www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

প্রলয়ের প্রয়াণ

১.
- হ্যালো! আপনাকে না বলেছি আমাকে আর ফোন দিয়ে বিরক্ত করবেন না! কি শুরু করেছেন আপনি, বলুন তো?
- হাহাহাহা যার ঠিকানা আকাশে সীমাহীন নীলে মিশে হারিয়ে যায়, তার কি আর শুরু আছে?
- আতলামি রাখেন। আমাকে আর বিরক্ত করবেন না! রাখলাম।
- একটু দাঁড়াও। বিরক্ত তো তাকেই করা যায়, যে অনুরক্ত হয়! আর তুমি তো তোমার সিদ্ধান্তে হিমালয়ের মতো অটল, আর...
- আর কিছু না।বাই!
- আরেকটু প্লিজ! বিরক্ত হতে হতে যখন ফোনটা পিক করেই ফেলেছো হুট করে না বলে রেখে দিও না প্লিজ!
- আচ্ছা আপনার সমস্যাটা কি বুঝলাম না। আপনি এমন কেনো?
- হাহাহাহা আমরা যদি আমাদের সমস্যা গুলা বুঝেই ফেলতাম তাহলে কি বেঁচে থাকার জন্য এতো দৌঁড়-ঝাঁপ করতাম!! আর আমরা কেমন আর কেনোই বা এমন! এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই তো ভব সাগর পাড়ি দেয়া শেষ হয়ে যাবে! কিন্তু সে উত্তর কি মিলবে?

টুট টুট টুট! ওপাশ থেকে কানেকশানটা কেটে গেলো বলে অর্পিতাকে আবার ফোন দিলো প্রলয়! নো আনসার! নো আনসার! নো আনসার!

কলেজে এক বছর জুনিয়র অর্পিতা। ওদের ওরিয়েন্টেশন দিতে গিয়ে প্রথম পরিচয়। শুরুটা ভালোই ছিলো, কিন্তু প্রলয় সবকিছুতেই টাইমটা একটু কম নিয়েছিলো বলেই হয়তো অর্পিতার এত্তো ইগনোর‍্যান্স! আর ঊনিশ-কুঁড়ির আবেগই যেনো এমন! প্রলয়ও যেনো এর শেষ দেখে ছাড়বে এমন অবস্থা! প্রেম নিবেদন যেনো না, রীতিমত জোর-জবরদস্তি! আর অর্পিতাও তো আট-দশটা তরুণীর মতোই। প্রলয়ের দৃঢ় বিশ্বাস যে, অর্পিতা তার দুর্বলতা জেনে গেছে দেখেই এটাকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।

রাতের গভীরতা বাড়ার সাথে সাথে গরমের তীব্রতাও যেনো বাড়ছে। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বাতি নিভিয়ে অর্পিতা শুতে গেলো বিছানায়। বাসার সবাই ঘুমিয়েছে রাত্রির প্রথম প্রহরেই। আর অকারণে রাত জাগাটা তার নেশা। কলেজে আজ থেকেই বন্ধ শুরু হলো। পনেরো দিনের গ্রীষ্মকালীন ছুটি। কাল থেকে বিরামহীন ঘুরাঘুরির প্ল্যান তার। বিছানায় শুয়ে আবার যুদ্ধ করছে চোখ দু'টোর সাথে। ফেসবুকের জমানায় ঘুমানোর আগে একটু ফেসবুকিং না করলে তো আর ঘুম আসে না! কিছুক্ষণের মধ্যে কিছুটা তন্দ্রা ভাব চলে আসলেই মোবাইল ফোনটা ভাইব্রেট করতে লাগলো। উফফফফ! আবার একই ফোন! আজ এই নিয়ে ঊনিশ বার। একটা মানুষকে আর কত্ত এভোয়েড করলে মানুষ সেটা বুঝবে। নেহাত কলেজের সিনিয়র বলে সে ব্লক লিস্টে ফেলতে পারে না। আজ সন্ধ্যার পর থেকে এ নিয়ে একান্নটা কল দিয়েছে। আর কতো রিসিভ না করে থাকা যায়!

- হ্যালো।আচ্ছা ভাই। আপনি কি আমাকে শান্তি দেবেন না?
- শান্তি?? হুম আমি যখন শান্ত হয়ে তোমার আকাশে পাখি হয়ে উড়ে বেড়াবো সেদিনই তোমার শান্তি। তুমি উদাস মনে সন্ধ্যা তারা গুনবে আর আমি দূর আকাশের ঐ তারাদের ভীড় থেকে মিটিমিটি হাসবো!
- আচ্ছা আমি রাখি। দয়া করে আমাকে একটু ঘুমোতে দিন।
- হুম ঘুম! শান্তির ঘুম। আমিও ঘুমাবো তো। আচ্ছা একটা প্রশ্নের উত্তর দিবে সত্যি সত্যি?
- এক কথায় বলে শেষ করেন...
-আমি কি তোমাকে খুব বেশি বিরক্ত করি?
- নাহ! করেন না! আতলামি বাদ দেন! আপনার যন্ত্রণায় আমি কলেজে শান্তি পাই না। আপনার পোষা জুনিয়র গুলা আমাকে টিজ করে! আপনার বন্ধুরা আমাকে দেখে এমন ভাবে তাকায় যেনো আমি একটা সার্কাস!
- আর?
- আর!! ক্যান্টিনে গিয়ে কিছু খেলে টাকা নেয় না কেউ! বলে আমার বিল আপনি নিতে নিষেধ করছেন! কি পেয়েছেন বলেন তো? ক্যাম্পাসটা কি বাপ দাদার সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছেন? - স্যরি! স্যরি! হয়তো আর হবে না এমন!
- হয়তো?
- হয়তো বললাম! কারণ নিজের উপর ভরসা করতে পারি না যে! আচ্ছা ফেসবুকে আমাকে এড করা যায় না?
- না এমনিতেই সুন্দর এ পৃথিবী আপনার জন্য বিভীষিকাময় হয়ে আছে আপনার জন্য। ভার্চুয়ালটা না হয় ভার্চুয়ালই থাক! আপনি নেহাৎ আমার সিনিয়র বলে ব্লক দেই না! নিজের সম্মানটা অন্তত রাখেন। বিশ্বাস করেন এর চেয়ে খারাপ ব্যবহার আমি আর মানুষের সাথে করতে পারি না!
- হা হা হা যাক! অন্তত মানুষ তো ভাবেন! ভালো লাগলো!
- আচ্ছা আপনি আপনার ভালো লাগা নিয়ে থাকেন। আর আমাকে একটু শান্তি দেন ভাই প্লিজ!
- অর্পিতা?
- আবার?
- না থাক! তোমাকে ফেসবুকে মেসেজ দিবো! একটা প্রশ্নের উত্তর চাইবো। উত্তর দিও।

টুট! টুট! টুট! আবার ওপাশ থেকে কানেকশনটা কেটে গেলো। প্রলয় এক গাল হাসি নিয়ে বাতি নিভিয়ে বিছানায় গেলো। কিছু প্রশান্তির হালকা নিঃশ্বাস নিতে নিতে হারিয়ে গেলো স্বপ্ন রাজ্যে।

প্রলয় অর্পিতার মোহে আবদ্ধ সেই প্রথম দেখা থেকেই। নীল শাড়ি। সাদা ব্লাউজ। নীল টিপ। সাদ-নীল চূড়ির মিশ্রণ। হালকা গোলাপী লিপস্টিক। খোলা চুল। হাতে রজনীগন্ধা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক নবাগতা! এক অদ্ভুত ভালো লাগা। তাইতো এত্তো অপমান সহ্য করেও একটু ফোনে কথা বলে দু'দন্ড সুখ কুড়িয়ে নিতে দ্বিধাবোধ করে না প্রলয়। আর জুনিয়রগুলোও বদের হাড্ডি। এতো নিষেধ করা সত্ত্বেও অর্পিতাকে পঁচায় কলেজে। আর তাইতো অর্পিতার এতো বিরক্তি!

২.
স্নিগ্ধ রৌদ্রস্নাত সকাল! মোবাইলের এলার্ম শোনে ঘুম ভাঙলো অর্পিতার। দেখতে না দেখতেই পনেরোটা দিন শেষ। আজ আবার ক্লাস শুরু। তড়িঘড়ি করে ফ্রেশ হয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসলো সে। নিজের প্রতিবিম্ব দেখে হঠাৎ তার মাথায় এলো প্রলয় নামক জীবন্ত প্রলয়ের কথা। আবার সেই একই যন্ত্রণা! অবশ্য স্বস্তিও আছে যে ঐ রাতের ফাঁপর খেয়ে প্রলয় ফোনে আর বিরক্ত করে নি! এটা অর্পিতাকে যেনো ভরসা যোগায় আবাফ সন্দেহও হয়! এমন সুবোধ বালকের মতো কথা শোনার ছেলে তো না প্রলয়!

কলেজ গেটের সামনে রিক্সা থামলো। দূর থেকে ওই বিরক্তিকর মুখগুলো দেখা যাচ্ছে। অর্পিতা ধীরে ধীরে ক্যাম্পাসের দিকে এগোয়। মুখটা আগেই বিরক্তির ভাব করে সে এগুতো থাকে। এ তো তার অভ্যাস! ঐ বদ গুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় আঁড় চোখে ওদের দিকে তাকায় সে। "কি ব্যাপার আজ ওরে দেখে কেউ কিছু বললো না যে!" অজান্তেই অর্পিতার মনে প্রশ্ন উঁকি মারে। সবগুলো দেখেও যেনো না দেখার ভান করছে! কলেজের ওই পাশ থেকে এই পাশে হেঁটে হেঁটে আসলো। অথচ একটা লোকও তাকে প্রলয় নিয়ে টিজ করলো না, ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগলো অর্পিতার কাছে। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে তার বান্ধবী তিশাকে ফোন দিলো। তিশা ক্যান্টিনে আছে। সে ক্যান্টিনে গেলো। ক্যান্টিনে ঢুকেই পানির বোতল কিনে টাকা বের করে দিলো। টাকা দিতেই ক্যান্টিনওয়ালা মামা টাকাটা রাখতেই খটকা খেলো আরেকটা। পানির বোতলটা হাতে নিয়ে তিশার পাশে যেতে যেতে কোন হিসাব মিলছিলো না অর্পিতার। এমন তো কখনোই হয় নি! প্রলয়ের ভয়ে তো কেউ তার থেকে টাকাই রাখতো না!
" কিরে কি খবর? তিশা আমার কেমন খটকা লাগছে রে! " কেমন একটা অস্বস্তিকর ভাব নিয়ে অর্পিতা বসলো ক্যান্টিনে। "কিরে কথা বলছিস না যে! এই তিশা! সব কিছু ঠিক আছে তো?" তিশা অর্পিতাকে হাত ধরে আলতো টেনে ক্যান্টিনের বাইরে নিয়ে এলো। " হুম! অর্পিতা। আজ থেকে এই কলেজে তোর সব কিছু ঠিকই থাকবে।" তিশার এই রহস্যজনক কথা আর ক্রোধান্বিত চেহারা দেখে কিছু বুঝে উঠতে পারে না অর্পিতা।
তিশা তাকে ক্যান্টিনের দেয়ালে টাঙানো একটা কালো রঙের ব্যানারের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে দ্রুত চলে যায়।

" ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের সম্মান শেষ বর্ষের মেধাবী ছাত্র প্রলয় রায়ের দুর্ঘটনাজনিত অকাল প্রয়ানে আমরা শোকাহত।" ব্যানারে লেখাটা পড়তে পড়তে যেনো চোখ-মুঝ শুকিয়ে আসে অর্পিতার। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণিত ছেলেটির মৃত্যু সংবাদ শোনে সে হতভম্ব হয়ে পড়ে। অপ্রত্যাশিতভাবে তার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়ে অকস্মাৎ! অর্পিতা ক্যান্টিনের পাশেই ছোট মাঠটার উপর বসে পড়লো। মোবাইলটা বের করে ফেসবুকে লগ ইন করলো। ঐ দিন রাতেই ফেসবুক ইনবক্সে ম্যাসেজ দিয়েছিলো প্রলয়। সে দেখে তা ওপেনই করে নি! ম্যাসেজে গিয়ে ক্লিক করলো অর্পিতা।

" অর্পি,
কিছু ভালো লাগা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না! মোহের জালে বন্দী হয়ে তোমাকে পাবার আশায় ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় তোমাকে বিষিয়ে তুলেছি নিজের অজান্তেই। মনের ভেতরে জমে থাকা কথাগুলো হৃদয় নিংড়িয়ে বের হতে হতেও কখনো বের হয় নি ভয়ে, জড়তায়। আর তুমি তো দেখেছো আমার বাইরের দৃশ্য। ভেতরে পুঞ্জিভূত আবেগগুলো তোমাকে দেখানোর সৌভাগ্যও হয় নি আমার। কারণে-অকারণে আমি ফোনে বিরক্ত করেছি তোমাকে। আমার প্রিয় জুনিয়রগুলোও আসলে তোমাকে আমার পাশেই কল্পনা করেছিলো, তাই একটু আবেগের বশেই তোমাকে ক্ষ্যাপাতো আমাকে নিয়ে। আমি খুবই দুঃখিত! আমি আজ তোমার বিরক্তির তীব্রতা অনুভব করেছি। আর এমন হবে না এই প্রতিজ্ঞা করছি। তুমি যদি আমার এই মেসেজের উত্তর না দাও, আমি আর তোমাকে ফোনও করবো না। কিন্তু পনেরোটা দিন পরে ক্যাম্পাস খুললে তোমার সামনে শেষবারের মতো দাঁড়িয়ে শুধু একটি কথাই বলবো...
" তোমায় না দেখে তোমার কন্ঠ না শোনে এই ছুটির দিনগুলো আমার অসহ্য যন্ত্রণায় কেটেছে। তুমি শুনতে কি পাও সে আর্তনাদ?"

অর্পিতার চোখ বেয়ে জল নেমে আসে অঝোরে। অজান্তেই। কিছু চাপা কান্নার সুর বাতাসে মিশে। আশপাশের গাছপালা বিল্ডিং চেনা অচেনা লোকজন নীরব স্বাক্ষী হয়ে থাকে কিছু অনুশোচনার! কিছু আক্ষেপ জমে থাকে আজীবন অর্পিতার চোখের কোণে।

--------------------------------------------------------------------------
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৯৭১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৯/০৮/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast