www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

নববর্ষ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা

প্রায় সকল দেশে, সকল জাতির মাঝেই আছে নতুন বর্ষবরণের সংস্কৃতি। তবে বাঙ্গালীর পহেলা বৈশাখের মত নাচে গানে, খাবারে, পোশাক আর উৎসবে এমন রঙে রঙিন বর্ষবরণ আর পৃথিবীর কোথাও বুঝি নেই। সকল বাঙ্গালির মনে ভরে উঠে খুশির আমেজে। সকলে দুঃখ-বেদনা সব কিছু ভুলে আনন্দে মেতে উঠে। বাঙালিরা ফিরে পায় বাঙ্গালির ঐতিহ্য। তাই কবি রবীন্দ্রনাথের গানের সুরে বলা যায়-
“এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ
তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক।
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা
রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি,
আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ
মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক।”

নববর্ষ উৎসব মানেই এক অন্যরকম অনুষ্ঠান,অন্যরকম আনন্দ। বাঙ্গালির সবচেয়ে বড় উৎসব। এক সময় নতুন বছর এলে এমন অনুষ্ঠান বা উসৎবমুখর ছিল না। ইতিহাসটা একটু অন্য রকমের ছিল। ইতিহাসের শুরু বলতে গেলে শুরু হয়েছে মোঘল আমলে।

ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকার অনুসারে ভূমির মালিকরা কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করত। কিন্তু, হিজরী সন চাঁদের উপর নিরভরশীল, যা কিনা ১০/১১ দিন কমে আসত প্রতি বছর। তাই কৃষকরা খাজনা ঠিক সময়ে দিতে পারত না। কিন্তু, কৃষিকাজ ছিল ঋতুনির্ভরশীল। কৃষকদের সেই সমস্যার সমাধান করতে সম্রাট আকবরের আদেশে তার রাজসভার জ্যোতিষী ফতেহ উল্লাহ সিরাজী একটা সার্বজনীন বর্ষপঞ্জি তৈরি করেন, আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০/১১ মার্চ তারিখে প্রবর্তন করেন । তা কার্যকর হয় ৫ নভেম্বর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর সিংহাসন-আরোহণের সময় থেকে। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌরসনকে ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। নতুন সনটি প্রথমে ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত ছিল, পরে তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়।এই উৎসবটি কালের পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ-খায়িয়ে চলতে রূপ ধারন করেছিল ‘হালখাতা’ র উৎসব নামে। আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। বাংলা নববর্ষ উৎসব পালন করে থাকে বাংলাদেশে এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। পূর্বে গ্রেগ্ররিয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ই এপ্রিল বা ১৫ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হত। বাংলাদেশে বাংলা একাডেমি কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক পঞ্জিকা অনুসারে পহেলা বৈশাখ ১৪ই এপ্রিল পালিত হয়। এই দিনকে বাংলাদেশে ও পশ্চিমবঙ্গে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে গৃহীত।

নববর্ষকে উৎসবমুখর করে তোলে বৈশাখী মেলা। এটি মূলত সর্বজনীন লোক। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধরনের মেলা হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মেলা, বউমেলা, ঘোড়ামেলা ইত্যাদি। লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সব প্রকার হস্তশিল্পজাত ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী এই মেলায় পাওয়া যায়। এছাড়া শিশু-কিশোরদের খেলনা, মহিলাদের সাজ-সজ্জার সামগ্রী এবং বিভিন্ন লোকজ খাদ্যদ্রব্য যেমন: চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা, বিভিন্ন প্রকার মিষ্টি প্রভৃতির বৈচিত্র্যময় সমারোহ থাকে মেলায়। মেলায় বিনোদনেরও ব্যবস্থা থাকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকগায়ক ও লোকনর্তকদের উপস্থিতি থাকে। তাঁরা গম্ভীরা গান, গাজীর গান, আলকাপ গানসহ বিভিন্ন ধরণের লোকসঙ্গীত, বাউল-মারফতি-মুর্শিদি-ভাটিয়ালি ইত্যাদি আঞ্চলিক গান পরিবেশন করেন। নাটক, পুতুলনাচ, নাগরদোলা, সার্কাস ইত্যাদি মেলার বিশেষ আকর্ষণ। এছাড়া শিশু-কিশোরদের আকর্ষণের জন্য থাকে বায়োস্কোপ। শহরাঞ্চলে নগর সংস্কৃতির আমেজেও এখন বৈশাখী মেলা বসে এবং এই মেলা বাঙালিদের কাছে এক অনাবিল মিলন মেলায় পরিণত হয়। বৈশাখী মেলা বাঙালির আনন্দঘন লোকায়ত সংস্কৃতির ধারক।

পহেলা বৈশাখের এই দিনে মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রতি বছর বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে আয়োজিত একটি তুলনামূলকভাবে নতুন বর্ষবরণ উৎসব। প্রতি বছর বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নিতে ঢাকার রমনা পার্কে ছায়ানট আয়োজিত প্রাদোষিক সঙ্গীতানুষ্ঠান এবং একে ঘিরে আয়োজিত অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলা মানুষকে নিবিড়ভাবে আকৃষ্ট করতে থাকে এবং নাগরিক আবহে সার্বজনীন পহেলা বৈশাখ উদযাপনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলাদেশের ঢাকা শহরে এটি প্রবর্তিত হয়। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব হিসাবে সারাদেশে এটি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে প্রতিবছরই পহেলা বৈশাখে ঢাকা শহরের শাহবাগ-রমনা এলকায় এই মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। এই শোভাযাত্রায় চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন স্তরের ও বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রায় বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী শিল্পকর্ম বহন করা হয়।বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর বাংলাদেশের ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’’ জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেস্কোর অধরা বা ইনট্যানজিবল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরর তালিকায় স্থান লাভ করে।

পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ‘অনেক আলো জ্বালতে হবে মনের অন্ধকারে’। বাঙালি মনে-প্রাণে, চলনে-বলনে, চিন্তা-চেতনায় জাগ্রত হোক, নির্ভয়ে পথ চলতে উদ্বুদ্ধ হোক এই কামনা। পহেলা বৈশাখ নববর্ষ উদযাপনে কর্পোরেট পুঁজির দৌরাত্ম্যে আমাদের স্বকীয়তা যেন হারিয়ে না যায়, উত্সবে-আমেজে ফিরে আসুক প্রাণের স্পন্দন, যাতে প্রতিটি বাঙালি সামিল হতে পারে- সম্প্রীতির অটুট বন্ধনে বাঁধতে পারে নিজেদের। সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা। শুভ নববর্ষ।
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ৯০৪ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১২/০৪/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast