www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

গল্পটি একান্তই বর্ষার

তখন মধ্য আষাঢ়। দুদিন হলো বৃষ্টির অঝোর ধারা। ঝরছে তো ঝরছে বিরামহীন। প্রবল বর্ষণে ঘর থেকে বেরোবার পথটিও ডুবে গেছে হাঁটু জলে। মফস্বলের শহরগুলিতে এই এক চরম দুর্ভোগ, রাস্তার দুধারে ড্রেন না থাকায় হালকা বৃষ্টিতেই জল জমে যায়। আর ভরা আষাঢ়ে তো অন্তহীন দুর্ভোগ। কি আর করা, বাধ্য বালক জানালার ধারে বসে বৃষ্টির গান শোনা আর নযিম হিকমতের কবিতার বইটি নাড়াচাড়া করে বর্ষাযাপন। এমনিতে ঘরকুণো ছেলে আমি নই। গড়ে ২৪ ঘন্টায় রাতের ঘুম ছাড়া ঘন্টা তিনেকও আমার ঘরে থাকা হয়না। বৃষ্টি আজ আমায় বাধ্য করেছে ঘরকুণো হতে।

দুপুর বেলা বেডরুমে শুয়ে ছিলাম। বাইরে তখনও টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। মা, আর অনিতা (আমার ছোট বোন) ওরা গেছে পাশের বাড়ি। পুরো ঘরেই আমি একা। জেমসের 'লিখতে পারিনা কোনো গান আজ তুমি ছাড়া...' গানটি গুনগুন করছিলাম। হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠল। প্রথমে বিরক্তিই লাগল... এই ভেজা দুপুরে কে আবার এলো? চোখে মুখে বিরক্তির ভাব নিয়ে যখন দরজা খুললাম, দেখি বর্ষা।

পাশের বাড়ির মেয়ে বর্ষা। ইন্টারমিডিয়েট পড়ছে সরকারি মহিলা কলেজে। পাশাপাশি নিবাস হলেও ওর সাথে খুব একটা দেখা হয়না আমার। মাঝে মাঝে অনিতা বলত-ভাইয়া আজ বর্ষা আপু এসেছিল, তোমার দুটো বই নিয়েছে। বর্ষার গল্প, উপন্যাস খুব প্রিয় ছিল। অনিতার কথা অনুযায়ী তাই বোঝা যায়। সুযোগ পেলেই বর্ষা আমার বইগুলো নিয়ে পড়ত। বেশকিছু জনপ্রিয় উপন্যাস ও গল্পের বই আমার সংগ্রহে ছিল। কখন যে বর্ষা বই নিয়ে পড়ত, কখন দিয়ে যেত অনিতাই তা বুঝে রাখত। আমাকে মাঝে মাঝে বলত-ভাইয়া, বর্ষা আপু এই এই বইটা নিয়েছে। তেমন একটা ভ্রুক্ষেপ করিনি কখনো। অনিতার মুখেই যে কবার শুনেছি বর্ষা... বর্ষা নামনটি। তবে বর্ষার দিকে তেমন করে কোনোদিনও তাকিয়ে দেখা হয়নি। আজ বাদল ঝরা দিবসের এ মধ্যক্ষণে বর্ষাকে নিজের দরজায় দেখে কেন জানি চোখ দুটো আটকে গেলো ওর কাজল কালো চোখের কাছে। অপলক তাকিয়ে থাকলাম....বর্ষার কথায় সম্বিত ফির পাই।

বর্ষা বলল-কি বসতে বলবে না!
আশ্চর্য! বিস্ময়ে থ মেরে গেলাম। বর্ষার সাথে যতটুকু মনে পড়ে মাঝে মধ্যে দূর থেকে চোখাচোখি ছাড়া এ যাবত তেমন কোনো কথাই হয়েছে বলে মনে পড়ে না। অথচ বর্ষা কতো স্বাভাবিক তুমি করে বলল! মনে হল কতো দিনের যেন চেনা। দরজা ছেড়ে দাড়ালাম। বর্ষা নূপুর পায়ে ছন্দ তুলে ধীরলয়ে ভেতরে প্রবেশ করল।
বর্ষা শুধায়-তুমি করে বলেছি বলে বিস্মিত হয়েছ মনে হয়।
বললাম- না, তোমার সাথে তো ইতিপূর্বে...
বর্ষা আমার কথা শেষ করতে না দিয়েই বলল- ইতিপূর্বে তোমার সাথে কখনো কথা হয়নি এই তো। বলতে বলতে বর্ষা আমার বেডরুমে গিয়ে বসল।
আমি বললাম-বর্ষা ওরা তো কেউ বাসায় নেই।
বর্ষা বলল- কেন তোমার কাছে কি আসতে নেই?
বললাম-না, মানে কখনো...
শেষ করতে না দিয়ে বর্ষা বলল- তুমিই তো সুযোগ দাওনি। সারাদিনে কতক্ষণইবা বাসায় থাকো বলো? যখনই আসতাম অনিতা বলত- ভাইয়া তো বাসায় নেই। কোনোদিন বলত-ভাইয়া বন্ধুদের বাসায় গেছে, কোনোদিন বলত-কোথায় যেন আড্ডা মারছে। আবার কোনো কোনো দিন বলতেও পারতনা । আজ তো সৌভাগ্য বলতে হয় আমার। বুঝতে পারিনি এমন করে তোমার সাথে দেখা হবে, আর এমন করে তোমায় একা পাব।

বর্ষার এমুহূর্তের কথাগুলো একটু অন্য রকম মনে হল। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হল কোনো এক স্বপ্নের দোলায় দুলছে সে।
বর্ষার থেকে বেশ কিছু ব্যবধান রেখে আমিও বিছনায় বসলাম। কিছু একটা বলতে যাব এরই মধ্যে বর্ষা হঠাৎ উঠে এসে আমার গা ঘেঁষে বসল। আমি একটু সরে বসতে চাইলাম। ও আমার হাতদুটো শক্ত হাতে চেপে ধরে। তারপর মুখের কাছে তুলে ওর ঠোঁটদুটো ছুঁয়ে দিল আমার দশটি আঙুলে।আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। নির্বাক তাকিয়ে রইলাম পাথরের মূর্তির যেনো।

বর্ষা আবেগঝরা কণ্ঠে বলল-অনিক, এ হাতদুটো আমি আর কোনো দিন ছাড়তে চাইনা, সারাজীবনের জন্য ধরে রাখতে চাই নিজের করে। এ হাত ধরেই আমি হাঁটতে চাই সমুখের অজানা পথ। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য-নিজের অজান্তেই তোমাকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখে ফেলেছি অনিক। আমায় তুমি ফিরিয়ে দিওনা। ভাসিওনা না পাওয়ার বিরহ স্রোতে। সত্যি বলছি অনিক, এ যাবত অনেকবার চেষ্টা করেছি তোমার সংস্পর্শে যাবার। একটা সুযোগ পর্যন্ত তুমি দাওনি। সারাদিন আছ শুধু নিজেকে নিয়েই। তোমার জন্য কোনো একজন যে সবকিছু উৎসর্গ করে বসে আছে ভুলেও তা দেখনি।

বর্ষা আরো কিছু বলতে যাচ্ছে ঠিক সে মুহূর্তে আমি ওকে থামিয়ে দিলাম। নিজেকে কিছুটা সংবরণ করে বললাম-বর্ষা প্লিজ যে পর্যন্ত তুমি এগিয়েছ আর এসনা, আর সমুখে এগিওনা প্লিজ...! আর ভেবনা আমাকে নিয়ে। তবে কষ্ট পাবে। ভেসে যাবে বিরহ স্রোতে। আমাকে নিয়ে তুমি স্বপ্ন দেখনা প্লিজ।

বর্ষা আমার হাতদুটো আরো শক্ত করে ধরে বিস্ময়মাথা কণ্ঠে বলল-কি বলছ তুমি অনিক? আমার পৃথিবীতে আমি তোমাকেই একমাত্র ভালোবাসা বলে ভেবেছি। আর কিছুই আমি ভাবতে চাইনা, বুঝতে চাইনা। আমার আকাশে একটাই সুখপাখি, সে তুমি। এ ছাড়া অন্যকিছু বুঝিনা।
আমি বললাম-বর্ষা কিন্তু........
বর্ষার যেন তর সইছেনা দুহাতে আমাকে ধাক্কাদিয়ে বলল-বল, কিন্তু কি? বল....
বললাম-বর্ষা! আমাকে ভালোবাসার কোনো অযোগ্যতা তোমার নেই। এটা ধ্রুব সত্য। বরং তোমার ভালোবাসা পাবার যোগ্যতা আমি অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছি। বড্ড দেরি হয়ে গেছে বর্ষা! তুমি বড্ড দেরি করে ফেলেছ। অনেক আগেই আমি একজনকে ভালোবেসে মন দিয়ে বসে আছি। কি করে তোমায় ধরে রাখি বলো। আমি যে আমার নেই, অন‌্যের হয়ে গেছি আজ।

বর্ষার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়ে। আমার হাতদুটো কখন যেনো বর্ষার মুঠোথেকে খুলে গেল। হঠাৎ আলোকোজ্জ্বল আকাশে যেনো মেঘের ঘনঘটা, বজ্রের কাঠফাটা ধ্বনি। থমথমে বায়ু, পাহাড়, নদী, পৃথিবীর সবস্তব্ধতা নেমে এল আমার বেডরুমে।

আর কিছু বলবার সুযোগ না দিয়েই বর্ষা উঠে দাঁড়াল। জন্মের পর প্রথম হাঁটার মতো গুটিগুটি পায়ে হাঁটতে লাগল দরজার দিকে। আমার অধিকার নেই আমি বর্ষাকে ফেরাই। বর্ষার জন্য এমুহূর্তে মনটা হু হু করে কেঁদে ওঠে। একবার হাত বাড়াই বর্ষাকে ফেরাবো বলে। আবার অজান্তেই গুটিয়ে নেই।
আমি বর্ষাকে ডাকলাম-বর্ষা, শোনো। শোনো বর্ষা...

বর্ষা একটি বারের জন্যও পিছু তাকায়নি। বাইরে তখন প্রবল বর্ষণ। বৃষ্টির মধ‌্যেই বর্ষা ধীরপায়ে হাঁটতে শুরু করল। নির্বাক তাকিয়ে রইলাম বর্ষার চলে যাবার দিকে। একসময় বর্ষাকে আর চোখে পড়েনা.....
.
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৮৭৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ৩০/০৯/২০১৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • সালমান মাহফুজ ৩০/০৯/২০১৩
    পরিবেশ-চিত্রণ, চরিত্র সৃষ্টি -- সব মিলিয়ে অসাধারণ লেগেছে রাসেল ভাই ।
  • সুজয় আচার্য্য ৩০/০৯/২০১৩
    বেশ ভাল লেগেছে
  • গুরু বলতেই হবে গল্পেও আপনার হাত পাকা।
  • রোদের ছায়া ৩০/০৯/২০১৩
    সুন্দর গল্প , ঝরঝরে লেখা, পড়তে কোথাও বাধে নি । আগামীতে আরও ভালো গল্প পাবার আশা থাকলো।
    • ইব্রাহীম রাসেল ৩০/০৯/২০১৩
      কিন্তু এটাতেই অনেকের আপত্তি আছে, গল্পের নায়িকা বর্ষাকে অনেকে বলেছে পাগল, এতো আবেগ নাকি বাস্তবে হয় না ইত্যাদি ইত্যাদি। আপনার মন্তব্যে স্বস্তি পেলাম।--
  • সত্য অপ্রিয় হলেও অনেক সময় অনাগত কষ্ট থেকে রক্ষা করে। তাই বর্ষাকে বিষয়টা বলে দেয়া সততারই পরিচয়। গল্প নৈতিক দিক থেকে অনেক উচ্চমার্গের যদিও কষ্টটা মনে বড় লেগেছে
  • Înšigniã Āvî ৩০/০৯/২০১৩
    অনেক অনেক বার পড়লাম.......
    অসাধারণ........
    দুর্দান্ত.......

    মন কেড়ে নিলো ।
 
Quantcast