www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

হাসির ফেরিওয়ালা

“হাসি” ওর নাম। কি অদ্ভূত নাম, ”হাসি”! “হাসি” আবার কারো নাম হয় নাকি? নামটা শুনেই সবার হাসি পায়। এ নামের পেছনে একটা বিশেষত্ব আছে। এমনি এমনিই ওর নামটা "হাসি" রাখা হয়নি। ওকে সবাই চেনে ওর এই হাসিটার কারণে। খুব সুন্দর করে হাসে ও। চেনা অচেনা সবার কথা, তোমার "হাসি"টা খুব সুন্দর। শুনে সে আরো হাসে। না প্রশংসা শুনে খুশীতে নয়, অন্য একটা কারণ আছে। নাহ, এক্ষুনি বলবো না... পরের জন্য থাক।

“হাসি” শুধু সুন্দর করে হাসেই না, তার অট্টহাসিতে মুখরিত করে রাখে চারপাশ। অনেকে একটু অবাকও হয়। এত জোরে কেউ হাসতে পারে? তাতে আবার মেয়ে মানুষ! ওতে হাসির কিচ্ছুটি যায় আসে না। কোন একটা ইস্যু পেলেই হলো, অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে "হাসি"। "হাসি"র হাসি দেখে ওর চারপাশে থাকা সবাই হেসে মরে। হাসতে হাসতে "হাসি"র দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়, চোখে জল এসে যায় কিন্তু সে তার হাসিতে দাড়ি টানতে পারে না।

“হাসি” বাবা মায়ের খুব আদরের সন্তান হলেও আদরে শাসনে সে বেড়ে ওঠা একটা মানুষ। তবে শাসনের মাত্রাটা একটু বেশীই ছিল ওর দুরন্তপনা আর স্বাধীনচেতা মনোভাবের কারণে। "হাসি" মাঝে মাঝে পরী হওয়ার স্বপ্ন দেখতো, রংগীন ডানায় ভর করে যেতে চাইতো অচিন কোন দেশে। পাখি হয়ে ছুঁতে চাইতো মেঘ কন্যাকে। কখনো কখনো দূরন্ত ঘোড়ার মতো ক্ষিপ্র গতিতে জীবনের রেসকোর্স ময়দানে ছোটার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকতো। আবার বিদ্রোহী কোন লেখিকার কোন লেখা পড়ে নিজের জীবনেই বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে চারপাশের অসামঞ্জস্যগুলোকে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে মরিয়া হয়ে উঠতো।

“হাসি”র কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার সে মেলে দেয়া ডানা দুটোকে হঠাৎ করে ছেটে ফেলা হলো আর ক্ষিপ্র গতিতে ছোটা পা দুটোতে বেড়ী পরিয়ে দেয়া হলো। বিয়ে নামের বন্দিত্বের বেড়ীকে সে পায়ের পায়েল ভেবে ভুল করে বসে। আর তাই ক্ষিপ্র গতিতে ছোটার পরিবর্তে "হাসি" ঝুমুর ঝুমুর শব্দে জীবনে নাচের ছন্দ তোলার স্বপ্ন এঁকে ফেলে। কিন্তু যখনই সে নাচের ছন্দ তোলার জন্য পা তোলে তখনই সে বুঝতে পারে নাচের ছন্দ তোলা নয়, জীবনের গতি স্তব্ধ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে তার জন্য। সার্কাসের হাতির মতো পায়ে টান পড়তেই তীব্র ব্যাথায় সে ককিয়ে ওঠে। হৃদয়ে তার রক্তক্ষরণ, নিজের বন্দীত্বে নিজেই হাহাকার করে ওঠে। ভুলে যায় সে খোলা আকাশকে, দিগন্ত বিস্তৃত মাঠকে, বাহারি রং এর ফুলকে।

ধীরে ধীরে জীবনীশক্তি হারিয়ে নির্জীব "হাসি" যখন জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়ার পথে, ঠিক তখনই তার মনে হয় দূর থেকে কেউ যেন তাকে ডাকছে। যখন সে ডাক তার কান অবধি পৌছায় তখন সে শুনতে পায়- "হাসি" তোমার হাসিটা খুব সুন্দর, একে হারিয়ে যেতে দেবো না আমি। আমার হাত ধরে উঠে এসো, বলেই সে এক ঝটকায় হাসিকে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে দেয়। "হাসি" উঠে দাঁড়ায়, ভেতরে ভেতরে হারিয়া যাওয়া হাসিটার জন্য লোভী হয়ে ওঠে। শক্ত করে সে হাতটাকে আঁকড়ে ধরে "হাসি" ভালাবাসার সাগরের তীব্র স্রোতে ভেসে চলে যায়।

বিধি বাম, কিছুদিন না যেতেই সে বোঝে ভালবাসার ফুল বাগানে ফুলের চেয়ে কাঁটাই যেন বেশী। কিন্তু "হাসি" ফুলকে এত বেশী ভালবেসে ফেলেছিল যে, সে সব ধরণের কষ্ট যন্ত্রণা সয়ে একটা একটা করে কাঁটা তুলে ভালবাসার ফুল বাগানকে কাঁটামুক্ত করতে থাকে। এভাবে "হাসি" যখন তার ফুল বাগান সাজানো প্রায় শেষ করে নিয়ে আসে তখন আচমকা ইয়া বড় এক দৈত্য এসে "হাসি"র ফুল বাগানটাকে তছনছ করে দিল। বিধ্বস্ত বাগানে জ্ঞান হারিয়ে হাসি পড়ে রইল অধপতিত অবস্থায়। জ্ঞান ফিরে আসার পর সে ধীরে ধীরে চোখ মেলার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে পুরো চোখ মেলে, চারদিকটা দেখে নেয়ার চেষ্টা করে সে এবং দেখতে পায় তার ভালবাসার বাগানের অবশিষ্ট আর কিছুই নাই। যন্ত্রণায়, ব্যাথায় সে কুকড়ে ওঠে। "হাসি" এবার পাশ ফিরে চিৎ হতে চায় কিন্তু পারে না। তার আসলে নড়ার মতো সামান্যতম শক্তিটুকুও ছিল না। তবু সে প্রাণপণে চেষ্টা চালাতে থাকে এবং এক পর্যায়ে চিৎ হয়ে দৃষ্টিটাকে শুন্য মেলে ধরে। আহ, ঐ যে দিগন্তবিস্তৃত নীল আকাশ! খোলা নীল আকাশে সে মনে হয় এক ঝাক ফিনিক্স পাখিদের উড়ে বেড়াতে দেখতে পায়। "হাসি"র মনের আকাশেও কিছু কথা ডানা মেলতে থাকে। যন্ত্রণা ভুলে সে ডানা মেলা কথাগুলোকে ধরে মনে মনে আওড়াতে থাকে- "শুন্য থেকে আবার শুরু করবো", "আমি ফিনিক্স পাখির মতো ছাই থেকে আবার সৃষ্টি হবো"। "হাসি" যেন তার ভেতরে একটা শক্তিকে অনুভব করে, সে শক্তিতে ভর করে সে উঠে দাঁড়ায় এবং টালমাটাল পায়ে ধীরে ধীরে চলতে শুরু করে।

এভাবে চলতে চলতে বেশ কিছুটা পথ অগ্রসর হওয়ার পর হঠাৎ তার দৃষ্টি আটকে যায় দূরে থাকা কিছু একটার প্রতি। “হাসি” স্পষ্ট করে দেখতে পায় না, তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। ধীরে ধীরে ঝাপসা দৃষ্টিটা স্বচ্ছ হতে থাকে সাথে সাথে একটা ক্ষীণ আওয়াজও তার কানে আসে। এবার সে পরিষ্কার দেখতে ও শুনতে পায়। তার সামনে এক "ফেরিওয়ালা" দাঁড়িয়ে। "ফেরিওয়ালা"র ঝাপি ভরা হরেক রকম "আনন্দ" আর "জীবনীশক্তি"। বিষন্ন আর স্বপ্নহারা হাসির সামনে দাঁড়ায় "ফেরিওয়ালা"। কি যে মায়া ভরা মুখ "ফেরিওয়ালা"র! হাসি অপলক নয়নে শুধু তাকিয়ে থাকে। এর বেশী সে কিছুই দেখতে পায় না। কথা বলার শক্তিটুকুও যেন "হাসি" হারিয়ে ফেলে। "ফেরীওয়ালা"র কথায় সে স্বম্বিৎ ফিরে পায়। "ও মেয়ে কি হয়েছে তোমার"? ফেরিওয়ালা"র কণ্ঠে মমতার জাদু খেলে যায়, কথার মধ্য দিয়ে যেন মধু ঝরে পড়ে। কথায় শুধু মধু নয়, কোথায় যেন শক্তির বিশাল এক ভান্ডার লুকিয়ে আছে। মধু, জাদু আর শক্তি মেশানো কথায় বিমোহিত "হাসি" মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার স্বপ্ন, রং আর হাসি হারানোর গল্প বলে যায় "ফেরিওয়ালা"র কাছে।

"ফেরিওয়ালা" তার হাত ধরে না, মাথায় মমতার স্পর্শও করে না। শুধু কথার শক্তি দিয়ে তাকে শেখাতে থাকে আবার নতুন করে জীবনের পাখায় রং লাগাতে, হাসির ফোয়ারা বানাতে।

“হাসি” আবার নতুন করে নতুন আংগিকে জীবনকে রং দিয়ে, আনন্দের আল্পনা দিয়ে সাজাতে শুরু করে। ফেরিওয়ালা প্রতিদিন একবার এসে “হাসি”কে দেখে যায়। প্রশান্ত চিত্তে সে হাসির রং আর আনন্দের আল্পনা আঁকা দেখে। বিদায়বেলায় “হাসি”র হাতে দিয়ে যায় বিনি পয়সায় এক মুঠো জীবনীশক্তি। সে জীবনীশক্তি হাতে পেয়ে “হাসি” আবার জীবনের রেসকোর্স ময়দানে ক্ষিপ্রগতিতে ছোটার তাগিদ অনুভব করে। মনের অজান্তেই সে গেয়ে ওঠে “আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে......”

“হাসি” নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্জীবনী সুধা পান করে নতুন জীবন প্রাপ্তির আনন্দে “আনন্দ সাগরে” অবগাহনে মত্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু ফেরিওয়ালার কথা সে ভোলে না, ভোলে না তার পথ চাইতে। ফেরিওয়ালা আসে, হাসির নতুন জীবন দেখে তার মুখে খেলে যায় পরিতৃপ্তির এক স্বর্গীয় হাসি। সে হাসিতে “হাসি” যেন আরো উজ্জীবিত হয়ে ওঠে।

দিন যায়, রাত যায়, “হাসি”র জীবন ভালই কাটছে। ফেরিওয়ালার জাদুভরা কন্ঠের ডাক শোনার আগ্রহ নিয়ে সে ছুটে চলে জীবনের বিস্তৃত মাঠে। ঐ ডাকের মধ্যেই যে হাসির জীবনী শক্তি লুকিয়ে আছে! জীবনীশক্তি নামের সে সঞ্জিবনী সুধা পান না করলে যে “হাসি”র গতি থেমে যেতে চায়।

ইদানীং ফেরিওয়ালার ডাক কেন যেন তেমন একটা শুনতে পায় না “হাসি”, মনে মনে ভাবে কত ব্যস্ত ফেরিওয়ালা...... কত মানুষের কাছে তাকে যেতে হয়। সময় করে নিশ্চয়ই তাকে দেখতে আসবে তার প্রিয় জীবনীশক্তিদাতা ফেরিওয়ালা। “হাসি”কে নিরাশ করে না, ফেরিওয়ালা আসে, “হাসি”কে ডাকে, জানতে চায় কেমন আছে সে? ওটুকুইতে “হাসি” যেন প্রাণ ফিরে পায়। ছোট্ট খুকীটির মতো মাথা দুলিয়ে জানায়, সে অনেক ভাল আছে। চলে যায় ফেরিওয়ালা। চোখে মুখে ভাল লাগার আবীর মেখে “হাসি” আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার জগৎ নিয়ে।

নাহ, অনেকদিন হলো ফেরিওয়ালা আসছে না...... হলোটা কি ফেরিওয়ালার... ভাল আছেতো? পথ চাইতে চাইতে “হাসি” ক্লান্ত হয়ে পড়ে, টুপ করে দু ফোটা জল গড়িয়ে যায় দু গাল বেয়ে। মনে মনে ডাকে “ফেরিওয়ালা ও ফেরিওয়ালা...... কোথায় গেলে...... আমি যে তোমায় দেখতে চাই...... তোমার ডাক শুনতে চাই......।

ফেরিওয়ালা আর আসেও না, তার নাম ধরে ডাকেও না। “হাসি” কিন্তু থেমে যায়নি... ভেতরে একটা “দুঃখপাখি” ডানা ঝাপটালেও বাইরে তা প্রকাশ পায় না, সে নিজের গতিকে থামতে দেয় না, জীবনকে জয়ের পথে এগুতে থাকে। কারণ ফেরিওয়ালা তাকে একদিন বলেছিল- “ও মেয়ে শোন দেখি, তোমার জীবন ঘরের দরজার চাবিটা অন্য কারো হাতে রেখো না, নিজের হাতেই রাখবে এটা, যাতে অন্য কেউ তোমার ঘরে তালা ঝোলাতে না পারে”। কথাটা “হাসি”র খুব মনে ধরেছিল, তাই সে প্রাণপণে সে চাবিটা নিজের কাছে ধরে রাখার চেষ্টা করে। আসলে ফেরিওয়ালার কথায় কি জাদু আছে কে জানে? সে যাই বলে তাই যেন “হাসি”র কাছে অমোঘ বাণী হয়ে যায়।

“হাসি” ফেরিওয়ালাকে ভুলতে পারে না... সারাদিন শত কাজ, শত বস্ততার মধ্যেও ফেরিওয়ালেকে তার মনে পড়ে। কোথায় গেল ফেরিওয়ালা? তার কথা কি একবারও মনে পড়ে না? জীবনকে জয়ের প্রয়োজনীয় জীবনীশক্তি দিয়ে কোথায় হারিয়ে গেল ফেরিওয়ালা?

“হাসি” খুঁজে ফেরে ফেরিওয়ালাকে। মনের ইথারে ডেকে যায় অবিরাম... বলতে থাকে তার মনের যত কথা... “ও ফেরিওয়ালা কোথায় গেলে? আমি যে জীবনের জয়গান গাইতে শিখে গেছি, শুনবে না তুমি? আমার হাসি আর আনন্দের আল্পনা তুমি দেখবে না? তুমি আমার গান না শুনলে আমার আল্পনা না দেখলে আমার যে আর গাইতে ইচ্ছে করে না, আল্পনা আঁকতেও আর যে ভাল লাগে না... ফেরিওয়ালা আমি যে জীবনের গান আর থামাতে চাইনে, আল্পনা দিয়ে জীবনকে সাজিয়ে যেতে চাই... একবার ঘুরে যাও, দেখে যাও আমায়......” এ রকম আরো কত কথা...

ফেরিওয়ালার কাছে সে কথা, সে ডাক পৌঁছায় কিনা সে জানে না, কিন্তু তার কথা বলা, গল্প করা থামে না। ফেরিওয়ালাকে সে ডেকেই যায়... তার গল্প শুনিয়েই যায়... কে জানে হয়তো একদিন ফেরিওয়ালার কাছে তার ডাক আর গল্প পৌঁছে যাবে... হয়তো সে “হাসি”কে আবার দেখতে আসবে, যাবার বেলায় মুঠো ভরে দিয়ে যাবে বিনি পয়সায় “জীবনী শক্তি”। এমনই বিশ্বাস নিয়ে “হাসি” এগুতে থাকে।

ইদানীং “হাসি”র হাসি যেন বাঁধ মানছে না। সবার মধ্যে চাপা গুঞ্জন হলোটা কি ওর? এত হাসির কারণ কি? সেদিকে হাসির কোন ভ্রুক্ষেপই নাই। সে হাসির বাঁধ ভেংগে জোয়ারের ঢেউ তুলে চলেছে। তার হাসি নিয়ে সবার কথার জবাবে সে শুধু হেসেই যায়। আসলে “হাসি” হাসির আড়ালে তার কান্নাটাকেই ঢেকে রাখতে চায়। ফেরিওয়ালার জন্য তার চাপা কান্নাটা যেন কখনো বেরিয়ে না আসে সেজন্য “হাসি” মরিয়া হয়ে হাসতে থাকে...।

ওদিকে ফেরিওয়ালা তার ঝোলা ভরা “জীবনী শক্তি” আর “আনন্দ” নিয়ে ফেরি করছে আপনমনে আর দেয়ার আনন্দে তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠেছে পরিতৃপ্তির হাসি।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১৩৭২ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৩/০১/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • এম এস সজীব ১৩/০২/২০১৭
    অনেক অনেক অনেক সুন্দর। যোগাযোগ করবেন।
  • মুহাম্মদ রুমান ৩১/০১/২০১৭
    সুন্দর
  • ভালো লাগার মতো লেখা।
    শুভেচ্ছা জানবেন, প্রিয় লেখিকা।
  • পরশ ২৪/০১/২০১৭
    ভাল হয়েছে
  • সোলাইমান ২৪/০১/২০১৭
    অসাধারণ গল্পটি।
  • মোনালিসা ২৩/০১/২০১৭
    সুন্দর
 
Quantcast