www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ভয়ঃ ভিন্ন প্রেক্ষিত

খন্দকার সাহেব একজন সুখী মানুষ, কারণ জীবনে তার চাহিদা খুব বেশী কিছু নয়। জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে অল্পতেই তিনি সন্তুষ্ট থাকতে শিখেছেন। সন্তানদেরকেও তাই শেখাতে চেয়েছেন। যুগের প্রভাব বলয় থেকে ক’জনাই বা বের হয়ে আসতে পারে? কিন্তু তিনি সফলতার সাথে তা পেরেছেন। এ জন্যেই তার সুখটা নির্ভেজাল।

নিজে যতটুকু ধর্মকে বোঝেন, খন্দকার সাহেব ততটুকুই ধর্মাচার যথাসম্ভব নিষ্ঠার সাথে পালন করেন এবং ধর্ম নিয়ে কিছুটা হাল্কা পড়াশোনাও করে থাকেন। ধর্ম বিষয়ে কোন আলোচনায়, তর্ক বিতর্কে পারতপক্ষে তিনি অংশ গ্রহণ করেন না, এড়িয়ে চলেন। দু’ ধরণের লোকজনকে তিনি মোটেই পছন্দ করেন না- ধর্ম ব্যবসায়ী আর বাঙালী জাতির সবচেয়ে গৌরবময় অর্জন, মুক্তিযুদ্ধ ব্যবসায়ীদেরকে। এই উভয়দলকে দেশ, সমাজ ও জাতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক বলে তিনি মনে করেন।

খন্দকার সাহেব প্রথম যখন একটি গাড়ী কিনেছিলেন, অনেক ইন্টারভিউ এর পর তিনি একজন চালককে নিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু তার গাড়ীচালক নয় মাস চাকুরী করার পর ঈদের বোনাস নিয়ে ছুটিতে বাড়ী গিয়ে আর ফিরে আসলোনা। ঐ চালকটিকে তিনি তার অপর একজন কর্মচারীর সুপারিশে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তিনি সেই কর্মচারীর নিকট অভিযোগ করলেন, কিন্তু সে তাতে শুধু বিব্রতই হলো, কোন প্রতিকার করতে পারলোনা। চালকহীন অবস্থায় তিনি যখন বেশ অসুবিধার মধ্যে ছিলেন, তখন একদিন বাসুদেব ডিব্রা নামে এক ব্যক্তি তার সাথে দেখা করে তার ড্রাইভার হবার ইচ্ছা ব্যক্ত করলো। তার নাম ধাম পরিচয় জেনে নিয়ে তিনি যখন তার পরিবারের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলেন, পরিবারের কেউ কেউ একটু ইতস্ততঃ করলো, কারণ বাসুদেব অন্য ধর্মের লোক, এবং নেত্রকোনার পাহাড়ী অঞ্চল দূর্গাপুরের অধিবাসী একজন উপজাতীয়। কিন্তু এ নিয়ে খন্দকার সাহেবের কোন দ্বিধা বা সংশয় ছিল না, কারণ তিনি মনে করতেন, প্রত্যেক মানুষ তার আচরণের জন্য নিজেই দায়ী। এর সাথে তার ধর্ম, পরিবার, ভাষা বা আঞ্চলিকতা সম্পৃক্ত নয়। তাই তিনি আর বেশী কিছু না ভেবে বাসুদেবকে তার গাড়ীচালক হিসেবে নিয়োগ করলেন। নিয়োগের সময় তিনি স্পষ্ট করে দিলেন, চাকুরী ছাড়তে চাইলে অন্ততঃ এক মাসের আগাম নোটিশ দিতে হবে, যেন এর মধ্যে তিনি প্রতিস্থাপক খুঁজে নিতে পারেন। তার দেয়া সুযোগ সুবিধা ও বেতনের চাইতে সে যদি অন্য কোথাও আরো বেশী ভাল সুযোগ সুবিধা পায়, তবে তাকে আটকানোর কোন ইচ্ছে তার নেই, এ কথাটা প্রথম দিনেই তিনি খোলাসা করে বলেছিলেন।

সাত মাস চাকুরী করার পর সেই শর্ত মোতাবেক একদিন বাসুদেব ডিব্রা নোটিশ দিয়ে বসলো, সে আর চাকুরী করবেনা, কারণ একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে তার একটি ভাল চাকুরী হয়েছে। নোটিশ দেয়ার কিছুদিন পর সে নিজেই তার একজন প্রতিস্থাপক নিয়ে এসেছিল, খন্দকার সাহেবের যদি পছন্দ হয়, তবে তিনি যেন তার জায়গায় নতুন ব্যক্তিটিকে নিয়োগ দিতে পারেন। নতুন চালকের নাম লিও, সেও বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার একজন উপজাতীয়। দেখতে বাসুদেবের চেয়েও নম্র ভদ্র, পোশাকেও অধিক পরিপাটি। খন্দকার সাহেব তাকে দিয়ে একটি স্বল্প দূরত্বের ডিউটি করালেন। ইঞ্জিনের স্টার্ট দিয়ে গাড়ী গ্যারেজ থেকে রাস্তায় বের করা দেখেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন গাড়ী চালনায় সে বাসুদেবের চেয়ে অধিক পারদর্শী। তাই তিনি এবারে আর কারো সাথে আলাপ না করেই লিওকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। লিও’র পরে এক এক করে তার আরও চারজন চালক বদলী হয়েছে দেড়-দুই বছর পর পর, কিন্তু কেউই কোন বেয়াদবী করে যায়নি, যাবার সময় ছল চাতুরী করে যায়নি। অম্বর সাংমা, বাদল, হলি আর অপূর্ব চিসিম এই চারজন একে একে তার চালক হিসেবে চাকুরী করে গেছে এবং বিদায় নেয়ার আগে একজন অপরজনকে তার হাতে তুলে দিয়ে গেছে তাদের নিয়োগ যোগ্যতা বিবেচনার জন্য। এ বিষয়টা খন্দকার সাহেবকে খুবই মুগ্ধ করেছিল। তিনি তাদের মধ্যে একতা, সহমর্মিতা, সহযোগিতা এবং একের প্রতি অপরের শুভাকাংখা দেখে বিস্মিত ও বিমুগ্ধ হয়েছিলেন। সবচেয়ে অবাক হয়েছিলেন এটা দেখে যে কেউ কোন অযোগ্য প্রার্থী আনেনি এবং প্রার্থীকে নেয়ার জন্য কোন জোরাজুরিও করেনি। এরা সবাই নিয়ম মেনেই চাকুরী ছেড়েছিল এবং প্রত্যেকে যোগ্য প্রতিস্থাপক দিয়ে গিয়েছিল, তাই খন্দকার সাহেবও তাদের পাওনাপাতি খুশী মনেই মিটিয়ে দিয়ে তাদেরকে বিদায় দিয়েছিলেন। শুধু শেষের জন, অপূর্ব চিসিম তার মায়ের অসুখের কথা বলে ছুটিতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি, তবে টেলিফোন করে তাকে জানিয়েছিল যে সে মায়ের অসুখের কারণেই আর ঢাকায় ফিরবেনা। তার ফোন পেয়ে খন্দকার সাহেব প্রথমে কিছুটা নাখোশ হলেও, সে যে টেলিফোন করে তার অপারগতার কথাটুকু জানিয়েছে, এই সৌজন্যটুকুর কথা ভেবে মনে মনে প্রীতও হয়েছিলেন। এ ছাড়া যে কারো মায়ের অসুখ বিসুখের ব্যাপারে তিনি আজীবন সংবেদনশীল।

গাড়ীচালকগণ অন্য ধর্মাবলম্বী হওয়াতে খন্দকার সাহেবের একটা বিশেষ সুবিধে হয়েছিল যে ঈদ উৎসবগুলোতে তিনি ঈদের দিনেও তাদেরকে দিয়ে ডিউটি করাতে পারতেন, কখনো কখনো ঢাকা থেকে বহু দূরে তার নিজ গ্রামেও নিয়ে যেতেন। তবে ওদের বড়দিন উৎসবের সময় তিনি ওদেরকে লম্বা ছুটি দিতেন এবং উৎসব বোনাসও ঐ সময়েই পরিশোধ করতেন। অপূর্ব চিসিম যখন বাড়ী যায়, তখন জুন মাস শেষের পথে। তাই তখন তাকে উৎসব বোনাস দেয়ার প্রশ্ন উঠেনি, দাবীও উঠেনি। কিন্তু জুন থেকে বছর গড়িয়ে যখন ডিসেম্বর এলো, তখন অপূর্ব চিসিম উৎসব বোনাসের কথা না ভাবলেও খন্দকার সাহেব ভেবেছিলেন। তিনি মনে মনে ভাবলেন, সে বেচারাতো বছরের অন্ততঃ ছ’টি মাস তার সাথে ডিউটি করেছে। সেই হিসেবে তার অন্ততঃ অর্ধেক বোনাস পাবার কথা। এটা সে তাকে ভয় পেয়ে দাবী না করলেও, সবচেয়ে বড় বিচারকের বিচারের ভয় তার মনে থাকলে তো তারই উচিত ছিল তাকে ডেকে এনে পাওনা টাকাটা তাকে দিয়ে দেয়া। যতই দিন যাচ্ছিল, ততই একটা অপরাধবোধ তার ভেতরে শেকড় ছড়াচ্ছিল। ইতোমধ্যে কয়েকবার তার সেলফোন বদল হওয়াতে তার নম্বরটিও তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন। এমতাবস্থায় একদিন তিনি তার সব কর্মচারীকে ডেকে বললেন, কেউ যদি অপূর্ব চিসিমকে কখনো কোথাও দেখে থাকে, তবে সে যেন তাকে তার সাথে কথা বলতে বলে অথবা তার ফোন নম্বরটি সংগ্রহ করে তাকে জানায়।

অপূর্ব চিসিম অন্যদের চেয়ে একটু হাবাগোবা ধরণের ছিল। তার আই কিউ এবং রোড সেন্স একটু কম ছিল তুলনামূলকভাবে। তাই একমাত্র ওকেই খন্দকার সাহেব মাঝে সাঝে বকাঝকা করতেন, অন্যদের কখনো করতে হয়নি। এজন্য অপূর্ব চিসিমও অন্যদের চেয়ে তাকে একটু বেশীই ভয় করতো। কিন্তু বকাঝকা করলেও খন্দকার সাহেব ওকেই অন্যদের চেয়ে একটু বেশী ভালবাসতেন। উনি যখন ওকে ‘অপূর্ব’ নাম ধরে ডাকতেন, তখন আশে পাশের শ্রোতারা নামটা শুনে বেশ মুগ্ধই হতেন। একদিন তো এক মুগ্ধ শ্রোতা তার কানের কাছে এসে বললেন, ‘আপনার ড্রাইভার এর নামটা খুবই সুন্দর’! বকাঝকা শুনেও মুখে একটা নির্মল হাসি অপূর্ব ধরে রাখতে পারতো। কিছুটা নির্বোধ প্রকৃতির এই অপূর্ব চিসিম কখনো তার কাছ থেকে জোর করে কিছু চাইতে পারতো না। প্রয়োজনে ছুটিও না। তাই এই সাদাসিধে ছেলেটার ন্যায্য পাওনা কী করে মেটানো যায়, তা নিয়ে খন্দকার সাহেব দিনে দিনে অস্থির হয়ে যাচ্ছিলেন।

প্রায় চার বছর পর একদিন খন্দকার সাহেব হাঁটতে বের হয়েছেন, এমন সময় তার বাসার কাছেই দেখতে পেলেন অপূর্ব অন্য একজন উপজাতীয় লোকের সাথে আলাপরত। চোখাচোখি হতেই তিনি তার দিকে মৃদু হেসে হাত বাড়িয়ে দিলেন করমর্দনের জন্য। অপূর্বও কিছুটা দৌড়ে এসে আলতো করে তার হাতটি স্পর্শ করলো। তিনি তাকে তার মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করলেন। অপূর্ব জানালো যে তার মা এক বছর আগে দেহত্যাগ করেছেন। কথাটা শুনে খন্দকার সাহেব ভেতরে ভেতরে দুঃখবোধ করলেন, আহা, ছেলেটার তো তাহলে কোনই দোষ ছিলনা! সে তো সত্যই বলেছিল, ওর মা তো সত্যই গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তার কোন বকেয়া পাওনা পাতি আছে কিনা। অপূর্ব ত্বরিত উত্তর দিল, ‘না স্যার, বরং আমি তো মাস শেষ হবার এক সপ্তাহ আগেই চলে গিয়েছিলাম, কিন্তু আপনি তো পুরো মাসেরই বেতন দিয়ে দিয়েছিলেন।‘ তিনি হেঁটে হেঁটেই কথা বলছিলেন, অপূর্বও তার পাশাপাশি হেঁটে চলছিল। আজ খন্দকার সাহেবের সাথে পাশাপাশি হাঁটতে এবং তার সাথে কথা বলতে অপূর্বের তেমন সংকোচ হচ্ছিল না, সে একে একে ভাইয়াদের খবর নিল, ম্যাডামেরও খবর নিল। খন্দকার সাহেব স্মরণ করলেন, অপূর্ব তার এক বন্ধুর সাথে কথা বলা অবস্থায় তার সম্বোধনে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসেছিল। তিনি অপূর্বকে বললেন তার বন্ধুর কাছে ফিরে যেতে এবং যদি তার হাতে সময় থাকে, তবে ঘন্টাখানেক পর তিনি বাসায় ফিরলে তার সাথে দেখা করতে।

খন্দকার সাহেব বাসায় ফেরার সময় লক্ষ্য করলেন, অপূর্ব ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে। তিনি তাকে ইশারায় তার সাথে লিফটে উঠতে বললেন। ঘরে ঢুকে প্রথমেই তিনি ড্রয়ার খুলে অপূর্বের বোনাসের পাওনা টাকার সমপরিমান টাকা বের করে এনে তার হাতে দিলেন। অপূর্ব অবাক হয়ে গেল। সে কাচুমাচু করে বললো, ‘স্যার এ টাকা তো আমার পাওনা নয়। আমি আপনাকে কোন বদলী ড্রাইভার না দিয়েই চলে গিয়েছিলাম। আপনারই বরং অনেক অসুবিধে হয়েছিল। আর তা ছাড়া বড়দিন আসার ছয় মাস আগেই তো আমি চলে গিয়েছিলাম। বড়দিনের সময় আমি আমার পরবর্তী চাকুরীস্থল থেকে বোনাস পেয়েছিলাম’। খন্দকার সাহেব আর বেশী কিছু শুনতে না চেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, এটাও রাখো’। টাকাটা হাতে নিয়ে অপূর্ব কিছুক্ষণ স্থানুর মত দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর টুপ করে বসে খন্দকার সাহেবের পায়ে ধরে মুসলমানদের মতই কদমবুসি করলো। খন্দকার সাহেব তাকে টেনে তুলে তার সাথে বুক মেলালেন। তখন চোখে টলটল পানি নিয়ে সে বললো, “স্যার, আপনি খুব ভাল মানুষ এটা জানতাম, কিন্তু আপনাকে আমি ভয়ও পেতাম। আমি আপনার কথা অনেক মনে করেছি। আপনার বাসার সামনের রাস্তাটা দিয়ে অনেকদিন হাঁটাহাঁটি করেছি শুধু আপনাকে একটু দেখার জন্য। একদিন ম্যাডামকে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি নীচ থেকে নমস্কারও দিয়েছিলাম। কিন্তু আপনাকে ভয় পেতাম বলে দারোয়ানকে আপনার সাথে দেখা করার কথা বলতে পারি নাই। আমার জন্য দোয়া করবেন স্যার”! এই বলে সে আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে গেল।

ও চলে যাবার পর খন্দকার সাহেব খানিকক্ষণ আনমনে ভাবলেন, ‘ব্যাটা তোর আবার ভয় কিসের? যার ভয়ে আমি আজ তোকে তোর এই পাওনাটুকু পরিশোধ করে ভারমুক্ত হ’লাম, তার কাছে তো তোকে কোন জবাব দিতে হতো না, দিতে হতো আমাকে’! তারা উভয়েই ভীত ছিলেন, কিন্তু দু’জনার ভয়ের প্রেক্ষিত ভিন্ন ছিল।

ঢাকা
২০ জানুয়ারী ২০১৮
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৯৪৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২১/০১/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • অনেক গুছানো লেখা
  • মাহামুদুল হাসান ২১/০১/২০১৮
    নিজস্ব ভাব আছে।
 
Quantcast