অকালগমন
অকালগমন
একপ্রকার বিদ্যুৎ গতিতেই ফাস্টফুডের ভ্যানের কাছের পৌঁছালো মাহিন।পৌঁছানোর আগেই অর্ডার করলো দু'টো চিকেন রোলের।
প্রায়শই সন্ধ্যায় মাহিনকে এখানে পাওয়া যায়।
মাহিন পেটুক বটে,কিন্তু বোঝার উপায় নেই যে সে পেটুক কিনা।কিছু হ্যাঙলা পাতলা মানুষকে দেখে পেটুক মনে না হলেও তাঁরা অবিশ্বাস্য রকমের পেটুক হয়ে থাকে,আর মোটা মানুষকে দেখে পেটুক মনে হলেও তাঁরা কিন্তু সাধারণত পেটুক হয় না।মাহিন মাঝারি গড়নের।ওজন বেশিও না কমও না।ওজন এবং শরীরের দিকে যথেষ্ট খেয়াল দেয় মাহিন।পেটুক হলেও ব্যায়াম করে নিজেকে যথেষ্ট ফিট রেখেছে মাহিন।
ফাস্টফুড ভ্যানের মালিক মুরগী-গরুর মাংসের টুকরো গুলো ফ্রাই করছে।তাঁর সহকারী মাহিনের অর্ডার শোনামাত্রই চিকেন রোল প্রস্তুত করতে লেগে গেলেন।দক্ষ হাতে দ্রুত বেগে পরোটায় ভাজা মুরগীর মাংসের টুকরো গুলো দিয়ে তার সাথে হালকা শশার সালাদ দিয়ে তার উপর এক টেবিল চামচ মেয়নিজের তৈরি সস দিয়ে ওটাকে রোল করে কাগজে মুড়ে দিলো।একইরূপে আরেকটা করছিলো তখন ফাস্টফুড ভ্যানের মালিকের কাছে একটা ছোট ছেলে এসে কী যেন বললো।মাহিন একপাশে আর তার বিপরীত পাশে মানে মাহিনের মুখোমুখি হলে ভ্যানের মালিক আর তাঁর পাশে ছোট ছেলেটা।আর মাহিনের পাশে সহকারী।চারপাশের ভীড় আর গাড়ির আওয়াজে কিচ্ছুই শুনলো না ছেলেটার কথা।কিন্তু অঙ্গভঙ্গিমা দেখে অনুরোধ ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না বলে মাহিন নিশ্চিত হলো।পরক্ষণেই সে একটা শব্দ শুনলো।ধমকের শব্দ।ফাস্টফুড ভ্যানের মালিক ছেলেটাকে ধমক দিয়েছে।
ছেলেটা আর বাক্যব্যয় না করে ওখান থেকে বাইশ-পঁচিশ হাত দূরে গিয়ে ফুটপাতে বসলো জনবহুল গাড়িতে কিলবিল করা ব্যস্ত রাস্তার দিকে।চোখ ছলছল করছে।বয়সটা একদমই কম।বড়জোড় বারো বছর হবে।কম হলে দশ।হয়তোবা দশই।অভাব অনটনের ছাপে হয়তো বয়সটা বেশি দেখাচ্ছে।এইটুকু বয়সেই তার চোখে হাজারো দুশ্চিন্তা দেখতে পাচ্ছে মাহিন।শরীরের রঙ যে একসময় ফুটফুটে ফর্সা ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই।অনাদরে অভাবে আর রোদের কড়া ছোবলে যেন চামড়ার উপর কালোত্বের একটা মেঘ বাস করতে শুরু করেছে বহুকাল ধরে।ছেলেটিকে বিভোর হয়ে দেখছিলো মাহিন।তার হুশ ফিরলো ফাস্টফুডের সহকারীর ডাকে।তাঁর রোল প্রস্তুত।
'আরো দুটো বানান',সহকারীর দিকে তাকিয়ে কথাটি বলে হালকা ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে মালিকের দিকে তাকালো মাহিন।মালিক মাহিনের দিকেই তাকিয়ে ছিল।চোখে হালকা বিস্ময়।যেন মাহিনের কথাটা শুনেছে সে।কিন্তু শোনার তো কথা নয় এত শব্দের মধ্যে।
মাহিন রোলটা দু'টি নিয়ে গেল বাচ্চাটার কাছে।এগিয়ে দিলো তার সামনে।সে কোনো এক গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিল সেই রাস্তাতে তাকিয়ে।তাঁর সামনে এগিয়ে দেয়া রোল দেখে রীতিমতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।মাহিন তাঁর চোখ আর হালকা হাঁ করা মুখ দেখে তাঁর হতভম্ব রূপটা আঁচ করতে পেরেছিলো।সে ছেলেটি ভাবনা পড়ার চেষ্টা করলো।হয়তো ভাবছে,সে যখন দোকানের মালিকের কাছে চাইলো সে দিলো না,কিন্তু কোত্থেকে এই ভাইয়াটা এসে আমাকে রোল দু'টি না চাইতেই দিয়ে দিলো!
'আরে নাও নাও,লজ্জা পাচ্ছো কেন?!'মাহিন মুচকি হাসি দিয়ে ছেলেটির উদ্দেশ্যে বললো।ছেলেটি তখনও স্বাভাবিক হতে পারেনি।মাহিন নিজেই ছেলেটির দু'হাতে রোল দু'টি ভরে দিলো।
মাহিন জিজ্ঞেস করলো,'কী নাম তোমার?'
ছেলেটি আস্তে মিনমিন করে বললো,'রোকন।'
মাহিন একটু বাঁ গালে হাসলো।এ যে তাঁরই দ্বিতীয় নামের ছেলে জেনে।
ওঁর মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,'তোমার বাবা কী করেন?'
ছেলেটি মিনমিন করে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,'মোর বাপ নাই।ছাইররা গ্যাছে।'
মাহিন তেমন একটা অবাক হলো না।তাঁর কাছে এটা বড্ড তুচ্ছ মনে হলো।কারণ তাঁর বাবা তো তাকে খুন করতে চেয়েছিলে মাতৃগর্ভেই।
তবুও সে সহানুভূতি দেখিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো,'বাসায় কে কে আছে?'
ছেলেটাকে এবার কিছুটা শান্ত দেখাচ্ছে।যেন উদ্বেগ অনেকটা কমেছে।মাহিনের নরম সুরের আদুরে কথায় সে কিছুটা স্বস্তির সাথেই কথা বলতে শুরু করলো।
'ঘরে মায় আছে।অসুখ।দুইডা বুইন আছে ছোডো।আমনে দুইডা মাংস রুডি দেছেন ভালোই হইছে।এউক্কা বুইনেরা,আরেউক্কা মায় খাইবে আনে।'
মাহিন একটু ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো,'কী হয়েছে তোমার মায়ের?আর ওঁদের সব দিয়ে দিলে তুমি কী খাবে?'
ছেলেটি বিরস মুখে বললো,'জানি না ভাই,কী জানি হইছে।খালি বমি করে।বমিতে জম্মের রক্ত বাইর হয়।'
মাহিন আন্দাজ করলো,বোধহয় ব্লাড ক্যান্সার।
'তুমি কী খাবে ওঁদের সব দিয়ে দিলে?'দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব না পাওয়ায় আবার জিজ্ঞেস করলো মাহিন।
সে একটি প্রাণবন্ত হাসি দিয়ে বললো,'আমার খাওন লাগবে না ভাই।মায় কইছে,ব্যাডা মাইন্সের কষ্ট নাই।'
মাহিন বিড়বিড় করে বলে উঠলো,'জানি না কেন,পৃথিবীর প্রায় সব নারীরাই এই এক ধারণা নিয়ে জন্মায়!
ছেলেটিই বললো,'ভাই আমি যাই।'
মাহিন বললো,'দাঁড়াও।'
মাহিন ওঁর কাছে আসার আগে আরো দু'টো রোল বানাতে বলে এসেছিলো।গিয়ে সে দু'টো এবং সাথে একটি কাগজের প্যাকেট নিয়ে এলো।সে দু'টো প্যাকেটে ভরে রোকনের হাত থেকে বাকি দুটো ভরে ওঁর হাতে দিয়ে বললো,'যাও,চারজনে চারটা খাবে।'
রোকন আবারও সেই প্রাণবন্ত হাসিটা দিলো।অভাবের অনাদরের চেহারাতে এতই সুন্দর একটা হাসি যেন অমাবস্যাতে কাস্তের মতো চাঁদের মতো ফুটে উঠেছিলো।
মাহিন রোকনের দুই কাঁধে দুই হাত দিয়ে ধরলো।অভাব অনটনের মধ্যে দিয়ে গেলেও শরীরটা পেশিবহুল।এত অল্প বয়সে এমন শক্ত পেশি গঠিত হওয়া সম্ভব না।অবশ্যই জেনেটিক।
মাহিন বললো,'শোনো রোকন।জানি না,কেন যেন মনে হচ্ছে তোমার জীবনে কষ্টের অধ্যায়ের বোধহয় আজই শেষ।আমি তোমার চোখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তুমি কেমন পরিশ্রমী।কীভাবে যেকোনো সিদ্ধান্তে অটল থাকো।তোমার মধ্যে অফুরন্ত আত্মবিশ্বাস আছে।কিন্তু এখনো তা তুমি চিনতে শিখোনি।তাই কিছুটা পিছিয়ে আছো সুখময় জীব্ব থেকে।আমি বলি তোমায়,শোনো।'
রোকন সম্পূর্ণ বাধ্য ছেলের মতো মাহিনের সব কথা শুনছে।যেন মাহিন বহুকালের পরিচিত বিজ্ঞ বন্ধুসুলভ শিক্ষক তাঁর।
মাহিন বলতে থাকলো,'যেকোনো কাজ,যেকোনো ধরণের কাজ তুমি করতে পারবে।মানে তুমি মন থেকেই বিশ্বাস করতে পারবে যে ঐ কাজটা করা তোমার দ্বারা সম্ভব।তা যতই জটিল হোক না কেন।তুমি পারবেই।নিজের উপর এই বিশ্বাস টুকুকে আত্মবিশ্বাস বলে।তোমার উপর আমারোপ বিশ্বাস আছে।আমি জানি তুমি অনেক বড় ভাল কিছু করবে।তবে,তোমার মধ্যে যে পরোপকারীর পোকাগুলো আছে তা থেকে বেশকিছু ছাটাই করতে হবে তোমাকে।সবাইকে বিশ্বাস করে সাহায্য করতে যেও না।সবাইকে বিশ্বাস কোরো না রোকন।তুমি জীবনে অনেক আচমকা বিপদের সম্মুখীন হবে।কিন্তু কখনোই বিপদের পরিনাম নিয়ে ভাববে না সেই সময়ে।ভাববে বিপদ কাটানো যায় কীভাবে।কীভাবে নিজেকে মুক্ত করা যায় সেই বিপদ থেকে।তোমার ক্ষুধার কষ্টের জীবন হয়তো শেষ হবে দ্রুতই।কিন্তু তার চেয়েও ভয়ংকর হবে জীবন সংগ্রাম।কিন্তু তুমি পারবে।অনায়াসেই তুমি জীবনে সফল হবে।মনে রেখো,বিশেষ কিছু পাওয়াটা বরাবরই সহজ হয়,কিন্তু তা আগলে রাখা বড্ড কঠিন।আজ আমার কথা গুলো অনেকটা দুর্বোধ্য হলেও,বছরখানেক বাদে খুব কাজে আসবে তোমার এই কথাগুলো।শেষ একটা কথাই বলবো,কখনো কারো মনে কষ্ট দিয়ো না।কাউকে কষ্ট দেয়ার চেয়ে নিজে কষ্ট পাওয়া হাজার গুণে ভাল।এটাকে আগন্তুক ভাইয়ের অনুরোধ কিংবা কঠোর নির্দেশও ভাবতে পারো।আসি তাহলে,হয়তো কখনো আবার দেখা হবে না।ভালো থেকো।'
বলেই মাহিন ঘুরে হাঁটতে শুরু করলো অমনি ফাস্টফুড ভ্যানের মালিক ডাক দিয়ে বললো,'ভাই টাকা তো দিলেন না।'
এত কথার মাঝে মাহিন ভুলেই গিয়েছিলো টাকার কথা।মানিব্যাগে চল্লিশটাকাই ছিল।তা বের করে দিয়ে দিলো মালিকের হাতে।
টাকাটা নিয়ে সে বললো,'ভাই?আপনে খাইবেন না?'
মাহিনের চোখে মুখে একপ্রকার বিশাল স্বস্তির ছাপ।যেন হাজার বছরের অদৃশ্য মানসিক বোঝা সরে গিয়েছে মাথা থেকে।মাহিন শান্ত স্বরে বললো,'টাকা নেই আর।'
অপরাধীর মতো মাথা আর কন্ঠ খানিকটা নামিয়ে ফাস্টফুড ভ্যানের মালিক বললো,'ভাই,আমারই ওরে দেওয়া উচিৎ আছিলো।দিই নাই।তাই এহন দুইডা আমি আপনেরে দিতাছি।নাইলে এই অপরাধের বোঝা আমি সইতে পারমু না সারা জন্মেও।'
মাহিন একটু হেসে বললো,'বোঝা সইতে হবে না।রেখে দিন ঐ দু'টো।হয়তো আমি আসবো না আর।তবে আমার নামে লেখা রইলো ঐ দুটো।দিয়ে দিবেন ওঁরই মতো কাউকে।ওঁকে দেয়ার দরকার নেই।ওঁর আর প্রয়োজন নেই আপনার সহানুভূতির।তবে,ওঁর মতো অনেকেই আসবে,কাউকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেবেন না কখনো।একদিন তাঁদেরই কারো দ্বারা আপনার জীবনে অঢেল সুখ আসবে যার কল্পনা আপনি কখনোই করবেন না।'
কথাগুলো বলে মাহিন আর একসেকেন্ডও সেখানে রইলো না।সোজা পথে রাস্তার দিকে চলে গেলো পিঁপড়ার মতো গাড়ির মিছিলের মধ্যে।হারিয়ে গেলো সে।ফাস্টফুডের মালিকটি সেদিকে তাকিয়ে ছিল মন্ত্রমুগ্ধের মতো।কিন্তু মাংসের পোড়া গন্ধে তার হুশ ফিরলো।
আরো একজন মাহিনের চলে যাওয়া দেখছিলো।রোকন।তার উজ্জ্বল চোখ আবারো ছলছল করছে।মাসকয়েকের না কাটা অযত্নের লম্বা চুলো গুলো উড়ে এসে বার বার তাঁর অশ্রুসিক্ত চোখ ঢেকে দিতে চাইছে,লুকাতে চাইছে পৃথিবীর কাছ থেকে।
রোকন মাহিনের কথার প্রতিটা শব্দ তাঁর মস্তিষ্কে কাঁঠালের আঠার মতো লাগিয়ে নিলো।
রোকন পিছনে ঘুরে চলে গেলো।সারাটা পথ সে অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিলো।ঘরে কিছু সামনেই এসে তাঁর অন্যমনস্কতা কাটলো।কিন্তু ততক্ষণে কিছুটা দেরী হয়ে গেছে।রাস্তা দিয়ে ধীর গতিতে যাচ্ছিলো এক প্রাইভেট কার।হঠাৎ রোকন তাঁর সামনে একটা চলন্ত গাড়ি আবিষ্কার করে প্রচন্ড রকমের ভয় পেয়ে গেলো এবং হাত থেকে প্যাকেটটি পড়ে গেলো।আর পড়লো একেবারে চাকা সোজাই।চালকও অন্য দিকে চেয়ে গাড়িটা চালাচ্ছিলো।কোনো বাড়ি খুঁজছিলো।হঠাৎ সামনে রোকনকে দেখে ব্রেক করতে করতে প্যাকেটটিকে পিষে দিয়ে গেলো গাড়িটি।প্যাকেটটি এখন চাকার নিচে।একেবারে ভর্তা হয়ে গিয়েছে।রোকন ততক্ষণে রাস্তার পাশে সরে গিয়েছিলো।রোকন আর নিজেকে সামলে রাখতো পারলো না।কেঁদেই ফেললো রাস্তায় বসে চাকার নিচে পড়ে থাকা প্যাকেটটির দিকে চেয়ে।
রাগে ফেটে পড়লো ড্রাইভার।বেড়িয়ে এসে রোকনকে ধমক দিতে যাবে এমনই সময় গাড়ির ভিতর থেকে একটা থমথমে গম্ভীর কণ্ঠ বলে উঠলো,'দীপ্ত!'
ড্রাইভার তৎক্ষনাৎ ঘুরে গিয়ে তড়িঘড়ি করে গাড়ির দরজা খুললো।আর গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন একজন স্যুট পরা লোক।রোকন দেখলো,লোকটা অনেক সুন্দর আর ফর্সা।চুলগুলো সিঁথি করে আঁচড়ানো।মুখে যা দাঁড়ি আছে তা বোধহয় না থাকলেও চলতো।অল্প কটা দাঁড়ি থুতনিতে।গুণলে বিশ-পঁচিশের বেশি বের হবে না।তাও রেখে দিয়েছেন লোকটি।এই আবছা আলোতেও সে লোকটির ডান ভ্রুর ঠিক মাঝখানে উপরে একটা ছোট তিল দেখতে পেলো।তাঁর ভ্রু খুবই ঘন।
লোকটি বেরিয়ে রোকনের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।তারপর ঘুরে রোকনের কাছে এলেন।রাস্তার যে পাশে রোকন আছে সেপাশে নয়ন আঁকনদের বাড়ির সীমানার দেয়াল।দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে কাঁদছিলো রোকন।কিন্তু লোকটিকে দেখে কান্না থেমে গেলো তাঁর।কিন্তু যখন লোকটি ঘুরে তাঁর দিকে আসছিলো তখন আবার তাঁর মাংস রুটির কথা মনে পড়লো।আবার চোখ থেকে গলগল করে পানি বের হতে লাগলো।লোকটি রোকনের পাশে বসে সেই চাকার নিচে পড়া প্যাকেটটির দিকে চাইলো।সেদিকে তাকিয়েই রোকনকে জিজ্ঞেস করলো,'কী ছিলো ওতে?'
রোকন কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,'মাংস রুডি।'
তারপর রোকনের উদ্দেশ্যে মোলায়েম স্বরে বললো,'বাসা কোথায় তোমার?'
রোকন বাঁ হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে আঙুল দিয়ে সামনের বাড়িটি দেখিয়ে দিলো।
লোকটি বাড়ির দিকে তাকালো।তারপর একটু করে কপাল কুঁচকে ওঁকে জিজ্ঞেস করলো,'তুমি কী নীলিমার ছেলে?'
রোকন একটু অবাক হয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।তারপর জিজ্ঞেস করলো,'আমনে মোর মায়রে চেনেন?'
এবার লোকটি একটু হেসে সেই স্যুট পরা অবস্থাতেই ময়লা রাস্তায় বসে পড়লেন।তারপর বললেন,'চিনি রে বাবা চিনি।চিনেও কেন যে অচেনা করে দিলাম।হয় তা না করলে তোর মায়ের এমন দূরাবস্থা হতো না।'
কিছুই বুঝলো না রোকন।নিরবতা ভেঙে সেই লোকটিই আবার বললেন,'ভালই হয়েছে তোমাকে পেয়েছি।নীলিমাকে ফেইস করার মতো সাহস আর সময় আমার নেই।'
লোকটি উঠে গিয়ে গাড়ির ভেতর থেকে একটি ল্যাপটপ বের করে আনলো।রোকন জানে যে ওটাকে ল্যাপটপ বলে।বছর দুয়েক আগে স্কুল থেকে একবার একটা বিজ্ঞান মেলায় নিয়ে গিয়েছিলো স্কুলের বিজ্ঞান ম্যাডাম নাইমা রহমান।সেখানে সে বিভিন্ন নতুন জিনিসের নাম জেনেছে।ল্যাপটপও ছিল সেখানে।
লোকটি ল্যাপটপটা রোকনের হাতে দিয়ে বললেন,'তুমি শুধু তোমার মাকে গিয়ে বলবে,"হলে একটি ভুল,
দেবো গোলাপ ফুল,
হলে দু'টি ভুল,
দেবো কানের দুল,
হলে বিশাল ভুল,
দেবো ভুলের মাশুল।"
মনে থাকবে?নাকি আবার বলবো?'
রোকন বললো,'না না,আর কওয়া লাগবে না।মোর মুখুস্তো করতে টাইম লাগে না।'
লোকটি বুকে হাত বেঁধে হেসে বললেন,'তাহলে বলো দেখি কী বলেছি আমি?'
রোকন স্যারের কাছে পড়া দেয়ার মতো করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অনর্গল বলে ফেললো,'হলে একটি ভুল,
দেবো গোলাপ ফুল,
হলে দু'টি ভুল,
দেবো কানের দুল,
হলে বিশাল ভুল,
দেবো ভুলের মাশুল।'
লোকটি রোকনের ডান কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বললেন,'বাহ!চমৎকার!তোমার স্মরণ শক্তি তো চমৎকার!'
রোকন একটু করে হাসলো।
লোকটি এবার তাঁর ড্রাইভার দীপ্তকে উদ্দেশ্য করে বললো,'যাও,গিয়ে ওঁর জন্যে কতগুলো মাংস রুটি নিয়ে আসো।ওঁকে সাথে নিয়ে যাও।তুমি চিনবে না হয়তো।আমিও মাংস রুটির না আগে শুনিনি।'
রোকনের হাত থেকে ল্যাপটপটা নিয়ে নিলো লোকটি।রোকন ড্রাইভারের সাথে গিয়ে তাঁর মাংস রুটি কিনে নিয়ে এলো।
লোকটি দেখলো,রোকনের সেই কাঁদো কাঁদো চেহারা আর নেই।এখন খুশিতে উজ্জ্বল।যেন এখনই খুশির আলো চারিদিকে ছড়িয়ে সব বেজায় আলোকিত করে দেবে।
রোকন আসামাত্রই ল্যাপটপটা রোকনের হাত্র দিতে রোকনের মাথায় একবার হাত বুলিয়ে গাড়িতে উঠে গেলেন লোকটি।দেখলে রোকন ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে ঘরের দিকে।একবার পিছনে ফিরে তাকালো সে।লোকটি হাত নেড়ে রোকনকে বিদায় জানালেন।সেই সঙ্গে ড্রাইভারও হাত নেড়ে বিদায় জানালো।
ড্রাইভারকে বললেন তিনি,'চলো এবার।'
ড্রাইভার বিনা বাক্যব্যয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে চললো।
গাড়ির ভিতরটা কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকলেও নিস্তব্ধতা ভেঙে দীপ্তই বললো,'শোভন সাহেব!এবার তো ওরা সারাজীবন সুখেই কাটাবে তাই না?'
বাইরের দিকে চেয়েই শোভন সাহেব বললেন,'হুম,যদি নীলিমার সেই কলেজ লাইফের পাসওয়ার্ডটা মনে থাকে তবে।তা না হলে কোনো ব্যাংক থেকেই কোনো টাকা বের করতে পারবে না।'
দীপ্ত আবার বললো,'কিন্তু শোভন সাহেব?আপনি এতটা শিওর কীভাবে হলেন যে আজ রাতেই আপনি খুন হবেন!'
অন্যমনস্ক শোভন সাহেব কোনো উত্তর দিলেন না।
দীপ্ত ভাবলো হয়তো খেয়াল করেননি,মৃত্যু চিন্তায় বিভোর হয়ে আছেন।তাই সে আবারো জিজ্ঞেস করতে যাবে তখনই শোভন বলে উঠলেন,'গাট ফিলিং দীপ্ত,গাট ফিলিং।আজকাল বোধহয় ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়টা খুব সক্রিয় হয়ে উঠেছে।'
কিছুক্ষণ চুপ রইলেন শোভন।তারপর আবার বললেন।
'বুঝলে দীপ্ত,মানুষের মৃত্যুর আগে মানুষের জীবনে বিভিন্ন পরিবর্তন আসে।আবার কারো কারো তো আরো বাঁচার ইচ্ছে জাগে।এই আমাকেই দেখো না।ছেলেটির মতো অমন ফুটফুটে চেহারার বাচ্চাকে সাথে নিয়ে বাঁচতে ইচ্ছে করছে।নীলিমাকে আবারো বুকে আগলে নিতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু আর যে ওঁদের ধারেকাছেও ঘেঁষা যাবে না।আমি জেনে শুনে ওঁদের বিপদ কী ডেকে আনতে পারি তুমিই বলো দীপ্ত?'
দীপ্ত বললো,'না,একদমই না।'
'তোমাকে তোমার বাসার এক কিলো আগেই নামিয়ে দেবো।তুমি চলে যেও।আমি একা যেতে পারবো।'দীপ্তর দিকে তাকিয়ে বললেন শোভন।
দীপ্ত কথাটায় কিছুটা উত্তেজিত হয়ে এক ঝলক পিছনে দেখে আবার সামনে তাকিয়ে বললো,'কিন্তু শোভন সা...!'
দীপ্তকে থামিয়ে শোভন বললেন,'শোনো দীপ্ত।আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে।এতে তুমি আমার সাথে না থাকলেও মরবো আর সাথে থাকলেও মরবো।মরবে তুমিও।এখন মরার সময় নয় তোমার।তোমাকে আরো এগিয়ে যেতে হবে নিজের জীবনে।তুমি খুব দক্ষ এবং বিচক্ষণ আর বুদ্ধিমান গোয়েন্দা দীপ্ত।ইউ আর রিয়েলি এক্সসিলেন্ট ডিটেকটিভ।'
দীপ্ত বললো,'কিন্তু শোভন সাহেব!মক্কেলকে বিপদের মুখে ছেড়ে আসা কী আদৌ শোভনীয়?'
শোভন দীপ্তর কথার জবাব দিলেন না।একরাশ কী যেন ভাবছেন।
দীপ্তকে বিদায় দিয়ে নিজেই ড্রাইভ করতে নিলেন শোভন।এদিকটা হাইওয়ে তাই থেকে থেকে গাড়ি আসছে।কখনো দূরপাল্লা বাস কখনো মাল বোঝাই ট্রাক।অন্যমনস্ক হওয়ায় বার দুয়েক রংওয়েও চলে গিয়েছিলেন শোভন।ভাগ্যিস খেয়াল হয়েছিলো।নইলে মালবোঝাই ট্রাক উড়িয়ে দিতো গাড়ি।
শোভন গাজী।শংকর ফার্মাসিউটিক্যালসের ম্যানেজার।যদিও তার অর্থের পরিমাণ ফার্মাসিউটিক্যালসের মালিকের অর্থেরও দ্বিগুণ।একজন ম্যানেজারের অর্থ-সম্পদ এত হতে পারে কীভাবে?বলছি।
ফার্মাসিউটিক্যালসের মালিকের তৈরি তিনটি ঔষধের ফর্মুলা তিনি দেশের বাইরে পাচার করেছেন।হ্যাঁ,আর এ কারণেই তাঁর খুন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।কিন্তু তা ফার্মাসিউটিক্যালসের মালিকের হাতে না।তিনি তো কবেই পটল তুলেছেন।এখন মালিক তাঁর ছেলে বিনয় শংকর।তাঁর পরিবারের কেউই জানেন না তাঁর ঐ আবিষ্কারের কথা।শুধুমাত্র তিনি ছাড়া আর কারো জানা নেই।তাই বিপদটা যাদের কাছে বিক্রি করেছেন তাঁদের হাতে।কারণ তিনি সেই ফর্মুলা একাধিক লোকের কাছে বিক্রি করেছেন।এটা পরস্পরের মধ্যে জানাজানি হবার পরই তাঁদের নিয়োজিত পেশাদার খুনিরা শোভনকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে।যদিও গাড়িতে শোভনের কাছে একটা রিভলভার আছে ফুল লোডেড।কিন্তু তা দিয়ে কজনকে ঠেকাবেন?তাঁকে মারতে তো আর এক আধজন লোক পাঠাবেন না।পাঁচজনে কম করে হলেও তিন-চারজন করে পাঠাবেন।
শোভন ফার্মাসিউটিক্যালসের মালিক বাহাদুর শংকরকে শায়েস্তা করতে আর নীলিমার প্রতিশোধ নিতেই মূলত ফর্মুলা চুরি করেছিলেন।কিন্তু,মানব মন,কী আর করার।লোভ চেপে বসলো।এতজনের কাছে বিক্রি করে দিলেন ফর্মুলাটা।কিন্তু একটাকাও হজম করতে পারলেন না।যাক,তাতেও দুঃখ নেই।তাঁর প্রাক্তন নীলিমা তো পারবে।দীপ্তর দ্বারা খোঁজ নিয়ে জেনেছিলেন যে নীলিমার স্বামী বছর দুয়েক আগে যখন জানতে পারলো নীলিমার কোনো জটিল রোগ হয়েছে,বাঁচবে না বেশিদিন,তাই সে অন্যত্র চলে গেলো,গিয়ে আরেক মেয়েকে বিয়ে করে শান্তিতেই আছে।একটিবারের জন্য খোঁজও নেয়নি প্রথম স্ত্রী আর সন্তান তিনজনের।আর তখনই সেও উপলব্ধি করলেন যে তাঁর মৃত্যু কাছাকাছি।তাই সে তাঁর উপার্জিত সকল টাকা দিয়ে এলেন নীলিমাকে।
শোভন এতটাই অন্যমনস্ক যে তাঁর পিছনে যে একটি ট্রাক তেড়ে আসছিলো তা খেয়ালই করেননি।ট্রাকটা শোভনের গাড়িকে ধাক্কা দিবে,আর মাত্র চার ইঞ্চি এগোলেই ধাক্কা লাগবে।সামনে একটা স্পিড ব্রেকার,সেটার উপরে চাকা পড়তেই শোভন একটা কোমল উষ্ণতা অনুভব করলেন সারা শরীর জুড়ে।সাসপেনশনের সাথে লাগানো বোমা সাসপেশনের উপর চাপ পড়ায় বিস্ফোরণ ঘটলো।এতই ভয়ানক এবং শক্তিশালী বিস্ফোরণ ছিল যে পিছনের ট্রাকটিও বিস্ফোরণের শিকার হলো।নিশ্চিহ্ন হয়ে গেকো শোভনের শরীর।সেই সঙ্গে ট্রাক ড্রাইভার ও তার পাশে বসা রাশিয়ানেরও।তবে রাশিয়ানের মাথার বাদামী চুল গুলোর কিছু অংশ রয়ে গেলো অক্ষত।
<>
দীপ্তর হাতে একটা মোটা ফুলে থাকা খাম ধরিয়ে দিয়েছেন।নিসন্দেহে টাকার বান্ডিল।এক লক্ষ টাকা বোধহয়।তেমনই কথা ছিল শোভন সাহেবের সাথে।কিন্তু এখন সেটা হাতে রাখতেও তাঁর বড্ড অস্বস্তি লাগছে।মানুষটা কখন মারা যান তার ঠিক নেই।তাঁকে বাঁচানোর জন্যে সে কিছুই করতে পারছে না।যে মানুষটা নিশ্চিত মরে যাবে আর যাকে বাঁচানোর জন্যে সে কিছুই করছে না তাঁর দেয়া টাকা রাখতে খুব খারাপ লাগছে দীপ্তর।তাঁর এখন কী করনীয়!সে হাঁটছে আর ভাবছে গভীর ভাবে।তারপর কী মনে করে টাকা সমেত খামটা রাস্তার জঙ্গলে ফেলে দিলো দীপ্ত।তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে হেঁটে চললো নিজের গন্তব্যে।কিন্তু কিছুদূর হেঁটে আর হাঁটতে ইচ্ছে করছিলো না তাঁর।একটা বাস আসতে দেখে হাত দেখিতে থামিয়ে উঠে পড়লো বাসে।
*
গত সাড়ে সাত ঘন্টা ধরে অজ্ঞান হয়ে জঙ্গলে পড়ে ছিলো আশিক।সারা শরীর জুড়ে ময়লা।নাক বেকে পড়া রক্ত শুকিয়ে গিয়েছে।লাঠির ভয়ানক আঘাতে জামা অব্দি ছিঁড়ে গিয়েছে।শ্যামলা চেহারার আশিক কিছুটা হ্যাঙলা।পাঁচ-ছদিনের শেভ না করা দাঁড়ি।ইটের গুড়ো লেগে চুল দাঁড়ি লাল হয়ে আছে।শ্যামলা হলেও মুখমণ্ডলের ত্বকে খুবই পরিষ্কার আর কোমল।তা হলে কী হবে?ঘুষির আঘাতে ঠোঁট,কপাল,গাল ফেটে ফুলে গিয়ে এক বীভৎস রূপের সৃষ্টি করেছে।এমনিতে আশিকের মুখমণ্ডলের গঠন অনেক সুন্দর।
জ্ঞান ফেরার পর সে চোখ মেলে দেখলো মেঘে ঢাকা চাঁদের হালকা অবয়ব।আকাশে আজ চমৎকার তারা দেখা যাচ্ছে।উঠার জন্য মনস্থির করলো সে,তখনই যেন আকাশ থেকেই একটা আয়তক্ষেত্রের মতো কিছু একটা ঠিক তাঁর মুখমণ্ডলের উপর পড়লো।ফাটা নাকের উপর পড়া ব্যাথা সে ককিয়ে উঠলো।সে বাঁহাতি তা বাঁ হাত দিয়েই মুখ থেকে ওটা সরাতে যাবে কিন্তু দেখে বাঁ হাতের আঙুল একটাও নাড়াতে পারছে না।বোধহয় সব ভেঙে গিয়েছে।ডান হাতেও তিনটে অবশ।ডান হাত দিয়ে সেটা উঠিয়ে নিয়ে নিজেও কোনোরকম উঠে বসলো।সারা শরীর জুড়ে প্রচন্ড ব্যাথা।উঠতে উঠতে,আঃ মা বলে ককিয়ে উঠছিলো আশিক।প্রতিটা আঘাত তার চামড়ার সাথে সাথে যেন পেশিগুলোকেও ফাটিয়ে দিয়েছে।আশিক দেখলো,তাঁর মুখের উপর যেটা উড়ে এসে পড়েছিলো সেটা একটা খাম।খামের মধ্যে মোটা কী যেন আছে।খাম খুলে তো তাঁর সারা শরীর অবশ হয়ে গেলো।ব্যাথাতেও এতটা অবশ হয়নি তাঁর শরীর,যতটা হয়েছে একটা কাগজ আর এক বান্ডিল টাকা দেখে!না,টাকা না,ইতালীয়ান নোট এগুলো।সে চেনে এই নোট।কারণ তাঁদের পাশের বাসার শাকিল ভাই ইতালীতে থাকেন।তাঁর কাছে এমনই নোট দেখেছিলো সে।জিজ্ঞেস করায় বলেছিলেন যে ওগুলো ইতালীয়ান টাকা।কিন্তু টাকা না,এগুলোকে ডলার বলা হয় বোধহয়।এখানে কম করে হলেও এক লক্ষ ডলার আছে।
আশিক কাগজটা খুললো।A4 সাইজের কাগজে কয়েক লাইন লেখা।তাও টাইপ করে।
'তুমি আমার জন্যে অনেক করেছো।এগুলো ওঁদের দিতে পারতাম না।কারণ ওঁরা সাধারণ বোকাসোকা মানুষ।এগুলো নিয়ে কোথাও বিক্রি করতে গেলেই ওঁদের চোর বলে আখ্যায়িত করবে।তাই এগুলো তোমায় দিয়ে যাচ্ছি।তুমি যথেষ্ট ভাল একজন মানুষ।আগেই সামনাসামনি বললে তুমি নিতে চাইতে না।তাই চিঠিতে বলে দিলাম।
শহরের উত্তরে গিয়ে শহর ছাড়িয়েও আরো দশ কিলোমিটার সামনে গেলেই নদীর পাড়ে একটা ভাঙাচোরা বাগানবাড়ি দেখতে পাবে।সেটা আমার বাগানবাড়ি।আমি ছাড়া কেউ ওখানে যায় না আর জানেও না যে ওটা আমার বাগানবাড়ি।একটাই রুম।ঢুকে আমার খাটের ঠিক মাঝ বরাবর নিচে একটা মোটা কালো সুতো দেখতে পাবে।সেটা টান দিলেই কিছুটা মাটি উঠে আসবে।মাটি উঠে সরে গেলে একটা লোহার হাতল দেখতে পাবে।সেটা একটা লোহার বাক্সের ঢাকনা।টান দিলেই ঢাকনা খুলে যাবে আর তাতে পাবে স্বর্ণমুদ্রাসহ কিছু হিরেও।তুমি ছাড়া আমার আর কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী নেই বলে তোমাকেই দিয়ে দিচ্ছি এসব।এখন বাকিটা তোমার উপর।ইচ্ছে হলে রাখো,নয়তো দিয়ে দাও যাকে ইচ্ছে তাঁকে।'
আশিকের শরীরের ব্যাথা যেন নাই হয়ে গিয়েছে।চটপট উঠে দাঁড়ালো সে।এই চিঠিই যেন তাঁর জন্যে মেডিসিন ছিল।ব্যাথা প্রশমনের কাজ করলো।
ইতালীয়ান মুদ্রাগুলো আবার খামে ঢুকিয়ে কোনোরকম রাস্তায় উঠে খোঁড়াতে সামনে এগোতে লাগলো আশিক।
হাত দিয়ে কত গাড়িকে থামতে ইশারা করলো সে কিন্তু কোনোটাই থামলো না।পাত্তাই দিলো না আশিককে।বোধহয় তাঁর গোবেচারা গোছের মুখ দেখে তাঁকে পাগল ভেবেছে সবাই।
আশিক তাই স্থির করলো সে হেঁটেই যাবে।তাছাড়া আর কিছুই করার নেই তাঁর।
সে এখন শহরের দক্ষিণ দিকে আছে।শহর থেকে এক কিলোমিটার দূরে।তাঁর আগে চিকিৎসা দরকার।বজ্জাত গুলো এমনভাবে মেরেছে যে চিকিৎসা না করালে ক্ষতস্থানে ইনফেকশন হবে।তাছাড়া নাজানি কতঘন্টা ময়লা ধুলোর মধ্যে পড়ে ছিল কে জানে।
আশিকের কোনো দোষ ছিল না।শুধু সে একজন দূর্বল হাড্ডিসার চোরকে বাঁচাতে চেয়েছে বলে চোরের সাথে সাথে তাঁকেও খুব মেরেছে।খুবই হ্যাঙলাপাতলা এক পকেটমার ছিল বাসে।একজনের পকেট থেকে মানিব্যাগ চুরি করতে দেখে ফেলেছিলো পিছনে থাকা এক অবসরপ্রাপ্ত আর্মির সৈনিক।দেখামাত্রই খপ করে হাত ধরে ফেলেছিলেন চোরের।আর সে চোরও যেই পকেটে হাত দিয়েছিল তিনি ছিলেন একজন পুলিশের ওসি।বদলি হয়েছে বলে যাচ্ছিলেন গন্তব্যে।পকেট মারার অপরাধে তাঁর ব্যাগ থেকে নিজের একটা মসৃণ তেলতেলে লাঠি বের করে বেদম প্রহার শুরু করেছিলেন।তখন আশিক বাঁধা দিয়ে মাফ করতে বলে আর বোঝায় যে হয়তো খুবরকমের বিপদে পড়েই এই কাজ করেছে।কিন্তু তা শোনার কোনো ইচ্ছে বোধহয় ছিল না ওসি আর অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকের।ওসির হাত থেকে লাঠিটা নিয়ে আশিককে চোরের চেয়েও বেশি মারলেন চোর বলে।কারণ সে আর আশিক পাশাপাশি বসেছিল।সবাইকে তাঁরা একে অপরের সাথে মিলিত বুঝিয়ে প্রচুর মারলো আশিককে।তাছাড়া বাসে ওঠার আগে আশিকের সিটে সেই সৈনিক বসেছিলেন।আশিককে বলেছিলেন যে সে যেন তাঁর সিটে গিয়ে বসে।তাঁর জানালার পাশের সিট দরকার ছিল কিন্তু কাউন্টার থেকে দেয়া হয়নি তাই সে এখানে বসেছে।কিন্তু আশিক নাছোড়বান্দা।সে তাঁকে সেখান থেকে উঠিয়ে ছাড়লো।সেই থেকে সৈনিক আশিকের দিকে হিংস্র নজরে বার বার দেখছিলো।যেন সুযোগ পেলেই ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে।আর সেই সুযোগ পেয়েও গিয়েছিলো।সুযোগের সৎ ব্যবহার করে ফেলেছেন অনতিবিলম্বে।
আঘাতের ব্যাথায় সারা শরীর জমাট বেঁধে গিয়েছে আশিকের।তবুও কোনোরকম হেঁটে চলছে।হাতে তাঁর ঘড়ি আছে কিন্তু ক'টা বাজে তা বোঝার উপায় নেই।লাঠির আঘাতে ঘড়ির উপরিভাগের কাঁচ ফেটে চৌচির।তাই কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না।আশিক খামটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে নিয়েছে।তাঁর মানিব্যাগ,মোবাইল কেউ নিয়ে গেছে।তবে টাকা সব মানিব্যাগে ছিল না।আন্ডারওয়্যারেই রাখে বেশিরভাগ।যখন সে ট্রাভেল করে।খুঁজে দেখলো সব টাকাই আছে ঠিকঠাক।যদিও সে এখন অনেক অনেক টাকার মালিক।শাকিল ভাইয়ের কাছে শুনেছে ইতালীর একটা মুদ্রার দাম বাংলাদেশে ১০০ টাকা!তাহলে এক লক্ষ টাকা হিসেব করলে দাঁড়ায় দশ লাখ!খুশিতে আর উত্তেজনায় আশিকের বুক এতই ভরে গেলো যে তাঁর একটু শ্বাসকষ্টও হলো।সে বার বার পিছনে তাকাচ্ছিলো।যদি কোনো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।একটি পিকাপ আসছিলো।একদম খালি।বোধহয় ডেলিভারি শেষ করে ফিরে আসছে।হাত দিয়ে ইশারা দিলো আশিক আর ফিল্মি স্টাইলে বললো, 'লিফট!লিফট!'
আশিককে পাগল ভেবে প্রায় উপেক্ষা করেই যাচ্ছিলো পিকাপটি,কিন্তু তাঁর কাছ থেকে শোনা 'লিফট' শব্দটি শুনেই সহকারী ড্রাইভারকে বললো গাড়ি থামাতে।থামলো,আশিক কাছে গিয়ে অসহায় সুরে বললো,'ভাই,খুব বিপদে পড়েছি।আমারে মেরে আবার মানিব্যাগ,মোবাইল নিয়ে গেছে ওঁরা।শরীরটা খুবই খারাপ।যদি কাছেপিঠের কোনো হাসপাতালে নামিয়ে দিতেন তাহলে খুব উপকার হতো ভাই।'
আশিকের এই অসহায় ভাষণে দুজনেরই মন গলে জল হয়ে গেলো।তাঁরা পিছনে উঠতে নির্দেশ দিলেন।
একটি সরকারী হাসপাতালের সামনে আশিককে নামিয়ে দিয়ে গেলো তাঁরা।রাত তখন সোয়া দুইটা বাজে।এত রাতে ইমার্জেন্সি বিভাগ খোলা পাওয়ার আশা করছেই না আশিক।সে হাসপাতালের করিডোরে দেয়াল হেলান দিয়ে বসে পড়লো।সে খামটাও তাঁর আন্ডারওয়্যারে ঢুকিয়ে নিয়েছে।বসার একটু পরই চোখ লেগে এলো ওঁর।ঘুমিয়ে পড়লো।
ঘুম ভাঙলো ঘাড়ে সিকিউরিটি গার্ডের লাঠির গুতায়।এমন কাণ্ডে আশিক খেঁকিয়ে উঠে বললো,'কেমন জ্ঞান বোধহীন বলদ আপনি?একজন জখমপ্রাপ্ত আহত লোক শুয়ে আছে কোথায় তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন তা না করে লাঠি দিয়ে গুতাচ্ছেন?বেকুব নাকি আপনি?'
সিকিউরিটি গার্ডটি আশিকের কথায় যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো।হাতের লাঠিটি উঁচিয়ে আশিককে মারতে চেয়েও পারলেন না।পিছন থেকে কে যেন লাঠিটি ধরে ফেলেছে।আশিক দেখলো জিন্সের উপর ফুলহাতা ব্রাউন চেক শার্ট ইন করা আনুমানিক ছাব্বিশ-আঠাশ বছর বয়সের এক ছেলে লাঠিটি ধরেছে সিকিউরিটি গার্ডের।গার্ডটি তাঁর দিকে ঘুরতেই কষিয়ে একটা চড় বসালেন গার্ডের গালে।চড় মেরেই বললেন তিনি,'উনি তো ঠিকই বলেছেন।তাতে বুনো ষাড়ের মতো ক্ষেঁপে ওঠার কী আছে?'
সিকিউরিটি গার্ডটি কোনো কথা বললো না।রাগী চোখে আশিকের দিকে তাকিয়ে চলে সেখান থেকে।
ছেলেটি কাছে এসে আশিককে ধরে দাঁড় করালো।এবার আশিক ভাল করে দেখলো তাঁকে।যথেষ্ট ফর্সা।যেন রোদের ছোঁয়া গায়ে লাগতেই দেন না।ইনি ডাক্তারই হবে হয়তো।যেহেতু গার্ডটিও তাঁকে সমঝে চলে।ক্লিন শেভড।চুল গুলো সুন্দর করে আঙুল দিয়ে আঁচড়ানো।মেদহীন শরীর,টাইট শার্টে শরীরের অবয়ব বোঝা যাচ্ছে।ভাসা ভাসা চোখ,কিন্তু চশমা পড়েননা।গোলগাল মুখ,থুতনির মাঝখানে খাঁজ আছে।অবশ্যই ব্যায়াম করেন রেগুলার।এককথায় সুপুরুষই বলা চলে তাঁকে।
খুবই বিনয়ের সঙ্গে আশিককে জিজ্ঞেস করলেন তিনি,'কী হয়েছে আপনার সাথে?'
আশিক বললো,'ছিনতাই।'
'আচ্ছা।',
আশিককে ইমারজেন্সীতে নিয়ে যাওয়া হলো।
তারপর সেই লোকটি নিজে থেকেই বললেন,'আমার নাম প্রণয়।যদিও কার্ডিওলজি বিভাগের ডাক্তার।কিন্তু এখন আপনার জন্যে আমি কম্পাউন্ডার।কারণ হাসপাতালে এখন কোনো কম্পাউন্ডার নেই।'
আশিক কৃতজ্ঞতার সুরে বললো,'আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ভাই।আপনি যথাযথ সময়ে না এলে এই মার খাওয়া শরীর আর ঐ লাঠির আঘাত সহ্য করতে পারতো না।'
ডাক্তার প্রণয় বললেন,'ওসব কথা বাদ দিন।লোকটা একটু বিদঘুটে প্রকৃতির।আপনি আপনার জামা কাপড়গুলো খুলে ফেলুন তো।নিচে আন্ডারওয়্যার আছে?'
আশিক,'জ্বী আছে।তবে...।'
ডাক্তার প্রণয়,'তবে কী?'
আশিক,'টাকা আছে সাথে কিছু,ওগুলো কোথায় রাখবো?'
ডাক্তার প্রণয় আশিককে আশ্বাসের সুরে বললেন,'ও নিয়ে ভাবার দরকার নেই আপনার।'আপনার কাছেই রাখবো।দরকার হলে আপনার বালিশের নিচেই থাকবে।'
ডাক্তারের আশ্বাসে আশিক কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো।
প্রণয় ড্রেসিং শেষ করে ব্যাণ্ডেজ করতে করতে বললো,'কতটা পাষণ্ড ওরা।কী বাজে ভাবেই না মেরেছে আপনাকে।'
আশিক কিছু বললো না।
ব্যাণ্ডেজ শেষ করে ডাক্তার তাঁর জন্যে কিছু খাবার নিয়ে এলেন।স্যুপটি খেতে পারলেও বাকি খাবার গুলো খেতে পারলো না আশিক।গালে লাঠির আঘাত লাগায় চোয়ালে খুব ব্যাথা তাঁর।তাই চিবোতে কষ্ট হয়।স্যুপটি খেয়ে সোজা হয়ে শুয়ে পড়লো আশিক।পরক্ষণেই তাঁর চোখ লেগে এলো।ঘুমিয়ে পড়লো সে।
বিকেল সোয়া চারটা নাগাদ তাঁর ঘুম ভাঙলো।শরীরটা একটু চনমনে লাগছে তাঁর।বেড থেকে নেমে দাঁড়ালো সে,শরীরের দূর্বলতা আগের চেয়ে কমেছে অনেকটা।সে দ্রুত বালিশের নিচে খাম আর টাকা গুলো আছে কিনা দেখে নিলো।হ্যাঁ আছে।খামের মধ্যকার ইতালীয়ান ডলারগুলোও আছে।সেই সঙ্গে চিঠিটাও।আশিক তড়িঘড়ি করে জামাকাপড় পড়েই বের হয়ে এলো হাসপাতাল থেকে।সেই ডাক্তারের সাথে দেখা করা তো দূর কারো সাথে একটি কথা পর্যন্ত বললো না।
একটি সিএনজিতে উঠে সে মার্কেটের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।তাঁর নতুন জামা কামড় দরকার।তাঁকে ভিখিরির মতো লাগছে এমন অবস্থায়।সিএনজি ভাড়া মিটিয়ে সে একটি ব্রান্ডের জামা-কাপড়ের শোরুমে ঢুকে গেলো।একটি শার্ট আর একটি প্যান্ট কিনে ট্রায়াল রুম থেকে চেঞ্জ করে ময়লা জামা-কাপড় গুলো হাতে নিয়ে বিল পরিশোধ করে বেরিয়ে এলো সে।
এবার তাঁকে যেতে হবে ব্যাঙ্কে।কিছু ডলার এক্সচেঞ্জ করে টাকা করতে হবে।
শহরটা তাঁর চেনা।গত আড়াই বছর ধরে সে এখানে আছে।ভার্সিটির মৃত্তিকা বিভাগের ছাত্র সে।তাই তাঁর ব্যাঙ্ক খুঁজে পেতে সমস্যাই হলো না।কাপড়ের দোকানের বিপরীতেই একটু ডান পার্শে দোতলায় ব্যাঙ্ক আছে।দ্রুতবেগে তবে সাবধানে সে ব্যাঙ্কে চলে গেলো।বার বার আশেপাশে চতুর্দিকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করছে সে।যদি কেউ তাঁকে ফলো করে!তাঁর কাছে এখন দশলক্ষ টাকা আছে।তাই তাঁর মনে এক অজানা ভয়ের সৃষ্টি হয়েছে।
আশিক ব্যাঙ্কে ঢুকে গেলো।সে আপাতত দু'শো ডলার এক্সচেঞ্জ করবে।তাতে হয় বিশহাজার টাকা।সে দু'শো ডলার ট্রায়াল রুমে থাকতেই আলাদা করে রেখেছিলো।কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো।১৬-১৭ জন পুরুষের একটা লাইন ছিল এক্সচেঞ্জ কাউন্টারে।সবাই বিদেশী টাকা এক্সচেঞ্জ করতে এসেছে।ঠিক তার পাশেই একাই দাঁড়িয়ে আছে একজন।লাইন ছাড়া।পিছন দেখে আশিক তাঁকে প্রথমে বিদেশী ছেলেই ভেবে নিয়েছিলো।কারণ তাঁর পরণে আছে একটা ছাই রঙের গেঞ্জি,বাদামী রঙে থ্রি কোয়ার্টার।আর তাঁর উচ্চতাও আনুমানিক ছয় ফুট এক কিংবা দুই।সে টাকা নিয়ে ঘুরে চলে আসছিলো তখন তাঁকে সামনে থেকে দেখলো আশিক।তাঁর চেহারা দেখেও বোঝার উপায় নেই সহজে।অনেকেই হয় মাকুন্দা।আর তাঁর চেহারাতেও ছিল কঠোরতার একটা গভীর ছাপ।বাংলাদেশে বোধহয় অনেকদিন থেকে ঘুরছেন,তাই এদেশের কাঠফাটা রোদে পুড়ে চামড়ায় কালোত্বের আস্তরণ পড়ে গিয়েছে।চুলও সব ছোট ছোট।সে যে একজন নারী তা আশিক বুঝলো তাঁর বুকের দিকে তাকিয়ে।এক দৃষ্টিতে তাঁর দিকেই তাকিয়ে ছিলো আশিক,তাকিয়ে তাঁর চলে যাওয়া দেখছিলো।আসলে আশিক এর আগে কখনো সামনাসামনি কোনো বিদেশী নারীকে দেখেনি।কিন্তু ওদিকে সামনে থেকে অনেকটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিলো।প্রায় আট-নয়জন টাকা নিয়ে চলেও গিয়েছে।আশিকের পিছনে থাকা প্রকাণ্ড ভুড়ির অধিকারী চল্লিশের কাছাকাছি আধবুড়ো লোকটার ধাক্কায় আশিকের জ্ঞান ফিরলো।আশিক সামনে এগোলো।
টাকা নিয়ে বেরিয়ে এলো সে।চারদিকটা আবার ভালো করে দেখছে।কেউ তাঁর দিকে নজর রাখছে কিনা।নাহ,কেউ রাখছে না।সবাই নিজের মতো ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে।নিজের জীবন নিয়ে।আশিকের জীবনে কী চলছে তা নিয়ে এখানে কারো মাথা ব্যাথা নেই।কেউ জানতেও চায় না আশিকের মনে এখন আনন্দের মাত্রা কতটুকু।কারো জানার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।
আশিক শহরের উত্তরের বাসস্ট্যান্ডে যাবার জন্যে সিএনজিতে উঠলো।যেতে বড়জোড় ৭-৮ মিনিট সময় লাগলো।
সিএনজি থেকে নেমে ভাড়া দিয়ে এবার এগোলো বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষমান বাইকওয়ালাদের দিকে।
একজনের বাইকে উঠে বললো,'সামনেই কিলো দশেক দূর যেতে হবে,চলো।'
'ঠিকাছে ভাই।',বাইক চালকও আর কথা না বাড়িয়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে ছুটে চললো।
আশিক তাকিয়ে আছে রাস্তায় পাশে পাশে।কোথায় ভাঙাচোরা একটা বাগানবাড়ি পাওয়া যাবে।দেখতে দেখতে দূর থেকেই তাঁর চোখে পড়লো একটা বাঁশের বেড়ার তৈরি ছোট একটা মুরগীর খোপের মতো ঘর।আশেপাশে বিভিন্ন ফুলগাছ।ঐ দূরে থাকাবস্থাতেই সে নামলো।যদি সন্দেহ করে ওটার সামনে নামলে।আর সন্দেহের বশে যদি সেও আশিকের পিছু পিছু ঘরে ঢুকে সোনাদানা দেখে ফেলে!তাহলে তো আশিককে মেরেও ফেলতে পারে।এরা খুব বাজে রকমের বর্বর হয়।এমনিও লোকটার শরীর থেকে বোটকা একটা ঝাঁঝালো গন্ধ আসছিলো।সে গন্ধটা চেনে আশিক।গাঁজার গন্ধ।নেশাগ্রস্থ মানুষের এমনিও হিতাহিত জ্ঞান থাকে না।
তাই সে মূল গন্তব্যেরও অনেক আগে নামল বাইক থেকে।ভাড়া মিটিয়ে আশপাশ ঘুরতে লাগলো।লোকটাকে বুঝাতে চাইলো যে সে এখানে শুধুমাত্র ঘুরতেই এসেছে।আর কোনো কারণ নেই।লোকটা বাইক ঘুরিয়ে চলে গেলো।আশিকও আস্তে আস্তে ঘরটির দিকে এগোলো।তাড়াহুড়ো করলো না মোটেই।কারণ জলদির কাজ শয়তানের।যদিও এটাও শয়তানি।আরেকজনের মাল সে হাতিয়ে নিচ্ছে।কিন্তু এটা অপরাধ না।এর মালিক নিজেই বলেছেন যে চাইলে সে রাখতে পারে নাহলে দানও করে দিতে পারে।আর সেই লোক দানও করেছে।অতএব এটা সম্পূর্ণ আশিকের।এর মালিকানাধীন আশিকের।প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এলো।এখনো আলো বাকি আছে।শরৎের গোধূলি।অপূর্ব সুন্দর ডোরাকাটা মেঘ আকাশে।পড়ন্ত সূর্যের আশেপাশের মেঘগুলো নানান রঙের।লাল,হলুদ,সবুজ,কালো।সূর্যটা যেন অগ্নিকুসুম।বহুদিনে দেখা হয় এমন গোধূলি।সারাদিন রাত পড়াশোনা আর টিউশনি করিয়ে করিয়েই কেটে সময়।আমরা অগাধ সীমাহীন শিক্ষার ভাণ্ডার পৃথিবীকে দেখি না,দেখি সীমাবদ্ধ শিক্ষার বই।
আশিক রাস্তা দিয়ে নেমে এলো বাগান বাড়িতে।রাস্তা থেকে আনুমানিক পঁয়তাল্লিশ কী পঞ্চাশ হাত দূরে হবে বাগানবাড়িটি।ফুল গাছে ভরা উঠোন।বিভিন্ন ধরণের ফুল।কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো এতগুলো ফুল গাছের মধ্যে কেন একটি বেগুন গাছ!গাছে বেগুনও আছে।তিনটে লম্বা লম্বা।ঘরের কাছে এগোতেই মাঝখানের বেগুনটার গায়ে স্মাইলিটা স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠলো।বেগুনটার একদম কাছে গিয়ে দেখলো স্মাইলিটা বেশি পুরোনো নয়।আজকেরই।তা নিয়ে অতটা ভাবার সময় আশিকের নেই।আশিককে এখন সোনাদানা যা আছে তা নিয়ে চম্পট হতে হবে।
দরজাটা ঠেলে খুলে ভিতরে ঢুকলো দরজার সামনে মাটি সামান্য উঁচু।মনে হলো এই মাটি নতুন।ঘরের অন্যান্য স্থানের মাটির সাথে এই মাটির মিল নেই।কিন্তু এসব নিয়ে তেমন মাথা ঘামালো না আশিক।ভিতরে এগোলো আশিক।সামনে পা রাখতেই ক্লিক শব্দ হওয়ায় সে চারপাশে তাকিয়ে ইঁদুর খুঁজলো।না দেখে ঘরের দিকে নজর দিলো।ঘরে তেমন আসবাবপত্র নেই।এক কোণে একটি খাট,খাটের উপর ভাজ করা তোশক।পাশে টেবিল চেয়ার।আরেক কোণে মাটির কলস।আর দরজাটা সে বেড়াতে লাগানো সেই বেড়ায় ঠিক মাঝ বরাবর একটি আয়না।
আশিক গোছানো তোশকের উপর একটি ভাঁজ করা কাগজ দেখতে পেলো।খাটের কাছে গিয়ে কাগজটা খুলে কিছু দেখলো,'বোকা বানানোর জন্যে দুঃখিত দীপ্ত।আসলে শোভন যে চালাকিটা বিভিন্ন দেশের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি প্রধানদের সাথে করলো তাতে আমার রাগ নেই।কিন্তু আমার রাগটা হলো ওঁ কেন আমার বাবাকে ধোকা দিলো!ঐ ফর্মুলা মালিক আমার বাবার পরে আমি ছিলাম।কিন্তু সে নিজে তো মরলোই সাথে সাথে আমারো ভাত মারলো।তুমি অনেক কিছু জেনে ফেলেছিলে।তোমাকেও মরতে হবে।তুমি এখানে যা নিতে এসেছো তা আমি আগেই নিয়ে নিয়েছি।কারণ ওগুলোর প্রতি অধিকার আমার।তোমার নয়।অতএব তুমি এবার নিশ্চিন্তে মরো।ভাবছো মরবে কীভাবে?আশেপাশে তো কাউকে দেখোনি।অত ভাবতে হবে না।দরজার ওখানে মাটির নিচে টাইম বোমা সেট করে রেখেছি।তোমার পায়ের চাপেই অন হয়ে গিয়েছে।ওটা টাইমার দিয়ে...।'
বিকট আওয়াজ তুলে বিস্ফোরণ ঘটলো।বাড়ি বাগান সবকিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো।সেই সঙ্গে আশিকও।
<>
দীপ্ত সকাল সকাল উঠে আগে যোগ ব্যায়াম করে।একজন গোয়েন্দাকে সবসময় ফিট থাকতে হয়।শরীর ও মনের উপর সম্পূর্ণ কাবু রাখতে হয়।যদিও তা সবাই পারে না।দীপ্তও পারে না।যোগ ব্যায়াম শেষ করে তাঁর রুমে কফি আর টিভি অন করে নিয়ে বসেছে দীপ্ত।প্রথম চুমুকেই বিষম খেয়ে কাশতে লাগলো দীপ্ত।টিভিতে খবরে মূল হেডলাইন দেখে তাঁর চোখ ছানাবড়া।শোভন সাহেব মারা যাবেন তা জানতো দীপ্ত।কিন্তু তাই বলে এত দ্রুত?কাল রাতেই!ভাগ্যিস,শোভনকে নামিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।নয়তো এখন নিজের রুমে বসে কফি না,স্বর্গে বসে মেঘ চিবোতে হতো।দীপ্ত আর দেরী করলো না।দ্রুত কফিটা শেষ করেই জামাকাপড় পাল্টে বেরিয়ে পড়লো।
'স্যার,সামনে আর যাওয়া যাইবে না।জম্মের জ্যাম।',বললো সিএনজিওয়ালা।
দীপ্ত নেমে ভাড়া দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো।তাঁকে আধ কিলোমিটারেরও বেশি হাঁটতে হলো।যা ভীড় স্পটে,উঁকি দেয়ারও জোঁ নেই।দীপ্তকে মোটামুটি অনেকেই চেনে পুলিশে।তাই তাঁর ভীড় ঠেলে ভিতরে ঢুকতে সমস্যা হলো না।তাঁকে দেখে ওসি বদরুল উদ্দিন এগিয়ে এসে হ্যাণ্ডশেক করলেন।
'এমন ফাটা ফেটেছে শালার বোমাটা,ট্রাকের মাথা গো নব্বইভাগ খুইয়েছে।আর সামনের এটা অবশ্যই প্রাইভেট কার,এটা তো টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে।তা দীপ্ত বাবু,আপনি কী বুঝছেন?'থুতনি চুলকোতে চুলকোতে জিজ্ঞেস করলেন বদরুল উদ্দিন।
দীপ্ত একজন বিজ্ঞ গোয়েন্দার মতো করে বললেন, 'নিসন্দেহে বোমাটা খুবই উন্নত এবং শক্তিশালী ছিল।আর ট্রাকটা গাড়ির সংস্পর্শেই ছিল বোধহয়।হয়তোবা এক্সিডেন্ট হতে যাচ্ছিলো এই দুটোর একটার ভুলে।আর ঠিক তখন আরেক এক্সিডেন্ট নিজের বাঁ হাত ঢুকিয়ে দিলো এঁদের মধ্যে।'
দীপ্তর কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বদরুল উদ্দিন বললেন,'যথার্থ বলেছেন দীপ্ত বাবু।তবে আমাদের বুঝতে বেগ পেতে হবে যে এগুলো কাদের মৃত দেহ।ক'টাই বা আছে এখানে।আর কে ট্রাকে ছিল আর কে প্রাইভেট কারে।সব দেহ যে গলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে।'
বদরুল সাহেব তাঁর হালকা চুলওয়ালা মাথা একটু চুলকে নিলেন।
লোকটার বয়স তেপ্পান্ন হলেও চেহারা সুরুতে তাঁকে তেষট্টি বছরের লাগে।ঘুষ খেয়ে খেয়ে আর বসে বসে ঝিমাতে ঝিমাতে শরীরের হাড়গোড়ে মরিচা পড়ে গিয়েছে।সেই সঙ্গে শরীরের উপরীভাগে বাসা বেঁধেছে বার্ধক্যের ছাপ।দীপ্তর মনে হয়,লোকটার বয়স যত বাড়ে ততই যেন তার গম্ভীর বজ্রকণ্ঠ আরও গম্ভীর আর ভয়ানক হয়ে যায়।
দীপ্ত আর এখানে থাকতে পারছে না।তাঁর গা গুলিয়ে বমি আসছে এসব দেখে।যে লোকটার সাথে গতকালও ছিলো সে।একই গাড়িতে।কত কথা বলেছে তাঁরা।আর আজ সেই লোকটির দেহের গলিত তরল অবস্থা পড়ে আছে তাঁর চোখের সামনে!এটা কী বিশ্বাস করা যায়!
দীপ্ত কোনো ভাবে ভীড় ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এলো।আর ধরে রাখতে না পেরে রাস্তার পাশে বমি করে দিলো সে।
দীপ্ত পিঠে প্রকাণ্ড একটি হাতের ঘষা অনুভব করলো।বমি করা অবস্থায় এমন করলে বমিটা কমে তা জানে দীপ্ত।এমন শেষবার করেছিলো দীপ্তর বাবা আট-নয় বছর আগে।ঘাড় ঘুরিয়ে দীপ্ত বদরুল উদ্দিনকে দেখতে পেলে।উচ্চতা ছয়ফুট দুই ইঞ্চি।শারীরিক ভাবে তিনি যেমন বিশাল তেমন তার হাতও বিশাল।
'কী দীপ্ত বাবু?এসব দেখার অভ্যেস নেই নাকি?তাহলে কেমন গোয়েন্দা আপনি হাঁ?'বললেন বদরুল উদ্দিন।
দীপ্ত উঠে দাঁড়িয়ে রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো,'কাটা-ছেঁড়া,ভাঙা,টুকরো অনেক লাশ দেখেছি বদরুল সাহেব,কিন্তু এমন গলিত তরল লাশ প্রথম দেখলাম।'
বদরুল উদ্দিন ভীড়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,'হ্যাঁ হ্যাঁ,জীবনে যে কতকিছু যে দেখা লাগে তার কোনো হিসেব নেই।'
এবার দীপ্তর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,'তা,কী করবেন?থাকবেন না চলে যাবেন?'
দীপ্ত একরাশ ক্লান্তির সাথে জবাব দিলো,'থাকা সম্ভব না,চলেই যাবো।'
'আচ্ছা যান তাহলে',বলে বদরুল সাহেব শরীর ভরা অনিচ্ছা নিয়ে আবার ঢুকে গেলেন ভীড়ের মধ্য দিয়ে স্পটে।
দীপ্তর আর সাহসে কুলালো না ওখানে থাকতে।দ্রুত বেগে চলে এলেন সেখান থেকে।
বাসায় এসে দরজা ভাল করে আটকেই সে তাঁর প্রয়োজনীয় যা যা আছে সব গোছাতে শুরু করলেন।তিনি তাঁর বিপদও আঁচ করতে পারছেন শোভন সাহেবের মতো।
মালপত্র গুলো গাড়িতে উঠিয়ে দীপ্ত আর এক মুহূর্তের জন্যেও থামলো না।ভয়ে তাঁর হাত পা অবশ লাগছে।একটু পর পর দৃষ্টি ঘোলা হয়ে যাচ্ছে।খুবই ভয়ানক রকমের ভয় পেয়ে গিয়েছে দীপ্ত।তাঁর মাথা কাজ করছে না।তাঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অস্বাভাবিক আচরণ করছে।শরৎ কালে যেন শীতের ঠান্ডা তাঁদের গ্রাস করেছে।প্রচুর কাঁপছে।সে জানে যে সে কোনো অপরাধ করেনি।কিন্তু,সে ছিল শোভন সাহেবের সাথে অনেকদিন।অবশ্যই তাঁকে দেখেছে তাঁর শত্রুরা।তাঁকে অবশ্যই মেরে ফেলতে চাইবে।ভাবছে শোভন সাহেবের কুকাজে আমিও এক অন্যতম সহযোগী।
দীপ্ত গাড়ি চালাতে পারছে না ঠিকভাবে।এমন ভাবে চালাচ্ছে যেন সে প্রথম স্টিয়ারিং হাতে ধরেছে।ব্যালেন্স রাখতেই যেন কষ্ট হচ্ছে দীপ্তর।গতি ষাটের কাছাকাছি কিন্তু গাড়ির উপর কোনো কন্ট্রোল নেই দীপ্তর।গাড়ি সেতুর উপরে সাপের মতো আঁকাবাঁকা হয়ে চলছে।একটি বাইক আরোহীকে তো প্রায় ধাক্কা মেরেই দিয়েছিলেন।কিন্তু সেই বাইক আরোহী একজন দক্ষ রাইডার বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন।
দীপ্ত এভাবে ঘুরতে ঘুরতে রেলিং ভেঙে নদীতে গাড়ি সমেত পড়ে গেলো দীপ্ত সেতুর মাঝপথে এসে।সিট বেল্ট আটকানো।ভয়ে শরীরের শক্তি আশিভাগই চলে গিয়েছে দীপ্তর।তার উপর পানির মধ্যে দীপ্ত একেবারেই শক্তি শূন্য।না পারলো সিটবেল্ট খুলতে,আর না পারলো বের হতে।চোখের সামনে তাঁর ভেসে উঠলো জীবনে করা সব বড় পাপ গুলো।দীপ্তর মনে এখন জীবনের শেষ মুহূর্তে আফসোসটা জেগে উঠেছে।তাঁর উচিৎ হয়নি নীলিমার ধনী স্বামীর কাছে তার বোনকে মুসলমান সাজিয়ে বিয়ে দেয়া।হয়তো ঐ ফুটফুটে বাচ্চাগুলো আর নীলিমার অভিশাপ লেগেছে।তখনই যদি শোভন সাহেবের সাথে তাঁর পরিচয় হতো,তাহলে তিনি এ কাজ কখনোই করতে না।জীবনের এই অন্তিম মুহূর্তে তাঁর খুব করে নীলিমার কাছে ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু তার কোনো উপায় এখন আর নেই।
পাগলের মতো গাড়ি চালাচ্ছিলো আর তাঁকে একটুর জন্যে তো উড়িয়ে দিতো।তাই জন্যে বিনয় শংকর রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো সেই গাড়িওয়ালার দিকে।কিন্তু তাঁর রাগের জোড় যে এত বেশি তা তিনি জানতেন না।তিনি তাকানো মাত্রই গাড়িটি রেলিং ভেঙে নিচে পড়ে গেলো।বাইকটা ঘুরিয়ে যে সে সেদিকে যাবে তারও কোনো সুযোগ রাখলো না সামনে থেকে আসা ট্রাকটি।বাইক ঘুরাতে গিয়ে আড়াআড়ি হয়েছিলো বিনয় শংকর।আর ছিলেনও রং সাইডে।এরমধ্যেই বিপরীত দিক থেকে আসা ট্রাকটি বিনয় শংকরকে পিষে দিয়ে একটু সামনে গিয়ে থামলো।ঘোর বিপদ আঁচ করতে পেরে দ্রুততার সাথে কেটে পড়লো ঐ স্থান থেকে।
একপ্রকার বিদ্যুৎ গতিতেই ফাস্টফুডের ভ্যানের কাছের পৌঁছালো মাহিন।পৌঁছানোর আগেই অর্ডার করলো দু'টো চিকেন রোলের।
প্রায়শই সন্ধ্যায় মাহিনকে এখানে পাওয়া যায়।
মাহিন পেটুক বটে,কিন্তু বোঝার উপায় নেই যে সে পেটুক কিনা।কিছু হ্যাঙলা পাতলা মানুষকে দেখে পেটুক মনে না হলেও তাঁরা অবিশ্বাস্য রকমের পেটুক হয়ে থাকে,আর মোটা মানুষকে দেখে পেটুক মনে হলেও তাঁরা কিন্তু সাধারণত পেটুক হয় না।মাহিন মাঝারি গড়নের।ওজন বেশিও না কমও না।ওজন এবং শরীরের দিকে যথেষ্ট খেয়াল দেয় মাহিন।পেটুক হলেও ব্যায়াম করে নিজেকে যথেষ্ট ফিট রেখেছে মাহিন।
ফাস্টফুড ভ্যানের মালিক মুরগী-গরুর মাংসের টুকরো গুলো ফ্রাই করছে।তাঁর সহকারী মাহিনের অর্ডার শোনামাত্রই চিকেন রোল প্রস্তুত করতে লেগে গেলেন।দক্ষ হাতে দ্রুত বেগে পরোটায় ভাজা মুরগীর মাংসের টুকরো গুলো দিয়ে তার সাথে হালকা শশার সালাদ দিয়ে তার উপর এক টেবিল চামচ মেয়নিজের তৈরি সস দিয়ে ওটাকে রোল করে কাগজে মুড়ে দিলো।একইরূপে আরেকটা করছিলো তখন ফাস্টফুড ভ্যানের মালিকের কাছে একটা ছোট ছেলে এসে কী যেন বললো।মাহিন একপাশে আর তার বিপরীত পাশে মানে মাহিনের মুখোমুখি হলে ভ্যানের মালিক আর তাঁর পাশে ছোট ছেলেটা।আর মাহিনের পাশে সহকারী।চারপাশের ভীড় আর গাড়ির আওয়াজে কিচ্ছুই শুনলো না ছেলেটার কথা।কিন্তু অঙ্গভঙ্গিমা দেখে অনুরোধ ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না বলে মাহিন নিশ্চিত হলো।পরক্ষণেই সে একটা শব্দ শুনলো।ধমকের শব্দ।ফাস্টফুড ভ্যানের মালিক ছেলেটাকে ধমক দিয়েছে।
ছেলেটা আর বাক্যব্যয় না করে ওখান থেকে বাইশ-পঁচিশ হাত দূরে গিয়ে ফুটপাতে বসলো জনবহুল গাড়িতে কিলবিল করা ব্যস্ত রাস্তার দিকে।চোখ ছলছল করছে।বয়সটা একদমই কম।বড়জোড় বারো বছর হবে।কম হলে দশ।হয়তোবা দশই।অভাব অনটনের ছাপে হয়তো বয়সটা বেশি দেখাচ্ছে।এইটুকু বয়সেই তার চোখে হাজারো দুশ্চিন্তা দেখতে পাচ্ছে মাহিন।শরীরের রঙ যে একসময় ফুটফুটে ফর্সা ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই।অনাদরে অভাবে আর রোদের কড়া ছোবলে যেন চামড়ার উপর কালোত্বের একটা মেঘ বাস করতে শুরু করেছে বহুকাল ধরে।ছেলেটিকে বিভোর হয়ে দেখছিলো মাহিন।তার হুশ ফিরলো ফাস্টফুডের সহকারীর ডাকে।তাঁর রোল প্রস্তুত।
'আরো দুটো বানান',সহকারীর দিকে তাকিয়ে কথাটি বলে হালকা ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে মালিকের দিকে তাকালো মাহিন।মালিক মাহিনের দিকেই তাকিয়ে ছিল।চোখে হালকা বিস্ময়।যেন মাহিনের কথাটা শুনেছে সে।কিন্তু শোনার তো কথা নয় এত শব্দের মধ্যে।
মাহিন রোলটা দু'টি নিয়ে গেল বাচ্চাটার কাছে।এগিয়ে দিলো তার সামনে।সে কোনো এক গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিল সেই রাস্তাতে তাকিয়ে।তাঁর সামনে এগিয়ে দেয়া রোল দেখে রীতিমতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।মাহিন তাঁর চোখ আর হালকা হাঁ করা মুখ দেখে তাঁর হতভম্ব রূপটা আঁচ করতে পেরেছিলো।সে ছেলেটি ভাবনা পড়ার চেষ্টা করলো।হয়তো ভাবছে,সে যখন দোকানের মালিকের কাছে চাইলো সে দিলো না,কিন্তু কোত্থেকে এই ভাইয়াটা এসে আমাকে রোল দু'টি না চাইতেই দিয়ে দিলো!
'আরে নাও নাও,লজ্জা পাচ্ছো কেন?!'মাহিন মুচকি হাসি দিয়ে ছেলেটির উদ্দেশ্যে বললো।ছেলেটি তখনও স্বাভাবিক হতে পারেনি।মাহিন নিজেই ছেলেটির দু'হাতে রোল দু'টি ভরে দিলো।
মাহিন জিজ্ঞেস করলো,'কী নাম তোমার?'
ছেলেটি আস্তে মিনমিন করে বললো,'রোকন।'
মাহিন একটু বাঁ গালে হাসলো।এ যে তাঁরই দ্বিতীয় নামের ছেলে জেনে।
ওঁর মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,'তোমার বাবা কী করেন?'
ছেলেটি মিনমিন করে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,'মোর বাপ নাই।ছাইররা গ্যাছে।'
মাহিন তেমন একটা অবাক হলো না।তাঁর কাছে এটা বড্ড তুচ্ছ মনে হলো।কারণ তাঁর বাবা তো তাকে খুন করতে চেয়েছিলে মাতৃগর্ভেই।
তবুও সে সহানুভূতি দেখিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো,'বাসায় কে কে আছে?'
ছেলেটাকে এবার কিছুটা শান্ত দেখাচ্ছে।যেন উদ্বেগ অনেকটা কমেছে।মাহিনের নরম সুরের আদুরে কথায় সে কিছুটা স্বস্তির সাথেই কথা বলতে শুরু করলো।
'ঘরে মায় আছে।অসুখ।দুইডা বুইন আছে ছোডো।আমনে দুইডা মাংস রুডি দেছেন ভালোই হইছে।এউক্কা বুইনেরা,আরেউক্কা মায় খাইবে আনে।'
মাহিন একটু ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো,'কী হয়েছে তোমার মায়ের?আর ওঁদের সব দিয়ে দিলে তুমি কী খাবে?'
ছেলেটি বিরস মুখে বললো,'জানি না ভাই,কী জানি হইছে।খালি বমি করে।বমিতে জম্মের রক্ত বাইর হয়।'
মাহিন আন্দাজ করলো,বোধহয় ব্লাড ক্যান্সার।
'তুমি কী খাবে ওঁদের সব দিয়ে দিলে?'দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব না পাওয়ায় আবার জিজ্ঞেস করলো মাহিন।
সে একটি প্রাণবন্ত হাসি দিয়ে বললো,'আমার খাওন লাগবে না ভাই।মায় কইছে,ব্যাডা মাইন্সের কষ্ট নাই।'
মাহিন বিড়বিড় করে বলে উঠলো,'জানি না কেন,পৃথিবীর প্রায় সব নারীরাই এই এক ধারণা নিয়ে জন্মায়!
ছেলেটিই বললো,'ভাই আমি যাই।'
মাহিন বললো,'দাঁড়াও।'
মাহিন ওঁর কাছে আসার আগে আরো দু'টো রোল বানাতে বলে এসেছিলো।গিয়ে সে দু'টো এবং সাথে একটি কাগজের প্যাকেট নিয়ে এলো।সে দু'টো প্যাকেটে ভরে রোকনের হাত থেকে বাকি দুটো ভরে ওঁর হাতে দিয়ে বললো,'যাও,চারজনে চারটা খাবে।'
রোকন আবারও সেই প্রাণবন্ত হাসিটা দিলো।অভাবের অনাদরের চেহারাতে এতই সুন্দর একটা হাসি যেন অমাবস্যাতে কাস্তের মতো চাঁদের মতো ফুটে উঠেছিলো।
মাহিন রোকনের দুই কাঁধে দুই হাত দিয়ে ধরলো।অভাব অনটনের মধ্যে দিয়ে গেলেও শরীরটা পেশিবহুল।এত অল্প বয়সে এমন শক্ত পেশি গঠিত হওয়া সম্ভব না।অবশ্যই জেনেটিক।
মাহিন বললো,'শোনো রোকন।জানি না,কেন যেন মনে হচ্ছে তোমার জীবনে কষ্টের অধ্যায়ের বোধহয় আজই শেষ।আমি তোমার চোখে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তুমি কেমন পরিশ্রমী।কীভাবে যেকোনো সিদ্ধান্তে অটল থাকো।তোমার মধ্যে অফুরন্ত আত্মবিশ্বাস আছে।কিন্তু এখনো তা তুমি চিনতে শিখোনি।তাই কিছুটা পিছিয়ে আছো সুখময় জীব্ব থেকে।আমি বলি তোমায়,শোনো।'
রোকন সম্পূর্ণ বাধ্য ছেলের মতো মাহিনের সব কথা শুনছে।যেন মাহিন বহুকালের পরিচিত বিজ্ঞ বন্ধুসুলভ শিক্ষক তাঁর।
মাহিন বলতে থাকলো,'যেকোনো কাজ,যেকোনো ধরণের কাজ তুমি করতে পারবে।মানে তুমি মন থেকেই বিশ্বাস করতে পারবে যে ঐ কাজটা করা তোমার দ্বারা সম্ভব।তা যতই জটিল হোক না কেন।তুমি পারবেই।নিজের উপর এই বিশ্বাস টুকুকে আত্মবিশ্বাস বলে।তোমার উপর আমারোপ বিশ্বাস আছে।আমি জানি তুমি অনেক বড় ভাল কিছু করবে।তবে,তোমার মধ্যে যে পরোপকারীর পোকাগুলো আছে তা থেকে বেশকিছু ছাটাই করতে হবে তোমাকে।সবাইকে বিশ্বাস করে সাহায্য করতে যেও না।সবাইকে বিশ্বাস কোরো না রোকন।তুমি জীবনে অনেক আচমকা বিপদের সম্মুখীন হবে।কিন্তু কখনোই বিপদের পরিনাম নিয়ে ভাববে না সেই সময়ে।ভাববে বিপদ কাটানো যায় কীভাবে।কীভাবে নিজেকে মুক্ত করা যায় সেই বিপদ থেকে।তোমার ক্ষুধার কষ্টের জীবন হয়তো শেষ হবে দ্রুতই।কিন্তু তার চেয়েও ভয়ংকর হবে জীবন সংগ্রাম।কিন্তু তুমি পারবে।অনায়াসেই তুমি জীবনে সফল হবে।মনে রেখো,বিশেষ কিছু পাওয়াটা বরাবরই সহজ হয়,কিন্তু তা আগলে রাখা বড্ড কঠিন।আজ আমার কথা গুলো অনেকটা দুর্বোধ্য হলেও,বছরখানেক বাদে খুব কাজে আসবে তোমার এই কথাগুলো।শেষ একটা কথাই বলবো,কখনো কারো মনে কষ্ট দিয়ো না।কাউকে কষ্ট দেয়ার চেয়ে নিজে কষ্ট পাওয়া হাজার গুণে ভাল।এটাকে আগন্তুক ভাইয়ের অনুরোধ কিংবা কঠোর নির্দেশও ভাবতে পারো।আসি তাহলে,হয়তো কখনো আবার দেখা হবে না।ভালো থেকো।'
বলেই মাহিন ঘুরে হাঁটতে শুরু করলো অমনি ফাস্টফুড ভ্যানের মালিক ডাক দিয়ে বললো,'ভাই টাকা তো দিলেন না।'
এত কথার মাঝে মাহিন ভুলেই গিয়েছিলো টাকার কথা।মানিব্যাগে চল্লিশটাকাই ছিল।তা বের করে দিয়ে দিলো মালিকের হাতে।
টাকাটা নিয়ে সে বললো,'ভাই?আপনে খাইবেন না?'
মাহিনের চোখে মুখে একপ্রকার বিশাল স্বস্তির ছাপ।যেন হাজার বছরের অদৃশ্য মানসিক বোঝা সরে গিয়েছে মাথা থেকে।মাহিন শান্ত স্বরে বললো,'টাকা নেই আর।'
অপরাধীর মতো মাথা আর কন্ঠ খানিকটা নামিয়ে ফাস্টফুড ভ্যানের মালিক বললো,'ভাই,আমারই ওরে দেওয়া উচিৎ আছিলো।দিই নাই।তাই এহন দুইডা আমি আপনেরে দিতাছি।নাইলে এই অপরাধের বোঝা আমি সইতে পারমু না সারা জন্মেও।'
মাহিন একটু হেসে বললো,'বোঝা সইতে হবে না।রেখে দিন ঐ দু'টো।হয়তো আমি আসবো না আর।তবে আমার নামে লেখা রইলো ঐ দুটো।দিয়ে দিবেন ওঁরই মতো কাউকে।ওঁকে দেয়ার দরকার নেই।ওঁর আর প্রয়োজন নেই আপনার সহানুভূতির।তবে,ওঁর মতো অনেকেই আসবে,কাউকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেবেন না কখনো।একদিন তাঁদেরই কারো দ্বারা আপনার জীবনে অঢেল সুখ আসবে যার কল্পনা আপনি কখনোই করবেন না।'
কথাগুলো বলে মাহিন আর একসেকেন্ডও সেখানে রইলো না।সোজা পথে রাস্তার দিকে চলে গেলো পিঁপড়ার মতো গাড়ির মিছিলের মধ্যে।হারিয়ে গেলো সে।ফাস্টফুডের মালিকটি সেদিকে তাকিয়ে ছিল মন্ত্রমুগ্ধের মতো।কিন্তু মাংসের পোড়া গন্ধে তার হুশ ফিরলো।
আরো একজন মাহিনের চলে যাওয়া দেখছিলো।রোকন।তার উজ্জ্বল চোখ আবারো ছলছল করছে।মাসকয়েকের না কাটা অযত্নের লম্বা চুলো গুলো উড়ে এসে বার বার তাঁর অশ্রুসিক্ত চোখ ঢেকে দিতে চাইছে,লুকাতে চাইছে পৃথিবীর কাছ থেকে।
রোকন মাহিনের কথার প্রতিটা শব্দ তাঁর মস্তিষ্কে কাঁঠালের আঠার মতো লাগিয়ে নিলো।
রোকন পিছনে ঘুরে চলে গেলো।সারাটা পথ সে অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিলো।ঘরে কিছু সামনেই এসে তাঁর অন্যমনস্কতা কাটলো।কিন্তু ততক্ষণে কিছুটা দেরী হয়ে গেছে।রাস্তা দিয়ে ধীর গতিতে যাচ্ছিলো এক প্রাইভেট কার।হঠাৎ রোকন তাঁর সামনে একটা চলন্ত গাড়ি আবিষ্কার করে প্রচন্ড রকমের ভয় পেয়ে গেলো এবং হাত থেকে প্যাকেটটি পড়ে গেলো।আর পড়লো একেবারে চাকা সোজাই।চালকও অন্য দিকে চেয়ে গাড়িটা চালাচ্ছিলো।কোনো বাড়ি খুঁজছিলো।হঠাৎ সামনে রোকনকে দেখে ব্রেক করতে করতে প্যাকেটটিকে পিষে দিয়ে গেলো গাড়িটি।প্যাকেটটি এখন চাকার নিচে।একেবারে ভর্তা হয়ে গিয়েছে।রোকন ততক্ষণে রাস্তার পাশে সরে গিয়েছিলো।রোকন আর নিজেকে সামলে রাখতো পারলো না।কেঁদেই ফেললো রাস্তায় বসে চাকার নিচে পড়ে থাকা প্যাকেটটির দিকে চেয়ে।
রাগে ফেটে পড়লো ড্রাইভার।বেড়িয়ে এসে রোকনকে ধমক দিতে যাবে এমনই সময় গাড়ির ভিতর থেকে একটা থমথমে গম্ভীর কণ্ঠ বলে উঠলো,'দীপ্ত!'
ড্রাইভার তৎক্ষনাৎ ঘুরে গিয়ে তড়িঘড়ি করে গাড়ির দরজা খুললো।আর গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন একজন স্যুট পরা লোক।রোকন দেখলো,লোকটা অনেক সুন্দর আর ফর্সা।চুলগুলো সিঁথি করে আঁচড়ানো।মুখে যা দাঁড়ি আছে তা বোধহয় না থাকলেও চলতো।অল্প কটা দাঁড়ি থুতনিতে।গুণলে বিশ-পঁচিশের বেশি বের হবে না।তাও রেখে দিয়েছেন লোকটি।এই আবছা আলোতেও সে লোকটির ডান ভ্রুর ঠিক মাঝখানে উপরে একটা ছোট তিল দেখতে পেলো।তাঁর ভ্রু খুবই ঘন।
লোকটি বেরিয়ে রোকনের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।তারপর ঘুরে রোকনের কাছে এলেন।রাস্তার যে পাশে রোকন আছে সেপাশে নয়ন আঁকনদের বাড়ির সীমানার দেয়াল।দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে কাঁদছিলো রোকন।কিন্তু লোকটিকে দেখে কান্না থেমে গেলো তাঁর।কিন্তু যখন লোকটি ঘুরে তাঁর দিকে আসছিলো তখন আবার তাঁর মাংস রুটির কথা মনে পড়লো।আবার চোখ থেকে গলগল করে পানি বের হতে লাগলো।লোকটি রোকনের পাশে বসে সেই চাকার নিচে পড়া প্যাকেটটির দিকে চাইলো।সেদিকে তাকিয়েই রোকনকে জিজ্ঞেস করলো,'কী ছিলো ওতে?'
রোকন কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,'মাংস রুডি।'
তারপর রোকনের উদ্দেশ্যে মোলায়েম স্বরে বললো,'বাসা কোথায় তোমার?'
রোকন বাঁ হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে আঙুল দিয়ে সামনের বাড়িটি দেখিয়ে দিলো।
লোকটি বাড়ির দিকে তাকালো।তারপর একটু করে কপাল কুঁচকে ওঁকে জিজ্ঞেস করলো,'তুমি কী নীলিমার ছেলে?'
রোকন একটু অবাক হয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।তারপর জিজ্ঞেস করলো,'আমনে মোর মায়রে চেনেন?'
এবার লোকটি একটু হেসে সেই স্যুট পরা অবস্থাতেই ময়লা রাস্তায় বসে পড়লেন।তারপর বললেন,'চিনি রে বাবা চিনি।চিনেও কেন যে অচেনা করে দিলাম।হয় তা না করলে তোর মায়ের এমন দূরাবস্থা হতো না।'
কিছুই বুঝলো না রোকন।নিরবতা ভেঙে সেই লোকটিই আবার বললেন,'ভালই হয়েছে তোমাকে পেয়েছি।নীলিমাকে ফেইস করার মতো সাহস আর সময় আমার নেই।'
লোকটি উঠে গিয়ে গাড়ির ভেতর থেকে একটি ল্যাপটপ বের করে আনলো।রোকন জানে যে ওটাকে ল্যাপটপ বলে।বছর দুয়েক আগে স্কুল থেকে একবার একটা বিজ্ঞান মেলায় নিয়ে গিয়েছিলো স্কুলের বিজ্ঞান ম্যাডাম নাইমা রহমান।সেখানে সে বিভিন্ন নতুন জিনিসের নাম জেনেছে।ল্যাপটপও ছিল সেখানে।
লোকটি ল্যাপটপটা রোকনের হাতে দিয়ে বললেন,'তুমি শুধু তোমার মাকে গিয়ে বলবে,"হলে একটি ভুল,
দেবো গোলাপ ফুল,
হলে দু'টি ভুল,
দেবো কানের দুল,
হলে বিশাল ভুল,
দেবো ভুলের মাশুল।"
মনে থাকবে?নাকি আবার বলবো?'
রোকন বললো,'না না,আর কওয়া লাগবে না।মোর মুখুস্তো করতে টাইম লাগে না।'
লোকটি বুকে হাত বেঁধে হেসে বললেন,'তাহলে বলো দেখি কী বলেছি আমি?'
রোকন স্যারের কাছে পড়া দেয়ার মতো করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অনর্গল বলে ফেললো,'হলে একটি ভুল,
দেবো গোলাপ ফুল,
হলে দু'টি ভুল,
দেবো কানের দুল,
হলে বিশাল ভুল,
দেবো ভুলের মাশুল।'
লোকটি রোকনের ডান কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বললেন,'বাহ!চমৎকার!তোমার স্মরণ শক্তি তো চমৎকার!'
রোকন একটু করে হাসলো।
লোকটি এবার তাঁর ড্রাইভার দীপ্তকে উদ্দেশ্য করে বললো,'যাও,গিয়ে ওঁর জন্যে কতগুলো মাংস রুটি নিয়ে আসো।ওঁকে সাথে নিয়ে যাও।তুমি চিনবে না হয়তো।আমিও মাংস রুটির না আগে শুনিনি।'
রোকনের হাত থেকে ল্যাপটপটা নিয়ে নিলো লোকটি।রোকন ড্রাইভারের সাথে গিয়ে তাঁর মাংস রুটি কিনে নিয়ে এলো।
লোকটি দেখলো,রোকনের সেই কাঁদো কাঁদো চেহারা আর নেই।এখন খুশিতে উজ্জ্বল।যেন এখনই খুশির আলো চারিদিকে ছড়িয়ে সব বেজায় আলোকিত করে দেবে।
রোকন আসামাত্রই ল্যাপটপটা রোকনের হাত্র দিতে রোকনের মাথায় একবার হাত বুলিয়ে গাড়িতে উঠে গেলেন লোকটি।দেখলে রোকন ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে ঘরের দিকে।একবার পিছনে ফিরে তাকালো সে।লোকটি হাত নেড়ে রোকনকে বিদায় জানালেন।সেই সঙ্গে ড্রাইভারও হাত নেড়ে বিদায় জানালো।
ড্রাইভারকে বললেন তিনি,'চলো এবার।'
ড্রাইভার বিনা বাক্যব্যয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে চললো।
গাড়ির ভিতরটা কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকলেও নিস্তব্ধতা ভেঙে দীপ্তই বললো,'শোভন সাহেব!এবার তো ওরা সারাজীবন সুখেই কাটাবে তাই না?'
বাইরের দিকে চেয়েই শোভন সাহেব বললেন,'হুম,যদি নীলিমার সেই কলেজ লাইফের পাসওয়ার্ডটা মনে থাকে তবে।তা না হলে কোনো ব্যাংক থেকেই কোনো টাকা বের করতে পারবে না।'
দীপ্ত আবার বললো,'কিন্তু শোভন সাহেব?আপনি এতটা শিওর কীভাবে হলেন যে আজ রাতেই আপনি খুন হবেন!'
অন্যমনস্ক শোভন সাহেব কোনো উত্তর দিলেন না।
দীপ্ত ভাবলো হয়তো খেয়াল করেননি,মৃত্যু চিন্তায় বিভোর হয়ে আছেন।তাই সে আবারো জিজ্ঞেস করতে যাবে তখনই শোভন বলে উঠলেন,'গাট ফিলিং দীপ্ত,গাট ফিলিং।আজকাল বোধহয় ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়টা খুব সক্রিয় হয়ে উঠেছে।'
কিছুক্ষণ চুপ রইলেন শোভন।তারপর আবার বললেন।
'বুঝলে দীপ্ত,মানুষের মৃত্যুর আগে মানুষের জীবনে বিভিন্ন পরিবর্তন আসে।আবার কারো কারো তো আরো বাঁচার ইচ্ছে জাগে।এই আমাকেই দেখো না।ছেলেটির মতো অমন ফুটফুটে চেহারার বাচ্চাকে সাথে নিয়ে বাঁচতে ইচ্ছে করছে।নীলিমাকে আবারো বুকে আগলে নিতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু আর যে ওঁদের ধারেকাছেও ঘেঁষা যাবে না।আমি জেনে শুনে ওঁদের বিপদ কী ডেকে আনতে পারি তুমিই বলো দীপ্ত?'
দীপ্ত বললো,'না,একদমই না।'
'তোমাকে তোমার বাসার এক কিলো আগেই নামিয়ে দেবো।তুমি চলে যেও।আমি একা যেতে পারবো।'দীপ্তর দিকে তাকিয়ে বললেন শোভন।
দীপ্ত কথাটায় কিছুটা উত্তেজিত হয়ে এক ঝলক পিছনে দেখে আবার সামনে তাকিয়ে বললো,'কিন্তু শোভন সা...!'
দীপ্তকে থামিয়ে শোভন বললেন,'শোনো দীপ্ত।আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে।এতে তুমি আমার সাথে না থাকলেও মরবো আর সাথে থাকলেও মরবো।মরবে তুমিও।এখন মরার সময় নয় তোমার।তোমাকে আরো এগিয়ে যেতে হবে নিজের জীবনে।তুমি খুব দক্ষ এবং বিচক্ষণ আর বুদ্ধিমান গোয়েন্দা দীপ্ত।ইউ আর রিয়েলি এক্সসিলেন্ট ডিটেকটিভ।'
দীপ্ত বললো,'কিন্তু শোভন সাহেব!মক্কেলকে বিপদের মুখে ছেড়ে আসা কী আদৌ শোভনীয়?'
শোভন দীপ্তর কথার জবাব দিলেন না।একরাশ কী যেন ভাবছেন।
দীপ্তকে বিদায় দিয়ে নিজেই ড্রাইভ করতে নিলেন শোভন।এদিকটা হাইওয়ে তাই থেকে থেকে গাড়ি আসছে।কখনো দূরপাল্লা বাস কখনো মাল বোঝাই ট্রাক।অন্যমনস্ক হওয়ায় বার দুয়েক রংওয়েও চলে গিয়েছিলেন শোভন।ভাগ্যিস খেয়াল হয়েছিলো।নইলে মালবোঝাই ট্রাক উড়িয়ে দিতো গাড়ি।
শোভন গাজী।শংকর ফার্মাসিউটিক্যালসের ম্যানেজার।যদিও তার অর্থের পরিমাণ ফার্মাসিউটিক্যালসের মালিকের অর্থেরও দ্বিগুণ।একজন ম্যানেজারের অর্থ-সম্পদ এত হতে পারে কীভাবে?বলছি।
ফার্মাসিউটিক্যালসের মালিকের তৈরি তিনটি ঔষধের ফর্মুলা তিনি দেশের বাইরে পাচার করেছেন।হ্যাঁ,আর এ কারণেই তাঁর খুন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।কিন্তু তা ফার্মাসিউটিক্যালসের মালিকের হাতে না।তিনি তো কবেই পটল তুলেছেন।এখন মালিক তাঁর ছেলে বিনয় শংকর।তাঁর পরিবারের কেউই জানেন না তাঁর ঐ আবিষ্কারের কথা।শুধুমাত্র তিনি ছাড়া আর কারো জানা নেই।তাই বিপদটা যাদের কাছে বিক্রি করেছেন তাঁদের হাতে।কারণ তিনি সেই ফর্মুলা একাধিক লোকের কাছে বিক্রি করেছেন।এটা পরস্পরের মধ্যে জানাজানি হবার পরই তাঁদের নিয়োজিত পেশাদার খুনিরা শোভনকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে।যদিও গাড়িতে শোভনের কাছে একটা রিভলভার আছে ফুল লোডেড।কিন্তু তা দিয়ে কজনকে ঠেকাবেন?তাঁকে মারতে তো আর এক আধজন লোক পাঠাবেন না।পাঁচজনে কম করে হলেও তিন-চারজন করে পাঠাবেন।
শোভন ফার্মাসিউটিক্যালসের মালিক বাহাদুর শংকরকে শায়েস্তা করতে আর নীলিমার প্রতিশোধ নিতেই মূলত ফর্মুলা চুরি করেছিলেন।কিন্তু,মানব মন,কী আর করার।লোভ চেপে বসলো।এতজনের কাছে বিক্রি করে দিলেন ফর্মুলাটা।কিন্তু একটাকাও হজম করতে পারলেন না।যাক,তাতেও দুঃখ নেই।তাঁর প্রাক্তন নীলিমা তো পারবে।দীপ্তর দ্বারা খোঁজ নিয়ে জেনেছিলেন যে নীলিমার স্বামী বছর দুয়েক আগে যখন জানতে পারলো নীলিমার কোনো জটিল রোগ হয়েছে,বাঁচবে না বেশিদিন,তাই সে অন্যত্র চলে গেলো,গিয়ে আরেক মেয়েকে বিয়ে করে শান্তিতেই আছে।একটিবারের জন্য খোঁজও নেয়নি প্রথম স্ত্রী আর সন্তান তিনজনের।আর তখনই সেও উপলব্ধি করলেন যে তাঁর মৃত্যু কাছাকাছি।তাই সে তাঁর উপার্জিত সকল টাকা দিয়ে এলেন নীলিমাকে।
শোভন এতটাই অন্যমনস্ক যে তাঁর পিছনে যে একটি ট্রাক তেড়ে আসছিলো তা খেয়ালই করেননি।ট্রাকটা শোভনের গাড়িকে ধাক্কা দিবে,আর মাত্র চার ইঞ্চি এগোলেই ধাক্কা লাগবে।সামনে একটা স্পিড ব্রেকার,সেটার উপরে চাকা পড়তেই শোভন একটা কোমল উষ্ণতা অনুভব করলেন সারা শরীর জুড়ে।সাসপেনশনের সাথে লাগানো বোমা সাসপেশনের উপর চাপ পড়ায় বিস্ফোরণ ঘটলো।এতই ভয়ানক এবং শক্তিশালী বিস্ফোরণ ছিল যে পিছনের ট্রাকটিও বিস্ফোরণের শিকার হলো।নিশ্চিহ্ন হয়ে গেকো শোভনের শরীর।সেই সঙ্গে ট্রাক ড্রাইভার ও তার পাশে বসা রাশিয়ানেরও।তবে রাশিয়ানের মাথার বাদামী চুল গুলোর কিছু অংশ রয়ে গেলো অক্ষত।
<>
দীপ্তর হাতে একটা মোটা ফুলে থাকা খাম ধরিয়ে দিয়েছেন।নিসন্দেহে টাকার বান্ডিল।এক লক্ষ টাকা বোধহয়।তেমনই কথা ছিল শোভন সাহেবের সাথে।কিন্তু এখন সেটা হাতে রাখতেও তাঁর বড্ড অস্বস্তি লাগছে।মানুষটা কখন মারা যান তার ঠিক নেই।তাঁকে বাঁচানোর জন্যে সে কিছুই করতে পারছে না।যে মানুষটা নিশ্চিত মরে যাবে আর যাকে বাঁচানোর জন্যে সে কিছুই করছে না তাঁর দেয়া টাকা রাখতে খুব খারাপ লাগছে দীপ্তর।তাঁর এখন কী করনীয়!সে হাঁটছে আর ভাবছে গভীর ভাবে।তারপর কী মনে করে টাকা সমেত খামটা রাস্তার জঙ্গলে ফেলে দিলো দীপ্ত।তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে হেঁটে চললো নিজের গন্তব্যে।কিন্তু কিছুদূর হেঁটে আর হাঁটতে ইচ্ছে করছিলো না তাঁর।একটা বাস আসতে দেখে হাত দেখিতে থামিয়ে উঠে পড়লো বাসে।
*
গত সাড়ে সাত ঘন্টা ধরে অজ্ঞান হয়ে জঙ্গলে পড়ে ছিলো আশিক।সারা শরীর জুড়ে ময়লা।নাক বেকে পড়া রক্ত শুকিয়ে গিয়েছে।লাঠির ভয়ানক আঘাতে জামা অব্দি ছিঁড়ে গিয়েছে।শ্যামলা চেহারার আশিক কিছুটা হ্যাঙলা।পাঁচ-ছদিনের শেভ না করা দাঁড়ি।ইটের গুড়ো লেগে চুল দাঁড়ি লাল হয়ে আছে।শ্যামলা হলেও মুখমণ্ডলের ত্বকে খুবই পরিষ্কার আর কোমল।তা হলে কী হবে?ঘুষির আঘাতে ঠোঁট,কপাল,গাল ফেটে ফুলে গিয়ে এক বীভৎস রূপের সৃষ্টি করেছে।এমনিতে আশিকের মুখমণ্ডলের গঠন অনেক সুন্দর।
জ্ঞান ফেরার পর সে চোখ মেলে দেখলো মেঘে ঢাকা চাঁদের হালকা অবয়ব।আকাশে আজ চমৎকার তারা দেখা যাচ্ছে।উঠার জন্য মনস্থির করলো সে,তখনই যেন আকাশ থেকেই একটা আয়তক্ষেত্রের মতো কিছু একটা ঠিক তাঁর মুখমণ্ডলের উপর পড়লো।ফাটা নাকের উপর পড়া ব্যাথা সে ককিয়ে উঠলো।সে বাঁহাতি তা বাঁ হাত দিয়েই মুখ থেকে ওটা সরাতে যাবে কিন্তু দেখে বাঁ হাতের আঙুল একটাও নাড়াতে পারছে না।বোধহয় সব ভেঙে গিয়েছে।ডান হাতেও তিনটে অবশ।ডান হাত দিয়ে সেটা উঠিয়ে নিয়ে নিজেও কোনোরকম উঠে বসলো।সারা শরীর জুড়ে প্রচন্ড ব্যাথা।উঠতে উঠতে,আঃ মা বলে ককিয়ে উঠছিলো আশিক।প্রতিটা আঘাত তার চামড়ার সাথে সাথে যেন পেশিগুলোকেও ফাটিয়ে দিয়েছে।আশিক দেখলো,তাঁর মুখের উপর যেটা উড়ে এসে পড়েছিলো সেটা একটা খাম।খামের মধ্যে মোটা কী যেন আছে।খাম খুলে তো তাঁর সারা শরীর অবশ হয়ে গেলো।ব্যাথাতেও এতটা অবশ হয়নি তাঁর শরীর,যতটা হয়েছে একটা কাগজ আর এক বান্ডিল টাকা দেখে!না,টাকা না,ইতালীয়ান নোট এগুলো।সে চেনে এই নোট।কারণ তাঁদের পাশের বাসার শাকিল ভাই ইতালীতে থাকেন।তাঁর কাছে এমনই নোট দেখেছিলো সে।জিজ্ঞেস করায় বলেছিলেন যে ওগুলো ইতালীয়ান টাকা।কিন্তু টাকা না,এগুলোকে ডলার বলা হয় বোধহয়।এখানে কম করে হলেও এক লক্ষ ডলার আছে।
আশিক কাগজটা খুললো।A4 সাইজের কাগজে কয়েক লাইন লেখা।তাও টাইপ করে।
'তুমি আমার জন্যে অনেক করেছো।এগুলো ওঁদের দিতে পারতাম না।কারণ ওঁরা সাধারণ বোকাসোকা মানুষ।এগুলো নিয়ে কোথাও বিক্রি করতে গেলেই ওঁদের চোর বলে আখ্যায়িত করবে।তাই এগুলো তোমায় দিয়ে যাচ্ছি।তুমি যথেষ্ট ভাল একজন মানুষ।আগেই সামনাসামনি বললে তুমি নিতে চাইতে না।তাই চিঠিতে বলে দিলাম।
শহরের উত্তরে গিয়ে শহর ছাড়িয়েও আরো দশ কিলোমিটার সামনে গেলেই নদীর পাড়ে একটা ভাঙাচোরা বাগানবাড়ি দেখতে পাবে।সেটা আমার বাগানবাড়ি।আমি ছাড়া কেউ ওখানে যায় না আর জানেও না যে ওটা আমার বাগানবাড়ি।একটাই রুম।ঢুকে আমার খাটের ঠিক মাঝ বরাবর নিচে একটা মোটা কালো সুতো দেখতে পাবে।সেটা টান দিলেই কিছুটা মাটি উঠে আসবে।মাটি উঠে সরে গেলে একটা লোহার হাতল দেখতে পাবে।সেটা একটা লোহার বাক্সের ঢাকনা।টান দিলেই ঢাকনা খুলে যাবে আর তাতে পাবে স্বর্ণমুদ্রাসহ কিছু হিরেও।তুমি ছাড়া আমার আর কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী নেই বলে তোমাকেই দিয়ে দিচ্ছি এসব।এখন বাকিটা তোমার উপর।ইচ্ছে হলে রাখো,নয়তো দিয়ে দাও যাকে ইচ্ছে তাঁকে।'
আশিকের শরীরের ব্যাথা যেন নাই হয়ে গিয়েছে।চটপট উঠে দাঁড়ালো সে।এই চিঠিই যেন তাঁর জন্যে মেডিসিন ছিল।ব্যাথা প্রশমনের কাজ করলো।
ইতালীয়ান মুদ্রাগুলো আবার খামে ঢুকিয়ে কোনোরকম রাস্তায় উঠে খোঁড়াতে সামনে এগোতে লাগলো আশিক।
হাত দিয়ে কত গাড়িকে থামতে ইশারা করলো সে কিন্তু কোনোটাই থামলো না।পাত্তাই দিলো না আশিককে।বোধহয় তাঁর গোবেচারা গোছের মুখ দেখে তাঁকে পাগল ভেবেছে সবাই।
আশিক তাই স্থির করলো সে হেঁটেই যাবে।তাছাড়া আর কিছুই করার নেই তাঁর।
সে এখন শহরের দক্ষিণ দিকে আছে।শহর থেকে এক কিলোমিটার দূরে।তাঁর আগে চিকিৎসা দরকার।বজ্জাত গুলো এমনভাবে মেরেছে যে চিকিৎসা না করালে ক্ষতস্থানে ইনফেকশন হবে।তাছাড়া নাজানি কতঘন্টা ময়লা ধুলোর মধ্যে পড়ে ছিল কে জানে।
আশিকের কোনো দোষ ছিল না।শুধু সে একজন দূর্বল হাড্ডিসার চোরকে বাঁচাতে চেয়েছে বলে চোরের সাথে সাথে তাঁকেও খুব মেরেছে।খুবই হ্যাঙলাপাতলা এক পকেটমার ছিল বাসে।একজনের পকেট থেকে মানিব্যাগ চুরি করতে দেখে ফেলেছিলো পিছনে থাকা এক অবসরপ্রাপ্ত আর্মির সৈনিক।দেখামাত্রই খপ করে হাত ধরে ফেলেছিলেন চোরের।আর সে চোরও যেই পকেটে হাত দিয়েছিল তিনি ছিলেন একজন পুলিশের ওসি।বদলি হয়েছে বলে যাচ্ছিলেন গন্তব্যে।পকেট মারার অপরাধে তাঁর ব্যাগ থেকে নিজের একটা মসৃণ তেলতেলে লাঠি বের করে বেদম প্রহার শুরু করেছিলেন।তখন আশিক বাঁধা দিয়ে মাফ করতে বলে আর বোঝায় যে হয়তো খুবরকমের বিপদে পড়েই এই কাজ করেছে।কিন্তু তা শোনার কোনো ইচ্ছে বোধহয় ছিল না ওসি আর অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকের।ওসির হাত থেকে লাঠিটা নিয়ে আশিককে চোরের চেয়েও বেশি মারলেন চোর বলে।কারণ সে আর আশিক পাশাপাশি বসেছিল।সবাইকে তাঁরা একে অপরের সাথে মিলিত বুঝিয়ে প্রচুর মারলো আশিককে।তাছাড়া বাসে ওঠার আগে আশিকের সিটে সেই সৈনিক বসেছিলেন।আশিককে বলেছিলেন যে সে যেন তাঁর সিটে গিয়ে বসে।তাঁর জানালার পাশের সিট দরকার ছিল কিন্তু কাউন্টার থেকে দেয়া হয়নি তাই সে এখানে বসেছে।কিন্তু আশিক নাছোড়বান্দা।সে তাঁকে সেখান থেকে উঠিয়ে ছাড়লো।সেই থেকে সৈনিক আশিকের দিকে হিংস্র নজরে বার বার দেখছিলো।যেন সুযোগ পেলেই ছিঁড়েখুঁড়ে খাবে।আর সেই সুযোগ পেয়েও গিয়েছিলো।সুযোগের সৎ ব্যবহার করে ফেলেছেন অনতিবিলম্বে।
আঘাতের ব্যাথায় সারা শরীর জমাট বেঁধে গিয়েছে আশিকের।তবুও কোনোরকম হেঁটে চলছে।হাতে তাঁর ঘড়ি আছে কিন্তু ক'টা বাজে তা বোঝার উপায় নেই।লাঠির আঘাতে ঘড়ির উপরিভাগের কাঁচ ফেটে চৌচির।তাই কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না।আশিক খামটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে নিয়েছে।তাঁর মানিব্যাগ,মোবাইল কেউ নিয়ে গেছে।তবে টাকা সব মানিব্যাগে ছিল না।আন্ডারওয়্যারেই রাখে বেশিরভাগ।যখন সে ট্রাভেল করে।খুঁজে দেখলো সব টাকাই আছে ঠিকঠাক।যদিও সে এখন অনেক অনেক টাকার মালিক।শাকিল ভাইয়ের কাছে শুনেছে ইতালীর একটা মুদ্রার দাম বাংলাদেশে ১০০ টাকা!তাহলে এক লক্ষ টাকা হিসেব করলে দাঁড়ায় দশ লাখ!খুশিতে আর উত্তেজনায় আশিকের বুক এতই ভরে গেলো যে তাঁর একটু শ্বাসকষ্টও হলো।সে বার বার পিছনে তাকাচ্ছিলো।যদি কোনো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।একটি পিকাপ আসছিলো।একদম খালি।বোধহয় ডেলিভারি শেষ করে ফিরে আসছে।হাত দিয়ে ইশারা দিলো আশিক আর ফিল্মি স্টাইলে বললো, 'লিফট!লিফট!'
আশিককে পাগল ভেবে প্রায় উপেক্ষা করেই যাচ্ছিলো পিকাপটি,কিন্তু তাঁর কাছ থেকে শোনা 'লিফট' শব্দটি শুনেই সহকারী ড্রাইভারকে বললো গাড়ি থামাতে।থামলো,আশিক কাছে গিয়ে অসহায় সুরে বললো,'ভাই,খুব বিপদে পড়েছি।আমারে মেরে আবার মানিব্যাগ,মোবাইল নিয়ে গেছে ওঁরা।শরীরটা খুবই খারাপ।যদি কাছেপিঠের কোনো হাসপাতালে নামিয়ে দিতেন তাহলে খুব উপকার হতো ভাই।'
আশিকের এই অসহায় ভাষণে দুজনেরই মন গলে জল হয়ে গেলো।তাঁরা পিছনে উঠতে নির্দেশ দিলেন।
একটি সরকারী হাসপাতালের সামনে আশিককে নামিয়ে দিয়ে গেলো তাঁরা।রাত তখন সোয়া দুইটা বাজে।এত রাতে ইমার্জেন্সি বিভাগ খোলা পাওয়ার আশা করছেই না আশিক।সে হাসপাতালের করিডোরে দেয়াল হেলান দিয়ে বসে পড়লো।সে খামটাও তাঁর আন্ডারওয়্যারে ঢুকিয়ে নিয়েছে।বসার একটু পরই চোখ লেগে এলো ওঁর।ঘুমিয়ে পড়লো।
ঘুম ভাঙলো ঘাড়ে সিকিউরিটি গার্ডের লাঠির গুতায়।এমন কাণ্ডে আশিক খেঁকিয়ে উঠে বললো,'কেমন জ্ঞান বোধহীন বলদ আপনি?একজন জখমপ্রাপ্ত আহত লোক শুয়ে আছে কোথায় তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন তা না করে লাঠি দিয়ে গুতাচ্ছেন?বেকুব নাকি আপনি?'
সিকিউরিটি গার্ডটি আশিকের কথায় যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো।হাতের লাঠিটি উঁচিয়ে আশিককে মারতে চেয়েও পারলেন না।পিছন থেকে কে যেন লাঠিটি ধরে ফেলেছে।আশিক দেখলো জিন্সের উপর ফুলহাতা ব্রাউন চেক শার্ট ইন করা আনুমানিক ছাব্বিশ-আঠাশ বছর বয়সের এক ছেলে লাঠিটি ধরেছে সিকিউরিটি গার্ডের।গার্ডটি তাঁর দিকে ঘুরতেই কষিয়ে একটা চড় বসালেন গার্ডের গালে।চড় মেরেই বললেন তিনি,'উনি তো ঠিকই বলেছেন।তাতে বুনো ষাড়ের মতো ক্ষেঁপে ওঠার কী আছে?'
সিকিউরিটি গার্ডটি কোনো কথা বললো না।রাগী চোখে আশিকের দিকে তাকিয়ে চলে সেখান থেকে।
ছেলেটি কাছে এসে আশিককে ধরে দাঁড় করালো।এবার আশিক ভাল করে দেখলো তাঁকে।যথেষ্ট ফর্সা।যেন রোদের ছোঁয়া গায়ে লাগতেই দেন না।ইনি ডাক্তারই হবে হয়তো।যেহেতু গার্ডটিও তাঁকে সমঝে চলে।ক্লিন শেভড।চুল গুলো সুন্দর করে আঙুল দিয়ে আঁচড়ানো।মেদহীন শরীর,টাইট শার্টে শরীরের অবয়ব বোঝা যাচ্ছে।ভাসা ভাসা চোখ,কিন্তু চশমা পড়েননা।গোলগাল মুখ,থুতনির মাঝখানে খাঁজ আছে।অবশ্যই ব্যায়াম করেন রেগুলার।এককথায় সুপুরুষই বলা চলে তাঁকে।
খুবই বিনয়ের সঙ্গে আশিককে জিজ্ঞেস করলেন তিনি,'কী হয়েছে আপনার সাথে?'
আশিক বললো,'ছিনতাই।'
'আচ্ছা।',
আশিককে ইমারজেন্সীতে নিয়ে যাওয়া হলো।
তারপর সেই লোকটি নিজে থেকেই বললেন,'আমার নাম প্রণয়।যদিও কার্ডিওলজি বিভাগের ডাক্তার।কিন্তু এখন আপনার জন্যে আমি কম্পাউন্ডার।কারণ হাসপাতালে এখন কোনো কম্পাউন্ডার নেই।'
আশিক কৃতজ্ঞতার সুরে বললো,'আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ভাই।আপনি যথাযথ সময়ে না এলে এই মার খাওয়া শরীর আর ঐ লাঠির আঘাত সহ্য করতে পারতো না।'
ডাক্তার প্রণয় বললেন,'ওসব কথা বাদ দিন।লোকটা একটু বিদঘুটে প্রকৃতির।আপনি আপনার জামা কাপড়গুলো খুলে ফেলুন তো।নিচে আন্ডারওয়্যার আছে?'
আশিক,'জ্বী আছে।তবে...।'
ডাক্তার প্রণয়,'তবে কী?'
আশিক,'টাকা আছে সাথে কিছু,ওগুলো কোথায় রাখবো?'
ডাক্তার প্রণয় আশিককে আশ্বাসের সুরে বললেন,'ও নিয়ে ভাবার দরকার নেই আপনার।'আপনার কাছেই রাখবো।দরকার হলে আপনার বালিশের নিচেই থাকবে।'
ডাক্তারের আশ্বাসে আশিক কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো।
প্রণয় ড্রেসিং শেষ করে ব্যাণ্ডেজ করতে করতে বললো,'কতটা পাষণ্ড ওরা।কী বাজে ভাবেই না মেরেছে আপনাকে।'
আশিক কিছু বললো না।
ব্যাণ্ডেজ শেষ করে ডাক্তার তাঁর জন্যে কিছু খাবার নিয়ে এলেন।স্যুপটি খেতে পারলেও বাকি খাবার গুলো খেতে পারলো না আশিক।গালে লাঠির আঘাত লাগায় চোয়ালে খুব ব্যাথা তাঁর।তাই চিবোতে কষ্ট হয়।স্যুপটি খেয়ে সোজা হয়ে শুয়ে পড়লো আশিক।পরক্ষণেই তাঁর চোখ লেগে এলো।ঘুমিয়ে পড়লো সে।
বিকেল সোয়া চারটা নাগাদ তাঁর ঘুম ভাঙলো।শরীরটা একটু চনমনে লাগছে তাঁর।বেড থেকে নেমে দাঁড়ালো সে,শরীরের দূর্বলতা আগের চেয়ে কমেছে অনেকটা।সে দ্রুত বালিশের নিচে খাম আর টাকা গুলো আছে কিনা দেখে নিলো।হ্যাঁ আছে।খামের মধ্যকার ইতালীয়ান ডলারগুলোও আছে।সেই সঙ্গে চিঠিটাও।আশিক তড়িঘড়ি করে জামাকাপড় পড়েই বের হয়ে এলো হাসপাতাল থেকে।সেই ডাক্তারের সাথে দেখা করা তো দূর কারো সাথে একটি কথা পর্যন্ত বললো না।
একটি সিএনজিতে উঠে সে মার্কেটের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।তাঁর নতুন জামা কামড় দরকার।তাঁকে ভিখিরির মতো লাগছে এমন অবস্থায়।সিএনজি ভাড়া মিটিয়ে সে একটি ব্রান্ডের জামা-কাপড়ের শোরুমে ঢুকে গেলো।একটি শার্ট আর একটি প্যান্ট কিনে ট্রায়াল রুম থেকে চেঞ্জ করে ময়লা জামা-কাপড় গুলো হাতে নিয়ে বিল পরিশোধ করে বেরিয়ে এলো সে।
এবার তাঁকে যেতে হবে ব্যাঙ্কে।কিছু ডলার এক্সচেঞ্জ করে টাকা করতে হবে।
শহরটা তাঁর চেনা।গত আড়াই বছর ধরে সে এখানে আছে।ভার্সিটির মৃত্তিকা বিভাগের ছাত্র সে।তাই তাঁর ব্যাঙ্ক খুঁজে পেতে সমস্যাই হলো না।কাপড়ের দোকানের বিপরীতেই একটু ডান পার্শে দোতলায় ব্যাঙ্ক আছে।দ্রুতবেগে তবে সাবধানে সে ব্যাঙ্কে চলে গেলো।বার বার আশেপাশে চতুর্দিকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করছে সে।যদি কেউ তাঁকে ফলো করে!তাঁর কাছে এখন দশলক্ষ টাকা আছে।তাই তাঁর মনে এক অজানা ভয়ের সৃষ্টি হয়েছে।
আশিক ব্যাঙ্কে ঢুকে গেলো।সে আপাতত দু'শো ডলার এক্সচেঞ্জ করবে।তাতে হয় বিশহাজার টাকা।সে দু'শো ডলার ট্রায়াল রুমে থাকতেই আলাদা করে রেখেছিলো।কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো।১৬-১৭ জন পুরুষের একটা লাইন ছিল এক্সচেঞ্জ কাউন্টারে।সবাই বিদেশী টাকা এক্সচেঞ্জ করতে এসেছে।ঠিক তার পাশেই একাই দাঁড়িয়ে আছে একজন।লাইন ছাড়া।পিছন দেখে আশিক তাঁকে প্রথমে বিদেশী ছেলেই ভেবে নিয়েছিলো।কারণ তাঁর পরণে আছে একটা ছাই রঙের গেঞ্জি,বাদামী রঙে থ্রি কোয়ার্টার।আর তাঁর উচ্চতাও আনুমানিক ছয় ফুট এক কিংবা দুই।সে টাকা নিয়ে ঘুরে চলে আসছিলো তখন তাঁকে সামনে থেকে দেখলো আশিক।তাঁর চেহারা দেখেও বোঝার উপায় নেই সহজে।অনেকেই হয় মাকুন্দা।আর তাঁর চেহারাতেও ছিল কঠোরতার একটা গভীর ছাপ।বাংলাদেশে বোধহয় অনেকদিন থেকে ঘুরছেন,তাই এদেশের কাঠফাটা রোদে পুড়ে চামড়ায় কালোত্বের আস্তরণ পড়ে গিয়েছে।চুলও সব ছোট ছোট।সে যে একজন নারী তা আশিক বুঝলো তাঁর বুকের দিকে তাকিয়ে।এক দৃষ্টিতে তাঁর দিকেই তাকিয়ে ছিলো আশিক,তাকিয়ে তাঁর চলে যাওয়া দেখছিলো।আসলে আশিক এর আগে কখনো সামনাসামনি কোনো বিদেশী নারীকে দেখেনি।কিন্তু ওদিকে সামনে থেকে অনেকটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিলো।প্রায় আট-নয়জন টাকা নিয়ে চলেও গিয়েছে।আশিকের পিছনে থাকা প্রকাণ্ড ভুড়ির অধিকারী চল্লিশের কাছাকাছি আধবুড়ো লোকটার ধাক্কায় আশিকের জ্ঞান ফিরলো।আশিক সামনে এগোলো।
টাকা নিয়ে বেরিয়ে এলো সে।চারদিকটা আবার ভালো করে দেখছে।কেউ তাঁর দিকে নজর রাখছে কিনা।নাহ,কেউ রাখছে না।সবাই নিজের মতো ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে।নিজের জীবন নিয়ে।আশিকের জীবনে কী চলছে তা নিয়ে এখানে কারো মাথা ব্যাথা নেই।কেউ জানতেও চায় না আশিকের মনে এখন আনন্দের মাত্রা কতটুকু।কারো জানার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।
আশিক শহরের উত্তরের বাসস্ট্যান্ডে যাবার জন্যে সিএনজিতে উঠলো।যেতে বড়জোড় ৭-৮ মিনিট সময় লাগলো।
সিএনজি থেকে নেমে ভাড়া দিয়ে এবার এগোলো বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষমান বাইকওয়ালাদের দিকে।
একজনের বাইকে উঠে বললো,'সামনেই কিলো দশেক দূর যেতে হবে,চলো।'
'ঠিকাছে ভাই।',বাইক চালকও আর কথা না বাড়িয়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে ছুটে চললো।
আশিক তাকিয়ে আছে রাস্তায় পাশে পাশে।কোথায় ভাঙাচোরা একটা বাগানবাড়ি পাওয়া যাবে।দেখতে দেখতে দূর থেকেই তাঁর চোখে পড়লো একটা বাঁশের বেড়ার তৈরি ছোট একটা মুরগীর খোপের মতো ঘর।আশেপাশে বিভিন্ন ফুলগাছ।ঐ দূরে থাকাবস্থাতেই সে নামলো।যদি সন্দেহ করে ওটার সামনে নামলে।আর সন্দেহের বশে যদি সেও আশিকের পিছু পিছু ঘরে ঢুকে সোনাদানা দেখে ফেলে!তাহলে তো আশিককে মেরেও ফেলতে পারে।এরা খুব বাজে রকমের বর্বর হয়।এমনিও লোকটার শরীর থেকে বোটকা একটা ঝাঁঝালো গন্ধ আসছিলো।সে গন্ধটা চেনে আশিক।গাঁজার গন্ধ।নেশাগ্রস্থ মানুষের এমনিও হিতাহিত জ্ঞান থাকে না।
তাই সে মূল গন্তব্যেরও অনেক আগে নামল বাইক থেকে।ভাড়া মিটিয়ে আশপাশ ঘুরতে লাগলো।লোকটাকে বুঝাতে চাইলো যে সে এখানে শুধুমাত্র ঘুরতেই এসেছে।আর কোনো কারণ নেই।লোকটা বাইক ঘুরিয়ে চলে গেলো।আশিকও আস্তে আস্তে ঘরটির দিকে এগোলো।তাড়াহুড়ো করলো না মোটেই।কারণ জলদির কাজ শয়তানের।যদিও এটাও শয়তানি।আরেকজনের মাল সে হাতিয়ে নিচ্ছে।কিন্তু এটা অপরাধ না।এর মালিক নিজেই বলেছেন যে চাইলে সে রাখতে পারে নাহলে দানও করে দিতে পারে।আর সেই লোক দানও করেছে।অতএব এটা সম্পূর্ণ আশিকের।এর মালিকানাধীন আশিকের।প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এলো।এখনো আলো বাকি আছে।শরৎের গোধূলি।অপূর্ব সুন্দর ডোরাকাটা মেঘ আকাশে।পড়ন্ত সূর্যের আশেপাশের মেঘগুলো নানান রঙের।লাল,হলুদ,সবুজ,কালো।সূর্যটা যেন অগ্নিকুসুম।বহুদিনে দেখা হয় এমন গোধূলি।সারাদিন রাত পড়াশোনা আর টিউশনি করিয়ে করিয়েই কেটে সময়।আমরা অগাধ সীমাহীন শিক্ষার ভাণ্ডার পৃথিবীকে দেখি না,দেখি সীমাবদ্ধ শিক্ষার বই।
আশিক রাস্তা দিয়ে নেমে এলো বাগান বাড়িতে।রাস্তা থেকে আনুমানিক পঁয়তাল্লিশ কী পঞ্চাশ হাত দূরে হবে বাগানবাড়িটি।ফুল গাছে ভরা উঠোন।বিভিন্ন ধরণের ফুল।কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো এতগুলো ফুল গাছের মধ্যে কেন একটি বেগুন গাছ!গাছে বেগুনও আছে।তিনটে লম্বা লম্বা।ঘরের কাছে এগোতেই মাঝখানের বেগুনটার গায়ে স্মাইলিটা স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠলো।বেগুনটার একদম কাছে গিয়ে দেখলো স্মাইলিটা বেশি পুরোনো নয়।আজকেরই।তা নিয়ে অতটা ভাবার সময় আশিকের নেই।আশিককে এখন সোনাদানা যা আছে তা নিয়ে চম্পট হতে হবে।
দরজাটা ঠেলে খুলে ভিতরে ঢুকলো দরজার সামনে মাটি সামান্য উঁচু।মনে হলো এই মাটি নতুন।ঘরের অন্যান্য স্থানের মাটির সাথে এই মাটির মিল নেই।কিন্তু এসব নিয়ে তেমন মাথা ঘামালো না আশিক।ভিতরে এগোলো আশিক।সামনে পা রাখতেই ক্লিক শব্দ হওয়ায় সে চারপাশে তাকিয়ে ইঁদুর খুঁজলো।না দেখে ঘরের দিকে নজর দিলো।ঘরে তেমন আসবাবপত্র নেই।এক কোণে একটি খাট,খাটের উপর ভাজ করা তোশক।পাশে টেবিল চেয়ার।আরেক কোণে মাটির কলস।আর দরজাটা সে বেড়াতে লাগানো সেই বেড়ায় ঠিক মাঝ বরাবর একটি আয়না।
আশিক গোছানো তোশকের উপর একটি ভাঁজ করা কাগজ দেখতে পেলো।খাটের কাছে গিয়ে কাগজটা খুলে কিছু দেখলো,'বোকা বানানোর জন্যে দুঃখিত দীপ্ত।আসলে শোভন যে চালাকিটা বিভিন্ন দেশের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি প্রধানদের সাথে করলো তাতে আমার রাগ নেই।কিন্তু আমার রাগটা হলো ওঁ কেন আমার বাবাকে ধোকা দিলো!ঐ ফর্মুলা মালিক আমার বাবার পরে আমি ছিলাম।কিন্তু সে নিজে তো মরলোই সাথে সাথে আমারো ভাত মারলো।তুমি অনেক কিছু জেনে ফেলেছিলে।তোমাকেও মরতে হবে।তুমি এখানে যা নিতে এসেছো তা আমি আগেই নিয়ে নিয়েছি।কারণ ওগুলোর প্রতি অধিকার আমার।তোমার নয়।অতএব তুমি এবার নিশ্চিন্তে মরো।ভাবছো মরবে কীভাবে?আশেপাশে তো কাউকে দেখোনি।অত ভাবতে হবে না।দরজার ওখানে মাটির নিচে টাইম বোমা সেট করে রেখেছি।তোমার পায়ের চাপেই অন হয়ে গিয়েছে।ওটা টাইমার দিয়ে...।'
বিকট আওয়াজ তুলে বিস্ফোরণ ঘটলো।বাড়ি বাগান সবকিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো।সেই সঙ্গে আশিকও।
<>
দীপ্ত সকাল সকাল উঠে আগে যোগ ব্যায়াম করে।একজন গোয়েন্দাকে সবসময় ফিট থাকতে হয়।শরীর ও মনের উপর সম্পূর্ণ কাবু রাখতে হয়।যদিও তা সবাই পারে না।দীপ্তও পারে না।যোগ ব্যায়াম শেষ করে তাঁর রুমে কফি আর টিভি অন করে নিয়ে বসেছে দীপ্ত।প্রথম চুমুকেই বিষম খেয়ে কাশতে লাগলো দীপ্ত।টিভিতে খবরে মূল হেডলাইন দেখে তাঁর চোখ ছানাবড়া।শোভন সাহেব মারা যাবেন তা জানতো দীপ্ত।কিন্তু তাই বলে এত দ্রুত?কাল রাতেই!ভাগ্যিস,শোভনকে নামিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।নয়তো এখন নিজের রুমে বসে কফি না,স্বর্গে বসে মেঘ চিবোতে হতো।দীপ্ত আর দেরী করলো না।দ্রুত কফিটা শেষ করেই জামাকাপড় পাল্টে বেরিয়ে পড়লো।
'স্যার,সামনে আর যাওয়া যাইবে না।জম্মের জ্যাম।',বললো সিএনজিওয়ালা।
দীপ্ত নেমে ভাড়া দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো।তাঁকে আধ কিলোমিটারেরও বেশি হাঁটতে হলো।যা ভীড় স্পটে,উঁকি দেয়ারও জোঁ নেই।দীপ্তকে মোটামুটি অনেকেই চেনে পুলিশে।তাই তাঁর ভীড় ঠেলে ভিতরে ঢুকতে সমস্যা হলো না।তাঁকে দেখে ওসি বদরুল উদ্দিন এগিয়ে এসে হ্যাণ্ডশেক করলেন।
'এমন ফাটা ফেটেছে শালার বোমাটা,ট্রাকের মাথা গো নব্বইভাগ খুইয়েছে।আর সামনের এটা অবশ্যই প্রাইভেট কার,এটা তো টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে।তা দীপ্ত বাবু,আপনি কী বুঝছেন?'থুতনি চুলকোতে চুলকোতে জিজ্ঞেস করলেন বদরুল উদ্দিন।
দীপ্ত একজন বিজ্ঞ গোয়েন্দার মতো করে বললেন, 'নিসন্দেহে বোমাটা খুবই উন্নত এবং শক্তিশালী ছিল।আর ট্রাকটা গাড়ির সংস্পর্শেই ছিল বোধহয়।হয়তোবা এক্সিডেন্ট হতে যাচ্ছিলো এই দুটোর একটার ভুলে।আর ঠিক তখন আরেক এক্সিডেন্ট নিজের বাঁ হাত ঢুকিয়ে দিলো এঁদের মধ্যে।'
দীপ্তর কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বদরুল উদ্দিন বললেন,'যথার্থ বলেছেন দীপ্ত বাবু।তবে আমাদের বুঝতে বেগ পেতে হবে যে এগুলো কাদের মৃত দেহ।ক'টাই বা আছে এখানে।আর কে ট্রাকে ছিল আর কে প্রাইভেট কারে।সব দেহ যে গলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে।'
বদরুল সাহেব তাঁর হালকা চুলওয়ালা মাথা একটু চুলকে নিলেন।
লোকটার বয়স তেপ্পান্ন হলেও চেহারা সুরুতে তাঁকে তেষট্টি বছরের লাগে।ঘুষ খেয়ে খেয়ে আর বসে বসে ঝিমাতে ঝিমাতে শরীরের হাড়গোড়ে মরিচা পড়ে গিয়েছে।সেই সঙ্গে শরীরের উপরীভাগে বাসা বেঁধেছে বার্ধক্যের ছাপ।দীপ্তর মনে হয়,লোকটার বয়স যত বাড়ে ততই যেন তার গম্ভীর বজ্রকণ্ঠ আরও গম্ভীর আর ভয়ানক হয়ে যায়।
দীপ্ত আর এখানে থাকতে পারছে না।তাঁর গা গুলিয়ে বমি আসছে এসব দেখে।যে লোকটার সাথে গতকালও ছিলো সে।একই গাড়িতে।কত কথা বলেছে তাঁরা।আর আজ সেই লোকটির দেহের গলিত তরল অবস্থা পড়ে আছে তাঁর চোখের সামনে!এটা কী বিশ্বাস করা যায়!
দীপ্ত কোনো ভাবে ভীড় ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এলো।আর ধরে রাখতে না পেরে রাস্তার পাশে বমি করে দিলো সে।
দীপ্ত পিঠে প্রকাণ্ড একটি হাতের ঘষা অনুভব করলো।বমি করা অবস্থায় এমন করলে বমিটা কমে তা জানে দীপ্ত।এমন শেষবার করেছিলো দীপ্তর বাবা আট-নয় বছর আগে।ঘাড় ঘুরিয়ে দীপ্ত বদরুল উদ্দিনকে দেখতে পেলে।উচ্চতা ছয়ফুট দুই ইঞ্চি।শারীরিক ভাবে তিনি যেমন বিশাল তেমন তার হাতও বিশাল।
'কী দীপ্ত বাবু?এসব দেখার অভ্যেস নেই নাকি?তাহলে কেমন গোয়েন্দা আপনি হাঁ?'বললেন বদরুল উদ্দিন।
দীপ্ত উঠে দাঁড়িয়ে রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো,'কাটা-ছেঁড়া,ভাঙা,টুকরো অনেক লাশ দেখেছি বদরুল সাহেব,কিন্তু এমন গলিত তরল লাশ প্রথম দেখলাম।'
বদরুল উদ্দিন ভীড়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,'হ্যাঁ হ্যাঁ,জীবনে যে কতকিছু যে দেখা লাগে তার কোনো হিসেব নেই।'
এবার দীপ্তর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,'তা,কী করবেন?থাকবেন না চলে যাবেন?'
দীপ্ত একরাশ ক্লান্তির সাথে জবাব দিলো,'থাকা সম্ভব না,চলেই যাবো।'
'আচ্ছা যান তাহলে',বলে বদরুল সাহেব শরীর ভরা অনিচ্ছা নিয়ে আবার ঢুকে গেলেন ভীড়ের মধ্য দিয়ে স্পটে।
দীপ্তর আর সাহসে কুলালো না ওখানে থাকতে।দ্রুত বেগে চলে এলেন সেখান থেকে।
বাসায় এসে দরজা ভাল করে আটকেই সে তাঁর প্রয়োজনীয় যা যা আছে সব গোছাতে শুরু করলেন।তিনি তাঁর বিপদও আঁচ করতে পারছেন শোভন সাহেবের মতো।
মালপত্র গুলো গাড়িতে উঠিয়ে দীপ্ত আর এক মুহূর্তের জন্যেও থামলো না।ভয়ে তাঁর হাত পা অবশ লাগছে।একটু পর পর দৃষ্টি ঘোলা হয়ে যাচ্ছে।খুবই ভয়ানক রকমের ভয় পেয়ে গিয়েছে দীপ্ত।তাঁর মাথা কাজ করছে না।তাঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অস্বাভাবিক আচরণ করছে।শরৎ কালে যেন শীতের ঠান্ডা তাঁদের গ্রাস করেছে।প্রচুর কাঁপছে।সে জানে যে সে কোনো অপরাধ করেনি।কিন্তু,সে ছিল শোভন সাহেবের সাথে অনেকদিন।অবশ্যই তাঁকে দেখেছে তাঁর শত্রুরা।তাঁকে অবশ্যই মেরে ফেলতে চাইবে।ভাবছে শোভন সাহেবের কুকাজে আমিও এক অন্যতম সহযোগী।
দীপ্ত গাড়ি চালাতে পারছে না ঠিকভাবে।এমন ভাবে চালাচ্ছে যেন সে প্রথম স্টিয়ারিং হাতে ধরেছে।ব্যালেন্স রাখতেই যেন কষ্ট হচ্ছে দীপ্তর।গতি ষাটের কাছাকাছি কিন্তু গাড়ির উপর কোনো কন্ট্রোল নেই দীপ্তর।গাড়ি সেতুর উপরে সাপের মতো আঁকাবাঁকা হয়ে চলছে।একটি বাইক আরোহীকে তো প্রায় ধাক্কা মেরেই দিয়েছিলেন।কিন্তু সেই বাইক আরোহী একজন দক্ষ রাইডার বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন।
দীপ্ত এভাবে ঘুরতে ঘুরতে রেলিং ভেঙে নদীতে গাড়ি সমেত পড়ে গেলো দীপ্ত সেতুর মাঝপথে এসে।সিট বেল্ট আটকানো।ভয়ে শরীরের শক্তি আশিভাগই চলে গিয়েছে দীপ্তর।তার উপর পানির মধ্যে দীপ্ত একেবারেই শক্তি শূন্য।না পারলো সিটবেল্ট খুলতে,আর না পারলো বের হতে।চোখের সামনে তাঁর ভেসে উঠলো জীবনে করা সব বড় পাপ গুলো।দীপ্তর মনে এখন জীবনের শেষ মুহূর্তে আফসোসটা জেগে উঠেছে।তাঁর উচিৎ হয়নি নীলিমার ধনী স্বামীর কাছে তার বোনকে মুসলমান সাজিয়ে বিয়ে দেয়া।হয়তো ঐ ফুটফুটে বাচ্চাগুলো আর নীলিমার অভিশাপ লেগেছে।তখনই যদি শোভন সাহেবের সাথে তাঁর পরিচয় হতো,তাহলে তিনি এ কাজ কখনোই করতে না।জীবনের এই অন্তিম মুহূর্তে তাঁর খুব করে নীলিমার কাছে ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু তার কোনো উপায় এখন আর নেই।
পাগলের মতো গাড়ি চালাচ্ছিলো আর তাঁকে একটুর জন্যে তো উড়িয়ে দিতো।তাই জন্যে বিনয় শংকর রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো সেই গাড়িওয়ালার দিকে।কিন্তু তাঁর রাগের জোড় যে এত বেশি তা তিনি জানতেন না।তিনি তাকানো মাত্রই গাড়িটি রেলিং ভেঙে নিচে পড়ে গেলো।বাইকটা ঘুরিয়ে যে সে সেদিকে যাবে তারও কোনো সুযোগ রাখলো না সামনে থেকে আসা ট্রাকটি।বাইক ঘুরাতে গিয়ে আড়াআড়ি হয়েছিলো বিনয় শংকর।আর ছিলেনও রং সাইডে।এরমধ্যেই বিপরীত দিক থেকে আসা ট্রাকটি বিনয় শংকরকে পিষে দিয়ে একটু সামনে গিয়ে থামলো।ঘোর বিপদ আঁচ করতে পেরে দ্রুততার সাথে কেটে পড়লো ঐ স্থান থেকে।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
আব্দুর রহমান আনসারী ০৬/০৪/২০২২সত্যই সুন্দর
-
স্বপন রোজারিও (মাইকেল) ১১/০৬/২০২১ভালো লেগেছে অনেক,
মনে দারুন আবেগ,
হয়ে মন্ত্রমুগগ্ধ,
জীবন আবদ্ধ। -
মাহতাব বাঙ্গালী ১১/০৬/২০২১Death comes suddenly! The accident is an obedient assistant of the death angel!
-
ফয়জুল মহী ১০/০৬/২০২১চমৎকার অনুভূতি I
-
মোঃ বুলবুল হোসেন ১০/০৬/২০২১চমৎকার
-
সাঞ্জু ১০/০৬/২০২১অনিন্দ্য সুন্দর।অভিবাদন প্রিয় কবি