www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

গোপলার কথা - ৪৮

গল্প চর্চা
--------

যুগ যুগ ধরে মনুষ্যমাত্রেই গল্প করে বাঁচে। একজনের সাথে আর একজনের দেখা হলে গল্প করে। কবিতা পড়ে না, আবৃত্তি করে না, গান শোনায় না, গান করে না, ছবি আঁকে না, ছবি দেখায় না, ইশারা করে না, নাটক করে না, পাঁচালি শোনায় না শুধু গল্প করে। আর গল্প করে। কিংবা এসব করার সাথে সাথে গল্প করে, গল্প বলে, গল্প শোনে, গল্প শোনায়।
গালগল্প, না-গল্প, হ্যাঁ-গল্প, শুধু গল্প, গল্পের আভাষ বা গল্পের বিভাস। এই গল্প করার মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে মানুষের হৃদ্যতা বাড়ে, মানুষ ভালোবাসে, মানুষ ঈর্ষান্বিত হয়, মানুষ সৃষ্টি করে, মানুষ ধ্বংস করে এবং মানুষ আগামী গড়ে অথবা মানুষ ইতিহাস হয়ে যায়।
অর্থাৎ গল্প করাই বাঁচিয়ে রাখে যুগের প্রবাহ। গল্পের মতে করে পড়লে পড়া সহজ হয়ে যায়। গল্পের মত করে বললে শোনা সহজ হয়ে যায়। গল্পের মত করে পর পর সাজিয়ে শুনলে বুঝতে পারা সহজ হয়ে যায়। গল্পের মত করে ভাবলে ভাবা সহজ হয়ে যায়। গল্পের মত করে দেখলে দেখা হয়ে যায় প্রাণবন্ত।
একজন আর একজনের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করলে তাকে চেনা জানা বোঝা হয়ে যায়। যার সঙ্গে আপনার ভাব তার সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ গল্প করুন দেখবেন তার সঙ্গে আরো গভীর ভাব ভালোবাসা গড়ে উঠছে। যার উপরে রাগ করেছেন তার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করুন রাগ গলে জল হয়ে যাবে। যাকে ভুল বুঝেছেন, খারাপ লোক মনে হচ্ছে তার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করুন উল্টো ফল পাবেন। তাই তো প্রেমিক প্রেমিকা একান্ত নির্জনে কিছু আলাপচারিতার (গল্প) মাধ্যমে নিজেদেরকে বুঝে নেয়। প্রেমের পথ প্রসারিত করে।
পাড়ার রকে, চায়ের আড্ডায়, অনেক মুখে মুখোমুখি হয়ে শুধু গল্প আর গল্প করে। কে শুনছে কে শুনছে না ভাবেও না দেখে না কিন্তু গল্প করতেই থাকে, গল্প বলতে থাকে। কেন না এই গল্পই আমাদের প্রাণের সংলাপ। জীবন ধারার কথা চিত্র।
এজন্য গল্প আমাদের জীবনের চেনা জানা দেখা বলা ভাবা চলার ক্ষেত্রে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে। হাটে বাজারে মাঠে ঘাটে ফুটপাতে আলিশানে সর্বত্র গল্প বসে থাকে, গল্প ঘুরে বেড়ায়, গল্প দেখে, গল্প ভাবে, গল্প আপনাকে আমাকে নিয়েই গল্প করে। এই গল্পকে বাদ দিয়ে কোন জীবনী নয়, কোন রচনা নয়, কোন আগামী নয়, কোন যুগ নয়।
আবার সাহিত্য ধারায় গল্প আপামর মানুষের কাছে সমান জনপ্রিয়। গল্প পড়ার ছলে, গল্প করার ছলে, গল্প ভাবার ছলে
গল্প দেখার ছলে যে কেউ যখন তখন দু এক কলি গান গেয়ে ওঠে, কবিতা মনে পড়ে যায়, মনে মনে আকাশের কুসুম নামিয়ে ছবি আঁকে আর পাশের কোন মানুষকে সহজ করে বুঝতে পারে। অর্থাৎ সমস্ত ধারার মাঝে গল্প আছে। গল্পের মাঝে সমস্ত ধারা আছে। গানে আছে, কবিতায় আছে, উপন্যাসে আছে, বক্তব্যে আছে, প্রবন্ধ আছে, বইয়ে আছে, প্রতিটি মানুষের সাথে আছে। শুধু গল্প এবং শুধু গল্প আছে।
গান শুনতে শুনতে বা গান গাইতে গাইতে আপনি মনে মনে যে চিত্র আঁকেন তা একটা গল্প। তাই আপনার চোখে জল আসে, আপনি হেসে ওঠেন বা ভাবেন।
কবিতা পড়ার সাথে সাথে বা কবিতা লেখার সাথে সাথে যে চিত্র আপনার চোখে ভেসে আসে বা অন্যকে যে চিত্র ভাবাতে বাধ্য করান তা অবশ্যই কোন গল্প ভাবনা। উপন্যাসের এক একটা অংশ ছোট ছোট উপজীব্য গল্প। তারপর তোমার আমার দেখা কোন বড় একজন।
প্রবন্ধে যা আপনার ব্যাখ্যার বিষয় তাতে অবশ্যই সমাজের দেখা কোন কল্প কথার বিস্তৃত গল্পের রূপ। যাকে নিয়ে ভাবতে ও ভাবাতে চাইছেন তা অবশ্যই কোন ব্যাখ্যার গল্প।
অর্থাৎ গান কবিতা উপন্যাস প্রবন্ধ বা সাহিত্যের যে কোন ধারায় আপনি যদি গল্পের আকারে সেই ভাবনা নিজে ভাবতে না পারেন বা অন্যকে ভাবেতে না পারেন তাহলে সেই গান কবিতা উপন্যাস প্রবন্ধ বা অন্য কোন সাহিত্যধারা জনমানসে উপজীব্য হবে না।
সেটা গানের মত, কবিতার মত, উপন্যাসের মত, প্রবন্ধের মত বা সাহিত্যের অন্য কোন ধারার মত হবে। সাহিত্য ধারা নাও হতে পারে। যদি হয়ও তাহলে তা কখনওই সুদূর প্রসারী হবে না।
অর্থাৎ গল্পই হল সাহিত্য। সাহিত্যের মাঝে গল্পের অনাবিল ভাবধারা। গল্প ভাবনা উপেক্ষা করে সাহিত্য সৃষ্টি কখনই সম্ভব নয়। যে কোন সমাজের দেশের গোষ্ঠীর সম্পর্কে জানতে হলে আপনাকে সেই সমাজের গোষ্ঠীর দেশের ইতিহাস/সাহিত্য পাঠ করলেই জানতে পারবেন। সেই গল্প উপন্যাস গান কবিতা প্রবন্ধ যাই হোক না কেন? জানতে পারবেন তখনকার সমাজ চিত্র যা উপন্যাসের সাথে সাথে ছোট ছোট গল্পের চিত্রকথা।
সাহিত্য ভাবধারার অন্যতম অংশ হল চিত্রকলা। যা কিচ্ছুটি না বলেও অনেক কথা বলে যায়। এক একটা চিত্রপট এক একটা গল্প। যেমন সমাজের দেখা প্রতিটি মানুষই এক একটা মস্ত বড় গল্প। আসলে এই মস্ত বড় গল্পকে কমপ্যাক্ট করে যে যেভাবে পারে উপস্থাপিত করে।
কেউ গানে কেউ গল্পে কেউ কবিতায় কেউ প্রবন্ধে কেউ উপন্যাসে আর এখন কেউ বর্তমানে অণুগল্পে উপস্থাপিত করছে।
আবহমান বিশ্বের চলমান গল্পকে অন্যের কাছে উপস্থাপনা করা বা অন্যকে বলব সে যেন শোনে এ রকম করে তুলে ধরা একটু কঠিন। যা বিভিন্ন ভাষায় অসামান্য সাহিত্যিকরা অন্যান্য মুন্সিয়ানায় আমাদের রত্নরাজি দিয়ে গেছেন।
তাই 'স্বরচিত গল্প' ভাবনা বিস্তারের ক্ষেত্রে অবশ্যই সাহিত্যের অন্যতম ধারা।
আপনি কিংবা আমি একটা বিষয় ভাবলাম। সেটা সমাজের রূপকথার কিংবা অন্য। যে কোন হতে পারে। তারপর তাকে উপস্থাপনা করব। সাহিত্য সংস্কৃতি ধারায়। সেটা গল্পে হতে পারে, কবিতায় হতে পারে, গানে হতে পারে, ছবিতে হতে পারে কিংবা নাটক সিনেমা ও অন্যান্য অলংকারে।
এই ভাবনাটাই স্বরচিত। যে কোন সাহিত্যধারার অনুগামী জীবনের কোন না কোন সময় এই স্বরচিত ধারায় আত্মপ্রকাশ করে।
তার মানে ভাবনাটাই উপজীব্য। ভাষা নয় বা তার কাঠামো (গল্প, কবিতা, গান, ছবি ইত্যাদি) নয়। যে দেশ যে জাতি যে ভাবুক এই ভাবনার সুদূর প্রসারী আকাশ আঁকতে পারে সেই দেশ সেই জাতি সেই ভাবুক অনন্ত ভাবধারায় বিরাজ করে।
স্বচ্ছ ভাবনা ভাবার পর তাকে বাংলা ইংরেজি হিন্দি উর্দু ইত্যাদি যে কোন ভাষায় প্রস্ফুটিত করা যেতেই পারে। কিংবা নির্বাক ভাষাতেও বলা যেতে পারে। তাতে কিছু যায় আসে না।
এই স্বরচিত ভাবনা যদি গল্প করা, গল্প বলা, গল্প শোনানো বা গল্প দেখার হাত ধরে, স্বচ্ছ স্পষ্ট গল্পিক ছবি যদি পাঠক শ্রোতা এবং দর্শকের সামনে তুলে ধরে তাহলে সাহিত্যধারার সেই গল্প, কবিতা, গান, নাটক, ছবি যাই হোক না কেন তা অনেক বেশি উপজীব্য হবে।
সাহিত্যধারায় সবচেয়ে বেশি লেখা হয় কবিতা। ছন্দে দ্বন্দ্বে ভাষার আনন্দে যে কেউ লিখে ফেললেন দু চার লাইন। এই লাইনে যদি গল্প ভাবনার সাথে গল্প ভাবনার বিস্তৃতি কম কথায় অপরিসীম অসীম ভাবে প্রস্ফুটিত হয় তাহলে তা সাহিত্যের আঙিনায় প্রবাহিত হবে অনন্তকাল।
না হলে শব্দের চাতুরীতে সাহিত্য জব্দ হওয়া ছাড়া আর কিছু থাকে না। বর্তমানে যেভাবে কবিতা লেখা হচ্ছে। পড়লাম। ব্যাস এটুকুই। কি বুঝলাম কে জানে? এমন কি লেখকও জানে না। অর্থাৎ শব্দের অপূর্ব বাঁধন আছে। কিন্তু ভাবনায় জীবনের অজীবনের নাজীবনের বা কোন প্রকার গল্প ভাবনার গল্পিক ছবি নেই।
আবার উল্টোদিক থেকে ভাবলে দেখা যায়, লেখক কোন বার্তা জীবন ইত্যাদি নিয়ে ভাবেন নি। শুধু লিখেছেন। এবং শব্দের কিছু নতুন অবস্থানও জুড়ে দিয়েছেন। আমাকে আপনাকে পড়াতেও বাধ্য করছেন। এভাবে সঠিক কবি ও কবিতা কখনই সাহিত্যধারার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত নয়।
তবে হ্যাঁ সাহিত্যভাবনায়, সাহিত্যধারার বাটন ধরার জন্য এসব খুবই প্রয়োজন। কারণ এও তো সাহিত্য ধারার একটা অংশ। এভাবেই এগোতে এগোতেই তো অসামান্যের সৃষ্টি হয়।
যে পারে নি সে কিন্তু চেষ্টায় আছে। যে পেরে গেছে সে দৌড়চ্ছে। তবে যে তোমার মত পারে নি চেষ্টায় আছে তার সেই চেষ্টাকে সাথে নিলে তবেই সাহিত্যধারা সফল হবে।
অনেক শিক্ষিত পণ্ডিত বিদ্বান জ্ঞানী অভিজ্ঞ পড়া ছেড়ে দিয়েছেন। প্রত্যেকে শুধু নিজেদের বিষয় ভিত্তিক ও প্রতিদিনের সংবাদপত্র ছাড়া কিছু পড়েন না। যারা লেখার সাথে সাহিত্য চর্চার সাথে যুক্ত তারা এবং শিক্ষার্থীরা নিজেদের বিষয়ের বাইরে কিছু পড়া পড়ে। যারা পড়েন ও লেখেন তারা আসলে ভাবেন আর ভাবায়। এই ভাবা ও ভাবনা হল সাহিত্য। এই ভাবনা ও ভাবার মধ্যে আপনি কতজনকে টেনে আনতে পারলেন তাতেই সাহিত্য অমোঘ হয়ে থাকবে।
এই সাহিত্যধারার ভাবা ও ভাবনা কখনই জীবনের বাইরে নয়। জীবনের জন্য। কিন্তু সাহিত্যধারার বাইরে যে ভাবা ও ভাবনা আছে তাতে জীবন থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে।
বইমেলা ইত্যাদিতে অনেকেই বই কেনে অনুরোধে, দেখানোর জন্য। না হলে যত বই বেরোক কেউ খুব একটা কেনে না। আপনার বই সাহিত্য চর্চার মধ্যে নেই অথচ পড়ার টানে কিনছে এ রকম যতজন কিনবে ততটাই আপনি 'সাহিত্যিক'।
কিন্তু গল্প ভাবনা এবং গল্প ভাবিত কোন লেখা সে গল্প, অণুগল্প, কবিতা যাই হোক তা পাঠ করলে কিন্তু সবাই শুনবে। সেই পাঠ সমৃদ্ধ সেই সব বই সবাই কিনছেও। এই স্বচ্ছ গল্পিক ভাবনা আজও সমানভাবে আদৃত।
কবি সাহিত্যিকদের ভাবরাজ্য হল বিরাট সাম্রাজ্যের ছোট ছোট অসীম চিত্রকথা। সেই রাজ্যে অন্যকে ঢুকিয়ে নিয়ে ভাব সমৃদ্ধ করে সসীম গড়ে তোলা খুব একটা সহজ না। ভাবরাজ্য এমন একটা রাজ্য যেখানে অন্যকে জোর করে ঢুকিয়ে নেওয়া যায় না, ভাবানো যায় না, দেখানো যায় না, ভোলানো যায় না। নিজস্ব তাগিদে স্ব-ইচ্ছেতে যদি সে ঢুকে যায় তাহলে তাকে আর জোর করতে হয় না।
ভাবরাজ্যে অন্যের স্বইচ্ছেতে আপনার যতটা মুন্সিয়ানা ততটাই আপনি স্বরচিত। সাহিত্যিক। কবিতার দিক থেকে অনেকের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার অন্যতম কারণ এই ভাবরাজ্য। ভাবনা বড্ড একমুখী কবির দিক থেকে। পাঠকের দিক থেকে কবিতার শুধু নাড়াচাড়া।
সবচেয়ে বেশি পঠিত কবিতার দিকে তাকালে দেখা যাবে সেগুলো বেশিরভাগই কল্পরাজ্যের গল্প চর্চা। 'বাঁশি', 'সাধারণ মেয়ে' 'সৎ পাত্র', 'ভয় পেয়ো না', 'বনলতা সেন' 'কেউ কথা রাখে নি', 'মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়', 'প্রার্থনা' 'বঙ্গভাষা' 'হঠাৎ নীরার জন্য' ইত্যাদি আরো অনেক অজস্র বাংলা ভাষায় লিখিত কবিতা যা ভাবরাজ্যে গল্পের হাত ধরে এগিয়েছে।
বহু পঠিত কবিতা মনে হয় সুকুমার রায়ের। যাঁর বেশির ভাগ কবিতা ভাবরাজ্যে কল্প গল্পের দুর্দান্ত মিশেলে রচিত। কবিতা পড়ার সাথে সাথে এমন একটা কল্পরাজ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে যা যে কোন ধরনের মানুষের (শিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত বা নিরক্ষর যাই হোক, বড়, ছোট, বয়স্ক গম্ভীর মিশুকে) মনে গল্পিক ভাবনার দ্যুতি ছড়িয়ে দেয়।
এই যে বলে না কবিতা উচ্চ শ্রেণির পাঠকের জন্য। আসলে তিনি সহজকে সহজ করে ভাবতে পারেন না, ভাবাতে পারেন না। উল্টে নিজের না পারার দোষ ত্রুটি অক্ষমতা অন্যের উপরে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য এমন কথা বলেন। আলোচনা সভায় কবিকে এ রকম প্রশ্ন করলেই তিনি রেগে উঠেন। বলেন - কবিতাটি আপনি বুঝতেই পারেন নি। আবার পড়ুন। যে পড়া একবারে বোধগম্য হল না সেটা এই সময় কমের বাজারে দ্রুত জীবন চলাচলের অবসরে আবার পড়ব, তাই কখনও হয়?
তাছাড়া বনলতা সেন, প্রার্থনা, বাঁশি, জনগণমন অধিনায়ক, মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়, বাবরের প্রার্থনা, যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো, ভারততীর্থ, বিদ্রোহী, পাল্কীর গান, তেলের শিশি ইত্যাদি হাজার হাজার লাখো লাখো কবিতায় তো মগজমারির প্রয়োজন পড়ে না? যে কেউ শিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত এমন কি একেবারে সাধারণ যখন তখন বলে ফেলে। একেবারে প্রাণ থেকে উচ্চারণ করে। তাহলে কবিতা বুঝতে বোদ্ধা হতে হবে কেন? তুমি বোদ্ধা হয়েও মাটির কাছাকাছি হতে পারো নি সেটাকে ঢাকা দেওয়ার নিরর্থক প্রয়াস কেন করে যাচ্ছো?
শব্দের মায়াজাল কেউ পছন্দ করে না। ভাবনার মায়াজালে সবাই ঢুকতে চায় তাও খুব প্রাঞ্জল মাটির গন্ধ মেখে। আপনার প্রাণের আবেগ মথিত, আপনার আত্মক্ষরণ আপনি প্রকাশ করলেন তাতে আমার কি? আমাদের মত সাধারণের আবেগ আত্মক্ষরণ আপনি কি বুঝতে পেরেছেন? সেটাকে কি কবিতায় প্রকাশ করেতে পেরেছেন? আপনার নিভৃত চর্চা আমাকে জেনে মন্থন হয়েছে কি?
এক্ষেত্রে যারা লেখেন নিয়মিত চর্চা করেন তারা অনেকেই বলেন লেখার পরে লেখাটি আর লেখকের নয় পাঠকের। যা বোঝার পাঠকেই বুঝতে হবে। একদম সত্যি। সঠিক কথা। তাহলে বাপু, লেখার পরে তুমিও তো নিশ্চয়ই পাঠক। তাই পাঠক হিসেবে বুঝিয়ে দাও তো দেখি।
এখন এই কবিতা আমাকে বোঝাতে হলে আপনাকে অবশ্যই গল্পকথার কল্পমালার আশ্রয় নিতেই হবে। সেই গল্পকথার কল্পমালার আশ্রয়ে লিখেছেন সুকুমার রায়, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, সুনীল, শক্তি, জয় এবং আরো অনেক অনেক কবি। পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতায় এত প্রাঞ্জল এই কাব্যের গল্প যা বলার নয়।
তাই কোন লেখায় গল্প ভাবনা উপেক্ষা করলে লেখা বা সৃষ্টি নিজস্ব দিশা হারাবে। সাহিত্যের সঠিক অনুগামী হতে পারবে না।
এক্ষেত্রে অণুগল্প খুব দ্রুত তার নিজস্ব জায়গা করে নিচ্ছে। কেন না গল্প ভাবনায় অণুগল্প এক অনন্যরূপ। যা অনেক বেশি করে গল্পের সূত্র ধরে পাঠকে ভাবাচ্ছে। পাঠ গ্রহণে গল্প আছে আবার দিশাও আছে। সাহিত্যের মর্যাদাও আছে। গল্প চর্চার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বলেই অণুগল্প সাহিত্যপাঠে পাঠকবর্গকে টানতে সক্ষম হচ্ছে। সাহিত্যে গল্প চর্চা যে কতটা বাস্তবসম্মত, প্রয়োজনীয় তা অণুগল্পের দ্রুত অগ্রগামীতা প্রমাণ করে।
গল্প ভাবনার যে সাহিত্যধারা অণুগল্প তার প্রধান উপাদান হল উপস্থাপনা। একই কাহিনী বা ভাবনা উপস্থাপনার গুনে অন্য থেকে অন্যতম হয়ে যায়। সবাই তো প্রেমের কথা লেখে। গল্পে কবিতায় গানে নাটকে। কিন্তু আজও অন্যন্য 'বনলতা সেন'। 'গুপ্তধন'এর মত গল্প আর লেখা হল না। 'কফি হাউসের আড্ডা'টার মত আর গান এল না। 'চাঁদের পাহাড়'এর মত আর উপন্যাস এল না। ইত্যাদি ইত্যাদি। অন্যান্য ভাষার ক্ষেত্রেও এ রকম অনেক উদাহরণ আছে।
শুধুমাত্র এই উপস্থাপনার গুনে বর্তমানে অণুগল্প চর্চা তার জায়গা করে নিচ্ছে। বৃহৎ কিছুকে অল্পে ধরে রাখা কবি সাহিত্যিকের কাজ। এই অল্পে ধরে রাখার জন্য উপস্থাপনা এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান। যাঁরা অণুগল্প চর্চা করছেন তাঁরা গল্পকে নিজস্ব উপস্থাপনার গুনে অসামান্য অবস্থানে পৌঁছে দিচ্ছেন। অল্প পড়ে পাঠকের মনে বৃহতের আশা জাগিয়ে তুলছে এই অণুগল্প চর্চা। গল্প চর্চা অথচ উপস্থাপনার গুনে সেটাই চূড়ান্ত এক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। পড়ে আপনাকে ভাবতেই হবে। গল্প মাধ্যমে, গল্পের মাধ্যমে এবং গল্পের অবস্থানে।
অণুগল্পের প্রধান বিষয় আমার মনে হয় উপস্থাপনা। যে বিষয়কে গল্পের আকারে বলতে চাওয়ার চেষ্টা তাকে সঠিক উপস্থাপন করতে পারলে তা সংক্ষিপ্ত হবে অণুগল্পও হবে।
অণুগল্পের ক্ষেত্রে বিষয়কে সঠিক উপস্থাপনা করার গুণ থাকা অত্যন্ত জরুরি।
কাহিনীর কোথা থেকে শুরু করব, কোথায় ঘটনার কেন্দ্র বিন্দু, কোন বিষয় অন্য সূত্রেও বলা যায়, কোথায় শুরু করলে পাঠক শেষ করতে বাধ্য হবে, আবার শেষ করেও পাঠক শুরুর পথে আবার শুরু করবে, ভাববে ইত্যাদি উপস্থাপনার মাধ্যমে ঠিকমতো বিন্যস্ত হলে বিষয়টি খুব সহজে সংক্ষিপ্ত হবে এবং অণুগল্পের দিকে এগিয়ে যাবে।
তাই আমার মনে হয় উপস্থাপনা অণুগল্পের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক। যার ফলে বিষয়ের একমুখীতা হাজার দিকে ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য। সবাই জানে উপস্থাপনাই সাহিত্যিকের অন্যতম গুণ। অণুগল্প লেখার জন্য এই উপস্থাপনার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন।
গল্পকে বাদ দিয়ে যে ভাবনার বিস্তার তা তো শুধুমাত্র শব্দের মায়াজাল। যা আগে ছিল না। বর্তমানে এই শব্দের মায়াজাল কবিতা লেখায় খুব বিস্তার লাভ করছে। কাব্য করে যে মহাকাব্য বচন গাঁথা পাঁচালী লেখা হয়েছে সবই গল্পের আশ্রয়ে গড়ে উঠেছে।
আর আছে গান। রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র এই গানের জন্য লক্ষ কোটি বছর পরেও বিন্দাস চির নবীন হয়ে থাকবেন। এর অন্যতম কারণ গানের ভেতরে গল্পচর্চা। গল্পের আঙ্গিকে সবার হৃদয়ে সুর হয়ে জেগে থাকা। ছোট ছোট গানের কলিতে তোমার আমার জীবনের প্রতি মুহূর্তের কথা বলা গল্প আছে। জীবনের সমস্ত অনুভূতি আত্মোপলব্ধি করে এত সহজভাবে উপস্থাপিত হয়েছে যা বলার নয়। তাই রবীন্দ্র সংগীত শুধুমাত্র গান নয় জীবনের যে কোন সময়ে গুনগুনিয়ে ওঠা। প্রাণের ভেতর থেকে উৎসারিত হয়ে ওঠা। কাজের মাঝে ক্লান্তির মাঝে অবসাদের মাঝে উচ্ছ্বাসের মাঝে নিজেকে নিজে জাগিয়ে তোলা এই গান। কেন না গানে প্রেরণা আছে। গল্পিক অনুভূতি আছে। যা আপনার আমার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। অনুভূতির আকাশ পাতাল শুধুমাত্র মাটি ছুঁয়ে বড় হয়েছে।
তাই অক্ষর শব্দ বাক্য বাক্যরচনা এবং তারপর কবিতা ছড়া গল্প নাটক উপন্যাস সবই গল্প জীবনের প্রকাশ। অক্ষরে অক্ষরে।
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ৮৭৪ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৮/১১/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • সোলাইমান ০৮/১১/২০১৭
    খুব সুন্দর।।।।।।
    শুভেচ্ছা রইল।
 
Quantcast