www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

শেষ বিকেলের জানালা (সম্পূর্ণ গল্প)

আবদুল কাদের সাহেব জানালার পাশে বসে আছেন, যেটা তাঁর সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। এখান থেকেই দেখা যায় উঠানের আমগাছটা, যেটা তিনি স্ত্রী রওশন আরার জন্য লাগিয়েছিলেন বিয়ের বছর দুয়েক পর। গাছটা এখন বিশাল, প্রতি বছর মিষ্টি আম ধরে, কিন্তু আজকাল আর কেউ খায় না। পড়ে যায়, পঁচে যায়, মাঝেমধ্যে ছেলেপুলেরা ঢিল ছুঁড়ে খেলে।

একসময় এই বাড়িতে কত কোলাহল ছিল! সকালে স্ত্রী রান্না করতেন, ছেলেরা বই হাতে দৌড়াত স্কুলের বাস ধরতে, মেয়েটা চুলে বেণি গাঁথিয়ে আয়নার সামনে ঘুরঘুর করত। সেই কোলাহল এখন থেমে গেছে। স্ত্রীর মৃত্যু এক ধাক্কায় তাঁকে বদলে দিয়েছিল। তারপর একে একে সবাই সংসার করল, বিদেশে পাড়ি দিল। শুরুতে ফোন আসত, এখন সেটা শুধু বিশেষ দিবসে। ঈদ, জন্মদিন, অথবা ভুলবশত।

দুপুরে তিনি একাই খান—সাদা ভাত, ডাল, ডিম ভাজি। রান্নার জন্য এক কাজের মেয়েকে রেখেছিলেন, কিন্তু সেও কিছুদিন পর চলে গেছে। বলেছিল, “দাদা, আপনি তো বেশি কিছু খেতেই চান না, আর আমি মাইনে পাই সামান্য।” আজকাল নিজেই চুলায় হাত দেন, কখনও রেঁধে ফেলেন, কখনও কিছু না খেয়েই থেকে যান।

একবার স্নানঘরে পড়ে গিয়েছিলেন। মাথায় চোট লেগেছিল, কয়েক ঘণ্টা অচেতন ছিলেন। কেউ জানে না। যখন হুঁশ ফিরল, নিজের হাতে ঠেকে দেখলেন রক্ত, নিজেই উঠে এলেন হামাগুড়ি দিয়ে। কাউকে জানাননি। ছেলে-মেয়েরা যেন শুনলে বিরক্ত না হয়।

তাঁর শয্যাশায়ী রাতগুলো আরো ভয়ানক। চুপচাপ ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ঘড়ির কাঁটা একেক করে এগোয়, ঘুম আসে না। মাঝে মাঝে বুক ধড়ফড় করে, মনে হয় আজ বুঝি সব শেষ হবে। কিন্তু মৃত্যু আসে না। আসলেও বা কে জানবে?

একবার এক প্রতিবেশীর ছেলে, স্কুলে পড়ে, এসে বলল, “দাদু, একটা গণিত বুঝিয়ে দেবেন?” কাদের সাহেবের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। দীর্ঘদিন পর কোনো শিশু তাঁর কাছে কিছু জানতে চেয়েছে। যত্ন করে বোঝালেন, আর ছেলেটি শেষে বলল, “আপনি তো অনেক ভালো বোঝান! স্কুলে এমন কেউ নেই।” সে দিন রাতে খেয়ে ঘুমিয়েছিলেন একটু শান্তিতে।

এরপর কিছুকাল ছেলেটা এল না। পরে শুনলেন, ছেলেটির পরিবার অন্য জায়গায় চলে গেছে। সেই উজ্জ্বলতা আবার নিভে গেল।

দেয়ালের ধুলোমাখা তাকগুলোয় সাজানো পুরনো বই—ম্যাক্সওয়েল, ইউক্লিড, নজরুল, জীবনানন্দ। মাঝে মাঝে বইয়ের পাতা ওল্টান, কিন্তু পড়া হয় না। দৃষ্টিশক্তি কমে গেছে। কানেও ভালো শুনতে পান না। চশমাটা ভাঙা, গোঁজামিল দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন।

একদিন পাশের বাসার বাচ্চা মেয়েটা এসে বলে, “দাদু, আপনি খুব একা থাকেন, না?” কাদের সাহেব একটু হেসে বলেন, “তুই যদি মাঝে মাঝে এসে গল্প করিস, তাহলে তো একা লাগবে না।” মেয়েটা চলে যায়, কিন্তু ওই কথাগুলো অনেকক্ষণ ধরে ওঁর মনে বাজে।

তারপর একদিন হঠাৎ এক ভোরে, মেঘলা সকালে, প্রতিবেশীরা দেখতে পায়—বাড়িটার জানালা খোলা, কিন্তু কাদের সাহেব আর সেখানে নেই।

তাঁকে মাটিচাপা দেওয়ার সময় তেমন কেউ ছিল না। প্রশাসনের লোকেরা জানায়—তিনি কিছু টাকা স্থানীয় এতিমখানায় দিয়ে গেছেন। তাঁর লেখা চিঠি পাওয়া গেছে, যেখানে তিনি লিখেছেন:
“যারা মা-বাবার ছায়া পায় না, তাদের পাশে থাকাই আমার শেষ চাওয়া। আমিও তো একদিন একা হয়ে গিয়েছিলাম।”
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৬৯ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২২/০৪/২০২৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast