায় । গভীর মরুভূমি হতে পাখি শিকার করে পুড়ে খায়। গরম কালে খুবই কম দিনে আড্ডা দেয় । রাতভর চলে পরিবার নিয়ে আড্ডাবাজি আর শুক্রবার আসলেতো রাস্তা ঘাট ,খাওয়ার হোটেল , এটিম বুথ থাকে জ্যামে পরিপূর্ণ । তবে করোনায় সব ওলোট পালট করেছে দিয়েছে। তিনশত জনের উপরে বাংলাদেশী মারা গিয়েছে। তের জুলাই পর্যন্ত করোনা রোগী সনাক্ত হয়েছে দুই লাখ তেত্রিশ হাজার তিনশত ঊনষাট জন । সর্বমোট মারা গিয়েছে দুই হাজার দুইশত বাইশ জন (বাহিরের লোকসহ)। আক্রান্তের দিক থেকে সৌদি আরব চৌদ্দ নম্বরে। এক নম্বরে আমেরিকা , একশ তিরাশি নম্বরে (সব শেষ) পাপুয়া নিউ গিনি ও ওয়েস্টিন সাহারা । প্রতি গরম কালে তিন মাস সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গ্রীষ্মকাল এর ছুটি থাকে । এর ফলে সৌদিয়ানদের বেড়ানো বেড়ে যেত। বেড়ে যেত ব্যবসা বাণিজ্য কমে যেত অফিস আদালতের কাজ। (চলবে)।
১ম পর্ব।
অনেক লম্বা সামনাসামনি দুইটা দালান । মাঝখানে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ফাঁকা গলি । একটা দালান গুদাম ঘরের মত আরেকটা শ্রমিক শ্রেণী লোকদের আবাস স্থল । একটু দুরে রাস্তার উপর সোড়িয়াম বাতির ঝলমল আলো। তবে গলিটা আবছা আবছা অন্ধকার । আবাসস্থলের দরজার বাহিরে বাতিগুলি নষ্ট হওয়ার পর আর লাগানো হয়নি। শীতকালে যখন বৃষ্টি হয় দুই দালানের পানি এই গলিতে হাটু সমান হয়। বৃষ্টির পানি এবং বার্থরুমের পানি মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকার ঘরে ঢুকে হাটু ডুবে। যেমন বাংলাদেশে বর্ষার সময় পিছ করা কালো রাস্তায় নৌকা চলে। আবুল কালাম তখন বিছানাপত্র ভাজ করে পা তুলে বসে থাকে । আর ভাবে কেমন আছে পরিবার ।
কয়েক মাসের প্রবাস জীবন আমি আবুল কালামের। নিজ গ্রামের মোস্তাক মিয়া ভিসার কারবারী । তার হতে ভিসা নিয়ে পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে সৌদি প্রবাসী আমি । দেশে আগে ঢাকায় বাদামতলিতে সবজির আড়তে চাকরী করতাম । মোস্তাক মিয়া আগে কাতার থেকে গিয়েছে , আরবী ভাষায় যেমন পারদর্শী তেমন মিথ্যা বলার শিল্পী । সৌদি আরব মোস্তাক মিয়ার ছেলে থাকে । সে ভিসা পাঠায় আর মোস্তাক মিয়া কথার রংয়ে সাজিয়ে তা বিক্রি করে। তবে মোস্তাক মিয়ার ছেলে ভিসার কারবারে ক্ষুদ্র কণা। এমপি পাপুলের মত শত শত দালাল আছে সৌদি আরবে ভিসার ব্যবসা সাইনবোর্ড লাগিয়ে মানব পাচারকারী। যাদের এক হাত আছে বাংলাদেশ দুতাবাসে আরেক হাত আছে এরাবিক দুর্নীতিগ্রস্ত বড় বড় লোকদের সাথে। আবুল কালাম দুই বছরে আরবী শিখেছে দশ / বার টা। কথায় কথায় এরাবিয়ানদের সাথে বাংলা বলে । তারা কিছু না বুঝে হাসে আর তখন আবুল কালাম বলে “দুর শালার ঘরের শালারা”। বাংলা শিখো, বাংলা ।
রিয়াদ বিমানবন্দরে আলোর ঝলকানিতে আবুল কালাম ভাবে ফরমালিনযুক্ত পচা সবজির গন্ধ আজ অনেক দুরে। ইস ! এত সুন্দর দেশের খেজুরে আমরা তেল মবিল ফরমালিন ঢেলেও মাছি মারি। আপেল বাগান নাই বলে আইনস্টন জন্ম হয়নি ঠিকই প্রচুর সরিষা-গাছ হয় বলে তেলবাজের জন্ম ঠিকই আমার দেশের গলিতে গলিতে । এত বাতি জ্বলে যেন দিনের মত আলো। আবুল কালাম ভাবে এই আলোতে জীবন জীবিকা সফে দিতে হবে। প্রথম মাসেই কিছু টাকা পাঠিয়ে চাচা হতে বসতবাড়ির দলিল নিতে হবে । না হয় চাচা আমার মা বাপকে গালি দিবে , বলবে টাকা দাও নাহয় জায়গা ছেড়ে দাও। তারপর কুমোদ বাবুর সুদের টাকা তারপর আঁশা হতে নেওয়া কিস্তি । মা বাপ আর বউ বাচ্চা , তাদের জন্য কিছু কিছু দিবো খরচের টাকা । এতে জমা হবে টাকা আর তাতে ঘরটা দালান করা যাবে।
চার / পাঁচ জনের থাকার ঘরে আমরা পনর জন গাদাগাদি করে ঢালাও বিছানায় ঘুমাই। কয়েকজন আছে ছয় মাস ধরে এখানে পড়ে আছে । থাকার কষ্টে , খাওয়ার কষ্টে নেই কোন চাকরীর খবর। এমনি কি নিদিষ্ট তিন মাস পার হওয়ার পরও দেয়নি ইকামা (পরিচয় পত্র )। আমাকে মোস্তাক মিয়া তাহলে কি মিথ্যা বলেছে। বলেছে তার ছেলে কাজ নিয়ে দিবে, এক সপ্তাহ এর ভিতর সৌদি মালিক ইকামা বানিয়ে দিবে। তবে তার জন্য সরকারী ফ্রী বাবত সব টাকা পয়সা মোস্তাক মিয়ার ছেলে বহন করবে। আর সেই টাকা মোস্তাক মিয়া দেশে আমার হতে নিয়ে নিয়েছে। এবং আমি যে কোন কাজ করতে পারবো । যেটাকে আমরা বলি ফ্রী ভিসা। তবে সৌদিতে এসে বুঝলাম এই ফ্রী ভিসার আইনগত কোন বৈধতা নাই। যে এরাবিয়ানের নামে যে এলাকায় এবং যে কাজের জন্য ভিসা ইস্যু হয়েছে ঠিক সেই এরাবিয়ানের সেই এলাকায় যথাযথভাবে সেই কাজই করতে হবে । এইটাই আইন এখানের । এর ব্যতিক্রম হলে জেল জরিমানা এবং দেশে ফেরত পাঠায়। মোস্তাক মিয়ারা ভিসা বিক্রির জন্য এবং লাভ বেশী করার জন্য ফ্রী নামক শব্দের ব্যবহার করে। তবে সবচেয়ে প্রতারক হলো সৌদি নাগরিক। সে ভুয়া লাইসেন্স দিয়ে ঘুষ দিয়ে প্রয়োজনের অধিক ভিসার জন্য আবেদন করে। আর এতে টাকা পয়সা ও বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করে এমপি পাপুলের মত শত শত ভিসার দালাল। যাদের ক্ষমতা এবং টাকা পাথরের পাহাড় এর মত। একটা ভিসা বাবত সরকারি ফিস মাত্র দুই হাজার রিয়েল ( প্রায় ৪৫ হাজার টাকা ) । তাহলে বাংলাদেশী একজন শ্রমিক সৌদি যেতে পাঁচ হতে সাত লাখ টাকা কেন খরচ লাগে । একটা ভিসায় এরাবিয়ান লাভ করে , এরপর সৌদিস্ত বাংলাদশী দালাল লাভ করে , রিকুটিং এজেন্ট এবং তাদের গ্রাম্য দালাল লাভ করে। এমনও হয় একটা ভিসা সৌদিতেই ছয় সাত বার বিক্রি হওয়ার পর বাংলাদেশ আসে। এই বিক্রির প্রক্রিয়া এমনও হয় সৌদি মালিকই জানে না তার ভিসা কতবার বিক্রি হলো। কয়েক মাস পরে বাংলাদেশের সৌদি দুতাবাস যোগাযোগ করলে মালিক জানতে পারে তার ভিসা প্রসেস হচ্ছে । এরাবিয়ানদের কাজ না থাকলেও লোভে পড়ে ভিসা বাহির করে তাই খরিদদারের সাথে মুখের একটা চুক্তি করে যে লোক আসলে টাকা দিলে ইকামা বানিয়ে দিবো এবং সে অন্যের কাজ করবে তবে মাসিক একটা লভ্যাংশ আমাকে দিতে হবে। এই হলো ফ্রী ভিসা যার কোন সরকারি বৈধতা নেই। এবং সরকার অন্যত্র কাজ করা লোকের ব্যাপারে খুবই কঠোর । আরো ভয়ংকর হলো এক রাজ্যের ভিসা অন্য রাজ্যে বিক্রি করে দেশীয় দালালেরা। অনেক সময় সমস্যা হলে মালিক কোন সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে না। কারণ তারা অবৈধ পন্থায় ভিসা বাহির করে লোক অন্যত্র ছেড়ে দিয়েছে বলে জেল জরিমানার ভয়ে থাকে। এবং যারা ভিসা বাহির করে তারা সরকারি সুবিধা পায় না। তাই অনেক সময় এই সুবিধার জন্যও শ্রমিক যাওয়ার কিছুদিন পর শ্রমিককে এক্সজিটও করে দেয়।
মোস্তাক মিয়ার ছেলে এই ধরনের ভিসা কিনেই দেশে পাঠায় । আর এইটা অমুক কোম্পানির ,ভালো বেতন , থাকা খাওয়া কোম্পানির এইসব বলে মোস্তাক মিয়া ভিসা বিক্রি করে । আসলে সবই এক বিশাল মিথ্যার জমিন। চাষ করবেন আপনি ফল খাবে মোস্তাক মিয়ারা। মানুষও মিথ্যার কাননে মালি হয় পরিবারের সুখের জন্য। এই রকম ভিসায় আমি আবুল কালাম সৌদি প্রবাসী । কয়েক মাস ধরে যারা পড়ে আছে তাদের দেশে টাকা পয়সা বাকি বকেয়া আছে । এবং কিছু লোককে কাজ না দিয়ে শাস্তিমূলকও ফেলে রেখেছে কারণ দেশে মোস্তাক মিয়াকে গালি দিয়ে ছিল। এবং এখনো তাদের পরিবার হতে চাপ অব্যাহত রেখেছে কাজের জন্য । অথচ মোস্তাক মিয়ার ছেলে এইসব কেয়ার করে না। এক সপ্তাহ পরে আমরা পাঁচ জনকে বিক্রি করে দেয় মদিনায় যা রিয়াদ হতে হাজার মাইল দুরে। এক খাওয়ার হোটেলের পরিচ্ছন্ন কর্মী হিসাবে । বলে রাখা দরকার , নতুন অবস্থায় তিন মাসের ভিতর কাজ ফেলে মালিক পরিবর্তন করার সরকারি আইন আছে। সেই কাজের মালিক সরকারি ফিস এবং সমস্ত অফিসিয়াল আনুষ্ঠানিকা বজায় রেখে মালিক পরিবর্তন করে এবং ইকামা বানায় । যার ভিসায় আসা হয় তা পরিবর্তন হয়ে নতুন মালিকের অধিনে ইকামা হয় আর নতুন মালিক ক্ষেত্র বিশেষ সমস্ত খরচও বহন করে। এতে দালাল যে দেশে ইকামার টাকা বাড়তি নেয় সেটাও তার লাভ থাকে। এই জন্য লোক আসে জমা হয় এবং কাজ খুজতে থাকে।
মসজিদে নবীর নিকটে আমার হোটেল । বার ঘন্টা ডিউটি দুঃখ নাই , কাজ পেয়েছি । থাকা খাওয়া ফ্রী , এবার যা বেতন দেয়। সৌদি আরবের অর্থনৈতিক যে হাহাকার চলছে তাতে আমার স্বপ্ন মরুদ্বীপের সুর্য কিরণে ভেসে উঠা জলপ্রপাত । এই জল পান করতে গেলে অতিদুরে আবার সেই রকম জল দেখা যায়। তবুও মন্দের ভালো কাজ করতে পারি। মা বাপ এবং বউ বাচ্চার সাথে ফোন করে সান্তনা দিতে পারছি । সকাল সাতটা হতে কাজ শুরু হয় চলে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত । থালা -বাসন, পাতিল ধৌতকরণে দিন যায় আসে রাত। মাঝারি সাইজের পাতিল ধুয়ে ঝকঝক করতে হয় । কারণ এইসব পাতিলে ভাত রান্না করে । হোটেলটাও চব্বিশ ঘন্টা কাস্টোমারে ভরপুর থাকে। হোটেল মালিক ভালো লোক । মদিনা ছাড়াও মক্কা , তায়েব এবং আল কাছিম আরো হোটেল আছে । কখনো কখনো মালিক আসে শ্রমিকদের সাথে কৌশল বিনিময় করে। খাওয়া থাকায় কোন সমস্যা আছে কিনা জানতে চায়। এতে সবাই খুশি মনে কাজ করে। বিশ বাইশ দিন কাজে হয়ে যায়। পুরাতন বাঙ্গালী শ্রমিকদের কেউ কেউ সহযোগীতা করে কেউ কেউ নিজের কাজ করাতে চায়। ভাষা না জানার দুর্বলতার সুযোগে ফোর ম্যানের কাছে নালিশ করে।
একমাস পরেই আমাকে নিয়ে যায় আল কাছিম। আমার কোন আপত্তি ছিল না কারণ কাজ চাই ,টাকা চাই। এখানে আমাদের দেশের মত বাসি পচা খাবার নেই । প্রত্যেকটি কর্মী পোষাক আষাকে পরিপাটি । হাতের নখ ছোট থাকে মাথায় টুপি পরতে হয় যেন চুল না পড়ে খাবারে। সরকারি কঠোর তদারকি নিত্য দিনের কাজ। মাছি তেলাপোকা দেখিনি কখনো। সাদা ধবধবে টাইলস সাবানের পানি দিয়ে জীবাণু মুক্ত করতে হয় সবসময়। আমি খুশি মনে নেচে গেয়ে কাজ করি মন প্রাণ উজাড় করে। মালিক এসে মাঝে মাঝে বলে আবুল কালাম মিয়া মিয়া ( একশতে একশত) । আমি মাথা নেড়ে বলি কোয়েছ (ভালো)।এইভাবে চলতে চলতে একদিন দুপুরে মালিক এসে বলে আবুল কালাম মুশকিল । আমি বুঝলাম কোন সমস্যা হয়েছে। একজন ভাষা জানা লোক জিজ্ঞাসা করলো কি সমস্যা হয়ছে। মালিক বললো আমি সরকারি অফিস গিয়েছি আবুল কালামকে রিলিজ করে ইকামা করার জন্য পরামর্শ করতে । তখন জানতে পারি তার কপিল (মালিক) তাকে হুরুপ (প্রাথমিক এক্সজিট ) দিয়ে রাখছে । এখন তাকে রিলিজ করা এবং তার ইকামা করা যাবে না । তাকে দেশে ফেরত যেতে হবে। সে এখন সৌদিতে অবৈধ । তাকে সৌদি থাকা কঠিন হবে। যে তাকে ভিসা দিয়েছে সে হয়তো আবুল কালামের কপিলের সাথে কোন যোগাযোগই করেনি। ইকামা করতে না পারলে , রিলিজ করতে না পারলে তাকে কাজে রাখা সম্ভব না । অবৈধ লোক রাখলে হোটেলের সমস্যা হবে। দোভাষি বাঙ্গালী আমাকে সব বুঝিয়ে বলার পর আমি হাউমাউ করতে থাকি। ফোন করি মোস্তাক মিয়ার ছেলেকে । নাম্বার বন্ধ পাই , অর্থাৎ পুরাতন নাম্বার ফেলে দিয়েছে। সেই দিনই সুস্থ স্বাভাবিক আবুল কালামের মরণ হয়। তারপরই জিন্দা লাশ আবুল কালাম দেহ নিয়ে ছুটে কাজ পেতে।
হোটেল মালিক আমার অসহায়ত্বের কথা শুনে তার বন্ধুর খামারে পাঠায় কাজে। সুনশান নিরব মরুভূমিতে ভেড়া পালকের রাখাল হিসাবে।(চলবে)।
করোনায় একজন প্রবাসী ।
২য় পর্ব।
জনমানবশূন্য মরুপান্তর । আমি আর আমার সাথে ভেড়ার পাল। যেন আমি শিক্ষক ওরা আমার ছাত্র। মোটা তারের বেড়া দিয়ে আবদ্ধ ভেড়ার সাথে ছাগলও আছে কয়েকটা । পাশে তাবু আমার থাকার ঘর। প্রচন্ড গরমে মনে হয় সূর্যটা দৃষ্টি সীমানার পান্ত শেষে। পানির তৃষ্ণায় শুকনো গলায় কথার বাহির হচ্ছে না। গাড়ি হতে নেমে কাপড়ের ব্যাগ রাখলাম তাবুতে। বালুর ভিতর একটা কার্পেট বিছানো । সৌদি আমাকে বসতে বললো । আমি অবনত মাথায় নিরীহ নির্বাক । সাত চল্লিশ ডিগ্রী তাপমাত্রায় দপ করে মুখটা জ্বলে উঠলো। হৃদয়ে ভেসে উঠলো তিন বছরের মেয়েটার কথা । টাকা নেই তার জন্য যে দুধ কিনবে। মায়ের শ্বাসকষ্টের ঔষধ ফুরিয়ে আসছে। এনজিও আঁশা এবং চাচা আছে পিছনে পিছনে তবে কমুদ বাবু মেনে গিয়েছে । বলেছে তোর সুবিধা মত টাকা দিস তবে তাড়াতাড়ি দিলে সুদ কম হবে। তাবুতে আমার দিন রাত মাঝখানে ভেড়ার খেদমত। ইস! এই টাকায় প্রবাসীদের বউ চোখে কালো চমশা পরে টাউনে গিয়ে দোকানে দোকানে সৌন্দর্য বিলি করে। ভাইটা পড়ার নাম করে টাকা নিয়ে নিজের এ্যাকাউন্টে জমা করছে । ক্ষমতাশালী রাজনীতি করে চাঁদা নিয়ে মাদক ও নারীতে মগ্ন থাকে । ছোট বোন রাত জেগে ন্যাটে ছবি দেখে । মা বাপ কখনো কখনো চোখের নেত্র বিসর্জন দেয়। ছোট ছোট শিশু সন্তান বলে বাবা কখন আসবে বাড়িতে। তারের বেড়ায় লোহার উপর হাত রাখতে চ্যাত করে উঠে। ফোসকা পড়ে যায় হাতের তালুতে। য়ে দিকে তাকাই স্বচ্ছ আকাশ আর আকাশ । এই দেশে শীতকালে বৃষ্টি হয় আর গরম কালে রৌদে আগুন ধরে।
স্বর্গে ডানে বামে সামনে পিছনে সুন্দরী হুর থাকবে খেদমতে। না চাইলেও থাকবে তারা । আর এখন আমি শিশুর দুধ কিনতে পারছি না । কি আজব রহস্য মরণের পর হুরের গন্ধে আমি হবো মাতোয়ারা আর এখন এক অযোগ্য বাবা । যাকে তুমি আরব দেশের রাখল বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছো। সাদা , হলুদ গোলাপী রংয়ের হুরের সাথে সুরা হাতে এরাবিক নৃত্য হবে , মাঝে জয় জয় বলে চিৎকার করবো । নেশাগ্রস্ত হয়ে লুটিয়ে পড়লে হুর আমাকে চুমা দিয়ে শিহরিত করবে আর এখন আমি মায়ের হাঁপানির ঔষধ কিনতে না পারা অযোগ্য সন্তান। তুমি কি জানো ঈশ্বর আমার মা আমার কাছে স্বর্গ । যে চাঁদ আলো দিয়ে অন্ধকার পৃথিবী জ্যোৎস্নাময় করে সেই চাঁদ হতেও আমার মা বেশি জ্যোৎস্নাময়। আজ তাঁর হতে অনেক দুরে ধুধুবালু পান্তরে সৌদি আরবের গভীর জঙ্গলে মেষপালক আমি। মায়ের সন্তান প্রসব করার সময় যে ব্যথা হয় তার সামন্য পরিমাণও যদি পুরুষদের দেওয়া হয় তাহলে মেরুদণ্ডের বাইশটা হাড় ভেঙ্গে চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে যাবে। তুমি সেই মা‘য়ের ঔষধ ও দুধ কিনতে আমাকে অপরাগ কেন করে রাখবে হে অধিপতি । আমার দেশে শত শত লোক হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে ব্যাংকে জমা করছে। তাদের সন্তানেরা বিদেশে উন্নত জীবনযাপন করছে । আর আমার সন্তান দুধ ভাতও পায় না । আমজনতার হোক মেরে খাওয়া লোক কত আরাম আয়াস করে আর তুমি আমাকে শাস্তি দিতে ব্যস্ত । দেশের শাসকও বৈষম্য তৈরি করে শিক্ষা চিকিৎসা ও আইনে আমাদের সেবা দেয় তুমিও তাই করছো।
সৌদিয়ান একজন ভারতীয় বাঙ্গালী সাথে করে নিয়ে ফেরত আসে। গায়ে সাদা লম্বা জামা তবে গামছা দিয়ে মুখ বাঁধা যাতে রোদ না লাগে। উনি এসেই বাংলা বলায় আমার আর কথা বলতে বেগ পেতে হলো না। কথা বলে বুঝা গেল কাজের পারদর্শী সে। কেমন আছো বাপু। আমি ফকির শাহ। পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদ বাড়ি। অনেক দিন আছি এখানে , সৌদি লোকটা ভালো । তুমি মন লাগিয়ে কাজ করো আস্তে আস্তে সব ভালো লাগবে। আর এখানে নিরাপদ থাকবা। আমি নিরব হয়ে তার কথা শুনি । সৌদিয়ান পঞ্চাশ রিয়েল আমাকে দিয়ে চলে যায়। পাশে রেস্ট হাউজে কাজ করে ফকির শাহ। আমি তার পিছে পিছে চলি। দরকারের চেয়ে একটু বেশী বলে ফকির শাহ । প্রাচীর ঘেরা রেস্ট হাউজ যেন রাজ প্রাসাদ। নানা জাতের ছোট বড় অসংখ্য খেজুর গাছ। পানির কৃত্রিম লেক , কুপ এবং ঝর্ণায় সজ্জিত । গেইট রাস্তায় কিংবা ঘর সব নিরাপত্তায় ঢাকা । সিসি ক্যামরা ও নিরাপত্তা ঘন্টা দেওয়া আছে। তাবুতে চা গাওয়া (কফি) খায় । এবং মেহমান আসলে বসে। লিপটন , কুব্বুস, শ্রীলষ্কান চায়ের পাশে ফ্রাসী ,তুর্কী আমেরিকান এবং মালাই , কোন কফি নাই তাদের । সবই আছে সাজানো আর বানানোর কারিগর ফকির শাহ।
ফকির শাহ কাজ করে রেস্ট হাউজে । তার জন্য আলাদা থাকার ঘর আছে । সেই ঘরে যাবতীয় সরঞ্জাম আছে। ভেড়া দেখার লোক ছুটিতে তাই সে ভেড়ার পালকে খাবার পানি দেয়। আমি তার কথা শুনি আর মাথা ডান বাম করি । ফ্রীজ হতে মোরগ বাহির করতে করতে বলে আজ মোরগটা ভালো করে রান্না দিতে হবে গো। আমি তার কোন কথায় মন দিতেছি না । আমার নাকে ঘুরে ভেড়ার বিচ্ছিরি গন্ধ। সকাল বিকাল খাবার দেওয়া । পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করতে হবে । রোগ জীবাণু হলে সেবা করতে হবে । সবচেয়ে বড় কথা হলো ভেড়া হতে দুধ বাহির করতে হয়। এরাবিয়ানদের কাছে উট , ভেড়া এবং ছাগলের দুধ খুবই প্রিয়। এমনকি দুধ হতে মাখন বানিয়ে বিক্রিও করে । এমন অনেক এরাবিয়ান আছে যাদের কাছে শত শত ভেড়া কিংবা উট আছে। এইটা এদের কৃষি কাজ । সরকার এই কৃষিকাজে উচ্চ হারে ভুতুর্কি দেয়। গম এবং কাঁচা ঘাস উট ও ভেড়ার খাদ্য। সীমানা হীন মরুভূমিতে বাঙ্গালীরাই কৃষি কাজে জড়িত। বার্থরুমে ঢুকে পানির ঝর্ণা ছেড়ে দিই মাথার উপর । দশ মিনিটের গন্ধ সহ্য হচ্ছে না অথচ মানুষ শত দিন হাজার দিন এই কাজে নিয়োজিত । অার আমি! আমার কান্নার জল ঝর্ণার জলে মিশে হারিয়ে যায়। কাজ করতেই হবে , কাজ পারতেই হবে। ভয় পেলে পুরুষ কিসের। (চলবে)।
করোনায় একজন প্রবাসী ।
৩য় পর্ব।
আমার এলাকার এক হাই স্কুলের শিক্ষক সৌদিতে এসে ভেড়া পালনের কাজে পড়ে ভিসা দালালের মিথ্যার কারণে। সৌদিতে গিয়ে কাজের কথা শুনে উনি হতবাক । পরে অনেক দেন দরবার করে উনার সাবেক ছাত্ররা টাকা দিয়ে টিকেট কেটে দেশে ফেরত পাঠায়। উনার সৌদি মালিক কিছুতেই উনাকে রিলিজ দিতে কিংবা দেশে যেতে দিতে রাজি না । সৌদিয়ান বলে আমি ভিসা দিতে কোন টাকা পয়সা দাবি করি নাই । কারণ যে আসবে সে কষ্ট করবে তাই ভিসা বিনা পয়সায় দিয়েছি যাতে একজন মিসকিন কৃষক আসতে পারে। শিক্ষক কেন এই ভিসায় সৌদিতে আসলো। এইটা শিক্ষকের ভুল , আমার না। তাকে বুঝানো গেল না ভিসার দালাল মিথ্যা বলেছে। সৌদিয়ান বলে তোরা সবাই বাঙ্গালী মিথ্যাবাদী । যেহেতু আমার ভিসা নষ্ট হয়েছে এবং কাজের জন্য লোকও নাই তাই এখন এই কাজ করতেই হবে। ঊনি এর বাসায় ওর বাসায় পালিয়ে থেকেছেন কিছু দিন পরে এক পূলিশ অফিসারের সহযোগিতায় দেশে আসেন । এখনো উনি হাই স্কুলের শিক্ষকায় নিয়োজিত। আসলে গরিবের জন্য শিক্ষাটাই অত্যন্ত উপকারী সম্পদ। যে কোন সময় এইটা বিক্রি করে আপনি খেয়ে পরে চলতে পারবেন। হয় আপনার কাছে অগাধ টাকা পয়সা থাকতে হবে না হয় যথেষ্ট শিক্ষা থাকতে হবে। আপনি অশিক্ষিত দীনহীন সময় পার করেছেন । তবুও মা বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই। তাদের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দোয়া কামনা করেন । কিন্তু বর্তমানের সন্তান বলবে কেমন মা বাবা যারা আমাকে পড়াশোনাও করতে দেয়নি সম্পদও রেখে যায়নি। তাদের ভুলের কারণে আজ আমি অশিক্ষিত , তাই আমি খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে কষ্ট পাচ্ছি । এই জন্য সন্তানকে আধুনিক বিজ্ঞান সম্মত কর্মময় শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চেষ্টা করুণ। যাতে সন্তান শিক্ষার সুফল পায় ।
ভাই তোমার নাম জানা হলো না। আমি আর তুমি এক ভাষার মানুষ। মন খুলে চলবা আমার সাথে। আমি আবুল কালাম । বাংলাদেশে কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি আমার বাড়ি।
এই লও বিড়ি খাও। পাতার বিড়ি এইটা । এত দিন একজন কথার বলার লোকও ছিল না । এখন তুমি আসায় ভালো লাগছে। চলো , ঘরের ভিতর দেখো। আমার মালিক লোক ভালো টাকা পয়সা ঝামেলা করে না । বৃহস্পতিবার বিকালে আসে পুরা পরিবার আবার শনিবার রাতে চলে যায়। এই দুই দিন আমার কাজ বেশী থাকে । দম ফেলতে পারি না । সে সরকারি বড় অফিসার তাই বিভিন্ন লোক আসে । খাওয়া - দাওয়া হয় প্রচুর । অনেকে আমাকে বকশিস দেয়।
আমি মন দিয়ে ফকির শাহর কথা শুনি । বাড়ির ভিতর সব কিছু এত দামি দামি যে চোখ ধাঁধানো। মনে হয় যেন রাজার মহল এইটা । দালানে রংয়ের কারুকর্ম , বাহারি বাতি , দামী ফার্নিচার । এইটাইতো স্বর্গ গরিবের জন্য ।
দুইটা মেয়ে বিয়ের বয়স পার হয়েছে । এখনো বিয়ে দিতেছে না ছোট একটা পোলা আছে সেই বিরক্ত করে। ছেলেমেয়েদের পিছনে বেতনের অর্ধেক টাকা পনর দিনে শেষ করে। দামি দামি পোষাক কসমেটিক্স কিনে । এরপরও বিউটি পার্লারে যায় দুইবোন। বড় লোকের মেয়ে বড় লোকের কাছে বিয়ে দিবে । মোহরানাও অনেক বেশী দাবি করে । এমনিতে বিয়ে করতে হলে একজন লোকের বাড়ি গাড়ি সংসার খরচ যাবতীয় পরিপূর্ণ থাকতে হয়। এই মেয়েদের বিয়ের কথা হলে তাদের বাবা এক লাখ রিয়েল মোহরানা দাবি করে । আমাদের দেশে মোহরানার কথা, বিয়ের পরে আর কারো খবরই থাকে না । এইখানে কলমা পড়ার আগেই তার লেনদেন শেষ হয়। যাদের টাকা পয়সা বেশী থাকে বহু বিবাহ করে। এইটা ইসলামের সুন্নত । অথচ নামাজে অনেকে সুন্নত পড়েই না। আর বহু বিবাহ করে সুন্নত পালন করে। সবচেয়ে আচার্য্য কথা বৃদ্ধ বয়সেও যুবতী মেয়ে বিয়ে করে বাচ্চার বাপ হয়। ঘরের ভিতর নারীর নূন্যতম মর্যাদা নেই । তবে বাহিরে কেউ চোখ তুলেও তাকাতে পারে না । একসাথে কয়েকটা মেয়ে কালো বোরখা পরে চললে মনে হয় পেঙ্গুনের দেশ।
অথচ এই এরাবিয়ানই গরিব দেশ হতে গৃহকর্মী নিয়ে আসে বেশীর ভাগ যৌন কাজের জন্য। ফিলিপাইন , শ্রীলংষ্কা, ইন্দোনেশিয়া এবং বাংলাদেশ হতে আসে এইসব গৃহকর্মী। ফিলিপানের বিধর্মী মেয়েরা আসার সময় সেই রকম প্রস্তুতি নিয়েই আসে। আবার সৌদিয়ান প্রচুর ফিলিপাইন ভ্রমনেও যায়। এইসব গৃহকর্মীদের বরাতে বিয়েও করে । থালা বাসন ধোঁয়া হতে ঘরের সমস্ত কাজ করতে হয়। ঘর পরিষ্কার , কাপড় পরিষ্কার , শিশুদের দেখাশোনা এবং ঘরের পাশে গ্রোসারি দোকানে যেতে হয় খরিদদার হয়ে। খুব কম সময় মিলে ঘুমানোর জন্য । ঘুমানোর জায়গা হয় রান্না ঘর কিংবা স্যাঁতসেঁতে অস্বাস্থ্যকর ঘরের কোণা । এর ফাঁকে ঘরের যুবকের যৌন লালসায় পড়তে হয়। বাপ বেড়া উভয়ের কুনজর থাকে গৃহকর্মীর উপর। প্রাপ্তবয়স্ক বয়স্ক পুরুষ মানে কাদ্দমা (গৃহকর্মী) ভোগ । আর এর পরিমাণ হয়তো শতকরা আশি জনের ঘরে। প্রতিবাদ করলে নির্যাতন নেমে আসে বর্বরোচিতভাবে । যেমন আমাদের দেশে বড়লোকের বউরা করে ছোট গৃহকর্মীদের উপর। খবুই কম সৌদি পরিবার আছে গৃহকর্মীদের যৌনসংগমে বিরত থাকে।এবং হাদিস কোরানে প্রভাবিত হয়। তবে ঘরের বাহিরে এদের চলাফেরা দেখলে মনে হবে না এরা এমন বর্বর। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ শতকরা ৯৮জন লোকই পড়ে। এবং সুযোগ পেলে কোরান তেলায়াতও করে। চীনের নকল পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার এই সৌদি । আবার এরা হালাল হারাম খাবার খুজে চীনে গিয়ে। আজব কথা হলো এইসব গৃহকর্মীদের কোন আজনবী ( সৌদিয়ান নয়) এর সাথে কথা বলতে দেখলে তারা খুব রাগ করে । বলে এইটা হারাম , ইসলাম অবমাননা । প্রেম ভালোবাসায় জড়ালে পড়তে হয় ইসলামি আইনের ম্যারপ্যাচে । হয় জেল জুলুম এবং অবশেষে নিজ দেশে ফেরত।
হাসপাতালের আয়া কিংবা নার্সের কাজে যারা আছে তারা ভালো আছে। নার্সের জায়গা ফিলিপাইনের দখলে আর আয়ার দখলে বাংলাদেশ। রাস্তা ঝাড়ু , অফিস আদালত ঝাড়ু , বিমান বন্দর ঝাড়ু কিংবা বার্থরুম ঝাড়ু সব বাংলাদেশের পরিচ্ছন্ন কর্মীর দখলে। অথচ বাংলাদেশের রাজনীতিক নেতারা কথায় কথায় বলে দেশ অনেক উন্নত যে কানাডার মত। এইসব ঝাড়ুদারের রেমিটান্স পাঠানো টাকায় রাজনৈতিক নেতারা নিজ পরিবার কানাডায় রাখে বলে তারা স্বপ্নিল থাকে। হাসপাতালের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা ভালোবাসার মধু পান করতে গিয়ে করে অনৈতিক কাজ। এবং কখনো কখনো সীমাহীন প্রতারিত হয় মেয়েটা । যেমন এখন বাচ্চাসহ এক বছর ধরে জেলবাসী নোয়াখালীর জেসমিন। তার সহকর্মী কুমিল্লার ছেলের সাথে প্রেম তারপর বিয়ে । (চলবে)।
করোনায় একজন প্রবাসী।
৪র্থ পর্ব।
জেসমিন রিয়াদ হতে আটশ কিলোমিটার দুরে গ্রাম এলাকায় এক হাসপাতালের আয়া। বাপ মরা মেয়েটা সৌদি আসে মা এবং অন্যান্যদের সুখের আশায়। ভালোই দিন যেতে লাগল । ওই যে বলে না “ সুখে থাকলে ভূতে কিলায় ” জেসমিনের বেলায়ও তাই হলো। পরিচয় গাঢ় হলো তারই কলিগ কুমিল্লা নিবাসী এক ছেলের সাথে । তারপর আর কি - প্রেম ফিরিত অবশেষে বিয়ে। মৌলভীর মুখে মুখে কলমা পড়ে কবুল বললেই শুধু বিয়ে হয়না । বিয়ে প্রমাণের জন্য লিখিত কাগজপত্র লাগে। বিয়ে নামক খেলা খেলতে গিয়ে একত্রে বসবাস শুরু করে জেসমিনেরা। এমনি এক পর্যায় জেসমিনকে অবৈধ সেক্স করার দায় পুলিশ হাসপাতাল হতে গ্রেফতার করে। হয়তো কেউ তাদের তথ্য পুলিশকে দিয়েছে ! এখানে আবার বাংলাদেশীদের রাজনীতি ও রেষারেষির শেষ নাই। জেসমিন ধরা পড়ার পর পরই গা ঢাকা দেয় জেসমিনের স্বামী । স্বামীর বড় ভাই পরিচয় দিত না ভয়ে। তবে নিরক্ষর জেসমিন কাবিন ছাড়া বিয়ে হয় না , ছেলেটা যে তাকে প্রতারিত করেছে চৌদ্দ মাস জেলে থেকে তারপর বুঝতে পারে। জেসমিন যখন ধরা পড়ে তখন সে গর্ভবতী । জেলে গিয়ে ফুটফুটে একটা ছেলের মা হয়। এইসব মামলায় বাংলাদেশ দূতাবাস চোখে টিনের চশমা পরে কানে তালা মারে। আইনী লড়াইয়ে হারতে থাকে কাগজপত্রহীন বিয়ে করায়। এক পর্যায় দেশ হতে কাবিন করে নিয়ে দেখিয়ে অবৈধ সেক্স করার অপবাদ হতে পার পায়। এই পর্যন্ত লড়তে সাহায্য করে সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশী সাংবাদিক ও কমিনিটি। কিন্তু তারপরও তার মুক্তি মিলে না কারণ কোম্পানি তাকে স্বিকার করে না । এমনকি পাসপোর্টও হারিয়ে ফেলে । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক প্রচার হওয়ার পর দূতাবাস খোজ নিতে যায় জেসমিনের। এবং পাসপোর্ট করার আনুষঙ্গিক তথ্য সংগ্রহ করে । এই করোনা সব উলটপালট করে দেয়। জেসমিন দুধের বাচ্চা নিয়ে জেলে মানবেতর জীবন পার করছে।
গুটি কিছু বাংলাদেশী লোক মাঝে মাঝে নারীঘটিত ঝামেলায় জড়িয়েছে। যাহা হিসাবেও পড়ে না। নারী নিয়ে লোভ তেমন নেই বললে চলে। কিন্তু এর বিপরীত দেশে, তাহলে কি সব ভালো লোক সৌদিতে যায়। তা না , বরঞ্চ বেকার মামলা মোকদ্দমার আসামি বিদেশে পাড়ি দেয়। সেখানের আইনের কঠোর প্রয়োগ দেখে ভয়ে নারী নিয়ে উৎসাহ দেখায় না। আর বাংলাদেশ হতে গৃহকর্মী গিয়ে নিজের ইজ্জত আব্রু তুলে দিচ্ছে বর্বর হায়নাদের হাতে। ঢাকায় গৃহকর্মীর ভিসার দালাল আছে । এই দালালেরা মহিলা ভিসার নাম দিয়েছে গাই (গাভী) ভিসা। সৌদির অনেক গৃহকর্মী সরবরাহ অফিস আছে তারা গ্রুপ ভিসা ঢাকায় পাঠায়। আর ঢাকার রিকুয়েটিং অফিস গাই খোজে লিপ্ত হয় । আর এই গাই সেখানে গিয়ে দুধ দিতে না পারলে জীবন নিয়ে ফিরতে কষ্ট হয় । আর এইসব গাই খেতে পারে না । ভয়ে বাহিরে যেতে পারে না । আইনের আশ্রয় নিতে পারে না।
বড় একটা হল রুম যেটাকে সৌদি ভাষায় দেওয়ানিয়া বলে। রাজ প্রাসাদের সব চেয়ে চমক এই হল রুম। দেয়ালে অপরূপ কারুকর্ম । বাদশা আজিজের ছবি এবং তার সাথে বর্তমান রাজার ছবিও দেয়ালে লাগনো। মেঝে বিছানো তুর্কীস্থানের সবচেয়ে দামি কার্পেট । এক কোণায় ডিস লাইনের রিসিভার বসানো। মাঝখানে ছোট ট্রি টেবিলে ফ্রাসের ছোট ছোট চায়ের পাত্র সাজানো । তবে কোন চেয়ার টেবিল নাই , সবাই চারিদিকে নিচে বসেই আলাপ করে। এখানে যারা আসে সরকারি বড় বড় অফিসার, আসে বড় বড় পয়সাওলা লোক। নারীদের জন্য আলাদা দেওয়ানিয়া (হল রুম ) আছে। গাড়ি হতে নেমে আলাদা দরজা দিয়ে মহিলা রুমে চলে যায় । সৌদিতে প্রত্যেক বাড়ি হোটেল , মোটেল এবং রেস্ট হাউজ সব জায়গায় মহিলার জন্য সংরক্ষিত দরজা আছে। সদর দরজার সাথে রুমের দরজা সংযোগ যাতে পুরুষ না দেখে । মহিলাদের পর্দা রক্ষায় এই নিয়ম মেনে চলতে হয়। প্রাপ্তবয়স্ক প্রতিটি নারী ঘরের বাহিরে বোরখা পরা বাধ্যতামূলক । তবে এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে । নারীরা গাড়ি চালাতে পারে , গ্যালারিতে বসে ফুটবল খেলা দেখে , গ্যাল্যারিতে বসে ছবি দেখে । বাদশা সুলতান বিন আবদুল আজিজ ব্যাপকভাবে আধুনিকীকরণ করেছে সমাজ এবং অর্থনীতিকে। এই সৌদি প্রাচীন কাল হতে কঠোর ধর্মীয় বিধিনিষেধ মেনে চলা একটা দেশ। এখানে এখন ললনা স্বল্প বসনে সমুদ্র স্নান করে । বাহিরের লোক মহিলা পুরুষ বন্ধু হলেও হোটেলে রাত যাপন করতে নিষেদ নেই । যা আগে অবৈধ যৌনমিলন বলে ইসলামি শরিয়া মোতাবেক কঠোর অপরাধ ছিল।
বেশীর ভাগ পরিবারে গৃহকর্মী এবং পারিবারিক ড্রাইভার থাকে । এই ড্রাইভারদেরও অনেক অসহনীয় কষ্ট এবং অপমান সহ্য করে কাজ করতে হয়। ড্রাইভারের নিদিষ্ট কোন সময় থাকে না কাজের । রাতে এবং দিনে যখনি প্রয়োজন তখনি তাদের কাজের ডাক পড়ে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই ড্রাইভারের সাথে গৃহকর্মীর কিংবা সৌদি মেয়েদের সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠে । যা প্রকাশ হয় খুবই খুবই কম। আর প্রকাশ হলে রেহাই নাই। শুনেছি সৌদি মেয়েদের সাথে সম্পর্ক নিয়ে সন্দেহ করে ড্রাইভারকে দেশে ফেরত পাঠাতে। এই জন্য পারিবারিক ড্রাইভারের বয়স চল্লিশ বছর হতে হয় , বিবাহিত হতে হয়। এবং মহিলাদের কাপড় সেলাই করা ট্রেইলারদের বয়সও চল্লিশ বছর বয়স হতে হয়। এইসব ট্রেইলার দোকানে সবকিছু সংরক্ষিত হয় । মহিলা দোকানে গেলে নিজেকে নিরাপদ দূরত্ব রেখে ট্রেইলারের সাথে কথা বলতে হয়। জনবহুল এলাকায় এইসব মহিলা ট্রেইলারিং দোকান কম হয় । তবে এখন মহিলারা প্রচণ্ড পর্দা থেকে চাকরী , ব্যবসা বাণিজ্য , দোকান পাট সবই করতেছে। তবে আমাদের দেশের মত নারী আন্দোলন , নারী নির্যাতন , ধর্ষণ হত্যা কোন কিছুই নেই। আছে অগণিত তালাক । আর সৌদিয়ান ঘরের নারীকে অত্যন্ত মূল্যহীন মনে করে । পুরুষদের ইচ্ছাই সব কিছু। এরা ছোট বড় সবাইকে নাম ধরে ডাকে। তবে সন্তান থাকলে বড় ছেলের নাম ধরে বলে অমুকের বাপ। মেয়ে বড় হলেও মেয়ের নাম বলে না । যেমন এই সৌদিয়ানের দুই মেয়ে বড়, ছেলে ছোট তবুও লোকজন উনাকে আবু আবদুল্লা (আবদুল্লার বাবা) বলে । (চলবে)।
করোনায় একজন প্রবাসী ।
৫ম পর্ব।
কালেমা লিখা , তলোয়ার এবং খেজুর গাছ খচিত পতাকা দেয়ালে সাঁটানো । সবাই ভক্তি শ্রদ্ধা করে পতাকাকে এইটাই নিয়ম । কিন্তু এদের মত এমন করে ঘরে সাঁটানো রাখে না। সরকার যা বলে তা সৌদি জনগণ শুনে । কারণ জনগণের চাহিদা সরকার মিটিয়ে থাকে। আগে রাজা মারা গেলে রাজার বয়সে ছোট ভাই রাজা হয়ে ক্ষমতাপ্রদান হতেন । এখন রাজতন্ত্রের এইদেশে রাজা মরলে উনার ছেলেই রাজা হবে । আমাদের দেশের রাজনীতির হাওয়া লেগেছে কিছুটা । বুঝে নিবেন , বেশী বলা যাবে না । বিখ্যাত সাংবাদিক জামাল খাশোগী বেশী বলতে গিয়ে লাশও পায়নি ।পালিয়ে থাকা খাশোগীকে তুরস্কে হত্যা করে লাশ পর্যন্ত পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে । এমন কি নিজের পরিবারের অনেক জনকে জেল জুলুম দিয়ে এবং দুই/একজনকে মেরে সিংহাসনে বসার পথ পরিস্কার এখন রাজার বড় ছেলের । তবে জনগণের এইসব নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই। সিংহাসনে কে বসলো তা নিয়ে তাদের কোন কিছু আসে যায় না। দুর্নীতি দমনের নামে রাজার ছেলের প্রতিদ্বন্দ্বী নিজ পরিবাবার লোকজন কিংবা সন্দেহভাজন বড় বড় কর্মকর্তাকে জেল জুলুম দিয়ে প্রচণ্ড হেনস্থা করা হয়েছে। তবে বাদশাহ ফয়সাল , খালেদ কিংবা আবদুল্লাহর শাসন আমলে বাহিরের লোক সবদিকে ভালো ছিল। ইকামার ফিস কম ছিল , কাজের চাহিদা ছিল । তাদের আমলে শুধু ধর্মীয় কঠোর বিধান মেনে চলতে হয়েছে। সীমান্তবর্তী সব দেশের সাথে মোটামুটি সদ্ভাব ছিল । আর আজ ইয়েমেন ও সিরীয়া যুদ্ধে জড়িত সৌদি । মধ্যপাচ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো শিয়া এবং সুন্নি মতবাদ অথচ উভয় মুসলিম । আর মুসলিম হয়ে শিয়া সুন্নির প্রভাব বিস্তারে ব্যস্ত ইরান এবং সৌদি । হত্যা করছে লাখ লাখ নিরহ মানুষ কে। ইরান শিয়াদের দেশ আর সৌদি সুন্নি । ফিলিস্তিনে হাজারো মুসলিম হত্যা করছে ঈজরাল নামক সার্বভৌমত্বহীন একটা ইহুদী রাষ্ট্র । অথচ মুসলিমদের তীর্থস্থান চুপ । কাতারের সাথে চলছে অর্থনৈতিক অবরোধ। সৌদি আরব, আরব আমিরাত , বাহারাইন কুয়েত এবং মিশর মিলে কাতারকে করে এক ঘরে। আর তখন তুরস্ক এগিয়ে আসে কাতারের পাশে । নিত্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিস যেমন রান্না ঘর হতে বার্থরুম পর্যন্ত , এমনকি জীবন ধারণের যা প্রয়োজন তা সরবরাহ নিশ্চিত করে তুরস্ক। এই অপরিপক্ব রেষারেষিতে কাতার হল স্বাভলম্বী । দুর্ভিক্ষ অনাহার এবং বোমার আঘাতে রোজ রোজ সিরীয়া এবং ইয়েমেনে শিশু মহিলা পুরুষ অকাতরে মরতেছে । মুলত ইগো ক্ষমতার বলয় বিস্তারে আমেরিকার পদলেহনে এইসব পাপে লিপ্ত মক্কা মদিনার মালিক।
অথচ আমরা কাঁদি রোহিঙ্গা মুসলিম বলে। আমরা কাঁদি দিল্লী এবং কাশ্মীরের মানুষ মুসলিম বলে । আর আমাদের দেশের শাসকের চেয়ার পাকা পোক্ত হয় দিল্লীর অমুসলিমদের ইশারায়। ওরে বাবা ! কি আজব পলিট্রিক্স। মধ্যপাচ্যে ক্ষমতার পালা বদল হয় আমেরিকা ইচ্ছাতে। পৃথিবীর সবচেয়ে শৃঙ্খলাপূর্ণ রেশন ব্যবস্থা ছিল ইরাকে । সেটা আজ অতীত আমেরিকার চালে। পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিশালী টিভি চ্যানেল ইহুদীদের। সবচেয়ে বড় প্রসাধনী কোম্পানি ইহুদীদের । সবচেয়ে বড় পানীয় কোম্পানি ইহুদীদের। অথচ কুয়েত পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী টাকার মানধারী মুসলিম রাষ্ট্র । পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী তেল উত্তলোন হয় সৌদিতে । সৌদি আরব, বাহারাইন , আরব আমিরাত , ওমান , কুয়েত এবং কাতার ইচ্ছে করলে পুরা দুনিয়ায় নির্যাতিত মুসলিমদের পাশে দাঁড়াতে পারে। অথচ তারা নিজের পাশের দেশে যুদ্ধে লিপ্ত। এইসব দেশ একজোট হলে ফিলিস্তিন একের একের জায়গা হারাতে হতো না। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পেত মুসলিম জনগণ। আর এখন যাযাবর একটি জাতি গলা চেপে ধরেছে মুসলমানদের । এর পিছনে আছে এইসব রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ইন্ধন । একদিনে এই ঈসরাল দানবে পরিনত হয়নি । আজকে তারা শিক্ষা দীক্ষা ,জ্ঞান গরিমায় , বিজ্ঞান এবং আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত এক বিশাল মহীরুহ । পুরা দুনিয়ার ইহুদী ঈসরালকে টাকা পয়সা দিয়ে প্রথম হতে সাহায্য করেছে। স্কুল কলেজ গড়ে তুলেছে যাতে তারা শিক্ষিত হয়ে দেশ গঠনে মনোযোগ দেয়। ঈসরালের সেনাবাহিনীতে নারীরাও পৃথিবীর সেরা সৈনিক । রাস্তা ঘাট এবং আধুনিক স্থাপত্য ও গবেষণা দুনিয়ার মানুষকে অবাক করবে।ইয়েমেন এবং সিরীয়ায় যুদ্ধের কারণে শত শত শিশু দুধের অভাবে মরছে । অবরোধ চলছে ইয়েমেন সিরীয়া ইরান কাতারে এই সৌদি আরবের তত্বাবধানে। আমি আপনি কাশ্মীর কিংবা রোহিঙ্গা নিয়ে চোখের জল হাস্যকর তেমনি মুসলিমদের রক্তে স্নান করা সৌদি কালেমা খচিত পতাকা দেয়ালে সাঁটানোও হাস্যকর । ছোট ছোট শিশু শিয়া নয় , সুন্নি নয় , ইহুদী কিংবা মুসলিম নয়। কাশ্মীর রোহিঙ্গা ও ফিলিস্তিন তোমরা মানব সন্তান । প্রতিবাদ হোক লাল রক্তের সাগরে টেউ বন্ধে। প্রতিবাদ হোক গরিব মিসকিন ও ভূমিহীন মানব পাচারের । বিশ্ব হোক এক পাসপোর্টের । বিচার হোক যারা বাংলাদেশের পাসপোর্টকে কলুষিত করে মানহীন করছে।
ফকির শাহ দেওয়ানিয়া হতে বাহির হয় । দুপুর একটার উপরে বাজে আমি মনে করেছি ভাত খেতে যাবে ফকির শাহ। তা না গিয়ে পানির পাইপ হাতে নিয়ে দুর্বাঘাসে পানি দিচ্ছে। দেয়ালের পাশে একটা আঙ্গুর এবং একটা ডালিম গাছ আছে। রৌদে আঙ্গুর গাছের পাতা মরে গিয়েছে। কয়েকটা ডালিম আছে গাছে। ফকির শাহ গাছগুলিতে পানি দিয়ে দেয়। খেইমা (তাবু) যেতেই আমি বলি ভাই চলো খেতে যাই। ফকির শাহ স্মিত মুখ করে । এটাও আড্ডাখানা তবে বাড়তি হলো হুক্কা পানের জায়গা। বার-বি কিউ করার সরজ্ঞামও পড়ে আছে। এরা মাছ মাংস পুড়ে খায় । গভীর মরুভূমি হতে পাখি শিকার করে পুড়ে খায়। গরম কালে খুবই কম দিনে আড্ডা দেয় । রাতভর চলে পরিবার নিয়ে আড্ডাবাজি আর শুক্রবার আসলেতো রাস্তা ঘাট ,খাওয়ার হোটেল , এটিম বুথ থাকে জ্যামে পরিপূর্ণ । তবে করোনায় সব ওলোট পালট করেছে দিয়েছে। তিনশত জনের উপরে বাংলাদেশী মারা গিয়েছে। তের জুলাই পর্যন্ত করোনা রোগী সনাক্ত হয়েছে দুই লাখ তেত্রিশ হাজার তিনশত ঊনষাট জন । সর্বমোট মারা গিয়েছে দুই হাজার দুইশত বাইশ জন (বাহিরের লোকসহ)। আক্রান্তের দিক থেকে সৌদি আরব চৌদ্দ নম্বরে। এক নম্বরে আমেরিকা , একশ তিরাশি নম্বরে (সব শেষ) পাপুয়া নিউ গিনি ও ওয়েস্টিন সাহারা । প্রতি গরম কালে তিন মাস সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গ্রীষ্মকাল এর ছুটি থাকে । এর ফলে সৌদিয়ানদের বেড়ানো বেড়ে যেত। বেড়ে যেত ব্যবসা বাণিজ্য কমে যেত অফিস আদালতের কাজ। (চলবে)।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
পুষ্পিতা পাল ১৬/০৭/২০২০Heart touching
-
জানবক্স খান ০৭/০৭/২০২০চোখে জল এসে গেল। পবিত্র দেশ সৌদি আরব। প্রবাসী ভাইদের এমন দুঃখ কোনদিন জানতাম না। আরো লিখুন অপেক্ষায় রইলাম।
-
ন্যান্সি দেওয়ান ০৬/০৭/২০২০Bah
-
কুমারেশ সরদার ০৪/০৭/২০২০বাহ্
-
রেদোয়ান আহমেদ ০৪/০৭/২০২০বাস্তবিক!
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ০৩/০৭/২০২০বাস্তব ঘটনার মতো।