www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

দূরত্ব (পর্ব-৩)

(দ্বিতীয় পর্বের পর)
৮.
বিবর্ণতার মাঝে কাটে প্রতিটি মুহূর্ত।পাতা ঝরা দিনের মতো শুকনো হয়ে থাকে তুলির মুখ।ঈদের ছুটি শেষে আরো পাঁচ দিন কেটে গেলো।অপু এখনো ফেরে নি।মোবাইলও বন্ধ।তুলি অনেকগুলো টেক্সট মেসেজ দিয়ে রেখেছে।একটি মেসেজও ডেলিভার্ড হয় নি। চোখের নিচে কালি জমে তুলির প্রতিটি নির্ঘুম রাতের সাক্ষী বহন করে।শুধু তুলিই না নিশো,প্রদীপ,লোপা,টুশি,বিথী,তনু সবারই বিষাদময়তায় ছেঁয়ে যায় যেন পুরো ক্যাম্পাস।ওদের আড্ডা জমে না।জমবে কি?? আড্ডাই হয় না আর! কেমন যেন ছন্ন-ছাড়া লাগে সবকিছু।ক্লাস শেষে কেউই যেন ক্যাম্পাসে আর স্থিরতা খুঁজে পায় নি।অপু পাঁচ দিন আসবে না,না আসুক,এমনতো আগেও অনেক হয়েছে।কিন্তু এভাবে মোবাইল অফ,কারো সাথে পুরো এক মাসের ছুটিতে যোগাযোগ না করা নিশ্চিত ভাবে কোন খারাপ কিছু কিংবা কোন অঘটনের ইঙ্গিত বহন করে।
ক্যাম্পাস খোলার সপ্তম দিন সকাল বেলা ক্লাস রুমে বসে একটা আলোচনা করছিলো।স্যার ক্লাসে আসেন নি।তুলির ইচ্ছা,নিশো-প্রদীপ কেউ একজন না হয় অপুর বাসায় যাক! গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসুক কী এমন হয়েছে অপুর!

স্যার ক্লাসে এলে যে যার যার জায়গায় গিয়ে বসে।নিলয় স্যার।এই স্যারের লেকচার খুব বিরক্ত লাগে ওদের।শুধু এটেন্ডেন্সের জন্যই কষ্ট করে পয়তাল্লিশ মিনিট কাটানো আর কি!ডিপার্টমেন্টের অর্ধেক শিক্ষকের ক্লাসই যেন মনে ধরে না।পাবলিক ভার্সিটির যেন এমনই অবস্থা এখন।তবে কিছু কিছু খুব ভালো শিক্ষকের জন্যই এখনো পাবলিক ভার্সিটি তার ঠিক গতি বদলায় না।

মিনিট দশেক পার হলো। কোন একজন ছাত্র ক্লাসে এলো..."আসবো স্যার" তুলি অবাক দৃষ্টিতে তাকায়।স্টুডেন্টটি ভেতরে ঢুকে একেবারে পেছনের ডেস্কে গিয়ে বসে।ক্লাসের সবাই তার হাঁটার গতির সাথে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে।চোখের নিচে কালিমার ছাপ।মুখটা স্বাভাবিকের চেয়ে ফুলে আছে যেন! গাল ভর্তি দাঁড়ি।মাঝারি লম্বাই বলা যায়।চুলগুলো লম্বা হয়ে আছে।লালটে ভাব চুলে।অগোছালো।
স্যার আবার ক্লাস শুরু করেন।কিন্তু তুলি সহ তাদের সার্কেলের কয়েকজনের মনযোগ যেন ওই ছেলেটির দিকে।ছেলেটি যে তাদেরই প্রাণপ্রিয় বন্ধু,যার অপেক্ষায় আজ সাতটি দিন কাটছে! কিন্তু অপুর এ কি দশা!এতো বিবর্ণতা ঘিরে আছে তাকে।মরা মাছের মতো ফুলে গেছে।মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে আছে।চুলগুলো পাটের মতো হয়ে আছে! স্যার তার লেকচারে ব্যস্ত।আর তুলি মগ্ন অপুকে নিয়ে ভাবনায়।অপুকে দেখে বুঝতে আর বাকি নেই যে কিছু একটা হয়েছে।তবু অন্তত অপুকে ফিরে পেয়ে কিছুটা স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলে তুলি।কখন যে ক্লাসটা শেষ হবে আর সে অপুর কাছে যাবে,সেই সময় যেন শুধু দীর্ঘায়িতই হচ্ছে।যেন সময় গুলো থমকে আছে ক্লাসরুমের বদ্ধ দেয়ালে।

অপু চুপটি মেরে বসে থাকে ক্যাম্পাসের জেনিটিক্স ল্যাবের লম্বা বারান্দায়।শহীদ মিনারের পাশেই বিশাল ল্যাব।আর বারান্দাটা যেন ছাত্র-ছাত্রীদের বসার জন্যই।প্রতিনিয়ত ছেলে-মেয়েরা বারান্দার ওখানে-এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আড্ডা দেয়।ল্যাবের কাজ যখন চলে তখন অবশ্য বসা গেলেও জোরে আওয়াজ করা যায় না।আজ ল্যাব বন্ধ।
ক্লাস শেষেই অপু দ্রুত ক্লাস থেকে বের হয়ে যায়।তুলি আর তার সার্কেলের সব বন্ধুরা তাকে ডাকতে ডাকতে তার পিছু নিয়ে এই ল্যাবের বারান্দায় আসে।অপু কে তিন দিক থেকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ওর ক্লোজ সাত বন্ধু-বান্ধবী। অপু বিড়ি ফুঁকে এক মনে।তুলিও চুপ।নিশো আর প্রদীপ অপুর নীরবতা ভাঙ্গার চেষ্ঠায় মত্ত।অপুর এই উদ্ভট আচরণ যেন সূঁচের মতো বিধে বিথী,লোপা,টুশি,তনুর।
মা'কে ডাক্তার দেখাবে বলে তনু চলে যায়।সাথে চলে যায় টুশিও।অপু এক সাথে টানা তিনটে সিগারেট ফুঁকে।ক্যান্টিনে যাচ্ছে বলে বিথী,লোপাও কেটে পড়ে।তুলি,নিশো আর প্রদীপ রইলো।রাগ সামলাতে না পেরে প্রদীপ অপুর মুখ থেকে সিগারেটটা কেড়ে নিয়ে ফেলে দেয়। "ওই কি পাইছিস তুই? এতোক্ষণ থেকে সবাই মিলে বলছি কি হইছে, তুই চুপ!" নিশোর মুখ রাগে লাল হয়। "ফাজলামি পাইছিস তুই? আমাদের ইমোশনের কোন দাম নেই?" রেগে-মেগে বসা থেকে উঠে পড়ে নিশো-প্রদীপ।কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে খুব বিরক্ত হয়ে চলে যায়।তুলি অবাক দৃষ্টিতে সবার চলে যাওয়া দেখে।ধৈর্যের সীমানা দেখে ওদের।ভেতরে তীব্র আন্দোলন চলতে থাকলেও একটি বাক্য উচ্চারণ না করেও পাশে বসে থাকে অপুর।অপু আরেকটা বিড়ি ধরায়।জায়গা বদলে ল্যাবের বারান্দার আরো পেছনে গিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে।কিছু না বলে তুলিও তার পাশে গিয়ে বসে।ক্ষুধায় তুলির পেট চোঁ চোঁ করে তবু সে অপুর নীরবতা ভাঙ্গার অপেক্ষায়।

মনের সমস্ত শক্তি দিয়ে এতোক্ষণ নিজের কথা আটকে রাখতে পেরেছে তুলি,কিন্তু আর চোখের জল আটকাতে পারে না। সে আর আটকাতেও যেন চায় না।এক সপ্তাহে ধরে জমে থাকা বিরহ যে বরফে পুঞ্জিভূত হয়েছিল,তা যেন গলতে শুরু করলো।অঝোরে ঝরে তুলির কান্না।সময়ের বুকে যে ক্ষত জমে আছে,আকাশের ঐ জ্বলন্ত সূর্যেরও সাধ্যি নেই যে সেটা শুকিয়ে ফেলবে।
"সবাই কতো আগেই চলে গেলো তুমি এখানে বসে আছো কেন?" বেশ ভরাট আর ভাঙা কন্ঠে অপু কথাটা বলতেই তুলি অপুর দিকে চমকে তাকালো।অপু তুলির মুখ চেয়ে আছে,তুলিও কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টি রাখে অপুর চোখে।"এতোটা দিন যার সুখের সাথী হয়েছি,তার খারাপ সময়েরও সাথী যে হতে চাই।"বিচলিত কন্ঠে উত্তর দিতে দিতে তুলি চোখ মুছতে থাকে।
প্রায় দু'ঘন্টা তুলির নীরব যুদ্ধের পর অপু কথা বললো।মেয়েদের কান্নায় সত্যিই যেন আলাদা কোন শক্তি আছে।বেশির ভাগ পুরুষই মেয়েদের কান্না সহ্য করতে পারে না।দুর্বল এক দিক যেন এটা।আবার মেয়েদের শক্তিও বলা যেতে পারে।
অপু অস্বস্তি বোধ করে।হঠাৎ করে এক নাগাড়ে কাশি শুরু হয় তার।একটার পর একটা বিড়ি ফুঁকে আর কাশতেও থাকে।এক বছর ধরে এমনই দেখে আসছে তুলি।অপুর হাত শক্ত করে ধরে তুলি। " বেশি খারাপ লাগছে?" ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে দেয় তুলি "বেশি খারাপ লাগলে হলে চলে যাও।" অপু হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ায়।তুলিও। দু'জনে হাঁটে হলের দিকে।অপুর হল তো আর ক্যাম্পাসের মধ্যেই।একটু শেষ প্রান্তে আর কি। "তোমার এ কি অবস্থা হয়েছে?" তুলিকে অপুর অবাক জিজ্ঞাসা।তুলি হাসে।হাসিটা যেন ঠোঁট থেকে বের হবে কি হবে না এমন করছে।মাথার উপর জ্বলন্ত সূর্য।শরীরটাকে যেন পুড়িয়ে মারছে।তুলি ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে ধরে মাথার উপর।এক ছাতার নিচে দু'জন। বেশ কিছু দিন পর। "আমার উত্তর তো পেলাম না।" "আমার মনেও যে নানান প্রশ্ন উঁকি মারছে অপু।সে প্রশ্নের উত্তর কি আমি পাবার যোগ্যতা রাখি না।" কথাটা মনের মধ্যে বিড়বিড় করে তুলির।আর উত্তরে বলে, "নাহ! এমনি!" হাঁটতে হাঁটতে হলের সামনে এসে যায় দু'জন। "যাও।পারলে একটু যত্ন নিও নিজের।কাল তো আর দেখা হচ্ছে না।ক্যাম্পাস বন্ধ।" "হবে না কেন?আমি ফোন..." অপু একটু আটকে যায়।আবার বলে,"আমার নাম্বার খোলা আছে।আমি ফোন দিলে ক্যাম্পাসে চলে এসো। কিছু জরুরী কথা আছে।" তুলি মাথা নাড়ে।তুলিকে একটা রিকশা দেখে দেয় অপু।মনের হাজার জিজ্ঞাসা দমিয়ে 'বাই' সূচক হাত নেড়ে চলে যায় তুলি।সাথে নিয়ে যায় একটুখানি প্রশান্তি।প্রিয় মানুষটিকে ফিরে পাবার প্রবল শান্তি।


৯.
মোবাইল ফোন এর রিংটোন বেজেই চলেছে।দু'তিন বার রিং হবার পর ঘুম কাতুরে চোখে স্ক্রিনে অপুর নাম দেখে আৎকে লাফ দিয়ে উঠে তুলি। "হ্যালো" " হ্যালো।দশ মিনিট সময় দিলাম।তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বের হও।" " মানে?" ঘড়ির দিকে তাকিয়েই আবার চমকে উঠে তুলি। "কি বলো অপু? কেবল সাতটা বাজে?" "আমি রিকশা নিয়ে তোমার বাসার সামনে আছি।দশ মিনিটের মধ্যে আসো।" "হ্যালো..হ্যালো..." অপু কল কেটে দেয়। তুলি হাই তুলতে তুলতে বিছানা থেকে উঠে। তড়িঘড়ি করে হাত-মুখ ধুয়ে একটা ড্রেস পরেই মায়ের রুমে যায়।তুলির বাসার সবাই নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে।মা কে কী বলবে ভেবে পাচ্ছিলো না।তাও মায়ের রুমে গিয়ে আবার ঘুরে নিজের রুমে আসলো।মা'কে বললে নির্ঘাত এতো সকালে বের হতে দিবে না।আর অপুর সাথে বেরোচ্ছে সেটা তো বলাই যাবে না।তুলি রুলিকে ঘুম থেকে তুলে ওকে দরজা লাগাতে বলে বেরিয়ে গেলো।রুলি ওর বাবার কাকাতো ভাইয়ের মেয়ে।অর্থাৎ তার কাজিন। ওদের বাসায় থেকে পড়ালেখা করে।মেট্রিক পরীক্ষা দিবে এই বার।পরে যা হয় হবে কিন্তু অপুকে এ যাত্রায় ফিরিয়ে তো আর দিতে পারে না সে।তাই এই রিস্ক নিতে দ্বিধা বোধ করলো না তুলি। বাবার কাছে নিশ্চিত বকা খাবে তাও বের হলো।
রিকশা চলে।দু'জনের গায়ে লাগে সকালের ঝিরি ঝিরি হাওয়া।তুলিকে ঘুম থেকে উঠার পর দেখতে স্নিগ্ধ সকালের মতোই লাগছে অপুর।ন্যাচারাল বিউটি।অপু'র প্রিয় জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে তুলিকে।ক্যাম্পাসের দিকেই।মাঝে মাঝে সারা রাত জাগার পর যে দোকানে নাশতা করে সেখানে নাশতা করতে নিয়ে যাচ্ছে।এ কথা শোনে তুলির খুশিতে মন আর ধরে না। অনেক দিনের শখ ছিল তার খুব সকালে সে ক্যাম্পাসে যাবে।আজ সেটা হয়তো পূরণ হবে।অপু তবু যেন খুব কম কথা বলছে।তার মধ্যে বিশাল এক পরিবর্তন নিমিষেই ধরা পড়ে।তুলিরও টেনশন।বাসায় ফিরে কি জবাব দিবে! তবু সব ভুলে তুলি হারিয়ে যেতে চায় আজকের সকালে।স্নিগ্ধ সকালটা যেন আরো মনোরোম হয় অপুর হাতটা ধরতে পেরে।
নাশতা শেষ করে দু'জন সোজা ক্যাম্পাসে চলে যায়।এতো সকালের ক্যাম্পাস তুলির প্রথম দেখা।বাসায় থাকে বলে এই সুযোগ হয় না।হলে থাকলে তো আর কথাই ছিলো না।গোল চত্বরে পাশাপাশি বসে দু'জন।ক্যাম্পাসে লোকজন নাই বললেই চলে।মাঝে মাঝে দু'একজনকে দেখা যায় মর্নিং ওয়াকে আসছে।শান্ত পরিবেশ।নির্মল হাওয়া।তুলি আবারো হাত ধরে।অপুও নিষেধ করে না।অথচ ওদের মধ্যে এমন কোন চাক্ষুস গভীর সম্পর্ক গড়ায় নি।মনের গভীরতাটুকুই ভিত্তি।অপুর মধ্যে গম্ভীর ভাব বাড়তে থাকে।চোখ দু'টো ছলছল করে। "আমি যখন শুরু করবো তুমি ভীষণ কষ্ট পাবে , কারণ আমি খুব খারাপ মানুষ।আর আমি যখন কথা শেষ করবো তুমি শুরুর চেয়েও বেশি কষ্ট পাবে,কারণ তুমি খুব ভালো মানুষ।" অপুর কথার কোন মানে বুঝতে না পেরেই তুলি কথা শুরু করতে বলে।

"কিছু স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন নিয়ে এই ক্যাম্পাসে পরীক্ষা দিতে আসা আর সাথে করে নিয়ে গেলাম আরেক স্বপ্ন। "নিতু"। এই ক্যাম্পাসেই পরিচয়।সে সূত্র ধরেই পরিনয়।ভালোবাসায় ভর করে সম্পর্ক গড়ায়।" তুলি অপুর হাত থেকে হাতটা সরিয়ে নেয় আস্তে করে।অবাক দৃষ্টি সরিয়ে নেয় অপুর মুখ থেকে।মুখটা লাল হয়ে যায়।টলমল করে চোখ দু'টো।পায়ের নিচের মাটি যেন সরে যায়! এ কি বলছে অপু।অপু এতোদিন প্রেম করলো আর কেউই জানলো না কিছু।তুলি বিস্ময়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় মাটির দিকে।
অপু একের পর এক কাহিনী বলতে থাকে।তার কথার গভীরতায় ভারি হয় আকাশ।স্নিগ্ধ সকালের হালকা হাওয়া তুলির কাছে ক্রমাগতভাবে ভারি মনে হতে থাকে।তুলি জানতে থাকে অপুর না জানা প্রেম কাহিনী।। "আমার সিগারেট খাওয়া নিয়ে প্রায়ই আপত্তি তুলতো নিতু।কতো না চেষ্টা করেছে।কিন্তু আমি তো আমিই।" এই বলে অপু একটা সিগারেট ধরায়। "খুব ভালোবাসতো আমায়।নিজের মনের মতো করে সাজিয়েছিলো বাগান।আমার জায়গাটা যেন শুধু ওরই।আমার প্রতি তার এই অগাধ ভালোবাসাই জন্ম দেয় কিছু প্রশ্নের।তোমার ছবি দেখার পর সে খুব কষ্ট পায়।তার ভাবনার রাজ্যে যেন তোমার অদৃশ্য উপস্থিতি বাড়তেই থাকে।আর বাড়ে সন্দেহের বীজ।আমি তাকে বোঝা ই যে তুমি আমার ফ্রেন্ড ছাড়া আর কিছুই নও,তবু আমাকে হারানোর ভয় তাকে তীব্র ভাবে গ্রাস করে।" অপু বলতে থাকে।শেষ কথাটা শোনে তুলি মাথা তোলে অপুর দিকে তাকায়।কথাটি যেন প্রবল ভাবে তার হৃদয় ভেদ করে মিশে যায় তার কান্নায়।অপু তুলির দিকে তাকায়।দু'হাত দিয়ে তুলির দু'গালে ধরে তার মুখের সামনে আনে তুলির মুখ। "আমি জানি কথাগুলো তোমাকে না বলে আমি অন্যায় করেছি।কিন্তু বিশ্বাস করো,আমি কিছু মাস পরেই বলতাম কিন্তু তোমাকে নিতু সহ্য করতে পারতো না বলে তোমাকে আর বলার সাহস পাই নি।" তুলি হাত সরিয়ে মুখ নিয়ে যায় মাটির দিকে।মাথা নিচু করে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে থাকে।চোখের জল তার অঝোরে ঝরে।যে অপুকে নিজের ভেবে এসেছিল সে যে তার ছিলোই না কখনো!
"কিন্তু তোমার মোবাইল পুরো ছুটিতে বন্ধ,আমার সাথে, কারো সাথে যোগাযোগ না করা,ছুটির পর এক সপ্তাহ ক্যাম্পাসে না আসা,এসবের সাথে নিতু কাহিনীর সম্পর্ক কি? তবে কি নিতু তোমাকে...?" তুলির মুখ থেকে কথা কাড়ে অপু। "আমার কথা এখনো শেষ হয় নি তুলি।জীবনের কিছু কঠিন সময়কে বর্ণনা করার সাহস আজ অনেক কষ্টে যুগিয়েছি।তোমার ভরসায় তুলি।" অপু আরেকটা বিড়ি ধরায়।তার কন্ঠ যেন আরো ভারী হতে থাকে।থরথর করে কাঁপে তার গলা।তুলি নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে অপুর দিকে। "ভালো থাকার শেষ দিন মনে হয় সেদিনই ছিলো।তোমাদের সবার মাঝে ঈদের আমেজ,পূজার আমেজ।তোমরা মত্ত রাত পোহাবার অপেক্ষায়।সকাল হবে,আর বাড়ি যাবার আয়োজন শুরু হবে।ফুরফুরে মেজাজে পুরো ক্যাম্পাসের আলো-বাতাস।সে রাত যেন নিয়ে আসে আমার জন্য এক বিভীষিকা।ফোনে তুমুল ঝগড়া,মনোমালিন্য হয় নিতুর সাথে।আমি যেন তোমার সাথে এক সাথে না ফিরি,অদ্ভুত আবদার।ধৈর্যের সমস্ত বাঁধ ভেঙ্গে আমি প্রতিবাদ করি ওর ওই হীনমণ্যতার।ভালোবাসার সম্পর্কে শুরু হয় বিধুর তিক্ততা।তোমার যে বাসাই এখানে সেটা তাকে বোঝাতে পারি না আর!বাসায় গিয়ে পরের দিন বিকালে দেখা করি নিতুর সাথে।খুব তর্ক যুদ্ধে শুরু হয় সে সাক্ষাত।নিতু আমাকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকে।আমাকে বুঝায় যে তীব্র ভালোবাসা থেকেই তার এমন উচ্চারণ।আমার অভিমান ভাঙ্গে না।তোমার মতো এতো ভালো একটা মেয়েকে জড়িয়ে আজেবাজে কথা আমার মনে কাঁটার মতো বিঁধে।আমি তীব্র ক্ষোভের মুখে চলে যাই বাসায়।পিছনে ফিরে তাকাই নি।ওর কান্না সহ্য করতে পারবো না বলেই চলে যাই।আমি রাস্তায় থাকতে থাকতে সে অনেকবার আমাকে ফোন দেয়।আমি ধরি নি।ওকে কিছু শিক্ষা দিতে মোবাইলটা অফ করে রাখি।সারা রাত মোবাইল অফ থাকে।আমি বিরহ বেদনায় ছটফট করি অনবরত।প্রিয় মানুষটিকে কষ্ট দিচ্ছি বলে সারারাত পুড়ে ছার-খার হয় দেহ-মন।টানা দু'দিন পর মোবাইলটা অন করি। এর মাঝে বিড়ি খাইতে যাওয়া ছাড়া আর বের হতে যাই নি।" তুলির ফোন বেজে উঠে।ওর বাসা থেকে মা'র ফোন।ফোন রিসিভ করে মায়ের বকা শোনে,তাও কোন রকম মা'কে ম্যানেজ করে সে।সকাল সাড়ে ন'টা বাজে।কতো সকাল বেরিয়ে ছিলো! তা ও ছুটির দিনে।" ফোনে কথা শেষে তুলি লক্ষ্য করে অপু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। অপুর হাত আবার ধরে তুলি। "তারপর?" ধীর জিজ্ঞাসা তুলির। "মোবাইল অন করতেই তিন-চারটে টেক্সট মেসেজ আসে নিতুর।অনেক আবাগ মাখা প্রথম দু'টো মেসেজ।তাকে যেন ভুল না বুঝিএই টাইপের আর কি!তিন নম্বর মেসেজটা আসে গত কাল সকালে,যে মেসেজটি আমাকে আচমকা ঝড়ের মতো উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইলো। "আই লাভ ইউ ডিয়ার।অনলি ইউ নেভার আন্ডারস্ট্যান্ড।আ'ম কুইট অপু।" হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে আমি নিতুর বাসার দিকে রওয়ানা দেই।এ ম্যাসেজের অর্থ কী উদঘাটন করতে পারি না।গভীর এক আশংকা মনে দাগ কাটে।জেদের বসে নিতু কিছু করে বসলো না তো এ উদ্বেগ কাজ করে! নিতুর বাসায় ঢুকে নিতুর মা'কে বললাম নিতুকে একটু ডেকে দিতে।নিতুর মা আমাকে ড্রয়িং রুমে বসতে বললেন।ওদের বাসার সুঁনসান নীরবতা দেখে অবাক হই।পরিবেশটা কেমন জানি গম্ভীর।নিতুর বাবা আসলেন, উনি এসে যা শোনালেন তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।উনার কথা শোনে আমার মাথায় যেন বাজ ভেঙ্গে পড়ে।পায়ের নিচের মাটি সরে যায়।আমার জীবনটা যেন থমকে যায় সেখানেই।সকল আশা ভরসার শেষ যেন হয় আমার।নিতুর মৃত্যু সংবাদ জেনো কোন ভাবেই আমি মেনে নিতে পারি নাই " অপু হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।নিতুও কাঁদে আর শক্ত করে হাত ধরে ভরসা যোগায় অপুকে। "একদিনের মধ্যে কি এমন হয়ে গেলো নিতুর?" তুলি ক্রন্দন কন্ঠে জিজ্ঞেস করে। " সকাল বেলা বেরিয়েছিলো রিকশায়।কলেজে যাবে বলে।আহত রিকশাওয়ালার ভাষ্যমতে একটি অটোরিকশার(সিএনজি চালিত) সাথে দুর্ঘটনায় সে স্থলেই প্রাণ হারায় নিতু।পেছন থেকে ধাক্কা দেয় এসে।দুর্ঘটনাস্থলে নিতুর মোবাইল ফোনের অস্তিত্বই খুঁজে পায় নি কেউ।" অপু একটু থেমে আবার শুরু করে। "আমি সেদিনই শেষ হয়ে যাই তুলি।আমার মোবাইলটা বন্ধ করে রেখেই এই কাল ডেকে এনেছি আমি।আমার জন্যই ও এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে।সেদিনই বাসায় ফিরে আমার মোবাইলটা আমি ভেঙ্গে ফেলি।কিন্তু আমার নিতু ফিরে আসে না আর।"
ওটা দুর্ঘটনা ছিলো নাকি সুইসাইড এই চিন্তা এখনো ভাবায় অপুকে।পুরো দুনিয়া জানে এক্সিডেন্ট।কিন্তু নিতুর শেষ মেসেজটা যেন অপরাধি করে তুলে অপুকে।নিষ্ঠুর বাস্তবতার কারণে নিতুর মেসেজটির কথা ওর বাসায়ও জানাতে পারে নি।
অপুর আর্তনাদ ভাসে ফাঁকা ক্যাম্পাসে।তুলিও কাঁদে অপুর কান্নায়।
আকাশে-বাতাসে যেন ভেসে বেড়ায় নিতুর মুখ।সে যে চলে গেছে না ফেরার দেশে।তাকে শেষ সুযোগটি থেকে বঞ্চিত করার অপরাধে নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না অপু।ভালোবাসা কি তা যে শিখেছে নিতুর হাত ধরে।নিতুর স্পর্শে শিখেছে সম্পর্কের মানে।
(চলবে)
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১২৬৬ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৬/০৩/২০১৬

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • খুব ভাল লাগল।
  • হাসান কাবীর ১৪/০৩/২০১৬
    ভালো লেগেছে, সময় নিয়ে মনোযোগ দিয়ে পরতে হবে। শুভেচ্ছা।
  • স্বপন শর্মা ১১/০৩/২০১৬
    দুরত্বের অবসান হোক, পরের পর্বের অপেক্ষায় রলাম।
  • দারুণ লাগল ভাই, পরেরটার অপেক্ষায় থাকলাম, আর আজকে অর্কর গোয়েন্দাগিরির পরের পর্বটা দিলাম, সময় পেলে পড়ে দেখ।
  • প্রদীপ চৌধুরী. ০৬/০৩/২০১৬
    ভাল হয়েছে, তবে ফেরেনি, পায়নি, হয়নি এগুলো এক সাথে লিখবেন|
    • দেবাশীষ দিপন ০৬/০৩/২০১৬
      www.bangla-kobita.com/oniruddho/post20151223022715/
    • দেবাশীষ দিপন ০৬/০৩/২০১৬
      আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই কবি।মূলত বাংলা কবিতা ডট কমের শ্রদ্ধেয় কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল বানান শুদ্ধিকরণের উপায়ে এটা এক সাথে না লিখার পরামর্শ দেন।লিংকটা আমি দিয়ে দিলাম মন্তব্যে।
 
Quantcast