www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

গোপলার কথা - ৫৪

প্রবাসী
--------

প্রবাসী নিজের গ্রামে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মত যোগ্যতা অর্জন করে বেরিয়ে পড়ে। আর গ্রামে ফিরে না। ফিরতে চায় না। দু পাঁচ বছর অন্তর এক আধ বার আসে। যাইহোক করে দু চার ঘণ্টা কাটিয়ে পালাই পালাই রব তুলে চলে যায়। নোংরা জঘন্য এঁদো ভুতুড়ে ইত্যাদি ভাবনায় নাক সিঁটিয়ে নিজের প্রবাসে ফিরে আসে।
এই যাওয়া আসা নাড়ির টান যতক্ষণ থাকে অর্থাৎ বাবা মা যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ; না হলে লোকে কি বলবে এই ভেবে কষ্ট করে হলেও যাওয়া আসা করতে থাকে। তারপর বাবা মা মারা গেলে, সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা করে এই যাওয়া আসা বন্ধ হয়ে যায় কিংবা নিতান্ত খুব দরকারে গ্রামে ফেরে অথবা ফেরে না। এইসব কারণে প্রবাসীরা ক্রমশ শহর ছাড়িয়ে শহরে দেশে এবং বিদেশে আকাশচুম্বী বাসা বাঁধে।

মানুষ কেন প্রবাসী হয়? কর্মসূত্রে? ব্যবসার জন্য? কাজের জন্য? ছেলেমেয়ের শিক্ষার জন্য? বিলাসিতার জন্য? নাকি শহরের প্রাচুর্যে জন্য? এসব কোন না কোন বিষয় সামনে রেখে মানুষ দেশে বিদেশে শহরে শহরতলিতে ভিড় জমায়। তারপর আর ফিরে আসে না। নিজের নেটিভ বা জন্মস্থানে আর ফিরে আসে না। আসতে চায় না। কিন্তু কেন ফিরে আসে না? কেন ফিরে আসতে চায় না?
কর্মের অবসরে কিংবা ব্যবসার সাথে সাথে গ্রামের স্কুল, গ্রামের রাস্তা, গ্রামের মানুষের বিকাশ, গ্রামের জীবনযাত্রায় আরও মনুষ্যত্ব খোঁজা ইত্যাদি করার মানসিকতা নেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু নেয় না। গ্রামে যারা থাকে, যারা বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে না, প্রবাসী হওয়ার সুযোগ পায় না (প্রায় অনেকেই প্রবাসীর সম্পর্কিত, রক্তের সাথে বা হৃদয়ের সাথে যুক্ত) তাদেরকে তাদের পিছিয়ে পড়া অবস্থানে ছেড়ে দেয় প্রবাসীরা। পাশে দাঁড়ায় না।
কিন্তু কেন?
তবু কোনো না কোনো প্রবাসীর মনে সেই দুপুর রোদ, মাঠ পুকুরে বিলের ধারে কৈ মাছ, তালগাছের পাশে ভুতুড়ে বাঁশবন, লুটকু ছুটকু মিটকুর সাথে বর বউ খেলা, চুপি চুপি খড়ের গাদায় কিছু বাল্য গন্ধ, ভয়ের রাত, মায়ের কোল, তাল পড়ার শব্দে চমকে ওঠা, কুকুরের বাচ্চা, বর্ষার রাতে ছপছপ শব্দ আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক ইত্যাদি মনে পড়ে। মনে পড়তে বাধ্য। কোন কোন প্রবাসীর মন উদাস করে দেয় জীবনের সেই সব স্পর্শ।
ধান ক্ষেত্রের ধারে সেই সব লুকানো মাটির গন্ধে সে মাতাল হয়ে যায়। ফিরতে চায়। শীতের রাতে উনুনের পাশে বসে সে গা সেঁকতে চায়। কাদা মেখে বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরে সে একশা হতে চায়। বাবা মা দাদা দিদির বকুনি খেতে চায়। রোদে ঘেমে নেয়ে এসে মায়ের আঁচলে মুখ মুছে তালপাতার প্রাণ জুড়ানো পাখার হাওয়া খেতে চায়। সুট বুট পরে হাঁটুর উপর ছেঁড়া কাপড় পরা কাস্তে হাতে ধরা চাষীকে বলতে চায় - কি গো নেতাই খুঁড়ো এ বছর আলু কেমন ফলেছে? তোমার খবর কি হে বংশীদাদা? মতিনচাচা, আজকাল মিতুর সঙ্গে খুব বাঁশি বাজাচ্ছো?
কিন্তু ফিরতে পারে না। সেই সব বলার জন্য, দেখার জন্য আর ফিরে যায় না। না কি, ফিরতে চায় না? সত্যিই কি ফিরতে চায় না। নাকি ফিরতে পারে না।
কর্মসূত্রে বা কর্মের খোঁজে যেই কেউ প্রবাসে বেরিয়ে গেল অমনি যারা থেকে গেল তারা প্রবাসীর নামের পৈত্রিক সম্পত্তি নিয়ে নানান ভাবনা চিন্তা শুরু দেয়। 'ও তো আর ফিরবে না? ওর সম্পত্তি শুধু শুধু রেখে দিলে বেহাত হয়ে যাবে। তার চেয়ে আমাকে দিয়ে দাও?' এই বলে লক্ষ্মণ দশরথের কাছ থেকে লিখিয়ে নেয়।
দশরথও ভাবে 'ওর (প্রবাসীর) তো মাসে মাসে মাইনে আসছে। টাকায় টাকা। এখানে লক্ষ্মণ বা ভরত বা শত্রুঘ্ন বেচারা অসহায়, আমার চোখ বোজার আগে এদের জন্য কিছু করে যাওয়া দরকার'। তাই সব কিছু দিয়ে দেয় লক্ষ্মণকে বা অন্য ভাই বোনেদের। রামের সাঙ্গপাঙ্গ সীতা লব কুশ এরা সত্যিই হয়তো আর ফিরতে চায় না। তাই সেই সুযোগে চুপ থাকে। ভাবে ভালই হল। কিন্তু যখন লব কুশ ছেড়ে যায়। মাসে মাসে মাইনে আসার জোর কমে যায়। সীতাকে নিয়ে নিরিবিলি আস্তানা খোঁজে তখন মন কাঁদে। ফিরতে চায়। অনেকেই। কিন্তু আর কোন রাস্তা থাকে না।
যখনই সে ফেরে দু চার দিনের জন্য তখন সে যতটা পাশ কাটিয়ে যায় তার চেয়ে বেশি সেখানকার অধিবৃন্দ তাকে পাশ কাটিয়ে দেয় - তোরা কি আর আমাদের কথা মনে রাখবি? তোদের ফ্রিজ এসি বড় টিভি মোবাইল কম্পিউটারের আহ্লাদী জীবন। আমাদের কাদা ঘাস লতাপাতার জঙ্গল, দূরে দূরে আলোর কুপি তোদের কি ভাল লাগবে? সরু চালের বিরিয়ানি খাওয়া মুখে মোটা চালের ভাত খেতে পারবি?
এসব প্রবাসী কি সত্যিই শুনতে চায়? সে তো এখানকার ছেলে কিংবা মেয়ে। বড় অট্টালিকা এসি টিভির যান্ত্রিকে সে অতিষ্ঠ তার উপর এই ঠেস দেওয়া কথা সে কি সত্যিই সহ্য করতে চায়। ভেতরে তার ফেরার ব্যকুল বাসনা কেউ দেখতে পায় না। না তার ছোটবেলার গ্রাম্যযাত্রা না বর্তমানের গ্রামে না থাকা প্রজন্ম। দুমুখো ঠেলায় সেই প্রবাসীই থেকে যায় প্রবাসে। ফেরে না। ফিরতে পারে না।
আর আয়োজন। প্রবাসী কেউ ফিরলেই সবাই ভাল ভাল কথা বলে, মাছ মাংস ডিমের এলাহী আয়োজন করে। সে এসব আয়োজন চায় না। একাত্ম হতে চায়। কোথায় যেন বিচ্ছিন্ন করার ভাবনা সবার মধ্যে ঘোরে ফেরে।
সে ফিরতে চায়।
বিষয়শ্রেণী: সমসাময়িক
ব্লগটি ৬৬৬ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২১/০১/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

 
Quantcast