“বই পড়ার গুরুত্ব এবং গ্রন্থাগারের ভূমিকা”
“কবি হওয়ার জন্যে প্রযোজন বেশি বেশি কবিতা পড়া। জ্ঞানী হওয়ার জন্যে প্রয়োজন বেশি বেশি জ্ঞান অর্জন করা। আর জ্ঞান আহরণ করতে পারবো সবচেয়ে বেশি বই পড়ার মাধ্যমে। তাই আমাদের বেশি বেশি বই পড়তে হবে এবং বই পড়ার জন্যে দরকার গ্রন্থাগার।
আমাদের দেশে শতকরা ৬-৭ ভাগের বেশি মানুষ বই পড়ে না। আমি পাঠ্য বইয়ের কথা বলছি না, সস্তা বিনোদন সর্বস্ব বইয়ের কথাও না। বই বলতে বোঝাচ্ছি সেই বই, যা মানুষকে ভাবায়, তাকে তার চেয়ে বড় করে তোলে।এ সকল বই খুব কম মানুষই পড়ে। আর সবাই যে পড়ে না, তেমন কিন্তু নয়। পড়ার জন্যে চাই সঠিক ব্যবস্থা অর্থাৎ স্থান। কিন্তু, স্থান থাকলেই বা কি হবে কে-ই বা চাইবে হাজার হাজার টাকা দিয়ে বই কিনে পড়তে? তাই চাই গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরী। আর এছাড়াও চাপে না পড়লে কেই বা বই পড়তে চায়। যে সব বাধাকে তুচ্ছ করে বই পড়ে সে তো প্রতিভাবান। সেরা পাঠক তো সেই, যে নিজের স্বেচ্ছায় আনন্দে পড়ে। পড়ার ভেতর দিয়ে নিজের বিকাশ দেখে পড়ে। আর সেই বিস্ময়ে হতবাক হয়।
সাধারণ মানুষ কাজ করে আদিষ্ট হয়ে নানান ঘটনা বা পরিস্থিতির চাপে। যে মানুষ বই পড়ে তার আনন্দে, এটি তার শ্রেষ্ঠত্ব। তবে সবাই তা পারে না। খুব অল্প মানুষই পারে। এরাই পৃথিবীকে পরিবর্তন করে সভ্যতাকে নতুন পথের দিশা দেখায়। এদের ফলেই জাতি উন্নতি লাভ করবে। ইংরেজীতে একটি কথা আছে যা আমরা সবাই জানি -
“ ঊফঁপধঃরড়হ রং ঃযব নধপশনড়হব ড়ভ ধ হধঃরড়হ. ”
শিক্ষাই একটি জাতির মেরুদন্ড। মেরুদন্ড ছাড়া যেমন মানুষ চলতে পারে না, তেমনি শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারে না। যে জাতি যত বেশি বই পড়ে সে জাতি তত ওপরে। বাংলাদেশ বই পড়ার ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। বই মনের হাজারও জানালা খুলে দিয়ে মানুষকে বড় পৃথিবীর বাসিন্দা করে তোলে। এসব জানালা আজও আমাদের বন্ধ হয়ে আছে। তাই সম্পূর্ণ জীবনকে আমরা আজও স্পর্শ করতে পারছি না। তাই আমাদের বইয়ের কাছে যাওয়া দরকার বই মানে কেবল তথ্য বা তত্ত্ব নয়, বই মানে স্বপ্ন, জীবনবোধ, প্রজ্ঞা, মেধার স্ফূরণ, উন্মোচন ও বুদ্ধি জাগ্রত হওয়া। বই পড়ার বিস্তৃত আনন্দ সম্পর্কে বলতে গেলে ভিনসেন্ট স্টারেটের কথা বলতে হয়। তিনি বলেছিলেন -
“ ডযবহ বি নুঁ ধ নড়ড়শ
ডব নুঁ ঢ়ষবধংঁৎব. ”
কেন বইয়ের মাধ্যমে সবকিছু প্রেরিত হল? সৃষ্টিকর্তা তো সর্বশক্তিমান, তিনি তো চাইলে টেলিভিশন বা সিনেমার মাধ্যমেও পাঠাতে পারতেন। কেন তা করলেন না? এর কারণ একটাই বই ছাড়া আর কিছুই মানুষের গভীর মনোজগতকে পুরোপুরি ধারণ করতে পারে না। কেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) বললেন, ‘‘ দরকারে জ্ঞান অর্জনের জন্যে চীন দেশে যাও ’’। চীন দেশে তো তখনও ইসলাম ধর্ম পড়ানো হত না, তাহলে কেন চীন দেশে যেতে হবে? যেতে হবে এজন্যে যে চীনে যাওয়া মানে দূরে যাওয়া, যেখানে তুমি যেতে পার জ্ঞান অর্জনের জন্যে, জানার জগতকে আকাশ ভেঙ্গে লুট করে আনো, নিজেকে প্রসারিত করো, মনের জানালা খোল, বিশাল পৃথিবীর একেবারে মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াও।
সভ্যতার অগ্রযাত্রা তো রিলে-রেসের মতো প্রত্যেকটি দলের সদস্যরাই এই কাজ করে - যার হাতে মশালটা থাকে, যাত্রা শেষ হওয়ার আগে তাই একটু জোরে দৌড়ায়, যেন পরের জনের হাতে একটু আগে মশালটা তুলে দিতে পারে। এ প্রসঙ্গে একটি কথা আছে, “ বই প্রেম সবার মধ্যে থাকে না, কারও কারও মধ্যে থাকে ”। মানুষ যে বই পড়তে চায় না, আমি বিশ্বাস করি না । আমি মনে করি এদের পড়ার কোনো সুযোগ নেই এবং অনেকে জন্মগতভাবেই অন্তত ৬ -৭ ভাগ লোক চিন্তাশীল স্বভাব নিয়ে জন্মায়। সারাক্ষণই তারা সিরিয়াস আর গভীর ব্যাপার খুঁজে, সে শিশু হলেও তা করে। টিভিতে হালকা নাচ, গান অনুষ্ঠান হয়তো সে-ও দেখে। কিন্তু, তিন মাস দেখার পরেই সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তার জন্মগত সিরিয়াস মন এসব এর পাশাপাশি গভীর কিছু খুজতে থাকে ওখানে না পেলে অন্য কোথাও খুঁজে, এই সিরিয়াস ধারার মানুষের নামই ‘ পাঠক ’। তাই আমাদের উচিত চিন্তাশীল গভীর মানুষদের বিকাশের সুযোগ করে দেওয়া। বাকি ৯৩ বা ৯৪ ভাগ মানুষ এ অংশে না এলেও বড় কোনো ক্ষতি হয় না। গোটা পৃথিবী তাকিয়ে আছে ওই ছোট ৬-৭ ভাগের দিকে। তারা কি করছে না করছে , তার ওপর নির্ভর করছে ভবিষ্যতের পৃথিবী। পৃথিবীকে পথ দেখাচ্ছে তো এরাই, কাজেই ওই ৬-৭ ভাগ লোক জ্ঞান আহরণ করলো তো গোটা মানব জাতির কাছেই পৌঁছাল। তাই আমাদের আজকের বাংলাদেশের শিক্ষিত মানুষদের শতকরা ৬ জন মানুষকে এর আওতায় আনতে হবে অর্থাৎ বই পাঠে আগ্রহী করে তুলতে হবে। তাদের জন্যে তাই খুলে দিতে হবে জ্ঞানের সর্ব্বোচ পথ, তৈরি করতে হবে গ্রন্থাগার।
আমাদের বয়সের ছেলে-মেয়েরা একটু অবসর পায় না পরিবারের সঙ্গে মিলে-মিশে আনন্দ করার মতো। আর তারা কি না পড়বে বই ! ভাবতে ও নেই এই কথা, কারণ বেশির ভাগ পরিবারে দেখা যায় ছেলে বা মেয়ে একটু বই পড়তে চাইছে, কিন্তু তার জন্যে লাইব্রেরীতে যেতে দিচ্ছে না। যতই পড়–ক - তবুও পিতা-মাতারা আবার বলে, ‘‘ ভালভাবে, ভাল করে আবার পড়ো ”। সারাদিন কোচিং ক্লাস বা প্রাইভেট পড়ার জন্যে দৌঁড়ে বেড়ায়। কারও হাতে সময় নেই। এই কথা বলতেই মনে পড়ে গেল উনিশ শতকের এক কবির কথা। তিনি লিখেছিলেন -
“ ডযধঃ রং ষরভব রভ ভঁষষ ড়ভ পধৎব, বি যধাব হড় ঃরসব ঃড় ংঃধহফ ধহফ ংঃধৎব. ”
পৃথিবীতে লক্ষ্য করে দেখা গেছে যে, অনেক বড় বড় কবি, সাহিত্যিকরা আছেন যারা পাঠশালার নির্ধারিত পড়ার ধারেকাছে ছিল না। আবার এমনও দেখা গেছে, অনেক খারাপ ছাত্র ছিল যারা ক্লাসে সব সময় পিছনের দিকে বসত। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ঘটেছে এই যে, সেই খারাপ ছাত্রটি হচ্ছে বিরাট বিখ্যাত লোক এবং তার রয়েছে সফল ব্যক্তিত্ব এবং তার শ্রেণীর সবচেয়ে ভাল ছাত্রটি হচ্ছে তার সহকারী । সেই খারাপ ছাত্রটি ছিল সৃজনশীল দক্ষতা সম্পন্ন এবং তার ছিল কিছু করে বিশ্বে তার নাম স্থাপনের জন্যে অনেক আগ্রহ। এদের কথা ভাবলে বোঝা যায় যে, শুধু মাত্র পাঠশালার নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তক পাঠ করলেই অনেক বড় বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব অর্জন করা যায়, এটা ভুল ধারণা। তাদের ছিল কিছু অসাধারণ মেধা। এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে না বললেই নয় যে কথা, তা হল একজন পন্ডিত হতে হলে কিন্তু সব বিষয়ে জ্ঞান রাখতে হবে। আর একজন গবেষক যে কোন একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর জ্ঞান অর্জন করেন। আর পন্ডিত হওয়ার জন্যে শুধু যে পাঠ্য বই পড়বে, কোচিং ক্লাসে দৌঁড়াবে তা নয়। বিশ্বকে জানতে হবে, জানতে হবে বিশ্বের জ্ঞান ভান্ডারকে । আর তার জন্যে প্রয়োজন বই পড়া , জ্ঞানমূলক বই পড়া। আর সবাই যদি পন্ডিত হয়ে যায় তাহলে তো সমস্যা । তাই যারা শিক্ষানুরাগী নয় তারা বই না পড়তে চাইলে পড়বে না। তাদেরকে জোর করার কোন মানে নেই। যারা আনন্দ লাভের জন্যে বই পড়ে,
জ্ঞান আহরনের জন্যে বই পড়ে। তাদের উদ্দেশ্যে জনৈক বিখ্যাত ঔপন্যাসিক তলস্ত বলেছিলেন,
“ ঞযৎবব ঃযরহমং ধৎব বংংবহঃরধষ ভড়ৎ ষরভব ধহফ ঃযবংব ধৎব ইড়ড়শং, ইড়ড়শং ধহফ ইড়ড়শং. ”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন -
“ মানুষ বই দিয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সাঁকো বেঁধে দিয়েছে। ”
বইয়ের মাধ্যমেই আমরা পুরাতন ঐতিহ্য ও সভ্যতাকে জানতে পারি। পুরান সংস্কৃতির সঙ্গে বন্ধন সৃষ্টি করতে পারি। আমাদের বৃহত্তম জীবনের যাত্রা পথের সবচেয়ে বরেণ্য মনীষীদের লেখা মূল্যবান বই । এসব বই পড়ে আমরা পরিচিত হতে পারি তাদের সাথে, পরিচিত হতে পারি সেই সব ব্যক্তির মহৎ চিন্তা-ভাবনা ও মহৎ কর্ম-কা-ের সাথে। আর বই পাঠে যে শুধু জ্ঞানার্জন হয় এই কথা ভুল। জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি বই মানুষের মনে কাব্যিক, দার্শনিক, সত্যবোধ জাগায়। এ প্রসঙ্গে প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন -
“ সাহিত্যে মানবাতœা খেলা করে এবং সেই খেলায় মানুষ আনন্দ উপভোগ করে। ”
আমরা যদি বই পাঠ না করি, তাহলে বই কিনব কেন ? আর বই প্রকাশকরা প্রকাশ করবে কিভাবে? আর কবি লেখকরাই বা কিসের আশায় লিখবে? যে জাতি বই পড়ে না সেই জাতির জন্যে কি কবি, লেখকরা বই লিখবে? তাই আমাদের উচিত বই পড়া। সবার তো আর সাধ্য নেই হাজার হাজার টাকা দিয়ে বই কিনে পড়বে ? কিন্তু চেষ্টা করতে হবে যতটুকু সম্ভব সেই সামর্থ্যের মধ্যে বই কেনা এবং পড়া। আর যারা কিনতে পারবে না, তারা কি বই পড়বে না ? না, তারা পড়বে। তাই আমাদের প্রয়োজন প্রত্যেক এলাকায় কমপক্ষে একটা লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার।
তাহলে এবার বই পাঠের জন্যে গ্রন্থাগারের ভূমিকা নিয়ে কথা বলা যাক। গ্রন্থাগার একটি বিদগ্ধ প্রতিষ্ঠান যেখানে পাঠক-গবেষকদের ব্যবহারের জন্য বই, পত্র-পত্রিকা, পান্ডুলিপি, সাময়িকী, জার্নাল ও অন্যান্য তথ্যসামগ্রী সংগ্রহ ও সংরক্ষিত হয়। গ্রন্থাগারের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘খরধনৎধৎু’। এর উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ ‘খরনবৎ’ থেকে। যার অর্থ ‘পুস্তক’। ‘খরনবৎ’ শব্দটি এসেছে ‘খরনৎধরঁস’ শব্দ থেকে। যার অর্থ হল, ‘পুস্তক রাখার স্থান’। এ্যাংলো-ফ্রেঞ্চ শব্দ ‘খরনৎধৎরব’ অর্থ হলো, ‘পুস্তকের সংগ্রহ’। আর কবির ভাষায় বলতে গেলে গ্রন্থাগার মানেই হল জ্ঞান পিপাসুদের নিকট একটি মহামিলনের স্থান। কথায় আছে- বই এমন এক বন্ধু যে কখনও রাগ বা দুঃখ করে না। তার ভালবাসার কোন শেষ নেই। সে অন্যকে শুধুই কাছে টানে।তার মাঝে নেই কোনো স্বার্থপরতা। গ্রন্থাগার হল সাহিত্যের এক বিপুল সমাহার। গ্রন্থাগার অতীত-বর্তমান- ভবিষ্যতের মিলনের অক্ষর নির্মিত সেতু। গ্রন্থাগার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন -
“ মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাধিয়া রাখিতে পারিত, তবে সেই নীরব মহা শব্দের সহিত এই লাইব্রেরীর তুলনা করা হইত।এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাতœার অমর আলো কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাধা পড়িয়া আছে। বিদ্যুতকে মানুষ লোহার তার দিয়ে বাধিয়াছে, কিন্তু কে জানিত মানুষ শব্দকে নিঃশব্দের মধ্যে বাধিতে পাড়িবে। কে জানিত সংগীতকে, হৃদয়ের আশাকে জাগ্রত আতœার আতœধ্বনিকে, আকাশের দৈববাণীকে সে কাগজে মুড়িয়া রাখিবে। কে জানিত মানুষ অতীতকে বর্তমানে বন্দী করিবে। অতলস্পর্শ কাল সমুদ্রের উপর কেবল এক একখানি বই দিয়া সাঁকো বাঁধিয়া দিবে। ”
গ্রন্থাগারের ইতিহাসের শুরু ২৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে, প্রাগৈতিহাসিক থেকে ঐতিহাসিক যুগের সন্ধিক্ষনে। তক্ষশীলা ও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীব সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব মিলেছে। তাছাড়া ও বহু বছর আগে থেকেই গ্রন্থাগারের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। ব্যবিলনের ভূগর্ভ খনন করে আবিষ্কৃত হয় প্রায় সাড়ে চার হাজার বছরের এক পুরাতন গ্রন্থাগার। সন্ধান মিলেছে খ্রিষ্টপূর্ব দশ বছর আগের অ্যাসিরীয় রাজা আসুরবাণী পালের নিজস্ব গ্রন্থাগারে সংগৃহীত পোড়া মাটির গ্রন্থ। খিষ্টপূর্ব ৪০০ বছর পূর্বে আলেকজান্দ্রিয়ায় ছিল গ্রিক শাসনকর্তা টলেমি কর্তৃক নির্মিত প্রাচীনকালের বৃহত্তম গ্রন্থাগার। তাছাড়াও মুসলিম খলিফাগণের রাজতন্ত্রের সময় বাগদাদে একটি বিরাট গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়েছিল।এ গ্রন্থাগারে খলিফা হারুন-অর-রশিদ ও আল-মামুনের পৃষ্ঠপোষকতায় বহু মূল্যবান গ্রন্থ সংরক্ষিত হয়েছিল।
বাংলাদেশে ১৯৫৩ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরী। তাছাড়াও ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়। কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরীর সহযোগিতায় শতাধিক সরকারী ও বেসরকারী গ্রন্থাগার দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি জেলা এবং উপজেলায় বেসরকারি গণগ্রন্থাগার স্থাপিত হয়েছে। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের এক জরিপে দেখা যায় সারাদেশে প্রায় ১,৬০০ বেসরকারি গণগ্রন্থাগার আছে। তবে বেশিরভাগ গ্রন্থাগারের অবস্থা উন্নত নয়। দেশের ৩৯টি সরকারি এবং ৯৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার রয়েছে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় থেকে এখানে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার গড়ে ওঠে। বর্তমানে এ গ্রন্থাগারের গ্রন্থসংখ্যা প্রায় ৬ লক্ষ ৫০ হাজার এবং ৭৬ হাজার বাধাঁই সাময়িকী রয়েছে। এ গ্রন্থাগারে প্রায় ৩শ জার্নাল রতি আছে। দেশে ৭০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১২ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার রয়েছে। মাদ্রাসা কেন্দ্রিক ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও গ্রন্থাগার রয়েছে। তেমনি একটি গ্রন্থাগার হচ্ছে দিশা কর্তৃক পরিচালিত একটি পাঠাগার “আলোঘর”। এই লাইব্রেরীটি ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এতে দশ হাজারেরও অধিক বই সংরক্ষিত রয়েছে। এতে রয়েছে ১৮টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা, যা হতে জনপ্রিয়গুলো আর্কাইভ আকারে বাঁধানো রয়েছে ২০০৬ সাল থেকে এবং প্রায় সকল প্রকার সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকাও এখানে রাখা হয়ে থাকে, নানা বয়সী পাঠকের কথা বিবেচনা করে। তাছাড়াও এর রয়েছে আরও ৪টি শাখা। আমার দেখা প্রথম একটি পাঠাগার যেখানে এক কথায় বিনা মূল্যে অনেক সেবা দেয়, সদস্য হয়েই বই বাসায় নিয়ে পড়া যায় এবং নির্ধারিত সময়ের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহারেরও সুযোগ রয়েছে এখানে। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়, তাদের জন্য রয়েছে এখানে অনেক বই এবং পড়ার স্থান। আমার মতে বলতে চাই, এই রকম গ্রন্থাগার যেন প্রত্যেক শহরে, মহল্লায় প্রতিষ্ঠিত হয়। তাহলে আমরা সূর্যের আলো ছাড়াও জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতে পারবো।
আমাদেরকে বই পড়তে হবে। যতটুকু অবসর সময় পাবো, বই পড়ার চেষ্টা করবো। বই পড়লে তো আর আমাদের বিরাট কোনো ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে না। দিনে অন্তত সব পড়াশোনা, কাজ-কর্মের পরে দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় বই পড়বো। যদি তাও না পারি, তবুও চেষ্টা করবো ২০ থেকে ৩০ পৃষ্ঠা পড়ার। পিতা-মাতাকে বুঝাতে হবে জ্ঞান আহরণে বইয়ের ভূমিকা। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি উন্নত। আমরাই তো আগামী দিনের ভবিষ্যত।
তাই কোন এক বই পড়ুয়া বলেছিলেন -
“ পড়িলে বই আলোকিত হই,
না পড়িলে বই অন্ধকারে রই। ”
আমাদের দেশে শতকরা ৬-৭ ভাগের বেশি মানুষ বই পড়ে না। আমি পাঠ্য বইয়ের কথা বলছি না, সস্তা বিনোদন সর্বস্ব বইয়ের কথাও না। বই বলতে বোঝাচ্ছি সেই বই, যা মানুষকে ভাবায়, তাকে তার চেয়ে বড় করে তোলে।এ সকল বই খুব কম মানুষই পড়ে। আর সবাই যে পড়ে না, তেমন কিন্তু নয়। পড়ার জন্যে চাই সঠিক ব্যবস্থা অর্থাৎ স্থান। কিন্তু, স্থান থাকলেই বা কি হবে কে-ই বা চাইবে হাজার হাজার টাকা দিয়ে বই কিনে পড়তে? তাই চাই গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরী। আর এছাড়াও চাপে না পড়লে কেই বা বই পড়তে চায়। যে সব বাধাকে তুচ্ছ করে বই পড়ে সে তো প্রতিভাবান। সেরা পাঠক তো সেই, যে নিজের স্বেচ্ছায় আনন্দে পড়ে। পড়ার ভেতর দিয়ে নিজের বিকাশ দেখে পড়ে। আর সেই বিস্ময়ে হতবাক হয়।
সাধারণ মানুষ কাজ করে আদিষ্ট হয়ে নানান ঘটনা বা পরিস্থিতির চাপে। যে মানুষ বই পড়ে তার আনন্দে, এটি তার শ্রেষ্ঠত্ব। তবে সবাই তা পারে না। খুব অল্প মানুষই পারে। এরাই পৃথিবীকে পরিবর্তন করে সভ্যতাকে নতুন পথের দিশা দেখায়। এদের ফলেই জাতি উন্নতি লাভ করবে। ইংরেজীতে একটি কথা আছে যা আমরা সবাই জানি -
“ ঊফঁপধঃরড়হ রং ঃযব নধপশনড়হব ড়ভ ধ হধঃরড়হ. ”
শিক্ষাই একটি জাতির মেরুদন্ড। মেরুদন্ড ছাড়া যেমন মানুষ চলতে পারে না, তেমনি শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারে না। যে জাতি যত বেশি বই পড়ে সে জাতি তত ওপরে। বাংলাদেশ বই পড়ার ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। বই মনের হাজারও জানালা খুলে দিয়ে মানুষকে বড় পৃথিবীর বাসিন্দা করে তোলে। এসব জানালা আজও আমাদের বন্ধ হয়ে আছে। তাই সম্পূর্ণ জীবনকে আমরা আজও স্পর্শ করতে পারছি না। তাই আমাদের বইয়ের কাছে যাওয়া দরকার বই মানে কেবল তথ্য বা তত্ত্ব নয়, বই মানে স্বপ্ন, জীবনবোধ, প্রজ্ঞা, মেধার স্ফূরণ, উন্মোচন ও বুদ্ধি জাগ্রত হওয়া। বই পড়ার বিস্তৃত আনন্দ সম্পর্কে বলতে গেলে ভিনসেন্ট স্টারেটের কথা বলতে হয়। তিনি বলেছিলেন -
“ ডযবহ বি নুঁ ধ নড়ড়শ
ডব নুঁ ঢ়ষবধংঁৎব. ”
কেন বইয়ের মাধ্যমে সবকিছু প্রেরিত হল? সৃষ্টিকর্তা তো সর্বশক্তিমান, তিনি তো চাইলে টেলিভিশন বা সিনেমার মাধ্যমেও পাঠাতে পারতেন। কেন তা করলেন না? এর কারণ একটাই বই ছাড়া আর কিছুই মানুষের গভীর মনোজগতকে পুরোপুরি ধারণ করতে পারে না। কেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) বললেন, ‘‘ দরকারে জ্ঞান অর্জনের জন্যে চীন দেশে যাও ’’। চীন দেশে তো তখনও ইসলাম ধর্ম পড়ানো হত না, তাহলে কেন চীন দেশে যেতে হবে? যেতে হবে এজন্যে যে চীনে যাওয়া মানে দূরে যাওয়া, যেখানে তুমি যেতে পার জ্ঞান অর্জনের জন্যে, জানার জগতকে আকাশ ভেঙ্গে লুট করে আনো, নিজেকে প্রসারিত করো, মনের জানালা খোল, বিশাল পৃথিবীর একেবারে মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াও।
সভ্যতার অগ্রযাত্রা তো রিলে-রেসের মতো প্রত্যেকটি দলের সদস্যরাই এই কাজ করে - যার হাতে মশালটা থাকে, যাত্রা শেষ হওয়ার আগে তাই একটু জোরে দৌড়ায়, যেন পরের জনের হাতে একটু আগে মশালটা তুলে দিতে পারে। এ প্রসঙ্গে একটি কথা আছে, “ বই প্রেম সবার মধ্যে থাকে না, কারও কারও মধ্যে থাকে ”। মানুষ যে বই পড়তে চায় না, আমি বিশ্বাস করি না । আমি মনে করি এদের পড়ার কোনো সুযোগ নেই এবং অনেকে জন্মগতভাবেই অন্তত ৬ -৭ ভাগ লোক চিন্তাশীল স্বভাব নিয়ে জন্মায়। সারাক্ষণই তারা সিরিয়াস আর গভীর ব্যাপার খুঁজে, সে শিশু হলেও তা করে। টিভিতে হালকা নাচ, গান অনুষ্ঠান হয়তো সে-ও দেখে। কিন্তু, তিন মাস দেখার পরেই সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তার জন্মগত সিরিয়াস মন এসব এর পাশাপাশি গভীর কিছু খুজতে থাকে ওখানে না পেলে অন্য কোথাও খুঁজে, এই সিরিয়াস ধারার মানুষের নামই ‘ পাঠক ’। তাই আমাদের উচিত চিন্তাশীল গভীর মানুষদের বিকাশের সুযোগ করে দেওয়া। বাকি ৯৩ বা ৯৪ ভাগ মানুষ এ অংশে না এলেও বড় কোনো ক্ষতি হয় না। গোটা পৃথিবী তাকিয়ে আছে ওই ছোট ৬-৭ ভাগের দিকে। তারা কি করছে না করছে , তার ওপর নির্ভর করছে ভবিষ্যতের পৃথিবী। পৃথিবীকে পথ দেখাচ্ছে তো এরাই, কাজেই ওই ৬-৭ ভাগ লোক জ্ঞান আহরণ করলো তো গোটা মানব জাতির কাছেই পৌঁছাল। তাই আমাদের আজকের বাংলাদেশের শিক্ষিত মানুষদের শতকরা ৬ জন মানুষকে এর আওতায় আনতে হবে অর্থাৎ বই পাঠে আগ্রহী করে তুলতে হবে। তাদের জন্যে তাই খুলে দিতে হবে জ্ঞানের সর্ব্বোচ পথ, তৈরি করতে হবে গ্রন্থাগার।
আমাদের বয়সের ছেলে-মেয়েরা একটু অবসর পায় না পরিবারের সঙ্গে মিলে-মিশে আনন্দ করার মতো। আর তারা কি না পড়বে বই ! ভাবতে ও নেই এই কথা, কারণ বেশির ভাগ পরিবারে দেখা যায় ছেলে বা মেয়ে একটু বই পড়তে চাইছে, কিন্তু তার জন্যে লাইব্রেরীতে যেতে দিচ্ছে না। যতই পড়–ক - তবুও পিতা-মাতারা আবার বলে, ‘‘ ভালভাবে, ভাল করে আবার পড়ো ”। সারাদিন কোচিং ক্লাস বা প্রাইভেট পড়ার জন্যে দৌঁড়ে বেড়ায়। কারও হাতে সময় নেই। এই কথা বলতেই মনে পড়ে গেল উনিশ শতকের এক কবির কথা। তিনি লিখেছিলেন -
“ ডযধঃ রং ষরভব রভ ভঁষষ ড়ভ পধৎব, বি যধাব হড় ঃরসব ঃড় ংঃধহফ ধহফ ংঃধৎব. ”
পৃথিবীতে লক্ষ্য করে দেখা গেছে যে, অনেক বড় বড় কবি, সাহিত্যিকরা আছেন যারা পাঠশালার নির্ধারিত পড়ার ধারেকাছে ছিল না। আবার এমনও দেখা গেছে, অনেক খারাপ ছাত্র ছিল যারা ক্লাসে সব সময় পিছনের দিকে বসত। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ঘটেছে এই যে, সেই খারাপ ছাত্রটি হচ্ছে বিরাট বিখ্যাত লোক এবং তার রয়েছে সফল ব্যক্তিত্ব এবং তার শ্রেণীর সবচেয়ে ভাল ছাত্রটি হচ্ছে তার সহকারী । সেই খারাপ ছাত্রটি ছিল সৃজনশীল দক্ষতা সম্পন্ন এবং তার ছিল কিছু করে বিশ্বে তার নাম স্থাপনের জন্যে অনেক আগ্রহ। এদের কথা ভাবলে বোঝা যায় যে, শুধু মাত্র পাঠশালার নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তক পাঠ করলেই অনেক বড় বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব অর্জন করা যায়, এটা ভুল ধারণা। তাদের ছিল কিছু অসাধারণ মেধা। এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে না বললেই নয় যে কথা, তা হল একজন পন্ডিত হতে হলে কিন্তু সব বিষয়ে জ্ঞান রাখতে হবে। আর একজন গবেষক যে কোন একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর জ্ঞান অর্জন করেন। আর পন্ডিত হওয়ার জন্যে শুধু যে পাঠ্য বই পড়বে, কোচিং ক্লাসে দৌঁড়াবে তা নয়। বিশ্বকে জানতে হবে, জানতে হবে বিশ্বের জ্ঞান ভান্ডারকে । আর তার জন্যে প্রয়োজন বই পড়া , জ্ঞানমূলক বই পড়া। আর সবাই যদি পন্ডিত হয়ে যায় তাহলে তো সমস্যা । তাই যারা শিক্ষানুরাগী নয় তারা বই না পড়তে চাইলে পড়বে না। তাদেরকে জোর করার কোন মানে নেই। যারা আনন্দ লাভের জন্যে বই পড়ে,
জ্ঞান আহরনের জন্যে বই পড়ে। তাদের উদ্দেশ্যে জনৈক বিখ্যাত ঔপন্যাসিক তলস্ত বলেছিলেন,
“ ঞযৎবব ঃযরহমং ধৎব বংংবহঃরধষ ভড়ৎ ষরভব ধহফ ঃযবংব ধৎব ইড়ড়শং, ইড়ড়শং ধহফ ইড়ড়শং. ”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন -
“ মানুষ বই দিয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সাঁকো বেঁধে দিয়েছে। ”
বইয়ের মাধ্যমেই আমরা পুরাতন ঐতিহ্য ও সভ্যতাকে জানতে পারি। পুরান সংস্কৃতির সঙ্গে বন্ধন সৃষ্টি করতে পারি। আমাদের বৃহত্তম জীবনের যাত্রা পথের সবচেয়ে বরেণ্য মনীষীদের লেখা মূল্যবান বই । এসব বই পড়ে আমরা পরিচিত হতে পারি তাদের সাথে, পরিচিত হতে পারি সেই সব ব্যক্তির মহৎ চিন্তা-ভাবনা ও মহৎ কর্ম-কা-ের সাথে। আর বই পাঠে যে শুধু জ্ঞানার্জন হয় এই কথা ভুল। জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি বই মানুষের মনে কাব্যিক, দার্শনিক, সত্যবোধ জাগায়। এ প্রসঙ্গে প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন -
“ সাহিত্যে মানবাতœা খেলা করে এবং সেই খেলায় মানুষ আনন্দ উপভোগ করে। ”
আমরা যদি বই পাঠ না করি, তাহলে বই কিনব কেন ? আর বই প্রকাশকরা প্রকাশ করবে কিভাবে? আর কবি লেখকরাই বা কিসের আশায় লিখবে? যে জাতি বই পড়ে না সেই জাতির জন্যে কি কবি, লেখকরা বই লিখবে? তাই আমাদের উচিত বই পড়া। সবার তো আর সাধ্য নেই হাজার হাজার টাকা দিয়ে বই কিনে পড়বে ? কিন্তু চেষ্টা করতে হবে যতটুকু সম্ভব সেই সামর্থ্যের মধ্যে বই কেনা এবং পড়া। আর যারা কিনতে পারবে না, তারা কি বই পড়বে না ? না, তারা পড়বে। তাই আমাদের প্রয়োজন প্রত্যেক এলাকায় কমপক্ষে একটা লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার।
তাহলে এবার বই পাঠের জন্যে গ্রন্থাগারের ভূমিকা নিয়ে কথা বলা যাক। গ্রন্থাগার একটি বিদগ্ধ প্রতিষ্ঠান যেখানে পাঠক-গবেষকদের ব্যবহারের জন্য বই, পত্র-পত্রিকা, পান্ডুলিপি, সাময়িকী, জার্নাল ও অন্যান্য তথ্যসামগ্রী সংগ্রহ ও সংরক্ষিত হয়। গ্রন্থাগারের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘খরধনৎধৎু’। এর উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ ‘খরনবৎ’ থেকে। যার অর্থ ‘পুস্তক’। ‘খরনবৎ’ শব্দটি এসেছে ‘খরনৎধরঁস’ শব্দ থেকে। যার অর্থ হল, ‘পুস্তক রাখার স্থান’। এ্যাংলো-ফ্রেঞ্চ শব্দ ‘খরনৎধৎরব’ অর্থ হলো, ‘পুস্তকের সংগ্রহ’। আর কবির ভাষায় বলতে গেলে গ্রন্থাগার মানেই হল জ্ঞান পিপাসুদের নিকট একটি মহামিলনের স্থান। কথায় আছে- বই এমন এক বন্ধু যে কখনও রাগ বা দুঃখ করে না। তার ভালবাসার কোন শেষ নেই। সে অন্যকে শুধুই কাছে টানে।তার মাঝে নেই কোনো স্বার্থপরতা। গ্রন্থাগার হল সাহিত্যের এক বিপুল সমাহার। গ্রন্থাগার অতীত-বর্তমান- ভবিষ্যতের মিলনের অক্ষর নির্মিত সেতু। গ্রন্থাগার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন -
“ মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাধিয়া রাখিতে পারিত, তবে সেই নীরব মহা শব্দের সহিত এই লাইব্রেরীর তুলনা করা হইত।এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাতœার অমর আলো কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাধা পড়িয়া আছে। বিদ্যুতকে মানুষ লোহার তার দিয়ে বাধিয়াছে, কিন্তু কে জানিত মানুষ শব্দকে নিঃশব্দের মধ্যে বাধিতে পাড়িবে। কে জানিত সংগীতকে, হৃদয়ের আশাকে জাগ্রত আতœার আতœধ্বনিকে, আকাশের দৈববাণীকে সে কাগজে মুড়িয়া রাখিবে। কে জানিত মানুষ অতীতকে বর্তমানে বন্দী করিবে। অতলস্পর্শ কাল সমুদ্রের উপর কেবল এক একখানি বই দিয়া সাঁকো বাঁধিয়া দিবে। ”
গ্রন্থাগারের ইতিহাসের শুরু ২৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে, প্রাগৈতিহাসিক থেকে ঐতিহাসিক যুগের সন্ধিক্ষনে। তক্ষশীলা ও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীব সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব মিলেছে। তাছাড়া ও বহু বছর আগে থেকেই গ্রন্থাগারের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। ব্যবিলনের ভূগর্ভ খনন করে আবিষ্কৃত হয় প্রায় সাড়ে চার হাজার বছরের এক পুরাতন গ্রন্থাগার। সন্ধান মিলেছে খ্রিষ্টপূর্ব দশ বছর আগের অ্যাসিরীয় রাজা আসুরবাণী পালের নিজস্ব গ্রন্থাগারে সংগৃহীত পোড়া মাটির গ্রন্থ। খিষ্টপূর্ব ৪০০ বছর পূর্বে আলেকজান্দ্রিয়ায় ছিল গ্রিক শাসনকর্তা টলেমি কর্তৃক নির্মিত প্রাচীনকালের বৃহত্তম গ্রন্থাগার। তাছাড়াও মুসলিম খলিফাগণের রাজতন্ত্রের সময় বাগদাদে একটি বিরাট গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়েছিল।এ গ্রন্থাগারে খলিফা হারুন-অর-রশিদ ও আল-মামুনের পৃষ্ঠপোষকতায় বহু মূল্যবান গ্রন্থ সংরক্ষিত হয়েছিল।
বাংলাদেশে ১৯৫৩ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরী। তাছাড়াও ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়। কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরীর সহযোগিতায় শতাধিক সরকারী ও বেসরকারী গ্রন্থাগার দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি জেলা এবং উপজেলায় বেসরকারি গণগ্রন্থাগার স্থাপিত হয়েছে। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের এক জরিপে দেখা যায় সারাদেশে প্রায় ১,৬০০ বেসরকারি গণগ্রন্থাগার আছে। তবে বেশিরভাগ গ্রন্থাগারের অবস্থা উন্নত নয়। দেশের ৩৯টি সরকারি এবং ৯৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার রয়েছে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় থেকে এখানে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার গড়ে ওঠে। বর্তমানে এ গ্রন্থাগারের গ্রন্থসংখ্যা প্রায় ৬ লক্ষ ৫০ হাজার এবং ৭৬ হাজার বাধাঁই সাময়িকী রয়েছে। এ গ্রন্থাগারে প্রায় ৩শ জার্নাল রতি আছে। দেশে ৭০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১২ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার রয়েছে। মাদ্রাসা কেন্দ্রিক ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও গ্রন্থাগার রয়েছে। তেমনি একটি গ্রন্থাগার হচ্ছে দিশা কর্তৃক পরিচালিত একটি পাঠাগার “আলোঘর”। এই লাইব্রেরীটি ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এতে দশ হাজারেরও অধিক বই সংরক্ষিত রয়েছে। এতে রয়েছে ১৮টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা, যা হতে জনপ্রিয়গুলো আর্কাইভ আকারে বাঁধানো রয়েছে ২০০৬ সাল থেকে এবং প্রায় সকল প্রকার সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকাও এখানে রাখা হয়ে থাকে, নানা বয়সী পাঠকের কথা বিবেচনা করে। তাছাড়াও এর রয়েছে আরও ৪টি শাখা। আমার দেখা প্রথম একটি পাঠাগার যেখানে এক কথায় বিনা মূল্যে অনেক সেবা দেয়, সদস্য হয়েই বই বাসায় নিয়ে পড়া যায় এবং নির্ধারিত সময়ের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহারেরও সুযোগ রয়েছে এখানে। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়, তাদের জন্য রয়েছে এখানে অনেক বই এবং পড়ার স্থান। আমার মতে বলতে চাই, এই রকম গ্রন্থাগার যেন প্রত্যেক শহরে, মহল্লায় প্রতিষ্ঠিত হয়। তাহলে আমরা সূর্যের আলো ছাড়াও জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতে পারবো।
আমাদেরকে বই পড়তে হবে। যতটুকু অবসর সময় পাবো, বই পড়ার চেষ্টা করবো। বই পড়লে তো আর আমাদের বিরাট কোনো ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে না। দিনে অন্তত সব পড়াশোনা, কাজ-কর্মের পরে দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় বই পড়বো। যদি তাও না পারি, তবুও চেষ্টা করবো ২০ থেকে ৩০ পৃষ্ঠা পড়ার। পিতা-মাতাকে বুঝাতে হবে জ্ঞান আহরণে বইয়ের ভূমিকা। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি উন্নত। আমরাই তো আগামী দিনের ভবিষ্যত।
তাই কোন এক বই পড়ুয়া বলেছিলেন -
“ পড়িলে বই আলোকিত হই,
না পড়িলে বই অন্ধকারে রই। ”
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
কামরুজ্জামান সাদ ০১/০১/২০১৮ভাল প্রবন্ধ
-
মোঃ ইমরান হোসেন (ইমু) ১৬/০৩/২০১৭সচেতনতামূলক প্রবন্ধ