www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

সাদা অ্যাপ্রোন (গল্প)

এক.
লালমনিরহাট সদর হাসপাতালের এক কোণে- ছোট্ট একটা চেম্বার। চেম্বারের দরজায় কোনো বড়ো নামের তকমা নেই, শুধু লেখা—
“ডা. মোঃ আতিকুর রহমান (এমবিবিএস)।”
সকাল হলেই লাইন পড়ে যায়। কেউ আসে জ্বর নিয়ে, কেউ হাঁপানির সমস্যা, কেউ আসে শুধু পরামর্শ নিতে।
সবাই জানে, এই ডাক্তার সাহেব চট করে ওষুধ দেন না, আগে মন দিয়ে রোগির সমস্যার কথাগুলো শোনেন। তারপর ব্যবস্থাপত্র লেখেন অথবা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন।
একদিন সকালবেলা এক বৃদ্ধা এলেন। পরনে জীর্ণ ময়লা শাড়ি, পায়ে ছেঁড়া সেন্ডেল। হাতে একটা কাগজ—পুরোনো প্রেসক্রিপশন।
“বেটা, শরীরটা কেমন জানি করছে, চোখেও ঠিক মতো দেখি না!” বললেন কাঁপা কণ্ঠে।
ডাক্তার আতিক একটু হেসে বললেন-
“আচ্ছা মা, বসুন। একটু দেখি মেপে দেখি আপনার প্রেসারটা। কেন এমন লাগছে। তার আগে বলুন, এই সমস্যাটো কতদিনের?”
বৃদ্ধা অবাক হলেন—কেউ এভাবে ডাকে না, কেউ এভাবে অন্তর থেকে “মা” বলে না।
ডাঃ আতিকুর রহমান খুব যত্ন করে বৃদ্ধার প্রেসার মাপলেন। স্টেথো দিয়ে বুকে পিঠে পরীক্ষা করলেন। তারপর তার পুরনো প্রেসক্রিপশনটা দেখে একটা ছোট্ট চিরকুটে দুইটা ওষুধ লিখে দিলেন।বললেন-
“এখানে দুই পদের বড়ি দেওয়া হয়েছে। দুই পদের দুইটা বড়ি সকালে খাবেন আর রাতে দুই পদের দুইটা খাবেন।পাঁচ দিন চলবে- মনে থাকবে মা? আগামী রবিবার আপনি আবার আমার কাছে আসবেন। আর এই ঔষধ দুইটা এই সরকারি হাসপাতালের ফার্মেসি থেকেই পেয়ে যাবেন। টাকা লাগবে না। আর হ্যাঁ, পানি কিন্তু একটু বেশি খাবেন।”
এই রকম ঘটনা প্রতিদিনই ঘটে। কেউ অনেক কষ্ট করে আসে, কেউ মনে ভয় নিয়ে আসে—কিন্তু বেরিয়ে যায় হালকা মন নিয়ে।
লোকেরা বলে—
“আতিক ডাক্তার সাহেবের কাছে গেলে শুধু শরীর না, মনটাও ভালো হয়ে যায়।”
অনেকেই জিজ্ঞেস করেছে,
“আপনার চেম্বার নেই কেন? এত নাম, এত রোগী, বাইরেও অনেক ইনকাম করতে পারেন!”
ডা. আতিকুক রহমান হাসেন।বলেন-
“চিকিৎসা আমার কাছে ব্যবসা নয়, এটা তো সেবা। সরকারি হাসপাতালে এসেছি মানুষের জন্য। এখন যদি তাদের পকেট খালি করে ফেলি, তাহলে তো আল্লাহর কাছে জবাব দিতে হবে।”
একবার এক মেডিকেল ছাত্র তার চেম্বারে এল।
জিজ্ঞেস করল-
“স্যার, কীভাবে একজন ভালো ডাক্তার হওয়া যায়?”
ডা. আতিকুর রহমান ছাত্রটির মুখের দিতে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন—
“ভালো ডাক্তার হবার জন্য কেবল বই পড়ে ঔষধের নাম মাখস্থ করলেই হবে না। রোগির মন বুঝতে হবে, কষ্টটা বুঝতে হবে। তারপর সেই কষ্ট প্রশমনের জন্য আন্তরিক চেষ্টায় হাত রাখার নামই ডাক্তারি।”
আজও হাসপাতালের করিডোরে যখন কেউ বলে,
“আতিক ডাক্তার আছেন তো?”
তখন একটা আশার আলো চোখে পড়ে সবার।
কারণ মানুষ জানে—
এই মানুষটার কাছে গেলে শুধু ওষুধ নয়, ভালোবাসাও মেলে।

দুই.
.
লালমনিরহাট শহরের অলিতে-গলিতে সব শ্রেণির রোগি ও অভিভাবকের মুখে এখন একটা নাম ঘোরে—
ডা. মোঃ আতিকুর রহমান।
গরিব রিকশাওয়ালার মুখে তার প্রশংসা, প্রাইমারির শিক্ষিকার চোখে তার জন্য কৃতজ্ঞতা, আর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা রোগির মুখে আশীর্বাদ—“আল্লাহ সকল ডাক্তারকে এই ডাক্তারের মত মন-মানষিকতায় পরিপুর্ণ করে দিন।”
কিন্তু এই প্রশংসার ঢেউ পৌঁছে গেছে হাসপাতালের ভেতরের ঘন ছায়াতেও। সেখানে বসে আছেন কিছু অর্থলোভী পাষন্ড ডাক্তার, যারা অভ্যস্ত কমিশন, পার্টনারশিপ আর ক্লিনিক চুক্তিতে। তাদের মাথাব্যথার কারণ এখন- ডা. আতিকুর রহমান সাহেব। তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে-
“এই ছেলেটা কী মনে করে নিজেকে?”
“আমরা তো চেম্বার চালাই—সে যদি বিনে পয়সায় চিকিৎসা দেয়, রোগী তো আমাদের কাছে আর আসবে না!”
“কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে, ওকে সরাতে হবে এই হাসপাতাল থেকে।”
নীরব গুঞ্জন শুরু হয়।
কেউ তাকে ডাক্তার না বলে “অ্যামেচার” বলে,
কেউ বলে “পাগল সেবা বিলায়, টাকা ছাড়া! এত টাকা আর পরিশ্রম করে ডাক্তার হয়েছি কি মাগনা সেবা করার জন্য?”
“ব্যাটাকে একটা উচিত শিক্ষা না দিলেই নয়! প্রয়োজনে গুন্ডা ভাড়া করবো।”
শেষে একদিন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মিটিং ডাকা হলো লালমনিরহাট সদর হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষে।
সবার সামনে ডা. আতিকুর রহমান বসে আছেন, গলায় স্টেথো ঝুলছে, কিন্তু মুখ শান্ত।
অভিযোগ তোলা হলো:
“রোগীদের সাথে বেশি সময় নষ্ট করেন।”
“বাহিরের দোকানের ওষুধ না লিখে শুধু সরকারি ওষুধ লেখেন আর নিজের মত করে পরামর্শ দেন।”
“কোন রোগীকে ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য হাসপাতালের ভেতরে অথবা বাহিরের ক্লিনিকগুলোতে পাঠান না।”
“হাসপাতালের নিয়ম ভাঙেন”
ডা. আতিক চুপ করে থাকলেন। সবাই যখন চিৎকার করছে, তখন তিনি বললেন:
“আমি যদি মানুষের সেবা করার জন্য অপরাধী হই, তাহলে সেই অপরাধ আমি বারবার করতে রাজি।”
এক মুহূর্তের নীরবতা নেমে আসে ঘরে। তারপর একজন বলে-
“এভাবে তো চলতে পারে না। এর একটা বিহিত বের করতেই হবে।”
পরদিন, লালমনিরহাট সদর হাসপাতালের গেটে একটা দৃশ্য।
দুপুরে হঠাৎ হাসপাতালের সামনে জড়ো হয় শত শত মানুষ।
রিকশাওয়ালা, স্কুলছাত্রী, বৃদ্ধা, গর্ভবতী মা—সবার হাতে লেখা প্ল্যাকার্ড:
“আমরা ডাক্তার আতিকুর রহমানকে চাই”
“আদর্শকে তাড়ানো যায় না”
“সাদা অ্যাপ্রন সাদা-ই থাকে”
হাসপাতালের দেয়াল যেন কেঁপে ওঠে ভালোবাসার শব্দে।
সেই দিন অনেক কিছু বদলে যায়।পরিচালক এসে চুপচাপ দাঁড়ান ডা. আতিকুর রহমানের পাশে। নীরবে বলেন—
“আপনার মতো একজন মানুষকে আমরা হারাতে পারি না। আপনার লড়াইটা আমাদের সবার জন্য শিক্ষা।”
গল্পের শেষ নয়, এটা শুরু।
ঈর্ষা সব সময় সত্যকে থামাতে চায়।
কিন্তু সত্যের সাদা অ্যাপ্রোন, সময় হলে বাতাসেই ওড়ে।

তিন.
.
গ্রীষ্মের শেষ দিকে লালমনিরহাট শহরে শুরু হলো অদ্ভুত এক রোগের ছড়িয়ে পড়া। শুরুতে কেউ গুরুত্ব দেয়নি। ছোট্ট সর্দি-জ্বর, মাথা ঘোরা, কিছু বমি।
কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই শহরের প্রতিটি এলাকায় ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক।শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে, বৃদ্ধরা হাঁটতে পারছে না। কিছু রুগী অজ্ঞান হয়ে পড়ছে দিনের পর দিন। নাম দেওয়া হলো: “ভ্যারিয়েন্ট ফিবার”। কোন জীবাণু, ভাইরাস—কিছুই নিশ্চিত নয়।
হাসপাতালে রোগীর ঢল নামলো। চিৎকার, কান্না, বিশৃঙ্খলা।
অনেক চিকিৎসক তখন নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত।
কেউ কেউ ডিউটি থেকে ছুটি চাইলেন। কেউ রেফার করলেন রুগীকে অন্যত্র। কিন্তু একজন মানুষ থামলেন না।তিনি-
ডা. মোঃ আতিকুর রহমান।
তিনি সকাল, দুপুর, রাত—ঘুমহীন অবস্থায় রুগীর পাশে।
গ্লাভস নেই! আত্মরক্ষার পোশাক নেই! নিজের হাতেই সেবা দিচ্ছেন। ভয় নেই? না, তাঁর ভয় একটাই—কোনো মানুষ যেন অবহেলায় মারা না যায়।
একদিন, এক সহকর্মী এসে বললেন:
“আপনি নিজের জীবনের চিন্তা করছেন না?
এই রোগ তো ছোঁয়াচে—আপনার নিজের পরিবার…?”
ডা. আতিক বললেন:
“আমি তো নিজের জন্য ডাক্তারি শুরু করিনি।
যারা আজ ভয়ে ঘুমাতে পারে না, তাদের পাশে না দাঁড়ালে, আমার সাদা অ্যাপ্রোনটা কলঙ্কিত হবে।”
রাতের শেষভাগে, হাসপাতালের এক করিডোরে তিনি হাঁটছেন ক্লান্ত শরীরে।
হঠাৎ এক নার্স ছুটে এসে বলল:
“স্যার! একটা বাচ্চা মেয়ের শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, মা কান্না করছে!”
তিনি দৌড়ে গেলেন,
হাত লাগালেন, অক্সিজেন সেট করালেন, সেবিকাদের নির্দেশনা দিলেন।
ঘণ্টা দুয়েক পর, শিশুটি চোখ মেলে তাকালো।
মা কেঁদে ফেললেন—“স্যার, আপনি না থাকলে আমার মেয়ে বাঁচতো না।”
ডা. আতিকুর রহমান কিছু বললেন না। শুধু চুপচাপ জানালার বাইরে তাকান। দেখেন- সূর্য উঠছে।
সেই দিন, শহরের সব মানুষ বুঝে ফেলল—আদর্শ শুধু ভাষণ নয়, সেটা দায়িত্ব আর আত্মত্যাগে প্রমাণ করতে হয়।
ডা. আতিক ছিলেন, আছেন, থাকবেন।

চার.
.
ভয়াবহ “ভ্যারিয়েন্ট ফিবার” ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
লালমনিরহাট শহর আবার নিজের ছন্দে ফিরছে। মানুষ ঘর থেকে বেরোচ্ছে, দোকানপাট খুলছে, স্কুলে বাচ্চাদের কোলাহল।
আর শহরের কেন্দ্রে, লালমনিরহাট সদর হাসপাতালে—
আছেন এক চুপচাপ মানুষ।
ডা. মোঃ আতিকুর রহমান।
তিনি আগের মতোই নিজের ডেস্কে বসে আছেন।
পকেটে প্রেসক্রিপশন প্যাড, চোখে ক্লান্তি, তবু মুখে হাসি।
এই ছোট্ট শহরের মানুষ ভোলেনি।
একদিন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ফোন এলো—
“ডা. আতিকুর রহমান, আপনাকে জেলা সম্মাননা দেয়া হবে।
আপনার আত্মত্যাগ আর সেবার জন্য সরকার আপনাকে স্বীকৃতি দিতে চায়।”
সেদিন সন্ধ্যায়, লালমনিরহাট শহরের মিশনমোড়ে জেলা পরিষদের বড় মিলনায়তন আলোয় সেজে উঠল। মন্ত্রী এসেছেন, জেলা প্রশাসক মঞ্চে, অতিথিরা বসেছেন সারি সারি চেয়ারে।
মঞ্চে ডাকা হলো:
“বাংলাদেশের সেবার প্রতীক, ডাক্তার মোঃ আতিকুর রহমান!”
হলজুড়ে করতালি, কিছু মানুষের চোখে জল।
ডা. আতিকুর রহমান মঞ্চে উঠলেন। সাদা অ্যাপ্রোনে তাঁর শরীর ঢেকে আছে, তবু বুকের ভেতরে যেন আগুন জ্বলছে। তিনি হাত বাড়িয়ে নিলেন না পুরস্কার। সবাই অবাক। দর্শক স্তব্ধ।
তাঁর কণ্ঠে শান্ত অথচ গভীর স্বর:
“আপনাদের এই ভালোবাসা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্মান। এই মঞ্চে আমি কোনো পদক নিতে আসিনি। আমি এসেছি একটি প্রতিজ্ঞা নিয়ে— এই দেশের প্রতিটি রুগী, ধনী-গরিব নির্বিশেষে যেন সেবা পায়, একটা শিশুও যেন চিকিৎসার অভাবে মারা না যায়, একজন মাও যেন শুধুমাত্র টাকার অভাবে চোখের সামনে সন্তান হারায় না—
এই স্বপ্ন নিয়েই আমি সাদা অ্যাপ্রোন পরেছিলাম। এবং যতদিন বাঁচবো, এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে বাঁচবো।”
মঞ্চে তখন নিঃশব্দ কান্না।
একজন মানুষ যখন নিজের জীবনকে অন্যদের জন্য উৎসর্গ করে, তখন শব্দ হয় ছোট—আলো হয়ে যায় বড়।
“সাদা অ্যাপ্রোন” এখন কেবল একটা পোশাক নয়—
এটা এক প্রতিজ্ঞার প্রতীক।
ডা. আতিকুর রহমান আমাদের মনে করিয়ে দেন—
আদর্শকে কখনো পুরস্কার দিয়ে আটকে রাখা যায় না,
আদর্শকে হৃদয়ে ধারণ করতে হয়।”
সমাপ্ত
.
লেখকের কথা : গল্পটা কাল্পনিক। কিন্তু আমি মনে মনে ডা. আতিকুর রহমানের মত চিকিৎসক সারা বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে কামনা করি।
==========================================
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১০৯ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৭/০৪/২০২৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • দারুণ
  • বাহ। ভালো লেখা।
  • ফয়জুল মহী ০৭/০৪/২০২৫
    খুবই চমৎকার
    পাঠে ভীষণ মুগ্ধ প্রিয় ।
 
Quantcast